রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

সুখরঞ্জন বালীর জন্য অপেক্ষা

মেহেদী হাসান, ২১/৯/২০১৪
‘মোর স্বামীর পরানডা কি  আছে? আমনেগো পায় ধরি, মোর স্বামীরে আইন্যা দ্যান।  মোরে এটটু খবর  দ্যান।”
প্রায় দুই বছর আগে সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানী  এই আকুতি প্রকাশ করেছিলেন। বালী নিখোঁজ হবার পর ২০১২ সালের   ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আরতী রানীকে ফোন করা হলে নিখোঁজ স্বামীর জন্য তিনি বিলাপ করে এভাবে আকুতি প্রকাশ করেছিলেন।

নিখোঁজ স্বামীর কোন সন্ধান ছাড়াই আরতী রানীর পর হয়ে যায় ছয় মাস।  এরপর ২০১৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার নিউএজ পত্রিকায় খবর বের হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন। 

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে ২০১২ সালের পাঁচ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন সুখরঞ্জন বালী। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় হয়েছে। কিন্তু বালীর জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানদের।

গত শুক্রবার সকালে আবার ফোনে যোগাযোগ করা হয় সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী আরতী রানীর সাথে। স্বামীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেই কান্নার  সুর ভেসে আসতে থাকে ফোনের ওপার থেকে।  “মোর স্বামীরে আইন্না এটটু দেহান মোরে। মোর অসুখ। মরার আগে স্বামীর মুখ দেখে যেন মরতে পারি হেই ব্যবস্থা করেন আমনেরা।”

সংসার কিভাবে চলছে জানতে চাইলে আরতী রানী জানান, তার স্বামী সুখরঞ্জন বালী কাঠমিস্ত্রীর কাজ করত। নিখোঁজ হবার আগে একটি ঘর বানিয়েছিলেন নিজেদের জন্য ।  কিন্তু সে ঘরে আজ নেই তিনি। স্বামী নিখোঁজের পর দিশাহীন অবস্থায় পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরেছেন আরতী রানী। বেহাল দশা নেমে আসে সংসারে। আগে থেকেই তার হাপানীসহ আরো রোগব্যাধি ছিল। স্বামীর শোক এবং সংসারের এ দুরবস্থার কারনে তার অসুস্থতার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। অধিকাংশ সময় তিনি এখন শয্যাশায়ী ।  একমাত্র মেয়ে মনিকার বিয়ে হয়েছিল । সে স্বামীর বাড়ি না থেকে এখন বাপের বাড়ি থাকে তার দেখাশুনার জন্য। মনিকা ছাড়া তাদের  অপুর্ব নামে আরেকটি ছেলে আছে ১৬ বছর বয়সের।

আরতী রানী জানান, স্বামী কাঠ মিস্ত্রী বাবদ যে আয় করত তা দিয়েই চলত সংসার। জমিজমা নেই; সামান্য বাস্তুভিটা এবং একটা গরু আছে। স্বামী নিখোঁজ হবার পর অভাব অনটন নেমে আসে সংসারে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতে থাকে। গরুটি তিনি বেঁচতে চেয়েছিলেন। মেয়ে বলেছে বাবার স্মৃতি বেচা ঠিক হবেনা ।  একথা বলার সময় আবার কান্নার সুর ভেসে আসে ফোনে।

ফোনে কথা বলার সময় আরতি রানী প্রথমে কথা বলদে দ্বিধা এবং  জড়তা প্রকাশ করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান কত লোক কত কথা জানতে চায়। কার কাছে কি বললে কোন বিপদ নেমে আসে সে ভয়ে আছেন তারা। তার স্বামী মাওলানা সাঈদীর মামলার স্বাক্ষী হওয়া এবং নিঁেখাজ হবার পর অনেক লোক অনেক কথা বলেছে। অনেকে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে তাদের কাছে।  অনেকে ভয়ভীতিও দেখিয়েছে।
আরতী রানী বলেন, তার সাথে এখনো অনেকে কথা বলেনা। এড়িয়ে চলে। কারণ এর ফলে যদি তাদেরও কোন বিপদ হয়। দোকানে কোন কিছূ কিনতে গেলে দোকানদার তাড়াতাড়ি সদায় দিয়ে বিদায় করতে চায়।
আরতী রানী জানান, সুস্থ থাকলে তিনি মানুষের বাড়িতে কিছু কাজ টাজ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তিনি এখন অসুস্থ। হাটাচলা করতে পারেননা ঠিকমত। কারণ হিসেবে সঙ্কোচের সাথে জানালেন তার জরায়ু অনেক নিচে নেমে গেছে অনেক দিন থেকে। কোন চিকিৎসা হয়নি। হাপানিরও কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা। তুদপরি রয়েছে ঠিকমত খাবার না পাবার সমস্যা। আরতি রানী জানান তার বয়স ৫০ এর উপরে হবে।

কে সুখরঞ্জন বালী : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালে যেসব অভিযোগ আনে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল পিরোজপুরের উমেদপুর গ্রামে বিশাবালী নামে একজনকে  নারকেল গাছের সাথে বেঁধে রাজাকাররা  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে তারই সামনে গুলি করে হত্যা করে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। তার মধ্যে একটি হল এই বিশাবালী হত্যার অভিযোগ। আপিল বিভাগের রায়ে বিশবালী হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। সেই বিশাবালীর আপন ছোটভাই হলেন সুখরঞ্জন বালী। তিনি ছিলেন মাওলানা স্ঈাদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী।  কিন্তু তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আসেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  সাক্ষ্য দিতে আসার দিন ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে তাকে অপহরন করা হয়। 

গোটা বিশ্বে এ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায় ডেভিড বার্গম্যানের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হয় সুখরঞ্জন বালী বিষয়ে। তাতে বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দমদম সংশোধন কেন্দ্রে রয়েছেন। সুখরঞ্জন বালীর সাথে তারা যোগাযোগ করলে বালী তাদের জানিয়েছেন ঢাকার আইনশঙ্খলা বাহিনী তাকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ভারতে বালী : নিউএজ পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানানো হয় বালীকে ৫ নভেম্বর অপহরনের পর ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতে পাঠানো হয় জোর করে। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাকে গ্রেফতার করে উত্তর চব্বিশপরগনার বশিরহাট জেলে রাখে।  এরপর বশিরহাট আদালত ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল   অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়।  যেহেতু বিচার চলাকালে এই মেয়াদটা  তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে  তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যেতে পারে বলে মত দেন আদালত।

সুখরঞ্জন বালীর ভারতে অবস্থানের বিষয়ে জানার পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের প্রতি অনুরোধ জানায় তাকে যেন বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানো হয় কারণ তাতে তার জীবনের আশঙ্কা রয়েছে।

সুখরঞ্জন বালীকে সহায়তার জন্য এ পর্যায়ে বেশ কিছু মানবাধিকার সংস্থা এবং আইনজীবী এগিয়ে আসেন। সুখরঞ্জন বালীর কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কা তৈরি হয়। সেজন্য তিনি ভারতের সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ হন তার সাহায্যে এগিয়ে আসা আইনজীবীদের মাধ্যমে।  সুপ্রিম কোর্টে বালী অনুরোধ করেন তাকে যেন দেশে ফেরত পাঠানো না হয়। দেশে ফেরত পাঠালে তার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৩ সালের ২রা আগস্ট শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বালীকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দুই সপ্তাহ স্থগিত করে আদেশ দেন।

এরপর কলকাতা হাইকোর্ট  ছয় আগস্ট এক আদেশে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ মেয়াদ শেষ হলে ২০ আগস্টের পর বালীকে দেশে পাঠানোর জন্য।
এ প্রেক্ষিতে বালী ১৩ আগস্ট ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবদন করেন এবং ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট  এক আদেশে বলেন তাকে দেশে ফেরত পাঠানো বা ভারতে রাখার বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছা। সেই অবধি এখনো ভারতেই সরকারি হেফাজতে আছেন তিনি।

তবে বালীর জন্য অপেক্ষারত তার অসুস্থ স্ত্রী এবং সন্তানেরা চান বালী দেশে ফিরে আসুক এবং আগের মত যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন সে নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হোক।




বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

ঘটনাবহুল আলোচিত একটি মামলা

 মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে আলোচিত মামলা  হিসেবে স্থান পেয়েছে  ১৯৭১ সালের  যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম।  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলা হয়েছে  তার মধ্যে নানা কারনে অন্যতম  আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলায় পরিণত হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে এ মামলার প্রতি মানুষের অধীর আগ্রহের মূলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় ছিলনা। ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীকে অপহরন করা, স্কাইপ কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী গণেশ চন্দ্র  পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়াসহ নানা কারনে বিশ্বজুড়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে এ মামলা। 

মামলার আসামী যেমন এ মামলায় মানুষের আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু তেমনি এ মামলার বিভিন্ন অভিযোগ এবং মামলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা প্রবাহের  কারনেও এ মামলার খবরাখবর পাঠকের কাছে ছিল গভীর আগ্রহের বিষয়। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ, ‘সাঈদী’ এবং ‘দেলু  শিকদার’ এসব বিষয়ও ছিল এ মামলার আলোচিত বিষয়।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ১৯৭১ সালের ৮ মে তার নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজারের নিকটস্থ  চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর সেখান থেকে ইব্রাহীম কুট্টি এবং মফিজউদ্দিন পসারীকে ধরে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট নেয়ার পর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে । 
বিচার চলাকালে আসামী পক্ষ আদালতে জানান, ইব্রাহীম কট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট ১৪ জনকে আসামী করেছিলেন। আসামীর তালিকায়  আল্লামা সাঈদীর নাম নেই। ওই মামলার বিবরনে আরো বলা হয় ইব্রাহীম কুট্টিকে  ১৯৭১ সালে ১ অক্টোবর তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। আসামী পক্ষ অভিযোগ করে মমতাজ বেগম এখনো জীবিত কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি।

মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন এবং সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী  হওয়ায় দেশে এবং বিদেশে অগণতি মানুষের নিয়মিত মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়  এ মামলার কার্যক্রম ।
মাওলানা সাঈদীর বিচারে যখন সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয় তখন এ বিষয়ক খবরের জন্য পাঠকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। জেরায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর মুখ থেকে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম কি বের করে আনেন তা জানার জন্য পরের দিনের পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করেছেন অগণিত পাঠক। পিরোজপুরের বর্তমান এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাছাড়া জেরায়  রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষীর বিরুদ্ধে চুরি, জেল খাটাসহ আরো নানাবিধ তথ্য বের হয়ে আসে যা ছিল  পাঠকের কাছে বেশ  আকর্ষণীয়। 

ট্রাইব্যুনাল থেকে এ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশে দেড়শতাধিক মানুষ জীবন দেয়। সারা দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে।
বিচার চলাকালে  এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর  ২০১২ সালে  জুন মাসে বিচার চলাকালে  ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী।

মামলা চলাকালে ২০১২ সালের  পাঁচ নভেম্বর মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন সুখরঞ্জন বালী। সেদিন তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করে নিয়ে যাওয়া হয়। বালী অপহরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাড়া ফেলে। কারণ সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তিনি পক্ষ ত্যাগ করে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। আরো একটি কারনে বালী অপহরন ঘটনা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে সেটি হল  তিনি ছিলেন বিশাবালীর আপন ভাই। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের  অভিযোগ ছিল তার নির্দেশে বিশাবালীকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। সেই বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী এসেছিলেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে।
এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মে ঢাকার দৈনিক নিউএজ পত্রিকায়  প্রকাশিত ডেভিড বার্গম্যানের  অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে  বলা হয় সুখরঞ্জন বালীর সন্ধান  পাওয়া গেছে। তিনি ভারতের একটি কারাগারে বন্দী আছেন। বালী জানিয়েছেন তাকে আইনশঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এরপর আবার নতুন করে শুরু হয় এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। 

গণেশ চন্দ্র সাহা ছিলেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আরেকজন সাক্ষী। কিন্তু গনেশ রাষ্ট্রপক্ষে  সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো মাওলানা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।  ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে একটি মর্মান্তিক হত্যাকান্ড হল ভাগিরথী হত্যাকান্ড। বিধবা ভাগীরথীকে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে আটকে রেখে ইজ্জত হরন করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য পাচারের অভিযোগে ভাগিরথীকে পাকিস্তান আর্মি গাড়ির পেছনে বেঁধে টেনে হিচড়ে হত্যা করে।  মাওলানা সাঈদীর সহায়তায় এই ভাগীরথীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। সেই  ভাগিরথীর ছেলে হলেন সাক্ষী গনেশ চন্দ্র সাহা। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি কোর্টে এসে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বললেন  মাওলানা সাঈদী তার মাকে মারেননি। পাকিস্তান আর্মিরাই তার মাকে মেরেছে।  এ ঘটনা তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। 

২০১২ সালের ছয় ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে এ মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ ঘোষনা করার কথা ছিল। সেদিন দেশ বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক হাজির হন ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সেদিন ফাঁস হল স্কাইপ কেলেঙ্কারীর খবর।  ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নিজেই বিষয়টি ওপেন কোর্টে প্রকাশ করলেন সেদিন এ ঘটনা।  

বিচারপতি নিজামুল হক বলেন,   ব্রাসেলসে বসবাসরত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের কাছ থেকে ট্রাইব্যুনালের  বিচার প্রকৃয়া চলাকালে এবং বিভিন্ন আদেশের  সময় সহায়তা নিয়েছেন তিনি। এ উপলক্ষে তাদের দুজনের মধ্যে স্কাইপের মাধ্যমে কথপোকথন হয়েছে। এ  তথ্য হ্যাক করে ইকনোমিস্ট হস্তগত করেছে বলে   উল্লেখ করেন তিনি ।
নয় ডিসেম্বর থেকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে বিচারপতি নিজামুল হক ও ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন।  এ নিয়ে দেশে বিদেশে তুমুল ঝড়  ওঠে।    বিচারপতি নিজামুল হকের কথোপোকথনের বিষয়বস্তু পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা একে  দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শুধু স্কাইপ সংলাপ নয় বিচারপতি নিজামুল হক এ বিচার বিষয়ে তার সাথে যেসব মেইল আদান প্রদান করেছেন তাও ফাঁস হয়ে যায়। বিচারের বিভিন্ন বিষয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে । এ ঘটনার জের ধরে  ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন তিনি।

২০১২ সালের ২০ মার্চ  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   ৪৬ জন সাক্ষীর বিষয়ে একটি দরখাস্ত দাখিল করা হয়  ট্রাইব্যুনালে । দরখাস্তে নিবেদন করা হয়  ৪৬ জন সাক্ষীকে  ট্রাইব্যুনালে হাজির করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। তাই এসব সাক্ষী  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক।
সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় কেউ নিখোঁজ, কেউ পলাতক, কেউ অসুস্থ, কেউবা চলে গেছে ভারতে।

ট্রাইব্যুনাল ২৯ মার্চ ১৫ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী প্রদান করেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আদেশ দেয়।

এরপর ৩রা জুন আসামী পক্ষ সেফহাউজের (ঢাকায় যেখানে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী  এনে রাখা হত)  বিশাল ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে বলেন সাক্ষী হাজির করতে না পারা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যে কারণ দেখিয়েছে তা সম্পূর্ণ  মিথ্যা। সাক্ষীগন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাদেরকে আদালতে হাজির করেনি।   অনেক সাক্ষী তাদের হেফাজতেই ছিল এবং সেফহাউজের রেজিস্ট্রার বইয়ে  তার প্রমান রয়েছে।  কোন সাক্ষী কবে সেফহাউজে আসে, কতদিন থাকে,  কে কয়বেলা খেয়েছে তার সমস্ত তথ্য রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়।  আসামী পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সেফহাউজ থেকে রেজিস্ট্রার খাতা সংগ্রহ করে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।  অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষ তাকে জাল হিসেবে আখ্যায়িত করে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার একেবারে শুরুতে বিতর্ক শুরু হয় ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হককে নিয়ে।  বিচারপতি নিজামুল হক ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি  (ঘাদানিক)  গঠিত  জাতীয়  গণতদন্ত কমিশিনের সেক্রেটারিয়েট এর সদস্য ছিলেন।

এ তদন্ত কমিশন কারাবন্দী মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ  মোট ১৬ জনকে  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই দফা তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে ১৯৯৪ এবং ১৯৯৫ সালে। মাওলানা সাঈদীর আবেদনে  বলা হয় যিনি আগে থেকেই আসামীদের বিচারের সাথে জড়িত তার কাছ থেকে ন্যায় বিচার পওয়ার আশা করা যায়না। তাই তাকে সরে দাড়ানোর অনুরোধ করা হয়। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়াকআউট করার ঘটনাও ঘটে আসামী পক্ষের আইনজীবীদের।

মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর আমত্যৃ জেল

মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনটি পৃথক অভিযোগে তাকে আমৃত্যু জেল, অপর  দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ১২ বছর জেল এবং বিশাবালী হত্যাকান্ডে আমৃত্যু জেল দেয়া হয়েছে। বিশাবালী হত্যার অভিযোগসহ আরো দুটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারান্দণ্ড  দেয়া হয়েছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ চূড়ান্ত এ রায় ঘোষনা করে আজ। 

রায়ে আসামী এবং রাষ্ট্রপক্ষ উভয়পক্ষের আবেদন আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা  উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।

আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে আসামী পক্ষের আবেদন আংশিক গ্রহণ করে  মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে একটিতে আমত্যৃ জেল এবং আরেকটিতে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হল।
অপরদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনও আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার অভিযোগ ছিল  আট নং অভিযোগ।  এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুত্যুদন্ড দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিশাবালীর অভিযোগটি ছিল ১০ নং অভিযোগ। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আজকের রায়ে এ অভিযোগে আমৃত্য কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ।
১৬ নং অভিযোগ হল  গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগে  আপিল বিভাগের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্য জেল দেয়া হয়েছে। অপরদিকে  ১৯ নং অভিযোগ হল  মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এ অভিযোগেও মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেলা দেয়া হয়েছে।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগে ট্রাইবু্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোন সাজা উল্লেখ করেনি।  আপিল বিভাগর রায়ে  এ তিন অভিযোগের বিপরীতে সাজা  উল্লেখ করা হল।

এছাড়া আরো তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও  সে তিনটি অভিযোগে আজকের  চূড়ান্ত রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে।  এ অভিযোগ তিনটি হল  (৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন  এবং (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  ।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চ  সকালে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করে। সকাল ১০টা পাঁচ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। ১০টা সাত মিনিটের সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় রায় ঘোষনা। এসময় আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এবং সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। ঠিক পাঁচ মাস শেষে  চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করা হল।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে  মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত  ১৬ এপ্রিল।

মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

ইবরাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে বলা হয়  ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  সাঈদীর নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে।  তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট বাজারে আনার পর  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে।

১০ নং যে অভিযোগ বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।

আপিল শুনানীর সময় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে জানায়  ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতকাজ বেগম ১৯৭২ সালে মামলা করে ১৩ জনকে আসামী করে তাতে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত আছেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন : ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে  অসংখ্য অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।







মাওলানা সাঈদীর মামলায় চূড়ান্ত রায় কাল

মেহেদী হাসান, ১৬/৯/২০১৪
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার  চূড়ান্ত রায় আগামীকাল ঘোষনা করা হবে। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আগামী কালের মামলার কার্যতালিকায় মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। 

আগামী কালের মামলার কার্যতালিকায় এক নং ক্রমিকে রয়েছে এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে একদিন আগেই  প্রকাশ করা হয়  পরবর্তী দিনের মামলার কার্যতালিকা।

গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার  সমস্ত কার্যক্রম শেষে  রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ আপিল মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে  ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। যে ছয়টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল  সেগুলোতে সাজা উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে একই দিন রাষ্ট্রপক্ষও আপিল আবেদন করে।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত  ১৬ এপ্রিল।

মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল।  অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।

মাওলানা সাঈদীকে দুটি হত্যার অভিযোগে মুত্যুদণ্ড  দেয় ট্রাইব্যুনাল-১।  এ দুটি অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টি  এবং বিশাবালী হত্যার ঘটনা। মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে, নির্দেশে এবং সহযোগিতায়  তাদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। এ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মোট ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন হয়। এর মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল।  প্রমানিত আটটি অভিযোগের দুটি হত্যার অভিযোগ। দুটি  হত্যার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেয়ার কারনে বাকী ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হলেও তাতে কোন শাস্তির কথা উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল। বাকী  যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরন  প্রভৃতি।

১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয় রায়ে। খালাস দেয়া অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের পিতা ফফজুর রহমানসহ পিরোজপুরের তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ, ভাগিরথী হত্যা এবং ভানুসাহাকে ধর্ষনের অভিযোগ।


যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয় তার মধ্যে আট নং অভিযোগে বলা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর  সাঈদীর নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে মানিক পসারীর বাড়িসহ ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা দুজন  মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। মাওলানা সাঈদী এদের দুজনকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যান  তার সাথে লোকজনের সহায়তায়। এরপর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে। মফিজকে  আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পর সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কয়েকজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। পালিয়ে আসা মফিজও সাক্ষ্য দিয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন  মফিজ এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী।  রায়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ  প্রমানিত হয়েছে উল্লেখ করে মাওলানা সাঈদীকে মুত্যৃ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।


অপর  ১০ নং যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে  সে বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।


মুত্যৃদন্ডের অভিযোগ দুটি নিয়ে বিতর্ক : রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ এবং সাক্ষীরা বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালের ৮ মে মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অপর দিকে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম বর্তমানে জীবিত। তিনি ১৯৭২ সালে তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন । সে মামলায় তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭১ সালে ১ অক্টোবর তার বাবার বাড়িতে থাকা অবস্থায়  শান্তি কমিটির লোকজন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করে। এসময় তার মা সিতারা বেগম এবং ভাই সাহেব আলীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে পিরোজপুরে হত্যা করে পাকিস্তান আর্মি। ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম  মামলায় ১৩ জনকে আসামী করেন।  আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মামলার সেই ডকুমেন্ট আসামী পক্ষ হাজির করেন ট্রাইব্যুনালে। এছাড়া মাওলানা সাঈদীর  পক্ষে বেশ কয়েকজন সাক্ষীও  সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়া তার শশুর বাড়িতে থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়।  মাওলানা সাঈদী এর সাথে জড়িত ছিলনা।

মামলার আপিল শুনানীতেও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা এ বিষয়ে তথ্য প্রমান তুলে ধরে যুক্তি উপস্থাপন করে।

এছাড়া বিশাবালী হত্যার ঘটনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালী ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসে গত বছর ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরনের শিকার হন।

অপর যে  ছয় অভিযোগ প্রমানিত : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অপর যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল (অভিযোগ নং ৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে  লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (৭) শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  (১৬) গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়া এবং (১৯) মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তবে শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

খালাস ১২টি অভিযোগ : যে ১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অভিযোগ হল  পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান (হুমায়ূন আহমেদের পিতা), মেজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহামান  এবং এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার অভিযোগ। এছাড়া ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে নির্মম হত্যার শিকার ভাগিরথীকে হত্যা এবং  ভানু সাহাকে ধর্ষনের  অভিযোগ থেকেও খালাস দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীকে। এছাড়া মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে, মাসিমপুর হিন্দুপাড়া এবং ধোপপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যাক হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া, লুটপাট করা, হিন্দুদের  অনেক হিন্দুকে এক দড়িতে বেঁধে হত্যঅ করা, হত্যার উদ্দেশে হিন্দুদের  পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াসহ মোট ১২টি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।


মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৩ সালের ১৩ ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক আদালতে   ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুর নালিশী আদালতে একটি নালিশী দরখান্ত দাখিল করেন।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

তদন্ত সংস্থা ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং ৩/১০/২০১১ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৮ জন সাক্ষী হাজির করে। এর মধ্যে ঘটনার সাক্ষী ছিল ২০ জন  । বাকীরা জব্দ তালিকার এবং একজন তদন্ত কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৮ জন ঘটনার সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালে।   ৬৮ জনের মধ্য থেকে হাজির করা হয়নি এমন ১৬ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মামলায়  ট্রাইব্যুনালে যেসব আইনজীবী অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন প্রমুথ।
অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামালায় রাষ্ট্রপক্ষের নির্ধারিত আইনজীবী ছিলেন সৈয়দ  হায়দার আলী।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে   অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।

আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ মামলায় শুনানী পেশ শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর তার অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান শুনানী পেশ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। এছাড়া এ মামলার আপিল শুনানীর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাজুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম, মহিনুর ইসলাম, মতিয়ার রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, মোসাদ্দেক বিল্লাহ। 





বৃহস্পতিবার, ৫ জুন, ২০১৪

কামারুজ্জামানের আপিল শুনানী শুরু

 ৫/৬/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে আপিল শুনানী শুরু হয়েছে। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন।

শুনানীর শুরুতে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদিন অভিযোগ গঠন আদেশ পড়ে শোনান। এরপর সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী নজরুল ইসলাম অভিযোগ পড়ে শোনাতে শুরু করেন। প্রথম দিন মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে  এক নং অভিযোগ বদিউজ্জামান হত্যাকান্ড বিষয়ে দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য পড়ে শোনান। এরপর শুনানী আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

শুনানীর সময় মুহম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে আদালতে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রীম কোর্ট বার কাউন্সিলের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট শিশির মো: মনির এবং   শাহীনুর ইসলাম । 

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত বছর ৯ মে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দেয়।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগ এনেছিল। এর মধ্যে তাকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং আরেকটি অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।   অপর দুটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

মঙ্গলবার, ২০ মে, ২০১৪

কামারুজ্জামানের শুনানী ৩ জুন পর্যন্ত মুলতবি

২০/৫/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল আবেদন শুনানী আগামী ৩ জুন পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। আজ এ মামলার শুনানীর জন্য ধার্য্য ছিল। তবে প্রস্তুতির জন্য আসামী পক্ষ বিচার কার্যক্রম পাঁচ সপ্তাহ মুলতবি চেয়ে আবেদন করলে আদালত ৩ জুন পর্যন্ত মুলতবি করেন।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানীর এ পরবর্তী তারিখ ধার্য্য করেন। মুহম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিশেনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন আবেদনের পক্ষে শুনানী করেন। এসময় আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, শিশির মো: মনির প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত বছর ৯ মে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দেয়। একই বছর ৬ জুন মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ড খালাস চেয়ে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়।

রবিবার, ১৮ মে, ২০১৪

কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য বেঞ্চ গঠন

 ১৮/৫/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল আবেদন শুনানীর জন্য বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি মো : ঈমান আলী ও বিচারপতি এএইএম শামসুদ্দীন চৌধুরী। প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এ বেঞ্চ গঠন করেন।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় গত বছর ৯ মে। গত বৃহষ্পতিবার ১৫ মে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ ১৮ মে আপিল আবেদন শুনানীর জন্য ধার্য্য করেন। সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নং কোর্টের আজকের কার্যতালিকায় দেখা যায়  বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে মুহম্মদ কামারুজ্জামানের  আপিল শুনানীর জন্য নির্ধারন করা হয়েছে। তবে মামলাটি কার্যতালিকার শেষে থাকায় গতকাল শুনানী হয়নি।

এর আগে জামায়াতের অপর দুই নেতা আবদুল কাদের মোল্লা এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল আবেদন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে গঠিত পৃথক দটি আপিল বেঞ্চ নিষ্পত্তি করেছেন। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানীর জন্য গঠিত বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি ছাড়া  অপর চার সদস্য ছিলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
এর আগে আবদুল কাদের মোল্লার আপিল শুনানীর জন্য গঠিত বেঞ্চে প্রধান বিচারপতি ছাড়া অপর চার সদস্য ছিলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহব মিঞা, বিচারপতি  সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামদ্দীন চৌধুরী।

সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম বলেন, আগের দুটি আপিল  যে দুটি আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহন করেছে তা আলাদা দুটি বেঞ্চ ছিল। এখন মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি নতুন বেঞ্চ গঠন করেছেন।

এদিকে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছেন, মামলার প্রস্তুতির জন্য পাঁচ সপ্তাহের মুলতবি চেয়ে আবেদন জমা দেয়া হয়েছে। 

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০১৪

কামারুজ্জামানের আপিল শুনানী ১৮ মে

১৫/৫/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল আবেদন শুনানী আগামী ১৮ মে থেকে শুরু হবে। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ শুনানীর এ তারিখ ধার্য্য করেন।

১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত বছর ৯ মে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদন্ড দেয়। একই বছর ৬ জুন মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ড খালাস চেয়ে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। আজ আপিল বিভাগের  কার্যতালিকায় মুহম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর তারিখ নির্ধারনের  আদেশের জন্য ধার্য্য ছিল। আদেশের সময় রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আসামী পক্ষে অন্যান্যের মধ্যে  সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগ এনেছিল। এর মধ্যে তাকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং আরেকটি অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।   অপর দুটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ট্রাইব্যুনাল-২ মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেয়া ৯টি মামলার রায়ের  মধ্যে দুটি মামলার আপিল আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। এ দুটি হল জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও নায়েবে আমির  মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী । আপিল বিভাগের রায়ের পর গত ১২ ডিসেম্বর আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল আবেদন শুনানী গত ১৬ এপিল শেষ হয় এবং রায় অপেক্ষমান রাখা হয়েছে।

রবিবার, ৪ মে, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার রায় যেকোনদিন


জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার রায় যেকোনদিন ঘোষনা করা হবে।  আজ এ মামলার সমস্ত বিচার কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বিচার কার্যক্রম শেষে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে রায় ঘোষনার তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন।

এর আগে আসামী পক্ষে ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন আইনী দিক তুলে ধরে যুক্তি পেশ করেন এবং রাষ্ট্রপক্ষে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ সংক্ষেপে আসামী পক্ষের যুক্তির জবাব দেন।
ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন বলেন, সাধারণত সামরিক অফিসারদের বেলায় উর্দ্ধতন নেতৃত্বে দায় বা কমান্ড রেসপনসিবিলিটি আনা হয়। মীর কাসেম আলী একজন বেসামরিক ব্যক্তি। কমান্ড রেসপনসিবিলিটি বিষয়টি মিলিটারির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আলী আহসান মো : মুজাহিদ এবং মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রায়ে তাদের বিরুদ্ধে  কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় আনার জন্য যে দুটি মামলার উদাহরন দেয়া হয়েছে তারা দুজনই ছিল সামরিক ব্যক্তি। এই উদাহরন এ মামলায় পড়েনা। আর আকা ইউসু এবং মাহিমানা নামে যে দুজন বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এর আগে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় আনা হয়েছে তা করা হয়েছে তাদের স্টাটাসের কারনে। ওইসব অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রশাসনিক উচ্চ পদে আসিন ছিল। প্রশাসনিক উচ্চপদে আসীন না হলে এবং তার কোন কর্তৃত্ব না থাকলে তার বিরুদ্ধে কমান্ড রেসপনসিবিলিটির অভিযোগ আনা যায়না।
ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন বলেন, ডালিম হোটেলের মালিক ডালিম হোটেল দখলদার মইত্যা গুন্ডার বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং সেখানে তিনি মীর কাসেম আলীর নাম উল্লেখ করেননি। এখানে যারা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে তারা গত ৪২ বছরে তার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি কোথাও। রাষ্ট্রপক্ষ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যে বই জমা দিয়েছে সেসব বইয়ের লেখকও স্বাধীনতার পর মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে একটি কথাও কোথাও লেখননি। তাছাড়া মীর কাসেম আলী অপরাধ সংঘটনকালে যে চট্টগ্রামে ছিলেননা তা রাষ্ট্রপক্ষের জমা দেয়া অনেক পেপারকাটিং থেকে দেখা যায়।
ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ বলেন, মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আলবদর কমান্ডার ছিলেন এ মর্মে কোন প্রমান দিতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আসামী পক্ষের যুক্তির সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দাবি করেন।

বিচার কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনালের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্ট থেকেই এটা অকাট্যভাবে প্রমানিত যে মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের নভেম্বরের শুরু থেকে চট্টগ্রামে ছিলেননা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানের প্রশ্নই আসেনা। ডালিম হোটেলের দখলদার মইত্যা গুন্ডার বিরুদ্ধে মামলা করেছে হোটেলের মালিক। সেই মামলার বিবরনে অনেক কিছু উল্লেখ আছে কিন্তু মীর কাসেম আলীর নাম নেই কোথাও। ৪২ বছর পর রাজনৈতিক প্রতিহিংশা চরিতার্থ করার জন্য ব্যক্তি  টার্গেট করে ছক একে নীলনকশার মাধ্যমে এ মামলা সাজানো হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ যে ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তাতে চট্টগ্রাম আল বদর কমান্ডারসহ অন্য শীর্ষ আলবদর নেতৃবৃন্দের নাম এসেছে। তাতে মীর কাসেম আলীর নাম নেই। কিন্তু তারপরও তাকে আল বদর কমান্ডার বানানো হয়েছে। ১৯৭৭ সালে জন্ম নেয়া ব্যক্তিকে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়েছে। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। আশা করছি আদালত এসব বিবেচনা করবেন।

মামলার সংপিক্ষপ্ত বিবরন :
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, নির্যাতন, অপহরন লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের মত ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। ১৪টি অভিযোগেই তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হল।
১৪টি অভিযোগের মধ্যে দুটি নির্যাতন ও হত্যা বিষয়ক। বাকী  ১২টি অভিযোগ অপহরন, নির্যাতন এবং  বন্দী করে রাখা বিষয়ক। হত্যা বিষয়ক যে দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে মোট সাতজনকে হত্যার ঘটনা রয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মীর কাসেম আলীর  নেতৃত্বে চট্টগ্রামে মহামায়া বা ডালিম হোটেলে স্বাধীনতাপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অপহরন করে  নির্যাতন, হত্যা, গুম করা হত। এছাড়া  লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড পারিচালিত হয়েছে তার নেতৃত্বে। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে যে ১৪টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার  সবগুলোর সাথেই হয়  তার নেতৃত্ব  অথবা  সরাসরি  সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়েছে।

২০১২ সালের   ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে  ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১  এর নির্দেশে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।

গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন  করে। এরপর এ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।


মীর কাসেম আলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
মীর কাসেম আলী ১৯৫২ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার চাকরির সুবাদে তিনি ১৯৬৫ সাল থেকে  চট্টগ্রামে বসবাস করেন এবং ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন।

একজন সংগঠক, উদ্যোক্তা, পৃষ্ঠপোষক, সমাজকর্মী এবং রাজনীতির অঙ্গন ছাড়াও আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচয় রয়েছে মীর কাসেম আলীর। ব্যাংকিং, চিকিৎসা, শিক্ষা, পুনর্বাসন, আবাসন, গণমাধ্যম, পর্যটন পরিবহন খাতসহ অর্থনৈতিক সামাজিক বিভিন্ন খাতে উদ্যোগ গ্রহণ এবং নেতৃত্বে মীর কাসেম আলীর প্রশংসনীয় ভূমিকা রয়েছে।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় আসামী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, আসাদ উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমন ও তুরিন আফরোজ।





বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৪

রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টই রয়েছে মীর কাসেম আলী নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন-আইনজীবী

মেহেদী হাসান, ৩০/৪/২০১৪, বুধবার, ঢাকা।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ১৯৭১ সালের বেশ কিছু পেপারকাটিং জমা দিয়েছে। তাতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের  নভেম্বর ও  ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন। এ সময়ে তিনি চট্টগ্রামে ছিলেননা। অথচ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ডালিম হোটেলকেন্দ্রিক রাষ্ট্রপক্ষ যেসব অপহরন নির্যাতন এবং হত্যার অভিযোগ করেছে তার সবগুলোই  নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে সংঘটিত। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষেরই  ডকুমেন্টে দেখা যায় তিনি অপরাধ সংঘটনকালে ঢাকায় ছিলেন চট্টগ্রামে নয়। 
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি উপস্থাপনের সময় অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম এ তথ্য তুলে ধরেন।

মিজানুল ইসলাম দাবি করেন মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালের সাত  নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। ছয়  নভেম্বরের আগে তিনি চট্টগ্রম নগর ছাত্রসংঘ সভাপতি ছিলেন। ছয়  নভেম্বরের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘ সাধারন সম্পাদক হন এবং এরপর তিনি ঢাকায় আসেন। সাধারনত কোন পার্টির সমাধারন সম্পাদক ঢাকায়ই বাস করেন। মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ছিলেন এ তথ্য রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টে আছে। ৮ সেপ্টেম্বরের পর তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন এ মর্মে তাদের কোন পেপারকাটিং নেই তাদের।
তিনি বলেন, বরং  রাষ্ট্রপক্ষের জমা দেয়া পেপারকাটিংয়ে দেখা যায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে মীর কাসেম আলী ঢাকায় ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এবং ৮ নভেম্বর তারিখে প্রকাশিত দুটি খবরের কাটিং জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ যে খবরে উল্লেখ আছে মীর কাসেম আলী ঢাকার সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন।
যুক্তি পেশ শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হয়ে মিজানুল ইসলাম দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন,  দৈনিক আজাদের ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখের একটি পেপার কাটিং জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ পেপারকটিংয়ের খবরে বর্নিত রয়েছে ১০ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের সমাবেশে মীর কাসেম আলী বক্তব্য দেয়। ১১ ডিসেম্বর তা আজাদে ছাপা হয়। এতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী তখন ঢাকায় ছিল। তাছাড়া তাদের আরেকটি পেপারকাটিং হল ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর। এ পেপারকাটিংয়েও দেখা যায় মীর কাসেম  আলী ঢাকায় একটি সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন ৭ নভেম্বর।
তাছাড়া তাদের  ৭, ১১, ১৪  ও ২৪ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের পেপারকটিংয়ে মীর কাসেম আলীর বিবৃতি রয়েছে যা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ট্রাইব্যুনাল তখন বলেন ঢাকায় না থাকলেও বিবৃতি দেয়া যায়। মিজানুল ইসলাম বলেন, ধরে নেয়া যায় ঢাকায় বসেই তিনি বিবৃতি দিয়েছেন।  এসব থেকে প্রমানিত যে মীর কাসেম আলী নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্ট থেকে এটি স্পষ্ট যে মীর কাসেম আলী ৬ নভেম্বরের পর থেকে চট্টগ্রামে ছিলেননা বরং ঢাকায় ছিলেন। 

চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২  বিচার কার্যক্রম পরিচালান করেন।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে নয় নং অভিযোগ হল ২৯ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সৈয়দ মো : এমরান হোসেন, কামাল উদ্দিন, জামালউদ্দিন, সরওয়ার উদ্দিন,  গোলাম কিবরিয়া, গোলাম রহমান এ   ছয় জনকে অপহরন ও নির্যাতন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এদের মধ্যে এমরান হোসেন, জামালউদ্দিন এবং সরওয়ারউদ্দিন এ তিনজকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়েছে। এ তিনজন বাদে বাকী চারজন বিষয়ে আর কোন তথ্য নেই। আর যে তিনজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছে তারা অপহরন ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কিছুই বলেনি।

জামালউদ্দিন বলেছেন, আটকের সময় ডালিম হোটেলের কাউকে তিনি চিনতে পারেননি। কারণ তারা মুখোস পড়া ছিল। অপরদিকে একই ঘর থেকে একই সময়ে আটক হওয়া অপর সাক্ষী সরওয়ার উদ্দিন বলেছেন, আটকের সময় দুজন আর্মি এবং একজন বদর সদস্য ছিল। বদর সদস্য হল মীর কাসেম আলী।

মিজানুল ইসলাম বলেন, সাতজনকে একই ঘর থেকে একই সাথে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে তিনজন এসে সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে  দুজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছে গ্রেফতার ঘটনা বিষয়ে।
অপর সাক্ষী  এমরান বলেছেন তিনি যুদ্ধ করেছেন কিন্তু কোন এলাকায় যুদ্ধ করেছেন তা বলতে পারেননি। আর্মি ক্যাম্প কোথায় ছিল তাও বলতে পারেননি। আলবদর ক্যাম্প সম্পর্কেও বলতে পারেনি। এরকম একজন সাক্ষী আসামীকে জড়িয়ে যা বলেছে তাও অসত্য এটাই স্বাভাবিক।

মিজানুল ইসলাম বলেন, দুই জন সাক্ষী ঘটনার বর্ননা এবং তারিখ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন ১১ নং অভিযোগ যথা জসিম হত্যা বিষয়ে।
গাজী সালাহউদ্দিন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন জসিমের নিহত হবার স্থান এবং তারিখ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বই ডিফেন্স ডকুমেন্ট হিসেবে প্রদর্শনী মার্ক করা হয়েছে। অপর দিকে জসিম নিহত হওয়া বিষয়ে সাক্ষী সানাউল্লাহ এবং জাহাঙ্গীর আলম ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, তিনি  ২৪ নভেম্বর ডালিম হোটেলে জসিমের লাশ দেখেছেন। আর সানাউল্লাহ বলেছেন তিনি ২৮ নভেম্বর ডালিম হোটেল জসিমের লাশ দেখেছেন।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১২ নং অভিযোগ হল  জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, টন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসকে অপহরন করে নির্যাতন করা হয়। টন্টু  রঞ্জিত দাসকে হত্যা  করে  তাদের লাশ গুম করা হয়।

সানাউল্লাহ বলেছেন তিনি ২৭ নভেম্বর ডালিম হোটেলে টন্টু সেন ও রঞ্জিতের সাথে কথা বলেছেন। ২৮ তারিখ তাদের হত্যা করা হয়।
শফিউল আলমকে গ্রেফতার করা হয় ২৮ নভেম্বর। তিনি তার সেই সে সময় আনন্দ বেদনা বইয়ে উল্লেখ করেছেন ২৮ নভেম্বর টন্টু মারা যাবার  তিনদিন আগে থেকে অজ্ঞান ছিল। কিন্তু সানাউল্লাহ বলেছেন বলেছেন তিনি ২৭ তারিখ টন্টুর সাথে কথা বলেছেন ডালিম হোটেলে।  মিজানুল ইসলাম প্রশ্ন করেন অজ্ঞান লোকের সাথে সাক্ষী সানাউল্লাহ  কথা বললেন কি করে?

টন্টু সেনের ভাগনে প্রদীপ তালুকদার । ১২ নং অভিযোগ বিষয়ে  প্রদীপ সাক্ষ্য দিয়েছেন অপহরন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। প্রদীব বলেছেন ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিলণ ছয় বছর। তিনি যে ঠিকানা ট্রাইব্যুনালে দিয়েছেন সে ঠিকানায় তার কোন অস্তিত্ব নেই। নতুন যে ঠিকানা দিয়েছেন সেখানেও তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে নতুন ঠিকানা অনুযায়ী আমরা তার ভোটার লিস্ট সংগ্রহ করেছি এবং সেখানে তার জন্ম তারিখ লেখা আছে ১৯৭৭ সাল। ১৯৭৭ সালে জন্ম নেয়া ব্যক্তি কি করে ১৯৭১ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, ১২ নং অভিযোগে আরো রয়েছে হাজারি লেনে আড়াইশ থেকে তিনশ বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে এবং একশরও বেশি পরিবারকে জোর করে ভারতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোন সাক্ষী হাজির করেনি।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৩ নং অভিযোগ হল সুনীল কান্তি বর্ধনকে অপহরন ও নির্যাতন।
মিজানুল ইসলাম বলেন, এ অভিযোগ বিষয়ে সাক্ষী সুনীল কান্তি বর্ধন অস্বাভাবিক বক্তব্য দিয়েছে। সে একবার বলছে শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে গেছে। আবার বলছে গ্রামে টিকতে না পেরে শহরে এসেছে। গ্রামে সে কেন টিকতে পারলনা? তাছাড়া সে কোন রাজাকার আলবদরও চিনতনা। তাহলে কি করনে কাদের কারনে সে গ্রামে টিকতে পারলনা? সে বলেছে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি পোড়ানো হয়নি। সে যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে এটা তার প্রমান। কারণ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি পোড়ানো হয়েছিল ।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৪ নং অভিযোগ হল নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরন ও নির্যাতন।
নাসির উদ্দিন চৌধুরী একজন মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম শহরে সে এসেছে যুদ্ধের জন্য। অথচ সে বলেছে সার্কিট হাউজ ছাড়া অন্য কোথাও আর্মি ক্যাম্প ছিল কিনা তা তার জানা নেই। এটা কেমন কথা? এসময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাইতো? এটা কি করে হতে পারে?
মিজানুল ইসলাম বলেন, তাদের এলাকা হাজারি লেন  বারবার পুড়িয়ে দেয়া হল, বারবার লুট হয়েছে তার এলাকায়, তার এলাকার পাশেই ডালিম হোটেল বলছে তারা আর সেখানেই এসে সে আশ্রয় নিল। এটা কি করে সত্য হতে পারে? কাজেই তার আহত হবার ঘটনা অসত্য।

সাত নং অভিযোগ হল মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে সাত/আট জন যুবক ডাবলমুরিং থানা থেকে সানাউল্লাহ চৌধুরী,  হাবিবুর রহমান, ইলিয়াসকে  ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।
মিজানুল ইসলাম বলেন, সানাউল্লাহ বলছে তার চোখ বাঁধা ছিল। কাজেই তাকে ডালিম হোটেলের সামনে না অন্য কোথায় আনা হল তা তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ইলিয়াসের অপহরন এবং নির্যাতন বিষয়ে এখানে একটা লাইন ছাড়া আর কোন কিছু কোথাও বলা হয়নি। ইলিয়াসের অপরহন নির্যাতন বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আর কোন কিছু নেই। কেন তাকে সাক্ষী হিসেবে আনা হলনা, অন্য কোন সাক্ষী দিয়ে কেন কিছু বলানো হলনা এর কোন ব্যাখ্যা নেই।
মিজানুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম পিডিবি নেতা নবি চৌধুরী স্বাধীনতা বিরোধী কি-না তাও সে জানেনা। তার বক্তব্য যে অসত্য এটা তার প্রমান। সে ডিসি অফিসে চাকরি করত কিন্তু ডিসি অফিস লুট হওয়ার খবরও সে জানেনা বলছে। একজন মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে যা জানার কথা তাও সে জানেনা বলছে। সত্য এড়িয়ে গেছে। যে লোক স্বাভাবিক জানাকথা সঠিকভাবে বলছেনা তার বাকি কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

১০ নং অভিযোগ মীর কাসেম আলীর নির্দেশে মো : জাকারিয়াসহ চারজনকে অপহরন ও নির্যাতন।
ভিকটিম চারজনই সাক্ষ্য দিয়েছে। মিজানুল ইসলাম বলেন, সাক্ষী জাকারিয়া বলেছেন আটকের সময় পাকিস্তান আর্মি ছিল। শান্তি কমিটি বিষয়ে তার কোন ধারণা নেই।  এলাকায় রাজাকর ক্যাম্প দেখেনি সে। মীর কাসেম আলী ছাড়া অপর কাউকে তিনি চেনেননা।

সাক্ষী হাসিনা বেগম বলেছেন তিনি ১৯৭২ সালে সম্পাদক ছিলেন। ন্যাপ নেতা ছিলেন। কিন্তু তিনি জেরায় বলেছেন ১৯৭২ সালে দালাল আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠন বিষয়ে জানা নেই। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বিষয়েও বলতে পারছেননা। তার একথা কি বিশ্বাসযোগ্য? কারণ তিনি কোন সাধারন গৃহিনী নন। তিনি আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লিখেছেন।

মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ডালিম হোটেল তদন্ত  বিষয়ে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি তদন্ত করতে গিয়ে ওই বাড়ির  কারো সাথে কথা বলেননি প্রথমে । আসলে তিনি তদন্ত করেছেন ঠিকই কিন্তু তদন্তে যখন মীর কাসেম আলী বিষয়ে কোন তথ্য পাননি তখন তিনি তদন্ত বিষয়ে অস্বীকার করেন। তিনি আসল তথ্য গোপন করেছেন। ওই বাড়ির একজনকে সাক্ষী করা হয় কিন্তু তাকে আনা হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় স্বীকার করেছেন ডালিম হোটেলের মালিক মইত্যা গুন্ডার বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিল ১৯৭২ সালে সে বিষয়ে কোন তদন্ত করেননি।

মিজানুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে অসদ উদ্দেশ্য নিয়ে মীর কাসেম আলীকে আসামী নির্ধারন করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সাজিয়ে সে অনুযায়ী শিখিয়ে পরিয়ে সাক্ষী হাজির করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে।
যুক্তি উপস্থাপনে মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন,  ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম, আসাদ উদ্দিন ও আবু বকর সিদ্দিক।
আগামী রোববার উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হবার কথা রয়েছে। এর মাধ্যমে শেষ হবে এ মামলার বিচার  কার্যক্রম।





মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলায় আসামী পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু// রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আল বদর কমান্ডার ছিল এ মর্মে উল্লেখ নেই বরং ফেনির নাসির নামে এক লোক কমান্ডার ছিল মর্মে উল্লেখ আছে

মেহেদী হাসান, ২৯/৪/২০১৪, মঙ্গলবার, ঢাকা।
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়েছে। মীর কাসেম আলীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাবি  মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তার নির্দেশে এবং সিদ্ধান্তে ডালিম হোটেলে  মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনকে অপহরন করে এনে বন্দী করে রাখা, নির্যাতন করা এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ যেসব ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তাতে দেখা যায় মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আলবদর কমান্ডার ছিলেননা। চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার ছিল ফেনির নাসির নামে এক লোক। সেক্রেটাারি ছিল সন্দ্বীপের ফয়জুল্লাহ।

মিজানুল ইসলাম আজ আসামী সনাক্তকরন প্রক্রিয়া,  আলবদর কমান্ডার ইস্যু বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের পর অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি পেশ শুরু করেন। এরপর বিচার কার্যক্রম আগামীকাল  বুধবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

মীর কাসেম আলী আলবদর কমান্ডার ছিলেন কি-না :
মিজানুল ইসলাম শুনানীর শুরুতে বলেন, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের দাবি হল মীর কাসেম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারন সম্পাদক  ছিলেন, তিনি চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন, তার নির্দেশে এবং সিদ্ধান্তে ডালিম হোটেল পরিচালিত হত যেখানে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন এবং হত্যা করা হয়েছে।
অপরদিকে এ মামলায় আসামি পক্ষের দাবি হল মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেননা। ডালিম হোটেল মতিউর রহমান ওরফে মইত্যা গুন্ডার নিয়যন্ত্রন করত। ডালিম হোটেল কোন ক্যাম্প ছিলনা।

মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে যেসব ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তার কোথাও তিনি  আল বদর কমান্ডার ছিলেন এ মর্মে উল্লেখ নেই। বরং অপর তিন থেকে চারজন ব্যক্তিকে এসব বইয়ে আলবদর প্রধান  হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাহবুবুল আলমের  লেখা বই যা রাষ্ট্রপক্ষ জমা দিয়েছে তাতে ফেনির নাসির নামে একজন লোক চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার ছিল বলে উল্লেখ আছে। সেক্রেটারি ছিল সন্দ্বীপের ফয়জুল্লাহ। এছাড়া চট্টগ্রাম আলবদর নেতা হিসেবে জাকির হোসেন এবং  মনসুর এর নাম উল্লেখ আছে। এসময় ট্রাইব্যুনাল বইটি নিয়ে বিষয়টি পড়ে দেখেন।
এরপর মিজানুল ইসলাম বলেন, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষের ডকুমেন্টেই দেখা যাচ্ছে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আলবদর কমান্ডার ছিলেননা।  ছিল অন্যরা।

মিজানুল ইসলাম  বলেন, ডালিম হোটেল যে মতিউর রহমান ওরফে মইত্যা গুন্ডার নিয়ন্ত্রনে ছিল সে মর্মে আমরা দুটি ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি। ১৯৭২ সালে মতিউর রহমান ওরফে মইত্যা গুন্ডার বিরুদ্ধে  একটি মামলার ডকুমেন্ট দিয়েছি । এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম একটি প্রামান্য দলিল বইয়েও  এ বিষয়ে উল্লেখ আছে।
তদন্ত কর্মকর্তাও জেরায় স্বীকার করেছেন ডালিম হোটেল নির্যাতন কেন্দ্র ছিল মর্মে কোন রিপোর্ট তিনি দেখেননি।

অভিযোগ খন্ডন :
মীর  কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মোট ১৪টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এক  এবং পাঁচ  নং অভিযোগ বিষয়ে কোন সাক্ষী হাজির করেনি। মিজানুল ইসলাম আজ দুই, তিন, চার, ছয় এবং আট  নং অভিযোগ খন্ডন করে যুক্তি পেশ করেন।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে দুই নং অভিযোগ হল লুৎফর রহমানকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নির্যাতন। মিজানুল ইসলাম বলেন, লুৎফর রহমান বলেছেন, নির্যাতনের ফলে তার সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তিনি এ ঘটনার পরে বিয়ে করেছেন। তিনি যদি পুরুষত্বহীন হবেন তাহলে তিনি বিয়ে করলেন কিভাবে? এথেকে বোঝা যায় নির্যাতনের ঘটনা মিথ্যা।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে তিন নং অভিযোগে বলা হয়েছে ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর আসামীর নেতৃত্বে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে তার কদমতলা বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়।

মিজানুল ইসলাম বলেন, জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেছেন ২২ অথবা ২৩ নভেম্বর তাকে ধরে নিয়ে আসা হয়। অপর দিকে শফিউল আলম তার আনন্দ বেদনার সেই সে সময় বইয়ে লিখেছেন ২৭ নভেম্বর তাকে (শফিউল আলম) ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাহলে চারদিন আগে জাহাঙ্গীর আলম ডালিম হোটেলে শফিউল আলমকে দেখল কি করে? কাজেই জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য অসত্য এবং তিনি ডালিম হোটেলে মীর কাসেম আলীকে জড়িয়ে যেসব কথা বলেছেন তাও অসত্য। অপর দিকে শফিউল আলমও তার বইয়ে চট্টগ্রাম আলবদর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলীর নাম উল্লেখ করেননি । তিনি তার আরেকটি বইয়ে আলবদর কমান্ডার হিসেবে ভিন্ন লোকের নাম উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষই এসব বই জমা দিয়েছে।
তাহলে মীর কাসেম আলী আলবদর কমান্ডার ছিল  এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকেই তিন রকম তথ্য দিয়েছে দেখা যায়। তাদের জমা দেয়া বইয়ে মীর কাসেম আলী নয় বরং ফেনির নাসিরকে আল বদর কমান্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাদের অভিযোগ এবং সাক্ষীদের বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম আল বদর কমান্ডার ছিল। মীর কাসেম আলী আল বদর কমান্ডার ছিল এ দাবি বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের তিনরকম তথ্য রয়েছে এবং বেনিফিট অব ডাউটের সুবিধা তারা পাবেনা। 

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে চার নং অভিযোগে বলা হয়েছে ডাবলমুরিং থানায় সাইফুদ্দিন খানকে তার নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে নির্যাাতন করা হয়। মিজানুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় সাইফুদ্দিনের বোন নুরজাহান ঘটনা দেখেছেন মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তাকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়নি।

মীর কাসেম আীল বিরুদ্ধে ছয় নং অভিযোগ হল চট্টগ্রাম শহরের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুনুর রশিদ নামে একজনকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেল এবং সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন করা। মিজানুল ইসলাম বলেন, হারুনুর রশিদের স্ত্রী এ ঘটনায় সাক্ষ্য দিয়েছে। অভিযোগ বিষয়ে তার বক্তব্যই বেশি গ্রহণযোগ্য হবার কথা। কিন্তু তিনি যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার বিপরীত তথ্য রয়েছে তার স্বামীর কথায়। তার স্বামী হারুনুর রশিদের উদ্ধুতি দিয়ে মাহবুবুল আলম তার বইয়ে লিখেছেন, আল বদর কমান্ডারদের তিনি চিনতেননা।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আট নং অভিযোগ হল নুরুল কুদ্দুস, মো : নাসির, নুরুল হোসেনসহ চারজনকে অপহরন করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন। মিজানুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তিনজনই জীবিত আছে। তাদের জবানবন্দীও রেকর্ড করা হয়েছে এবং সাক্ষী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।  কিন্তু তাদের কাউকে সাক্ষী হিসেবে আনা হয়নি। কি কারনে আনা যায়নি তারও কোন ব্যাখ্যা রাষ্ট্রপক্ষ দেয়নি।
এসময় ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেন তাদেরকে সাক্ষী হিসেবে আনা না হলে তাতে কি অভিযোগের গুরুত্ব কমবে? মিজানুল ইসলাম বলেন, অবশ্যই কমবে। রুলসে এটা বলা আছে এবং রায়ে  এ বিষয়ে মূল্যায়ন ভিন্ন হবে।

বাঙ্গাল খান :
মিজানুল ইসলাম বলেন, মীর কাসেম আলী বাঙ্গাল খান নামে পরিচিত ছিল বলে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ যুক্তি উপস্থাপনের সময় বলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যেই দেখা যায়  বাঙ্গাল খান নামে আরেক ব্যক্তি ছিলেন, মীর কাসেম আলী নয়।
যেমন রাষ্ট্রপক্ষের আট নং সাক্ষী এস্কান্দার আলম বলেছেন, তিনি শুনেছেন মীর কাসেম আলী বলছেন  খান সাহেব কোথায়? তখন খান সাহেব বলছেন, মীর কাসেম আমি আসছি।
১৯ নং সাক্ষী বলছেন, চোখ খুলে মীর কাসেম আলীর সাথে আরো একজনকে দেখি। উনি খান সাহেব হতে পারে। এ থেকে স্পষ্ট যে মীর কাসেম আলী খান সাহেব ছিলেননা। খান সাহেব নামে আরেকজন  আলাদা ব্যক্তি ছিলেন।

আসামী সনাক্তকরন :
মিজানুল ইসলাম বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এ মামলর তদন্ত শুরু হয়েছে। আইন অনুসারে তদন্ত শুরু হয়নি। জেরায় তদন্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন  মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে কোন মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ ছিলনা। তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমে ব্যক্তি হিসেবে মীর কাসেম আলীকে বাছাই করে তার নিজস্ব ধারণা অনুসারে তদন্ত শুরু করেছে । এরপর  ডালিম হোটেলের ঘটনা লিপিবদ্ধ করে  সে মোতাবেক শিখিয়ে পরিয়ে সাক্ষী হাজির করা হয়েছে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, যখন মামলা শুরু হয় তখন মীর কাসেম আলী বাংলাদেশে একজন পরিচিত ব্যক্তি। যারা পত্রপত্রিকা পড়েন এবং টিভিতে খবর দেখেন তারা তাকে চেনেন। ট্রাইব্যুনাল আইনে আসামী  সনাক্তকরন প্রকৃয়া বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তবে বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় আসামী সনাক্তকরন প্রকৃয়া উল্লেখ আছে। কি পদ্ধতিতে সাক্ষী আসামীকে সনাক্তকরন করবে তা বলা আছে। আসামীকে আট থেকে ১০ জন লোকের সাথে মিলিয়ে রেখে সাক্ষীকে আসামী সনাক্ত করতে বলা হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী কর্তৃক আসামী সনাক্ত করা খুব সহজ ছিল। কারণ এখানে ডকে আসামী ছাড়া আর কেউ থাকেনা। তারপর সাক্ষী সাক্ষ্য দেয়ার পর সাক্ষীকে  বলা হয় আপনি যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন তিনি আজ ডকে উপস্থিত আছেন কি-না দেখেনতো। এভাবে খুব সহজেই সাক্ষী আসামীকে সনাক্ত করতে পারে।
মিজানুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের এক নং সাক্ষী সৈয়দ এমরান বলেছেন মীর কাসেম আলী তার স্কুলের সহপাঠী ছিলেন সেই হিসেবে তিনি তাকে চিনতেন। সৈয়দ এমরান বলেছেন তিনি ১৯৬৮ সালে এমএনসি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন।
অথচ মীর কাসেম আলী এসএসসি পাশ করেন ১৯৬৭ সালে। সহপাঠী হতে হলে একই কাসে পড়তে হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মীর কাসেম আলী তার এক বছর আগে  এসএসসি পাশ করেন। কাজেই সাক্ষী অসত্য তথ্য দিয়েছে ।
যুক্তি উপস্থাপনে মিজানুল ইসলামকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, আসাদ উদ্দিন ও আবু বকর সিদ্দিক।

সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৪

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ

মেহেদী হাসান, ২৮/৪/২০১৪, সোমবার, ঢাকা।
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের  মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ যুক্তি পেশ শেষ করে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড দাবি করেন। এরপর আগামীকাল আসামী পক্ষের যুক্তি  উপস্থাপন শুরু করার জন্য নির্ধারন করে ট্রাইব্যুনাল।

চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, অপহরন,  নির্যাতন, লুন্ঠন এবং অগ্নিসংযোগের মত ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়।

আগের দিনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আজ সকালে রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন ১১, ১২.১৩ এবং ১৪ নং অভিযোগ বিষয়ে যুুক্তি পেশ শুরু করেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের অপর আইনজীবী রেজিয়া সুলতানা চমন আসামী পক্ষের তিন সাক্ষীর বক্তব্য খন্ডন করে যুক্তি পেশ করেন। সবশেষে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ আইনী বিষয় তুলে ধরে সাবমিশন রাখেন।
রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি উপস্থাপনের সময় ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
সুলতান মাহমুদ সিমন যুক্তি পেশের সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে দেখা যায় আসামী নিজে কারো গায়ে হাত দেয়নি। নিজে কাউকে মারেনি। আসামী নিজ হাতে কাউকে মেরেছে এরকম অভিযোগ আছে?
সুলতন মাহমুদ সিমন বলেন, আছে।
১৪ নং অভিযোগ  নাসিরউদ্দিন নামে একজনকে অপহরন এবং নির্যাতন বিষয়ে যুক্তি পেশের সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, অপহরনের সময় আসামী ছিলনা। অপহরনের অভিযোগ প্রমানিত নয়।  ভিকটিম নিজেই বলেছে অপহরনের সময় আসামী ছিলনা। কিন্তু আমরা তো অপহরন বিষয়ে চার্জ গঠন করে ফেললাম। কোর্ট ভুল করতে পারে কিন্তু আপনারা তখন বললেননা কেন এ বিষয়ে? আপনারা তো মনে করেন একটা চার্জ গঠন করলেই হয়ে গেল।  চার্জ প্রমান করতে হবেনা?
সুলতান মাহমুদ সিমন বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যে মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে।

এরপর আসামী পক্ষের তিন সাক্ষীর বক্তব্য খন্ডন করে রেজিয়া সুলতানা চমন যুক্তি পেশ করেন। এসময় ট্রাইবুনালের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হন তিনি। ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলায় আসামী পক্ষের দাবি কি? আসামী পক্ষের দাবি হল ডালিম  হোটেল চালাত মতিউর রহমান ওরফে মইত্যা গুন্ডা । সে একজন  রাজাকার। আসামী পক্ষের দাবি ডালিম হোটেল মীর কাসেম আলী চালাতনা। আসামী পক্ষ যে ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তা দেখে এসেছেন? আসামী পক্ষের ডকুমেন্টে ডালিম হোটেলের যে বিবরন রয়েছে তা দেখেছেন?
এসময় নীরব থাকেন রেজিয়া সুলতানা চমন।
ট্রাইব্যুনালের আরো কিছু প্রশ্ন করার পর বলেন, আপনার আর্গুমেন্ট কি আমরা করে দেব? আপনার ফি তাহলে আমাদের দিয়ে দিয়ে দিয়েন।

এরপর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ যুক্তি পেশ করে বলেন, ডালিম হোটেল মীর কাসেম আলীর সিদ্ধান্ত এবং নেতৃত্বে পরিচালিত হত। কাজেই এখানে সংঘটিত সকল অপরাধের দায়ভার তার।
ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন করেন, পুরো সিস্টেম যে সে পরিচালনা করত তা কোথায় আছে? সাক্ষীদের বক্তব্যে এসেছে? অনেক সময় দেখা গেছে একজন ভিকটিম ধরে হোটেলে নিয়ে এসেছে তখন আসামী সেখানে উপস্থিত ছিলনা।
তুরিন আফরোজ বলেন, বিষয় হল সেখানে কোন সিস্টেম কাজ করেছে কি-না সেটা দেখা। যেহেতু মীর কাসেম আলীর সিদ্ধান্তে এবং নেতৃত্বে ডালিম হোটেল পরিচালিত হত তাই সব ঘটনার দায় তার ওপরই বর্তায়। মীর কাসেম আলী  উপস্থিত থাকলে ধরে আনা লোকজনের ওপর নির্যাতন বেড়ে যেত। তারা দেখাত যে সবকিছু ঠিকমত চলছে, তারা ঠিকমত কাজ করছে।
তিনি বলেন, ডালিম হোটেলের নির্যাতনের যে চিত্র আমরা পাই তাতে এর সাথে সামন্যতম সম্পৃক্ত যেকোন ব্যক্তির সাজা হওয়া উচিত। আর মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে যেহেতু পরিচালিত হত তাই তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দাবি করছি আমরা।





বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৪

সন্দেহাতীত অবস্থানে পৌছার সুযোগ কেন হাতছাড়া করা হল বোধগম্য নয়

মেহেদী হাসান,17/4/2014
ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথি পিরোজপুর থেকে তলবের আবেদন  করেছিল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী। আদালত গতকাল বুধবার আবেদনটি খারিজ করে দেয়। একই সাথে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের দায়ের করা বরিশাল থেকে ১৯৭২ সালে গঠিত স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের নথি তলবের আবেদনও খারিজ করে দেয়া হয়েছে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত একটি অভিযোগ হল ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দাবি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৮ মে পাড়েরহাট বাজারে তাকে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। আর আসামি পক্ষের দাবি ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় রাজাকারদের হাতে নিহত হয়। এ হত্যাকান্ডের সাথে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কোন সম্পর্ক নেই। আসামি পক্ষ এ দাবির পক্ষে ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে পিরোজপুর আদালতে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে যে মামলা করেন সেই মামলার এফআইআর বা মামলার প্রাথমিক অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। মমতাজ বেগমের সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট১৩ জনকে আসামি করেন । কিন্তু আসামির তালিকায় সাঈদীর নাম নেই। আসামি পক্ষের যুক্তি সাঈদী যদি এ ঘটনায় জড়িত থাকত তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের ওই মামলায় আসামির তালিকায় তার নাম থাকত।  শুধু তাই নয় মমতাজ বেগমের সেই মামলার বিবরনে ইব্রাহিম কুট্টি নিহত হবার ঘটনাস্থল  নলবুনিয়া এবং ঘটনার তারিখ ১ অক্টোবর ১৯৭১ সাল উল্লেখ আছে। আর রাষ্ট্রপক্ষের দাবি ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালের ৮ মে পাড়েরহাট বাজারে নিহত হয়। মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনাস্থল এবং তারিখের সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য রয়েছে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে।

২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে আসামি পক্ষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মমতাজ বেগমের মামলার এ ডকুমেন্ট জমা দেয় এবং ট্রাইব্যুনালে তা প্রদশীনী ‘এ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন আসামি পক্ষের এ ডকুমেন্টকে জাল এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত বলে আখ্যায়িত করে। একে জাল আখ্যায়িত করার আগে তারা পিরোজপুর  গিয়ে এ মামলা বিষয়ে কোন খোঁজখবর নিয়েছিল কিনা এমন কোন দাবিও তারা করেনি। রাষ্ট্রপক্ষ এ ডকুমেন্টকে জাল আখ্যায়িত করার পর আসামি পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার জিআর বইয়ের একটি ফটোকপি ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে এবং পিরোজপুর থেকে জিআর বই তলবের আবেদন করে। ট্রাইব্যুনাল তাদের সে আবেদন খারিজ করে দেয়।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয় এবং তার মধ্যে একটি হল আলোচিত এ ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আসামি পক্ষের দায়ের করা মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে কোন আলোচনা করা হয়নি। 

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানীতেও অন্যতম আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয় ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা এবং মমতাজ বেগমের মামলা।
গত ৩ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নতেৃত্বে আপিল শুনানীর  সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন।
আদালত তাকে প্রশ্ন করেন, আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার ডকমেন্ট সংগ্রহ করতে পারল আর আপনারা পারলেননা কেন? ১৯৭২ সালে আদৌ এ ধরনের কোন এফআইআর হয়েছিল কি-না? পিরোজপুরে অবশ্যই জিআর রেজিস্ট্রেশন বই আছে। আপনারা এটা চাইতে পারতেননা? আপনাদের অনেক বড় মেশিনারীজ আছে। তার মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন? আমরা যদি আসামী পক্ষের দায়ের করা এ ডকুমেন্ট গ্রহণ করি তাহলে অ্যাটলিস্ট আমরা বলতে পারি সাঈদী এ ঘটনায় জড়িত নয়।
আদালত আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ মামলার শুনানী চলছে। আসামী পক্ষ অনেক আগে এ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে। আপনারা অনেক সময় পেয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে আপনারা চাইলে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন।

এরপর গত ১ এপ্রিল শুনানীর পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ মামলার বিচার ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি চান। এরপর খবর বের হল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথির খোঁজে অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল সফর করছেন। ৯ এপ্রিল অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে দাবি করলেন পিরোজপুর এবং বরিশালে এ মামলার কোন কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা। কাজেই আসামি পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার যে এফআইআর জমা দিয়েছে তা জাল, মিথ্যা এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত।  তিনি লিখিত আবেদন করে বলেন, আসামি পক্ষের দায়ের করা মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর যেন  বিবেচনায় না নেয়া হয়।
মমতাজ বেগমের মামলাকে জাল, মিথ্যা, সৃজনকৃত আখ্যায়িত করা এবং একে বিবেচনায় না নেয়ার আবেদনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান যুক্তি ছিল পিরোজপুর এবং বরিশালে এ মামলার কোন কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা। এরপর দ্বিতীয় প্রধান যুক্তি ছিল একটি মামলায় এফআইআরে সব আসামি বা মূল আসামির নাম নাও থাকতে পারে। মামলার তদন্ত শেষে যে চার্জশিট তৈরি হয় সেখানে মূল আসামির নাম থাকতে পারে। আসামি পক্ষ দাবি করেছে এ মামলার চার্জশিট হয়েছিল কিন্তু তারা সে চার্জশিট তুলতে পারেনি এবং জমাও দিতে পারেনি। তারা এফআইআর তুলতে পারল চার্জশিট কেন তুলতে পারলনা? তাছাড়া চার্জশিট হলে এফআইআর নির্ভরযোগ্য থাকেনা।

অবশেষে  গত ১৩ এপ্রিল মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিটের সার্টিফাইড কপি জমা দেয় আসামি পক্ষ। সেখানেও আসামির তালিকায় সাঈদীর নাম নেই। আসামি পক্ষ ১৩ এপ্রিল আবেদন চার্জশিট যেন বিবেচনায় নেয়া হয় সে মর্মে আবেদন করে। একই আবেদনে তারা পিরোজপুর থেকে মমতাজ বেগমের  মামলার জিআর বই তলবেরও আবেদন করে। গতকাল  ১৬ এপ্রিল আদালত র আবেদনটি খারিজ করে দেয়।

আমি মনে করি সকল  প্রশ্নের মীমাংসার জন্য আদালতের পিরোজপুর থেকে মমতাজ বেগমের মামলার নথি তলব করা উচিত ছিল। এটা তলব করলেই প্রমান হয়ে যেত আসামি পক্ষের  দাবি সত্য নাকি মিথ্যা। মমতাজ বেগমের মামলার যে এফআইআর তারা জমা দিয়েছে  জাল কিনা।  নথি তলব করলেই বোঝা যেত ১৯৭২ সালে মমতাজ বেগম নামে কোন মহিলা পিরোজপুর আদালতে এ ধরনের কোন মামলা করেছিলনা কিনা, এ ধরনের কোন মামলার অস্তিত্ব সেখানে আছে কি-না। আসামি পক্ষ জাল জালিয়াতি করেছে কি-না তাও প্রমানিত হত।  কিন্তু আবেদনটি খারিজ করে দেয়ায় বিষয়টি অমিমীমাংসিত থেকে গেল । সাঈদী সত্যিই ইব্রাহিম কুট্টি হত্যায় জড়িত কি-না এ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমানের একটি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন আদালত সে সুযোগ  কাজে না লাগিয়ে আবেদন খারিজ করে দিল  এ জিজ্ঞাসা সবসময়ই মানুষের মনে থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে।

আরেকটি মজার বিষয় হল  ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম এখনো জীবিত। তিনি ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এক নম্বর সাক্ষী হতে পারতেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তাকে এ মামলায় সাক্ষী করেনি। মমতাজ বেগম জীবিত সেটা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও জানেন বলে জেরায় স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাকে তিনি সাক্ষী করেননি। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তকালে কখনো মমতাজ বেগমের কাছে যানওনি।

ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগ এবং এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত এত আলোচিত একটি বিষয়ে পরিণত হলেও কোন পক্ষ থেকেই তাকে আদালতে হাজির করার কোন আবেদন কেউ করেনি। ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার সাথে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জড়িত কিনা এবং তিনি ১৯৭২ সালে এ বিষয়ে কোন মামলা করেছিলেন কি-না তা সবই পানির মত পরিষ্কার হয়ে যেত তাকে হাজির করা গেলে। কারণ তিনি তার স্বামী হত্যার ঘটনায় একজন চাুস সাক্ষী। ঘটনার সময় তিনি তার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন এবং তার হাতেও গুলি লেগেছে মর্মে মামলার বিবরনে বর্নিত আছে।




বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর আপিলের রায় যেকোনদিন// নথি তলব এবং চার্জশিট বিবেচনার আবেদন খারিজ

মেহেদী হাসান, ১৬/৪/২০১৪
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মোফাসসিরে কুরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল মামলার রায় যেকোন দিন ঘোষনা করা হবে। প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ রায় প্রদানের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন।

তাছাড়া পিরোজপুর এবং বরিশাল থেকে মমতাজ বেগমের মামলা সংক্রান্ত নথি তলবের আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। একই সাথে আসামী পক্ষ থেকে দাখিল করা মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিট বিবেচনায় নেয়ার আবেদনও খারিজ হয়ে গেছে। 
সকালে উভয় পক্ষের আবেদন খারিজ করে দিয়ে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করেন আদালত।
গত মঙ্গলবার উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয় এ মামলার।

ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে যে মামলা করেছিল সেই মামলার জিআর (জেনারেল রেজিস্টার) বই তলবের আবেদন করে আসামী পক্ষ গত ১৩ এপ্রিল। একই আবেদনে  আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিট এর মূল সার্টিফাইড কপি জমা দিয়ে তা বিবেচনায় নেয়ার আবেদন করে। ফলে  নথি তবলবের আবেদন খারিজ এর সাথে চার্জশিট বিবেচনায় নেয়ার আবেদনও খারিজ হয়ে গেল।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পিরোজপুর এবং বরিশাল ঘুরে এসে আদালতে বলেন, মমতাজ বেগমের মামলার কোন কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছেনা এবং আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার যে এফআইআর জমা দিয়েছে তা জাল। তিনি তা বিবেচনায় না নেয়ার আবেদন করেন। এরপর গত ১০ এপ্রিল  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আবেদন করা হয় ১৯৭২ সালে গঠিত বরিশাল স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল এর রেজিস্টার বই তলবের জন্য। গতকাল সে আবেদনও খারিজ করে দেন আদালত।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষ থেকে দায়ের করা মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর কপিকে জাল আখ্যায়িত করে তা বিবেচনায় না নেয়ার যে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ তাতে অন্যতম একটি যুক্তি ছিল আসামী পক্ষ এ মামলর চার্জশিট জমা দিতে পারেনি। এফআইআর এ নাম না থাকলেও চার্জশিটে আসামির নাম থাকতে পারে। এরপর গত ১৩ এপ্রিল আসামি পক্ষ চার্জশিট জমা দেয় এবং তা বিবেচনার আবেদন জানায়।

আদালত রায় ঘোষনার তারিখ অপেক্ষমান রাখার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনাল যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে তা আমরা সঠিক মনে করি এবং আশা করছি সে রায় বহাল থাকবে। এছাড়া অপর যে ছয়টি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষীয় সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করা হয়নি সেগুলোতেও সাজার দাবি করেছি।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালত থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে দেলোয়ার শিকদারকে সাঈদী বানিয়ে সাজা দেয়া হয়েছে। আমরা ন্যায় বিচার দাবি করছি এবং তিনি মুক্তি পাবেন আশা করছি। আমরা বিশাবালীর ভাই সুখরঞ্জন বালীকে এনেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ট্রাইব্যুনাল কম্পাউন্ড থেকে তাকে অপহরন করে নিয়ে গেল সাদা পোশাকের লোকজন। অপহরনের আগে সুখরঞ্জন বালী টিভিতে যে সাক্ষাতকার দিয়েছিল তার ভিডিও আমরা জমা দিয়েছি আপিল আদালদে। সেটি বিবেচনায় নেয়া হলে রাষ্ট্রপক্ষের মিথ্যাচার প্রমানিত হবে। সত্য বলতে চাওয়ার কারনে আজ সুখরঞ্জন বালীকে ভারতের কারাগারে জীবন কাটাতে হচ্ছে।

২০১৩ সালেল ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয়। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে  ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। যে ছয়টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল  সেগুলোতে সাজা উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে একই দিন রাষ্ট্রপক্ষও আপিল আবেদন করে।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আজ আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হল।

প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে এ মামলার শুনানীর জন্য গঠিত  পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক এবং বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ মামলায় শুনানী পেশ শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর তার অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান শুনানী পেশ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। এছাড়া এ মামলার আপিল শুনানীর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাজুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম, মহিনুর ইসলাম, মতিয়ার রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, মোসাদ্দেক বিল্লাহ। 

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর আপিল শুনানী শেষ

মেহেদী হাসান, ১৫/৪/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল শুনানী শেষ হয়েছে। আলোচিত এ মামলায় আজ উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়। তবে রায় কবে ঘোষনা করা হবে সে বিষয়ে শুনানী শেষে আদালত কিছু উল্লেখ করেননি। পিরোজপুর এবং বরিশাল থেকে মমতাজ বেগমের দায়ের করা ১৯৭২ সালের মামলার নথি তলব করা বিষয়ে উভয় পক্ষের দুটি ভিন্ন আবেদন বিষয়ে আগামীকাল  আদেশ দেয়ার জন্য ধার্য্য করা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মামলাটির শুনানী গ্রহণ করেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান যুক্তি উপস্থাপন শেষ করে মাওলানা সাঈদীকে নির্দেষা দাবি করে তার মুক্তি দাবি করেন। এছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এর সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে দরখাস্তের শুনানী শেষে যুক্তি উপস্থাপনের সমাপনি টানেন। তিনি স্কাইপ সংলাপসহ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ড তুলে  ধরে আদালতকে বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল একটি পক্ষপাতমূলক আদালত । মাওলানা সাঈদীর মামলাটিকে ঐতিহাসিক মামলা উল্লেখ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে তিনি ন্যায় বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, ৪০ বছর পরে শুরু হওয়া এ মামলা একদিন দেশে ইতিহাস হয়ে থাকবে।

ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে যে মামলা করেছিল সেই মামলার  চার্জশিট জমা দিয়েছে আসামি পক্ষ। মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিট বিবেচনায় নেয়া এবং পিরোজপুর থেকে ওই মামলার জিআর বই তলবের আবেদন করেছে আসামি পক্ষ। অপর দিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পিরোজপুর এবং বরিশাল ঘুরে এসে বলছেন মমতাজ বেগমের মামলার কোন নথি পাওয়া যাচ্ছেনা। তিনি বরিশাল থেকে ১৯৭২ সালে গঠিত স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্টার বই তলবের আবেদন করেছেন। আগামীকাল  বুধবার এ বিষয়ে আদেশের জন্য ধার্য্য করেছেন আদালত।

চার্জশিট বিবেচনায় নেয়া  এবং জিআর বই তলবের আবেদনের ওপর শুনানী করেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন। আবেদনের সাথে তারা মমতাজ বেগমের মামলার জিআর কপির  ফটোকপি জমা দিয়েছে। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা ট্রাইব্যুনালে পিরোজপুর থেকে পাওয়া মমতাজ বেগমের মামলার জিআর বই জমা দিয়েছিলাম কিন্তু তা খারিজ করে দিয়েছে । গতকাল শুনানীর সময় আদালত জিআর বইর ফটোকপি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। আদালত প্রথমে বলেন, এটা একটা ফটোকপি। সার্টিফাইড কপি নয়। তখন অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, আমরা সার্টিফাইড কপি চেয়েছিলাম কিন্তু দেয়নি। জিআর বই’র ফটোকপি কিভাবে সংগ্রহ করা হল আদালতের এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, সেটা আমার জানা নেই। তখন একজন বিচারপতি বলেন,  নিশ্চয়ই জিআর বই ফটোকপির জন্য বাইরে নিয়ে যেতে হয়েছে। যারা এটা করতে পারে তারা সবই পারে। জিআইর নথিতে বরিশাল স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের নম্বর না থাকা, কবে কিভাবে মামলাটি প্রত্যাহার হল, কে কিভাবে কোন ক্ষমতাবলে প্রত্যাহার কর, বাকেরগঞ্জ ডিসির কাছে কিভাবে গেল আদালত এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমাদের ডকুমেন্টটি সত্য না মিথ্যা সেটা প্রমানের জন্যই পিরোজপুর থেকে এ মামলার জিআর বই তলব করা উচিত এবং তার সাথে আমাদের এ কপি মিলিয়ে দেখা যাবে। তাহলেই সত্য মিথ্যা বের হয়ে যাবে। আর মূল বিষয় হল মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে এ ধরনের একটি মামলা করেছিল কি-না, এ ধরনের একটি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল কি-না, এফআইর এবং চার্জশিট হয়েছিল কিনা । এটা জানা গেলেই ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আমাদের দাবির সত্য  না মিথ্যা প্রমানিত হবে। সেজন্য পিরোজপুরের জিআর বই তলব করা দরকার।  আপনারা গোড়ায় হাত দেন। বরিশল ট্রাইব্যুনালে এ মামলা গিয়েছিল কিনা এবং সেখানে কি হয়েছিল তা পরের বিষয়। আগে জানা দরকার পিরোজপুরে আদৌ এ মামলা হয়েছিল কিনা। খন্দকার মাহবুব হোসেন বারবার বলেন, আপনারা দয়া করে গোড়ায় হাত দেন। এটাই আমাদের নিবেদন।

আজ অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানী পেশ করার পর একজন বিচারপতি বলেন,  মি. অ্যাটর্নি জেনারেল আমার স্পষ্ট মনে আছে আসামী পক্ষের দাখিল করা মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর গ্রহণ না করার যে আবেদন আপনারা দিয়েছেন তাতে আপনি বলেছেন এ  মামলার চার্জশিট আসামি পক্ষ জমা দেয়নি। আপনি বলেছিলেন  এফআইআরে আসামির নাম না থাকলেও চার্জশিটে থাকতে পারে। আপনি বারবার বলেছেন আসামি পক্ষ চার্জশিট জমা দিতে পারেনি। কিন্তু এখন তারা চার্জশিট জমা দেয়ার পর আপনি ভিন্ন যুক্তি দেখাচ্ছেন।

দরখাস্ত বিষয়ে শুনানী শেষে মাওলানা সাঈদীপর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন আদালতের অনুমতি নিয়ে  ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা এবং সুখরঞ্জন বালি বিষয়ে কিছু কথা বলেন। তিনি বলেন, সুখরঞ্জন বালি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তারা তাকে আনতে পারলনা। আমরা তাকে আনলাম। এরপর তাকে ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে অপহরন করা হল। তাকে অপহরন করায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
এরপর তিনি সুখরঞ্জন বালীর একটি সাক্ষাৎকার পড়ে শোনান যেখানে সুখরঞ্জন বালি  বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রপক্ষের শেখানোমত মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ তাকে ট্রাইব্যুনালে আনেনি। তিনি আগে থেকেই মাওলানা সাঈদীকে চিনতেন। তাদের বাড়ি আক্রমন এবং তার ভাই বিশাবালীকে ধরে নিয়ে যাবার ঘটনার সময় তাদের বাড়িতে যারা এসেছিল তাদের সাথে মাওলানা সাঈদী ছিলনা। থাকলে তিনি তাকে চিনতেন। কারণ মাওলানা সাঈদীকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন। পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা সাঈদীর শশুরের কাপড়ের দোকান ছিল । সেই সূত্রে আগে থেকেই তিনি তাকে চিনতেন।

এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে পক্ষপাতমূলক (বায়াজড) আখ্যায়িত করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে বাইরের একজন লোকের সাথে ১৭ ঘন্টা স্কাইপ সংলাপ করেছেন এর চেয়ারম্যান। বিচার নিয়ে ২২৩টি ইমেইল আদান প্রদান করেছেন। বাইরে থেকে পাঠানো অনেক বিষয় তিনি হুবহু ট্রাইব্যুনালে পড়ে শুনিয়েছেন।

সকালে শুনানীর  শুরুতে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট শাহজাহান বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মাওলানা সাঈদী স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার ইত্যাদি। কিন্তু আবার তারাই বলছে মাওলানা সাঈদী পাড়েরহাট বাজারে চট বিছিয়ে তেল নুন লবন মরিচ বিক্রি করত। এ ধরনের একজন লোক কি করে তাদের বর্নিত কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, মাওলানা সাঈদী যশোরে ছিলেননা বরং পিরোজপুরে ছিলেন এ মর্মে কোন সাজেশন তারা সাফাই সাক্ষীদের দেয়নি।
আদালতের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পিরোজপুর জেলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত পিরোজপুর জেলার ইতিহাস বইতে স্বাধীনতা বিরোধীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। দেলোয়ার হোসেন মল্লিক নামে এক লোকের নাম আছে। সেই বইয়ে পিরোজপুরের কৃতি সন্তানদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম আছে।

২০১৩ সালেল ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দেয়। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটাপাট, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনসহ ২০টি অভিযোগ আনে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আটটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মাওলানা সাঈদীর খালাস চেয়ে  ওই বছর ২৮ মার্চ আপিল বিভাগে আবেদন করে আসামি পক্ষ। যে ছয়টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে কিন্তু সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল  সেগুলোতে সাজা উল্লেখ করার দাবি জানিয়ে একই দিন রাষ্ট্রপক্ষও আপিল আবেদন করে।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আজ আলোচিত এ মামলায় উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হল।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এ মামলায় শুনানী পেশ শুরু করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর তার অনুপস্থিতিতে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান শুনানী পেশ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন। তাকে সহায়তা করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। এছাড়া এ মামলার আপিল শুনানীর সময় বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন অংশগ্রহণ করেছেন।
আসামী পক্ষে অন্যান্য আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাজুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম, মহিনুর ইসলাম, মতিয়ার রহমান, আবু বকর সিদ্দিক, মোসাদ্দেক বিল্লাহ। 


রবিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৪

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা ও ইব্রাহীম কুট্টি ইস্যু// অবশেষে মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিটও দাখিল করল আসামী পক্ষ

মেহেদী হাসান,১৩/৪/২০১৪
ইব্রাহিম কৃট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলার চার্জশিট ( চার্জশিট নং ২৬, তারিখ ২৯/৯/৭২) আপিল বিভাগে জমা দিয়েছে আসামী পক্ষ। আজ শুনানী শেষে আপিল বিভাগে একটি দরখাস্তের সাথে এ মামলার মূল সার্টিফাইড কপি জমা দেয়া হয়। মমতাজ বেগমের মামলার সেই চার্জশিটেও মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।

এর আগে আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর কপি জমা দেয় ট্রাইব্যুনালে যেখানে ১৩ জন আসামীর মধ্যে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে  ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।

ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে তার স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি মোট ১৩ জনকে আসামী করেন। কিন্তু আসামীর সেই তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের দায়ের করা সেই মামলার এফআইআর নর্থির একটি সার্টিফাইড কপি ২০১১ সালে ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়। মামলার আপিল শুনানীর শেষ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম পিরোজপুর এবং বরিশাল সফর করেছেন। সফর শেষে গত ৯ এপ্রিল আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পিরোজপুর এবং বরিশালের জেলাজজ আদালতে কোথাও এ মামলার কাগজ পাওয়া যায়নি। আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার নথি মর্মে যে ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে তা জাল, মিথ্যা এবং মামলার প্রয়োজনে সৃজনকৃত। তাই এ কাগজ বিবেচনায় না নেয়ার লিখিত আবেদন করেন তিনি।

আসামী পক্ষের দায়ের করা এফআইআর কপিটিকে জাল আখ্যায়িত করা এবং এটি বিবেচনায় না নেয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল এর পক্ষ থেকে যেসব যুক্তি আদালতে তুলে ধরা হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল মমতাজ বেগমের দায়ের করা মামলার চার্জশিট বিষয়ক। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামী পক্ষ দাবি করেছে এ মামলায় চাজশিট হয়েছিল কিন্তু তারা সেই চার্জশিট জমা দেয়নি। একটি মামলার প্রাথমিক অভিযোগে সব বা মূল আসামীর নাম নাও থাকতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে চার্জশিটে মূল আসামীর নাম আসতে পারে বা অন্য আসামীর নাম যোগ হতে পারে। আসামী পক্ষ মামলার এফআইআর কপি যোগাড় করতে পারল আর চার্জশিট তারা জোগাড় করতে পারলনা? তারা কেন চার্জশিট তুলতে পারলনা?

এ প্রেক্ষিতে আসামী পক্ষ আজ মমতাজ বেগমের মামলর চার্জশিট দাখিল করল আদালতে। ১৯৭২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ এ মামলর চার্জশিট দাখিল করে। মমতাজ বেগমের মামলার প্রাথমিক অভিযোগ বা  এফআইআরে ঘটনার  বিবরন, তারিখ এবং  ঘটনাস্থলের যে বিবরন রয়েছে তার সাথে মিল রয়েছে চার্জশিটে বর্নিত ঘটনা, ঘটনার তারিখ এবং ঘটনাস্থলের।  তবে এফঅইআরে যে ১৩ জনকে আসামী করা হয়েছে তা থেকে চারজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে মাওলানা সাঈদী বা অন্য কোন নতুন আসামীর নাম এ ঘটনায় আর যুক্ত হয়নি চাজশিটে।

মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিটে ঘটনার বিবরন :
২ নং কলামে বর্নিত পলাতক  (১. দানেশ আলী মোল্লা ২. আশরাফ আলী ৩. আব্দুল মমিন হাওলাদার ৪. আব্দুল কালাম চৌকিদার, ৫. আবদুল হাকিম মুন্সি, ৬. মমিন উদ্দিন ৭. মোসলেম মাওলানা) এবং ৩ নং কলামে বর্নিত গ্রেফতারকৃত ( আইউব আলী ও  সুন্দর আলী) আসামীরা ১/১০/৭১ তারিখ রাইফেলসহ মমতাজ বেগমের ঘরে প্রবেশ করে তার স্বামী ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে, রাইফেলের গুলিতে মমতাজ বেগমের হাতে জখম হয়, তাদের বাড়ির জিনিসপত্র লুট করে, তার (মমতাজ বেগম) ভাই সাহেব আলী ওরফে সিরাজকে অপহরন করে পাকিস্তান আর্মির কাছে তুলে দেয় যারা তাকে পরে হত্যা করে। আসামীদের সবাই রাজাকার এবং দালাল। তদন্তে প্রাথমিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১ নং কলামে বর্নিত চারজনকে (আতাহার আলী হাওলাদার, রুহুল আমিন, সেকেন্দার আলী সিকদার এবং শামসুর রহমান) অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া যেতে পারে।

গত বৃহষ্পতিবার শুনানীর সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বরিশাল থেকে ১৯৭২ সালে  গঠিত স্পেশাল ট্রাইবুনালের রেজিস্ট্রার বই তলবের আবেদন করেন আদালতে। তখন আসামী পক্ষ থেকে মৌখিক আবেদন করে বলা হয় ১৯৭২ সালে পিরোজপুর থেকে মমতাজ বেগমের মামলার জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) বইও তলব করা হোক। আদালত তখন আসামী পক্ষকে লিখিত আবেদন করতে বলেন। আজ আসামী পক্ষ পিরোজপুর থেকে জিআর বই তলব এবং মমতাজ বেগমের মামলার চার্জশিট জমা দিয়ে তা বিবেচনায় নেয়ার জন্য একটি দরখাস্ত জমা দেয়।


পূর্বসূত্র :
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাট বাজারে  পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে যে মামলা করেন তাতে আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। সেই মামলার ডকুমেন্ট আসামী পক্ষ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করে আসামী পক্ষ মামলার প্রয়োজনে এ জাল দলিল তৈরি করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তবে আসামী পক্ষের এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।

গত ৩ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নতেৃত্বে আপিল শুনানীর  সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন।
আদালত তখন তাকে প্রশ্ন করেন, আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে পারল আর আপনারা পারলেননা কেন? ১৯৭২ সালে আদৌ এ ধরনের কোন এফআইআর হয়েছিল কি-না? পিরোজপুরে অবশ্যই জিআর রেজিস্ট্রেশন বই আছে। আপনারা এটা চাইতে পারতেননা? আপনাদের অনেক বড় মেশিনারীজ আছে। তার মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন? আমরা যদি আসামী পক্ষের দায়ের করা এ ডকুমেন্ট গ্রহণ করি তাহলে অ্যাটলিস্ট আমরা বলতে পারি সাঈদী এ ঘটনায় জড়িত নয়।
আদালত আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ মামলার শুনানী চলছে। আসামী পক্ষ অনেক আগে এ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে। আপনারা অনেক সময় পেয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে আপনারা চাইলে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন।

এরপর গত ১১ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেল আসামী পক্ষের জমা দেয়া মমতাজ বেগমের মামলার মূল সার্টিফাইড কপি আপিল বিভাগের রেকর্ড রুম থেকে দেখার আবেদন করেন। গত ১ এপ্রিল শুনানীর পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ মামলার বিচার ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি চান। এরপর খবর বের হল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথির খোঁজে অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল সফর করছেন।

ইব্রাীহম কুট্টি হত্যার অভিযোগ : পাড়েরহাট বাজারের নিকটে সইজুদ্দিন পসারীদের  বাড়িতে কাজ করত ইব্রাহীম কুট্টি। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীসহ শান্তি কমিটির অন্যান্য লোকজনের নেতৃত্বে পাকিস্তান সৈন্যরা ওই বাড়িতে আক্রমন করে। এসময় ইব্রাহীম কুট্টি ও অপর আরেকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে। পরে মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে পাকিস্তান সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে পাড়েরহাট বাজারে।

আসামী পক্ষের দাবি : আসামী পক্ষের দাবি ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার সাথে মাওলানা সাঈদী জড়িত নন। এ দাবির পক্ষে তারা ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথি জমা দিয়েছে আদালতে। মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে মোট ১৩ জন আসামী করা হয়। আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আসামী পক্ষের দাবি তিনি যদি এর সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তাকে তখন আসামী করা হত।

মমতাজ বেগমের মামলার এফআইর-এ ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিবরন : স্বামী  ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে মমতাজ বেগম দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে একটি মামলা করেন। সে মামলার বিবরনে মমতাজ বেগম উল্লেখ করেছেন   তার স্বামী  ইব্রাহীম কুট্টি তার বাপের বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় শান্তি কমিটির লোকজন এবং পাকিস্তান আর্মি গুলি করে  হত্যা করেছে। ঘটনার সময়কাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১  অক্টোবর ।
মমতাজ বেগমের মামলায় আরো উল্লেখ আছে যে, ওই ঘটনার সময় তাদের বাড়ি থেকে তার ভাই সাহেব  আলী ওরফে সিরাজ এবং তার মা সিতারা বেগমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পিরোজপুর। পরে তার মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে আর ছাড়া হয়নি। তাকে পাকিস্তান পিরোজপুরে আর্মি গুলি করে হত্যা করে।

মমতাজ বেগমের মামলার বিবরনে বলা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবার নলবুনিয়া তার শশুর বাড়ি থাকা অবস্থায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের দাবির্  ৮ মে তাকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যের স¤পূর্ণ বিপরীত তথ্য রয়েছে মমতাজ বেগমের মামলার নথিতে।

মমতাজ বেগমের মামলায় ঘটনার বিবরন নিম্নরূপ :

“ঘটনার বিবরন এই যে, বিবাদীগন পরষ্পর যোগাযোগে রাইফেল পিস্তল ছোরা লাঠি ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া আমার পিতার ঘর বেড়দিয়া আমার স্বামীর উপর গুলি করিয়া হত্যা করিয়া আমার শরীরে জখম করিয়া আমার মাতা ও ভ্রাতাকে ধরিয়া পিরোজপুর আনিয়া আমার মাতাকে ছাড়িয়া দিয়া আমার ভ্রাতা সিরাজুলকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আক্রোশের কারণ এই যে, আমি ও আমার স্বামী আমার স্বামীর বারিতে বাদুরা গ্রামে বাসবাস করিতেছিলাম। গত মে মাসে পাক সৈন্য এদেশে আসিয়া যখন অকারনে গুলি করিয়া মানুষ হত্যা করিতে থাকে তখন কতিপয় হিন্দু আমাদের সরনাপন্ন হওয়ায় আমরা তাহাদের আশ্রয় দেওয়ায় পাক সৈন্য ও তাহাদের দালালরা আমার স্বামীকে হত্যা করিতে খোঁজ করিতে থাকায় আমরা ভয়ে ভীত হইয়া আমরা পিত্রালয়ে বসবাস করিতেছিলাম। তথায় বিবাদীগন ক্রোধ করিয়া উক্তরুপ অত্যাচার করিয়াছে।

প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে আমি গর্ভবতী থাকায় আমার পিতা পারোরহাট আওমীলীগ অফিসে জানাইয়া কোন প্রতিকার পাইনাই। তাই এই দরখাস্ত করিতে বিলম্ব হইল।
সে মতে প্রার্থনা, আদালত দয়া করিয়া উক্ত ধারামতে উক্ত বিবাদীগনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দিয়া ধৃত করাইয়া সুবিচার করিতে আজ্ঞা হয়। ইতি মমতাজ বেগম”

মামলঅর নথি থেকে ঘটনার এ ব্বিরন আসামী পক্ষ থেকে আদালতে পড়ে শোনানো হয়েছে শুনানীর সময়।

মমতাজ বেগমের মামলার এফআইআর এ   আসামীর তালিকা :
মমতাজ বেগম  সে মামলায় মোট ১৩ জনকে আসামী করেছেন।  এরা হল  দানেশ মোল্লা,  আতাহার আলী, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী, কালাম চৌকিদার, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা।  এছাড়া পাকিস্তান আর্মিকেও আসামী করা হয় মমতাজ বেগমের মামলায়। কিন্তু মমতাজ বেগমের মামলায় আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।

আপিল শুনানীর সময় মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম  শাহজাহান আদালতে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের এ ডকুমেন্টকে অসত্য এবং জাল আখ্যায়িত করেছে।  তাদের উচিত ছিল পিরোজপুর থেকে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ডাকার ব্যবস্থা করে তাদের দাবি প্রমান করা। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং  আমরা থানা থেকে এ মামলার নথিপত্র তলবের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।

আসামী পক্ষ যেভাবে সংগ্রহ করল মমতাজ বেগমের মামলার নথি : মাওলানা সাঈদীর ছেলে   ও ১৩ তম সাফাই সাক্ষী মাসুদ সাঈদী ট্রাইব্যুনালে জেরায় বলেছেন, ‘তার বড় ভাই মরহুম রাফিক বিন সাঈদীকে মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম মামলার মূল সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করেন।’
মামলার বাদী মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম ১৯৭২ সালে এ মামলার সার্টিফাইড কপি পিরোজপুর থেকে ইস্যু করান এবং সিতারা বেগম দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এ মামলার কপি সংরক্ষন করেছেন।

মমতাজ বেগমের মামলার ঘটনাপ্রবাহ :
মামলার নথি  ঘেটে দেখা যায় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ মমতাজ বেগম পিরোজপুর এসডিও কোর্টে প্রথম এ মামলা করেন। তখন এসডিও ছিলেন একে আজাদ। ওই তারিখে এসডিও মামলাটি পিরোজপুর থানায় পাঠান।

বাদী মমতাজ বেগমের লিখিত অভিযোগ এসডিওর কাছ থেকে পাবার পর পিরোজপুর থানা ১৬/৭/১৯৭২ তারিখ বেলা ১টা ৩০ মিনিটের সময় অভিযোগটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করে। মামলা নং ৯। জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) নং ৩৭৮/৭২।

১৭/৭/১৯৭২ তারিখ সকাল ৮টায় থানা থেকে মামলাটি পিরোজপুর কোর্টে পাঠানো হয়। তখন থানার ওসি ছিলেন মেফতাউদ্দিন আহমেদ। তিনি নিজে মামলার তদন্ত শুরু করেন। মামলার এজাহারে ঘটনার তারিখ লেখা আছে ১/১০/১৯৭১। বাংলা ১৩ আশ্নিন ১৩৭৮।
২২ জুলাই ১৯৭২ এসডিও কোর্টে মামলাটি উত্থাপন করা হয়।

২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ পুলিশ এ মামলার চার্জশিট দাখিল করে।

৩ অক্টোবর ১৯৭২ এসডিও বরাবর চার্জশিট উপস্থাপন করা হয়।
মমতাজ বেগমের অভিযোগ অনুসারে  এ মামলার তদন্তকালে আসামীদের মধ্য থেকে ২ জনকে আটক করা হয়। এরা হল আইউব আলী চৌকিদার ও সুন্দর আলী দফাদার।

পুলিশের প্রতিবেদনে আসামীদের মধ্য থেকে যাদেরকে পলাতক দেখানো হয় তারা হল
১.    দানেশ মোল্লা
২.    আশরাফ আলী
৩.     আব্দুল মান্নান
৪.    কালাম চৌকিদার
৫.    আব্দুল হাকিম মুন্সি
৬.    মমিন উদ্দিন
৭.    মোসমেল মওলানা।

মামলা চলাকালে পলাতক আসামীদের মধ্য থেকে আরো ২ জনকে আটক করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ অক্টোবর আব্দুল মান্নান এবং ১৯৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মমিন উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয় যা মেজিস্ট্রেট কোর্টে সংরক্ষিত জিআর বইতে ৩৭৮/৭২ জিআর কপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়।
জিআর কপি পর্যালোচনা করে আরো দেখা যায় মমতাজ বেগমের দায়ের করা ওই মামলা থেকে আসামী আতাহার আল হাওলাদার, রুহুল আমিন সেকেন্দার শিকদার, শামসুর রহমান (তৎকালীন পিরোজপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই) কে অব্যাহতি দেয় কোর্ট।

মমতাজ বেগমের দায়ের করা মামলাটি ২৭/১১/১৯৭২ সালে তৎকালীন এসডিও এমএ হাশেম মিয়া স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জাজ বরিশাল প্রেরন করেন।
মামলার জিআর বইয়ে দেখা যায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে মামলার কার্যক্রমের জন্য মামলাটি বাকেরগঞ্জ ডিসির কাছে পাঠানো হয়েছিল। জিআর বইয়ের ১৭ নং কলামে লেখা আছে-
ঔঁফরপরধষ ৎবপড়ৎফ ংবহঃ ঃড় উঈ ইধশবৎমড়হম ঢ়ৎড়ারফব ঃযরং সবসড় ঘড় ২৫৫ ঔঁফরপরধষ, ফধঃবফ ১৭/২/১৯৮১ ারফব ঃযরং পড়সঢ়ষঃ সপপ ঘড় ১৮৯/৮১.