মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

শুনানীতে ব্যারিস্টার রাজ্জাক// গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আর মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ১০ হাজার মাইলের ব্যবধান

মেহেদী হাসান, ৬/৬/১২
অধ্যাপক গোলাম  আযমের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তা অস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট নয় । তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞার আওতায় পড়েনা। ট্রাইব্যুানালের চার্জে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সাথে  মানবতাবিরোধী অপরাধের দশ হাজার মাইলের ব্যবধান রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে গত ১৩ মে চার্জ  চার্জ গঠন করে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।  চার্জ গঠনের আদেশ পুনরায় বিবেচনার জন্য আবেদন করেন গোলাম আযমের আইনজীবী।  আজ  আবেদনের ওপর শুনানীতে  অংশ নেন  গোলাম আযমের  প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এসময়   চার্জ গঠন বিষয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক  উপরোক্ত মন্তব্য করেন  ট্রাইব্যুনালে।

চার্জ  গঠন আদেশ রিভিউ আবেদনের শুনানীতে ব্যারিস্টার  আব্দুর রাজ্জাক কিছু বিষয় বাদ  দেয়ার  দাবি জানান। এছাড়া যেসব অভিযোগ অস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট নয় সে বিষয়গুলো উল্লেখ করে যুক্তি পেশ করেন তিনি।
যেসব বিষয় বাদ  দেয়ার জন্য তিনি উল্লেখ করেন তার মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলাম, শান্তি কমিটিকে পাকিস্তান আর্মির সহযোগী বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং একে ঐতিহাসিক ঘটনা বলা হয়েছে চার্জে । ব্যারিস্টার রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালে বলেন, জামায়াতে ইসলাম,  শান্তি কমিটি কখনো পাকিস্তান আর্মির সহযোগী বাহিনী ছিলনা।  আপনরা যদি এটাকে ঐতিহাসিক ঘটনা না বলে অভিযোগ আকারেও উল্লেখ করতেন তবু একটা কথা ছিল।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক চার্জ  থেকে  পড়ে শুনিয়ে বলেন, ১৯৫ জন পাকিস্তান আর্মি সম্পর্কে আপনারা উল্লেখ করেছেন তাদের পাকিস্তান  বিচার করবে এ মর্মে নাকি বিষয়টি সুরাহা করা হয়েছে। কিন্তু এটি  সঠিক নয়। বরং  ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার ত্রিদেশীয় চুক্তি অনুযায়ী তাদের বিচার থেকে অব্যহাতি দেয়া  হয়েছে এবং বাংলাদেশ তাদের ক্ষমা করেছে। এভাবে বিষয়টি সুরাহা  হয়েছে।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক আরো বলেন, চার্জে উল্লেখ করা হয়েছে  ১৯৫ জনকে বিচারের বিষয়টি আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে ছিল এবং এ কারনেই নাকি তারা পরবর্তী নির্বাচনে ব্যাপক বিজয় অর্জন করেছে। এটাও সঠিক নয়।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, টিক্কা খান,  মাওলানা মওদূদীর সাথে গোলাম আযম দেখা করেছেন এবং তাও যুদ্ধাপরাধ ধরা হয়েছে। দেখা করা কি করে যুদ্ধাপরাধ হতে পারে?  সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে দেখা করে  তিনি কি  বলেছেন বা দেখা করার কারনে কি  হয়েছে। দুজন বেসামরিক নাগিররের মধ্যকার বৈঠক কি করে যুদ্ধাপরাধ হয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সমর্থন করা, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সমর্থন


করা যুদ্ধাপরাধ  হতে পারেনা। কোন প্রমান ছাড়াই জামায়াতে ইসলামী, শান্তি কমিটিকে পাকিস্তান আর্মির সহযোগী বাহিনী হিসেবে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে।
ব্যারিস্টার  রাজ্জাক বলেন, কিছু কিছু বিষয় চার্জে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেছেন যা প্রসিকিউশন আনেনি এবং চার্জশিটেও ছিলনা।  ভারতের বিরুদ্ধে, ভারতের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে  বক্তব্য দেয়াও যুদ্ধাপরাধ গণ্য করা হয়েছে। একটা ঘটনার মধ্যে অনেকগুলো অপরাধের ধারা যুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক যুক্তি উপস্থাপনের এক পর্যায়ে উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় দায়িত্বের প্রসঙ্গ আসে গোলাম  আযমের বিরুদ্ধে। এছাড়া একটি ঘটনায় অনেকগুলো অপরাধের ধারা যুক্ত করার অভিযোগ  প্রসঙ্গে  ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ধরেন আমি একটি বক্তৃতা দিলাম। তাতে উৎসাহিত হয়ে ৫০ জন লোক গ্রামে গিয়ে কেউ খুন করল, কেউ ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ করল। তার দায় দায়িত্ব কি বক্তা হিসেবে আমার ওপর বর্তাবেনা? তার ঐ বক্তব্যের কারনে সারা দেশে হত্যার অপরাধ হয়েছে। সে কারনে ঐ ঘটনার সাথে হত্যার ধারা যুক্ত করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার গোলাম আযমের মামলা দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের আবেদনের ওপর শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল বুধবার  সকালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জেয়াদ আল মালুম এ বিষয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এরপর চার্জ গঠন আদেশ  রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানীতে অংশ নেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। আজ  বৃহষ্পতিবার জেয়াদ আল মালুমের এ  আবেদনের ওপর যুক্তি উপস্থাপনের পর এ বিষয়ে আদেশ প্রদানের কথা রয়েছে। এছাড়া  গোলাম  আযমের মামলা দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর বিষয়ক আদেশ মুলতবি রাখা হয়েছে (সিএভি, কোর্ট এডজর্নড ফর ভারডিক্ট)।

ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি
গোলাম আযমের মামলা দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর  বিষয়ে আবেদেরন ওপর শুনানীতে অংশ নিয়ে জেয়াদ আল মালুম বলেন, একই বিষয়ে আগেও দরখাস্ত করা হয়েছে মাওলানা সাঈদীর কেসে। সেই  একই বিষয়ে দরখাস্ত আনা হয়েছে। সুদুর প্রসারী  অংশ হিসেবে এ আবেদন করা হয়েছে।  বিচার মানিনা, আইন ভালনা এই হল তাদের লক্ষ্য। এ দরখাস্তের উদ্দেশ্য একটাই আর তা হল বিচার প্রকৃয়াকে বাঁধাগ্রস্ত করা।  এ দরখাস্ত বিচারকে বাঁধাগ্রস্ত করার শামিল। ত্যক্তকরন, উত্যক্তকরনের জন্য এ দরখাস্ত দেয়া হয়েছে।  এ দরখাস্ত আইন বহির্ভূত, বেআইনী এবং অসদ উদ্দেশ্যমূলক। তাই আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এ আবেদনের কারনে   আবেদনকারীর   বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের আবেদন জানান জেয়াদ আল মালুম।
এ অভিযোগের জবাব দেয়ার জন্য ব্যারিস্টার রাজ্জাক  ট্রাইব্যুনালের সামনে দাড়িয়ে বলেন,  গোলাম আযমের বিচার চলছে। তার আইনজীবী হিসেবে আমার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানানো হয়েছে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। আদালত অবমাননার মানে কি তা যদি আমার প্রতিপক্ষ বন্ধু জানতেন তাহলে তিনি এ ধরনের কথা বলতেননা। এসময়  বিচারপতি নিজামুল হক ব্যারিস্টার রাজ্জাককে উদ্দেশ্য করে  বলেন, এ বিষয়টি  আমলে নিয়েননা।  বিষয়টি  আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। আপনার জবাব দেয়ার দরকার নেই।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক  জেয়াদ আল মালুমের অভিযোগ সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন, আমার দরখাস্ত বেআইনি  হলে ট্রাইব্যুনাল শুনল কেন। বেআইনী হলে তাতো ট্রাইব্যুনাল বলত। ট্রাইব্যুনাল তো কিছু বলেননি এবং তারা আমাদের আবেদন গ্রহণ করে শুনানী করেছেন। আমরা যেসব কাগজপত্র দিয়েছি তা



গ্রহণ করেছেন। আমাদের কোন কোন দাবির সাথে ট্রাইব্যুনাল একমত পোষনও করেছেন। তারা আমাদের অভিযোগ  সম্পর্কে নোট নিয়েচেন।

আজ  সোয়া চারটার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম  শেষ হবার ঠিক আগ মুহূর্তে  জেয়াদ আল মালুম চার্জ গঠন আদেশ রিভিউ আবেদন বিষয়ে এক মিনিট  কথা বলার অনুমিত  চান।  ট্রাইব্যুনাল অনুমতি দিলে তিনি বলেন,   চার্জ গঠনের শুনানীতে ডিফেন্স যেসব যুক্তি তুলে ধরেন ঠিক একই যুক্তি হুবহু আবার
এখানে  পেশ করলেন রিভিউ আবেদনে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক এর জবাবে  ট্রাইব্যুনালে বলেন, আমার প্রতিপক্ষ বন্ধু রিভিউ শব্দটার মানে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জেয়াদ আল মালুমের অভিযোগ সম্পর্কে  ট্রাইব্যুনালও ভিন্নমত পোষন করেন । বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, রিভিউ আবেদনে তারা অনেক নতুন বিষয় এনেছেন।

গোলাম আযমের পক্ষে আরো  যেসব আইনজীবী  আজ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভীর আল আমিন, ব্যারিস্টার এমরান সিদ্দিক, শিশির মোহাম্মদ মনির প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সৈয়দ হায়দার আলী, রানাদাস গুপ্ত অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
আজ  মাওলানা সাঈদী এবং সালাহউদ্দিন্ কাদের চৌধুরীর মামলা চলেনি।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন