বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৩

আইনজীবীরা মারমুখী হয়ে তেড়ে গেলেন পরষ্পরের দিকে


১/১/২০১৩
স্কাইপ কেলেঙ্কারি  বিষয়ে আবেদনের শুনানীর সময় আজ  আন্তর্জাতিক অপরাধ  ট্রাইব্যুনালে (১) দফায় দফায় তীব্র হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপক্ষ, আসামী পক্ষের আইনজীবী এবং  আসামী  একে অপরের প্রতি অকথ্য ভাসায়   আক্রমন  করে গালিগালাজে লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে উভয় পক্ষের আইনজীবীরা পরষ্পরের প্রতি মারমুখী হয়ে  তেড়ে যান।  উত্তেজনাকর পরিস্থিত সৃষ্টির সাথে সাথে ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালনরত বিপুল সংখ্যাক পুলিশ ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রবেশ করে আইনজীবীদের  নিয়ন্ত্রনে আনে।

২০১০ সালের মার্চ মাসে যাত্রার পর থেকে এর আগেও  বেশ কয়েকবার ট্রাইব্যুনালে উত্তেজনাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি  হয়েছে কিন্তু আজকের মত পরিস্থিতি এর আগে কখনো  হয়নি।

স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন  কাদের চৌধুরী বেশ কয়েকটি আবেদন করেন ট্রাইব্যুনালে। এসব আবেদনের বিরোধীতা করে রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি পেশের এক পর্যায়ে কাঠগড়ায়  বসা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার বিরোধীতা করে কিছু মন্তব্য করেন। তখন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পেছন ফিরে তার প্রতি ধমকের সুরে   ‘চুপ’ বলেন। সাথে সাথে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীও তীব্র  হুঙ্কার দিয়ে  তাকেও চুপ করতে বলেন।  সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং মাহবুবে আলমের মধ্যে তীব্র বাগি¦তন্ডা চলে। এসময় রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামী পক্ষের আইনজীবীরাও উচ্চস্বরে আক্রমনাত্মক   কথা বলতে থাকেন পরষ্পরের দিকে লক্ষ্য করে। এর এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বেঞ্চে বসা একজন সহকারি এটর্নি জেনারেল  দাড়িয়ে  হাত উচিয়ে উচ্চস্বরে  চুপ বলতে বলতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দিকে তেড়ে যেতে থাকেন। তখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং  উক্ত সহকারি এটর্নি জেনারেল পরষ্পরকে অকথ্য  ভাষায় আক্রমন করতে থাকেন। এ পর্যায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে একজন জুনিয়র  আইনজীবীও মারমুখী হয়ে সহকারি এটর্নি জেনারেলের দিকে ছুটে আসতে থাকেন আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে। এ পর্যায়ে উভয় পক্ষের এ দুজন আইনজীবীর মধ্যে তীব্র আক্রমনাত্মত বাক্য বিনিময় চলতে থাকে। কোর্টের বাইরে একে অপরকে দেখে নেয়ার হুমকি দিতে থাকেন পরষ্পরকে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী  চিৎকার করে বলতে থাকেন আমাকে ছেড়ে দে। তারপর আমার সামনে আয় দেখি কার কত ক্ষমতা।
তীব ্রহট্টগোলের শব্দে  আদালত কক্ষের বাইরে  দায়িত্বরত  প্রায় ২০ জনের মত পুলিশ কোর্টরুমে প্রবেশ করে  আক্রমনাত্মক আইনজীবীদের  নিয়ন্ত্রন করেন। 

আজ বিকালের ঘটনা এটি। এর আগে  দুপুর বারটার পর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আবেদনের ওপর ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম শুনানী  শুরুর পরপরই উত্তেজনা শুরু হয়। ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম  বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ সংলাপ থেকে পড়ে শোনাতে থাকলে উত্তেজনার সূচনা হয়। ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম শুনানী পেশ করার এক পর্যায়ে  এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপত্তি করে বলেন, ট্রাইব্যুনালকে  ম্যালাইন (হেয়) করা এসব  আবেদন  কি  এভাবে এলাউ করা হবে? এসব বাতিল করে দেয়া উচিত। সাথে সাথে কাঠগড়ায় দাড়ানো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী   উচ্চস্বরে বলেন ‘ম্যালাইন’? ট্রাইব্যুনালের বারটা বাজিয়ে  এখন বলছেন ম্যালাইন? এসময় উত্তেজনাকর বাক্য বিনিময় চলতে থাকে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীও উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকেন। এসময় একটা বেজে গেলে কোর্ট দুপুরের বিরতি ঘোষনা করেন।
এরপর ২টা ২৫ মিনিটের সময় আবার কোর্ট বসলে বিকালে আবারো তীব্র হট্টগোল সৃষ্টি হয়।  দুপুরের বিরতির পর কোর্ট বসলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামকে শুনানী শরুর করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির। ফখরুল ইসলাম তখন বলেন আসামী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কোর্টে নেই। তাকে হাজির করার  ব্যবস্থা করা হোক। এটিএম ফজলে কবির বলেন, তাকে আনা হবেনা। তিনি কোর্টে সমস্যা সৃষ্টি করেছেন। চিৎকার করে কথা বলেছেন। তাকে ছাড়াই আপনি আর্গুমেন্ট শুরু করেন।
কিন্তু ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম এরপরও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ছাড়া শুনানী  করার বিষয়ে আপত্তি জানালে বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, আসামীর উপস্থিতিতে বিচার হবে সেটাই তো বিচারের নিয়ম। কিন্তু তিনিতো কোর্টের ডেকোরাম মানেননা। এরপর তিনি বলেন, ঠিক আছে তাকে আনা যেতে পারে তবে আপনাদের শর্ত দিতে হবে যে, তিনি অনুমতি ছাড়া কথা বলবেনা। লিখিত অঙ্গীকার করতে হবে আপনাদের এ বিষয়ে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা এ শর্ত মেনে নিলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আনা হয় ট্রাইব্যুনালে।
এরপর শুনানী শরু হলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কথা বলেন এবং এরপর শুরু হয়ে যায় তীব্র হট্টগোল, চিৎকার চেচামেচি।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী  বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপ কেলেঙ্কারি বিষয়ে যেসব  দরখাস্ত জমা দিয়েছেন সেগুলো হল আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং  রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুমের বিরুদ্ধে  স্কাইপ কেলেঙ্কারির সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে  ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন, ট্রাইব্যুনালের বর্তমান বিচারপতিদের কেউ এ বিষয়ে আগে থেকে জানতেন কিনা সে বিষয়ে আদেশ চেয়ে আবেদন এবং বিচারপতি নিজামুল হককে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার জন্য সমন চেয়ে আবেন।

বর্তমান ট্রাইব্যুনালের তিনজন বিচারপতিদের কেউ স্কাইপ সংলাপ  বিষয়ে অবহিত ছিলেন  কি-না এ মর্মে আদেশ চেয়ে দায়ের করা আবেদনের ওপর  শুনানী শুরু করেন ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম।
শুনানীর  এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি  এটিএম ফজলে কবির বলেন,  আপকি কিভাবে, কোন আইনের বলে এ আবেদন করলেন তার জবাব দেন। বিচারপতি নিজামুল  হকের যে স্কাইপ সংলাপের কথা বলছেন তা তার বিষয়। আমার কার সাথে পরিচয় আছে বা নাই সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। একজন বিচারপতি হিসেবে আমি আমার ব্যক্তিগত বিষয় কি কোর্টে বলব? সেটা আপনি আমাকে করতে বলছেন?  পেয়েছেন কি আপনি? আপনাকে জবাব দিতে হবে আমাদের?
এসময় এটর্নি জেনারেল   মাহবুবে আলম  এ দরখাস্ত দায়েরের জন্য ফখরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা  গ্রহনের অনুরোধ করেন।
বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এসময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, মি. চেয়ারম্যান,  দরখাস্ত করেছি আমি আমার আইনজীবীর মাধ্যমে। রাগ করলে আমার ওপর করেন। আইনজীবীর ওপর করিয়েননা। এটা একটা নতুন ট্রাইব্যুনাল। আগের ট্রাইব্যুনালের দায় দায়িত্ব আপনারা কেন নেবেন? আমিতো আপনাদের পক্ষে  দরখাস্ত করেছি। আপনাদের সম্মান রক্ষার জন্য।  বিচারপতি নিজামুল  হককে হাইকোর্টের  বিচারপতি অবৈধ প্রস্তাব দেয়নি? তার  রেখে যাওয়া জিনিসের দায় আপনারা নেবেন কেন?
এসময়  এটর্নি জেনারেল  বলেন অবান্তর কথাবার্ত বলা হচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল অনুরোধ করেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে থামার জন্য। তখন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি একজন এমপি। ৩২  বছর আমাকে মানুষ ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। আমাকে ফাঁসি দেয়ার জন্য বেলজিয়াম থেকে আদেশ লিখে আনা হয়েছে। আর  আমাকে বলা হচ্ছে আমি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছি?

এসময় বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির  ব্যারস্টার ফখরুল ইসলামকে বলেন কি আদেশ দিলে আপনি   খুসী হবেন বলেন। আপনি কি আদেশ চান এ দরখাস্ত বিষয়ে। আপনি তো চান আমরা শপথ করে বলি আমরা  স্কাইপ  সংলাপ বিষয়ে কিছু জানিনা। এটা কি আপনি চাইতে পারেন?
এসময় ব্যারস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, আমরা কি চাই তা আমরা দরখাস্তে উল্লেখ করেছি।  বর্তমানে আপনরা যারা তিনজন বিচারপতি আছেন তাদের সবাই বিভিন্ন সময় বিচারপতি নিজামুল হকের  সাথে এই ট্রাইব্যুনালে বসেছেন কোন না কোন সময়।  আপনাদের তিনজনের দুজন সম্পর্কে স্কাইপ সংলাপে উল্লেখ আছে।  বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পর্কে বলা আছে চেয়ারম্যান যা বলবে সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য তাকে নির্দেশ দেয়া   হয়েছে  নিয়োগের সময়। এটা কোন ধরনের আয়োজন?
এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, একজন আইনজীবী কি এ ধরনের আবেদন করতে পারেন? এ আবেদন বাতিল করা হোক এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
এরপর আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের আবেদনের ওপর শুনানী  শুরু করে ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম  বলেন,  এই ট্রাইব্যুনালের  বিচারক জহির আহমেদের পদত্যাগের বিষয়ে স্কাইপ সংলাপে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের নাম উল্লেখ আছে।  বিচারপতি নিজামুল হক সংলাপে বলেছেন জহির আহমেদকে পদত্যাগের আগের দিন আইনমন্ত্রীর বাসায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। পদত্যাগের দিন সচিবালয়ে ডেকে পদত্যাগ করিয়েছেন।  তাছাড়া দুই ট্রাইব্যুনালের সব সদস্যদের আইনমন্ত্রীর বাসায় একত্রে বৈঠক আয়োজনের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ আছে সংলাপে।    জহির আহমেদেরে পদত্যাগের বিষয়ে যে কথা উল্লেখ আছে এখন পর্যন্ত আইনমন্ত্রী সে অভিযোগ অস্বীকার করেননি। কাজেই এ থেকে প্রমানিত যে, এই বিচারে আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছিল। তারা  ন্যায় বিচারকে বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য কাজ করেছেন। বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন।

এরপর এটর্নি জেনারেল এর জবাবে শুনানী পেশ শুরুর পর ট্রাইব্যুনালে হট্টগোল সৃষ্টি হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন