বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৩

প্রথম ও তৃতীয় সাক্ষীর পরষ্পর বিরোধী বক্তব্য

মেহেদী হাসান, ২০/১২/২০১১
মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে  প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলদার জেরার সময়  জানান তিনি ঢাকায় এসে  মিজানুর রহমানের কাছে ঠিকানা জেনে প্রধান তদন্ত কর্মকর্তার  অফিসে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  দরখাস্ত জমা দেন। কিন্তু   তৃতীয় সাক্ষী মিজানুর রহমান জেরার সময় বলেছেন, মাহবুবুল আলমের সাথে তার দেখাই হয়নি।

আজ  মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে তৃতীয় সাক্ষী মিজানুর রহমান  আদালতে জবানবন্দী দেন।  মিজানুর রহমান তালুকদার আদালতে জবানবন্দির সময় জানান, তার বয়স আনুমানিক ৫৭ বছর। আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে তিনি বলেন ২৫ মার্চের  রাতে আক্রমনের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমত যুদ্ধের  প্রস্তৃতি নেন। 

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে তিনি বলেন, দেলোয়ার হোসেন কথিত সাঈদী  স্বাধীনতার আগে পারেরহাট বাজারে খেয়াঘাটের সামনে মধ্য গলিতে চট বিছিয়ে লবন, হলুদ, মরিচ  বিক্রি করত। হাটের দিন ছাড়া লঞ্চে  এবং অন্যান্য বাজারে ১২ চান্দের কবজ, আবে হায়াত নামে দাতের ওষুধ বিক্রি করত।

দেলোয়ার হোসেন কথিত সাঈদী নিজে ও অন্যান্য লোকদের নিয়ে পারেরহাট বাজারে বড় বড় দোকান লুটাপাট করে। নগরবাসী সাহার দোকান দখল করে লুটের মাল ঐ ঘরে তোলে। এটি পাসতহবিল নামে পরিচিত। কথিত সাঈদী ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের ধরে এনে জোরপূর্ব ধর্মান্তকরণ করেন।

মিজানুর রহমান বলেন,  মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেযার জন্য জুন মাসে আত্মীয় বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে দেখেন  চরখালি গ্রাম জ্বলছে। পলায়নপর লোকদের কাছে জানতে  পারেন  পারের হাট বাজারে রাজাকার ও পাক হানাদার বাহিনী এসে বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

মিজানুর রহমান তালুকদার বলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে জুন মাসে সুন্দরবন ক্যাম্পে যান এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তায় (সম্ভবত উল্লেখ  করেন)  এলাকায় ফিরে আসেন।

তিনি বলেন, দেলোয়ার হোসেন শিকদার কথিত সাঈদী পারের হাট বাজারে সেনাবাহিনী  এবং রাজাকার ক্যম্প স্থাপনের পর যেসব কুকর্ম সংঘটিত হয়েছে যেমন অগ্নি সংযোগ, হত্যা লুটপাট, নারী নির্যাতন,
হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ, রেপের উদ্দেশে গ্রামের সাধারণ মহিলাদের ধরে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর এসব কাজের সাথে প্রত্যক্ষ  এবং পরোক্ষভাবে দেলোয়ার হোসেন শিকদার জড়িত ।

মিজানুর রহমান আরো বলেন, তার বড় ভাই আব্দুল মান্নান তালুকদার একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দেলোয়ার হোসেন কথিত সাঈদীসহ অন্যান্য রাজাকারা ধরে ফকির দাসের দালানে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আমাকে ক্যাম্পে হাজির করার জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে  এবং মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন করে। পরে আমার শিক্ষক দানেশ আলী মোল্লার অনুরোধে দেলোয়ার হোসেন কথি সাঈদী  আমার বড়  ভাইকে ছেড়ে দেয় এই শর্তে যে, আমার বড় ভাই কয়েক দিনের মধ্যে  রাজাকার ক্যাম্পে হাজির করা হবে।
মিজানুর রহমান  আদালতে জানান, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশে জুন মাসে সুন্দরবন ক্যাম্পে যান এবং দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ফিরে  আসেন এলাকায় ।
মিজানুর রহমানকে জেরা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনছারী, কফিলউদ্দিন চৌধুরী।
আইনজীবী: পাক হানাদার বাহিনী পারেরহাট বাজারে আসার পরই পিস কমিটি গঠিত হয়?
সাক্ষী: প্রকাশ হয়েছে পাক বাহিনী আসার পরে।
আইনজীবী: কত তারিখ বলতে পারবেন?
সাক্ষী: পাক বাহিনী আসার পর আমি বাসা থেকে বের হয়নি। সঠিক বলতে পারবনা।
আইনজীবী: রাজাকার বাহিনী কত তারিখে গঠন করা হয় তাও বলতে পারবেনরা?
সাক্ষী: রাজাকার পিস কমিটি  ঐসব কোন বাহিনী গঠনের কথা বলতে পারবনা। প্রকাশ হবার পর শুনেছি। আপনি যখন রাজারহাটে ছিলেন তখন পাক হানাদার বাহিনী বা রাজাকার বাহিনীর কেউ আপনাকে ধরতে যায়নি?
সাক্ষী: না।
আইনজীবী: মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত আপনার বাড়িতেও  এদের কেউ যায়নি?
সাক্ষী: গ্রামের বাড়িতে বহুবার গেছে। গুলি করে আমগাছ ফুটো করেছে। তখন আমি ছিলামনা সেখানে।
আইনজীবী: পিরোজপুর পারেরহাটে যেসব রাজাকার ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেলোয়ার হোসেন মল্লিক।
সাক্ষী: একেবারেই সত্য নয়ঢ। আমার জানামতে ঐ নামে কোন রাজাকার ছিলনা। ছিল দেলোয়ার হোসেন শিকদার নামে।
আইনজীবী: আমি বলছি দেলোয়ার হোসেন মল্লিক নামে রাজাকার ছিল এবং তাকে স্বাধীনতার পরে গ্রেফতার করে হাজতে পাঠানো হয়।
সাক্ষী: আপনার বক্তব্য সঠিক নয়।
আইনজীবী: চরখালি গ্রাম আগে থেকে চিনতেন?
সাক্ষী: খুব একটা আসা যাওয়া ছিলনা।
আইনজীবী: চরখালি গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক লুটপাট এবং আগুন দেয়ার খবর বাশবুনিয়া বসে  শুনতে পান?
সাক্ষী: সত্য নয়।
আইনজীবী: আপনি বলেছেন পলায়নপর লোকদের কাছে শুনেছেন পারের হাট বাজার এবং চরখালিতে আগুন লাগানো হয়েছে  লুটপাটের পর। পলায়নর  দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
সাক্ষী: না না । আমি কেমন করে বলব?
আইনজীবী: আপনার ভাইকে যেসব রাজাকার ধরে নিয়ে আপনাকে হাজির করার জন্য  চাপ সৃষ্টি করে তারা কি পারের হাটের রাজাকার ছিল?
সাক্ষী: জানা নেই। (এসময় সাক্ষী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বারবার চেয়ার থেকে ওঠেন এবং আবার বসেন। তিনি বলেন আমি সেখানে না গেলে এবং না দেখলে কিভাবে বলব ।)
আইনজীবী: আপনার ভাইকে যেসব রাজাকাররা আটকে রাখে তাদের দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
সাক্ষী: বড়ভাইর কাছে শোনামতে  তারা ছিল আব্দুর রশিদ, মহসিন, এসহাক, মোমিন।
আইনজীবী: আপনি যখন বাশঁবুনিয়া ছিলেন তখন সেখানে স্বাধীনতার পক্ষে  এবং বিপক্ষে কারা ছিল তাদের খোঁজ খবর নিতেন।
সাক্ষী: নো (উচ্চস্বরে)।
আইনজীবী: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ১৯৭১ সালে পিরোজপুর মহকুমায় যেসব ঘটনা ঘটেছে তা কম বেশি জানা আছে?
সাক্ষী: মে মাসের ১৭/১৮ তারিখ আমি পিরোজপুর সদর থেকে চলে আসি। তার আগ পর্যন্ত সব  না জানলেও কিছু কিছু জানি।
আইনজীবী: পিরোজপুর সদরে ১৭/১৮ মে’র পরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা জানেনা এবঙ দেখেননি।
সাক্ষী: লোকমুখে শুনেছি।
আইনজীবী:  চরখালি গ্রামে কার কার বাড়ি পুড়েছে তা স্বাধীনতার পর দেখতে গিয়েছিলেন?
সাক্ষী: হ্যা।
চরখালি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, বাদশা  খন্দকার,  আশরাফ আল হাওলাদার, আল আহমদ, রাজাকার হানিফ, মুজিবুর মল্লিক, আব্দুল মান্নান, আব্দুল হামিদ হাওলাদার, আব্দুল জলিল জমাদ্দার, ফজলুল হক হাওলাদার  রাজাকারসহ অনেক বিখ্যাত এবং কুখ্যাত রাজাকারের নাম জিজ্ঞেস করলে সাক্ষী  মিজানুর রহমান  চেননননা বলে জানান।   এসময় তিনি বারবার আদালতকে বলেন ওটি তার গ্রাম নয় এবং তাদের তার চেনার কথা নয়। তাই এসব প্রশ্নে তিনি বার বার উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।  মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের প্রতি উচ্চ স্বরে  কথা বলায় মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা আদালতকে অভিযোগ করেন এবং সাক্ষীর কাছ থেকে নিরাপত্তা দাবি করেন। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, তিনি একটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু সেই গ্রামের কোন  রাজাকারকে তিনি চেনেননা।
আইনজীবী: পিরোজপুর মহকুমার কুখ্যাত রাজাকার আমির হোসনেকে চেনেন?
সাক্ষী: খেয়ালে নেই।
আইনজীবী: চরখালিতে ঘর পুড়েছে এমন ১০ জনের নাম বলতে পারবেন?>
সাক্ষী: যাদের নাম  মনে আছে বলতে পারব। নরেন হরিপদ।
আইনজীবী: নরেন এবং হরিপদ নামে কেউ ছিলনা।
সাক্ষী: মিথ্যা কথা।
আইনজীবী: আপনার বর্ণনামতে চরখালিতে কোন লুটপাট এবং অগ্নিসযোগ হয়নি।
সাক্ষী:  সত্য নয়।
আইনজীবী: এখানে জবানব্দী দেয়ার আগে আর কোথাও আগে অভিযোগ করেননি?
সাক্ষী: খেয়াল নেই।
আইনজীবীধ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কবে জবানবন্দী দিয়েছেন?
সাক্ষী: ২০/১/২০১১ সম্ভবত।
আইনজীবী: এর আগে তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল সাহেবের সাথে দেখা হয়েছে?
সাক্ষী: না। আপনি বর্তমানে ঢাকায় থাকেন?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী : জবানবন্দী ঢাকায়   বসে দিয়েছেন?
সাক্ষী: হ্যা।
আইনজীবী: কোথায় বসে দিয়েছেন বাসায় না অফিসে?
সাক্ষী: বেইলি রোডের তদন্ত কর্মকর্তার অফিসে।
আইনজীবী: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  কোন অভিযোগ করেননি?
সাক্ষী: না।
আইনজীবী: দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সব সময়ই এই নামে পরিচিত ছিলেন কখনো দেলোয়ার হোসেন শিকদার  নামে পিরিচিত ছিলেননা।
সাক্ষী: সত্য নয়।
আইনজীবী: আপনার নিজ বাড়িতে আগুন দেয়া হয়নি।
সাক্ষী: না।
আইনজীবী: মামলা  দায়েরের আগে মামলার বাদী এবং এক নম্বর সাক্ষী মাহবুবুর আলম হাওলাদার আপনার  কাছে কোন পরামর্শ  বা সাহায্য নেয়?
সাক্ষী: দেখাই হয়নি।
আইনজীবী: মাহবুবুল আলম ২০০৯ সালে পিরোজপুরে যে মামলা করেছিলেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  সে বিষয়ে জানেন?
সাক্ষী: না।
আইনজীবী: যুদ্ধ শুরুর সময় মাহবুবুল আলম হাওলাদার কি করতেন?
সাক্ষী: মনে হয় ছাত্র ছিলেন।
আইনজীবী: মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় আপনি ভারতে চলে যান এবং দেশ স্বাধীনের অনেক পরে দেশে আসেন?
সাক্ষী : সত্য নয়।
আইনজীবী: মাওলানা সাঈদী স্বাধীনতার স্বপক্ষের  এবং হিন্দুদের মালামাল গণিমতের মাল বলে ফতোয়া দিয়েছেন বলে যে অভিযোগ আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় করেছেন সে অভিযোগ তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দীকে করেননি।
সাক্ষী: স্মরনে নেই।
আইনজীবী: মাওলানা সাঈদী লুটের মাল নিয়ে পাসতহবিলের দোকান খোলার অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়টিও তদন্ত কর্মকর্তার  জবানবন্দীতে বলেননি।
সাক্ষী: সম্ভবত বলেছি।
আইনজীবী: মাওলানা সাঈদী কর্তৃক জোর করে ধর্মান্তরকরন, খেয়াঘাটে চট বিছিয়ে  লবন মরিচ বিক্রির  বিষয়ে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাও বলেননি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে।
সাক্ষী: খেয়াল নেই।
আইনজীবী: আবে হায়াত নামে দাতের মাজন বিক্রির কথাও একইভাবে বলেননি।
সাক্ষী: বলেছি।
আইনজীবী: দেলোয়ার হোসেন শিকদার কথিত সাঈদী পারের হাট বাজারে সেনাবাহিনী  এবং রাজাকার ক্যম্প স্থাপনের পর যেসব কুকর্ম সংঘটিত হয়েছে যেমন অগ্নি সংযোগ, হত্যা লুটপাট, নারী নির্যাতন, হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণ, রেপের উদ্দেশে গ্রামের সাধারণ মহিলাদের ধরে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর এসব কাজের সাথে প্রত্যক্ষ  এবং পরোক্ষভাবে দেলোয়ার হোসেন শিকদার জড়িত  বলে যে সাক্ষী দিয়েছেন আদালতে তাও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি আগে।
সাক্ষী: বলেছি কিনা স্মরনে নেই।
আইনজীবী: চরখালি গ্রামে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের যে অভিযোগ করেছেন তাও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেননি আগে।
সাক্ষী: স্মরণ নেই।
এভাবে সাক্ষী   মিজানুর রহমান তালুকদার আদালতে যেসব অভিযোগ করেন সে বিষয় তুলে ধরে তার কাছে জানতে চাওয়া হয় তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া  জবানবন্দীতে এসব অভিযোগ করেছিলেন কিনা।  অধিকাংশ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন স্মরণ নেই , খেয়াল নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন