মেহেদী হাসান, ৪/১০/২০১২
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আগামী রোববার সাক্ষী আনতে না পারলে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হবে। আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ এ মর্মে এক আদেশ পাশ করেছেন।
আজ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী হাজিরের জন্য ধার্য্য ছিল। আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীর পক্ষে একজন সাক্ষী হাজির করে এবং তার জবানবন্দী ও জেরা পৌনে একঘন্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। এরপর ট্রাইব্যুনাল আসামী পক্ষকে পরবর্তী সাক্ষী হাজিরের জন্য বলেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে তাদের হাতে সাক্ষী নেই। অসুস্থতা এবং পিরোজপুর থেকে সাক্ষী ঢাকায় আনতে না পারার কারনে আজ আর কোন সাক্ষী আনা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
এরপর ট্রাইব্যুনাল উপরোক্ত আদেশ দেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ পর্যন্ত আটজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে । তারা সাধারনত একদিনে একজন করে সাক্ষী হাজির করে আসছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষীদের জবানবন্দী এবং জেরা অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার আসামী পক্ষকে বলেছেন আপনারা বেশি সাক্ষী আনবেন। একজন সাক্ষী শেষ হলে আরো সাক্ষী প্রস্তুত রাখবেন। গত বুধবার ট্রাইব্যুনাল আসামী পক্ষকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আগামীকাল বৃহষ্পতিবার একাধিক সাক্ষী আনতে হবে। তা নাহলে আমরা আদেশ পাশ করতে বাধ্য হব। আমাদের সে আদেশ করতে বাধ্য করবেননা আপনারা।
অবশেষে আজ মাওলানা সাঈদীর পক্ষে একজন সাক্ষী আনায় এবং পরবর্তীতে আর সাক্ষী হাজির না করায় ট্রাইব্যুনাল আদেশ পাশ করেন।
আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রতিদিন তারা একজন করে সাক্ষী আনেন। আমরা তাদেরকে বারবার বলেছি একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে পরবর্তী সাক্ষী রেডি রাখবেন। বিচার কার্যক্রম কোন মুলতবি ছাড়াই চলবে। অতীতে আমরা সাক্ষী আনতে না পারার কারনে বেশ কয়েকবার মুলতবি করেছি। কিন্তু এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে আদেশ পাশ করার। আগামী রোববার যদি তারা সাক্ষী আনতে না পারে তাহলে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হবে।
তাজুল ইসলামের প্রতিকৃয়া: আদেশ পাশের পর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘বন্ধ করে দেয়া হবে’ কথাটা একটু কঠিন হয়ে গেল। এটা পরিবর্তন করলে ভাল হয়। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে কিছুটা উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় । তাজুল ইসলাম বলেন, এর আগে রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর পক্ষে কতবার সাক্ষী আনতে ব্যর্থ হয়েছে এবং কতবার তারা সাক্ষী আনতে না পারার কারনে মুলতবি করা হয়েছে সে আমলনামা আমাদের কাছে আছে। তাজুল ইসলাম সে বিষয়ে একটি কাগজ ট্রাইব্যুনালের সামনে উচু করে দেখিয়ে বলেন, তাদের ক্ষেত্রে অতীতে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আপনারা রোববার সাক্ষী আনেন। তাহলেতো আর এ আদেশ থাকবেনা।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা কি এখন বসে থাকব? আমরা তো বসে থাকতে পারিনা। এটা একা লার্জার বেঞ্চ। তিনজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত। আমরা সবাই বসে থাকতে পারিনা।
জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, এ কোর্টে আরো অনেক মামলা আছে। সেগুলো চালাতে পারেন। মামলাতো একটা নয়।
এসময় ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন, দেখনে তাজুল সাহেব, আজ হঠাৎ করে কিন্তু এ আদেশ দেয়া হয়নি। চেয়ারম্যান মহোদয় বারবার আপনাদের বলেছেন সাক্ষী রেডি রাখার কথা। গতকালও শেষ বারেরমত সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, মাই লর্ড, আপনি শুরু থেকে এ ট্রাইব্যুনালে ছিলেননা। অতীতে রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী আনতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে এবং বহুবার সাক্ষী আনতে না পারার কারনে মুলতবি করা হয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে আদেশ এবং শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।
তাজুল ইসলাম এবং ট্রাইব্যুনালের মধ্যে কথপোকথনের এক পর্যায়ে তাজুল ইসলাম অনুরোধ করেন উভয় পক্ষের প্রতি সমান আচরনের। তখন ট্রাইব্যুনাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনি কি বলতে চান আমরা উভয় পক্ষের প্রতি সমান আচরন করছিনা? বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আপনার এ অভিযোগ আদালত অবমাননার শামিল।
তাজুল ইসলাম বলেন, আমি ন্যায় বিচার চেয়ে আবেদন করছি।
ট্রাইব্যুনাল বলেন, তা অবশ্যই চাইতে পারেন। কিন্তু কথাটা সেভাবে বলেননি আপনি।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এসয় তাজুল ইসলামকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তাজুল সাহেব এটা একটা কোর্ট, আপনি একজন লইয়ার তা মনে রাখবেন। লইয়ার এভাবে কোর্টের সাথে কথা বলতে পারেনা।
কথপোথনের এক পর্যায়ে বিচারপতি নিজামুল হক তাজুল ইসলামকে লক্ষ্য করে বলেন, আপনাদের তো বাইরে গিয়ে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। সেভাবে অভিযোগ করেন গিয়ে যে, আমরা তাদের (রাষ্ট্রপক্ষের ) বেশি সুযোগ দিয়েছি। আর আপনাদের কম সুযোগ দিয়েছি। এ অভিযোগ তো করেই আসছেন।
এসময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী আদেশ সমর্থন করে বলেন, আজই সাক্ষীর সাক্ষ্য বন্ধ করে দিয়ে আদেশ দেয়া উচিত ছিল।
দুপুরের বিরতির পর জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দুই জন সাক্ষীর জেরা শেষ হয়ে যায় তিনটার মধ্যে। তখন ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমকে পরবর্তী সাক্ষী হাজির করতে বলেন। কিন্তু জেয়াদ আল মালুম বলেন, আজ আর তাদের কাছে সাক্ষী নেই। তখন ট্রাইব্যুনাল তাদের ওপরও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা এখন কি করব। সাক্ষী কেন নেই। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু এবং জেয়াদ আল মালুম বলার চেষ্টা করেন তাড়াতাড়ি দুজন সাক্ষীর জেরা শেষ হয়ে যাবার কারনে সময় বের হয়েছে। আপনারাতো আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জেরার জন্য চারটা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু আসামী পক্ষ জেরা সংক্ষেপ করায় দ্রুত শেষ হয়ে গেল। এখানে তো আমাদের তেমন কিছু করার নেই।
সাঈদী এবং গোলাম আযমের বিচার চলবে মুলতবি ছাড়া :
এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সাক্ষী অসুস্থ, সাক্ষী নেই এ গ্রাউন্ডে আর বিচার মুলতবি করা হবেনা। মাওলানা সাঈদী এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ দুটা কেস চলতে থাকবে। কোন মুলতবি হবেনা। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামী পক্ষ উভয়ের প্রতি তিনি বলেন, আপনারা সাক্ষী রেডি রাখবেন।
রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক সময়মত সাক্ষী আনতে না পারার খতিয়ান :
১. ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২, ২৪ তম সাক্ষী না আনতে পারায় ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয় বিচার।
২. ১৩ ফেব্রুয়ারি ২৪ তম সাক্ষী না আনতে পারায় ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
৩. ২২ ফ্রেব্রুয়ারি ২০১২, ২৮ তম সাক্ষী আফরোজা বেগম অসুস্থতার কারনে বিচার মুলতবি করা হয়।
৪. ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১২ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী আনতে না পারার কারনে মুলতবি করা হয় বিচার।
৫. ৭ মার্চ ২০১২ সাক্ষী আনতে না পারার কারনে মুলতবি করা হয় এবং আদেশ পাশ করা। আদেশে তাদেরকে “শেষ চান্স” দেয়া হল বলে উল্লেখ করা হয়।
৬. ১৮ মার্চ ২০১২ তারা জানায় তাদের আর কোন সাক্ষী নেই এবং তদন্ত কর্মকর্তাকে জবানবন্দীর জন্য পেশ করতে চায়।
৭. ২০ মার্চ ২০১২ ট্রাইব্যুনালে দরখাস্ত দিয়ে জানান তাদের পক্ষে আর সাক্ষী হাজির করা সম্ভব নয়।
এভাবে আরো প্রায় ১০ দিন যথাসময়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী সাক্ষী আনতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। অনেকবার রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীর তালিকার সিরিয়াল ভঙ্গ করে অন্য সাক্ষী হাজির করেছে ।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অষ্টম সাক্ষীর জবানবন্দী :
আজ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে অষ্টম সাক্ষীর জবানবন্দী এবং জেরা শেষ হয়। জবানবন্দী শেষে তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমীন, মনজুর আহমদ আনসারী প্রমুখ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
জবানবন্দী :
আমারনাম মোঃ কোবাদ আলী । বয়স ৬৯ বছর । আমার গ্রাম মহিরন, থানা- বাঘারপাড়া, জেলা-যশোর। আমি কৃষিকাজ করি। ১৯৭১ সালে আমি কৃষি কাজ করতাম। ১৯৬৯/৭০ সালে মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব যশোর নিউটাউনে বাসাভাড়া করে থাকতেন এবং তিনি যশোর জেলার বিভিন্নএলাকায় মাহফিল করতেন। ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট হতে পাক সেনারা যশোর টাউনের উপরে শেল মারা শুরু করে। তখন টাউনের লোক গ্রামেআশ্রয় নেয় ভয়ে। মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব ও বাসা ছেড়ে আমাদের মহিরন গ্রামে মরহুম সদরউদ্দিন সাহেবেরবাড়িতে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে আশ্রয় নেন। ঐ বাড়িতে ১৫ দিন থাকার পর পীর সাহেব হুজুরের অনুরোধে দোহাকোলার রওশন সাহেব খুশি মনে উনাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় মে মাসের শুরুতে। ওখানে আড়াই মাসেরমত থাকার পরে দেলোয়ার হোসাইন ন সাঈদী সাহেব জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে দেশের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
জেরা : আপনার এলাকায় সাঈদী সাহেবকে কতবার দেখেছেন?
উত্তর : বহুবার গেছেন।
প্রশ্ন : যতবার উনি গেচেন ততবার আপনি ওনার সাথে থাকতেন?
উত্তর : দূরে গেলে যেতামনা।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি সবসময় যেতেন?
উত্তর : মাঝে মাঝে।
প্রশ্ন : কি কারনে যেতেন?
উত্তর : প্রতিবেশি হিসেবে।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের যশোরের বাড়ি যেতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনারা এলাকায় অন্যান্য যারা ওয়াজ মাহফিল করতে আসতেন তাদের সবার সাথেও আপনি থাকতেন?
উত্তর : পরিচয় থাকলে যেতাম।
প্রশ্ন : যাদের চিনতেন তাদের দুয়েকজনের নাম বলেন।
উত্তর : মাওলানা গোলাম রসুল, গোলাম মোস্তফা, আবু সাঈদ।
প্রশ্ন : এরা কোথায় থাকত তা জানেন?
উত্তর : এদের বাড়ি আমাদের এলাকার দ’ুচার মাইল দূরে।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াত করেন। সে কারনে জামায়াত নেতা সাঈদী সাহেবের পক্ষে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন