মেহেদী হাসান
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ১৮ জুলাই সংসদের একটি আইন পাশ হয়। এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস ) এ্যাক্ট ১৯৭৩’। আইনটি পাশের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধন করতে হয়েছিল। আইনটি পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই। এর তিনদিন আগে ১৫ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রথমবারের মত সংশোধন করা হয়। একটি আইন পাশ করতে সংবিধানে সংশোধনী আনার প্রয়োজন হয়েছিল কেন?
যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী যেসব সংস্থা এবং আইনজ্ঞ মতামত প্রদান করেছেন তাদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে যে সর্বজনীন মৌলিক মানাবধিকারের ঘোষনা রয়েছে তা ৭৩ সালের আইনে রহিত করা হয়েছে। সেজন্য ৭৩ সালের আইন পাশ এবং আইনটিকে সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী আনতে হয়েছিল। সংবিধান সংশোধন করে ৪৭ (ক) ও ৪৭ (৩ ) নামে দুটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। সংবিধান এবং আইনবিশেষজ্ঞদের মতে এই ধারা দুটি সয়ং সংবিধানের ৩৫, ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারা এবং সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মানবাধিকার বিষয়ক সংবিধানের বেশ কিছু ধারা অকার্যকর ঘোষনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ স্টিভেন কে কিউসি, টবি ক্যাডম্যান, বিচারপতি মাইকেল বেলফ, বিশ্বে আইনজীবীদের সবচেয়ে বড় সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন (আইবিএ), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো বিভিন্ন মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সংস্থা এবং আইনবিদদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে বাংলাদেশের সংবিধানে ঘোষিত কিছু মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়েছে। ৭৩ সালের আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সাংঘষিক। সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত এ আইনকে যাতে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে এবং আইনের অসাংবিধানিক ধারাগুলোকে সুরক্ষার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
কী আছে প্রথম সংবিধান সংশোধনীতে?
সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭ (৩) ধারায় বলা হয়েছে “ এই সংবিধানে যাহা বলা
হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবাতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোন
আইন বা আইনের বিধান সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবেনা কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবেনা।”
নতুভাবে সংযোজিত ৪৭ (ক) এ ১ ও ২ নামে দুটি উপধারা রয়েছে। ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”
৪৭ ক (১) ধারায় বলা হয়েছে “যে বক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা, এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য ইবেনা। ”
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। সংবিধানের এই ৩৫ ধারাসহ ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারায় বর্ণিত আরো কিছু মৌলিক রহিত করা হয়েছে ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সংবিধানে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ সংযোজনের ফলে জুডিশিয়াল রিভিউর অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেনা অভিযুক্ত ব্যক্তি। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিষয়ে যে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়েছে তাতে এই জুডিশিয়াল রিভিউকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর এই জুৃডিশিয়াল রিভিউর বিধান রাখা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে। এছাড়া সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৩ সালের আইনকে প্রটেকশন দেয়ার ফলে ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচারক নিয়োগ এবং রায় নিয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবেনা।
যুক্তরাজ্য রানীর সাবেক কাউন্সেলর এবং বিচারপতি মাইকেল জে বেলফ ১৯৭৩ সালের আইনে জুডিশিয়াল রিভিউ’র ক্ষমতা খর্ব করে সংবিধানে যে প্রটেকশন দেয়া হয়েছে তাকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
যুগোশ্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্টিভেন কিউসি বলেন, ১৯৭৩ সালের আইন এবং এ আইনকে সুরক্ষার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হল তার মাধ্যমে এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ‘অসাম্য’ প্রবর্তন করা হল।
১৯৭৩ সালের সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭ ক (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংবিধানে অন্যান্য যেসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু
লোকের ক্ষেত্রে। যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে কেউ উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে সংবিধানের এসব ধারা সংযোজনের মাধ্যমে।
১৯৭৩ সালের সংবিধানে প্রথম যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা যে বাংলাদেশের সযং ঐ সংবিধানেরই বিরোধী তা বোঝাতে স্টিভেন ১৯৭২ সালের সংবিধানের কয়েকটি ধারা উদাহরণ হিসেবে তুরে ধরেণ। যেমন , সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ শিরোনামে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।”
২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামাঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ , এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (১) । রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কোন আইন প্রনয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (২)।
স্টিভেন বলেন, তথাপি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে প্রথম সংশোধনী আনা হয় তাতে সকল নাগরিক সমান- সাম্যের এই আকাঙ্খা রহিত করা হয়েছে।
পূর্বের অপরাধের বিচার পরে আইন করে করা যায়না
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। অপরাধ সংঘটনের সময় বিদ্যমান আইনে যে শাস্তির বিধান থাকে পরে আইন করে তার চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া যায়না। সারা বিশ্বে আইনের মূলনীতি এটি। বাংলাদেশের সংবিধানেও নিশ্চয়তা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৫ ধারায় ঘোষিত এ নিশ্চয়তা অকার্যকর ঘোষনা করা হয়েছে। কারণ অপরাধ সংঘটন হয়েছে ১৯৭১ সালে। আর অপরাধের বিচারের জন্য আইন করা হয়েছে ১৯৭৩ সালে। পূর্বের অপরাধ পরে আইন করে বিচারের সুযোগ রাখার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়। আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি বিরোধী এটি।
যেমন জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) । এ আদালতে ২০০২ সালের পূর্বে সংঘটিত কোন অপরাধের বিচার করা যাবেনা। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আইসিসির প্রধান বিচারপতি স্যাং হুন সং বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা এবং সে সুযোগও নেই। সরকারকে ডিঙ্গিয়ে ৩৮ বছর আগের বিষয় নিয়ে কাজ করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পরেনা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে ১৮ জুলাই সংসদের একটি আইন পাশ হয়। এর নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস (ট্রাইবিউনালস ) এ্যাক্ট ১৯৭৩’। আইনটি পাশের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধন করতে হয়েছিল। আইনটি পাশ হয় ১৯৭৩ সালের ১৮ জুলাই। এর তিনদিন আগে ১৫ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রথমবারের মত সংশোধন করা হয়। একটি আইন পাশ করতে সংবিধানে সংশোধনী আনার প্রয়োজন হয়েছিল কেন?
যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী যেসব সংস্থা এবং আইনজ্ঞ মতামত প্রদান করেছেন তাদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে যে সর্বজনীন মৌলিক মানাবধিকারের ঘোষনা রয়েছে তা ৭৩ সালের আইনে রহিত করা হয়েছে। সেজন্য ৭৩ সালের আইন পাশ এবং আইনটিকে সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে সংশোধনী আনতে হয়েছিল। সংবিধান সংশোধন করে ৪৭ (ক) ও ৪৭ (৩ ) নামে দুটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়। সংবিধান এবং আইনবিশেষজ্ঞদের মতে এই ধারা দুটি সয়ং সংবিধানের ৩৫, ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারা এবং সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে মানবাধিকার বিষয়ক সংবিধানের বেশ কিছু ধারা অকার্যকর ঘোষনা করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞ স্টিভেন কে কিউসি, টবি ক্যাডম্যান, বিচারপতি মাইকেল বেলফ, বিশ্বে আইনজীবীদের সবচেয়ে বড় সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বার এসোসিয়েশন (আইবিএ), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো বিভিন্ন মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সংস্থা এবং আইনবিদদের মতে ১৯৭৩ সালের আইনে বাংলাদেশের সংবিধানে ঘোষিত কিছু মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়েছে। ৭৩ সালের আইনে এমন কিছু ধারা আছে যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার সাথে সাংঘষিক। সেজন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে প্রণীত এ আইনকে যাতে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে এবং আইনের অসাংবিধানিক ধারাগুলোকে সুরক্ষার জন্য সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে।
কী আছে প্রথম সংবিধান সংশোধনীতে?
সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭ (৩) ধারায় বলা হয়েছে “ এই সংবিধানে যাহা বলা
হইয়াছে তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবাতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোন
আইন বা আইনের বিধান সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবেনা কিংবা কখনো বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবেনা।”
নতুভাবে সংযোজিত ৪৭ (ক) এ ১ ও ২ নামে দুটি উপধারা রয়েছে। ৪৭ ক (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই সংবিধানে যাহা বলা হাইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবেনা।”
৪৭ ক (১) ধারায় বলা হয়েছে “যে বক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ, ৩৫ অনুচ্ছেদের (১) ও (৩) দফা, এবং ৪৪ অনুচ্ছেদের অধীনে নিশ্চয়কৃত অধিকারসমূহ প্রযোজ্য ইবেনা। ”
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। সংবিধানের এই ৩৫ ধারাসহ ৩১, ৩৩ এবং ৪৪ ধারায় বর্ণিত আরো কিছু মৌলিক রহিত করা হয়েছে ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সংবিধানে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদ সংযোজনের ফলে জুডিশিয়াল রিভিউর অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেনা অভিযুক্ত ব্যক্তি। বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিষয়ে যে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়েছে তাতে এই জুডিশিয়াল রিভিউকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর এই জুৃডিশিয়াল রিভিউর বিধান রাখা হয়নি ১৯৭৩ সালের আইনে। এছাড়া সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭৩ সালের আইনকে প্রটেকশন দেয়ার ফলে ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচারক নিয়োগ এবং রায় নিয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবেনা।
যুক্তরাজ্য রানীর সাবেক কাউন্সেলর এবং বিচারপতি মাইকেল জে বেলফ ১৯৭৩ সালের আইনে জুডিশিয়াল রিভিউ’র ক্ষমতা খর্ব করে সংবিধানে যে প্রটেকশন দেয়া হয়েছে তাকে অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
যুগোশ্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট আইনজ্ঞ স্টিভেন কিউসি বলেন, ১৯৭৩ সালের আইন এবং এ আইনকে সুরক্ষার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হল তার মাধ্যমে এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ‘অসাম্য’ প্রবর্তন করা হল।
১৯৭৩ সালের সংবিধানে নতুনভাবে সংযোজিত ৪৭ ক (১) অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংবিধানে অন্যান্য যেসব মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু
লোকের ক্ষেত্রে। যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে কেউ উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে সংবিধানের এসব ধারা সংযোজনের মাধ্যমে।
১৯৭৩ সালের সংবিধানে প্রথম যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা যে বাংলাদেশের সযং ঐ সংবিধানেরই বিরোধী তা বোঝাতে স্টিভেন ১৯৭২ সালের সংবিধানের কয়েকটি ধারা উদাহরণ হিসেবে তুরে ধরেণ। যেমন , সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ২৭ অনুচ্ছেদে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ শিরোনামে মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে পুনরায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।”
২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “এই ভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামাঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ , এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (১) । রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসামাঞ্জস্যপূর্ণ কোন আইন প্রনয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হাইয়া যাইবে (২)।
স্টিভেন বলেন, তথাপি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে যে প্রথম সংশোধনী আনা হয় তাতে সকল নাগরিক সমান- সাম্যের এই আকাঙ্খা রহিত করা হয়েছে।
পূর্বের অপরাধের বিচার পরে আইন করে করা যায়না
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “অপরাধের দায়যুক্ত কর্মসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবেনা এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবেনা।”
অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত অপরাধের জন্য পরে আইন করে শাস্তি দেয়া যাবেনা। অপরাধ সংঘটনের সময় বিদ্যমান আইনে যে শাস্তির বিধান থাকে পরে আইন করে তার চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া যায়না। সারা বিশ্বে আইনের মূলনীতি এটি। বাংলাদেশের সংবিধানেও নিশ্চয়তা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৩ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৫ ধারায় ঘোষিত এ নিশ্চয়তা অকার্যকর ঘোষনা করা হয়েছে। কারণ অপরাধ সংঘটন হয়েছে ১৯৭১ সালে। আর অপরাধের বিচারের জন্য আইন করা হয়েছে ১৯৭৩ সালে। পূর্বের অপরাধ পরে আইন করে বিচারের সুযোগ রাখার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়। আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতি বিরোধী এটি।
যেমন জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০২ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) । এ আদালতে ২০০২ সালের পূর্বে সংঘটিত কোন অপরাধের বিচার করা যাবেনা। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আইসিসির প্রধান বিচারপতি স্যাং হুন সং বাংলাদেশ সফরের সময় বলেছেন, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা এবং সে সুযোগও নেই। সরকারকে ডিঙ্গিয়ে ৩৮ বছর আগের বিষয় নিয়ে কাজ করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পরেনা।
এই সাইটের যেকোন লেখা, তথ্য উপাত্তা যেকেউ ব্যবহার, পুনমুদ্রন, পুন প্রচার, প্রকাশ করা যাবে; তবে শর্ত হল সূত্র হিসেবে Mehedy Hasan ও https//www.bangladeshwarcrimestrial.blogspot.com
উল্লেখ/লিঙ্ক
করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন