মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম তালুকদার
সাঈদী সাহেবর বিরুদ্ধে ৭১ সালে আমাকে কেউ কিছু বলেনি
সাঈদ সাহেব কোন অপরাধ করলে কমান্ডার হিসেবে লোকজন তা আমাকে বলত
মেহেদী হাসান
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে ট্রাইব্যুনালে (১) । তার পক্ষে প্রথম সাক্ষী হিসেবে আজ ২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দিয়েছেন নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম তালুকদার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। শামসুল আলম তালুকদার ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের পারেরহাটে কে কি অপরাধ করেছে তা স্বাধীনতার পর লোকজন আমাকে বলেছে। কিন্তু মাওলানা সাঈদী সাহেব সম্পর্কে আমাকে তখন কেউ কিছু বলেনি। যদি সাঈদী সাহেব কোন অন্যায় কাজ করতেন তাহলে আমি কমান্ডার হিসেবে লোকজন আমার নিকট তা অবশ্যই বলতো।
শামসুল আলম তালুকদার বলেন, ৮ ডিসেম্বর পারেরহাট মুক্ত হওয়ার পর মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনসহ (সুন্দরবন সাব সেক্টরের কমান্ডার ) আমি সেখানে যাই। মেজর জিয়াউদ্দিন ১০/১৫ মিনিট ছিলেন। আমাকে উনি পারেরহাটের সমস্ত অবস্থা জেনে ২/৩ ঘন্টা পরে পিরোজপুরে আসতে বলেন। সেখানে আমাদের কমান্ডার খসরু, মোকাররম, লিয়াকত আলী বাদশা, বাতেন, মুনাম, সানু খোন্দকারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারন তাদের অবস্থা বর্ণনা করে। আমি পারেরহাট মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করি। মোসলেম মওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, রাজ্জাক, দুইজন চৌকিদারসহ আরও কয়েকজন কে কি অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা করে। ঐ সময়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু বলে নাই।
জবানবন্দী শেষে আজই তার জেরা শেষ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ শামসুল আলম তালুকদার, বয়স- ৬৮ বছর।
আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার ইকরি গ্রামে এবং বাগেরহাট জেলার শরনখোলা থানার খুন্তাকাটা গ্রামে। পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার দিঘিরজান হাইস্কুল থেকে আমি ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাশ করি। তৎপর বাগেরহাট পি,সি কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। ঐ একই কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করি। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে আমি পি,সি, কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬৪ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের খুলনা জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৬৫ সালে একই জেলার সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হই। ১৯৬৯ সালে আমি মাওলানা ভাষানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করি এবং শরনখোলা থানা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হই। ছাত্র অবস্থায় আমি হামিদুর রহমান শিক্ষা রিপোর্ট বিরোধী এবং পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য দুবার কারাবরন করি। ১৯৭০ সালে আমি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নোমিনেশন পেপার দাখিল করি। তখন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলে সর্বনাশা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যের জন্য এবং অগনিত লাশ দাফন করার জন্য আমার নেতা ভাষানীর নির্দেশক্রমে আমি নির্বাচন থেকে বিরত থাকি।
ছাত্র জীবন থেকেই আমি সামাজিক কর্মকান্ডের সহিত জড়িত। ১৯৬২ সালে আমি আমার গ্রামে খোন্তাকাটা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করি এবং এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় জমি আমি এবং আমার পরিবার দান করি। ১৯৭৯ সালে ঐ স্কুলের পাশেই একটি জুনিয়র গার্লস স্কুল যার নাম বর্তমানে বি,কে গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করি এবং সেখানেও আমি এক একর জমি দান করি। ১৯৬৩ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে আমি তাফালবাড়ি হাইস্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি এবং চাঁদা দিয়ে সবার সহযোগিতায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৭৮ সালে শরনখোলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করি এবং ঐ কলেছে ১৪ কুরা (এক কুরা= ৬৬ শতক) জমি দান করি। ১৯৬২ সালে শরনখোলা- মোড়লগঞ্জের ছাত্রদের নিয়ে মোড়লগঞ্জে একটি কলেজ করার প্রস্তাব করি এবং পরবর্তীতে কলেজ প্রতিষ্ঠা করি । সেখানে প্রথম চাঁদা দিই আমি নিজে। বর্তমানে উক্ত কলেজটি এস,এম কলেজ নামে পরিচিত। এভাবে শরনখোলা থানায় রাজাপুর হাইস্কুল, জনতা হাইস্কুল, বাগেরহাট খানজাহান আলী কলেজ, বাগেরহাট আদর্শ বিদ্যালয়, ভান্ডারিয়া আব্দুস সোবহান মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করি সকলের সহযোগিতায়। ১৯৭০ সালে বাগেরহাট ফাউন্ডেশন জনাব মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবের সহযোগিতায় আমরা গরীব দুঃখী ছাত্রদের সহযোগিতার জন্য প্রতিষ্ঠা করি, উক্ত ফাউন্ডেশনে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি টাকা আছে। .....আমার গ্রামে মাছের ঘের এবং যথেষ্ট জমি আছে।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পরে ঘটনা পরম্পরায় আমরা বুঝতে পারি যে, আলোচনায় কোন কাজ হবে না। পরে আমরা এলাকায় যুব সমাজকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে আমরা কিছু চাল, ডাল, খাবার দাবার যোগাড় করে শরনখোলা সংলগ্ন সুন্দরবনের ভিতরে একটা আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করি যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনে সেগুলো কাজে লাগাতে পারি। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে মোড়লগঞ্জে প্রথম রাজাকাররা আসে। ঐ সময়ে ওখানে কিছু পুরানো বাঙ্গালী আর্মি অফিসার এবং অন্যান্য আর্মির লোক ছিল যার মধ্যে কবীর আহমেদ মধু ছিল, তাদের এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা যুবকের নিয়ে আমরা মোড়লগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের রাজাকার ক্যাম্প রাত্রি অনুমান ১১-টায় আক্রমন করি। আক্রমনে আমাদের আবু নামে একটি ছেলে শহীদ হয়। তিনজন রাজাকার মারা যায়। রাজাকাররা খুব ভোরে মোড়লগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে মোড়লগঞ্জের দুই মাইল দক্ষিণে রাজা গোবিন্দের বাড়িতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করি। এইভাবে আমরা তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের যে সমস্ত নেতা ছিলেন, তাদেরকে একত্রিত করে রাজা গোবিন্দর বাড়িতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করি। আমরা খবর পেলাম মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব একটি বাড়িতে অবস্থান করছেন। তখন আমরা একটি দল তৈরি করে তাকে স্বসম্মানে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়ে দিই এবং সন্ধ্যার ভিতর তাকে নিয়ে আসা হয়। তারপর তিনি আমাদের নিকট থেকে সব কিছু শুনেন। শোনার পরে আরও লোকজন একত্রিত করে আমরা একটা বৈঠকে বসি। উক্ত বৈঠকে সবাই মিলে মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেবকে উক্ত এলাকার কমান্ডার নিযুক্ত করি। উক্ত বৈঠকে দেড়/দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিল। আমাকে সেকেন্ড ইন কমান্ড নিয়োগ করা হয়। দুইদিন পরে পাকিস্তান আর্মি মোড়লগঞ্জ আক্রমণ করে। আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করি। সুন্দরবনে প্রবেশ করে আমরা রণ নীতি এবং রণ কৌশল কিছুটা পরিবর্তন করি । মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেবকে ভারত হতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য নৌকা যোগে ভারত পাঠিয়ে দিই । আমরা ছোট ছোট খালের ভিতর গিয় গাছের উপর ছোট ছোট টং তৈরি করি যেখানে প্রতিটি টংয়ে ২০/৩০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। পরবর্তীতে আমরা কলেজ ছাত্র বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক এবং স্কুল ছাত্র বা তার কম বয়স্ক দুটি গ্রুপ তৈরি করি । প্রত্যেকেই আস্তে আস্তে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করে সবাইকে ট্রেনিং দেয়া শুরি করি। এভাবে একটা বিরাট মুক্তিবাহিনী দল তৈরি হয়। তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য আমরা গাছ কেটে মাঠ সমতল করে প্যারেড গ্রাউন্ডের মত তৈরি করি। আমাদের মধ্যে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাও ছিল, তাদের একটি ভিন্ন গ্রুপ তৈরি করি। মেজর জিয়াউদ্দিন না ফেরা পর্যন্ত আমরা কোন বড় ধরনের অপারেশনে যাই নাই। আমাদের ঐ ক্যাম্পে আমার স্ত্রী, পটুয়াখালীর সর্দার রশিদ এবং তার দুই বোন আনু ও মনু এবং আরও অনেকে ছিলেন। তাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। রুটি বানানো, কাপড় সেলাই, রান্নাসহ ক্যাম্পে অন্যান্য কাজও করতেন। আমরা ঐখানে একটি ছোট খাট ক্যান্টমেন্টের মত গড়ে তুলি। ইতিমধ্যে মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব ১১ টি নৌকা ভরে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনে ফিরে আসেন। ঐ এলাকার সাউথখালী ইউনিয়নে কোন রাজাকার কখনও ঢুকতে পারে নাই । সর্বদা ঐ জায়গা আমাদের দখলে ছিল এবং সেখানে আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব আসার পরে আমাদের সংগে সিদ্ধান্ত হয় যে, আমরা মোড়লগঞ্জ থানা আক্রমণ করব। তখন মেট্রিক পরীক্ষা হচ্ছিল। মোড়লগঞ্জে তখন পাঁচটি রাজাকার ক্যাম্প ছিল। আমরা ছয়টি গ্রুপ করলাম। থানা আক্রমণের গ্রুপে সুবেদার আজিজকে দায়িত্ব দেয় হয় যিনি বর্তমানে ভান্ডারিয়া থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। কবির আহম্মদ মধুকে রায়ের বিল্ডিং রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কুঠিবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সুবেদার গফফারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মোড়লগঞ্জ কে.সি. হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য কবীর মুকুলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মোড়লগঞ্জ কলেজ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য মেজর জিয়াউদ্দিন নিজে দায়িত্ব নেন এবং সংগে আমাকে রাখেন। আমরা কলেজকে পশ্চাদপদ রেখে স্কুল আক্রমণ করি। স্কুলের ভেন্টিলেটর দিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিন গ্রেনেড চার্জ করেন। রাজাকাররা হতাহত হয়। তাদের ১৪/১৫ জনকে আমরা আটক করি। আমাদের দুইজন মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং সুন্দরবনে নেওয়ার পথে উক্ত দুইজন মারা যায়। যে সব রাজাকারদের আমরা আটক করি তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। আমাদের বিজয়ে গ্রামের লোকেরা আনন্দ প্রকাশ করে এবং আমাদেরকে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী দেয় । জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে বরণ করে নেয়।
পরবর্তীতে প্যারেড গ্রাউন্ডে আমরা মিটিং করি এবং কিভাবে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ চালাবে সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করি। ঐ সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই যোগদান করছিল। মেজর জিয়াউদ্দিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে সমগ্র এলাকায় অর্থাৎ বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন থানায় কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ চালাবো সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করি। মেজর জিয়াউদ্দিনের তখন বয়স কম হলেও অত্যন্ত সাহসী এবং কুশলী ছিলেন । আমরা ঝালকাঠির শাহজাহান ওমর সাহেব এবং পটুয়াখালীর মেহেদী সাহেবের সংগেও যোগাযোগ করি এবং হাজার হাজার শরনার্থী আসতেছিল তাদেরকেও ভারতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। ছোট ছোট কিছু আক্রমন পরিচালনার পর মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেবকে আবার ভারতে পাঠানো হয় এবং তিনি ১৫ দিন পরে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এবং অন্যান্য ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে আবার ফিরে আসেন। রণ নীতি এবং রণ কৌশল পরিবর্তন করে আমরা এবার থানা আক্রমণ শুরু করলাম। প্রথম তুযখালী বন্দর আক্রমণ করে ছয় হাজার মন চাল, দেড়শ রাজাকার ও পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসি। সেখান থেকে দুই হাজার মন চাল ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়ে দেই। এই আক্রমণের পরে আমাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে বিমান এবং গানবোটের মাধ্যমে আক্রমণ করা হয় কিন্তু তারা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে নাই। এরপর আমরা পিরোজপুরের কাউখালী থানা আক্রমণ করি। সেখানে আমরা দুইজন পাঞ্জাবী পুলিশসহ অন্যান্য পুলিশ ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে চলে আসি। এরপর ভান্ডারিয়া থানা আক্রমণ করি। ঐ থানার ও.সি সাহেব অস্ত্র-শস্ত্র ও পুলিশসহ আমাদের ক্যাম্পে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এরপর আমরা মংলা পোর্টে নেভাল পার্টি পাঠাই। তারা তিনটি জাহাজ ধ্বংস করে আমাদের ক্যাম্পে চলে আসে। তখন প্রায়ই গানবোটের মাধ্যমে আক্রমণ হতো। আমরা ৫/৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে একটি বিশেষ স্থানে রেখে নির্দেশ দিলাম যে, গানবোট দেখলেই গুলি করবে যেন তারা মনে করে সে স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প অবস্থিত। পরবর্তীকালে তারা ঐ স্থানে বার বার আক্রমণ করে গোলাগুলি করে চলে যেত। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ক্ষতি তারা করতে পারে নাই। পরবর্তীতে আমরা পিরোজপুর এবং বাগেরহাট অঞ্চলের অধিকাংশ থানায় আক্রমণ করি তবে তার পূর্বেই সেই সব থানার পুলিশ এবং রাজাকাররা আমাদের ক্যাম্পে এসে আত্মসমর্পণ করে । এর একটা কারণ ছিল সেটা হলো তুষখালী ক্যাম্প আক্রমণের পরে যে সব রাজাকারদের আমরা রাইফেলের পিন ভেঙ্গে ছেড়ে দিয়েছিলাম তারা ফেরত গিয়ে প্রচার করে যে, মুক্তিযোদ্ধারা কারো প্রতি অত্যাচার করে না বরং তারা বন্ধু মনোভাবাপন্ন । এই প্রচারে কাজ হয় এবং তারপরই পুলিশ এবং রাজাকাররা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করে। এই প্রচারের ফলে পিরোজপুর এবং বাগেরহাট থেকে অনেক রাজাকাররা গোপনে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
হঠাৎ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধি স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে সবাই আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। ইতিমধ্যে আমরা একবার পিরোজপুরে মেজর জিয়াউদ্দিনের মায়ের সংগে দেখা করার জন্য রাত্রে সশস্ত্র অবস্থায় যাই এবং সবাইকেই সবার সংগে ভাল ব্যবহার করার জন্য বলি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন থানার দায়িত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণকরি । দোষীদের গ্রেফতার করে পুলিশে দেওয়ার জন্য আদেশ করি, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে নিতে না পারে সেভাবে নির্দেশ দেয়া হয়। আমাদের সুন্দরবনের দলে তিন থেকে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, আমাদের ইন্সাট্রাকশন ব্যতীত তাদের নিকট রক্ষিত কোন আর্মস বা অন্য কোন কিছু কারো কাছে হস্তান্তর করবে না। আমাদের যোগাযোগ ছিল ভারতের সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সালেকের সঙ্গে এবং তার নির্দেশ মতই আমরা যা করার তা করতাম।
এই অবস্থায় আমরা ৮ই ডিসেম্বর মেজর জিয়াউদ্দিন সহ পিরোজপুরের পাড়ের হাটে যাই। মেজর জিয়াউদ্দিন ১০/১৫ মিনিট ছিলেন। আমাকে উনি সমস্ত অবস্থা জেনে ২/৩ ঘন্টা পরে পিরোজপুরে আসতে বলেছিলেন। সেখানে আমাদের কমান্ডার খসরু, মোকাররম, লিয়াকত আলী বাদশা, বাতেন, মুনাম, সানু খোন্দকার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক জনসাধারন তাদের অবস্থা বর্ণনা করে। আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করি। মোসলেম মওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, রাজ্জাক, দুইজন চৌকিদারসহ আরও কয়েকজন কে কি অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা করে। ঐ সময়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ঐ দিন আমরা রাত্রে পিরোজপুরে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমরা সমস্ত অস্ত্র সারেন্ডার করি।
দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের ছেলে মাসুদ সাঈদী আমাকে তার পিতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার অনুরোধ করে বলেছেন যে, যা সত্য আমি যেন তাই বলি ট্রাইব্যুনালে গিয়ে। তাই এখানে এসে সাক্ষ্য দিলাম। আমি সাক্ষ্য দিতে এসে একটিও মিথ্যা কথা বলিনি। যদি সাঈদী সাহেব কোন অন্যায় কাজ করতেন তাহলে আমি কমান্ডার লোকজন তখন আমার নিকট তা বলতো।
জবানবন্দী শেষে শামসুল আলম তালুকদারকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।
জেরা :
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে এমন দুয়েকটি রাজনৈতিক দলের নাম বলতে পারবেন তো?
উত্তর : মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম সহ অনেক দল ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পরেও আপনি ভাসানী ন্যাপে ছিলেন?
উত্তর : জিয়াউর রহমানের সময়ে ভাসানী ন্যাপ তার সঙ্গে মিটিং করে নিজেদের দলকে সাসপেন্ড করে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে তৈরি করে।
প্রশ্ন : আপনারা যখন ফ্রন্টে যোগ দেন তখন আপনাদের পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন মশিউর রহমান জাদু মিয়া।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানী যখন পার্টির প্রধান ছিলেন তখন এই যাদু মিয়া পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন।
উত্তর : মশিউর রহমান যাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধের পরে কারাগারে আটক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার কারনে।
উত্তর : আটক ছিলেন জানি তবে কি করনে তা জানা নেই।
প্রশ্ন : ভাসানী ন্যাপের পরে রাজনীতিতে ছিলেন?
উত্তর : জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে আমি বি,এন,পি কে যোগদান করি।
উত্তর : কখন?
উত্তর : ১৯৭৯ সালে আমি বিএনপিতে যোগদান করি।
প্রশ্ন : বিএনপিতে কি ছিলেন আপনি?
উত্তর : বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর বাগেরহাট জেলা সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই।
উত্তর : এখনো আছেন রাজনীতিতে?
উত্তর : এখন নিরব। শরীর খারাপ তাই নিরব আছি।
প্রশ্ন : আপনি বিএনপিতে থাকা অবস্থায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন?
উত্তর : হ্যা। সাংগঠনিক কারনে মামলা করেছিলাম এবং প্রেস কনফারেন্সও করেছিলাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধকালীন আপনার কোন অফিসিয়াল রেকর্ডপত্র পাওয়া যাবে?
উত্তর : সেসময় কোন অফিসিয়াল রেকর্ডপত্র ছিলনা।
প্রশ্ন : আপনার একাধিক স্ত্রী আছে।
উত্তর : বর্তমানে আমার দুজন স্ত্রী আছে।
প্রশ্ন : আপনার এক স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তিনি কততম?
উত্তর : ২য় স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে জমিজমা সংক্রান্ত একটি মামলা করেছিল।
প্রশ্ন : আপনার ওই স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে বাগেরহাট থানায় মামলা নং ২৭ তারিখ ১৭-০৭-২০০৯ ইং ধারা ১১(গ) জি,আর ৩৩৮/০৯, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নং ১৯/২০১০ দায়ের করেছিল।
উত্তর : হ্যা। আমার ঐ স্ত্রীর নাম রেহেনা তালুকদার।
প্রশ্ন : তিনি কি এখনো আপনার স্ত্রী আছেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনার বিরুদ্ধে চাাঁদবাজির মামলা হয়।
উত্তর : হ্যা, চাাঁদাবাজি, মাছ লুট ঘের লুটের মামলা হয়।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম স্ত্রীর নাম নাসিমা।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার সাথে বর্তমানে আপনার সম্পর্ক কি ?
উত্তর : তালাক হয়েছে।
প্রশ্ন : মেজর (অব) জিয়া উদ্দিনের বই সম্পর্কে জানা আছে?
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : তার সাথে পারেরহাট আসা বিষয়ে আপনি যে বর্ননা দিয়েছেন তার সাথে জিয়অ উদ্দিনের বইয়ের বর্ননার মিল নেই।
উত্তর : একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন লোকের বর্ননা ভিন্ন হবে। আমি জানি মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন। আমি পাড়ের হাটে জিয়াউদ্দিন সাহেবের সাথে যাওয়ার সমস্ত ঘটানর বর্ণনা আমার জবানবন্দীতে দিয়েছি তাহা জিয়াউদ্দিন সাহেবের বইয়ে সেভাবে নাও থাকতে পারে।
প্রশ্ন : ভাসানী ন্যাপের ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি ধারা ছিল।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মশিউর রহমান যাদু মিয়া সাহেব মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের ধারার নেতা ছিল,
উত্তর : হিস্টরি পিটিস ইটসেলফ। মশিউর রহমান সাহেব ভারতে গেলেন যুদ্ধের জন্য। পরে তিনি প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এলেন ভারত থেকে। (এরপর তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাম দলের মধ্যে বিভক্তি এবং ভিন্ন পলিসি বিষয়ে বর্ননা করেন। )
প্রশ্ন : ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি জামাত একজোট হয়ে রাজনীতি করছে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : পারেরহাটের যে রাজাকারদের নাম আপনি বলেছেন এবং যাদের নাম মনে নেই বলেছেন তারা কি পালিয়ে গিয়েছিল>
উত্তর : যারা লুটপাট অত্যাচার করেছে তারা কি পালিয়ে না গিয়ে সামনে ঘুরে বেড়াবে তখন?
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যেসব দল ও মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদের পুনর্বাসানের যাদু মিয়া এবং আপনার ভূমিকা ছিল।
উত্তর : কোশ্চেন ডাজ নট এরাইজ এট অল।
প্রশ্ন : বিএনপি জামায়াতের জোট থাকায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকান্ড জানা থাকা সত্ত্বেও আপনি তা গোপন করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে।
উত্তর : আপনার সাথে আমি একমত নই।
জেরা শেষ হলে শামসুল আলম তালুকদার ট্রাইব্যুনালের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষী দিতে আসার চারদিন আগে আমার বাসায় গিয়ে পুলিশ হাজির হয়। আমি এ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিলাম। ট্রাইব্যুনালের একটি নৈতিক দায়িত্ব আছে আমার নিরাপত্তার বিষয়ে। আমি নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা করছি। আমার যাতে কোন সমস্যা না হয় সেটি দয়া করে দেখবেন।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আইন আছে। আসামী পক্ষের আইনজীবীরা চাইলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আজ রাষ্ট্রপক্ষে সৈয়দ হায়দার আলী ছাড়া চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সুলতাম মাহমুদ সিমন উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আল আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মনজুর আহমদ আনসারী সাক্ষী পরিচালনা করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন