মেহেদী হাসান, ৩০/৪/২০১৪, বুধবার, ঢাকা।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ১৯৭১ সালের বেশ কিছু পেপারকাটিং জমা দিয়েছে। তাতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন। এ সময়ে তিনি চট্টগ্রামে ছিলেননা। অথচ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ডালিম হোটেলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপক্ষ যেসব অপহরন নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ করেছে তার সবগুলোই নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে সংঘটিত। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষেরই ডকুমেন্টে দেখা যায় তিনি অপরাধ সংঘটনকালে ঢাকায় ছিলেন চট্টগ্রামে নয়।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি উপস্থাপনের সময় অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম এ তথ্য তুলে ধরেন।
মিজানুল ইসলাম দাবি করেন মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের সাত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। ছয় নভেম্বরের আগে তিনি চট্টগ্রম নগর ছাত্রসংঘ সভাপতি ছিলেন। ছয় নভেম্বরের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘ সাধারন সম্পাদক হন এবং এরপর তিনি ঢাকায় আসেন। সাধারনত কোন পার্টির সমাধারন সম্পাদক ঢাকায়ই বাস করেন। মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছিলেন এ তথ্য রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টে আছে। ৮ সেপ্টেম্বরের পর তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন এ মর্মে তাদের কোন পেপারকাটিং নেই তাদের।
তিনি বলেন, বরং রাষ্ট্রপক্ষের জমা দেয়া পেপারকাটিংয়ে দেখা যায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে মীর কাসেম আলী ঢাকায় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এবং ৮ নভেম্বর তারিখে প্রকাশিত দুটি খবরের কাটিং জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ যে খবরে উল্লেখ আছে মীর কাসেম আলী ঢাকার সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
যুক্তি পেশ শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে মিজানুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, দৈনিক আজাদের ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখের একটি পেপার কাটিং জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ পেপারকটিংয়ের খবরে বর্নিত রয়েছে ১০ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সমাবেশে মীর কাসেম আলী বক্তব্য দেয়। ১১ ডিসেম্বর তা আজাদে ছাপা হয়। এতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী তখন ঢাকায় ছিল। তাছাড়া তাদের আরেকটি পেপারকাটিং হল ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর। এ পেপারকাটিংয়েও দেখা যায় মীর কাসেম আলী ঢাকায় একটি সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন ৭ নভেম্বর।
তাছাড়া তাদের ৭, ১১, ১৪ ও ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের পেপারকটিংয়ে মীর কাসেম আলীর বিবৃতি রয়েছে যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ট্রাইব্যুনাল তখন বলেন ঢাকায় না থাকলেও বিবৃতি দেয়া যায়। মিজানুল ইসলাম বলেন, ধরে নেয়া যায় ঢাকায় বসেই তিনি বিবৃতি দিয়েছেন। এসব থেকে প্রমানিত যে মীর কাসেম আলী নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্ট থেকে এটি স্পষ্ট যে মীর কাসেম আলী ৬ নভেম্বরের পর থেকে চট্টগ্রামে ছিলেননা বরং ঢাকায় ছিলেন।
চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বিচার কার্যক্রম পরিচালান করেন।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে নয় নং অভিযোগ হল ২৯ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সৈয়দ মো : এমরান হোসেন, কামাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, সরওয়ার উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, গোলাম রহমান এ ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এদের মধ্যে এমরান হোসেন, জামালউদ্দিন এবং সরওয়ারউদ্দিন এ তিনজকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছে। এ তিনজন বাদে বাকী চারজন বিষয়ে আর কোন তথ্য নেই। আর যে তিনজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে তারা অপহরন ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কিছুই বলেনি।
জামালউদ্দিন বলেছেন, আটকের সময় ডালিম হোটেলের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। কারণ তারা মুখোস পড়া ছিল। অপরদিকে একই ঘর থেকে একই সময়ে আটক হওয়া অপর সাক্ষী সরওয়ার উদ্দিন বলেছেন, আটকের সময় দুজন আর্মি এবং একজন বদর সদস্য ছিল। বদর সদস্য হল মীর কাসেম আলী।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সাতজনকে একই ঘর থেকে একই সাথে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে তিনজন এসে সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে দুজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছে গ্রেফতার ঘটনা বিষয়ে।
অপর সাক্ষী এমরান বলেছেন তিনি যুদ্ধ করেছেন কিন্তু কোন এলাকায় যুদ্ধ করেছেন তা বলতে পারেননি। আর্মি ক্যাম্প কোথায় ছিল তাও বলতে পারেননি। আলবদর ক্যাম্প সম্পর্কেও বলতে পারেনি। এরকম একজন সাক্ষী আসামীকে জড়িয়ে যা বলেছে তাও অসত্য এটাই স্বাভাবিক।
মিজানুল ইসলাম বলেন, দুই জন সাক্ষী ঘটনার বর্ননা এবং তারিখ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন ১১ নং অভিযোগ যথা জসিম হত্যা বিষয়ে।
গাজী সালাহউদ্দিন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন জসিমের নিহত হবার স্থান এবং তারিখ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বই ডিফেন্স ডকুমেন্ট হিসেবে প্রদর্শনী মার্ক করা হয়েছে। অপর দিকে জসিম নিহত হওয়া বিষয়ে সাক্ষী সানাউল্লাহ এবং জাহাঙ্গীর আলম ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, তিনি ২৪ নভেম্বর ডালিম হোটেলে জসিমের লাশ দেখেছেন। আর সানাউল্লাহ বলেছেন তিনি ২৮ নভেম্বর ডালিম হোটেল জসিমের লাশ দেখেছেন।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১২ নং অভিযোগ হল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, টন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসকে অপহরন করে নির্যাতন করা হয়। টন্টু রঞ্জিত দাসকে হত্যা করে তাদের লাশ গুম করা হয়।
সানাউল্লাহ বলেছেন তিনি ২৭ নভেম্বর ডালিম হোটেলে টন্টু সেন ও রঞ্জিতের সাথে কথা বলেছেন। ২৮ তারিখ তাদের হত্যা করা হয়।
শফিউল আলমকে গ্রেফতার করা হয় ২৮ নভেম্বর। তিনি তার সেই সে সময় আনন্দ বেদনা বইয়ে উল্লেখ করেছেন ২৮ নভেম্বর টন্টু মারা যাবার তিনদিন আগে থেকে অজ্ঞান ছিল। কিন্তু সানাউল্লাহ বলেছেন বলেছেন তিনি ২৭ তারিখ টন্টুর সাথে কথা বলেছেন ডালিম হোটেলে। মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন অজ্ঞান লোকের সাথে সাক্ষী সানাউল্লাহ কথা বললেন কি করে?
টন্টু সেনের ভাগনে প্রদীপ তালুকদার । ১২ নং অভিযোগ বিষয়ে প্রদীপ সাক্ষ্য দিয়েছেন অপহরন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। প্রদীব বলেছেন ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিলণ ছয় বছর। তিনি যে ঠিকানা ট্রাইব্যুনালে দিয়েছেন সে ঠিকানায় তার কোন অস্তিত্ব নেই। নতুন যে ঠিকানা দিয়েছেন সেখানেও তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে নতুন ঠিকানা অনুযায়ী আমরা তার ভোটার লিস্ট সংগ্রহ করেছি এবং সেখানে তার জন্ম তারিখ লেখা আছে ১৯৭৭ সাল। ১৯৭৭ সালে জন্ম নেয়া ব্যক্তি কি করে ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, ১২ নং অভিযোগে আরো রয়েছে হাজারি লেনে আড়াইশ থেকে তিনশ বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে এবং একশরও বেশি পরিবারকে জোর করে ভারতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোন সাক্ষী হাজির করেনি।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৩ নং অভিযোগ হল সুনীল কান্তি বর্ধনকে অপহরন ও নির্যাতন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এ অভিযোগ বিষয়ে সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধন অস্বাভাবিক বক্তব্য দিয়েছে। সে একবার বলছে শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে গেছে। আবার বলছে গ্রামে টিকতে না পেরে শহরে এসেছে। গ্রামে সে কেন টিকতে পারলনা? তাছাড়া সে কোন রাজাকার আলবদরও চিনতনা। তাহলে কি করনে কাদের কারনে সে গ্রামে টিকতে পারলনা? সে বলেছে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি পোড়ানো হয়নি। সে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে এটা তার প্রমান। কারণ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি পোড়ানো হয়েছিল ।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪ নং অভিযোগ হল নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন।
নাসির উদ্দিন চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম শহরে সে এসেছে যুদ্ধের জন্য। অথচ সে বলেছে সার্কিট হাউজ ছাড়া অন্য কোথাও আর্মি ক্যাম্প ছিল কিনা তা তার জানা নেই। এটা কেমন কথা? এসময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাইতো? এটা কি করে হতে পারে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, তাদের এলাকা হাজারি লেন বারবার পুড়িয়ে দেয়া হল, বারবার লুট হয়েছে তার এলাকায়, তার এলাকার পাশেই ডালিম হোটেল বলছে তারা আর সেখানেই এসে সে আশ্রয় নিল। এটা কি করে সত্য হতে পারে? কাজেই তার আহত হবার ঘটনা অসত্য।
সাত নং অভিযোগ হল মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান, ইলিয়াসকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সানাউল্লাহ বলছে তার চোখ বাঁধা ছিল। কাজেই তাকে ডালিম হোটেলের সামনে না অন্য কোথায় আনা হল তা তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ইলিয়াসের অপহরন এবং নির্যাতন বিষয়ে এখানে একটা লাইন ছাড়া আর কোন কিছু কোথাও বলা হয়নি। ইলিয়াসের অপরহন নির্যাতন বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আর কোন কিছু নেই। কেন তাকে সাক্ষী হিসেবে আনা হলনা, অন্য কোন সাক্ষী দিয়ে কেন কিছু বলানো হলনা এর কোন ব্যাখ্যা নেই।
মিজানুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম পিডিবি নেতা নবি চৌধুরী স্বাধীনতা বিরোধী কি-না তাও সে জানেনা। তার বক্তব্য যে অসত্য এটা তার প্রমান। সে ডিসি অফিসে চাকরি করত কিন্তু ডিসি অফিস লুট হওয়ার খবরও সে জানেনা বলছে। একজন মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে যা জানার কথা তাও সে জানেনা বলছে। সত্য এড়িয়ে গেছে। যে লোক স্বাভাবিক জানাকথা সঠিকভাবে বলছেনা তার বাকি কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
১০ নং অভিযোগ মীর কাসেম আলীর নির্দেশে মো : জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন।
ভিকটিম চারজনই সাক্ষ্য দিয়েছে। মিজানুল ইসলাম বলেন, সাক্ষী জাকারিয়া বলেছেন আটকের সময় পাকিস্তান আর্মি ছিল। শান্তি কমিটি বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। এলাকায় রাজাকর ক্যাম্প দেখেনি সে। মীর কাসেম আলী ছাড়া অপর কাউকে তিনি চেনেননা।
সাক্ষী হাসিনা বেগম বলেছেন তিনি ১৯৭২ সালে সম্পাদক ছিলেন। ন্যাপ নেতা ছিলেন। কিন্তু তিনি জেরায় বলেছেন ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন বিষয়ে জানা নেই। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বিষয়েও বলতে পারছেননা। তার একথা কি বিশ্বাসযোগ্য? কারণ তিনি কোন সাধারন গৃহিনী নন। তিনি আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ডালিম হোটেল তদন্ত বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি তদন্ত করতে গিয়ে ওই বাড়ির কারো সাথে কথা বলেননি প্রথমে । আসলে তিনি তদন্ত করেছেন ঠিকই কিন্তু তদন্তে যখন মীর কাসেম আলী বিষয়ে কোন তথ্য পাননি তখন তিনি তদন্ত বিষয়ে অস্বীকার করেন। তিনি আসল তথ্য গোপন করেছেন। ওই বাড়ির একজনকে সাক্ষী করা হয় কিন্তু তাকে আনা হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন ডালিম হোটেলের মালিক মইত্যা গুন্ডার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল ১৯৭২ সালে সে বিষয়ে কোন তদন্ত করেননি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে অসদ উদ্দেশ্য নিয়ে মীর কাসেম আলীকে আসামী নির্ধারন করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সাজিয়ে সে অনুযায়ী শিখিয়ে পরিয়ে সাক্ষী হাজির করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে।
যুক্তি উপস্থাপনে মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, আসাদ উদ্দিন ও আবু বকর সিদ্দিক।
আগামী রোববার উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হবার কথা রয়েছে। এর মাধ্যমে শেষ হবে এ মামলার বিচার কার্যক্রম।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ১৯৭১ সালের বেশ কিছু পেপারকাটিং জমা দিয়েছে। তাতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন। এ সময়ে তিনি চট্টগ্রামে ছিলেননা। অথচ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ডালিম হোটেলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপক্ষ যেসব অপহরন নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ করেছে তার সবগুলোই নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে সংঘটিত। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষেরই ডকুমেন্টে দেখা যায় তিনি অপরাধ সংঘটনকালে ঢাকায় ছিলেন চট্টগ্রামে নয়।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি উপস্থাপনের সময় অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম এ তথ্য তুলে ধরেন।
মিজানুল ইসলাম দাবি করেন মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের সাত নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। ছয় নভেম্বরের আগে তিনি চট্টগ্রম নগর ছাত্রসংঘ সভাপতি ছিলেন। ছয় নভেম্বরের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘ সাধারন সম্পাদক হন এবং এরপর তিনি ঢাকায় আসেন। সাধারনত কোন পার্টির সমাধারন সম্পাদক ঢাকায়ই বাস করেন। মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছিলেন এ তথ্য রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টে আছে। ৮ সেপ্টেম্বরের পর তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন এ মর্মে তাদের কোন পেপারকাটিং নেই তাদের।
তিনি বলেন, বরং রাষ্ট্রপক্ষের জমা দেয়া পেপারকাটিংয়ে দেখা যায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে মীর কাসেম আলী ঢাকায় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এবং ৮ নভেম্বর তারিখে প্রকাশিত দুটি খবরের কাটিং জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ যে খবরে উল্লেখ আছে মীর কাসেম আলী ঢাকার সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
যুক্তি পেশ শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে মিজানুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, দৈনিক আজাদের ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখের একটি পেপার কাটিং জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ পেপারকটিংয়ের খবরে বর্নিত রয়েছে ১০ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সমাবেশে মীর কাসেম আলী বক্তব্য দেয়। ১১ ডিসেম্বর তা আজাদে ছাপা হয়। এতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী তখন ঢাকায় ছিল। তাছাড়া তাদের আরেকটি পেপারকাটিং হল ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর। এ পেপারকাটিংয়েও দেখা যায় মীর কাসেম আলী ঢাকায় একটি সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন ৭ নভেম্বর।
তাছাড়া তাদের ৭, ১১, ১৪ ও ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের পেপারকটিংয়ে মীর কাসেম আলীর বিবৃতি রয়েছে যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ট্রাইব্যুনাল তখন বলেন ঢাকায় না থাকলেও বিবৃতি দেয়া যায়। মিজানুল ইসলাম বলেন, ধরে নেয়া যায় ঢাকায় বসেই তিনি বিবৃতি দিয়েছেন। এসব থেকে প্রমানিত যে মীর কাসেম আলী নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্ট থেকে এটি স্পষ্ট যে মীর কাসেম আলী ৬ নভেম্বরের পর থেকে চট্টগ্রামে ছিলেননা বরং ঢাকায় ছিলেন।
চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বিচার কার্যক্রম পরিচালান করেন।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে নয় নং অভিযোগ হল ২৯ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সৈয়দ মো : এমরান হোসেন, কামাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, সরওয়ার উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, গোলাম রহমান এ ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এদের মধ্যে এমরান হোসেন, জামালউদ্দিন এবং সরওয়ারউদ্দিন এ তিনজকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছে। এ তিনজন বাদে বাকী চারজন বিষয়ে আর কোন তথ্য নেই। আর যে তিনজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে তারা অপহরন ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কিছুই বলেনি।
জামালউদ্দিন বলেছেন, আটকের সময় ডালিম হোটেলের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। কারণ তারা মুখোস পড়া ছিল। অপরদিকে একই ঘর থেকে একই সময়ে আটক হওয়া অপর সাক্ষী সরওয়ার উদ্দিন বলেছেন, আটকের সময় দুজন আর্মি এবং একজন বদর সদস্য ছিল। বদর সদস্য হল মীর কাসেম আলী।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সাতজনকে একই ঘর থেকে একই সাথে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে তিনজন এসে সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে দুজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছে গ্রেফতার ঘটনা বিষয়ে।
অপর সাক্ষী এমরান বলেছেন তিনি যুদ্ধ করেছেন কিন্তু কোন এলাকায় যুদ্ধ করেছেন তা বলতে পারেননি। আর্মি ক্যাম্প কোথায় ছিল তাও বলতে পারেননি। আলবদর ক্যাম্প সম্পর্কেও বলতে পারেনি। এরকম একজন সাক্ষী আসামীকে জড়িয়ে যা বলেছে তাও অসত্য এটাই স্বাভাবিক।
মিজানুল ইসলাম বলেন, দুই জন সাক্ষী ঘটনার বর্ননা এবং তারিখ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন ১১ নং অভিযোগ যথা জসিম হত্যা বিষয়ে।
গাজী সালাহউদ্দিন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন জসিমের নিহত হবার স্থান এবং তারিখ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বই ডিফেন্স ডকুমেন্ট হিসেবে প্রদর্শনী মার্ক করা হয়েছে। অপর দিকে জসিম নিহত হওয়া বিষয়ে সাক্ষী সানাউল্লাহ এবং জাহাঙ্গীর আলম ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, তিনি ২৪ নভেম্বর ডালিম হোটেলে জসিমের লাশ দেখেছেন। আর সানাউল্লাহ বলেছেন তিনি ২৮ নভেম্বর ডালিম হোটেল জসিমের লাশ দেখেছেন।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১২ নং অভিযোগ হল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, টন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসকে অপহরন করে নির্যাতন করা হয়। টন্টু রঞ্জিত দাসকে হত্যা করে তাদের লাশ গুম করা হয়।
সানাউল্লাহ বলেছেন তিনি ২৭ নভেম্বর ডালিম হোটেলে টন্টু সেন ও রঞ্জিতের সাথে কথা বলেছেন। ২৮ তারিখ তাদের হত্যা করা হয়।
শফিউল আলমকে গ্রেফতার করা হয় ২৮ নভেম্বর। তিনি তার সেই সে সময় আনন্দ বেদনা বইয়ে উল্লেখ করেছেন ২৮ নভেম্বর টন্টু মারা যাবার তিনদিন আগে থেকে অজ্ঞান ছিল। কিন্তু সানাউল্লাহ বলেছেন বলেছেন তিনি ২৭ তারিখ টন্টুর সাথে কথা বলেছেন ডালিম হোটেলে। মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন অজ্ঞান লোকের সাথে সাক্ষী সানাউল্লাহ কথা বললেন কি করে?
টন্টু সেনের ভাগনে প্রদীপ তালুকদার । ১২ নং অভিযোগ বিষয়ে প্রদীপ সাক্ষ্য দিয়েছেন অপহরন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। প্রদীব বলেছেন ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিলণ ছয় বছর। তিনি যে ঠিকানা ট্রাইব্যুনালে দিয়েছেন সে ঠিকানায় তার কোন অস্তিত্ব নেই। নতুন যে ঠিকানা দিয়েছেন সেখানেও তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে নতুন ঠিকানা অনুযায়ী আমরা তার ভোটার লিস্ট সংগ্রহ করেছি এবং সেখানে তার জন্ম তারিখ লেখা আছে ১৯৭৭ সাল। ১৯৭৭ সালে জন্ম নেয়া ব্যক্তি কি করে ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, ১২ নং অভিযোগে আরো রয়েছে হাজারি লেনে আড়াইশ থেকে তিনশ বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে এবং একশরও বেশি পরিবারকে জোর করে ভারতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোন সাক্ষী হাজির করেনি।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৩ নং অভিযোগ হল সুনীল কান্তি বর্ধনকে অপহরন ও নির্যাতন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এ অভিযোগ বিষয়ে সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধন অস্বাভাবিক বক্তব্য দিয়েছে। সে একবার বলছে শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে গেছে। আবার বলছে গ্রামে টিকতে না পেরে শহরে এসেছে। গ্রামে সে কেন টিকতে পারলনা? তাছাড়া সে কোন রাজাকার আলবদরও চিনতনা। তাহলে কি করনে কাদের কারনে সে গ্রামে টিকতে পারলনা? সে বলেছে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি পোড়ানো হয়নি। সে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে এটা তার প্রমান। কারণ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি পোড়ানো হয়েছিল ।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪ নং অভিযোগ হল নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন।
নাসির উদ্দিন চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম শহরে সে এসেছে যুদ্ধের জন্য। অথচ সে বলেছে সার্কিট হাউজ ছাড়া অন্য কোথাও আর্মি ক্যাম্প ছিল কিনা তা তার জানা নেই। এটা কেমন কথা? এসময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাইতো? এটা কি করে হতে পারে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, তাদের এলাকা হাজারি লেন বারবার পুড়িয়ে দেয়া হল, বারবার লুট হয়েছে তার এলাকায়, তার এলাকার পাশেই ডালিম হোটেল বলছে তারা আর সেখানেই এসে সে আশ্রয় নিল। এটা কি করে সত্য হতে পারে? কাজেই তার আহত হবার ঘটনা অসত্য।
সাত নং অভিযোগ হল মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান, ইলিয়াসকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সানাউল্লাহ বলছে তার চোখ বাঁধা ছিল। কাজেই তাকে ডালিম হোটেলের সামনে না অন্য কোথায় আনা হল তা তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ইলিয়াসের অপহরন এবং নির্যাতন বিষয়ে এখানে একটা লাইন ছাড়া আর কোন কিছু কোথাও বলা হয়নি। ইলিয়াসের অপরহন নির্যাতন বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আর কোন কিছু নেই। কেন তাকে সাক্ষী হিসেবে আনা হলনা, অন্য কোন সাক্ষী দিয়ে কেন কিছু বলানো হলনা এর কোন ব্যাখ্যা নেই।
মিজানুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম পিডিবি নেতা নবি চৌধুরী স্বাধীনতা বিরোধী কি-না তাও সে জানেনা। তার বক্তব্য যে অসত্য এটা তার প্রমান। সে ডিসি অফিসে চাকরি করত কিন্তু ডিসি অফিস লুট হওয়ার খবরও সে জানেনা বলছে। একজন মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে যা জানার কথা তাও সে জানেনা বলছে। সত্য এড়িয়ে গেছে। যে লোক স্বাভাবিক জানাকথা সঠিকভাবে বলছেনা তার বাকি কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
১০ নং অভিযোগ মীর কাসেম আলীর নির্দেশে মো : জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন।
ভিকটিম চারজনই সাক্ষ্য দিয়েছে। মিজানুল ইসলাম বলেন, সাক্ষী জাকারিয়া বলেছেন আটকের সময় পাকিস্তান আর্মি ছিল। শান্তি কমিটি বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই। এলাকায় রাজাকর ক্যাম্প দেখেনি সে। মীর কাসেম আলী ছাড়া অপর কাউকে তিনি চেনেননা।
সাক্ষী হাসিনা বেগম বলেছেন তিনি ১৯৭২ সালে সম্পাদক ছিলেন। ন্যাপ নেতা ছিলেন। কিন্তু তিনি জেরায় বলেছেন ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন বিষয়ে জানা নেই। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বিষয়েও বলতে পারছেননা। তার একথা কি বিশ্বাসযোগ্য? কারণ তিনি কোন সাধারন গৃহিনী নন। তিনি আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ডালিম হোটেল তদন্ত বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি তদন্ত করতে গিয়ে ওই বাড়ির কারো সাথে কথা বলেননি প্রথমে । আসলে তিনি তদন্ত করেছেন ঠিকই কিন্তু তদন্তে যখন মীর কাসেম আলী বিষয়ে কোন তথ্য পাননি তখন তিনি তদন্ত বিষয়ে অস্বীকার করেন। তিনি আসল তথ্য গোপন করেছেন। ওই বাড়ির একজনকে সাক্ষী করা হয় কিন্তু তাকে আনা হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন ডালিম হোটেলের মালিক মইত্যা গুন্ডার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল ১৯৭২ সালে সে বিষয়ে কোন তদন্ত করেননি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে অসদ উদ্দেশ্য নিয়ে মীর কাসেম আলীকে আসামী নির্ধারন করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সাজিয়ে সে অনুযায়ী শিখিয়ে পরিয়ে সাক্ষী হাজির করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে।
যুক্তি উপস্থাপনে মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, আসাদ উদ্দিন ও আবু বকর সিদ্দিক।
আগামী রোববার উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হবার কথা রয়েছে। এর মাধ্যমে শেষ হবে এ মামলার বিচার কার্যক্রম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন