মেহেদী হাসান, ১৭/৯/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনটি পৃথক অভিযোগে তাকে আমৃত্যু জেল, অপর দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ১২ বছর জেল এবং বিশাবালী হত্যাকান্ডে আমৃত্যু জেল দেয়া হয়েছে। বিশাবালী হত্যার অভিযোগসহ আরো দুটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারান্দণ্ড দেয়া হয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ চূড়ান্ত এ রায় ঘোষনা করে আজ।
রায়ে আসামী এবং রাষ্ট্রপক্ষ উভয়পক্ষের আবেদন আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে আসামী পক্ষের আবেদন আংশিক গ্রহণ করে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে একটিতে আমত্যৃ জেল এবং আরেকটিতে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হল।
অপরদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনও আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার অভিযোগ ছিল আট নং অভিযোগ। এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুত্যুদন্ড দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিশাবালীর অভিযোগটি ছিল ১০ নং অভিযোগ। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আজকের রায়ে এ অভিযোগে আমৃত্য কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ।
১৬ নং অভিযোগ হল গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগে আপিল বিভাগের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্য জেল দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ১৯ নং অভিযোগ হল মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এ অভিযোগেও মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেলা দেয়া হয়েছে।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগে ট্রাইবু্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোন সাজা উল্লেখ করেনি। আপিল বিভাগর রায়ে এ তিন অভিযোগের বিপরীতে সাজা উল্লেখ করা হল।
এছাড়া আরো তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও সে তিনটি অভিযোগে আজকের চূড়ান্ত রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে। এ অভিযোগ তিনটি হল (৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন এবং (১৪) ১৯৭১ সালে হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা ।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সকালে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করে। সকাল ১০টা পাঁচ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। ১০টা সাত মিনিটের সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় রায় ঘোষনা। এসময় আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এবং সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। ঠিক পাঁচ মাস শেষে চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করা হল।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত ১৬ এপ্রিল।
মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
ইবরাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে বলা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি এবং মফিজুল নামে দুজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে। তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট বাজারে আনার পর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে।
১০ নং যে অভিযোগ বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ৬ জুন সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।
আপিল শুনানীর সময় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে জানায় ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতকাজ বেগম ১৯৭২ সালে মামলা করে ১৩ জনকে আসামী করে তাতে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত আছেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন : ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।
মানিক পসারী নামে এক লোক পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন। এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।
মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন। তার ওয়াজ শুনে অসংখ্য অনেক হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র। দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং কোরআনের তাফসির করেছেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনটি পৃথক অভিযোগে তাকে আমৃত্যু জেল, অপর দুটি অভিযোগের একটিতে ১২ বছর এবং আরেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডে ১২ বছর জেল এবং বিশাবালী হত্যাকান্ডে আমৃত্যু জেল দেয়া হয়েছে। বিশাবালী হত্যার অভিযোগসহ আরো দুটি অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু কারান্দণ্ড দেয়া হয়েছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ চূড়ান্ত এ রায় ঘোষনা করে আজ।
রায়ে আসামী এবং রাষ্ট্রপক্ষ উভয়পক্ষের আবেদন আংশিকভাবে মঞ্জুর করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে মোট আটটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড দেয়। অপর ছয়টি অভিযোগে কোন সাজা উল্লেখ করেনি ট্রাইব্যুনাল।
আসামী পক্ষ মাওলানা সাঈদীকে বেকসুর খালাস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ছয়টি অভিযোগে সাজা উল্লেখের দাবি জানিয়ে আপিল আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে আসামী পক্ষের আবেদন আংশিক গ্রহণ করে মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে একটিতে আমত্যৃ জেল এবং আরেকটিতে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হল।
অপরদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজা উল্লেখ করা হয়নি এমন ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনও আংশিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অপর তিনটি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২০টি অভিযোগ আনে। আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার অভিযোগ ছিল আট নং অভিযোগ। এ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুত্যুদন্ড দেয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগে ১২ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিশাবালীর অভিযোগটি ছিল ১০ নং অভিযোগ। এ অভিযোগেও ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। আজকের রায়ে এ অভিযোগে আমৃত্য কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন গ্রহণ করে যে তিনটি অভিযোগে সাজা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগ।
১৬ নং অভিযোগ হল গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, আনু এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়ার অভিযোগ। এ অভিযোগে আপিল বিভাগের রায়ে মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্য জেল দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ১৯ নং অভিযোগ হল মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এ অভিযোগেও মাওলানা সাঈদীকে আমৃত্যু জেলা দেয়া হয়েছে।
সাত নং অভিযোগ ছিল শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া। এ অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
সাত, ১৬ এবং ১৯ নং অভিযোগে ট্রাইবু্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোন সাজা উল্লেখ করেনি। আপিল বিভাগর রায়ে এ তিন অভিযোগের বিপরীতে সাজা উল্লেখ করা হল।
এছাড়া আরো তিনটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীকে দোষী সাব্যস্ত করলেও সে তিনটি অভিযোগে আজকের চূড়ান্ত রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে। এ অভিযোগ তিনটি হল (৬) পাড়েরহাট বাজারে দোকানপাটে লুটপাটে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন এবং (১৪) ১৯৭১ সালে হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা ।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সকালে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করে। সকাল ১০টা পাঁচ মিনিটের সময় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। ১০টা সাত মিনিটের সময় সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষনা শুরু করেন। তিন মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে যায় রায় ঘোষনা। এসময় আদালত কক্ষে বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এবং সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ এপ্রিল আপিল বিভাগে মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয়। ঠিক পাঁচ মাস শেষে চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করা হল।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শুরু হয়। সাড়ে ছয় মাসেরও অধিক সময় পর আলোচিত এ মামলায় আপিল শুনানী শেষে রায় অপেক্ষমান ঘোষনা করা হয় গত ১৬ এপ্রিল।
মাওলানা সাঈদীর আপিল মামলার শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গঠন করা হয় তখন। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞ, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
ইবরাহীম কুট্টি ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগ বিষয়ে বলা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আর্মি এবং শান্তি কমিটির লোকজন চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এরপর মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি এবং মফিজুল নামে দুজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে। তারা ওই বাড়িতে কাজ করত। পাড়েরহাট বাজারে আনার পর মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে।
১০ নং যে অভিযোগ বিষয়ে চার্জ ফ্রেমিং অর্ডারে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ৬ জুন সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।
আপিল শুনানীর সময় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে আসামী পক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে জানায় ইব্রাহিম কুট্টি ১৯৭১ সালে আট মে তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছে। এ বিষয়ে তার স্ত্রী মমতকাজ বেগম ১৯৭২ সালে মামলা করে ১৩ জনকে আসামী করে তাতে মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। মমতাজ বেগম এখনো জীবিত আছেন।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন : ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর মামলার সমস্ত কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় নির্দিষ্ট করে তারিখ ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।
মানিক পসারী নামে এক লোক পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি নালিশ দায়ের করেন পিরোজপুর নালিশী আদালতে।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন। এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।
এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী রয়েছেন।
মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় : মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ করার পর তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসা শিক্ষা শেষ করে গবেষণা কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৬৭ থেকে মাওলানা সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন। তার ওয়াজ শুনে অসংখ্য অনেক হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র। দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং কোরআনের তাফসির করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন