মেহেদী হাসান, ১২/১২/২০১৩, বৃহষ্পতিবার দিবাগরত রাত ১২টা ৩৫ মিনিট
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
আজ সকালে রিভিউ আবেদন খারিজের পর রাতেই কার্যকর করা হলো তার ফাঁসি।
জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সব অনুরোধ এবং আপত্তি উপেক্ষা করে সরকার আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল।
রাত ১১টা ১৩ মিনিটের সময় আবদুল কাদের মোল্লার লাশ অ্যাম্বুলেন্সযোগে তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয় কড়া নিরাপত্তায় ব্যবস্থায়। এসময় কারাগার থেকে ১৪টি গাড়ির বহর বের হয়ে লাশবাহী গাড়ির সাথে। ফাঁসি কার্যকরের সময় কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশ এবং আশপাশের সব এলাকায় বিপুল সংখ্যক র্যাব, পুলিশ, বিজিবি এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়।
ফাঁসি কার্যকরের পর সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশঙ্খলা বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা প্রধান কারা ফটকের সামনে আসেন। এসময় বিপূল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেল গেটের দুই দিকে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়ান। লাশবাহী গাড়ি বের হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করেন তারা। ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন এসময় সাংবাদিকদের জানান মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ১০টা ১ মিনিট থেকে পরবর্তী ২০ মিনিট পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয় কাদের মোল্লার দেহ। মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এ মর্মে ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষার পর পাঁচজন জল্লাদ নামিয়ে আনে লাশ।
সূত্র জানায় এরপর পায়ের রগ কর্তনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে গোসল এবং কাফনের কাপড় পড়িয়ে স্বজনদের কাছে লাশ পৌছানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে রওয়ানা দেয়া হয়। শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঢামে ছ/৭১-০৬৫৪ নম্বরধারী অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ দুপুর ১২টায় কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি। রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পর সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে বৃহস্পতিবার রাতেই কার্যকর করা হবে ফাঁসি। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষণা করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো বাঁধা নেই। সন্ধ্যার পর আবদুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার সাথে। কাদের মোল্লা তার আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের সময় আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে অনুযায়ী রাত সাড়ে ৮টার দিকে আইনজীবীরা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য গেলে জেল কর্তৃপক্ষ সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেন ফাঁসির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তাই আর দেখা করার অনুমতি নেই। আইনজীবীদের কাছে উপস্থিত সাংবাদিকেরা এ কথা জানার পরই সবাই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রাতেই কার্যকর করা হবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড। গত মঙ্গলবার রাতে ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ বিষয়ে সরকার এবং জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হলেও গতকাল আগে থেকে কোনো কিছু গণমাধ্যম বা অন্য কাউকে জানায়নি জেল কর্তৃপক্ষ বা সরকারের অন্য কেউ। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মুনির, মতিউর রহমান আকন্দ ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন গিয়েছিলেন আবদুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাতের জন্য।
সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা আব্বুর সাথে দেখা করার আবেদন করেছিলাম। আমাদের ছয়-সাতজনকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। আমরা যাচ্ছি দেখা করার জন্য। কারাগারের সামনে থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন ৬টা ২২ মিনিটের সমায় আবদুল কাদের মোল্লার আত্মীয়স্বজন কারাগারে প্রবেশ করেন এবং ৭টার দিকে তারা বের হন। স্ত্রী সানোয়ার জাহান, ছেলে এবং মেয়েসহ ১০ জন নিকটাত্মীয় তার সাথে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে যান।
কারা ফটকের সামনে থেকে আমাদের প্রতিবেদক জানান, রাত ৮টা ৫৬ মিনিটের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল ইফতেখার আলম কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। একই সময় ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন ও কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন মূল ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন। রাত সোয়া ৯টার দিকে সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মোল্লা প্রবেশ করেন। এ সময় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত। রাতেই কার্যকর করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী যাদের উপস্থিত থাকার কথা তারা সবাই উপস্থিত হয়েছেন।
রিভিউ আবেদন খারিজের পর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার শামসুল ইসলাম গনমাধ্যমকে জানান বিকেল ৩টার পরে আমরা রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠিয়েছি।
সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয় ওই দিন। তার আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়া হয় মহড়া। ছয়জন জল্লাদকে কারাগারে আনা হয়। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে আবারো আলোচনায় চলে আসে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এর পরপরই সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে সরকার এবং সরকারবিরোধী আইনজীবীদের শুরু হয় মিছিল-পাল্টামিছিল এবং পরস্পর বিরোধী স্লোগান। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে মিছিল স্লোগান, ধস্তাধস্তি এবং হট্টগোল। রিভিউ আবেদন শুনানি উপলক্ষে গতকাল হাইকোর্ট অঙ্গনে বিপুল সংখ্যক র্যাব পুলিশি, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়।
সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, (বৃহস্পতিবার) রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্ততি উপলক্ষে জেলখানার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আশপাশের সব সড়কে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাধারণ লোকজন এবং যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মোড়ে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী ছাড়া কাউকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এলাকায় প্রবেশের পূর্বে তাদের তল্লাশি করা হচ্ছে। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এ ছাড়া ফাঁসি কার্যকরের খবর উপলক্ষে সন্ধ্যার আগে থেকেই দেশের এবং বিদেশের বিপুল সাংবাদিক ভিড় করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে।
গত মঙ্গলবার আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরা হলেন শাহজাহান ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মূল জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়ার নেতৃত্বে তারা রোববার এবং সোমবার ফাঁসির মঞ্চে আবদুল কাদের মোল্লার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলে ফাঁসির মঞ্চ ধোয়া মোছার কাজ।
রিভিউ আবেদন শুনানি : রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই। এটি একটি বিশেষ আইন এবং বিশেষ আদালত। সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’ তাই রিভিউ আবেদন চলতে পারে না বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন।
অপর দিকে আসামিপক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলীর-সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত কোন রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
তা ছাড়া আজ কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে জেল প্রয়োগেরও আবেদন করে আসামিপক্ষ। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কাদের মোল্লাকে জেলকোডের বিধান মেনেই এত দিন জেলে রাখা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করা হবে না?
এর বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশ বাস্তবায়ন সরকার করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। জেলকোড প্রয়োগ করার দরকার নেই।
সরকারের শীর্ষপর্যায়ে বৈঠক : এ দিকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে জরুরি এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইনবিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে প্রায় দুই ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে চলা বৈঠকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরে আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর আগে একই বিষয় নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। এসব বৈঠকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়াও রায় কার্যকরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) ও জেলকোডসহ ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।
আজকের বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো: কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং দুই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরপর দুই দিনের বৈঠকে কেউ কোনো কথা না বললেও আজ বৈঠকের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে জেলকোড এপ্লিকেবল না। কাদের মোল্লার প্রাণ ভিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে; কিন্তু তিনি (কাদের মোল্লা) এর কোনো সুযোগ নেননি। এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ দিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় জেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর রিভিউ আবেদনের আগেই রায় কার্যকরের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
মামলার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।
রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ অভিযোগটি হলো মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। এটি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নম্বর অভিযোগ। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল চার নম্বর অভিযোগ কেরানীগঞ্জ ঘাটারচর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে যাবজ্জীবন সাজা দেন। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত অপর একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
ছয়টি অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লার সাজা হয় ৪:১ ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগের ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত এবং ভিন্ন রায় প্রদান করেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে পাঁচটি অভিযোগ থেকে তিনি আবদুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণরূপে খালাস দেন। এগুলো হলো মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা, মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা, মিরপুরে সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যা, কেরানীগঞ্জে ঘাটারচর গণহত্যা হত্যা এবং মিরপুর আলুবদি গ্রামে গণহত্যা। একটি অভিযোগ যথা মিরপুরে হযরত আলী পরিবার হত্যার অভিযোগে তিনি ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
গত ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানির জন্য। ১ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু হয়।
আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
আজ সকালে রিভিউ আবেদন খারিজের পর রাতেই কার্যকর করা হলো তার ফাঁসি।
জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের সব অনুরোধ এবং আপত্তি উপেক্ষা করে সরকার আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করল।
রাত ১১টা ১৩ মিনিটের সময় আবদুল কাদের মোল্লার লাশ অ্যাম্বুলেন্সযোগে তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয় কড়া নিরাপত্তায় ব্যবস্থায়। এসময় কারাগার থেকে ১৪টি গাড়ির বহর বের হয়ে লাশবাহী গাড়ির সাথে। ফাঁসি কার্যকরের সময় কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশ এবং আশপাশের সব এলাকায় বিপুল সংখ্যক র্যাব, পুলিশ, বিজিবি এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সমন্বয়ে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়।
ফাঁসি কার্যকরের পর সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী, নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশঙ্খলা বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা প্রধান কারা ফটকের সামনে আসেন। এসময় বিপূল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেল গেটের দুই দিকে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়ান। লাশবাহী গাড়ি বের হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করেন তারা। ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন এসময় সাংবাদিকদের জানান মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ১০টা ১ মিনিট থেকে পরবর্তী ২০ মিনিট পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয় কাদের মোল্লার দেহ। মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এ মর্মে ডাক্তার কর্তৃক পরীক্ষার পর পাঁচজন জল্লাদ নামিয়ে আনে লাশ।
সূত্র জানায় এরপর পায়ের রগ কর্তনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে গোসল এবং কাফনের কাপড় পড়িয়ে স্বজনদের কাছে লাশ পৌছানোর জন্য অ্যাম্বুলেন্সে করে রওয়ানা দেয়া হয়। শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঢামে ছ/৭১-০৬৫৪ নম্বরধারী অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আজ দুপুর ১২টায় কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি। রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পর সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ে বৃহস্পতিবার রাতেই কার্যকর করা হবে ফাঁসি। সরকারের পক্ষ থেকেও ঘোষণা করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজের পর ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো বাঁধা নেই। সন্ধ্যার পর আবদুল কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করেন তার সাথে। কাদের মোল্লা তার আত্মীয়দের সাথে সাক্ষাতের সময় আইনজীবীদের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সে অনুযায়ী রাত সাড়ে ৮টার দিকে আইনজীবীরা তার সাথে সাক্ষাতের জন্য গেলে জেল কর্তৃপক্ষ সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারা কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়ে দেন ফাঁসির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তাই আর দেখা করার অনুমতি নেই। আইনজীবীদের কাছে উপস্থিত সাংবাদিকেরা এ কথা জানার পরই সবাই নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রাতেই কার্যকর করা হবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড। গত মঙ্গলবার রাতে ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ বিষয়ে সরকার এবং জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হলেও গতকাল আগে থেকে কোনো কিছু গণমাধ্যম বা অন্য কাউকে জানায়নি জেল কর্তৃপক্ষ বা সরকারের অন্য কেউ। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মুনির, মতিউর রহমান আকন্দ ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন গিয়েছিলেন আবদুল কাদের মোল্লার সাথে সাক্ষাতের জন্য।
সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা আব্বুর সাথে দেখা করার আবেদন করেছিলাম। আমাদের ছয়-সাতজনকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। আমরা যাচ্ছি দেখা করার জন্য। কারাগারের সামনে থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন ৬টা ২২ মিনিটের সমায় আবদুল কাদের মোল্লার আত্মীয়স্বজন কারাগারে প্রবেশ করেন এবং ৭টার দিকে তারা বের হন। স্ত্রী সানোয়ার জাহান, ছেলে এবং মেয়েসহ ১০ জন নিকটাত্মীয় তার সাথে সাক্ষাৎ করে বের হয়ে যান।
কারা ফটকের সামনে থেকে আমাদের প্রতিবেদক জানান, রাত ৮টা ৫৬ মিনিটের সময় ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল ইফতেখার আলম কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। একই সময় ঢাকা জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন ও কেন্দ্রীয় কারা মসজিদের ইমাম মনির হোসেন মূল ফটক দিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন। রাত সোয়া ৯টার দিকে সিভিল সার্জন আব্দুল মালেক মোল্লা প্রবেশ করেন। এ সময় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত। রাতেই কার্যকর করা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী যাদের উপস্থিত থাকার কথা তারা সবাই উপস্থিত হয়েছেন।
রিভিউ আবেদন খারিজের পর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার শামসুল ইসলাম গনমাধ্যমকে জানান বিকেল ৩টার পরে আমরা রিভিউ আবেদন খারিজের সংক্ষিপ্ত আদেশের কপি ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ, রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অফিসে পাঠিয়েছি।
সরকারের নির্দেশে মঙ্গলবার রাতেই আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। রাত ৮টায় আত্মীস্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠানো হয় ওই দিন। তার আগে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়া হয় মহড়া। ছয়জন জল্লাদকে কারাগারে আনা হয়। ওই দিন জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের দু’জন প্রতিমন্ত্রীও ঘোষণা করেন রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু ফাঁসি কার্যকরের মাত্র দেড় ঘণ্টা আগে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ফলে আবারো আলোচনায় চলে আসে ঘটনাবহুল এবং আলোচিত এ মামলাটি। গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চে শুরু হয় রিভিউ আবেদনের শুনানি। এ ছাড়া আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানোরও আবেদন করে। রিভিউ আবেদন চলবে কি চলবে না এ বিষয়ে বুধবার শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করায় ফাঁসি স্থগিতাদেশও বহাল থাকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। বৃহস্পতিবার সকালে আবার শুরু হয় রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি। শুনানি শেষে ১২টা ৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ঘোষণা করেন আবেদন ডিসমিসড।
এর পরপরই সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে সরকার এবং সরকারবিরোধী আইনজীবীদের শুরু হয় মিছিল-পাল্টামিছিল এবং পরস্পর বিরোধী স্লোগান। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে মিছিল স্লোগান, ধস্তাধস্তি এবং হট্টগোল। রিভিউ আবেদন শুনানি উপলক্ষে গতকাল হাইকোর্ট অঙ্গনে বিপুল সংখ্যক র্যাব পুলিশি, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়।
সন্ধ্যা ৭টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকা থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, (বৃহস্পতিবার) রাতে কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রস্ততি উপলক্ষে জেলখানার আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আশপাশের সব সড়কে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাধারণ লোকজন এবং যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মোড়ে ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। কারাগারের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী ছাড়া কাউকে ওই এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এলাকায় প্রবেশের পূর্বে তাদের তল্লাশি করা হচ্ছে। নাজিম উদ্দিন রোড, বেগম বাজার, চকবাজার প্রভৃতি এলাকায় প্রধান প্রধান সড়ক ব্লক করে দেয়া হয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
এ ছাড়া ফাঁসি কার্যকরের খবর উপলক্ষে সন্ধ্যার আগে থেকেই দেশের এবং বিদেশের বিপুল সাংবাদিক ভিড় করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে।
গত মঙ্গলবার আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের জন্য ছয়জন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। এরা হলেন শাহজাহান ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন, ফয়েজ আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন, রাজু ও জনি। মূল জল্লাদ শাহজাহান ভুইয়ার নেতৃত্বে তারা রোববার এবং সোমবার ফাঁসির মঞ্চে আবদুল কাদের মোল্লার ওজনের সমান বালুর বস্তা ও কলাগাছ ঝুলিয়ে মহড়া চালিয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলে ফাঁসির মঞ্চ ধোয়া মোছার কাজ।
রিভিউ আবেদন শুনানি : রিভিউ আবেদনের বিষয়ে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে রিভিউ আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই। এটি একটি বিশেষ আইন এবং বিশেষ আদালত। সংবিধানের ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’ তাই রিভিউ আবেদন চলতে পারে না বলে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন।
অপর দিকে আসামিপক্ষে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ১০৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘সংসদের যেকোন আইনের বিধানাবলীর-সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপিল বিভাগের ঘোষিত কোন রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
তা ছাড়া আজ কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে জেল প্রয়োগেরও আবেদন করে আসামিপক্ষ। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কাদের মোল্লাকে জেলকোডের বিধান মেনেই এত দিন জেলে রাখা হয়েছে। দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কেন প্রয়োগ করা হবে না?
এর বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দণ্ডাদেশ বাস্তবায়ন সরকার করবে বলে আইনে বলা হয়েছে। জেলকোড প্রয়োগ করার দরকার নেই।
সরকারের শীর্ষপর্যায়ে বৈঠক : এ দিকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর আইন মন্ত্রণালয়ে জরুরি এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর আইনবিষয়ক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সভাপতিত্বে প্রায় দুই ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে চলা বৈঠকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরে আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এর আগে একই বিষয় নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর পরপর দুই দিন রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। এসব বৈঠকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া এবং আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ ছাড়াও রায় কার্যকরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) ও জেলকোডসহ ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।
আজকের বৈঠকে আইন উপদেষ্টা ছাড়াও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো: কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এবং দুই মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পরপর দুই দিনের বৈঠকে কেউ কোনো কথা না বললেও আজ বৈঠকের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছেন, এখানে জেলকোড এপ্লিকেবল না। কাদের মোল্লার প্রাণ ভিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাকে প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার কথা আগে থেকেই বলা হয়েছে; কিন্তু তিনি (কাদের মোল্লা) এর কোনো সুযোগ নেননি। এখন আর কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এ দিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় জেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার পর রিভিউ আবেদনের আগেই রায় কার্যকরের জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।
মামলার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন কাদের মোল্লাকে। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ৮ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। এরপরই শুরু হয়ে যায় ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি।
রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লাকে দুইটি অভিযোগে যাবজ্জীবন, তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং একটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে একটি যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে আবদুল কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ অভিযোগটি হলো মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা। এটি ছিল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ছয় নম্বর অভিযোগ। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল চার নম্বর অভিযোগ কেরানীগঞ্জ ঘাটারচর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ খালাস বাতিল করে যাবজ্জীবন সাজা দেন। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত অপর একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে দণ্ড বহাল রাখে আপিল বিভাগ।
ছয়টি অভিযোগে আবদুল কাদের মোল্লার সাজা হয় ৪:১ ভিত্তিতে। অর্থাৎ বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা আপিল বিভাগের ছয়টি সাজার ক্ষেত্রেই ভিন্ন মত এবং ভিন্ন রায় প্রদান করেন। ছয়টি অভিযোগের মধ্য থেকে পাঁচটি অভিযোগ থেকে তিনি আবদুল কাদের মোল্লাকে সম্পূর্ণরূপে খালাস দেন। এগুলো হলো মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা, মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা, মিরপুরে সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যা, কেরানীগঞ্জে ঘাটারচর গণহত্যা হত্যা এবং মিরপুর আলুবদি গ্রামে গণহত্যা। একটি অভিযোগ যথা মিরপুরে হযরত আলী পরিবার হত্যার অভিযোগে তিনি ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখেন।
২০১০ সালের ১৩ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট থেকে কাদের মোল্লাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ট্রাইব্যুনালে তদন্তকারী সংস্থার এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২ আগস্ট কাদের মোল্লাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় আটক রাখার আদেশ দেয়া হয়।
২০১২ সালের ২৮ মে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগের ঘটনায় চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৩ জুলাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে ছয়জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে ২০১২ সালের ৭ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ মামলাটি সেখানে স্থানান্তর করা হয়।
গত ৩১ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় আপিল আবেদন শুনানির জন্য। ১ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন