২৪/৭/২০১৩আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আজ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ১৫ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ আমিনুল ইসলাম ডাব্লু, আমার বয়স- ৪৫/৪৬ বৎসর, আমার ঠিকানা- সাং বৃশিলাখা, থানা- বেড়া, জেলা- পাবনা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আনুমানিক ৩ বৎসর। আমরা মোট ৯ ভাই-বোন, তার মধ্যে ৪ ভাই, ৫ বোন। ভাইদের মধ্যে সবার বড় বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সেলিম লতিফ। আমি বড় হয়ে জানতে পারি যে, আমার আব্বা শহীদ সোহরাব উদ্দিন প্রামাণিক এবং বড় ভাই মোঃ আব্দুস সেলিম লতিফ মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে আমার আব্বা পাটের ব্যবসা করতেন এবং বড় ভাই আব্দুস সেলিম লতিফ বেড়া কলেজের এইচ,এস,সি প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আমার বড় ভাই আব্দুস সেলিম লতিফ ১৯৭১ সালের ১৫ ই আগষ্ট বেড়া থানায় রেকি করতে যাওয়ার সময় বেড়া লঞ্চ ঘাটের নিকট রাজাকার, আলবদরদের হাতে ধরা পড়ে। আমার বড় ভাইয়ের সংগে ছিল চাচাতো ভাই আলাউদ্দিন। উল্লেখিত দুইজনকেই সেখান থেকে নগরবাড়ী ঘাটে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বড় ভাই আব্দুস সেলিম লতিফের নিকট থেকে জানতে পারি নগরবাড়ী ঘাটে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আমার উক্ত ভাই সেখানে জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে আলাপরত অবস্থায় দেখাতে পান। এরপর আমার ভাইকে পাকিস্তানী মিলিটারী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে এবং এক পর্যায়ে তার পিঠে জলন্ত সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা দেয় যার ফলে তার পিঠে ক্ষত চিহ্ন হয় যা ভাইয়ের পিঠে এখনও আছে। এরপর আমার বড় ভাই ও চাচাতো ভাইকে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে নগরবাড়ী ঘাটে ফেরীর মধ্যে আটক রাখা হয়। তারপর আমার চাচাতো ভাই আলাউদ্দিনকে আমার ভাইয়ের নিকট থেকে অন্যত্র নিয়ে যায়। এর ১৫/২০ মিনিট পর আমার বড় ভাইকেও হাত পা বেঁধে নগরবাড়ী ঘাটে নদীতে ফেলে দেয়। ভাগ্যক্রমে আমার বড় ভাই আব্দুস সেলিম লতিফ বেঁচে যান এবং একদিন পরে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। আমার চাচাতো ভাই ২/৩ দিন পর বাড়িতে ফিরে আসে।
আমার বড় ভাই এবং চাচাতো ভাই ফিরে আসার ১০/১৫ দিন পর আমার আব্বা সহ আমার উক্ত বড় ভাই ও চাচাতো ভাই এবং আরও কয়েকজন মাইনকার চর হয়ে ইন্ডিয়া চলে যায়। সেখান থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে কয়েকদিন পর আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। আমার বড় ভাই ফিরে আসলেও আমার আব্বা সাবেক তথ্য মন্ত্রী ও তৎকালীন এম,এন,এ অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের সাথে ভারতে থেকে যান। ১৯৭১ সালের ২রা ডিসেম্বর আমার আব্বা ভারত থেকে আমাদের বাড়িতে ফিরে আসেন। আমার আব্বার ফিরে আসার খবর স্থানীয় আলবদর, রাজাকাররা জেনে যায় এবং মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নিকট খবর জানায়। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ ভোর বেলা আলবদর, রাজাকার এবং পাকিস্তানী আর্মিরা আমাদের বৃশালিখা গ্রাম ফিরে ফেলে আমার আব্বাকে আমাদের বাড়ী থেকে ধরে রাস্তায় নিয়ে চরম নির্যাতন করে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া আমাদের গ্রামের মনু, ষষ্ঠি, ভাদু, জ্ঞানেন্দ্র নাথ হালদার সহ অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে এবং গ্রামের ৭০/৭৫ টি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। উল্লেখিত ঘটনা আমি আমার আম্মা, ভাই-বোন ও প্রতিবেশীদের নিকট থেকে জানতে পেরেছি। মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে আমি চিনি, তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন (সনাক্তকৃত)। আমি অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। (জবানবন্দী সমাপ্ত)
জেরা ঃ
আমি বর্তমানে বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেব এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনাব শামছুল হক টুকু সাহেবের বাড়ি আমাদের গ্রামে। উল্লেখিত দুইজনই স্বাধীনতা যুদ্ধাকালীন সময়ে ভারতে গিয়েছিলেন, তবে কোন্ সময় গিয়েছিলেন তাহা আমার জানা নাই। অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের বাড়ি আমার বাড়ি থেকে আনুমানিক ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার হবে। পাকিস্তানী আর্মিরা অধ্যাপক আবু সাঈদ সাহেবের বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছিল মর্মে আমি জানতে পেরেছি।
আমার আব্বা মুক্তিযুদ্ধের জন্য বেড়া থানা থেকে এবং স্থানীয় জনসাধারনের লাইসেন্স করা অস্ত্র সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন শুনেছি। যে সকল রাজাকার ও আলবদররা আমার বড় ভাই এবং আলাউদ্দিনকে আটক করেছিল তাদের নাম আমার ভাই আমাকে বলেছিল। সেই রাজাকারদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছে এবং কেউ কেউ এখনও জীবিত আছে। যারা আমার বড় ভাই এবং আলাউদ্দিনকে আটক করেছিল তাদের মধ্যে অনেককে বিজয় অর্জনের পর আটক করা হয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না। বিজয় অর্জনের পর আমাদের এলাকায় কোন রাজাকারকে আটক করা হয়েছিল কিনা তাহাও আমি জানি না। সুরাইয়া সোহরাব, স্বামী ফজলুল বারী শাহীন সাং বেড়া ডাকবাংলা, আমার ছোট বোন। আমি কাস ওয়ানে ১৯৭৫/৭৬ সালে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি ১৯৮৬ সালে এস,এস,সি পাশ করেছি। স্কুলের কাস নাইনে রেজিষ্ট্রেশন আমি নিজে করি নাই। জাতীয় পরিচয় পত্র আমি নিয়েছি। আমার জাতীয় পরিচয়পত্র আমার দেওয়া তথ্য মতে আমার স্বাক্ষরে তৈরি হয়েছে। আমার জাতীয় পরিচয় পত্রে আমার জন্ম তারিখ লেখা আছে। আমি আমার ভাইয়ের নাম সম্বলিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার যে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে তাহা দেখেছি। ঐ তালিকায় আমার পিতার নাম শহীদ বা মৃত লেখা আছে কিনা তাহা আমি জানি না। আমার দাদার নাম নয়ন উদ্দিন। আমাদের গ্রামে আমার আব্বা ছাড়া সোহরাব আলী প্রামাণিক নামে অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা আমার জানা মতে নাই। আমার পিতা প্রামাণিক পদবী মাঝে মাঝে ব্যবহার করতেন মাঝে মাঝে ব্যবহার করতেন না। আমার ছোট বোন নাজমা আক্তার বেলী আমাদের বাড়ীতে একই সঙ্গে বসবাস করে। আমাদের এলাকায় মোট তিন দিনে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং যার যার সুবিধা মত সময়ে নিজ নিজ তথ্য প্রদান করেছে। আমার বোন নাজমা আক্তার বেলী এস,এস,সি পাশ করেছে। তিনি তার জন্ম তারিখ ১৫-১২-১৯৭৩ ইং দিয়েছিল কিনা তাহা আমার জানা নাই। আমার বোন আমার পরে এস,এস,সি পাশ করেছে। সুরাইয়া সোহরাব, নাজমা আক্তার বেলীর পরে এস,এস,সি পাশ করেছে। সুরাইয়া সোহরাব এর জন্ম তারিখ জাতীয় পরিচয়পত্রে ৩১-১২-১৯৭৬ লেখা আছে কিনা তাহা আমি জানি না। সুরাইয়া সোহরাবের বিবাহের সময় আমি বাড়িতে উপস্থিত ছিলাম। তার বিবাহের কাবিন নামায় জন্ম তারিখ কত লেখা হয়েছে, তাহা আমার জানা নাই।
“১৫ ই আগষ্ট বেড়া থানায় রেকি করতে যাওয়ার সময়” বা “আমার বড় ভাই আব্দুস সেলিম লতিফের নিকট থেকে জানতে পারি নগরবাড়ী ঘাটে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর আমার উক্ত ভাই সেখানে জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে আলাপরত অবস্থায় দেখাতে পান।” বা “এক পর্যায়ে তার পিঠে জলন্ত সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা দেয় যার ফলে তার পিঠে ক্ষত চিহ্ন হয় যা ভাইয়ের পিঠে এখনও আছে।” বা “তারপর আমার চাচাতো ভাই আলাউদ্দিনকে আমার ভাইয়ের নিকট থেকে অন্যত্র নিয়ে যায়।” বা “আমার চাচাতো ভাই ২/৩ দিন পর বাড়িতে ফিরে আসে।” বা “মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের নিকট খবর জানায়।” বা “রাস্তায় নিয়ে চরম নির্যাতন করে” এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার পিতা শহীদ হন নাই, ইহা সত্য নহে। আমার ভাইয়ের নিকট থেকে জানতে পাই জামায়াতের নেতা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে তিনি নগরবাড়ী ঘাটে পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে আলাপরত অবস্থায় দেখেছেন মর্মে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি তাহা অসত্য, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালে ২রা ডিসেম্বর স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা আমার পিতার বাড়িতে ফিরে আসার খবর মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে জানায় এই বক্তব্য অসত্য, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর আমাদের গ্রামের রাস্তার সামনে আমার পিতাকে নির্যাতন করে হত্যা করা এবং আমাদের গ্রামের ৭০/৭৫টি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার যে বক্তব্য আমি প্রদান করেছি তাহা অসত্য, ইহা সত্য নহে। আমার বয়স ৪৫/৪৬ বৎসর মর্মে আমি যে বক্তব্য দিয়েছি তাহা অসত্য, ইহা সত্য নহে। আমি এবং আমার ছোট বোন নাজমা আক্তার বেলীর জন্ম ১৯৭১ সালের পরে হয়েছে, ইহা সত্য নহে। আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার কারনে আমার দলের উর্দ্ধতন নেতাদের পরামর্শ ও নির্দেশে মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য অসত্য সাক্ষ্য দিলাম, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন