মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরীকে জেরার সময় আজ তীব্র হট্টগোল দেখা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-এ। সাক্ষী, আসামীপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ত্রিমুখী ত্রিমুখী বাগবিতন্ডা এবং উত্তেজনার এক পর্যায়ে কিছুই শোনা যাচ্ছিলনা। যে যার মত করে পরষ্পরকে আক্রমন করে যাচ্ছিলেন। সাক্ষী এবং উভয় পক্ষের আইনজীবীরা দাড়িয়ে, হাত উচিয়ে পরষ্পরকে মৌখিকভাবে আক্রমন চালান। বেশ কিছুক্ষন এভাবে চলার পর ট্রাইব্যুনাল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন।
মিছবাহুর রহমান চৌধুরী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে প্রথম সাক্ষী। গতকাল তাকে জেরার সময় একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সূত্রপাত। উত্তেজনার এক পর্যায়ে সাক্ষী মিছবাহুর রহমান আইনজীবী তাজুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সে আইনজীবীর বেশে শিবিরের ক্যাডার হিসেবে এখানে এসেছে এবং আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। তাজুল ইসলামও তাকে বেয়াদব বলেন। এসময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আলতাফ হোসেনও দাড়িয়ে তীব্রস্বরে প্রতিবাদ করতে থাকেন। তার সাথে যোগ দেন রাষ্ট্রপক্ষের অপর আইনজীবী সুলতান মাহমুদ সিমনও।
এর আগেও সাক্ষীকে জেরার সময় উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু গতকালের হট্টগোলের মাত্রা অতীতের সব উত্তেজনাকে ছাড়িয়ে গেছে।
উত্তেজনা শেষ হলে তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের কাছে বলেন, সাক্ষী আমাকে শিবিরের ক্যাডার বলেছেন। কোর্টে এসে আইনজীবীকে হুমকি দিয়েছে। আগে এর বিচার করতে হবে। তা না হলে আমরা মামলা পরিচালনা করতে পারবনা। সাক্ষী মিছবাহুর রহমান চৌধুরীও এসময় তাজুলের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, সে আমাকে বেয়াদব বলেছে।
যেভাবে সূত্রপাত : মিছবাহুর রহমান চৌধুরীকে জেরার সময় আইনজীবী মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন “আপনি আপনার গবেষনার সময় যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের একটি তালিকা করেছেন?”
সাক্ষী জবাব দেন “হ্যা করেছি”
এরপর মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, “সেই তালিকায় কতজন পাকিস্তান সেনা অফিসারের নাম আছে?”
জবাবে মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, এটি শুধু আলবদর বাহিনীর তালিকা।
আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, আমি জানতে চেয়েছি সেই তালিকায় কতজন পাকিস্তান সেনা অফিসারের নাম আছে সেটি। আলবদর বাহিনী সংক্রান্ত কোন প্রশ্নতো আমি করিনি। আগে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তারিকায় পাকিস্তান আর্মি অফিসারের নাম আছে কি নাই।
এসময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বলা হয় সাক্ষী যা উত্তর দিয়েছে তাই যাবে। মিজানুল ইসলাম তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলেন আমি আল বদর নিয়ে কোন প্রশ্ন করিনি। কাজেই কেন আল বদর বিষয়ে লেখা হবে এ প্রশ্নের জবাবে।
এসময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, মিজান সাহেব আপনি প্রথমে প্রশ্ন করেছেন তিনি যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতা বিরোধীদের তালিকা করেছেন কি-না। তিনি বলেছেন ‘হ্যা’ । এরপর আপনি প্রশ্ন করেছেন সেই তালিকায়
কয়জন পাকিস্তান সেনা অফিসারদের নাম আছে। তাহলে পরের প্রশ্নের জবাবে আল বদর বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে সমস্যা কোথায়।
মিজানুল ইসলাম বলেন, আমি প্রথম প্রশ্নটি করিনি। আমি একটি প্রশ্ন করতে চেয়েছি। এসময় ট্রাইব্যুনাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনি না বললে প্রশ্নটি লেখা হল কিভাবে। ট্রাইব্যুনাল এসময় বলেন, প্রয়োজনে ভিডিও দেখা হবে।
মিজানুল ইসলাম আবারো বলেন, আমি একটি প্রশ্ন করতে চেয়েছি। আলবদর বিষয়ে কোন প্রশ্ন আমি করিনি কাজেই সে উত্তর কেন লেখা হবে। মিজানুল ইসলাম প্রস্তাব করেন তার এ প্রশ্নটি প্রয়োজনে বাদ দেয়া হোক। মিজানু ইসলাম গতকাল এর আগেও আরেকটি প্রশ্ন নিয়ে সমস্যা হওয়ায় সেটি বাদ দিতে বলেন এবং ট্রাইব্যুনাল বাদ দেন।
এরপর ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তক্রমে সাক্ষী মিছাবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, তার সেই তালিকায় পাকিস্তান সেনা অফিসারে নাম নেই। সেটি রেকর্ড করেন কোর্ট।
এরপর মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন, “পাকিস্তান আর্মির পূবাঞ্চল বা পশ্চিমাঞ্চলের কোন অফিসার বা কমান্ডার আলবদর বাহিনী নিয়ন্ত্রন করত তার নাম আপনার গবেষনায় এসেছে?”
সাক্ষী জবাবে বলেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আল বদর বাহিনী নিয়ন্ত্রন করত জামায়াত।
সাথে সাথে মিজানুল ইসলাম আপত্তি জানিয়ে বলেন, আমি কি প্রশ্ন করলাম আর উনি কি উত্তর দিলেন। আমিতো এ প্রশ্ন করিনি। এসময় তাজুল ইসলাম বলেন, আইন অনুযায়ী সাক্ষী প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য।
সাক্ষী মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, মাই লর্ড আমি এখানে একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। ওনারাও একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। তারা একটি প্রশ্ন করেন। তার জবাব তাদের পছন্দ না হলে তারা সেটি বাদ দিতে বলেন। এসময় উত্তেজনা শুরু হয়ে যায়। মিছবাহুর রহমান চৌধুরী তাজুল ইসলামকে লক্ষ্য করে বলেন, মি. লর্ড, আপনি কোর্টের আইন না মানতে পারেন। আমিও পলিটিক্স করি। .... এরপর সাক্ষী এবং উভয় পক্ষের আইনজীবীর মধ্যে তীব্র হট্টগোলে কারো কথা কিছূ বোঝা যায়নি। সাক্ষী মিছবাহুর রহমান এবং তাজুল ইসলাম উভয়ে দাড়িয়ে পরষ্পরকে তীব্র ভাষায় আক্রমন করে যাচিছলেন। উভয় পক্ষের সব আইনজীবীরা দাড়িয়ে যান তখন। সাক্ষী মিছবাহুর রহমান অনবরত বলে যাচ্ছিলেন। তাজুল ইসলাম কোর্টের কাছে সাক্ষী থেকে আত্মরক্ষা কামনা করেন। কোর্ট সবাইকে থামার জন্য বারবার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে নিদের্শ তখন কারো কানে পৌছানোর মত পরিস্থিতি ছিলনা। বেশ কিছুক্ষন এভাবে চলার পর কোর্ট সাক্ষী মিছবাহুর রহমান এবং তাজুল ইসলামকে উচ্চস্বরে কঠোরভাবে নির্দেশ দেন থামার জন্য। পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
কোর্ট শেষে সামনের বেঞ্চে বসা আসামী পক্ষের আইনজীবীদের কাছে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় হট্টগোলের সময় মিছবাহুর রহমানকে কি বলেছিলেন। তারা জানান, সাক্ষী তাজুল ইসলামকে বলেছেন, সে শিবিরের ক্যাডার। আইনজীবীর বেশে কোর্টে এসেছে।
সাক্ষী মিছাহুর রহমান চৌধুরী পরে কোর্টের কাছে অভিযোগ করেছেন তাজুল ইসলাম তাকে বেয়াদব বলেছেন।
পরিস্থিতি শান্ত হলে কোর্ট মিজানুল ইসলামকে বলেন, জেরা শুরু করেন। মিজানুল ইসলাম বলেন, এখন সাড়ে চারটা বাজে। আমার মনের এখন যা অবস্থা তাতে আজ আর আমার পক্ষে জেরা করা সম্ভব নয়। দয়া করে আজ মুলতবি করেন।
কোর্ট বলেন, আজই জেরা শেষ করতে হবে । আজ ওনাকে আমরা বিদায় দেব। তাকে আর আনা হবেনা। (মিছবাহুর রহমান গত ২৬ আগস্ট জবানবন্দী দেন। তাকে এর আগে মোট পাঁচ দফা জেরা করা হয়েছে। সর্বশেষ জেরার দিন কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন পরবর্তীতে যেকোন দিন আর এক ঘন্টার মধ্যে জেরা শেষ করতে হবে। )
আজই জেরা শেষ করার পক্ষে দীর্ঘ সময় অনড় থাকেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আপনার এক ঘন্টা জেরা করার কথা ছিল। আজ দেড় ঘন্টার মত জেরা হয়েছে। আজ অনেক জেরা হয়েছে। আজ জেরা শেষ করতে হবে। তা না হলে তার জেরা আজ বন্ধ করে দেয়া হবে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এটা কেমন করে হতে পারে। জেরা শেষ করতে না দিয়ে বন্ধ করে দেবেন। এখনো অনেক প্রশ্ন বাকি আছে। কণ্ট্রাডিকশন নেয়া হয়নি এখনো। তাছাড়া আজ সাড়ে চারটা পার হয়ে গেছে।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, আজ জেরা শেষ করতে হবে। জেরা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোর্ট চলবে।
মিজানুল ইসলাম অপরাগতা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের সম্মানে আমি একটি প্রশ্ন করব। কিন্তু এরপর আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, সাক্ষী আমাকে শিবিরের ক্যাডার বলেছেন। আমাকে হুমকি দিয়েছেন। আগে এর বিচার করতে হবে। তা নাহলে আমাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
বিষয়টি পরে দেখা হবে আশ্বাস দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ট্রাইব্যুনাল মিজানুল ইসলামকে বলেন, আপনার আর কতক্ষন লাগবে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, ৪৫ মিনিট।
ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন আপনি কাল আসতে পারবেন?
সাক্ষী বলেন, আমি অসুস্থ। আমার পক্ষে আর আসা সম্ভব নয়।
এরপর ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীকে আদেশ দিয়ে বলেন, আপনাকে কাল আসতে হবে। এটা ট্রাইব্যুনালের আদেশ। সাক্ষী বলেন ঠিক আছে।
এসয় ৪টা ৫০ বেজে যায়। গতকালের মত মুলতবি হয় কোর্ট।
মিছবাহুর রহমানকে জেরা :
প্রশ্ন : বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডে সম্পর্কে যেসব মামলা হয়েছিল তার কোনটাই আপনি দেখেননি আপনার গবেষনার প্রয়োজনে।
উত্তর : না।
এরপর মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন “নির্বাচন কমিশিন যাদের নিবন্ধন দেয়ার পর তা আবার বাতিল করে সে তালিকায় প্রথমে ছিল ফ্রিডম পার্টির নাম তা জানেন? সাক্ষী “হ্যা” বলে জবাব দেন।
তবে ট্রাইব্যুনাল এসময় প্রশ্নটি বিষয়ে অষ্পষ্টতার আপত্তি জানালে মিজানুল ইসলাম অনুরোধ করেন প্রশ্নটি বাদ দেয়া হোক। পরে প্রশ্নটি বাদ দেয়া হয়।
প্রশ্ন : ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশিন যেসব দলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার একটি তালিকা আছে তা জানেন?
(এ প্রশ্নেও ট্রাইব্যুনাল আপত্তি জানিয়ে বলেন, এটির ক্ষেত্রেও আগের সমস্যা রয়ে গেল। তখন তাজুল ইসলাম এবং মিজানুল ইসলাম বলেন, আগের প্রশ্নটির উত্তরে সাক্ষী হ্যা বলেছেন। এ প্রশ্নটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার। যেসব দলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে তাদের একটি তালিকা হয়েছিল তা তিনি জানেন কি-না। )
উত্তর : নাই। তবে বাতিল তালিকায় তাদের নাম আছে।
প্রশ্ন : কানাডায় বসবাসরত খালেদ চৌধুরী, পিতা ফজলুল চৌধুরী, মা লুৎফুন চৌধুরী নামে কাউকে চেনেন?
উত্তর : না। তবে আমার ছেলের নাম খালেদ চৌধুরী। আমার বোনের নাম লুৎফুন চৌধুরী। সে কানাডায় থাকে। (মিজানুল ইসলাম এর সাথে যোগ করে বলেন, আপনার ভগ্নিপতির নাম ফজলুল চৌধুরী)
প্রশ্ন : বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড বিষয়ে যেসব মামলা হয়েছিল তা তদন্তের জন্য একজন ডিআইজকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তার নাম কি আপনার গবেষনায় এসেছে?
উত্তর : না।
এরপর যে সব প্রশ্ন নিয়ে হট্টগোলের সূত্রপাত হয় তা উপরে বর্নিত হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন