মেহেদী হাসান, ২১/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বৃহষ্পতিবার রাতে যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর করার লক্ষ্যে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ দুপুর ১২ টায় কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রস্তুতি। সন্ধ্যার পর আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার সাথে। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল জানিয়েছেন আমরা দেখা করার আবেদন জানিয়েছিলাম। আমাদের ছয়/সাতজনকে দেখা করার অনুমিত দিয়েছেন। আমরা যাচ্ছি দেখা করার জন্য। কারাগারের সামনে থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন ৬টা ২২ মিনিটের সমায় আব্দুল কাদের মোল্লার আত্মীয় স্বজন কারাগারে প্রবেশ করেন এবং সাতটার দিকে তারা বের হন।
সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রার শামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিকাল তিনটার পরে আমরা রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তপক্ষ, রাষ্ট্রাপক্ষ, আসামীপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠিয়েছি।
সকালে কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজের সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে পড়ে আজ (বৃহষ্পতিবার) রাতেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষনা করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাঁধা নেই।
সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত আটটায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরিভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়। তার আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়া হয় মহড়া। ছয় জন জল্লাদকে কারাগারে আনা হয়। ওইদিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দুজন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষনা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু কার্যকরের মাত্র দেড়ঘন্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে আবারো আলোচনায় চলে আসে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রীম কোর্টের প্রতি। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদন এর শুনানী। এছাড়া আসামী পক্ষ স্থগিতাদেশ এর মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবেনা এ বিষয়ে বুধবার শুনানী শেষে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত। বৃহষ্পিতবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদন এর ওপর শুনানী। শুনানী শেষে ১২টা ৭ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতি ঘোষনা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এরপরপরই সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ভবনে সরকার এবং সরকার বিরোধী আইনজীবীদের শুরু হয় মিছিল পাল্টা মিছিল এবং পরষ্পর বিরোধী স্লোগান। দীর্ঘক্ষন ধরে চলে মিছিল স্লোগান, ধস্তাধস্তি এবং হট্টগোল। রিভিউ আবেদন শুনানী উপলক্ষে গতকাল হাইকোর্ট অঙ্গনে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আজ সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, আজ রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্ততি উপলক্ষে জেলখানার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আশপাশের বিভিন্ন রাস্তায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাধারন লোকজন এবং যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ন বিভিন্ন মোড়ে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী ছাড়া কাউকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছেনা। প্রবেশের পূর্বে তাদের তল্লাসী করা হচ্ছে। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ফাঁসি কার্যকরের খবর উপলক্ষে সন্ধ্যার আগে থেকেই দেশের এবং বিদেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক ভিড় করেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে।
গত মঙ্গলবার আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরা হলেন, শাহজাহান ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মুল জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়ার নেতৃত্বে তারা রোববার এবং সোমবার ফাঁসির মঞ্চে আব্দুল কাদের মোলার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে। ফাঁসির রোপ ম্যানিলা রশি পিচ্ছিল করতে দেয়া হয়েছে তেল। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত চলে ফাঁসির মঞ্চ ধোঁয়া মোছার কাজ।
রিভিউ আবেদন শুনানী :
রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ আবেদন করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।” তাই রিভিউ আবেদন চলতে পারেনা বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন।
অপর দিকে আসামী পক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলীর-সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত কোন রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
তাছাড়া আজ কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে জেল প্রয়োগেরও আবেদন করে আসামী পক্ষ। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন কাদের মোল্লাকে জেলকোডের বিধান মেনেই এতদিন জেলে রাখা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করা হবেন?
এর বিরোধীতা করে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানীতে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দন্ডাদেশ বাস্তবায়ন সরকার করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। জেল কোড প্রয়োগ করার দরকার নেই।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক :
এদিকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে জরুরী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে প্রায় দুই ঘন্টারও অধিক সময় ধরে চলা বৈঠকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরে আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর আগে একই বিষয় নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। এসব বৈঠকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া এবং আইন শৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও রায় কার্যকরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) ও জেলকোড সহ ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।
আজকের বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুক, অ্যাটর্নী জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং দুই মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
পরপর দুই দিনের বৈঠকে কেউ কোনো কথা না বললেও গতকাল বৈঠকের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে জেল কোড এপ্লিকেবল না। কাদের মোল্লার প্রাণ ভিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি (কাদের মোল্লা) এর কোনো সুযোগ নেননি। এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় জেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর রিভিউ আবেদনের আগেই রায় কার্যকরের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
মামলার বিবরন :
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।
রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদন্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। এ অভিযোগটি হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা । এটি ছিল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নং অভিযোগ। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল চার নং অভিযোগ কেরানীগঞ্জ ঘাটার চর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত অপর একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
ছয়টি অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লার সাজা হয় ৪:১ ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগের ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত এবং ভিন্ন রায় প্রদান করেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে পাঁচটি অভিযোগ থেকে তিনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণরুপে খালাস দেন। এগুলো হল মিপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা, মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা, মিরপুরে সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যা, কেরানীগঞ্জে ঘাটারচর গনহত্যা হত্যা এবং মিরপুর আলুবদি গনহত্যা। একটি অভিযোগ যথা মিরপুরে হযরত আলী পরিবার হত্যার অভিযোগে তিনি ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগষ্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামী পক্ষে ছয় জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করে।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
গত ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানীর জন্য। ১ এাপ্রিল থেকে শুনানী শুরু হয়।
কাদের মোল্লার পরিচিতি :
মুক্তিযুদ্ধের পুরো দশকই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুতিকাগারখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটান আবদুল কাদের মোল্লা। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই বেলাভ’মিতে সকলের কাছে তিনি অত্যন্ত মেধাবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন তিনি। শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত উদয়ন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৭৪ সালে।
১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর) থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সাইন্স) সম্পন্ন করেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন এডুকেশনাল এডমিনিস্ট্রেশন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র।
১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আমিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৬৪ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন জেলার বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী থেকে। ওই সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৬ সালে এইচএসসি ও ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদের মোল্লা প্রাইমারী এবং জুনিয়র স্কুল পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে।
কিছু সময়ের জন্য প্রিয় শিক্ষায়তন শিব সুন্দরী একাডেমীতে গেলেও শিক্ষকতা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো তিনি কাটিয়েছেন উদয়ন স্কুল এবং তৎকালীন রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে (বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ)। সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করে এ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকুরি করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও। সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকার সময়ে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে পরপর দুই বার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদের মোল্লা।
জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৭ সালে একই শাখার আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতের রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জোটগত রাজনীতিতে বরাবরই তার অবস্থান ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভ’মিকায়। এরশাদবিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই লিয়াজোঁ রক্ষাকারী দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে আইউব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারনে তাকে চারবার কারাবরন করতে হয়। ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কারা অভ্যন্তরেই কাটান তিনি। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি চার কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। বৃহষ্পতিবার রাতে যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর করার লক্ষ্যে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং সরকারি সূত্রে জানা গেছে।
সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ দুপুর ১২ টায় কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় মৃত্যুদন্ড কার্যকরের প্রস্তুতি। সন্ধ্যার পর আব্দুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার সাথে। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল জানিয়েছেন আমরা দেখা করার আবেদন জানিয়েছিলাম। আমাদের ছয়/সাতজনকে দেখা করার অনুমিত দিয়েছেন। আমরা যাচ্ছি দেখা করার জন্য। কারাগারের সামনে থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন ৬টা ২২ মিনিটের সমায় আব্দুল কাদের মোল্লার আত্মীয় স্বজন কারাগারে প্রবেশ করেন এবং সাতটার দিকে তারা বের হন।
সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রার শামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিকাল তিনটার পরে আমরা রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তপক্ষ, রাষ্ট্রাপক্ষ, আসামীপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠিয়েছি।
সকালে কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজের সাথে সাথেই খবর ছড়িয়ে পড়ে আজ (বৃহষ্পতিবার) রাতেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষনা করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাঁধা নেই।
সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত আটটায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরিভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়। তার আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়া হয় মহড়া। ছয় জন জল্লাদকে কারাগারে আনা হয়। ওইদিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দুজন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষনা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু কার্যকরের মাত্র দেড়ঘন্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে আবারো আলোচনায় চলে আসে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রীম কোর্টের প্রতি। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদন এর শুনানী। এছাড়া আসামী পক্ষ স্থগিতাদেশ এর মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবেনা এ বিষয়ে বুধবার শুনানী শেষে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত। বৃহষ্পিতবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদন এর ওপর শুনানী। শুনানী শেষে ১২টা ৭ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতি ঘোষনা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এরপরপরই সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন ভবনে সরকার এবং সরকার বিরোধী আইনজীবীদের শুরু হয় মিছিল পাল্টা মিছিল এবং পরষ্পর বিরোধী স্লোগান। দীর্ঘক্ষন ধরে চলে মিছিল স্লোগান, ধস্তাধস্তি এবং হট্টগোল। রিভিউ আবেদন শুনানী উপলক্ষে গতকাল হাইকোর্ট অঙ্গনে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আজ সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, আজ রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্ততি উপলক্ষে জেলখানার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আশপাশের বিভিন্ন রাস্তায় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাধারন লোকজন এবং যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ন বিভিন্ন মোড়ে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী ছাড়া কাউকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছেনা। প্রবেশের পূর্বে তাদের তল্লাসী করা হচ্ছে। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ফাঁসি কার্যকরের খবর উপলক্ষে সন্ধ্যার আগে থেকেই দেশের এবং বিদেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক ভিড় করেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে।
গত মঙ্গলবার আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরা হলেন, শাহজাহান ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মুল জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়ার নেতৃত্বে তারা রোববার এবং সোমবার ফাঁসির মঞ্চে আব্দুল কাদের মোলার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে। ফাঁসির রোপ ম্যানিলা রশি পিচ্ছিল করতে দেয়া হয়েছে তেল। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত চলে ফাঁসির মঞ্চ ধোঁয়া মোছার কাজ।
রিভিউ আবেদন শুনানী :
রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শুনানীতে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ আবেদন করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।” তাই রিভিউ আবেদন চলতে পারেনা বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন।
অপর দিকে আসামী পক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলীর-সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত কোন রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
তাছাড়া আজ কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে জেল প্রয়োগেরও আবেদন করে আসামী পক্ষ। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন কাদের মোল্লাকে জেলকোডের বিধান মেনেই এতদিন জেলে রাখা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করা হবেন?
এর বিরোধীতা করে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানীতে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দন্ডাদেশ বাস্তবায়ন সরকার করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। জেল কোড প্রয়োগ করার দরকার নেই।
সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক :
এদিকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে জরুরী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে প্রায় দুই ঘন্টারও অধিক সময় ধরে চলা বৈঠকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরে আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর আগে একই বিষয় নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। এসব বৈঠকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া এবং আইন শৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও রায় কার্যকরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) ও জেলকোড সহ ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।
আজকের বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুক, অ্যাটর্নী জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং দুই মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
পরপর দুই দিনের বৈঠকে কেউ কোনো কথা না বললেও গতকাল বৈঠকের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে জেল কোড এপ্লিকেবল না। কাদের মোল্লার প্রাণ ভিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি (কাদের মোল্লা) এর কোনো সুযোগ নেননি। এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় জেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর রিভিউ আবেদনের আগেই রায় কার্যকরের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
মামলার বিবরন :
১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয় কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।
রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদন্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। এ অভিযোগটি হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা । এটি ছিল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নং অভিযোগ। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল চার নং অভিযোগ কেরানীগঞ্জ ঘাটার চর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছিল। আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত অপর একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
ছয়টি অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লার সাজা হয় ৪:১ ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগের ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত এবং ভিন্ন রায় প্রদান করেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে পাঁচটি অভিযোগ থেকে তিনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণরুপে খালাস দেন। এগুলো হল মিপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা, মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা, মিরপুরে সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যা, কেরানীগঞ্জে ঘাটারচর গনহত্যা হত্যা এবং মিরপুর আলুবদি গনহত্যা। একটি অভিযোগ যথা মিরপুরে হযরত আলী পরিবার হত্যার অভিযোগে তিনি ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগষ্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের গত ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামী পক্ষে ছয় জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করে।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
গত ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানীর জন্য। ১ এাপ্রিল থেকে শুনানী শুরু হয়।
কাদের মোল্লার পরিচিতি :
মুক্তিযুদ্ধের পুরো দশকই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুতিকাগারখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটান আবদুল কাদের মোল্লা। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই বেলাভ’মিতে সকলের কাছে তিনি অত্যন্ত মেধাবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন তিনি। শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত উদয়ন বিদ্যালয়ে যোগদান করেন ১৯৭৪ সালে।
১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর) থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সাইন্স) সম্পন্ন করেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন এডুকেশনাল এডমিনিস্ট্রেশন থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র।
১৯৪৮ সালে ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আমিরাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৬৪ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন জেলার বাইশরশি শিব সুন্দরী একাডেমী থেকে। ওই সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৬ সালে এইচএসসি ও ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাস করেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদের মোল্লা প্রাইমারী এবং জুনিয়র স্কুল পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে।
কিছু সময়ের জন্য প্রিয় শিক্ষায়তন শিব সুন্দরী একাডেমীতে গেলেও শিক্ষকতা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলো তিনি কাটিয়েছেন উদয়ন স্কুল এবং তৎকালীন রাইফেলস পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে (বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ)। সিনিয়র শিক্ষক পদে যোগদান করে এ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকুরি করেছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনেও। সাংবাদিকতায় যুক্ত থাকার সময়ে ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে পরপর দুই বার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল কাদের মোল্লা।
জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৭ সালে একই শাখার আমির নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। জামায়াতের রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জোটগত রাজনীতিতে বরাবরই তার অবস্থান ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভ’মিকায়। এরশাদবিরোধি আন্দোলন থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই লিয়াজোঁ রক্ষাকারী দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে আইউব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কারনে তাকে চারবার কারাবরন করতে হয়। ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কারা অভ্যন্তরেই কাটান তিনি। ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি চার কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন