পর্যালোচনা১:
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে
মেহেদী হাসান
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যে দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী, তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা।
এ ঘটনায় বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের বড় মেয়ে মোমেনা বেগম। মোমেনা বেগম ট্রাইব্যুনালে এসে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এ ঘটনা বিষয়ে । একই সাক্ষী মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ধর্ষনের ঘটনা বিষয়ে ২০০৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ যাদঘর কর্তৃপক্ষের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। ট্রাইবু্যুনালে মোমেনা বেগম বলেছেন ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ধর্ষনের ঘটনা দেখেছেন। তিনি নিজেও লাঞ্ছনার শীকার হন এবং এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন। অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে কাছে তিনি ঘটনার বর্ননা দিয়ে বলেছেন ঘটনার দুই দিন আগে তিনি শশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় প্রানে বেঁচে যান। কোর্টে তিনি বললেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত বক্তব্যে দেখা যায় তিনি ঘটনার দুই দিন আগে শশুর বাড়ি চলে যান।
ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনা) মোমেন বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে। ফলে সেসময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে বর্ননা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে আসলেন এবং বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরো বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।
মোমেনা জানায় সে এবং তার ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়। এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যকণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।
রয়ে মোমেনা বেগমের বরাদ দিয়ে তাদের পরিবারের ঘটনার বর্ননা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র এটি।
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে :
হযরত আলী হত্যাকান্ডসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষাতকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্প হাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাতকার বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
যে হযরত আলী হত্যাঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা লিপিবদ্ধ এবং সংরক্ষন করা হয়েছে। মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান।
হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০৭ তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তা নিম্নরূপ। ‘ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারির হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।
কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”
রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে মোমেনা বেগম তার পিতামাতা এবং ভাইবোনকে হত্যার ঘটনাটি যে স্বচক্ষে দেখেছেন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে। তার বয়স ছিল তখন ১৩ বছর এবং অলৌকিকভাবে সে বেঁচে যায়। তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। রায়ে মোমেনা বেগমের জবানবন্দী বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
আসামী পক্ষ থেকে দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানানো হয়েছে মোমেনা বেগমের যে জবানবন্দী মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত রয়েছে তা তারা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনাল তখন তা নথিভুক্ত করে জানিয়েছিলেন বিষয়টি তারা রায়ের সময় বিবেচনা করবেন। তবে রায়ে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। রায়ে আসামী পক্ষের দাবি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আসামী পক্ষ দাবি করেছে মোমেনা বেগম হযরত আলী লস্করের মেয়ে নন। তিনি যে হযরত আলী রস্করের মেয়ে সে মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ তা তিনি কোন ডকুমেন্ট হাজির করেনি। তাছাড়া জেরায় আসামী পক্ষ মোমেনা বেগমের যেসব দুর্বল বিষয় বরে করে আনে তাও উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।
আসামী পক্ষ কর্তৃক মোমেনা বগমের জেরার পর্যালোচা করে রায়ে বলা হয়েছে, জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে মোমেনা বেগম জানান, পাকিস্তান আর্মি এবং বিহারীদের সাথে যে বাঙ্গালী এসেছিল তিনি বাংলায় কথা বলছিলেন এবং তার বাবার কলার ধরে যিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হলে কাদের মোল্লা। তিনি খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেন। কাদের মোল্লা যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তা এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে মোমেনা বেগমের মা বাবা ভাই বোনকে কাদের মোল্লা নিজে হত্যা করেছে চার্জে সে অভিযোগ করা হয়েছে বলে মনে হয়না। তবে রায়ে বলা হয়েছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। মানবতা বিরোধী এ ধরনের হত্যা ঘটনা ব্যক্তি সরাসরি ঘটিয়েছে তা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়না।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ ঘটনায় একজনমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী জীবিত সাক্ষী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলেন মোমেনা বেগম। তার এভিডেন্সেকে পাশ কাটানো যায়না বা সন্দেহ পোশন করা যায়না।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় এবং এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে কারাদান্ড প্রদান করা হয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে। দুটি হযরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিয় ছয় নম্বর অভিযোগ এবং এ অভিযোগসহ আরো একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয়। হযরত আলী আওয়ামী লীগ করার কারনে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারনে আব্দুল কাদের মোল্লা বিহারী এবং আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।
রায় পর্যালোচনা২ :
এক নং চার্জ পল্লব হত্যার ভিত্তি শোনা কথা
কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ ঘটাননি
মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত পাঁচ তারিখ মঙ্গলবার রায় ঘোষনা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে পাঁচটি অভিযোগে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি হল ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা ঘটনা। এ হত্যা ঘটনার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাকে ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।
রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষন করে উল্লেখ করা হয়েছে এ হত্যা ঘটনার অভিযোগের ভিত্তি হল শোনা কথা। ট্রাইব্যুনালের হাতে যা এসেছে তাতে দেখা যায় আব্দুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ সংঘটন করেছেন এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত নন।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। একটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়ে পাঁচটি অভিযোগে তাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে ছয়টি অভিযোগ সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। তারপর প্রত্যেকটি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের যেসব সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তা বিশ্লেষন করা হয়েছে। এরপর আসামী পক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষন করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগের পক্ষে দুই পক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে। কোন অভিযোগে কেন আসামীকে দন্ডিত করা হল, সাক্ষীর সাক্ষ্য কেন, কতটুকু মাত্রায় গ্রহণ করা হল তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে দণ্ড ঘোষনা করা হয়েছে রায়ে।
রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা : আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এক নং চার্জ ছিল পল্লব হত্যার ঘটনা। এ অভিযোগটি বিশ্লেষনের শুরুতে রায়ে ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয় আব্দুল কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নওয়াবপুর থেকে জোর করে আব্দুল কাদের মোল্লার কাছে ধরে আনা হয়। তারপর আব্দুল কাদের মোল্লার সাঙ্গপাঙ্গরা পল্লবকে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১ নং শাহআলী মাজার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এরপর তাকে আবার মিরপুর ১২ নং ঈদগাহ মাঠে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর কাদের মোল্লার সহযোগী আক্তার গুন্ডা এবং অন্যারা মিলে পল্লবকে ৫ এপ্রিল হত্যা করে। পল্লাব হত্যায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যাকান্ড ঘটানোর অপরাধ হিসেবে মানবাতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় চার্জে। অথবা হত্যা ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সাক্ষী : রায়ে বলা হয় পল্লব হত্যা ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদের একজন হলেন শহিদুল হক মামা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইউম। অপর দিকে আসামী পক্ষে এ ঘটনায় সাক্ষ্য দিয়েছেন পল্লবের ভাবী সাহেরা খাতুন। সাহেরা খাতুন ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তবে তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য না দিয়ে আসামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সাক্ষী পর্যালোচনা : রায়ে বলা হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শহিদুল হক মামা পল্লবকে হত্যার জন্য আব্দুল কাদের মোল্লা নির্দেশ দিয়েছেন তা দেখননি। অথবা পল্লবকে যে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে আসা হয়েছে তাও দেখেননি। জেরায় সাক্ষী বলেছেন, তিনি জনতা এবং যাদেরকে তিনি চিনতেন তাদের কাছে পল্লবকে জোর করে ধরে আনা, নির্যাতন করা এবং হত্যার ঘটনা শুনেছেন ।
রাষ্ট্রপক্ষের অপর সাক্ষী আব্দুল কাইউমও বলেছেন তিনি শুনেছেন কাদের মোল্লা বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে হত্যা করেছে।
সাক্ষী শহিদুল হক মামা যদিও শোনা কথা বলেছেন তবু তিনি একজন ন্যাচারাল সাক্ষী। অন্যথায় তিনি বাড়িয়ে বলতে পারতেন যে, তিনি দেখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা পল্লবকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। তার যদি কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকত তাহলে তিনি বলতে পারতেন যে, তিনি ওই ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তা না বলে তিনি এ ঘটনায় কিভাবে, কাদের পরিকল্পনায় ঘটানো হয়েছে সে বিষয়ে বলেছেন। তিনি বলেছেন তিনি জনতার কাছে এবং যাদেরকে তিনি চেনেন এমন অনেকের কাছে এ ঘটনা শুনেছেন।
রায়ে সাক্ষী সাক্ষী শহিদুল মামা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত তার জবানবন্দীর ভিত্তিতে। এতে বলা হয় সাক্ষী শহিদুল হক মামা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা। সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লা বিহারীরা, আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাশিম হাসবি, নেহাল গোলাম আযমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় অংশ নিয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে স্লোগন দিত।
রায়ে বলা হয় আব্দুল কাদের মোল্লা যদিও একজন বাঙ্গালী ছিলেন কিন্তু স্থানীয় আক্তার গুন্ডা এবং বিহারী গুন্ডাদের সাথে তার ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাক্ষী শহিদুর হক মামা বলেছেন ২৫ মার্চের আগেই ছয় দফা এবং ১১ দফা আন্দোলনের সময় তিনি জামায়াতের আব্দুল কাদের মোল্লাসহ কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা কর্মীদের দ্বারা প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত হয়েছেন। এসব কারনে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং বিহারী গুন্ডা ও আক্তার গুন্ডাদের সাথে সাক্ষী শহিদুল হক মামার সাথে আগে থেকেই বিরোধ ছিল। ২৫ মার্চ রাতে মিরপুরেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সাক্ষী শহিদুল হক মামা রাতে শাহ আলী মাজারে আশ্রয় নেন। সকালে মাজার থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পান এবং কাদের মোল্লাসহ অন্যান্যরা তাকে ধাওয়া দেয়।
রায়ে বলা হয় জেরায় এসব বিষয় প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
সাক্ষী মূল্যায়ন : রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন বেনামী শোনা কথার কোন বিচারিক মূল্য নেই। জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন আইনে শোনা কথা গ্রহণযোগ্য।
অভিযোগের ভিত্তি শোনা কথা : রায়ে বলা হয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এক নং অভিযোগ পল্লব হত্যার অভিযোগের ভিত্তি হল শোনা কথা। সোনা কথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ডিসক্রিশন, আইনে প্রদত্ত বৈধতা, পারিপার্শিক পরিস্থিতি, সাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতা, সংশ্লিষ্ট ঘটনা ছাড়াও সার্বিক বিষয়ে আসামীর সংশ্লিষ্টতা প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষন করা হয়েছে এ পর্যায়ে। রায়ে বলা হয় যেহেতু টেকনিক্যাল রুল অব এভিডেন্স ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয় এবং পারিপার্শিক পরিস্থিতি, বিহারী গুন্ডা, আক্তার গুন্ডার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠতা ছিল তাই প্রভৃতি বিবেচনায় শোনাকথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয় সেসময় সেখানে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করে তাতে কোন বাঙ্গাীর পক্ষে এ হত্যা ঘটনা, জোর করে পল্লবকে কাদের মোল্লার কাছে ধরে আনা বা কাদের মোল্লা কর্তৃক পল্লবকে হত্যার নির্দেশ দেয়ার ঘটনা দেখা সহজ ছিলনা। সাক্ষীর মতে মিরপুরে তখন ৯০ ভাগ মানুষ ছিল বিহারী। সামান্য যে দশ ভাগ বাঙ্গালী ছিল তারা ছিল ভয়ে ভীত। হঠাৎ করে বিহারী গুন্ডা, স্বাধীনতা বিরোধী বাঙ্গালী যারা জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত ছিল তারা পাকিস্তান আর্মির সাথে মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধ’র শুরুতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির অবতারনা ঘটায় তাতে বাঙ্গালীরা ত্রাসের মধ্যে ছিল সেখানে। তাই সাক্ষী শহিদুল হক মামা লোকজনের কাছে পল্লব হত্যার ঘটনা শুনেছেন বলে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাকে উড়িয়ে দেয়া যায়না। কোন চাুস সাক্ষী নেই বলে তার সাক্ষ্যকে অস্বীকার করা যায়না।
তাছাড়া দীর্ঘ ৪১ বছর পর এ বিষয়ে জীবিত সাক্ষী নাও পাওয়া যেতে পারে এবং সেসময়কার ভয়াবহ পরিস্থিতির কারনে এ ঘটনা কারো পক্ষে দেখা সম্ভব নাও হতে পারে। সাক্ষী শহিদুল হক মামা একজন মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা এবং তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িত। তাই তার পক্ষে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং অন্য যারা পাকিস্তানপন্থী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তাদেরকে চেনা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা যায়।
আসামী পক্ষের সাক্ষী সম্পর্কে রায়ে যা বলা হয়েছে : পল্লবের ভাবী সাহেরা ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো ট্রাইব্যুনালে এসে কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি পল্লবের আপন ভাবী। এ সাক্ষী সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, তিনি একজন ম্যানেজড সাক্ষী। অর্থাৎ আসামী পক্ষ তাকে ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছে। সত্য প্রকাশ না করার জন্য, রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগকে মিথ্যা প্রমানের জন্য এবং আসামীকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার মেকানিজমের অংশ হিসেবে তাকে আনা হয়।
রায়ে আরো বলা হয় সাক্ষী সাহেরা জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার নাম জীবনেও শোনেননি। যদি এটা সত্য হয় তাহলে কাদের মোল্লা তখন এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিল বা ছিলনা এ বিষয়েও তার কিছু জানানর কথা নয়। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে সংশ্লিষ্টতা, স্থানীয় বিহারী, স্বাধীনতা বিরোধী, বাঙ্গালী বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কর্মতৎপরতার সাথে জড়িত থাকার কারনে ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনার আগে থেকেই কাদের মোল্লা পরিচিত ছিলেন। কাজেই জীবনে একবারও আব্দুল কাদের মোল্লার নাম না শোনার কথা মিথ্যা হিসেবে পরিগনিত।
এমনিভাবে আরো কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে কেন আসামী পক্ষের সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয় সে বিষয়ে। রায়ে বলা হয়েছে যেহেতু এ সাক্ষী সত্যকে গোপন করে আসামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তাই তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী প্রদানের কথাও অস্বীকার করেছেন। নি:সন্দেহে এ সাক্ষী সত্য গোপন করেছেন বিশেষ করে ঘটনার সাথে আসামীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে। অন্যদিকে তার সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষের শোনা কথাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে।
রায়ে বলা হয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে স্থানীয় বিহারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত। রায়ে উদাহরন পেশ করে বলা হয়েছে যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তার সাথে অভিযুক্তর সরাসরি সম্পৃক্ত বা জড়িত থাকতে হবে বিষয়টি এমন নয়। প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমান, পারিপাশ্বির্ক পরিস্থিতি এবং ঘটনা বিশ্লেষন করে আমরা পেয়েছি যে, আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সহযোগীরা মিলে বেসামরিক নাগরিক পল্লব হত্যা পরিকল্পনা করেছে। নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর আক্রমনের অংশ হিসেবে পল্লবকে হত্যা করা হয়। পল্লবকে যেখন হত্যা করা হয় তখন সেখানে আসামীকে উপস্থিত থাকতে হবে এমনটি অপরিহার্য নয়। রায়ে বলা হয়, তার নৈতিক সমর্থনে, জ্ঞাতসারে এবং পরিকল্পনায় এ হত্যা ঘটনা ঘটে, যদিও ঘটনাস্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেননা। কারণ পল্লব ছিল স্বাধীনতার পক্ষের। বেসারিমক নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত আক্রমনের অংশ হিসেবে পল্লবকে হত্যা করা হয়। তাই এটি একক হত্যাকান্ড হলেও আইনে বর্নিত মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবেও গন্য এটি।
রায়ের শেষ দিকে উল্লেখ করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের কাছে যেসব বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাতে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ সংঘটন করেছেন সে মর্মে কোন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই। বরং যেটি প্রমানিত হয়েছে সেটি হল মিরপুরে স্বাধীনতা বিরোধী বিহারী গুন্ডাদের সাথে তার যোগসাজস ছিল। অপরাধ সংঘটনের আগে থেকেই তাদের সাথে তার এ সম্পর্ক ছিল।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ে এক নং চার্জ বা পল্লব হত্যার ঘটনাটি প্রায় ১৮ পৃষ্ঠা জুড়ে বিশ্লেষন করা হয়েছে।
আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী যা বলেছেন : পল্লবের ভাবী সাহেরা ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু গত ২ ডিসেম্বর তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে চমক সৃস্টি করলেন। সাহেরা সেদিন ট্রাইব্যুনালে বলেন, তার দেবর পল্লবকে আব্দুল কাদের মোল্লা নয় বরং আক্তার গুন্ডা এবং বিহারীরা হত্যা করে। সাহেরা কর্তৃক আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনাটি রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তিনি কি বলেছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। বরং তাকে ম্যানেজড সাক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে রায়ে।
সাক্ষী সাহেরা ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দীতে যা বলেছিলেন তা এখানে তুলে ধরা হল।
আমার নাম মোছা ঃ সাহেরা। স্বামী মৃত ফজর আলী। আমার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। বাসা ১১ নং তালতলা বস্তি, থানা পল্লবী। আমার স্বামী ফজর আলীরা ৫ ভাই ছিলেন। বড় ভাসুরের নাম সেকেন্দার, মেজো ফজর আলী (আমার স্বামী), মন্টু, টুনটুনি ও আব্বাস। আমার শ্বশুরের নাম মৃত মানিক সরকার, শ্বাশুড়ির নাম গোলেহার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা সাভারে ছিলাম। সাভারে যাওয়ার আগে মিরপুর ১২ নম্বরে থাকতাম। ঐ বাসায় আমার শ্বাশুড়ি, ভাসুর, দেবর, আমি, আমার স্বামীসহ সবাই একত্রে বাস করতাম। ১২ নম্বর মুসলিম বাজার ছিল আমাদে বাসার ঠিকানা। টুনটুনির নামই পল্লব। পল্লব তখন মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বড় ছেলে ফারুক ৫ মাস বয়সের ছিল। আমার ও আমার স্বামীর ভোটার আই ডি কার্ড আমার কাছে আছে। পল্লবকে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আক্তার গুন্ডা আর বিহারীরা হত্যা করেছে। যুদ্ধের পর সাভার থেকে আমরা আবার মিরপুরে ফিরে আসি। মুসলিম বাজারের ঈদগা মাছে টুনটুনি ওরফে পল্লবকে আক্তার গুন্ডা ও বিহারীরা হত্যা করে। আমি শুনেছি আমার দেবর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারত যাচ্ছিল তখন নবাবপুর থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে এবং মুসলিম বাজারে তাকে হত্যা করে। আমি জনগণের কাছ থেকে শুনেছি পল্লবের হত্যাকান্ডের ঘটনা। ইতিপূর্বে এই মামলার ঘটনার ব্যাপারে আমি কারো কাছে কোন জবানবন্দী দেইনি।
রায় পর্যালোচনা-৩ :
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগের ভিত্তিও শোনা কথা//
কাদের মোল্লা হত্যাকান্ডে সশরীরে অংশ নেননি//
মেহেরুন্নেসার ঘরেও প্রবেশ করেননি
মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা হল মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ড।
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লাকে দন্ডিত করে প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে অভিযুক্ত কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে নিজে প্রবেশ করেননি হত্যাকান্ডের সময় । হত্যাকান্ডে কাদের মোল্লা নিজে সশরীরে অংশগ্রহণও করেননি। তবে যারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছেন এবং এ কাজে তার নৈতিক সমর্থন ছিল। কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমান নেই।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ হত্যাকান্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ অভিযোগের ভিত্তি হল সাক্ষীদের শোনা কথা।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রায় প্রদান করেন। দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়। একটিতে খালাস দেয়া হয়। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগটি ছিল দ্বিতীয় অভিযোগ। ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে পাঁচটি অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দন্ডিত করা এবং একটিতে খালাস দেয়া বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রত্যেকটি অভিযোগের সার সংক্ষেপ তুলে ধরে উভয় পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য, যুক্তি বিশ্লেষন করাসহ কেন কোন প্রেক্ষাপটে অভিযুক্তকে দণ্ড প্রদান বা খালাস দেয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দুই নং অভিযোগ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দন্ডিত করা বিষয়ে রায়ে যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করা হয়েছে তা শিরোনামসহ তুলে ধরা হল ।
২ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নং সেকশনে নিজ ঘরে থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা করে। এ হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং হত্যাকান্ড ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয় যা আইনে বর্নিত মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য।
সাক্ষী : রাষ্ট্রপক্ষ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ড বিষয়ে তিনজন সাক্ষী হাজির করে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষন করে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার অভিযোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ এবং ১০ নং সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন তারা জানতে পেরেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সহযোগী আক্তার গুন্ডা এবং অন্যান্যরা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তারা এ ঘটনা দেখেছেন তা দাবি করেননি।
আসামী নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে যে অর্থ দাড়ায় তাহল আসামী নিজে এ বর্বর হত্যাকান্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি।
সাক্ষ্য পর্যালোচনা : রাষ্ট্রপক্ষের ২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল এবং অন্যান্যরা মিলে ২৭ মার্চ কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই এবং মাকে করে হত্যা করে। জেরায় তার এ দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। জেরায় তিনি আবারো বলেছেন তিনি এ ঘটনা জনতার কাফেলার কাছ থেকে শুনেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের চার নং সাক্ষী কাজী রোজী আরেকজন শোনা সাক্ষী। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন যে, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি জানতে পেরেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই এবং মাকে হত্যা করেছে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। এর পরের বাক্যেই তিনি বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকান্ড পরিচালনা করে; কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে কবি মেহের এর ঘরে প্রবেশ করেছিল কি-না তা বলতে পারেননি সাক্ষী। দুই দিন পরে তিনি অবাঙ্গালী গুলজার এবং আরেকজন বিহারীর কাছ থেকে ঘটনা বিষয়ে জানতে পারেন।
উপরোক্ত দুই সাক্ষীর বক্তব্য জেরায় নির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করা হয়নি। উপরোক্ত শোনা কথার ভিত্তিতে আমরা একটি জিনিস পেয়েছি তা হল আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একটি দুর্বৃত্ত দল কবি মেহেরুননিসার ঘরে আক্রমন পরিচালনা করে। এ বিষয়টি আসামী পক্ষ জেরার মাধ্যমে দূর করতে পারেনি। আসামী নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া হয় তাহলে যে অর্থ দাড়ায় তাহল আসামী নিজে এ বর্বর হত্যাকান্ড ঘটানোর ক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি; যদিও তিনি দুর্বৃত্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নেতৃৃত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চার নং সাক্ষী।
রায়ে প্রশ্ন করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারকে কেন টার্গেট করা হল? এর ব্যাখ্যায় রায়ে বলা হয় চার নং সাক্ষী কাজী রোজী জানিয়েছেন যে, মিরপুরে বাঙ্গালীদের দুর্দশা দূর করার জন্য তারা একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলেন যার সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। ২৫ মার্চ সকালে তারা একটি মিটিং করেন এবং বাসায় ফেরার পর তিনি জানতে পারেন যে, তার এবং কবি মেহেরের ওপর আক্রমন করা হবে। তিনি মেহেরকে সতর্ক করে ছিলেন বাসায় না থাকার ব্যাপারে। তিনি (চার নং সাক্ষী) নিজে মিরপুর ছেড়ে গিয়েছিলেন।
রায়ে বলা হয় এ বিষয়টি জেরায় সম্পূর্ণভাবে থেকে গেছে। তাই এটা পরিস্কার যে, স্বাধীনতাপন্থী, প্রগতিশীল নাগরিক হওয়ায় এবং বাঙ্গালীদের দুর্দশা লাঘবে উদ্যোগী হওয়ায় ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর পরপরই আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে কবি মেহের এবং তার পরিবারের ওপর আক্রমন চালানো হয়।
রায়ে বলা হয় ২নং সাক্ষীর বর্ননা থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত যে, আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭০ এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী গোলাম আযমের পক্ষে প্রচারনায় অংশ নিয়েছে সক্রিয়ভাবে। তাই আমরা নির্ভুলভবে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্থানীয় বিহারী আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল গুন্ডা এবং অন্যান্যা বিহারী গুন্ডারা আব্দুল কাদের মোল্লার সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিল।
অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ড ঘটাননি বরং অন্য কোন এক কাদের মোল্লা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আসামী পক্ষ থেকে চার নং সাক্ষীকে জেরার সময় সাজেশন দেয়া হয় । সাক্ষী তা অস্বীকার করেন। আসামী পক্ষের এ সাজেশন থেকে এটা প্রমানিত যে, কাদের মোল্লা নামে একজন দুর্বৃত্ত এ ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে। কিন্তু সেই কাদের মোল্লা যে বর্তমানে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নয় এ মর্মে আসামী পক্ষ কোন প্রমান হাজির করতে পারেনি। কাজেই এ কুকর্মে সহকারি হিসেবে আব্দুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার পক্ষে প্রমান হিসেবে শোনা সাক্ষী ২ এবং ৪ এর দাবি যথেষ্ট নিশ্চয়তা প্রদান করে।
এ ঘটনার ব্যপারে রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী (১০ নং) হলেন সৈয়দ আব্দুল কাইউম। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে, অবাঙ্গালীরা কবি মেহেরুননিসা এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।
সাক্ষ্য মূল্যায়ন এবং প্রাপ্তি :
এখানে মূলত উভয় পক্ষের যুক্তি তুলে ধরে রায়ে বলা হয় আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুর রাজ্জাক এ নং অভিযোগ সম্পর্কে যা বলেছেন এ ক্ষেত্রেও তাই বললেন। তিনি বলেন, ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং আল বদর কোন সহযোগী বাহিনী ছিলনা। কাজেই তিনি এর সদস্য থাকলেও বলা যায়না তিনি কোন পাকিস্তান আর্মির সহযোগী সংস্থার সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে শুধুমাত্র রাজাকার বাহিনীকে গেজেটের মাধ্যমে আর্মির কমান্ডের অধীনে সহযোগী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আব্দুল কাদের মোল্লা সেসময় কোন রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এ কথা রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেননি। তিনি দাবি করেন তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমানিত হয়নি।
আসামী পক্ষের অপর বিজ্ঞ আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন সাক্ষী হাজির করেছে এবং তিনজনই বলেছেন তারা এ ঘটনা শুনেছেন। তাছাড়া আব্দুল কাদের মোল্লা এ কাজে সহায়তা করেছে মর্মে কোন প্রমানও রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি।
আব্দুস সোবহান তরফদার বলেন, চুতর্থ সাক্ষী কাজী রোজী ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামে একটি বই লিখেছেন যা এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। বইটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কাজী রোজী তার নিজের লেখা এ বইয়ে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লা সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেননি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতেও এ ঘটনা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।
তিনি বলেন, শোনা কথার কোন মূল্য নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, কবি মেহেরুন্নেসাকে মিরপুরের স্থানীয় অবাঙ্গালীরা হত্যা করেছে।
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ২ এবং ৪ নং সাক্ষীর শোনা কথা সম্পূর্ণরুপে নির্ভরযোগ্য এবং পারিপার্শিক অবস্থার প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাদের সাক্ষ্যের বিচাররিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, সহযোগী বাহিনীর সদস্য না হলেও ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনা যায় যদি দেখা যায় তিনি আইনের ধারা অনুসারে অপরাধ করেছেন।
রায়ে বলা হয়, ১৯৭২ সালের আইনে শোনা কথা (হেয়ারসে এভিডেন্স) গ্রহণযোগ্য। যদি এর বিচারকি মূল্য থাকে তবে তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করার এখতিয়ার রয়েছে ট্রাইব্যুনালের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশস সার্চ লাইট শুরুর পরপরই ২৭ মার্চ দুর্বৃত্তরা কবি মেহেরুন্নেসার পরিবারের ওপর হামলা করে এটা প্রমানিত এবং তিনি যে তার ঘরে নির্মম হত্যার শীকার হন তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই।
আসামী পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরায় এটাও প্রমান করতে পারেনি যে, এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকান্ড, কোন পরিকল্পিত এবং সিসটেমেটিক আক্রমনের অংশ নয়। কাজেই ঘটনার বিষয়বস্তু, ঘটনা এবং ঘটনার পারিপার্শিকতা বিবেচনায় এটা প্রমানিত যে, এটা ছিল মানবতা বিরোধী একটি অপরাধ।
২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামার সোনা কথার সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমানিত হয়েছে যে, ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমিম আব্বাস চেয়ারম্যান,ত হাক্কা গুন্ডা, আক্তার গুন্ডা, নেহাল এবং তাদের সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা করে। জেরায় আসামী পক্ষ এটি অস্বীকার করেছে কিন্তু দুর্বল করতে পারেনি। সাক্ষী শহিদুল হক মামা জনতার কাফেলা (ম্যাস পিপল) থেকে এ হত্যার ঘটনা শুনেছেন। আসামী পক্ষ এটা দুর্বল করতে পারেনি। তাছাড়া তখন সেখানে যে ভয়ানক পরিস্তিতি বিরাজ করে তাতে কোন বাঙ্গালীর পক্ষে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা স্বাভাবিক এবং সম্ববপর ছিলনা। কাজেই জনতার কাফেলা থেকে শোনাটাই স্বাভাবিক এবং সম্ভবপর। কাজেই ঘটনা পরম্পরা, ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং স্থানীয় বিহারীদের সাথে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার যোগসাজ সব বিবেচনা করলে ২ নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য বিবেচনায় নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
চার নং সাক্ষী কোজী রোজীর সোনা সাক্ষ্য বিবেচনা করা যাক এবার। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, তার এবং কবি মেহেরুন্নেসার ওপর আক্রমনের নির্দেশ দেয়া হতে পারে কারণ তারা অ্যকশন কিমিটর সাথে জড়িত ছিলেন যে কমিটি মিরপুরের দুর্দশাগ্রস্ত বাঙ্গালীদের সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছিল। এ ঘটনা অবিকৃত রয়েছে। এটা ইতোমধ্যে প্রমানিত হয়েছে যে, স্থানীয় বিহারী আক্তার গুন্ডা, নেহাল গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা এবং অন্যান্য বিহারী গুন্ডারা আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গী ছিল । কাদের মোল্লা এ গ্যাংদেরকে অপরাধ স্থলে নিয়ে যাবার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিল। চার নং সাক্ষী থেকে আমরা আরো প্রমান পেয়েছি যে আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে মেহেরুন্নেসার ঘরে প্রবেশ করেনি।
রায়ে বলা হয় এ থেকে আমরা নির্দিধায় একথা বলতে পারি যে, অপরাধ স্থলে গ্যাংদের নিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং অপরাধ সংঘটনের সাথে অভিযুক্তের যোগসাজসের বিষয়টি এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের হাতে যে তথ্য প্রমান এসেছে তাতে আমরা যা পেলাম সেটি হল আব্দুল কাদের মোল্লা দুর্বৃত্তদের নিরস্ত্র বেসামরিক ভিকটিম (মেহেরুন্নেসা) এর ঘরে নিয়ে যাবার নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমান নেই। কাজেই চার নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য, ঘটনার পারিপার্শিকতা, বিহারী দুর্বৃত্তদের সাথে সম্পর্ক এটা নির্দেশ করে যে, এ বর্বর এ ঘটনার সাথে তার একটা লিংক ছিল।
সেকশন ৩(২) ধারা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা সংঘটনের জন্য আসামীকে সশরীরে ঘটনা স্থলে উপস্থিত থাকতে হবে তা প্রতিষ্ঠার করার প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রপক্ষের। এ ধরনের অপরাধ সংঘঠনের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি যদি যেকোনভাবে প্রমানিত হয় তাহলে এর দায় দায়িত্ব হিসেবে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের দায় বর্তায় ।
আসামী পক্ষ দাবি করেছে চতুর্থ সাক্ষী কাজী রোজী বিশ্বাসযোগ্য নয় কারণ তিনি কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার তার নিজের লেখা বই ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ বর্নিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
সাক্ষী শীকার করেছেন যে, তিনি তার বইয়ে কারো নাম উল্লেখ করেননি কারণ তখন দুর্বত্তদের বিচারের কোন ব্যবস্থা ছিলনা। তিনি আরো বলেছেন দুর্বৃত্তদের ভয়ে তিনি দায়ীদের নাম উল্লেখ করেননি। এখন যেহেতু বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাই তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে রায়ের ব্যাখ্যায় বলা হয় কারো মৌখিক সাক্ষ্য পূর্বের বর্ননার সাথে হুবহু মিল নাও হতে পারে। পুর্বের সাক্ষাতকারে তাকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিচারের সময় তাকে তা থেকে ভিন্ন প্রশ্নও করা হতে পারে। এবং কোর্টে যখন তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করতে পারে। তাছাড়া সম্ভাব্য ভয়ের কারনে তাকে এটি থেকে বিরত রাখতে পারে বলে অনুমান করা যায়। এটা অনস্বিকার্য যে, উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ঐকমত্যের অভাবের কারনে ১৯৭১ সালে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধের অপরাধীদের বিচারের কাজ কয়েক দশক ধরে থেমে ছিল। এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান আবার চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে কোন বাঁধা ছাড়াই।
সে কারনে একজন স্বাধীনতাপন্থী ব্যক্তি হিসেবে ঝুকি এবং ভয়ের কারনে চতুর্থ সাক্ষী তার বইয়ে সবকিছু বর্ননা করেননি যে বই তিনি তার সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে লিখেছেন। তাছাড়া বইয়ে শুধুমাত্র দুর্বৃৃত্তদের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করা এবং বইয়ে কোন কিছু বাদ রাখার কারনে তিনি কোর্টে শপথ নিয়ে যা বলেছেন তা টিকবেনা তা নয়।
অপরাধীদের নেতৃত্ব নিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া নি:সন্দেহে অপরাধ সংঘটনের একটি অংশ এবং এটি অপরাধ সংঘটনে নৈতিক সমর্থন, উৎসাহ যোগানোর শামিল। অভিযুক্ত সশরীরে অপরাধ সংঘটনে অংশ নেননি শুধুমাত্র এ কারনে তাকে এর দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া যায়না যেহেতু অভিযুক্ত কর্তৃক নেতৃত্ব দিয়ে অপরাধীদের অপরাধ স্থলে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন এবং উৎসাহ যুগিয়েছে।
সুতরাং সরাসরি সাক্ষ্য নেই এ কারনে শোনা সাক্ষীকে পাশকাটিয়ে রাখা যায়না।
রায় পর্যালোচনা-৪ :
ফরমাল চার্জ, রায় এবং সাক্ষীদের বর্ননায় ঘটনার গরমিল//
সাংবাদিক আবু তালেব হত্যার অভিযোগের ভিত্তিও শোনা কথা
মেহেদী হাসান
আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা। এ ঘটনায়ও আব্দুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে দুজন সাক্ষীর শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে।
অপর দিকে খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা বিষয়ে একটি ক্ষেত্রে বিরাট গরমিল রয়েছে ফরমাল চার্জ ও রায়ে বর্নিত ঘটনার বিবরন এবং সাক্ষীদের জবানবন্দীর মধ্যে। ফরমাল চার্জ এবং রায়ে খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার যে বিবরন তুলে ধরা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে মিরপর ১০ নং বাস স্ট্যান্ড থেকে আবু তালেবকে কাদের মোল্লা অন্যান্য আলবদর, রাজাকার এবং বিহারী দৃস্কৃতকারীদের নিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানায় নিয়ে হত্যা করে। অপর দিকে এ ঘটনা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা বলেছেন খন্দকার আবু তালেব ইত্তেফাক থেকে মিরপুর বাসায় ফেরার পথে ইত্তেফাকেরই প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা বিহারী আব্দুল হালিম তাকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়। আব্দুল হালিম মিরপুরে পৌছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে খন্দকার আবু তালিবকে তোলে এবং তাকে কাদের মোল্লা/বিহারীদের হাতে তুলে দেয়।
খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পিতার হত্যা বিষয়ে। কিন্তু তিনি ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার সাথে বিস্তর গরমিল রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টের সাথে। সেখানে খন্দকার আবুল আহসান কর্তৃক বর্নিত তার পিতার হত্যার ঘটনার বর্ননায় দেখা যায় সেখানে আব্দুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করা হয়নি।
গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় দেন। তিন নং অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান বিষয়ে রায়ে বর্নিত বিশ্লেষন, মূল্যায়ন এবং যুক্তি নিম্নে তুলে ধরা হল।
৩ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নং সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নং বাস স্ট্যান্ডে পৌছার পর ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আল বদর সদস্যা, রাজাকার এবং দৃষ্কৃতকার এবং বিহারীদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে ফেলে। তারা খন্দকার আবু তালেবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়। একজন বেসামরিক ব্যক্তির হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ এবং সহাতার কারনে তার বিরুদ্ধে আইনে বর্নিত মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে ।
সাক্ষী : রায়ে বলা হয় এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ দুই জন সাক্ষী হাজির করেছে। এদের মধ্যে একজন হলেন খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান (৫ নং সাক্ষী) এবং অপর আরেকজন সাক্ষী হলেন খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু সৈয়দ আব্দুল কাইউম (১০ নং সাক্ষী)। তারা তখন মিরপুরে থাকতেন। তাদের দুজনেই এ হত্যাকান্ডের কথা শুনেছেন, দেখেননি।
সাক্ষ্য বিশ্লেষন : সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ২৫ মার্চ ইত্তেফাক অফিস গুড়িয়ে দেয়ার খবর শুনে তার পিতা খন্দকার আবু তালেব সেখানে যান তার সহকর্মীদের অবস্থা জানতে। তিনি সেখানে কিছু মৃতদেহ দেখতে পান। ২৯ মার্চ তিনি তাদের মিরপুর বাসায় আসছিলেন তার গাড়ি এবং টাকা নেয়ার জন্য। কিন্তু মিরপুর যাবার পথে ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা অবাঙ্গালী আব্দুল হালিমের সাথে দেখা হয় তার। আব্দুল হালিম তাকে পৌছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে ওঠান এবং আব্দুল কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যান। এরপর মিরপুর ১০ জল্লাদ খানায় তার পিতাকে আব্দুল কাদের মোল্লা হত্যা করে। এসময় আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে আক্তার গুন্ডা এবং আরো অবাঙ্গালী দুস্কৃতকারীরা ছিল।
সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান জেরায় জানান, তিনি অ্যাডভোকেট খলিল এর কাছ থেকে শুনেছেন যে, ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা আব্দুুল হালিম তার পিতাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছে। জেরায় তিনি আরো বলেন, তাদের অবঙ্গালী ড্রাইভার নিজাম তাকে বলেছেন যে, আব্দুল হালিম তার পিতাকে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
রায়ে বলা হয়, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান এর জবানবন্দী এবং জেরা বিশ্লেষন করলে দেখা যায় তার পিতাকে গাড়িতে করে আব্দুল হালিম কর্তৃক নিয়ে যাওয়া এবং আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীতের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী যে শোনা কথা বলেছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। তিনি যাদের কাছ থেকে তার পিতাকে তুলে নেয়ার ঘটনা শুনেছেন সেই অ্যাডভোকেট খলিল এবং নিজাম ড্রাইভার কেউ জীবিত নেই।
সাক্ষী বলেছেন, তিনি নিজে তার পিতার হত্যার ঘটনা দেখেননি এবং তখনকার পরিস্থিতিতে সীমিত কিছ বাঙ্গালী লোক ছাড়া এটা দেখা সম্ভব ছিলনা। এটা থেকে তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতি বোঝা যায় এবং খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার ঘটনা দেখা বিষয়ে সরাসরি সাক্ষী পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে বলে রায়ে বলা হয়।
রায়ে বলা হয় সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান আরো জানান যে, তিনি তাদের ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুরে মুসলিম বাজার, শিয়ালবারি, জল্লাদখানায় হত্যাকান্ড চালানো হয়।
১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম মিরপুরের বাসিন্দা এবং খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু ছিলেন। সৈয়দ আব্দুল কাইউম ২৩ মার্চ হামলায় আহত হন এবং তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো নয়। চিকিৎসা শেষে ২৭ মার্চ তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন জুন মাসে ফারুক খান তাকে তার গ্রামের বাড়ি নাসির নগরে দেখতে আসেন। ফারুক খানের কাছে তিনি শুনেছেন যে, স্থানীয় আক্তার গুন্ডা, বিহারী এবং কাদের মোল্লা তালেব সাহেবকে হত্যা করেছে মিপুর ১০ জল্লাদ খানায়। এছাড়া তালেব সাহেবের ড্রাইভার নিজামের কাছ থেকেও তিনি শুনেছেন যে, খন্দকার আবু তালেব মিরপুরে তার বাসায় আসার পথে ইত্তেফাকের অবাঙ্গালী হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা আব্দুল হালিম তাকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয় যারা তাকে মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় হত্যা করে।
সাক্ষ্য মুল্যায়ন : রায়ে বলা হয় খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। ৫ নং সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমানিত যে, খন্দকার আবু তালেব ২৯ মার্চ ইত্তেফাক এর অবাঙ্গালী একাউনট্যান্ট আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে মিরপুরে তার বাসায় আসছিলেন। তাকে আব্দুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা অস্বীকার করেছে আসামী পক্ষ। কিন্তু আক্তার গুন্ডা এবং স্থানীয় বিহারী কর্তৃক তাকে হত্যার বিষয়টি অবিকৃত রয়ে গেছে।
আসামী পক্ষ ৫ নং সাক্ষীর শোনা কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে সাক্ষী কর্তৃক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত স্টেটমেন্ট এবং কোর্টে প্রদত্ত জবানবন্দীর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন, অবাঙ্গী আব্দুল হালিম কর্তৃক খন্দকার আবু তালেবকে গাড়িতে করে নিয়ে আসা এবং আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীতের হাতে তুলে দেয়ার কথা তার কাছে বলেননি।
আসামী পক্ষ আরো যুক্তি উপস্থাপন করেছে যে, সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান এবং সৈয়দ আব্দুল কাইউম দুজনেই বলেছেন যে, তারা আবু তালেবকে আব্দুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন। কিন্তু সাক্ষী আব্দুল কাইউমও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ কথা বলেননি।
বরং এখানে যে বই প্রদর্শন করা হয়েছে (কবি মেহেরুন্নেসার ওপর লিখিত কাজী রোজীর বই) তাতে দেখা যায় সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, আবু তালেবকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
কাজেই আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক মিরপুরে নিয়ে আসা তাকে বিহারী কর্তৃক হত্যার ঘটনা আসামী পক্ষও অস্বীকার করছেনা। কিন্তু শোনা সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান তার পিতাকে তুলে দেয়ার বিষয়ে কোর্টে যা বলেছেন তার সাথে অমিল রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত স্টেটমেন্টে। কাজেই আসামী পক্ষের দাবি আবু তালেবকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়ার সাথে কাদের মোল্লার কোন সংযোগ ছিলনা এবং তিনি এ বিষয়ে কোন ভূমিকা পালন করেননি।
আসামী পক্ষ যুক্তি তুলে ধরে আরো বলে, ১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম এ ঘটনা প্রথম শুনেছেন ১৯৭১ সালে ফারুক খানের কাছে এবং এরপর তিনি তা শুনেছেন ১৯৭২ সালে বিহারী নিজাম ড্রাইভারের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন ফারক খানের কাছে তিনি শুনেছেন আবু তালেবকে বিহারী, আক্তার গুন্ডা এবং কাদের মোল্লা হত্যা করেছে মুসলিম বাজারে। কিন্তু ড্রাইভার নিজাম যেটা বলেছে তা হল বিহারীরা এবং আক্তার গুন্ডা আবু তালেবকে হত্যা করেছে । তার এ কথার সাথে মিল রয়েছে কাজী রোজীর লেখা বইয়ের তথ্যের সাথে। কাজেই কোনটা সত্য এ প্রশ্ন আসামী পক্ষের।
আসামী পক্ষের দাবি পরষ্পর বিরোধী শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়না।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন যে, ৫ নং সাক্ষী তাকে বলেছেন তিনি তার পিতাকে আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে নিয়ে আসার ঘটনা অ্যাডভোকেট খলিলের কাছ থেকে শুনেছেন। কাজেই এটা পরষ্পর বিরোধী হতে পারেনা।
রায়ে বলা হয়েছে, সকল ফৌজদারি কেসে মানুষের সাধারন পর্যবেক্ষন, সময়ের ব্যবধানে স্মৃতি লোপ পাওয়া, শোকাবহ ঘটনার কারনে মানসিক পীড়ন প্রভৃতি কারনে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে গোলযোগ ঘটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কাজেই ছোটখাট বৈপরিত্য, অসামাঞ্জস্য এবং অমিলের কারনে পুরো বিষয়কে বাতিল করা যায়না।
ঘটনার দিন আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক গাড়িতে করে নিয়ে আসা, তাকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়া এবং জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা অবিতর্কিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ৫ এবং ১০ নং সাক্ষীর শোনা কথা বিশ্বাসযোগ্য, প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় এবং এর বিচারকি মূল্য রয়েছে।
রায়ে বলা হয় ২ নং সাক্ষীর (শহিদুর হক মামা) কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি আব্দুল কাদের মোল্লার সহযোগী কারা ছিল এবং তাদের সাথে তার কিরকম যোগসাজস ছিল; বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে । এটা প্রমানিত যে, ২৫ মার্চ এর আগে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের বর্বরতার ঘটানোর ক্ষেত্রে আব্দুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল স্থানীয় বিহারী আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাসিব হাশমি। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর চার দিনের মাথায় ২৯ মার্চ আবু তালেব হত্যার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় বিহারী গুন্ডাদের সাথে কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠতা, তার ভূমিকা এবং কর্মকান্ড বিষয়ে ২ নং সাক্ষীর কাছ থেকে আমরা পরিস্কার বর্ননা পেয়েছি। কাজেই আবু তালেব হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লা সহযোগীতার বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক।
উপরোক্ত প্রমানাদি এবং ৫ নং সাক্ষীর সাক্ষ্য একত্র করলে দেখা যায় যায় যে, আব্দুল কাদের মোল্লা, আক্তার গুন্ডা এবং কিছু অবাঙ্গালী দৃস্কৃতকারী জল্লাদখানায় ছিল যখন খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার সহযোগিতার বিষয়টি ভালভাবে প্রমানিত। কাজেই আমরা নিশ্চিত যে, ৫ নং সাক্ষীর শোনা কথার বিচারিক মূল্য রয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক।
রায়ে বলা হয়েছে মিরপুরে ১০ ভাগ বাঙ্গালী ছিল। নিজ বাঙ্গালীদের সহযোগিতার বদলে আব্দুল কাদের মোল্লা সব সময় বাঙ্গালী বিদ্বেষী বিহারী গুন্ডা বিশেষ করে আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল এদের সাথে থাকত কেন? তার এ সহযোগিতা বিহারীদের স্বাধীনতাপপন্থী বাঙ্গালী নিধনে উৎসাহ যোগিয়েছে।
রায়ে বলা হয় পারিপার্শ্বিক বিষয় সরাসরি সাক্ষ্যের তুলনায় কম মূল্য বহন করেনা। উপরে যে সাক্ষ্য বিশ্লেষন করা হয়েছে তাতে আবু তালেব হত্যার ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমান করে। আক্রমনের বিষয় এবং ধরন থেকে এটা বোঝা যায় যে, এটি ছিল নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমনের একটি অংশ। খন্দকার আবু তালেব ছিলেন একজন স্বাধীনতাপন্থী নাগরিক। কাজেই এ হত্যার ঘটনা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আমরা আগেই বলেছি যে, অপরাধ ঘটানোর সময় অভিযুক্ত’র সশরীরে হাজির থাকতে হবে বিষয়টি এমন নয়। যদি এটা দেখা যায় যে, তিনি এ ঘটনা ঘটার বিষয়ে জ্ঞাত তাহলে বলা যায় তার এতে অংশগ্রহণ রয়েছে।
জল্লাদখানা যাদুঘরের ডকুমেন্টে যা রয়েছে :
শহীদ খন্দকার আবু তালেব, পল্লব হত্যাকান্ড এবং হযরত আলী হত্যাকান্ডসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড বিষয়ে শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের সাক্ষাতকার, লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে জল্লাদখানা যাদুঘরে। মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত পাম্প হাউজে এনে ১৯৭১ সালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে জল্লাদ খানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরের অংশ। জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন সময়ে তাদের সাক্ষাতকার বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
সেখানে শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব সম্পর্কে তার ছেলে খন্দকার আবুল আহসানের বক্তব্য রেকর্ড করা আছে যিনি ট্রাইব্যুনালেও সাক্ষ্য দিয়েছেন। সে রেকডে দেখা যায় খন্দকার আবুল আহসান তার পিতার হত্যার ঘটনার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করেননি।
এই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে খন্দকার আবুল আহসান কর্তৃক আবু তালেব হত্যা ঘটনার যে বিবরন উল্লেখ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ।
‘আজ দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করার সমস্ত পথ পাকিস্তানি হায়েনারা বন্ধ করে দিয়ে করেছে এতিম, মাকে করেছেন উন্মাদিনী, পাগল ও বিধবা। একজনের অনুপস্থিতি একটা পরিবারের সহায়-সম্বলহীন করে দেয় তার জ্বলন্ত সাক্ষী এই শহীদ খন্দকার আবু তালেবের পরিবার।
আমার বাবা ছিলেন কর্মমুখী, দায়িত্বশীল, পরোপকারী এবং স্বাধীনচেতা একজন মানুষ জ্ঞানচর্চা, তার পছন্দের বিষয় ছিল। আমাদের ভাই-বোনের সাথে তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুসুলব। আমাদেরকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর আমাদের সে রকম সুযোগ হয়নি ভালভাবে পড়ালেখা। আমাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। যুদ্ধের সময় দেশে মা ও ভাই-বোনকে টাকা পাঠাতাম ঢাকায়-- বিক্রি করে। আমাদের পরনে কাপড় পর্যন্ত ছিল না। আর্থিক দৈন্যের কারণে গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে লেখা করতে হয়েছে। বড় ভাইও অনেক কষ্ট করেছেন। স্বাধীনতার পর পরই তিনি প্রথমে গণ--- ৭৪ সালে দৈনিক অবজারভারে চাকরি করে সংসারের ভরণ-পোষণ করেছেন। কষ্ট করতে করতে উন্মাদিনী মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আর্থিক দৈন্য না কাটলেও আমরা বেঁচে আছি।
কারো কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। সকল শহীদ পরিবারের মতো শহীদদের স্বপ্ন--- দেশই আমাদের একান্ত কাম্য।’
রায় পর্যালোচনা৫
আলুবদি হত্যাকান্ড এবং যাবজ্জীন কারাদণ্ড বিষয়ে রায়ে যা বলা হয়েছে
মেহেদী হাসান
আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারদন্ড প্রদান করা হয় তার মধ্যে একটি হল মিরপুরের আলুবদি গ্রামে গণহত্যার ঘটনা। আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এটি ছিল পাঁচ নং অভিযোগ। এ ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান বিষয়ে রায়ে উভয় পক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষন, ঘটনার বিবরন, মুল্যায়ন প্রভৃতি শিরোনামে যা বলা হয়েছে তা নিম্নে তুলে ধরা হল।
৫ নং অভিযোগ : রায়ে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৫ নং অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরন তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে চারটার সময় আব্দুল কাদের মোল্লার সদস্যরা (মেম্বারস) পাকিস্তান আর্মি সাথে নিয়ে মিরপুর পল্লাবীর আলুবদি গ্রামে নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর আক্রমন পরিচালনা করে । আক্রমনের অংশ হিসেবে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং এতে ৩৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়। এ গণহত্যায় সহায়তার অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
সাক্ষী : রায়ে বলা হয়েছে এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ দুই জন সাক্ষী হাজির করেছে। তারা হলেন ৬ নং সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা এবং ৯ নং সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা। তারা দাবি করেছেন তারা এ গনহত্যা দেখেছেন এবং আব্দুল কাদের মোল্লা মূল নায়ক হিসেবে এতে অংশগ্রহণ করে। তারা সে সময় ওই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
৬ নং সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা : এ সাক্ষী জানিয়েছেন তার বয়স তখন ১৯ বছর ছিল। ২৪ এপ্রিল সকালে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। তিনি দেখলেন গ্রামের পশ্চিম পাশে নদীর ধারে হেলিকপ্টার নামছে। এরপর নির্বিচারে গুলির শব্দ শুনে ভয়ে ভীত হয়ে দৌড়ে গ্রামের মধ্যে চলে আসলেন । এখানে সেখানে অনেক মৃতদেহ দেখলেন তিনি। গ্রামের উত্তর দিকে ঝোপের নিচে লুকিয়ে থাকলেন এরপর । সেখান থেকে তিনি দেখলেন গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে পাকিস্তান আর্মি গ্রামবাসী এবং ধানকাটা কৃষকদের ধরে আনছে। এরপর তিনি আরো দেখলেন আব্দুল কাদের মোল্লা, তার বিহারী দুস্কৃতকারী সহযোগী এবং পাকিস্তান আর্মি পূর্ব দিক থেকে গ্রামবাসী এবং ধানকাটা কৃষকদের ধরে নিয়ে আসছে এবং তাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করছে।
একটু পরে সাক্ষী দেখলেন আব্দুল কাদের মোল্লা পাকিস্তান আর্মিদের সাথে উর্দু ভাষায় কথা বলছেন। তবে তিনি তা ঠিকমত শুনতে পাননি। এরপর ধরে আনা লোকজনের ওপর গুলি শুরু হল এবং আব্দুল কাদের মোল্লা নিজেও গুলি করে রাইফেল দিয়ে। এভাবে তারা ৩৬০/৩৭০ জনকে হত্যা করে । এর মধ্যে ৭০/৮০ জন ছিল ধানকাটা কৃষক। তার মধ্যে একজন ছিল সাক্ষীর নিজের চাচা নবিউল্লাহ। সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে এ আক্রমন। এসময় তারা লুটপাট এবং গ্রামের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
ঘটনা বিশ্লেষন করে রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে, সাক্ষী কর্তৃক এ ঘটনা দেখা, পাকিস্তান আর্মির উপস্থিতিতে আব্দুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে গুলি করতে দেখার ঘটনা সাক্ষী মিথ্যা বলছে তার কোন কারণ আমরা দেখছিনা।
প্রশ্ন হল কাদের মোল্লাকে সে তখন চিনল কিভাবে। তিনি কি তাকে আগে থেকে চিনতেন? সাক্ষী বলেছেন তিনি তখন ছাত্রলীগ করতেন এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিনের পক্ষে প্রচারনায় অংশ নিয়েছেন। আব্দুল কাদের মোল্লা তখন ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর দাড়িপাল্লা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারনা করেছেন। ২ এবং ৫ নং সাক্ষীও এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ৫ নং সাক্ষী বলেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা তখন মিরপুর দুয়ারিপাড়ায় থাকতেন। এ থেকে বোঝা যায় সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা ঘটনার আগে থেকেই আব্দুল কাদের মোল্লাকে চিনতেন।
রায়ে বলা হয় রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নং সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা বলেছেন আলুবদি গ্রামে প্রায় ৪০০ লোক হত্যার ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লা সরাসরি অংশ নিয়েছেন। ৫ নং সাক্ষীও একথা বলেছেন।
৯ নং সাক্ষী তখন আলুবদি গ্রামে থাকতেন এবং তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ৯ নং সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা বলেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা ছাত্রসংঘের ৭০/৮০ জন লোকজন নিয়ে বিহারীদের প্রশিক্ষন দিয়েছে পাকিস্তান রক্ষার নামে। এ থেকেও বোঝা যায় তিনিও আগে থেকেই আব্দুল কাদের মোল্লাকে চিনতেন।
এ সাক্ষী বলেছেন ২৪ এপ্রিল ফজরের সময় গ্রামের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর তীরে হেলিকপ্টার নামে। পূর্ব পাশ থেকে ১০০/১৫০ জন বিহারী এবং বাঙ্গালী নিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা গ্রামে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলি চালায়। এরপর তারা ৬৪/৬৫ জন গ্রামবাসীকে ঘর থেকে ধরে এনে গ্রামের উত্তর পাশে লাইনে দাড় করায়। ৩০০/৩৫০ জন ধানকাটা কৃষক যারা গ্রামে আসছিল ধানকাটার জন্য তাদেরও ধরে একই স্থানে লাইনে দাড় করিয়ে গুলি চালায়।
৯ নং সাক্ষী বলেছেন তিনি দেখেছেন সেখানে আব্দুল কাদের মোল্লা রাইফেল হাতি দাড়িয়ে ছিল। আক্তার গুন্ডার হাতেও রাইফেল ছিল। তারাও পাঞ্জাবীদের (পাকিস্তান আর্মি) সাথে গুলি চালায়। সেখানে প্রায় ৪০০ লোক মারা যায়। সাক্ষী জেরায় বলেছেন তিনি আক্তার গুন্ডাকে চিনতেন এবং তাকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পর জেলে পাঠানো হয়েছিল। জেরায় তিনি আরো বলেন তিনি এবং তার পিতা গ্রামের পশ্চিম-উত্তর পাশে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেন। এ ঘটনায় তাদের ২১ জন আত্মীয় স্বজন প্রাণ হারায়।
মূল্যায়ন : রায়ে বলা হয় আসামী পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ৬ এবং ৯ নং সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয় কারণ তাদের দুই জনের তথ্যে গরমিল রয়েছে। তারা ওই সময় গ্রামেও ছিলনা। ৬ নং সাক্ষীকে ওই দিন খুব সকালে সাভারের বিরুলিয়া পাঠিয়েছিলেন তার চাচা নবিউল্লা। আসামী পক্ষের ৫ নং সাক্ষী আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ট্রাইব্যুনালে একথা বলেছেন। আলতাফ উদ্দিন মোল্লা রাষ্ট্রপক্ষের ৬ নং সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লার ছোটভাই। (শফিউদ্দিন মোল্লা রাষ্ট্রপক্ষে এবং তার ছোট ভাই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে)।
আসামী পক্ষের আইনজীবী দাবি করেছেন ৯ নং সাক্ষীর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় কারণ তার বিরুদ্ধে অসংখ্য ফৌজদারি মামলা ছিল।
রায়ে মন্তব্য করা হয় সিভিল এবং ক্রিমিনাল কেসে জড়িত থাকলেই একজন যে খারাপ চরিত্রের অধিকারী তা বোঝায় না এবং এ কারনে তার শপথসহ সাক্ষ্য উড়িয়ে দেয়া যায়না।
তাছাড়া ৬ নং সাক্ষীর ছোট ভাই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা যিনি আসামী পক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি তখন ওই গ্রামে ছিলনা এবং তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর।
রায়ে বলা হয় ২৫ মার্চ গনহত্যার মাত্র এক মাসের মাথায় মিরপুরের এ ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান আর্মি হাজার মাইল দূর থেকে এখানে আসে। গ্রাম সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা না থাকা স্বাভাবিক । গ্রামের কোথায় কি রয়েছে তাও তারা জানতনা। পাকিস্তান সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কখন কিভাবে এবং কোন গ্রুপকে আক্রমন করতে হবে সে বিষয়েও তাদের ধারণা ছিলনা। স্বাভাবিকভাইে স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী লোকজনই তাদেরকে এ কাজে গাইড করেছে। এরপর রায়ে বলা হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিবেচনায় আমরা এ বিষয়টি কমন নলেজ হিসেবে নিতে পারি।
পাকিস্তান সৈন্যদের তখন স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী এবং জামায়াতে ইসলামের সাথে জড়িতদের সহায়তা নিতে হয়েছিল। আব্দুল কাদের মোল্লা তখন জামায়াতের ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম লিখিত জীবনে যা দেখলাম বইয়েও এ তথ্য রয়েছে।
রায়ে বলা হয় সাবির্ক ঘটনা এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা এটা বিশ্বাস করতে পারি যে, ৬ নং সাক্ষী কর্তৃক আব্দুল কাদের মোল্লাকে ঘটনা স্থলে রাইফেল হাতে দেখা কথা সত্য। তিনি নিজেও গুলি চালিয়েছেন রাইফেল দিয়ে । তবে গনহত্যার মূল হোতা ছিল পাকিস্তান আর্মি।
রাষ্ট্রপক্ষের ৬ নং সাক্ষীর ছোট ভাই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা আসামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন । তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন মূলত আসামীকে এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়ার জন্য। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। গনহত্যার ঘটনা তিনি অস্বীকার করেননি।
আসামী পক্ষের সাক্ষী আলতাফ উদ্দিন মোল্লা বলেছেন সাভারে বিরুলিয়ায় তাদের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে আক্তার গুন্ডা, ডোমাম গুল মোহাম্মদসহ ৪/৫ হাজার বিহারী পাকিস্তান আর্মির নেতৃত্বে আলুবদি গ্রামে আক্রমনের পর তারা বিরুলিয়ায় আশ্রয় নেন। তিনি বলেছেন তার বড় ভাই শফিউদ্দিন মোল্লা তখন গ্রামে ছিল এবং ২৪ এপ্রিল যেদিন সকালে গ্রামে হেলিকপ্টার নামল সেদিন সকালে তার চাচা নবিউল্লাহ তাকে বিরুলিয়ায় পাঠিয়েছিল। তিনি (আলতাফ উদ্দিন মোল্লা) এটি ঘটনা জানল কি করে? তার ব্যাখ্যা করা হয়নি।
রায়ে বলা হয় নিবউল্লাহ ওই ঘটনায় মারা যায়। কাজেই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা কেমন করে জানল যে, তার বড় ভাই শফিউদ্দিন মোল্লাকে নবিউল্লা বিরুলিয়ায় পাঠিয়েছিল? এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বিস্মিত। এ বিষয়ে আলতাফ উদ্দিন মোল্লা নিশ্চুপ। তিনি ঘটনার আগে থেকেই বিরুলিয়ায় তার পরিবারের সাথে থাকতেন। কাজেই এটা সত্য হলে আব্দুল কাদের মোল্লা এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিল কি-না তা বলার উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি নন। তিনি বলেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা তখন ঘটাস্থলে ছিলনা এবং তিনি তাকে দেখেননি। তিনি আরো বলেছেন এ মামলা শুরুর আগে তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার নামও শুনেননি। এটাও যদি সত্য হয় তাহলে আব্দুল কাদের মোল্লা এ ঘটনায় ছিল কি-না তাও তার জানার কথা নয়। আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে ছিলনা বলে যেকথা তিনি বলেছেন তাও অসত্য হিসেবে গন্য এবং এ ঘটনার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা থেকে তাকে রেহাই দেয়ার জন্য তিনি এটি বলেছেন।
আসামী পক্ষ বলেছে, ৯ নং সাক্ষী আব্দুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছে এবং অংশগ্রহণ করেছে এবং ৪০০ লোক হত্যা করা হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে যে কথা বলেছে সে কথা সে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেনি। আসামী পক্ষের এ দাবি অস্বীকার করেছে সাক্ষী। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, সাক্ষী তাকে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে অসিম, আক্তার গুন্ডা, নওয়াজ, লতিফ, ডোমাসহ ১৪০-১৫০ জন লোক আলুবদি গ্রামে হামলা চালায়।
রায়ে বলা হয় ৪০ বছর আগের ঘটনা বর্ননায় সামান্য এদিক সেদিক হওয়া অস্বাভিক নয়।
৯ নং সাক্ষীর বিরুদ্ধে ক্রিমানল কেসের সাথে জড়িত বিধায় তার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই বলে আসামী পক্ষের দাবির সাথে আমরা একমত নই। ক্রিমিনাল কেসের সাথে জড়িত থাকলেই তার চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হবে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারবেননা তা নয়। এমনিক কারো যদি ক্রিমিনাল কেসে সাজাও হয় এবং অপরাধ ঘটিয়েও থাকে তবু আমরা তার সাক্ষ্য বাতিল করার প্রয়োজন মনে করিনা। ফৌজাদারি অপরাধে সাক্ষীর সাজা হওয়া এবং অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত হওয়ার বিষয়টি কোর্টে প্রদত্ত সাক্ষ্যকে প্রভাবিত করে কি-না সেটা হল দেখার বিষয়। এ বিষয়টি কিভাবে তার সাক্ষ্যকে প্রভাবিত বা দুর্বল করেছে তা আসামী পক্ষ প্রমান করতে পারেনি।
রায়ে বলা হয় এটা সন্দেহাতিতভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, আব্দুল কাদের মোল্লা ঘটনার ঘটনাস্থলে সময় উপস্থিত ছিল। তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তা করেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন এবং জঘন্য এ গনহত্যায় তার নৈতিক সমর্থন ছিল। আব্দুল কালে মোল্লা শুধুমাত্র ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল আমরা যদি শুধু এটুকুও ধরে নেই তবু এর দায় এবং এর প্রতি নৈতিক সমর্থন তিনি এড়াতে পারেননা।
কাজেই আসামী আব্দুল কাদের মোল্লা রাইফেল হাতে ঘটনা স্থলে উপস্থিত ছিল অন্যান্যদের সাথে নিয়ে এ বিষয়টি আইনগতভাবে এবং বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে পেরেছে।
Verdict analysis of abdul kader mollah
International Crimes Tribunal, Bangladesh
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন