মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১২

পূর্বের একজন সাক্ষী কর্তৃক দাবিকৃত মৃত এক সাক্ষী সাক্ষ্য দিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে



মেহেদী হাসান, 2/10/2012
গত ৪ জুন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে  চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন গৌরাঙ্গ সিংহ।
গৌরাঙ্গ সিংহ সেদিন বলেছিলেন “আমি আমার জবানবন্দীতে যাদের নাম বলেছি তার মধ্যে আমি ও প্রফুল্ল ছাড়া আর কেউ জীবিত নাই।”
গৌরাঙ্গ সিংহ  তার জবানবন্দীতে যাদের নাম বলেছেন তার মধ্যে একজন ছিলেন গোপাল দাস। গৌরাঙ্গ সিংহের দাবি অনুযায়ী গোপাল দাস  মারা গেছে। কিন্তু  আজ  সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৪ তম সাক্ষী হিসেবে  রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করলেন সেই গোপাল  চন্দ্র দাসকে।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা   জেরার সময় ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন এর  আগে চতুর্থ সাক্ষী বলে গেছেন গোপাল চন্দ্র দাস মারা গেছে।
তিনি সাক্ষী গোপাল  চন্দ্র দাসকে জেরার সময় সাজেশন দিয়ে বলেন, যে গোপাল  চন্দ্র  দাসকে  এ মামলায় সাক্ষী  বলে দাবি করা হয়েছে  সে অনেক আগেই মারা গেছে।  জবাবে সাক্ষী গোপাল চন্দ্র দাস বলেন, সত্য নয়।

গোপাল দাস সম্পর্কে গৌরাঙ্গ সিংহ যা বলেছিলেন: 
 গৌরাঙ্গ  চন্দ্র সিংহ নূতন চন্দ্র সিংহের ভাইপো। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে বিচার হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি হত্যাকান্ড হল ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল গহিরার কুন্ডেশ্বরী কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ড।  ৪ জুন গৌরাঙ্গ সিংহ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দীতে  তার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ডের বর্ননা দিয়ে বলেন, ওই দিন তিনি কুন্ডেশ্বরীতে ছিলেন। এছাড়া  হিমাংশু বৈদ্য, ব্রজহরী কর্মকার, মনোরঞ্জন সিংহ এবং  গোপাল দাসও ছিলেন তাদের সাথে।  বাড়িতে আর্মির গাড়ি   ঢোকার পর এবং গাড়ি থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ আর্মি  নামার পর তিনি,   হিমাংশু বৈদ্য এবং  মনোরঞ্জন সিংহ বাড়ির দনি পাশে পালিয়ে যান।   অন্য দুজন যথা  ব্রজহরী কর্মকার ও গোপাল দাস বাড়ির দোতলায় উঠে যায়। 
তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেব, দেশীয় লোকজন এবং পাঞ্জাবীরা আমার কাকা নতুন চন্দ্র সিংহের  সংগে কথা বলে চলে যায়।  জঙ্গলে পালিয়ে থেকে গাড়ির শব্দে বুঝলাম যে তারা চলে গেল।১০/১৫ মিনিট পর আবার  গাড়ির শব্দে বুঝলাম তারা আবার আসলো। তখন বোধ হয় স্টেনগানের গুলি হবে এরকম শব্দ শুনলাম। ২/১ মিনিটের মধ্যে আবার ২/৩টা গুলির শব্দ শোনা যায়। তখন আমরা ভাবলাম যে ওখানে থাকা নিরাপদ হবেনা এবং আমরা দনি দিকে চলে গেলাম।
গৌরাঙ্গ  সিংহ বলেন, তার কাকা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ডের পর তারা ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর ভারত থেকে দেশে এসে ব্রজহরি কর্মকাকারের কাছে তার কাকার হত্যাকান্ডের বিবরন শুনেন তিনি। গৌরাঙ্গ সিংহ বলেন, আমরা ভারত থেকে ফিরে এসেছি একথা শুনে  ব্রজহরী কর্মকার আমাদের কাছে আসে । তার কাছে শুনি যে, ঘটনার দিন সে ও গোপাল দাস দোতলায় ছিল। সেখান থেকে তারা দেখেছে যে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সংগে কিছু বাঙ্গালী এবং পাঞ্জাবী মিলিটারী সহ বাড়িতে ঢুকে আমার কাকা  নতুন চন্দ্র সিংহের সাথে কথা বলে চলে যায়। কিছুণ পরে তারা আবার ফিরে এসে মন্দির থেকে কাকাকে টেনে হিচড়ে মন্দিরের সামনে নিয়ে আসে এবং পাঞ্জাবীরা ব্রাশ ফায়ার করে। তারপর দুই মিনিটের মধ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাকে গুলি করে।  এরপর ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। ব্রজহরী কর্মকারের নিকট থেকে আরও শুনি যে কাকা  নতুন চন্দ্র সিংহের লাশ ২/৩ দিন সেখানে পড়ে ছিল।

গৌরাঙ্গ সিংহের বর্ননা মতে  নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ডের দিন ব্রজহরি  ও গোপাল দাস দোতলায় ছিল। সেখান থেকে তারা নূতন চন্দ্র সিংরে হত্যাকান্ড দেখেছেন।  ব্রজহরির কাছ থেকে শোনা সে হত্যাকান্ডের বর্ননা দেন গৌরাঙ্গা সিংহ। জবানবন্দীর শেষের দিকে তিনি বলেন, “আমি আমার জবানবন্দীতে যাদের নাম বলেছি তরি মধ্যে আমি ও প্রফুল্ল (নুতন চন্দ্র সিংহের ছেলে) ছাড়া আর কেউ জীবিত নাই।
গৌরাঙ্গ সিংহের  এ দাবি অনুযায়ী গোপাল দাস মৃত। কিন্তু আজ  রাষ্ট্রপক্ষ  হাজির করল গৌরাঙ্গ সিংহ বর্নিত সেই  গোপাল দাসকে।  গৌরাঙ্গ সিংহের বর্নিত  সে হত্যাকান্ডের বিবরনের সাথে মিল রয়েছে  আজ  গোপাল চন্দ্র দাসের বর্ননার সাথে। গোপাল চন্দ্র দাসও আদালতে তার জবনাবন্দীতে বলেন ১৩ এপ্রিল তিনি এবং ব্রজহরি ভবনের দোতালায় আত্মগোপন করেন এবং সেখান থেকে নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাকান্ড দেখেন।

গোপাল চন্দ্র দাসের জবানবন্দী :
আমার নাম গোপাল চন্দ্র দাস।  বয়স-৭৬ বছর । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ৩৪/৩৫ বছর ছিল। আমি ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম,এ, পাশ করেছি। এর আগে সংস্কৃত শাস্ত্রে কাব্য ব্যাকরণথীর্থ ও বিধ্যানীধি উপাধি লাভ করি। আমি বর্তমানে চিটাগং এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক যাহা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭৫ সনে। ১৯৭১ সালে আমি কুন্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয়ের অধ্য হিসাবে কর্মরত ছিলাম। সেখানে আমি ১৯৭০ সালে যোগদান করি। ঐ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অধ্য নতুন চন্দ্র সিংহ এবং আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা অধ্য। ১৯৭১ সাল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সকলের নিকট একটি স্মরণীয় বছর। ১৯৭১ সালে কুন্ডেশ্বরী ভবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা যা এ যুগের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ঘটনা বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে বলে চট্টগ্রাম বাসী এবং বাংলাদেশের জনগণ জ্ঞাত আছেন। ১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল এই ঘটনাটি ঘটে। ঐ দিনে কুন্ডেশ্বরী আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয়, কুন্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যা মন্দির এবং কুন্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয়ের মহান প্রতিষ্ঠানা দানবীর নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে হত্যা করা হয় এবং এই ঘটনাটি আমি চাুস প্রত্য করেছি। দেশ যখন পাকিস্তানিদের দ্বারা আক্রান্ত সেই সময়ে তাদের কিছু সহযোগী পাকিস্তানি মিলিটারীদের সাথে একত্র হয়ে লুন্ঠন, হত্যাকান্ড, অগ্নি সংযোগ এবং ধর্ষণ ইত্যাদি জঘন্যতম ঘটনা ঘটতে থাকে এবং এ খবর কুন্ডেশ্বরীতে আমাদের কাছে আসছে। সেখানে আশ্রিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০টি অধ্যাপক পরিবারও এ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্রিত অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ রশিদুল হক, ডঃ মাহমুদ শাহ কোরায়েশী প্রমুখ। বিষয়টি অবহিত হয়ে আমরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকবৃন্দ একটি জরুরী আলোচনায় মিলিত হই। অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেব অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা বিষয়ে আলী আহসান সাহেবের জ্ঞান ছিল গভীর। তিনি সেদিন বলেছিলেন যুদ্ধ আসন্ন এবং আমরাও আক্রান্ত হতে পারি। আমরা সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দ সহ কুন্ডেশ্বরী ভবনের সকলেই ১০ই এপ্রিল তারিখের মধ্যেই আবাসস্থল ত্যাগ করে ভারতে চলে যাবো। পরবর্তীতে ১০ তারিখের মধ্যেই কুন্ডেশ্বরী ভবন এবং আশ্রিত অধ্যাপকবৃন্দ তাদের আবাসস্থল ত্যাগ করেন, একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা অধ্য নতুন চন্দ্র সিংহ ছাড়া। তাকে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেব সহ আমরা সকলেই অনুরোধ করি। কিন্তু নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয় সংকল্পে দৃঢ় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন এ আমার জন্মভূমি এবং আমার প্রাণ প্রিয় প্রতিষ্ঠান সমূহ আমি স্থাপন করেছি এখানে মা কুন্ডেশ্বরী মুর্তি স্থাপিত আছে এগুলোকে ত্যাগ করে আমি কোথাও যেতে পারি না। পরের দিন থেকে সকলেই কুন্ডেশ্বরীর আবাসন ত্যাগ করতে থাকে এবং আমিও স্বস্ত্রীক আমার একমাত্র কন্যাটিকে নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে চলে যাই। গ্রামের বাড়ীতে একরাত্রি অবস্থানের পর আমি পরের দিন কুন্ডেশ্বরী ভবনে ফিলে আসি। আমি যখন কুন্ডেশ্বরী ভবনে প্রবেশ করলাম তখন দেখলাম যে, নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয় একান্ত একা। তিনি আমাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হলেন এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রায় কাঁদ কাঁদ স্বরে তিনি বললেন বাবা সবাই চলে গেছে তুমিও যাবে নাকি? তুমি যেও না, তুমি থাক। আমিও আবেগে তাড়িত হয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে, কাকাবাবু যাবনা, আপনাকে নিয়েই আমি থাকবো। সেইদিন কিছুণ পরে আমি গৌরাঙ্গ সিংহকে দেখেছিলাম। তিনি অবস্থান করছিলেন নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে রান্না বান্না করে দেওয়ার জন্য। সেইদিন বেলা বারোটা/একটা পর্যন্ত আমি কুন্ডেশ্বরী ভবনে ছিলাম। তারপর দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে বিকাল ৪/৫ টার সময় আমি আবার কুন্ডেশ্বরী ভবনে ফিরে আসি। নতুন সিংহ মহাশয় আমাকে পুনরায় দেখে স্বস্তি পেয়েছিলেন। আমি প্রায় রাত্রি ৯/১০ টা পর্যন্ত কুন্ডেশ্বরী ভবনে ছিলাম এবং নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে সংগ এবং স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পুনরায় রাত্রিতে আমি আবার জগৎমল্লপাড়ায় আমার বড় শ্যালিকার বাড়িতে ফিরে আসি এবং সেখানে রাত্রি যাপন করি। পরের দিন আবার সকাল ৯/১০ টার দিকে আবার কুন্ডেশ্বরী ভবনে যাই এবং নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সংগে দেখা করি। সেইদিন আরও কিছু সংখ্যক লোক একজনের পর একজন করে প্রায় ৬/৭ জন লোক কুন্ডেশ্বরী ভবনে এসে নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সংগে সাাত করে। তাদের মধ্যে ছিলে শ্রী ব্রজহরি কর্মকার, শমাংক মোহন পালিত, হিমাংশু বৈদ্য, মনোরঞ্জন সিংহ এবং গৌরাঙ্গ সিংহ। আমরা বসে বেশ কিছুণ নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সংগে আলোচনা করেছি এবং আমাদের সকলের নিরাপত্তার জন্য কুন্ডেশ্বরী ভবন ত্যাগ করে অন্য কোন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এবং নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সংগে কথাবার্তা বলে আমরা যে যার বাড়িতে চলে যাই। আমি জগৎমল্লপাড়ায় চলে যাই। বিকালে আমি আবার কুন্ডেশ্বরী ভবনে আসি এবং নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে সংগ দিয়ে আবার বিকালে আমার সেই শ্যালিকার বাড়িতে জগৎমল্লপাড়ায় চলে যাই। পরের দিন অর্থাৎ ১৩ই এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে সকাল ৯টা/ সাড়ে নয়টার সময় আমি আবার কুন্ডেশ্বরীতে ফিরে আসার সময় আমি রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ শুনছিলাম। খুব তাড়াহুড়া করে কুন্ডেশ্বরী ভবনে এসে দেখলাম যে, ব্রজহরি বাবু, হিমাংশু বৈদ্য, মনোরঞ্জন সিংহ এবং গৌরাঙ্গ সিংহ কুন্ডেশ্বরী মন্দিরের উঠানে দাঁড়িয়ে নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সাথে আলাপ আলোচনা করছেন। আমি এসেই বললাম যে, আর দেরী নয়, আমাদের এখনই চলে যেতে হবে। আমি গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছি। পাকিস্তানি আর্মি এবং তাদের সহযোগীরা কুন্ডেশ্বরীতেও আসতে পারে। কথাটা বলেছিলাম শুধু নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে সরিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বেশী সময় লাগল না। অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানি আর্মি বহর সামনে একখানা জীপ গাড়ি হন হন করে কুন্ডেশ্বরী ভবনে ঢুকে পড়ে, বাইরের উঠানে থেমে যায়। তখন আমরা দেখলাম সঙ্গিন উঁচিয়ে পাকিস্তানি আর্মি নামছে এবং জীপ থেকে একজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার সহ কয়েকজন সিভিলিয়ান যারা বাঙ্গালী গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। তাদেরকে দেখেই সকলে বলে উঠলেন, ওই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ওই মাবুদ। আমরা তাদেরকে দেখেই অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আমি এবং ব্রজ হরি বাবু নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের দ্বিতল ভবনের দোতলায় উঠে পড়ি এবং সেখানে আত্মগোপন করে। অন্যারা বাড়ির পেছনের দিকে অর্থাৎ বাড়ির দণি-পশ্চিম দিকে বাঁশঝাড়ে এবং ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করে। আমি এবং ব্রজ হরি বাবু দোতলায় যে ছোট কামরাটিতে ব্রজ হরি বাবু থাকতেন সেই কামরায় নিজেকে আড়ালে রেখে জানালা দিয়ে সেদিনকার ঘটনা অবলোকন করতে থাকি। দেখলাম যে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাহেব এবং পাকিস্তানি আর্মি অফিসার এবং দু/একজন আর্মি সিপাই এবং আরও দুই/একজন বাঙ্গালী নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়ের সাথে কথাবার্তা বলছেন এবং কিছুণ পরেই তারা নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে ছেড়ে আবার চলে যায়। তারা গাড়িতে উঠেন, আমরা গাড়ির আওয়াজ শুনেছি। আমরা ভেবেছিলাম বিপদমুক্ত হলাম। আনুমানিক আট/দশ মিনিট পরে আবার গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। আমরা দোতলার ঐ ঘরটিতে আবার আত্মগোপন করি। কিছুণ পরে আমরা আবার দেখতে পাই সেই সেনাবাহিনী এবং তাদের সংগের লোকেরা আবার ফিরে আসে এবং মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করে নতুন চন্দ্র সিংহ মহাশয়কে টেনে হিচড়ে বাহির করে উঠানে নিয়ে আসে। তাকে উদ্দেশ্য করে ব্রাশ ফায়ার করে এবং তিনি ছটফট করতে থাকেন। আমি নিজে দেখেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও তার পিস্তল বা রিভলবার দিয়ে নতুন চন্দ্র সিংহের উপর দুই/তিন রাউন্ড গুলি বর্ষন করে এবং বলে তাকে হত্যা করার জন্য বাবার নির্দেশ আছে। এইভাবে নতুন চন্দ্র সিংহের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা ওখান থেকে চলে যায়। আমরা অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দোতলা থেকে নেমে দেিণ ধান বিলে দৌড়ে পালিয়ে যাই। নতুন চন্দ্র সিংহ ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আমি আমার স্ত্রী সহ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিই। স্বাধীনতার পরে ২৮শে ডিসেম্বর দেশে ফিরে এসে কুন্ডেশ্বরী মহাবিদ্যালয়ে যোগদান করি। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। আমি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী  সাহেবকে চিনি, তিনি অদ্য ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন।

জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা।

জেরা :
প্রশ্ন : ঢাকা কতদিন হল এসেছেন?
উত্তর :  গত ১ সেপ্টেম্বর।
প্রশ্ন : ভারত থেকে কবে আসলেন।
উত্তর : ও সেপ্টেম্বর।
প্রশ্ন : কোলকাতা থেকে এসে এখনো বাড়ি যাওয়া হয়নি?
উত্তর : না। 
প্রশ্ন : ভারতে কত তারিখ গেলেন?
উত্তর : চার মাস আগে।
প্রশ্ন : চট্টগ্রামে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে তিন মাসের বেশি ভিসা দেয়না।
উত্তর : আমাকেও দেয়নি। আমার ওভার স্টে করেছি আমার চোখের চিকিৎসার জন্য।
প্রশ্ন : ওভার স্টে বিষয়ে ভিসায় সিল মেরেছে?
উত্তর : আলাদা কাগজে মেরেছে।
প্রশ্ন : যে গোপাল চন্দ্র দাসকে এ মামলায় সাক্ষী বলে দাবি করা হয়েছে সে  অনেক আগে মারা গেছে।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে আপনার পিতার নাম  বঙ্গ চরন দাস বলেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
 ( এসময় নাম  নিয়ে প্রশ্ন করায় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক এ প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা জানতে চান আইনজীবীর কাছে। তখন আহসানুল হক হেনা বলেন, পূর্বের  চতুর্থ সাক্ষী বলে গেছেন গোপাল  মারা গেছে। )
প্রশ্ন : আপনি ১০, ১১ এবং ১২ এপ্রিল গৌরাঙ্গ সিংহকে দেখেননি । সে তার আগেই ভারতে চলে গেছে।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : নূতন চন্দ্র সিংহের বাবার বাড়ি কোথায় তা কখনো তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
উত্তর : না, কারণ আমি তা জানি।
প্রশ্ন : কোথায় তার বাবার বাড়ি?
উত্তর : গহিরায়। সুলতানপুরও হতে পারে।
প্রশ্ন : আপনি কোনদিন কোনকালে কুন্ডেশ্বরী বালিকা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেননা।
উত্তর : সত্য নয়।
এ পর্যন্ত জেরার পর জেরা  বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। জেরায় আহসানুল হক হেনাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, রেজাউল করিম।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি  জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু,  প্রসিকিউটর রানাদাস  গুপ্ত, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন