মেহেদী হাসান, ৫/১২/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত এটর্নি জেনারেল এমকে রহমান আজ দুপুরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের কাছে রায় প্রকাশের ঘোষনা দেন। এরপর বিকালে সুপ্রীম কোর্টের ওয়েব সাইটে রায় প্রকাশ করা হয়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্ট এর আপিল বিভাগ আবেদন শুনানী শেষে আব্দুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন। ওইদিন মৃত্যুদন্ডের সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনার আড়াই মাসের মাথায় আজ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। । আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আলোচিত এ মামলার আপিল শুনানী গ্রহণ শেষে রায় ঘোষনা করেন। আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় আপিল শুনানীর জন্য গঠিত আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পূর্ণ রায় লিখেছেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন রায়ে লিখেছেন তিন বিচারপতির লেখা রায় তিনি পড়েছেন এবং বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে তিনি একমত পোষন করেন। একইভাবে রায়ের প্রতি একমত পোষন করেছেন অপর বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পূর্নাঙ্গ রায়টি মোট ৭৯০ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ২২৭ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ৩১০ পৃষ্ঠা লিখেছেন।
১৭ সেপ্টেম্বরের সংক্ষিপ্ত রায়ে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে (৪ : ১) আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। অর্থাৎ চার জন বিচারপতি মৃত্যুদন্ডের পক্ষে এবং একজন বিচারপতি মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে রয়েছেন। ভিন্নমত পোষনকারী বিচারপতির নাম সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ ছিলনা। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দেখা গেছে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা অপর চার বিচারপতির সাথে একমত পোষণ করেননি। সাজার বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদন্ড দেয়। একটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।
আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এ অভিযোগটি হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা । এটি ছিল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নং অভিযোগ।
এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর চারটি অভিযোগে প্রদত্ত সাজা বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগের রায়ে। অপর দিকে একটি অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে তাকে খালাস দিলেও আপিল বিভাগ ওই অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দেন। অর্থাৎ ছয়টি অভিযোগেই আপিল বিভাগ সাজা দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় লিখেছেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে ছয়টি অভিযোগেই সাজা দেয়া হয় ৪ অনুপাত ১ ভিত্তিতে।
ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে মোট পাঁচটি অভিযোগে দন্ডিত করে। এর মধ্যে চারটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল যে অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয় সেটি বহাল রেখেছেন তিনি। ফলে তিনি মোট পাঁচটি অভিযোগ থেকে খালাস দিলেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে।
রায় :
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার অংশের রায়ে বলেছেন, সরকারের দায়ের করা আপিল রনযোগ্য। চতুর্থ অভিযোগ থেকে কাদের মোল্লাকে অব্যাহতির ট্রাইব্যুনালের আদেশ বাতিল করে এই অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হল। ৬ ন¤¦র অভিযোগে ট্রাইবুনালের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ বাতিল করে তার বদলে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হল। অপরদিকে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লার দায়ের করা আপিল খারিজ করা হল।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয় নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান বিষয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, অপরাধের মাত্রা যদি কাদের মোল্লার সাজার ভিত্তি ধরা হয়, তাহলে অভিযোগ ন¤¦র ৬ এর েেত্র কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ দন্ড প্রদানের েেত্র উপযুক্ততম মামলা যেখানে হত্যা এবং ধর্ষণ ছিল বর্বরোচিত, ঠান্ডা মাথার ও নিষ্ঠুরতম। এই অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় এই মামলায় যদি ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ সাজা না দেয় তাহলে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার মতো অন্য কোন মামলা পাওয়া কঠিন হবে।
ট্রাইবুনাল রায়ে বলেছেন আদালতের কাজে বিশ্বাসযোগ্য একমাত্র সাীও সাজা দেওয়ার েেত্র যথেষ্ট। এেেত্র ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাীকে ৬ ন¤¦র অভিযোগ প্রমানের েেত্র একমাত্র সাী বিবেচনায় এনেছে। ট্রাইব্যুনাল এেেত্র ভুল করেছে। কারণ, রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাী ছাড়াও রাষ্ট্রপরে ১, ২, ৪, ৭ এবং ৯ ন¤¦র পারিপার্শ্বিক সাী রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাীকে সমর্থন করেছে। তাদের স্যা ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে কাদের মোল্লার এই অপরাধ সংঘটনের অসৎউদ্দেশ্য সমর্থণ করে। তার এই অসৎউদ্দেশ্য থেকে এটি পরিস্কার যে, কাদের মোল্লা এ অপরাধ করেছিল।
রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাীর স্যাপ্রমান থেকে এই উপসংহারে পৌছান যায় যে, এটি এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী হত্যাকান্ডের ঘটনা ছিল যার জন্য যাবজ্জীবন সাজা অপর্যাপ্ত, মৃত্যুদন্ডই যার উপযুক্ত সাজা।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার রায়ে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার অপরাধসমূহ এতই পৈশাচিক যে, মৃত্যুদন্ড ছাড়া পৃথিবীর ফৌজদারি আইনের পুস্তকে নির্ধারিত কোন সাজাই তার জন্য পর্যাপ্ত নয়। একমাত্র মৃত্যুদন্ডই তার প্রাপ্য।
৫ অভিযোগে খালাস দিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা
বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা আপিল বিভাগের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে ৫টিতেই খালাস দিয়েছেন । একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখেছেন এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি আপিল বেঞ্চের অপর বিচারপতিদের সাথে ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল আব্দুল কাদের মোল্লাকে । এছাড়া ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাজা প্রদান করা চারটি অভিযোগ থেকেও তিনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে তিনি পাঁচটি অভিযোগ থেকে খালাস দিলেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা ট্রাইব্যুনালের একটি রায় তিনি বহাল রাখলেন।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১ নং অভিযোগ যথা মিরপুরে পল্লব হত্যার দায়ে ১৫ বছর জেল দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। অপরদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন তার রায়ে। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল অন্যায়ভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ২ নং অভিযোগ তথা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর দণ্ড দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে । বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্ব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৩ নং অভিযোগ যথা সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বিভাগের চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আসামীকে খালাস দিয়েছেন অভিযোগ থেকে।
চার নং অভিযোগ যথা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগ এ অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ট্রাইব্যুনালের দেয়া খালাস রায় বহাল রেখেছেন।
৫ নং অভিযোগ যথা মিরপুর আলুবদি হত্যাকান্ডের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়ে লিখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে উপস্থিত ছিল এবং এ গনহত্যায় কোন সহযোগিতা করেছে এ মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। ট্রাইব্যুনাল ভুল করেছে এ সাজা দিয়ে।
মিরপুরে হযরত আলী পরিবারের হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চা সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ ট্রাইব্যুনালের এ রায় বহাল রাখেন।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত এটর্নি জেনারেল এমকে রহমান আজ দুপুরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের কাছে রায় প্রকাশের ঘোষনা দেন। এরপর বিকালে সুপ্রীম কোর্টের ওয়েব সাইটে রায় প্রকাশ করা হয়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীম কোর্ট এর আপিল বিভাগ আবেদন শুনানী শেষে আব্দুল কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন। ওইদিন মৃত্যুদন্ডের সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনার আড়াই মাসের মাথায় আজ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। । আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আলোচিত এ মামলার আপিল শুনানী গ্রহণ শেষে রায় ঘোষনা করেন। আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় আপিল শুনানীর জন্য গঠিত আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পূর্ণ রায় লিখেছেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন রায়ে লিখেছেন তিন বিচারপতির লেখা রায় তিনি পড়েছেন এবং বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে তিনি একমত পোষন করেন। একইভাবে রায়ের প্রতি একমত পোষন করেছেন অপর বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পূর্নাঙ্গ রায়টি মোট ৭৯০ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ২৫২ পৃষ্ঠা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ২২৭ পৃষ্ঠা এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ৩১০ পৃষ্ঠা লিখেছেন।
১৭ সেপ্টেম্বরের সংক্ষিপ্ত রায়ে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে (৪ : ১) আব্দুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। অর্থাৎ চার জন বিচারপতি মৃত্যুদন্ডের পক্ষে এবং একজন বিচারপতি মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে রয়েছেন। ভিন্নমত পোষনকারী বিচারপতির নাম সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ ছিলনা। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দেখা গেছে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা অপর চার বিচারপতির সাথে একমত পোষণ করেননি। সাজার বিষয়ে তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদন্ড দেয়। একটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।
আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। এ অভিযোগটি হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা । এটি ছিল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নং অভিযোগ।
এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর চারটি অভিযোগে প্রদত্ত সাজা বহাল রাখা হয় আপিল বিভাগের রায়ে। অপর দিকে একটি অভিযোগ থেকে ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে তাকে খালাস দিলেও আপিল বিভাগ ওই অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দেন। অর্থাৎ ছয়টি অভিযোগেই আপিল বিভাগ সাজা দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় লিখেছেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে ছয়টি অভিযোগেই সাজা দেয়া হয় ৪ অনুপাত ১ ভিত্তিতে।
ট্রাইব্যুনাল আব্দুল কাদের মোল্লাকে মোট পাঁচটি অভিযোগে দন্ডিত করে। এর মধ্যে চারটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা তার রায়ে। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল যে অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয় সেটি বহাল রেখেছেন তিনি। ফলে তিনি মোট পাঁচটি অভিযোগ থেকে খালাস দিলেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে।
রায় :
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার অংশের রায়ে বলেছেন, সরকারের দায়ের করা আপিল রনযোগ্য। চতুর্থ অভিযোগ থেকে কাদের মোল্লাকে অব্যাহতির ট্রাইব্যুনালের আদেশ বাতিল করে এই অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হল। ৬ ন¤¦র অভিযোগে ট্রাইবুনালের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ বাতিল করে তার বদলে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হল। অপরদিকে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে কাদের মোল্লার দায়ের করা আপিল খারিজ করা হল।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয় নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান বিষয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখেছেন, অপরাধের মাত্রা যদি কাদের মোল্লার সাজার ভিত্তি ধরা হয়, তাহলে অভিযোগ ন¤¦র ৬ এর েেত্র কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ দন্ড প্রদানের েেত্র উপযুক্ততম মামলা যেখানে হত্যা এবং ধর্ষণ ছিল বর্বরোচিত, ঠান্ডা মাথার ও নিষ্ঠুরতম। এই অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় এই মামলায় যদি ট্রাইব্যুনাল সর্বোচ্চ সাজা না দেয় তাহলে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার মতো অন্য কোন মামলা পাওয়া কঠিন হবে।
ট্রাইবুনাল রায়ে বলেছেন আদালতের কাজে বিশ্বাসযোগ্য একমাত্র সাীও সাজা দেওয়ার েেত্র যথেষ্ট। এেেত্র ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাীকে ৬ ন¤¦র অভিযোগ প্রমানের েেত্র একমাত্র সাী বিবেচনায় এনেছে। ট্রাইব্যুনাল এেেত্র ভুল করেছে। কারণ, রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাী ছাড়াও রাষ্ট্রপরে ১, ২, ৪, ৭ এবং ৯ ন¤¦র পারিপার্শ্বিক সাী রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাীকে সমর্থন করেছে। তাদের স্যা ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে কাদের মোল্লার এই অপরাধ সংঘটনের অসৎউদ্দেশ্য সমর্থণ করে। তার এই অসৎউদ্দেশ্য থেকে এটি পরিস্কার যে, কাদের মোল্লা এ অপরাধ করেছিল।
রাষ্ট্রপরে ৩ ন¤¦র সাীর স্যাপ্রমান থেকে এই উপসংহারে পৌছান যায় যে, এটি এমন একটি ব্যতিক্রমধর্মী হত্যাকান্ডের ঘটনা ছিল যার জন্য যাবজ্জীবন সাজা অপর্যাপ্ত, মৃত্যুদন্ডই যার উপযুক্ত সাজা।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী তার রায়ে বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার অপরাধসমূহ এতই পৈশাচিক যে, মৃত্যুদন্ড ছাড়া পৃথিবীর ফৌজদারি আইনের পুস্তকে নির্ধারিত কোন সাজাই তার জন্য পর্যাপ্ত নয়। একমাত্র মৃত্যুদন্ডই তার প্রাপ্য।
৫ অভিযোগে খালাস দিলেন বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা
বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা আপিল বিভাগের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে ৫টিতেই খালাস দিয়েছেন । একটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত যাবজ্জীবন সাজা বহাল রেখেছেন এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি আপিল বেঞ্চের অপর বিচারপতিদের সাথে ভিন্নমত পোষন করে ভিন্ন রায় দিয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগ এনেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে একটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছিল আব্দুল কাদের মোল্লাকে । এছাড়া ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাজা প্রদান করা চারটি অভিযোগ থেকেও তিনি আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে তিনি পাঁচটি অভিযোগ থেকে খালাস দিলেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা ট্রাইব্যুনালের একটি রায় তিনি বহাল রাখলেন।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে ১ নং অভিযোগ যথা মিরপুরে পল্লব হত্যার দায়ে ১৫ বছর জেল দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। অপরদিকে বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন তার রায়ে। তিনি বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষ এ অভিযোগ প্রমানে ব্যর্থ হয়েছে এবং ট্রাইব্যুনাল অন্যায়ভাবে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ২ নং অভিযোগ তথা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর দণ্ড দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগের রায়ে ট্রাইব্যুনালের এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে । বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্ব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৩ নং অভিযোগ যথা সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার অভিযোগে ১৫ বছর সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগেও আপিল বিভাগের চার বিচারপতির সাথে ভিন্নমত পোষন করে আসামীকে খালাস দিয়েছেন অভিযোগ থেকে।
চার নং অভিযোগ যথা কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর হত্যাকান্ডের অভিযোগ থেকে আব্দুল কাদের মোল্লাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। আপিল বিভাগ এ অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আব্দুল কাদের মোল্লাকে। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা ট্রাইব্যুনালের দেয়া খালাস রায় বহাল রেখেছেন।
৫ নং অভিযোগ যথা মিরপুর আলুবদি হত্যাকান্ডের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছে। আপিল বিভাগ এ রায় বহাল রেখেছেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ অভিযোগ থেকেও আব্দুল কাদের মোল্লাকে খালাস দিয়ে লিখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে উপস্থিত ছিল এবং এ গনহত্যায় কোন সহযোগিতা করেছে এ মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমান করতে পারেনি। ট্রাইব্যুনাল ভুল করেছে এ সাজা দিয়ে।
মিরপুরে হযরত আলী পরিবারের হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। আপিল বিভাগের রায়ে এ সাজা বাড়িয়ে সর্বোচ্চা সাজা মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন। কিন্তু বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা এ ট্রাইব্যুনালের এ রায় বহাল রাখেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন