মেহেদী হাসান,9/10/2012
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ দু’জন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। এদের একজন হলেন মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন । আরেকজনের নাম গোলাম মোস্তাফা।
আনোয়ার হোসেন তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর পিরোজপুর মুক্ত হবার ২ দিন পরে দেলোয়ার শিকদার, মানিক খন্দকার এবং শঙ্করপাশার রাজ্জাক রাজাকারকে উত্তেজিত জনতা মেরে পায়ে দড়ি বেঁধে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে জনতা।
মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বর্তমানে যে বিচার চলছে তাতে একটি অভিযোগ হল মাওলানা সাঈদীর নাম দেলোয়ার শিকদার ছিল। স্বাধীনতার অনেক পরে নাম পাল্টে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীগন ইতোপূর্বে ট্রাইব্যুনালে প্রমানের চেষ্টা করেছেন দেলোয়ার শিকদার নামে একজন রাজাকার ছিল এটি সত্য। তবে সে স্বাধীনতার পরপর জনরোষে নিহত হয়। কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার শিকদার এবং মাওলানা সাঈদী সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন ব্যক্তি। তাদের পিতার নামও ভিন্ন। রাষ্ট্রপক্ষের প্রবীণ সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী জেরায় স্বীকার করেন দেলোয়ার শিকদার জনরোষে নিহত হয়ে থাকতে পারে। গতকাল মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বললেন দেলোয়ার হোসেনকে মেরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল জনতা।
অপর দিকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন গোলাম মোস্তাফ।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালে ৮ মে পারেরহাট নিয়ে মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী বললেন ইব্রাহীম কুট্টিকে ১ অক্টোবার তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। সে মর্মে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে যে মামলা করেছিলেন সে মামলার এজাহার আদালতে দাখিল করা হয়। তাতে ইব্রাহীম কুট্টির হত্যাকান্ডের স্থান নলবুনিয়া এবং হত্যার তারিখ ১ অক্টোবার উল্লেখ করেছেন তার স্ত্রী মমতাজ বেগম।
আনোয়ার হোসেনের জবানবন্দী : আমার নাম আনোয়ার হোসেন। বয়স ৫৭ বছর। গ্রাম কদমতলা, থানা এবং জেলা পিরোজপুর। আমি বর্তমানে ব্যবসা করি। ১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে পাক সেনারা নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। হাজার হাজার নারনারী খুন করে এবং গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকে। এ খবর ২৬ মার্চ আমরা সকালে জানতে পেরে আমিসহ আরো ৬/৭ জন আমাদের এম এন এ অ্যাডভোকেট জনাব এনায়েত হোসেন খান এর কাছে চলে যাই। তিনি তখন জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা বলেন, বক্তব্য শোনার জন্য আমরা আসিনি। অস্ত্র চাই। তাৎক্ষনিকভাবে এনায়েত হোসেন সাহেব উত্তেজিত জনতাসহ ট্রেজারিতে চলে যান। সেখান থেকে বিনা বাঁধায় অস্ত্র গুলি নিয়ে সরকারি স্কুলের মাঠে চলে যান। অস্ত্র গুলি নিজের কাছে রারেখন। তিনি বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চান তারা আগামীকাল সকালে আটটার আগে একটি থালা, একটি বালিশ, একটি চাদর নিয়ে হাজির হবেন । ওইভাবে আমরা ২৭ মার্চ সকালে আমিসহ ২১ জন হাজির হই। আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। আমাদের মোট ৩০ জনের গ্রুপে দুই জন ইনস্ট্রাক্টর ঠিক করে দেয়া হয়। এরা হলেন বরকত এবং গোলাম সরোয়ার। দুইজনই সেনাবাহিনীর সাবেক হাবিলদার ছিলেন। প্রশিক্ষনের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ট্রেজারি থেকে টাকা লুট করে। এই টাকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্ত তেরি হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এটা ঘটে মে মাসের তিন তারিখ। আমাদের গ্রুপটি নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে পড়ে। আমি ওই দিনই বাকলে বাড়ি চলে আসি। পরের দিন মে মাসের চার তারিখ আমার বড় চাচি আমাকে বলেন, তুমি তোমার অমুক ভাইয়ের সাথে গিয়ে তোমার আপাকে নিয়ে আস। শুনতে পাচ্ছি পিরোজপুরে বড় ধরনের গন্ডগোল হবে। আমার আপার নাম ছিল আনোয়ারা বেগম। ভগ্নিপতি আব্দুস সাত্তার পূর্বে পিরোজপুর এসডিও অফিসে চাকরি করতেন। ১৯৭০ সালে ভোলায় বদলি হন এবং পরে ১৯৭১ সালে আবার বদলী হয়ে পিরোজপুরে এসডিও অফিসে হেডকার্ক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ধোপাবাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। আমি এবং আমার ভাই অদুত আপার বাসাই যাই। তখন সকাল অনুমান দশটা হবে। আপাকে নেয়ার কথা বলার পর তিনি গোছগাছ শুরু করেন। এর ৮/১০ মিনিট পরে বাইরে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি দেখতে পেয়ে আমার ভগ্নিপতি বাইরে বের হন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন হুলারহাট থেকে মিলিটারি পিরোজপুর আসাতেছে। এই বলে ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দেন এবং আমাদের বাইরে বের হতে বারন করেন। অনুমান ১০/৫ মিনিট পরে আমরা বুটের আওয়াজ শুনতে পাই। কাঠের বেড়ার ফাক দিয়ে দেখতে পাই অনেক মিলিটারি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে দণি দিকে। সামনে চারজন বাঙ্গালি ছিল যাদেরকে আমি চিনতাম। এরা হল হুলারহাটের আশরাফ চেয়ারম্যান, চিলার দেলোয়ার শিকদার, পিতা রসুল শিকদার, মানিক খন্দকার এবং সাত্তার মোক্তার। আমার ভগ্নিপতিও এ চারজনকে চিনতে পারেন। ৫/৭ মিনিট পরেই আমার বাসা থেকে পশ্চিম দণি দিকে বিকল গুলির শব্দ শুনতে পাই। কাঠের বেড়ার ফাক দিয়ে আগুন এবং ধোয়া দেখতে পাই। ্বরে ৮/১০ মিনিট পর আমাদের বাসার কাছে আবার বিকট গুলির শব্দ শুনতে পাই। এরপর মিলিটারি আমাদের বাসার সামনে দিয়ে উত্তর দিকে চলে যায়। তখনো ওই চার বাঙ্গালি অগ্রভাগে ছিল। অনুমান আধাঘন্টা পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে রাস্তায় দুয়েকজনকে চলাফেরা করতে দেখে আমরা ভগ্নিপতি বের হন। প্রায় এক ঘন্টা পরে তিনি ফিরে এসে জানালেন মন্ডলপাড়ায় ১০/১২ জন এবং ধোপাপাড়ায় ৪/৫ জনকে খুন করেছে আর্মি। মিলিটারি শহরে গিয়ে সরকারি স্কুলে ক্যাম্প করেছে। আমরা সন্ধ্যার পর আমাদের বোন, ভাইগনা ভাগ্নীদেগর নিয়ে বাড়ি আসি।
এরপর আমরা আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকি। অনুমান আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি আমিসহ ২১ জন ভারতে যাই। আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করে বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষনের জন্য প্রস্ততি চলতে থাকে। অনুমান ১৫ দিন পরে শ্রাবন মাসের প্রথাম দিকে আমার পূর্ব প্রশিক্ষক গোলাম সরোয়ার আমাদের ক্যাম্পে আসেন। তিনি বলেন, তোমরা কে কে এসেছ। তোমরা অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে চল। আমি ভারত সরকারের কাছ থেকে অনেক অস্ত্র সংগ্রহ করেছি। আমি ট্রেনিংয়ের প্রস্ততির কথা জানালে তিনি বলেন, তুমি তো রাইফেল ট্রেনিং পার। নতুন অস্ত্রের ট্রেনিং বাংলাদেশে গিয়ে আমি তোমাদের দেব। আমাদের ২২ জনের মধ্য থেকে ১৫ জন এবং তার সাথে থাকা আরো ১৫ জনসহ আমরা দেশে আসি। নাজিরপুর থানাধীন কুমরাখালি গ্রামের মধ্যে ক্যাম্প স্থাপন করি। অনুমান শ্রাবন মাসের মাঝামাঝি রাত দশটার দিকে নাজিরপুর রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন করি। এতে আমাদের কমান্ডার গোলাম সরোয়ারের কপালে রাজাকারদের গুলি লাগে এবং তিনি শহীদ হন। ওই রাতেই আমরা কদম তলা চলে আসি। জুসখোলা ও কদম তলায় দুটি ক্যাম্প স্থাপন করি। কয়েকদিন পর আমরা জানতে পারি ভাগিরথী নামের এক মহিলা নিয়মিত পাক সেনাদের ক্যাম্পে যাতায়াত করে। তার বাড়ি আমাদের ইউনিয়নে বাগমারা গ্রামে। গোলাম সরোয়ার মারা যাবার পরে সর্দার মতিউর রহমান (বর্তমানে পিরোজপুর সদর থানার চেয়ারম্যান) আমাদের কমান্ডযার নিযুক্ত হন। সর্দার মতিউর রহমান সাহেব ভাগিরথীর সাথে পরিকল্পনাক্রমে আমাদেরকে বাগমারা গ্রামে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে তিন স্থানে রাখেন। তিনি জানান, ভাগিরথীর মাধ্যমে জেনেছি আজ পাক সেনারা আমাদের ধরতে আসবে। আমরাও পাক সেনাদের আক্রমনের অপেক্ষায় ছিলাম। ওই দিন বিকালে আছরের নামাজের পরে আমাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে এসে পড়ে পাক সেনারা। আমরা তাদের ওপর আক্রমন পরিচালনা করি। এতে পাক সেনারা দিশাহীন হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গুলিতে ১০/১২ জন পাক সেনা নিহত হয়। ওদের ফেলে যাওয়া ১০টি রাইফেল, তিনটি হেলমেট, ২টি লাঠি পাই। রাস্তায় অনেক রক্ত দেখি। ওইদিনই ভাগিরথীর সন্ধান নেয়ার পর আমাদেরকে কমান্ডার জানালেন ভাগিরথী আজ বাড়ি যায়নি। সে প্রতিদিন বাড়ি ফিরত। পরের দিন কমান্ডার মতিউর রহমান সাহেব আমাকে এবং আমার সহযোদ্ধা আব্দুল মালেককে ভাগিরথীর সন্ধানের জন্য পিরোজপুর পাঠান ছদ্মবেসে। তার আদেশে আমি এবং মালেক পিরোজপুর গিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে পৌছামাত্র পূর্ব দিক থেকে একটি গাড়ি আসার শব্দ পাই। ২/১ মিনিট পরে দেখতে পাই আমাদের সামনে দিয়ে একজন মহিলাকে গাড়ির পেছনে দাড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওই মহিলা বিবস্ত্র অবস্থায় ছিল এবং তার দেহ ক্ষত বিক্ষত ছিল। ওই গাড়িতে চারজন পাক আর্মি এবং একজন চালক ছিল । গাড়ি সামনে দিয়ে চলে গেলে আমরা ক্যাম্পে চলে যাই এবং কমান্ডারকে এ ঘটনা দেখার কথা জানিয়ে বলি ভাগিরথীকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর পাকিস্তানী সেনারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিদিন কদমতলা এবং জুসখোলা আসে। আমরা কদমতলা এবং জুসখোলা থেকে সুন্দরবন বগি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে যাই। আমাদেরকে তালতলা খালের মধ্যে ১ নং ক্যাম্পে রাখা হয়। তখন শফিউদ্দিন আহমেদ (ব্রিটিশ আমলের হাবিলদার) কে আমাদের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তার নতেৃত্বে আমরা তাফালবাড়ি রাজাকার ক্যােিম্প একটি অপারেশন পরিচালনা করি। চারজন রাজাকার ধরা পড়ে আমাদের হাতে এবং তাদের হত্যা করি আমরা।
ডিসেম্বর ৭ তারিখ কমান্ডার সাহেব আমাদের আদেশ দিলেন গোলাবারুদ, অস্ত্রসহ সবাই নৌকায় ওঠ। অনেক মুক্তিযোদ্ধা মিলে কয়েকটি নৌকায় করে মোড়েলগঞ্জে আসি। ডিসেম্বর ৮ তারিখ তিনি বলেন, সবাই পায়ে হেটে পিরোজপুর যাত্রা কর। পিরোজপুর আক্রমন করতে হবে। আমাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের আদেশ দেন। আমাদের গ্রুপটি পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীর অপর পারে হাজির হই। সন্ধ্যার পর সাতটা সাড়ে সাতট অনুমান এমন সমসয় চারদিকে আনন্দ ধ্বনি শুনতে পাই। জয়বাংলা, জয় বাংলাদেশ স্লোগান শুনি। আমরা খেয়া পার হয়ে শহরে প্রবেশ করি। সরকারি স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প দখল করে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। তখন রাজাকারদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসতে থাকে। ২ দিন পরে দেলোয়ার শিকদার, মানিক খন্দকার, শঙ্করপাশার রাজ্জাক রাজাকারকে উত্তেজিত জনতা মেরে পায়ে দড়ি বেধে” আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিন সাহেব আমাদেরকে কঠোর নির্দেশ দেন আশরাফ চেয়ারম্যান এবং সাত্তার মোক্তারকে খুজে বের করার জন্য। তাদের ধরার জন্য আমরা অনেক খোজাখুজি করি কিন্তু পাইনি। এর পর আমাদেরকে হুলারহাট ক্যাম্পে নিয়োগ দেয়া হয়। অনুমান মার্চ মাসে আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে আমি আমার লেখাপড়ায় ফিরে যাই।
জেরা : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী সাক্ষীকে জেরা করেন। ৮/১০ টি প্রশ্নের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় জেরা।
প্রশ্ন : মুক্তি বার্তায় আপনার নাম আছে?
উত্তর : আছে কি-না দেখিনাই। তবে জাতীয় তালিকায় আমার নাম আছে এবং সেখানে আমার নম্বর ২০। সরকারি তালিকায় আমার নম্বর ২৯২।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা ভোটর তালিকায় আপনার নাম আছে?
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : ভারতে কয়দিন ছিলেন?
উত্তর : অনুমান ১৬/১৬ দিন।
প্রশ্ন : ভাগিরথীর যে ঘটনা বললেন তা অনেক পত্রপত্রিকায় এসেছে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : যেসব ক্যাম্পের নাম বলেছেন তাও বিভিন্ন বইপত্রে এসেছে।
উত্তর : এসেছে কি-না আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের বিষয়টি কোন কাগজপত্র দ্বারা সমর্থিত নয়।
উত্তর : সত্য নয়।
গোলাম মোস্তাফার জবানবন্দী : আমার নাম মোঃ গোলাম মোস্তফা, বয়স- ৬২ বছর । গ্রাম নলবুনিয়া, থানা জিয়ানগর, জেলা- পিরোজপুর। বর্তমানে আমি অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই যে, উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাবেহ আলী এবং তার মাকে নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী চকিদার, কালাম চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাইকে (ইব্রাহীম কুট্টি) মেরে ফেলেছে। আজহাল আলীর স্ত্রী এবং ছেলেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আজাহরকেও মেরেছে। লোকজন বলল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যার সময় তার স্ত্রী মমতাজের হাতেও গুলি লাগে। মমতাজকেও জিজ্ঞাসা করায় সেও তাই জানাল।
এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি, বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি সাহেব আলীর মা সেতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। এরপর শুনেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মমতাজ বেগম তার স্বামী ও ভাই হত্যার জন্য এস.ডি.ও বরাবরে একটি মামলা দায়ের করেছে।
জেরা : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী সাক্ষীকে জেরা করেন।
প্রশ্ন : আপনার কয় ছেলে কয় মেয়ে?
উত্তর : তিন ছেলে তিন মেয়ে।
প্রশ্ন : মেয়েদের নাম কি এবং তারা কি করে?
উত্তর : বড় দুই মেয়ে ডিগ্রী পাশ। তাদের বিয়ে হয়েছে । তারা গৃহিনী। তাদের নাম নূরজাহান বেগম এবং সুমাইয়া আক্তার। ছোট মেয়ে এম এ, এলএলবি পাশ । সে প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা। তার নাম তানিয়া আক্তার।
প্রশ্ন : তানিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার বিরুদ্ধে জঙ্গি অভিযোগে মামলা হয়েছিল।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি রাজনীতির সাথে জড়িত?
উত্তর : হ্যা। জামায়াতে ইসলামী।
প্রশ্ন : কোন পদে আছেন?
উত্তর : পিরোজপুর পৌরসভার সভাপতি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব গ্রেফতারের পর তার মুক্তির জন্য আপনি অনেক মিটিং মিছিল করেছেন।
উত্তর : একটি মিছিলে অংশ নিয়েছি।
প্রশ্ন : ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত কয়টি মামলা হয়েছে আপনার বিরুদ্ধে ?
উত্তর : চারটি। একটি খারিজ হয়েছে। বাকী তিনটি মামলার একটি হয়েছে পুলিশের কাজে বাঁধা দেয়ার অভিযোগে। আরেকটি পুলিশের সাথে সংঘর্ষের অভিযোগে। এ মামলা দুটির বাদী পুলিশ। আরেকটি হয়েছে আওয়ামী লীগের এক বেকার যুবকের পকেট থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে। এ মামলায় আসামী আমিসহ ৪১ জন।
প্রশ্ন : আপনি সাঈদী সাহেবে নির্বাচনে আর্থিক সহায়তা করেছেন?
উত্তর : আমি ২০০৯ সালে জামায়াতে যোগ দেই।
প্রশ্ন : ২০০৮ সালে আপপনি ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন সাঈদী সাহেবকে নির্বাচনের জন্য।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও আপনি স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন
উত্তর : সত্য নয়। আমাদের বাড়িতে পাড়েরহাটের বেনিমাধব সাহাদের পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম তার স্বামী এবং ভাই হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেন সে মামলার এজাহার আদালতে উপস্থাপন করেন আসামী পক্ষ। মামলার এ এজাহারকে জাল এবং মামলার প্রয়োজনে তৈরি করা হয়েছে মর্মে সাজেশন দেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোটেক মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনসারী প্রমুখ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন