বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৩

স্কাইপ সংলাপের বিষয়বস্তু


বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদ জিয়া উদ্দিনের সাথে যেসব কথাবর্তা বলেছেন তার মধ্যে  রয়েছে  অভিযুক্তদের  মামলার শুনানী কখন হবে, কোন মামলার রায় আগে হবে, কোনটার  রায় পরে  হবে, কোন ট্রাইব্যুনালে কোন মামলায় কতজন সাক্ষী আসামী পক্ষকে আনতে দেয়া হবে, রায়ের কাঠামো কি হবে,  অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় সাক্ষী  সুলতানা কামাল, মুনতাসির মামুন এবং জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে দিয়ে কোন কোন বিষয় কিভাবে বলানো হবে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।  বিচারের রায়ের কাঠামো কি হবে সে বিষয়ে  বেলজিয়াম থেকে আহমেদ  জিয়া উদ্দিনের মাধ্যমে লিখিয়ে আনা বিষয়ে  তথ্য আদান প্রদান হয়।  পুরো বিচার প্রকৃয়া নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সাথে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের  গোপন যোগসাজস, আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রীর সাথে যোগসাজসসহ বিচার  কার্যক্রমের সাথে যে  বাইরের আরো  বিভিন্ন মহলের প্রভাবে  এবং ইশারা ইঙ্গিতে চলেছে  তা জানা যায় এ সংলাপ ফাঁস হওয়ার  মাধ্যমে।  বিশেষ করে সুদুর বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থানরত ড, আহমেদ জিয়াউদ্দিনই যে এ বিচারের বিভিন্ন গতি প্রকৃতি নির্ধারন  করে দিচ্ছিলেন তা স্পষ্ট হয়েছে। ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন  এ বিচার প্রকৃয়ার গতি প্রকৃতি নির্ধারনের জন্য  কোন কোন ব্যক্তি এবং মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তাও  স্পষ্ট হয়ে যায়।    এ কারনে দেশের আইনজ্ঞ মহল থেকে বলা হয়েছে এ বিচার যে একটি সাজানো নাটক এবং প্রহসন ছিল তা প্রমানিত হয়েছে।

বিচারপতি নিজামুল   হকের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে  ড. জিয়াউদ্দিন কোন ট্রাইব্যুনালের কোন মামলা  এগিয়ে আনতে হবে, কোনটি পিছিয়ে দিতে হবে সেজন্য দুই ট্রাইব্যুনালের সব বিচারপতিদের আইনমন্ত্রীর বাসায় তিনি বসার ব্যবস্থা করবেন  বলে স্কাইপির মাধ্যমে আলাপকালে জানান বিচারপতি নিজামুল হককে।

বিচারপতি নিজামুল হক আলোচনার এক পর্যায়ে বলেন, “গভর্নমেন্ট রায়ের জন্য পাগল হইয়া গেছে। সাঈদীরটা হলে ডিসেম্বরের মধ্যে রায় দেতে পারবো। গভর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া। তারা একটা রায় চায়।  সাঈদীর রায়ডা হইয়া গেলে গভর্নমেন্ট ঠাণ্ডা হইত।..আমাদের তো স্টেট মিনিস্টার (কামরুল ইসলাম) যাচ্ছে হজে। আজকে আসছিল আমার লগে দেখা করতে সন্ধ্যায়। ওনি বললেন যে রায়টা তাড়াতাড়ি দেবেন। ”

৬ সেপ্টেম্বরের কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, ‘সিনহা বাবু কইছে-ডিসম্বরের মধ্যে তিনডা দিয়া লন, তারপর আমরা আপনারে এহানে নিয়া আসি।’
চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের কাছে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম জানতে চান, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চার্জের  কপিটা আছে কি না। তিনি এ-ও বলেন, ‘থাকতেই হবে, থাকতেই হবে। তো, এই জিনিসগুলোর রিপলাইডা আপনি যদি একটু ইয়ে করে দেন আমাকে। তাইলে আমি জাজমেন্টর জন্য একটু রেডি হইতে পারি।’
একই দিনের স্কাইপি কথোপকথনে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম  বলেন, ‘জাজমেন্টের কাজ তো শুরু করছি আমি, অন্য কাজ ফেলাইয়া টাইপ শুরু করছি আমি।’ তখন তাকে আহমদ জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘আপনি ওই জায়গাটাকে, আপনি করেন কি যে... এ জায়গাটিতে একটু গ্যাপ রাখেন। কারণ এখনও লিগ্যাল আরগুমেন্ট কিন্তু তারা প্লেস করে নাই।’  এ থেকে বোঝা যায়  আরগুমেন্ট শুরুর আগেই বিচারপতি নিজামুল হক  রায় লেখার কাজ শুরু করে দেন এবং রায়ের কিছু বিষয় লিখে পাঠানোর জন্য ড. আহমদ জিয়াউদ্দিনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন।

নিজামুল হক নাসিম  নাসিম সংলাপের সময় বলেন, “এই গোলাম আযম হইলো টিম লিডার। সাঈদী সাইড ট্র্যাক। সাঈদীর লগে আপনার লিডার-টিডারশিপের কোনো প্রশ্ন আসতেছে না। গোলম আযমের রায়ের পরে আপনার নিজামী, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান—সবগুলা রায় হইতে পারে, এর পরে। কিন্তু গোলাম আযম ফাস্টে। ওই গ্রুপের থেকে একমাত্র সাঈদী, সাকা এরা বায়রায় (বাইরে)। সাকারে তো আমি থামাইয়াই দিছি। সাঈদীরে থামাচ্ছি না। কারণ, সাঈদী প্রায় শেষ। এইটা যদি উনাদেরকে বইল্লা... এইডা ওনাদেরকে (ট্রাইব্যুনাল-২) হায়ার লেভেল থেইকা বইল্লা, থামায়া দিতে হবে যে, আপনি কাদের মোল্লারে ঢিল দেন। ঢিল দিয়া বাকিগুলারে সামনে আগান। কেননা, ওই যে অ্যাবসেন্ট যে আছে, ওর নাম জানি কী...? ও বাচ্চু, হ্যারে দিয়া শুরু করেন। আরেকজনরে নিয়া আগান সামনে। এরপর আপনার, পর পর ৩-৪টা রায় দিয়া দেন, অসুবিধা নাই কোনো। বাট আফটার গোলাম আযম। নট বিফোর দ্যাট।”

বিচারপতি জহির আহমেদকে পদত্যাগে বাধ্য করার পর নতুন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। এ বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ড. জিয়াউদ্দিনের সাথে।  বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের  বিষয়ে তিনি বলেন,  “তাকে বলে দেয়া হয়েছে চেয়ারম্যান যা বলবে তুমি তাতে শুধু ইয়স বলবা।  তুমি যা বলবা রুমে বলবা, কোর্টে চেয়ারম্যান যা বলবে তাতে ওকে বলবা”
এছাড়া বিচারপতি নিজামুল   হক ট্রাইব্যুনালের নতুন সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে সোনা জাহাঙ্গীর, দুর্নীতি পরায়ন বলেছেন। আইনপ্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে কামরুল টামরুল, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে খাতুন টাতুন সহ আরো  বিভিন্ন ব্যক্তিকে চোরসহ বিভিন্নভাবে ব্যাঙ্গ করে কথা বলেছেন। তাদেরকে আওয়ামী বলে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন। (বিচারপতি নিজামুল হক ছাত্র জীবনে জাসদ ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন)।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হকের বিষয়ে বিচারপতি নিজামুল হক বলেন আমরা দুইজন শক্ত আছি।
এসব আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে  ট্রাইব্যুনালে তিনজন সদস্য থাকলেও মূলত বিচারপতি নিজামুল হকের একক সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হত। এবং তার সিদ্ধান্ত গ্রহনের পেছনে বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি, মহলের প্রভাব ছিল।

বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম আলোচনার এক পর্যায়ে  বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমকে শুধু লাফায়। আমি তাকে বসিয়ে দিয়েছি। পরে তাকে রুমে ডাকাই। মালুম বলে এটাই ঠিক আছে। আমি শুধু দাড়িয়ে যাব আপনি আমাকে বসিয়ে দেবেন। লোকে দেখবে আমাদের মধ্যে কোন খাতির নেই।

ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি জহির আহমেদকে সচিবালয়ে ডেকে  আইনমন্ত্রলয় পদত্যাগে বাধ্য করেছিল সে বিষয়টিও উল্লেখ আছে বিচারপতি নিজামুল হকের সংলাপে।   এ সংলাপ থেকে জানা যায় বিচারক জহির আহমেদকে আইনমন্ত্রীর বাসায় ডেকে প্রথমে পদত্যাগ করতে বলা হয়।  এরপর সচিবালয়ে ডেকে পদত্যাগে স্বাক্ষর রাখা হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন