মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর আপিল শুনানী শেষ

মেহেদী হাসান, ১৫/৪/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানী শেষ হয়েছে। আলোচিত এ মামলায় আজ উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। তবে রায় কবে ঘোষনা করা হবে সে বিষয়ে শুনানী শেষে আদালত কিছু উল্লেখ করেননি। পিরোজপুর এবং বরিশাল থেকে মমতাজ বেগমের দায়ের করা ১৯৭২ সালের মামলার নথি তলব করা বিষয়ে উভয় পক্ষের দুটি ভিন্ন আবেদন বিষয়ে আগামীকাল  আদেশ দেয়ার জন্য ধার্য্য করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মামলাটির শুনানী গ্রহণ করেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান যুক্তি উপস্থাপন শেষ করে মাওলানা সাঈদীকে নির্দেষা দাবি করে তার মুক্তি দাবি করেন। এছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে দরখাস্তের শুনানী শেষে যুক্তি উপস্থাপনের সমাপনি টানেন। তিনি স্কাইপ সংলাপসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ড তুলে  ধরে আদালতকে বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল একটি পক্ষপাতমূলক আদালত । মাওলানা সাঈদীর মামলাটিকে ঐতিহাসিক মামলা উল্লেখ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তিনি ন্যায় বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, ৪০ বছর পরে শুরু হওয়া এ মামলা একদিন দেশে ইতিহাস হয়ে থাকবে।

ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে যে মামলা করেছিল সেই মামলার  চার্জশিট জমা দিয়েছে আসামি পক্ষ। মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিট বিবেচনায় নেয়া এবং পিরোজপুর থেকে ওই মামলার জিআর বই তলবের আবেদন করেছে আসামি পক্ষ। অপর দিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পিরোজপুর এবং বরিশাল ঘুরে এসে বলছেন মমতাজ বেগমের মামলার কোন নথি পাওয়া যাচ্ছেনা। তিনি বরিশাল থেকে ১৯৭২ সালে গঠিত স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্টার বই তলবের আবেদন করেছেন। আগামীকাল  বুধবার এ বিষয়ে আদেশের জন্য ধার্য্য করেছেন আদালত।

চার্জশিট বিবেচনায় নেয়া  এবং জিআর বই তলবের আবেদনের ওপর শুনানী করেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন। আবেদনের সাথে তারা মমতাজ বেগমের মামলার জিআর কপির  ফটোকপি জমা দিয়েছে। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা ট্রাইব্যুনালে পিরোজপুর থেকে পাওয়া মমতাজ বেগমের মামলার জিআর বই জমা দিয়েছিলাম কিন্তু তা খারিজ করে দিয়েছে । গতকাল শুনানীর সময় আদালত জিআর বইর ফটোকপি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। আদালত প্রথমে বলেন, এটা একটা ফটোকপি। সার্টিফাইড কপি নয়। তখন অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, আমরা সার্টিফাইড কপি চেয়েছিলাম কিন্তু দেয়নি। জিআর বই’র ফটোকপি কিভাবে সংগ্রহ করা হল আদালতের এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সেটা আমার জানা নেই। তখন একজন বিচারপতি বলেন,  নিশ্চয়ই জিআর বই ফটোকপির জন্য বাইরে নিয়ে যেতে হয়েছে। যারা এটা করতে পারে তারা সবই পারে। জিআইর নথিতে বরিশাল স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের নম্বর না থাকা, কবে কিভাবে মামলাটি প্রত্যাহার হল, কে কিভাবে কোন ক্ষমতাবলে প্রত্যাহার কর, বাকেরগঞ্জ ডিসির কাছে কিভাবে গেল আদালত এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমাদের ডকুমেন্টটি সত্য না মিথ্যা সেটা প্রমানের জন্যই পিরোজপুর থেকে এ মামলার জিআর বই তলব করা উচিত এবং তার সাথে আমাদের এ কপি মিলিয়ে দেখা যাবে। তাহলেই সত্য মিথ্যা বের হয়ে যাবে। আর মূল বিষয় হল মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে এ ধরনের একটি মামলা করেছিল কি-না, এ ধরনের একটি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল কি-না, এফআইর এবং চার্জশিট হয়েছিল কিনা । এটা জানা গেলেই ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আমাদের দাবির সত্য  না মিথ্যা প্রমানিত হবে। সেজন্য পিরোজপুরের জিআর বই তলব করা দরকার।  আপনারা গোড়ায় হাত দেন। বরিশল ট্রাইব্যুনালে এ মামলা গিয়েছিল কিনা এবং সেখানে কি হয়েছিল তা পরের বিষয়। আগে জানা দরকার পিরোজপুরে আদৌ এ মামলা হয়েছিল কিনা। খন্দকার মাহবুব হোসেন বারবার বলেন, আপনারা দয়া করে গোড়ায় হাত দেন। এটাই আমাদের নিবেদন।

আজ অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানী পেশ করার পর একজন বিচারপতি বলেন,  মি. অ্যাটর্নি জেনারেল আমার স্পষ্ট মনে আছে আসামী পক্ষের দাখিল করা মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর গ্রহণ না করার যে আবেদন আপনারা দিয়েছেন তাতে আপনি বলেছেন এ  মামলার চার্জশিট আসামি পক্ষ জমা দেয়নি। আপনি বলেছিলেন  এফআইআরে আসামির নাম না থাকলেও চার্জশিটে থাকতে পারে। আপনি বারবার বলেছেন আসামি পক্ষ চার্জশিট জমা দিতে পারেনি। কিন্তু এখন তারা চার্জশিট জমা দেয়ার পর আপনি ভিন্ন যুক্তি দেখাচ্ছেন।

দরখাস্ত বিষয়ে শুনানী শেষে মাওলানা সাঈদীপর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতের অনুমতি নিয়ে  ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা এবং সুখরঞ্জন বালি বিষয়ে কিছু কথা বলেন। তিনি বলেন, সুখরঞ্জন বালি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তারা তাকে আনতে পারলনা। আমরা তাকে আনলাম। এরপর তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করা হল। তাকে অপহরন করায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
এরপর তিনি সুখরঞ্জন বালীর একটি সাক্ষাৎকার পড়ে শোনান যেখানে সুখরঞ্জন বালি  বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রপক্ষের শেখানোমত মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাকে ট্রাইব্যুনালে আনেনি। তিনি আগে থেকেই মাওলানা সাঈদীকে চিনতেন। তাদের বাড়ি আক্রমন এবং তার ভাই বিশাবালীকে ধরে নিয়ে যাবার ঘটনার সময় তাদের বাড়িতে যারা এসেছিল তাদের সাথে মাওলানা সাঈদী ছিলনা। থাকলে তিনি তাকে চিনতেন। কারণ মাওলানা সাঈদীকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা সাঈদীর শশুরের কাপড়ের দোকান ছিল । সেই সূত্রে আগে থেকেই তিনি তাকে চিনতেন।

এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে পক্ষপাতমূলক (বায়াজড) আখ্যায়িত করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে বাইরের একজন লোকের সাথে ১৭ ঘন্টা স্কাইপ সংলাপ করেছেন এর চেয়ারম্যান। বিচার নিয়ে ২২৩টি ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। বাইরে থেকে পাঠানো অনেক বিষয় তিনি হুবহু ট্রাইব্যুনালে পড়ে শুনিয়েছেন।

সকালে শুনানীর  শুরুতে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মাওলানা সাঈদী স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার ইত্যাদি। কিন্তু আবার তারাই বলছে মাওলানা সাঈদী পাড়েরহাট বাজারে চট বিছিয়ে তেল নুন লবন মরিচ বিক্রি করত। এ ধরনের একজন লোক কি করে তাদের বর্নিত কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, মাওলানা সাঈদী যশোরে ছিলেননা বরং পিরোজপুরে ছিলেন এ মর্মে কোন সাজেশন তারা সাফাই সাক্ষীদের দেয়নি।
আদালতের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিরোজপুর জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইতে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। দেলোয়ার হোসেন মল্লিক নামে এক লোকের নাম আছে। সেই বইয়ে পিরোজপুরের কৃতি সন্তানদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম আছে।

২০১৩ সালেল ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয়। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে  ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। যে ছয়টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল  সেগুলোতে সাজা উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে একই দিন রাষ্ট্রপক্ষও আপিল আবেদন করে।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আজ আলোচিত এ মামলায় উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হল।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ মামলায় শুনানী পেশ শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর তার অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান শুনানী পেশ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। এছাড়া এ মামলার আপিল শুনানীর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাজুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম, মহিনুর ইসলাম, মতিয়ার রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, মোসাদ্দেক বিল্লাহ। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন