হাজী মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষী খোদেজা বেগম জেরায় প্রশ্নের জবাবে যে উত্তর দেন তা নিম্নরূপ। গত ২৭ মে তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।
২৮/০৫/২০১৩
পুনরায় জেরা শুরু ঃ
০৩-০৫-২০০৯ তারিখে আসামী মোবারক ও জমশেদ মিয়ার বিরুদ্ধে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে, আমার পিতার হত্যার ব্যাপারে মামলা দায়ের করি। আমার দাখিলী নালিশী দরখাস্ত ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত হইতে তদন্তের জন্য থানায় প্রেরণ করা হয়েছে। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আমার মামলার উকিল ছিলেন জনাব সৈয়দ তানভীর হোসেন। আমি অন্য কোন উকিল নিয়োগ করি নাই। আমার দাখিলী নালিশী দরখাস্তে সাক্ষী হিসাবে আমার ভাই, চাচাদের নাম আমি দিয়েছিলাম, অন্যদের নাম আমি দিই নাই। আমার ভাইয়ের নাম রফিকুল ইসলাম এবং চাচার নাম আব্দুল আহাদ। আব্দুর রউফ ও মেম্বার ঐ মামলায় সাক্ষী ছিলেন। আমি যে জমশেদ মিয়ার নামে কেইস করেছিলাম অদ্য তাকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দেখছি না। জমসেদ মিয়া এখনও জীবিত আছে। আমার দাখিলী নালিশী দরখাস্তে আমার বাপের বাড়ি টেংরাপাড়া একথা উল্লেখ করি কিনা তাহা আমার স্মরণ নাই। উল্লেখিত নালিশী দরখাস্তে ১৯৭১ সালে আমার স্মরণ নাই। (চলবে)
২৮/০৫/২০১৩ ইং ২.০০ মিঃ পুনরায় জেরা শুরু ঃ
আমার পিতা আব্দুল খালেক সাহেব মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তার আগে তিনি আনছার ছিলেন। আমার পিতা সেনাবাহিনীতে ছিলনা। আমার পিতা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছিলেন তাহা আমার জানা নাই, কারণ আমি আমার পিতার সংগে যুদ্ধ করতে যাই নাই, আমি শুনেছি আখাউড়া, রানীদিয়া, সরাইল বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। আমার পিতা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তৎমর্মে কাগজপত্র আমার নিকট আছে। সেই কাগজপত্র আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করিনাই, তবে গেজেট নম্বর দিয়েছি। আমি লেখাপড়া জানি না বিধায় ঐ গেজেটের মাস, তারিখ বলতে পারব না। ইহা সত্য নহে যে, আমার পিতা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম চৌধুরী আমার পিতাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম চৌধুরী উপস্থিত থাকার কথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ১৪/১৫ বৎসর ছিল তৎমর্মে কোন কাগজপত্র আমার নিকট নাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ৫/৬ বৎসর ছিল, ইহা সত্য নহে। আমাদের গ্রামের রাস্তার কোন নাম নাই। যে স্থান থেকে আমার পিতাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে বাকাইল ঘাটের দূরত্ব আনুমানিক দুই কিলোমিটার হবে। আমার প্রথম স্বামীর নাম ইসমাইল, গ্রাম- মজলিসপুর এবং দ্বিতীয় স্বামীর নাম হাসিম, গ্রাম-শিমরাইলকান্দি। ইসমাইল আমাকে তালাক দিয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না, কারণ তখন আমি ছোট ছিলাম। আমার স্বামী হাসিম মারা গেছেন। ইসমাইল বর্তমানে জীবিত আছে কিনা তাহা আমি জানি না। ১৯৭১ সালে বাকাইল ঘাট থেকে আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকের রাস্তার যেতে কাঁচা রাস্তা ছিল, রিক্সা, ভ্যান চলাচল করতো। আমার পিতাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে ঘটনাস্থলে অনেক লোকজন জমায়েত হয়েছিল। যারা জমায়েত হয়েছিল তাদের মধ্যে কেউ বর্তমানে জীবিত নাই। ঘটনার দিন দৌড়িয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ পৌছি। ঐ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে ছিলেন তাহা আমার স্মরণ নাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের টেংরাপাড়ার মেম্বার ছিলেন ফুল মিয়া। টেংরাপাড়া গ্রামে ১৯৭১ সালে কতগুলি ঘরবাড়ি ও কতজন লোক ছিল তাহা আমি বলতে পারবনা, কারণ আমি গুনে দেখি নাই। আন্দাজে কেমনে বলব কতগুলি ঘরবাড়ি ছিল। মোবারক হোসেন রাজাকার কমান্ডার থাকা সংক্রান্তে কোন কাগজ আমার নিকট নাই, থাকার কথা নহে। আসামী মোবারক হোসেনের বাড়ি আমার বাড়ি থেকে কতদূর তাহা আমি বলতে পারব না। আমার বাড়ি থেকে মোবারক আলীর বাড়ি ৫৫ কিঃ মিঃ দূরে কিনা তাহা আমি আন্দাজ করে বলতে পারবনা। আমাদের পাড়ায় আমার পিতা ছাড়া তারা হলেন শমসের আলী, সিদ্দিক মিয়া, আব্দুল হেকিম, আহাদ মিয়া প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমার চাচা আহাদ মিয়া আমার পিতার সংগে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন মর্মে শুনেছি। রাজাকাররা আসার সংবাদ কেউ দেই নাই। ‘‘ রাস্তায় উঠলেই রাজাকাররা আমার বাবাকে ধরে হাত বেঁধে মারপিঠ শুরু করে। তখন আমরা চিল্লা চিল্লি ও কান্নাকাটি করতে করতে তাদের পিছনে পিছনে যাই” এই কথা অসত্য, ইহা সত্য নহে। জিল্লুর রহমান নামে দুইজনকে আমি চিনি, তবে তাদের পিতার নাম আমি জানিনা। আমার নানীর বাড়ি বুধল, দাদীর বাপের বাড়ি বেলতলা। মুক্তিযুদ্ধের আগে আসামী মোবারক হোসেনের সংগে আমাদের কোন জায়গা জমি নিয়ে কোন গোলমাল ছিল না এবং তখন তাকে আমরা চিনতামওনা। আমার মা বা দাদীর নয়াদিল গ্রামে কোন ব্যবসা বাণিজ্য ছিলনা। আব্দুর রউফ ভূঁইয়া, পিতা-মৃত আবুল কাহার ভূঁইয়াকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দুই/আড়াই বৎসর পরে চিনেছি, সে একজন রাজাকার ছিল। রাজাকার বাহিনী কখন গঠিত হয়েছিল তাহা আমি জানি না। আমার কোন জায়গাজমি নাই। স্বামীর দুই শতক জায়গা আছে সেখানে ঘর তুলে থাকি। আমি কোন ভাড়া ঘরে থাকিনা। ঘটনার দিন বাংলা কত তারিখ ছিল। ঐ সময় বাংলা কত সাল ছিল তাহা বলতে পারবনা। ঘটনাস্থলের উত্তর দিকে ঐ সময় স্কুল ছিল এবং অনেক দূরে ঘর বাড়ি ছিল ঘটনাস্থলের পূর্ব দিকে একটি পুকুর ছিল তার পূর্বে ঘর বাড়ি ছিল। ঐসময় পশ্চিম দিকে একটি বাড়ি ছিল। ঘটনাস্থল রাস্তার দুইপার্শে ঘটনার সময় ধানক্ষেতে কোন লোকজন কাজ করছিল না। সকলেই ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আমার পিতাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার স্থান দেখিয়েছি। বাকাইল ঘাটে ১৯৭১ সালে একটি মাত্র চায়ের দোকান ছিল। ঐ ঘাটের পাশে একটি বাজার আছে। দক্ষিণ দিকে একটি হাই স্কুল আছে। উত্তর পূর্ব দিকে একটি মন্দির আছে কিনা তাহা বলতে পারব না। বাকাইল ঘাটে ১৯৭১ সালে কোন নৌকা বাঁধা থাকতো না, তখন বাজার হওয়াতে নৌকা বাঁধা থাকে। ইহা সত্য নহে যে, ১৯৭১ সালে বাকাইল ঘাটে বাজার ছিল এবং সেখানে সবসময় অনেকগুলি নৌকা বাঁধা থাকতো। ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে অনেক রাজাকারের শাস্তি হয়েছিল কিনা তাহা আমি জানি না। সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ আমি ঘটনার দিন ১৫/২০ জন রাজাকার দেখেছিলাম। ঐ সময় ঐ ক্যাম্পে পাকিস্তান আর্মিদের দেখেছিলাম। ঘটনার দিন আমি, আমার মা, দাদী সুহিলপুর রাজাকার ক্যাম্প যাওয়ার কথা অসত্য, ইহা সত্য নহে। ‘‘খালেক মাওলানাকে আমার বাবাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনুরোধ করলে তিনি বলেন আজকে রাত হয়ে গেছে, আগামীকাল সকালে ক্যাম্পে গিয়ে আমার বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন। পরদিন সকালে খালেক মাওলানার নিকট যাওয়ার পূর্বে লোকজন বলাবলি করছে যে, তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে আমার বাবাকে গুলি করে করে হত্যা করে সেখানে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। তখন আমরা কান্নাকাটি করে বাকাইল ঘাটে গিয়ে দেখি আমার পিতার হাত, পা বাঁধা, কপালের ডান পাশে গুলি, মাথার খুলি উড়ে গেছে, বুকের ডান পাশে গুলির চিহ্ন এবং নাভির নীচে ও উপরে দুটি কাটা চিহ্ন অবস্থায় লাশ পড়ে আছে। তারপর আমার মা খালেক মাওলানার নিকট যায়। খালেক মাওলানা উল্লেখিত ক্যাম্প থেকে একটি সিøপ এনে আমাদের নিকট দিলে আমরা আমাদের পিতার লাশ নিয়ে এসে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি” একথাগুলি অসত্য, ইহা সত্য নহে। আমার পিতার বাড়িতে আমার ভাই ও মা থাকেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার মাকে ঘটনার বিষয় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, মা কি বলেছে তাহা আমি জানি না। মোবারক আলীকে মিথ্যা মামলার জড়ানো হয়েছে বিধায় আমি সাক্ষ্য দিবনা একথা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট আমার মা বলেছে, ইহা সত্য নহে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে নালিশী দরখাস্ত দাখিল করার আগ পর্যন্ত আমার পিতার হত্যা সংক্রান্ত আমি কোন মামলা ইতিপূর্বে করি নাই। গ্রামের যে রাস্তা থেকে আমার পিতাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই রাস্তা দিয়ে লোকজন চলাচল করে। আমাদের বাড়ির পশ্চিম পাশের বাড়ির মালিকের নাম শহীদ মিয়া। শহীদ মিয়ার মাতা জীবিত নাই। আমার পিতার আনছার বিভাগে চাকুরীর শেস কর্মস্থল ছিল উলছাপাড়া, সেখান থেকে পালিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আমার পিতার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কে ছিলেন তাহা আমি জানি না। পিতা বাড়িতে আসার পর কোন জায়গা থেকে এসেছিলেন তাহা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু তিনি বলেন নাই। আমার বাবার বাড়ি টেংরাপাড়া একথা তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে। আমি আব্দুল হামিদ, পিতা মৃত আবুল কাহার ভূঁইয়াকে চিনি না। ‘‘ পালানোর সময় রাস্তায় উঠলেই রাজাকাররা আমার বাবাকে ধরে হাত বেঁধে মারপিঠ শুরু করে” বা ‘‘তখন ক্যাম্পের একজন রাজাকার যার নাম আব্দুর রউফ আমার মা ও দাদীকে বলে যে ঐ খাবার আমার নিকট দিয়ে যান আমি খাইয়ে দিব। আব্দুর রউফ রাজাকার মা ও দাদীকে বলেছে উল্লেখিত ক্যাম্পের কমান্ডার আখাউরা থানার নয়াদিল গ্রামের মোবারক হোসেন, যাকে ধরলে আমার বাবাকে ছাড়িয়ে নেয়া যাবে। তখন আমার মা ও দাদী বািড়তে ফিরে আমাদের আমাদের ঐ কথা জানায়। তখন আমার মা আমাদের বাড়ির পাশের খালেক মাওলানাকে আমার বাবাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনুরোধ করলে তিনি বলেন আজকে রাত হয়ে গেছে, আগামীকাল সকালে ক্যাম্পে গিয়ে আমার বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসবেন” বা ‘‘যে সকল রাজাকাররা আমার পিতাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের কারো নাম ঐসময় জানতাম না, দেখলে চিনবো। আমি শুনেছি আমার বাবাকে ধরে নেওয়ার সময় রাজাকার কমান্ডার মোবারক হোসেন ও তার সহযোগী রাজাকার জামশেদ ছিল” বা ‘‘তখন তার বয়স কম ছিল, দাড়ি ছিলনা” এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মিদের ভয়ে আসামী মোবারক আলী দাড়ি রেখেছিল, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালে আসামী মোবারক হোসেন রাজাকার কমান্ডার ছিল না, ইহা সত্য নহে। আমি যখন আসামী মোবারক হোসেনকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সনাক্ত করি তখন কাঠগড়ায় একজন ব্যক্তিই উপস্থিত ছিলেন। আমি একটি কুচক্রী মহলের ইন্দনে এবং অর্থের লোভে অসত্য সাক্ষ্য প্রদান করলাম, ইহা সত্য নহে। আমার কথিত সময়ে, কথিত স্থান থেকে আমার পিতাকে ধরে নিয়ে যাওয়া এবং তাকে হত্যা করার কথা অসত্য, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন