মেহেদী হাসান, ১৬/১২/২০১৩
নানাবিধ কারনে আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে আলোচিত ছিল আবদুল কাদের মোল্লা মামলা। ফাঁসির পর তো বটেই ফাঁসির আগেও আরো একবার গোটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এ মামলা। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার মাত্র দেড়ঘন্টা আগে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করার ঘটনা এ মামলার ইতিহাসে যোগ করেছে আরো একটি স্মরনীয় অধ্যায়।
গভীর রাতে দাফন
১২ ডিসেম্বর বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হল আবদুল কাদের মোল্লার । সকালে রিভিউ আবেদন খারিজের পর রাতেই কার্যকর করা হলো তার ফাঁসি। কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁসি সম্পন্নের পর রাত সোয়া এগারটায় পুলিশ, বিজিবি ও এপিবিএন সদস্যরা ১৫টি গাড়িযোগে কাদের মোল্লার লাশ নিয়ে রওয়ানা হয় ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। লাশ পৌছার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কবর খুড়ে রাখে। রাত তিনটায় আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌছার পর গভির রাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয় জানাজা নামাজ। লাশ নিয়ে যাতে কোন ভিন্ন পরিস্থিতির অবতারনা না হয় সেজন্য রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে জানাজার পরপরই আইনশঙ্খলা বাহিনী লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। ফাঁসির পর লাশ নিয়ে রওয়ানার খবর পেয়েই রাতের শীত উপেক্ষা করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন ছুটতে থাকে আমিরাবাদের দিকে। কিন্তু সমস্ত রাস্তায় পুলিশ প্রহরা বসিয়ে তাদের আটকে দেয়া হয়।
আরো একটি স্মরনীয় অধ্যায়
সরকারের নির্দেশে ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয় ওই দিন। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। দেশের এবং বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক ভিড় করেছে আলোচিত এ ফাঁসর খবর সংগ্রহের জন্য। এদিকে ফাঁসির যখন এ আয়োজন প্রায় সম্মন্ন তখন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা হন্যে হয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসভবনের দিকে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত এবং রিভিউ আবেদন নিয়ে। ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। এর মাধ্যমে আরো একবার বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষন করে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি।
বুধবার গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এরপরই সরকার পক্ষ থেকে ঘোষনা করা হয় ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাঁধা নেই এবং যেকোন সময়ই তা করা হবে। অপরদিকে আসামী পক্ষ দাবি করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবেনা। কারণ কোর্টের আদেশে ফাঁসি স্থগিত রয়েছে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি। তাই কোর্ট থেকে কোন নির্দেশনা সেখানে না গেলে তারা ফাঁসি কার্যকর করতে পারবেনা।
তবে সব বিতর্ক শেষ হয়ে যায় যখন খবর বের হয় বিকেল ৩টার পরে রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠানো হয়েছে সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস থেকে। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় রাতেই কার্যকর হচ্ছে ফাঁসি।
যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদন্ড
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আবদুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ ১৭ সেপ্টেম্বর এ রায় ঘোষনা করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলো। রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ট্রাইব্যুনাল একটি অভিযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছিল। কিন্তু আপিল খালাস দেয়া সে অভিযোগটিতেও যাবজ্জীবন সাজাসহ ছয়টি অভিযোগেই তাকে সাজা দিয়েছে।
পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে (৪ : ১) আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অর্থাৎ চারজন বিচারপতি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং একজন বিচারপতি (বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা) মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এ অভিযোগটি হলো মিরপুরে কালাপানি লেনে হজরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। এটি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নম্বর অভিযোগ।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে চার নম্বর অভিযোগ (কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকাণ্ড) থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে খালাস দেয়া এ অভিযোগটিতে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া অপর যে চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাজা দিয়েছিল তা বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ :
গত ৫ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়টি মোট ৭৯০ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ২২৭ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ৩১০ পৃষ্ঠা লিখেছেন।
৫ অভিযোগে খালাস দিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা
বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা আপিল বিভাগের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে ৫টিতেই খালাস দিয়েছেন । একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখেছেন এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি আপিল বেঞ্চের অপর বিচারপতিদের সাথে ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১ নং অভিযোগ যথা মিরপুরে পল্লব হত্যার দায়ে ১৫ বছর জেল দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। অপরদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন তার রায়ে। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল অন্যায়ভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ২ নং অভিযোগ তথা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর দণ্ড দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে । বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্ব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৩ নং অভিযোগ যথা সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বিভাগের চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আসামীকে খালাস দিয়েছেন অভিযোগ থেকে।
চার নং অভিযোগ যথা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগ এ অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ট্রাইব্যুনালের দেয়া খালাস রায় বহাল রেখেছেন; অর্থাৎ তিনিও খালাস দিলেন।
৫ নং অভিযোগ যথা মিরপুর আলুবদি হত্যাকান্ডের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়ে লিখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে উপস্থিত ছিল এবং এ গনহত্যায় কোন সহযোগিতা করেছে এ মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। ট্রাইব্যুনাল ভুল করেছে এ সাজা দিয়ে।
মিরপুরে হযরত আলী পরিবারের হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চা সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ ট্রাইব্যুনালের এ রায় বহাল রাখেন।
আলোচিত ঘটনাবহুল একটি মামলা
নানা কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বে একটি আলোচিত ও ঘটনাবহুল মামলা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আবদুল কাদের মোল্লার মামলাটি। এ মামলাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার কারনে বারবার বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয় মামলাটি। ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উত্থান হয় হেফাজতে ইসলাম এবং শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় অপারেশন শাপলা পর্যন্ত। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, আবদুল কাদের মোল্লা মামলা এবং এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। শাহবাগের ধারাবাহিকতায় অপারেশন শাপলা এবং এর পরে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারের ধরাশয়ী হওয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু তথা আবদুল কাদের মোল্লা ইস্যু তাই বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ভোটের বাক্স নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে। এটি ছাড়াও আইনি গুরুত্বের কারণে এ মামলা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি আলোচিত ঘটনা হিসেবে স্থান করে নেবে ভবিষ্যতে। কারণ এই বিচারের রায় হয়ে যাওয়ার পর আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচারিক আদালতের সাজা বাড়িয়ে আসামীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা অতীতে এ দেশে কখনো হয়নি বলে জানিয়েছে আসামিপক্ষ।
চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীন সাজার রায় দেয়া হয়। এ রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের দাবি আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয় সরকারপক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে। আইন সংশোধনের পর সরকার আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।
ট্রাইব্যুনাল আইনে আগের বিধান ছিল আসামিপক্ষ সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামির সাজা হলে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল না। আসামিকে খালাস দেয়া হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে উভয় পক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দেয়া হয় এবং আইনের সংশোধনীকে ২০০৯ সাল থেকে কার্যকারিতা প্রদান করা হয়।
আইনের সংশোধনীর কারণে আবদুল কাদের মোল্লার আপিল শুনানি শেষ পর্যন্ত অ্যামিকাস কিউরি পর্যন্ত গড়ায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে তা আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না জানতে চেয়ে ২০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। এরা হলেন, সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রবীণ আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি।
সবশেষ ফাঁসি কার্যকর করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা এবং ফাঁসির মঞ্চে তোলার মাত্র দেড়ঘন্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কর্তৃক ফাঁসি কার্যকর স্থগিতাদেশের মাধ্যমে আরো একবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।
আসামিপক্ষের অভিযোগ
আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক রায়ের পর বলেছেন, বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্র্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এবং বিচার বিভাগের জন্য এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।
আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরপরই সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক লিখিত বক্তব্যে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু এটি একটি ভুল রায়। আমরা এ রায়ে সংুব্ধ। আমরা বিস্মিত। আমরা মনে করিÑ এ রায় ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
বিচারিক আদালত যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেননি সেখানে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ড প্রদান বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তা ছাড়া স্কাইপ কেলেঙ্কারির পরও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান আইনের শাসনের পরিপন্থী। আমাদের সমাপনী বক্তব্যে আমরা বলেছিলামÑ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আজ তাকে শুধু দোষী সাব্যস্তই করা হয়নি, মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছে। বিচারের ইতিহাসে এটি একটি দুঃখজনক অধ্যায়।
অভিযোগ : ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়
রাষ্ট্রপক্ষ আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে সাজা দেয়। এসব অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ কর্তৃক সাজা বিষয়ে নি¤েœ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।
১ নম্বর অভিযোগ পল্লব হত্যা :
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যার ঘটনা। অভিযোগে বলা হয়, আবদুল কাদের মোল্লার নির্দেশে তার সাঙ্গোপাঙ্গ মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নওয়াবপুর থেকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ হত্যা ঘটনার সাথে আবদুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে এ হত্যা ঘটনার অভিযোগের ভিত্তি হলো শোনা কথা। ট্রাইব্যুনালের হাতে যা এসেছে তাতে দেখা যায় আবদুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটন করেছেন এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত নন।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে পল্লব হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
২ নম্বর অভিযোগ কবি মেহের হত্যাকাণ্ড :
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আবদুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুননিসা, তার মা ও দুই ভাইকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে নিজে প্রবেশ করেননি হত্যাকাণ্ডের সময়। হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লা নিজে সশরীরে অংশগ্রহণও করেননি। তবে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছেন এবং এ কাজে তার নৈতিক সমর্থন ছিল। কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমাণ নেই।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তি হলো সাক্ষীদের শোনা কথা।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ সাংবাদিক আবু তালেব হত্যা :
১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর আবদুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আল বদর সদস্য, রাজাকার, দুষ্কৃতকারী এবং বিহারিদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরের সাজা দিয়েছে। এ ঘটনায়ও আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে দু’জন সাক্ষীর শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৪ নম্বর অভিযোগ ঘাটারচরে শতাধিক মানুষ হত্যা :
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর আবদুল কাদের মোল্লা ৬০-৭০ জন রাজাকার বাহিনী সদস্য নিয়ে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এবং ভাওয়াল দু’টি গ্রামে হামলা চালিয়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক গ্রামবাসীকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় তিনজন সাক্ষী হাজির করে। এদের একজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করা হয়। বাকি দু’জন শোনা সাক্ষী। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আবদুল মজিদ পালওয়ান সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ঘটনার দিন যখন গ্রামের উত্তর দিক থেকে গুলি আসতে শুরু করে তখন তিনি যে দিক থেকে গুলি আসে সে দিকে এগিয়ে যান।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনায় বলা হয়েছে একবার সাক্ষী বলেছেন সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে অপরাধীরা চলে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন দুষ্কৃতকারীদের সাথে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ছিল আবদুল কাদের মোল্লা। আবার আরেক জায়গায় বলেছেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে দেখেছেন। একবার বলেছেন ঘটনা ঘটার পর জানতে পেরেছেন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ছিল কাদের মোল্লা আবার আরেকবার বলেছেন তিনি তাকে রাইফেল হাতে দেখেছেন।
ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেছেন কোনটা সত্য? তা ছাড়া এ ধরনের অভিযানের সময় যখন সাধারণত মানুষ জীবন বাঁচাতে পেছনের দিকে পালিয়ে যায় তখন সাক্ষী বলছেন তিনি গুলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এটিও একটি অস্বাভাবিক ঘটনা এবং আপিল বিভাগের শুনানির সময়ও এ সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
আপিল বিভাগের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হলেও আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।
৫ নম্বর অভিযোগ আলুবদি হত্যাকাণ্ড :
এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৪টার সময় আবদুল কাদের মোল্লার সদস্যরা (মেম্বারস) পাকিস্তান আর্মি সাথে নিয়ে মিরপুর পল্লবীর আলুবদি গ্রামে নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণের অংশ হিসেবে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং এতে ৩৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৬ নম্বর অভিযোগ হজরত আলী হত্যাকাণ্ড :
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় হজরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। রায়ে বলা হয়েছে, কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে দড়ি
তখন আমার ছাত্র জীবন। একিদন মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কুতুব শহীদের শাহাদাতের ঘটনা বর্ননা করছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। বর্ননার সময় এক পর্যায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম আমার গলায় হাত রেখে বলেছিলেন একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে এ দড়ি।
১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকালে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে তার আইনজীবী দেখা করতে গেলে তাদেরকে তিনি এ ঘটনার কথা বলেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানান আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাত করেন সেদিন। আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা বিষয়ে তাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, সাক্ষাতের সময় কাদের মোল্লা সাহেব আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছেন, আমার জীবনে যদি সত্যিকার অর্থে এরকম কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে তাহলে তোমরা সেদিন আমার চোখে পানি দেখতে পাবেনা। আমার মাথা সারা জীবন উচু ছিল উচু থাকবে। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে যদি আমার জীবন দিতে হয় তবে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে। মানব জীবনে শাহাদাতের মৃত্যুর চেয়ে উত্তম এবং বড় আর কিছুই হতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে মহান আল্লাহর কাছে এটাই ছিল আমার সারা জীবনের কামনা। মহান আল্লাহ যদি আমার সে প্রার্থনা কবুল করে থাকেন তবে এর চেয়ে বড় কোন পাওয়া আর আমার জন্য হতে পারেনা। এটা হলে আমি সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হব। মিশরসহ বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদসহ সমকালীন আরো অনেকের ইতিহাস আমার সামনে আছে। মৃত্যু নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। এমন মৃত্যু আনন্দের, সৌভাগ্যের।
১০ ডিসেম্বর রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে সেদিন তার ফাঁসি কার্যকর না হলেও আইনজীবীদের সাথে এটাই ছিল তার শেষ সাক্ষাৎ। ১২ ডিসেম্ব রাতে ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনে আইনজীবীরা রাত সাড়ে আটটায় আবার জেলখানায় ছুটে যান তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেয় আর সম্ভব নয়। ফাঁসির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তবে কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের সাথে তাকে ওইদিন রাতে আবারো শেষ সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়।
আসল মোমেনা নকল মোমেনা
আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে । আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রকৃত মোমেনা বেগমকে হাজির না করে তার স্থলে অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবার।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে গত ৯ ডিসেম্বর জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান।
রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে তাকে হাজির করা হয়নি। তার স্থলে অপর মহিলাকে হাজির করা হয়েছে মোমেনা বেগম সাজিয়ে। তিনি বলেন, জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবির সন্ধান পাওয়ার পরই তারা সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সানোয়ার জাহান দাবি করেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পেরেছি যে, একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেই মোমেনা বেগম আদৌ আদালতে সাক্ষী দিতেই আসনেনি। ক্যামেরা ট্রাইয়ালের নামে গোপন বিচারে ভুয়া একজন মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে আদালতে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে । কিন্তু পরবর্তীতে জল্লাদখানায় সংরক্ষিত প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি দেখে আমাদের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মোমেনা বেগম প্রকৃত মোমেনা বেগম ছিলেন না।
আবদুল কাদের মোল্লাকে দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গত ৫ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চা আদালত বা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ হযরত আলী পরিবারের হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর।
হযরত আলী পরিবার হত্যা ঘটনায় বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা বেগম।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় একমাত্র সাক্ষী হিসেবে মোমেনা বেগমকে হাজির করে এবং ১৭ জুলাই ২০১২। ওইদিনই তার জবানবন্দী এবং জেরা সম্পন্ন হয়।
ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে অর্থাৎ রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মোমেনা বেগমকে লম্বা নেবাকসহ কালো বোরখা পড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামী পক্ষের আইনজীবী জেরার সময় চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এই মোমেনা আসল মোমেনা বেগম নয়। কিন্তু তখন তারা এর পক্ষে কোন ডকুমেন্ট হাজির করতে পারেনি।
রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় ট্রাইব্যুনালে শুধুমাত্রা রাষ্ট্রপক্ষের এবং আসামী পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। বিচারক, কোর্ট রুমে উপস্থিত অন্যান্য স্টাফ এবং আইনজীবীরা সাক্ষী মোমেনা বেগমের চেহারা দেখেছেন। অন্য কারোর সামনে রাষ্ট্রপক্ষ তার চেহারা উন্মুক্ত করেনি তখন। আসামী পক্ষের দাবি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবি তারা কয়েকদিন আগে সংগ্রহ করতে পেরেছেন । আসামী পক্ষের যেসব আইনজীবী মোমেনা বেগমের সাক্ষ্যের সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চিত করেছেন যে, ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগম নামে যাকে হাজির করা হয়েছে সে প্রকৃতপক্ষে আসল মোমেনা বেগম নয়। রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় আসামী পক্ষের তিনজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, একরামুল হক এবং সাজ্জাদ আলী চৌধুরী। তারা সবাই বলেছেন ট্রাইব্যুনালে তারা যে মোমেনা বেগমকে দেখেছেন সে মোমোনে বেগমের সাথে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কোন মিল নেই।
সানোয়ার জাহান দাবি করেন এইরকম একজন ভুয়া স্বাক্ষীর তিন জায়গায় প্রদত্ত তিনরকমের বক্তব্যে পরে শুধুমাত্র তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আমরা মনে করি তা নজিরবীহিন এবং এটি একটি ভুল রায়। আমরা মনে করি সংবিধান প্রদত্ত রিভিউ এর সুযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়গুলি তুলে ধরার মাধ্যমে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পাল্টে যাওয়া সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কথা : মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্প হাউজে এনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাতকার, বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষাতকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে।
যে হযরত আলী লস্করের পরিবার হত্যা ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আপিল বিভাগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন আকারে সংরক্ষন করা হয়েছে। এখানে হযরত আলী পরিবার হত্যার ঘটনার বিবরন রয়েছে। মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে বা প্রতিবেদনে লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান। ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেননা। ফলে একমাত্র তিনিই বেঁচে যান গোটা পরিবারের এ হত্যাকান্ড থেকে। মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর সাথে তার একটি ছবিও সেখানে সংযুক্ত রয়েছে।
হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০০৭ তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ যাদঘুর কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন তৈরি করে এবং এখনো ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষিত রয়েছে তা নিম্নরূপ।
ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারিরা হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভেতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।
কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগম যা বলেছেন : ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনা) মোমেন বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে। ফলে সেসময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে বর্ননা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে আসলেন এবং বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরো বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।
মোমেনা জানায় সে এবং তার ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খাটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়। এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যাণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।
ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সাক্ষী মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে সম্পূর্ণ বিপরতী তথ্য : ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী তথ্য রয়েছে।
যেমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী মোমেনা বেগম তার জবানবন্দীতে বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং তার বোনকে ধর্ষনের ঘটনা দেখেছেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও ধর্ষনের শিকার হন এবং পরে অচেতন হয়ে পড়েন। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে মোমেনা বেগম নামে যার জবানবন্দী রক্ষিত রয়েছে তাতে দেখা যায় মোমেনা বেগম ঘটনার দুই দিন আগে তার শশুর বাড়িতে চলে যান । ফলে তিনি প্রানে বেঁচে যান এ ঘটনা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের প্রতিবেদনে দেখা যায় মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের হত্যার জন্য বিহারীদের দায়ী করেছেন। সেখানে কাদের মোল্লার কোন নাম গন্ধই নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগম নামে যাকে হাজির করা হয়েছে সে তার জবানবন্দীতে বলছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে এবং নেতৃত্বে এ হত্যাকান্ড হয়েছে।
আসামী পক্ষের পরিবার এবং আইনজীবীরা বলছেন আমরা দাবি করছি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে সে-ই হল আসল মোমেনা বেগম। রাষ্ট্রপক্ষ মোমেনা বেগম নামে যাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছিল বোরখা পড়িয়ে তার রেকর্ড ট্রাইব্যুনাল কক্ষের সিসি ক্যামেরায় ধারন করা রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে হাজির করা মোমেনার সাথে জল্লাদখানায় রক্ষিত মোমেনার ছবি তুলনা করলেই প্রমান হবে আমাদের দাবি সত্য না মিথ্যা।
আপিল বিভাগেও আসামিপক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর বরাতে তৈরি করা প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছিল। শুনানির সময় আদালত এ রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাদুঘরের যে লোক এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাকে হাজির করা হয়েছিল কি না জানতে চেয়েছেন। জবাবে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন আমারা এ রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি। এখন এ রিপোর্ট সত্য কি না তা প্রমাণের দায়িত্ব কোর্টের। কোর্ট এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন। কোর্ট জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তলব করতে পারেন এবং তাদের কাছে জানতে চাইতে পারেন যে, তাদের কাছে এ ধরনের রিপোর্ট আছে কি না। তাহলেই বের হয়ে যাবে আমাদের রিপোর্ট সত্য কি মিথ্যা।
কিন্তু আদালত মন্তব্য করেছেন মোমেনা বেগম কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেটাই আসল বিবেচ্য। শেষ পর্যন্ত এ ঘটনাতেই আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হজরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিল ছয় নম্বর অভিযোগ । হজরত আলী লস্কর আওয়ামী লীগ করার কারণে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে আবদুল কাদের মোল্লা বিহারি এবং আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
কাদের মোল্লার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আবদুল কাদের মোল্লার জন্ম ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করার পর ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদের মোল্লা প্রাইমারি ও জুনিয়র স্কুল পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনস্টিটিট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)-এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সায়েন্স)-এ ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এ কোর্সে। এরপর তিনি ১৯৭৭ সালে এডুকেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
আবদুল কাদের মোল্লা স্কুলজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া বাইশরশি শিবসুন্দরী অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতা এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও চাকরি করেছেন তিনি।
আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮২-৮৩ সালে পরপর দুইবার ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (ডিউজে) সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৭ একই শাখার আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতের নেতৃত্বপর্যায়ের ভূমিকা পালনের সময় তিনি বিভিন্নপর্যায়ে জোটগত রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতার ভূমিকাও পালন করেছেন।
১৯৬৪ সালে আইউববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারণে তাকে চারবার কারাবরণ করতে হয়েছে।
আবদুল কাদের মোল্লা চার মেয়ে ও দুই পুত্রসন্তানের জনক।
আবদুল কাদের মোল্লা মামলায় আসামিপক্ষে প্রধান আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মনির, সাজ্জাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ।
নানাবিধ কারনে আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে আলোচিত ছিল আবদুল কাদের মোল্লা মামলা। ফাঁসির পর তো বটেই ফাঁসির আগেও আরো একবার গোটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এ মামলা। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার মাত্র দেড়ঘন্টা আগে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করার ঘটনা এ মামলার ইতিহাসে যোগ করেছে আরো একটি স্মরনীয় অধ্যায়।
গভীর রাতে দাফন
১২ ডিসেম্বর বৃহষ্পতিবার দিবাগত রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হল আবদুল কাদের মোল্লার । সকালে রিভিউ আবেদন খারিজের পর রাতেই কার্যকর করা হলো তার ফাঁসি। কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ফাঁসি সম্পন্নের পর রাত সোয়া এগারটায় পুলিশ, বিজিবি ও এপিবিএন সদস্যরা ১৫টি গাড়িযোগে কাদের মোল্লার লাশ নিয়ে রওয়ানা হয় ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। লাশ পৌছার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কবর খুড়ে রাখে। রাত তিনটায় আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌছার পর গভির রাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে এবং তাদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয় জানাজা নামাজ। লাশ নিয়ে যাতে কোন ভিন্ন পরিস্থিতির অবতারনা না হয় সেজন্য রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে জানাজার পরপরই আইনশঙ্খলা বাহিনী লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে। ফাঁসির পর লাশ নিয়ে রওয়ানার খবর পেয়েই রাতের শীত উপেক্ষা করে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন ছুটতে থাকে আমিরাবাদের দিকে। কিন্তু সমস্ত রাস্তায় পুলিশ প্রহরা বসিয়ে তাদের আটকে দেয়া হয়।
আরো একটি স্মরনীয় অধ্যায়
সরকারের নির্দেশে ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয় ওই দিন। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। দেশের এবং বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক ভিড় করেছে আলোচিত এ ফাঁসর খবর সংগ্রহের জন্য। এদিকে ফাঁসির যখন এ আয়োজন প্রায় সম্মন্ন তখন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা হন্যে হয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসভবনের দিকে ফাঁসি কার্যকর স্থগিত এবং রিভিউ আবেদন নিয়ে। ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। এর মাধ্যমে আরো একবার বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষন করে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি।
বুধবার গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এরপরই সরকার পক্ষ থেকে ঘোষনা করা হয় ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাঁধা নেই এবং যেকোন সময়ই তা করা হবে। অপরদিকে আসামী পক্ষ দাবি করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে পারবেনা। কারণ কোর্টের আদেশে ফাঁসি স্থগিত রয়েছে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি। তাই কোর্ট থেকে কোন নির্দেশনা সেখানে না গেলে তারা ফাঁসি কার্যকর করতে পারবেনা।
তবে সব বিতর্ক শেষ হয়ে যায় যখন খবর বের হয় বিকেল ৩টার পরে রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠানো হয়েছে সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রার অফিস থেকে। তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় রাতেই কার্যকর হচ্ছে ফাঁসি।
যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদন্ড
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আবদুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ ১৭ সেপ্টেম্বর এ রায় ঘোষনা করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দিলো। রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ট্রাইব্যুনাল একটি অভিযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছিল। কিন্তু আপিল খালাস দেয়া সে অভিযোগটিতেও যাবজ্জীবন সাজাসহ ছয়টি অভিযোগেই তাকে সাজা দিয়েছে।
পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে (৪ : ১) আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অর্থাৎ চারজন বিচারপতি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং একজন বিচারপতি (বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা) মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। এ অভিযোগটি হলো মিরপুরে কালাপানি লেনে হজরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। এটি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নম্বর অভিযোগ।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে চার নম্বর অভিযোগ (কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকাণ্ড) থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে খালাস দেয়া এ অভিযোগটিতে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া অপর যে চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল সাজা দিয়েছিল তা বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের রায়ে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ :
গত ৫ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়টি মোট ৭৯০ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ২২৭ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ৩১০ পৃষ্ঠা লিখেছেন।
৫ অভিযোগে খালাস দিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা
বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা আপিল বিভাগের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে ৫টিতেই খালাস দিয়েছেন । একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখেছেন এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি আপিল বেঞ্চের অপর বিচারপতিদের সাথে ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১ নং অভিযোগ যথা মিরপুরে পল্লব হত্যার দায়ে ১৫ বছর জেল দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। অপরদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন তার রায়ে। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল অন্যায়ভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ২ নং অভিযোগ তথা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর দণ্ড দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে । বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্ব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৩ নং অভিযোগ যথা সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বিভাগের চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আসামীকে খালাস দিয়েছেন অভিযোগ থেকে।
চার নং অভিযোগ যথা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগ এ অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ট্রাইব্যুনালের দেয়া খালাস রায় বহাল রেখেছেন; অর্থাৎ তিনিও খালাস দিলেন।
৫ নং অভিযোগ যথা মিরপুর আলুবদি হত্যাকান্ডের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়ে লিখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে উপস্থিত ছিল এবং এ গনহত্যায় কোন সহযোগিতা করেছে এ মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। ট্রাইব্যুনাল ভুল করেছে এ সাজা দিয়ে।
মিরপুরে হযরত আলী পরিবারের হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চা সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ ট্রাইব্যুনালের এ রায় বহাল রাখেন।
আলোচিত ঘটনাবহুল একটি মামলা
নানা কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বে একটি আলোচিত ও ঘটনাবহুল মামলা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে আবদুল কাদের মোল্লার মামলাটি। এ মামলাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনার কারনে বারবার বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয় মামলাটি। ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে উত্থান হয় হেফাজতে ইসলাম এবং শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় অপারেশন শাপলা পর্যন্ত। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, আবদুল কাদের মোল্লা মামলা এবং এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। শাহবাগের ধারাবাহিকতায় অপারেশন শাপলা এবং এর পরে অনুষ্ঠিত চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারের ধরাশয়ী হওয়ার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু তথা আবদুল কাদের মোল্লা ইস্যু তাই বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ভোটের বাক্স নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে। এটি ছাড়াও আইনি গুরুত্বের কারণে এ মামলা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি আলোচিত ঘটনা হিসেবে স্থান করে নেবে ভবিষ্যতে। কারণ এই বিচারের রায় হয়ে যাওয়ার পর আইন সংশোধন করা হয়েছে। বিচারিক আদালতের সাজা বাড়িয়ে আসামীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যা অতীতে এ দেশে কখনো হয়নি বলে জানিয়েছে আসামিপক্ষ।
চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীন সাজার রায় দেয়া হয়। এ রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের দাবি আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয় সরকারপক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে। আইন সংশোধনের পর সরকার আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।
ট্রাইব্যুনাল আইনে আগের বিধান ছিল আসামিপক্ষ সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আসামির সাজা হলে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল না। আসামিকে খালাস দেয়া হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের জন্য আপিলের বিধান ছিল। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইন সংশোধন করে উভয় পক্ষকে আপিলের সমান সুযোগ দেয়া হয় এবং আইনের সংশোধনীকে ২০০৯ সাল থেকে কার্যকারিতা প্রদান করা হয়।
আইনের সংশোধনীর কারণে আবদুল কাদের মোল্লার আপিল শুনানি শেষ পর্যন্ত অ্যামিকাস কিউরি পর্যন্ত গড়ায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে তা আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না জানতে চেয়ে ২০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের সাতজন বিশিষ্ট আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয় আপিল বিভাগ। এরা হলেন, সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রবীণ আইনবিদ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি।
সবশেষ ফাঁসি কার্যকর করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা এবং ফাঁসির মঞ্চে তোলার মাত্র দেড়ঘন্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কর্তৃক ফাঁসি কার্যকর স্থগিতাদেশের মাধ্যমে আরো একবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।
আসামিপক্ষের অভিযোগ
আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক রায়ের পর বলেছেন, বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্র্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এবং বিচার বিভাগের জন্য এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।
আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরপরই সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক লিখিত বক্তব্যে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু এটি একটি ভুল রায়। আমরা এ রায়ে সংুব্ধ। আমরা বিস্মিত। আমরা মনে করিÑ এ রায় ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
বিচারিক আদালত যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেননি সেখানে প্রথমবারের মতো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মৃত্যুদণ্ড প্রদান বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তা ছাড়া স্কাইপ কেলেঙ্কারির পরও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান আইনের শাসনের পরিপন্থী। আমাদের সমাপনী বক্তব্যে আমরা বলেছিলামÑ যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, আজ তাকে শুধু দোষী সাব্যস্তই করা হয়নি, মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হয়েছে। বিচারের ইতিহাসে এটি একটি দুঃখজনক অধ্যায়।
অভিযোগ : ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়
রাষ্ট্রপক্ষ আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে তাকে সাজা দেয়। এসব অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল ও আপিল বিভাগ কর্তৃক সাজা বিষয়ে নি¤েœ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।
১ নম্বর অভিযোগ পল্লব হত্যা :
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যার ঘটনা। অভিযোগে বলা হয়, আবদুল কাদের মোল্লার নির্দেশে তার সাঙ্গোপাঙ্গ মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নওয়াবপুর থেকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ হত্যা ঘটনার সাথে আবদুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে উল্লেখ করা হয়েছে এ হত্যা ঘটনার অভিযোগের ভিত্তি হলো শোনা কথা। ট্রাইব্যুনালের হাতে যা এসেছে তাতে দেখা যায় আবদুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ সংঘটন করেছেন এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত নন।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে পল্লব হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
২ নম্বর অভিযোগ কবি মেহের হত্যাকাণ্ড :
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আবদুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুননিসা, তার মা ও দুই ভাইকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে দণ্ডিত করে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে নিজে প্রবেশ করেননি হত্যাকাণ্ডের সময়। হত্যাকাণ্ডে কাদের মোল্লা নিজে সশরীরে অংশগ্রহণও করেননি। তবে যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছেন এবং এ কাজে তার নৈতিক সমর্থন ছিল। কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমাণ নেই।
রায়ে আরো বলা হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তি হলো সাক্ষীদের শোনা কথা।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত ১৫ বছরের সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ সাংবাদিক আবু তালেব হত্যা :
১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছার পর আবদুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আল বদর সদস্য, রাজাকার, দুষ্কৃতকারী এবং বিহারিদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে ১৫ বছরের সাজা দিয়েছে। এ ঘটনায়ও আবদুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে দু’জন সাক্ষীর শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৪ নম্বর অভিযোগ ঘাটারচরে শতাধিক মানুষ হত্যা :
১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর আবদুল কাদের মোল্লা ৬০-৭০ জন রাজাকার বাহিনী সদস্য নিয়ে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এবং ভাওয়াল দু’টি গ্রামে হামলা চালিয়ে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক গ্রামবাসীকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় তিনজন সাক্ষী হাজির করে। এদের একজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করা হয়। বাকি দু’জন শোনা সাক্ষী। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আবদুল মজিদ পালওয়ান সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ঘটনার দিন যখন গ্রামের উত্তর দিক থেকে গুলি আসতে শুরু করে তখন তিনি যে দিক থেকে গুলি আসে সে দিকে এগিয়ে যান।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনায় বলা হয়েছে একবার সাক্ষী বলেছেন সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে অপরাধীরা চলে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন দুষ্কৃতকারীদের সাথে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ছিল আবদুল কাদের মোল্লা। আবার আরেক জায়গায় বলেছেন, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে দেখেছেন। একবার বলেছেন ঘটনা ঘটার পর জানতে পেরেছেন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটা ছিল কাদের মোল্লা আবার আরেকবার বলেছেন তিনি তাকে রাইফেল হাতে দেখেছেন।
ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেছেন কোনটা সত্য? তা ছাড়া এ ধরনের অভিযানের সময় যখন সাধারণত মানুষ জীবন বাঁচাতে পেছনের দিকে পালিয়ে যায় তখন সাক্ষী বলছেন তিনি গুলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এটিও একটি অস্বাভাবিক ঘটনা এবং আপিল বিভাগের শুনানির সময়ও এ সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
আপিল বিভাগের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হলেও আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে।
৫ নম্বর অভিযোগ আলুবদি হত্যাকাণ্ড :
এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৪টার সময় আবদুল কাদের মোল্লার সদস্যরা (মেম্বারস) পাকিস্তান আর্মি সাথে নিয়ে মিরপুর পল্লবীর আলুবদি গ্রামে নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণের অংশ হিসেবে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং এতে ৩৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়।
ট্রাইব্যুনালের রায় : ট্রাইব্যুনালের রায়ে এ অভিযোগে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৬ নম্বর অভিযোগ হজরত আলী হত্যাকাণ্ড :
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় হজরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে।
ট্রাইব্যুনালের রায় : এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। রায়ে বলা হয়েছে, কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে।
আপিল বিভাগের রায় : আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে দড়ি
তখন আমার ছাত্র জীবন। একিদন মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কুতুব শহীদের শাহাদাতের ঘটনা বর্ননা করছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। বর্ননার সময় এক পর্যায়ে অধ্যাপক গোলাম আযম আমার গলায় হাত রেখে বলেছিলেন একদিন তোমার গলায়ও উঠতে পারে এ দড়ি।
১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকালে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে তার আইনজীবী দেখা করতে গেলে তাদেরকে তিনি এ ঘটনার কথা বলেন।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জানান আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাত করেন সেদিন। আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাৎ এবং কথাবার্তা বিষয়ে তাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, সাক্ষাতের সময় কাদের মোল্লা সাহেব আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলেছেন, আমার জীবনে যদি সত্যিকার অর্থে এরকম কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে তাহলে তোমরা সেদিন আমার চোখে পানি দেখতে পাবেনা। আমার মাথা সারা জীবন উচু ছিল উচু থাকবে। আমি জানি আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার সাথে সত্যের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে যদি আমার জীবন দিতে হয় তবে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে। মানব জীবনে শাহাদাতের মৃত্যুর চেয়ে উত্তম এবং বড় আর কিছুই হতে পারেনা। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে মহান আল্লাহর কাছে এটাই ছিল আমার সারা জীবনের কামনা। মহান আল্লাহ যদি আমার সে প্রার্থনা কবুল করে থাকেন তবে এর চেয়ে বড় কোন পাওয়া আর আমার জন্য হতে পারেনা। এটা হলে আমি সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হব। মিশরসহ বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদসহ সমকালীন আরো অনেকের ইতিহাস আমার সামনে আছে। মৃত্যু নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। এমন মৃত্যু আনন্দের, সৌভাগ্যের।
১০ ডিসেম্বর রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। তবে সেদিন তার ফাঁসি কার্যকর না হলেও আইনজীবীদের সাথে এটাই ছিল তার শেষ সাক্ষাৎ। ১২ ডিসেম্ব রাতে ফাঁসি কার্যকরের খবর শুনে আইনজীবীরা রাত সাড়ে আটটায় আবার জেলখানায় ছুটে যান তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেয় আর সম্ভব নয়। ফাঁসির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তবে কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের সাথে তাকে ওইদিন রাতে আবারো শেষ সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়।
আসল মোমেনা নকল মোমেনা
আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে । আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী প্রকৃত মোমেনা বেগমকে হাজির না করে তার স্থলে অপর এক মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে হাজির করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ করেছে আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবার।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে গত ৯ ডিসেম্বর জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন আব্দুল কাদের মোল্লার স্ত্রী সানোয়ার জাহান।
রাষ্ট্রপক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষী নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত আছে। মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে তাকে হাজির করা হয়নি। তার স্থলে অপর মহিলাকে হাজির করা হয়েছে মোমেনা বেগম সাজিয়ে। তিনি বলেন, জল্লাদখানা যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবির সন্ধান পাওয়ার পরই তারা সাক্ষী নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে সানোয়ার জাহান দাবি করেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পেরেছি যে, একমাত্র সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেই মোমেনা বেগম আদৌ আদালতে সাক্ষী দিতেই আসনেনি। ক্যামেরা ট্রাইয়ালের নামে গোপন বিচারে ভুয়া একজন মহিলাকে মোমেনা বেগম সাজিয়ে আদালতে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে । কিন্তু পরবর্তীতে জল্লাদখানায় সংরক্ষিত প্রকৃত মোমেনা বেগমের ছবি দেখে আমাদের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেছেন আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া মোমেনা বেগম প্রকৃত মোমেনা বেগম ছিলেন না।
আবদুল কাদের মোল্লাকে দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ গত ৫ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা। দেশের সর্বোচ্চা আদালত বা বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ হযরত আলী পরিবারের হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর।
হযরত আলী পরিবার হত্যা ঘটনায় বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা বেগম।
রাষ্ট্রপক্ষ এ ঘটনায় একমাত্র সাক্ষী হিসেবে মোমেনা বেগমকে হাজির করে এবং ১৭ জুলাই ২০১২। ওইদিনই তার জবানবন্দী এবং জেরা সম্পন্ন হয়।
ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে অর্থাৎ রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মোমেনা বেগমকে লম্বা নেবাকসহ কালো বোরখা পড়িয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। আসামী পক্ষের আইনজীবী জেরার সময় চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এই মোমেনা আসল মোমেনা বেগম নয়। কিন্তু তখন তারা এর পক্ষে কোন ডকুমেন্ট হাজির করতে পারেনি।
রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় ট্রাইব্যুনালে শুধুমাত্রা রাষ্ট্রপক্ষের এবং আসামী পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। বিচারক, কোর্ট রুমে উপস্থিত অন্যান্য স্টাফ এবং আইনজীবীরা সাক্ষী মোমেনা বেগমের চেহারা দেখেছেন। অন্য কারোর সামনে রাষ্ট্রপক্ষ তার চেহারা উন্মুক্ত করেনি তখন। আসামী পক্ষের দাবি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের ছবি তারা কয়েকদিন আগে সংগ্রহ করতে পেরেছেন । আসামী পক্ষের যেসব আইনজীবী মোমেনা বেগমের সাক্ষ্যের সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চিত করেছেন যে, ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগম নামে যাকে হাজির করা হয়েছে সে প্রকৃতপক্ষে আসল মোমেনা বেগম নয়। রুদ্ধদ্বার বিচার কক্ষে মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য গ্রহনের সময় আসামী পক্ষের তিনজন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। এরা হলেন, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, একরামুল হক এবং সাজ্জাদ আলী চৌধুরী। তারা সবাই বলেছেন ট্রাইব্যুনালে তারা যে মোমেনা বেগমকে দেখেছেন সে মোমোনে বেগমের সাথে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কোন মিল নেই।
সানোয়ার জাহান দাবি করেন এইরকম একজন ভুয়া স্বাক্ষীর তিন জায়গায় প্রদত্ত তিনরকমের বক্তব্যে পরে শুধুমাত্র তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই আমার স্বামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। আমরা মনে করি তা নজিরবীহিন এবং এটি একটি ভুল রায়। আমরা মনে করি সংবিধান প্রদত্ত রিভিউ এর সুযোগ পেলে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়গুলি তুলে ধরার মাধ্যমে আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পাল্টে যাওয়া সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের কথা : মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্প হাউজে এনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাতকার, বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ। শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষাতকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে।
যে হযরত আলী লস্করের পরিবার হত্যা ঘটনায় আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আপিল বিভাগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা লিপিবদ্ধ করে প্রতিবেদন আকারে সংরক্ষন করা হয়েছে। এখানে হযরত আলী পরিবার হত্যার ঘটনার বিবরন রয়েছে। মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে বা প্রতিবেদনে লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান। ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেননা। ফলে একমাত্র তিনিই বেঁচে যান গোটা পরিবারের এ হত্যাকান্ড থেকে। মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর সাথে তার একটি ছবিও সেখানে সংযুক্ত রয়েছে।
হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০০৭ তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ যাদঘুর কর্তৃপক্ষ যে প্রতিবেদন তৈরি করে এবং এখনো ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষিত রয়েছে তা নিম্নরূপ।
ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারিরা হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভেতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।
কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”
ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগম যা বলেছেন : ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনা) মোমেন বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে। ফলে সেসময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে বর্ননা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে আসলেন এবং বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরো বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।
মোমেনা জানায় সে এবং তার ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খাটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়। এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যাণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।
ট্রাইব্যুনালে হাজির করা সাক্ষী মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে সম্পূর্ণ বিপরতী তথ্য : ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী হিসেবে হাজির করা মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী তথ্য রয়েছে।
যেমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী মোমেনা বেগম তার জবানবন্দীতে বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং তার বোনকে ধর্ষনের ঘটনা দেখেছেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও ধর্ষনের শিকার হন এবং পরে অচেতন হয়ে পড়েন। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে মোমেনা বেগম নামে যার জবানবন্দী রক্ষিত রয়েছে তাতে দেখা যায় মোমেনা বেগম ঘটনার দুই দিন আগে তার শশুর বাড়িতে চলে যান । ফলে তিনি প্রানে বেঁচে যান এ ঘটনা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের প্রতিবেদনে দেখা যায় মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের হত্যার জন্য বিহারীদের দায়ী করেছেন। সেখানে কাদের মোল্লার কোন নাম গন্ধই নেই। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগম নামে যাকে হাজির করা হয়েছে সে তার জবানবন্দীতে বলছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে এবং নেতৃত্বে এ হত্যাকান্ড হয়েছে।
আসামী পক্ষের পরিবার এবং আইনজীবীরা বলছেন আমরা দাবি করছি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে যে মোমেনা বেগমের ছবি রয়েছে সে-ই হল আসল মোমেনা বেগম। রাষ্ট্রপক্ষ মোমেনা বেগম নামে যাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছিল বোরখা পড়িয়ে তার রেকর্ড ট্রাইব্যুনাল কক্ষের সিসি ক্যামেরায় ধারন করা রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে হাজির করা মোমেনার সাথে জল্লাদখানায় রক্ষিত মোমেনার ছবি তুলনা করলেই প্রমান হবে আমাদের দাবি সত্য না মিথ্যা।
আপিল বিভাগেও আসামিপক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর বরাতে তৈরি করা প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছিল। শুনানির সময় আদালত এ রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাদুঘরের যে লোক এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাকে হাজির করা হয়েছিল কি না জানতে চেয়েছেন। জবাবে আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন আমারা এ রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি। এখন এ রিপোর্ট সত্য কি না তা প্রমাণের দায়িত্ব কোর্টের। কোর্ট এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারেন। কোর্ট জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তলব করতে পারেন এবং তাদের কাছে জানতে চাইতে পারেন যে, তাদের কাছে এ ধরনের রিপোর্ট আছে কি না। তাহলেই বের হয়ে যাবে আমাদের রিপোর্ট সত্য কি মিথ্যা।
কিন্তু আদালত মন্তব্য করেছেন মোমেনা বেগম কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেটাই আসল বিবেচ্য। শেষ পর্যন্ত এ ঘটনাতেই আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হজরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিল ছয় নম্বর অভিযোগ । হজরত আলী লস্কর আওয়ামী লীগ করার কারণে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে আবদুল কাদের মোল্লা বিহারি এবং আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
কাদের মোল্লার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আবদুল কাদের মোল্লার জন্ম ১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলায়। তিনি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করার পর ১৯৬৬ সালে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদের মোল্লা প্রাইমারি ও জুনিয়র স্কুল পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালে।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর (ইনস্টিটিট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ)-এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সায়েন্স)-এ ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এ কোর্সে। এরপর তিনি ১৯৭৭ সালে এডুকেশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
আবদুল কাদের মোল্লা স্কুলজীবনে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।
বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া বাইশরশি শিবসুন্দরী অ্যাকাডেমিতে শিক্ষকতা এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও চাকরি করেছেন তিনি।
আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮২-৮৩ সালে পরপর দুইবার ঢাকা ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (ডিউজে) সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবনে আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৭ একই শাখার আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতের নেতৃত্বপর্যায়ের ভূমিকা পালনের সময় তিনি বিভিন্নপর্যায়ে জোটগত রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে মধ্যস্থতার ভূমিকাও পালন করেছেন।
১৯৬৪ সালে আইউববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারণে তাকে চারবার কারাবরণ করতে হয়েছে।
আবদুল কাদের মোল্লা চার মেয়ে ও দুই পুত্রসন্তানের জনক।
আবদুল কাদের মোল্লা মামলায় আসামিপক্ষে প্রধান আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মনির, সাজ্জাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন