মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত সাজা বিষয়ে আসামী পক্ষের আপিল শুনানী অব্যাহত রয়েছে। আজ সোমবারও তিন নং অভিযোগ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব হত্যার বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
যুক্তি উপস্থাপনের সময় ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক খন্দকার আবু তালেব হত্যা ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তা এবং ফরমাল চার্জ থেকে পরষ্পর বিরোধী বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তিনি আদালতকে দেখান যে, তালেব হত্যার ঘটনার বিবরনে ফরমাল চার্জ এবং সাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্যে পরষ্পর বিরোধী তথ্য রয়েছে। যেমন ফরমাল চার্জে ঘটনা বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে মিরপর ১০ নং বাস স্ট্যান্ড থেকে আবু তালেবকে কাদের মোল্লা অন্যান্য আলবদর, রাজাকার এবং বিহারী দৃস্কৃতকারীরা ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানায় নিয়ে হত্যা করে। অপর দিকে এ ঘটনা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা বলেছেন খন্দকার আবু তালেব বাসায় ফেরার পথে ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা বিহারী আব্দুল হালিম তাকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়। আব্দুল হালিম মিরপুরে বাসায় পৌছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে খন্দকার আবু তালিবকে তোলে এবং তাকে কাদের মোল্লা/বিহারীদের হাতে তুলে দেয়।
আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল-২ তার মধ্যে একটি হল খন্দকার আবু তালেব হত্যার অভিযোগ।
প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ শুনানী গ্রহণ করেন আজ।
তালেব হত্যা বিষয়ে সাক্ষী, তদন্দ কর্মকতা এবং ফরমাল চার্জের গরমিল তুলে ধরে আজ ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক যে যুক্তি তুলে ধরেন তা নিম্নরূপ।
৩ নং অভিযোগ : আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জের তিন নং অভিযোগ খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে -১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নং সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নং বাস স্ট্যান্ডে পৌছার পর ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আল বদর সদস্যা, রাজাকার এবং দৃষ্কৃতকার এবং বিহারীদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে ফেলে। তারা খন্দকার আবু তালেবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়।
ফরমাল চার্জ থেকে পড়ে শোনানোর পরে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক আবু তালেবের ছেলে ৫ নং সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসানের সাক্ষ্য পড়ে শোনান।
সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান ট্রাইব্যুনালে বলেছেন- ২৫ মার্চ ইত্তেফাক অফিস গুড়িয়ে দেয়ার খবর শুনে তার পিতা খন্দকার আবু তালেব সেখানে যান তার সহকর্মীদের অবস্থা জানতে। তিনি সেখানে কিছু মৃতদেহ দেখতে পান। ২৯ মার্চ তিনি তাদের মিরপুর বাসায় আসছিলেন তার গাড়ি এবং টাকা নেয়ার জন্য। কিন্তু মিরপুর যাবার পথে ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা অবাঙ্গালী আব্দুল হালিমের সাথে দেখা হয় তার। আব্দুল হালিম তাকে পৌছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে ওঠান এবং আব্দুল কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যান। এরপর মিরপুর ১০ জল্লাদ খানায় তার পিতাকে আব্দুল কাদের মোল্লা হত্যা করে। এসময় আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে আক্তার গুন্ডা এবং আরো অবাঙ্গালী দুস্কৃতকারীরা ছিল।
সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান জেরায় জানান, তিনি তার পিতার একসময়কার সহকর্মী অ্যাডভোকেট খলিল এর কাছ থেকে শুনেছেন যে, ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা আব্দুুল হালিম তার পিতাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছে। জেরায় তিনি আরো বলেন, তাদের অবঙ্গালী ড্রাইভার নিজাম তাকে বলেছেন যে, আব্দুল হালিম তার পিতাকে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
এ ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী হলেন আব্দুল কাইউম। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি মিরপুরের বাসিন্দা এবং খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু ছিলেন। তিনি বলেছেন- ফারুক খানের (তার কলিগ) কাছে তিনি শুনেছেন যে, স্থানীয় আক্তার গুন্ডা, বিহারী এবং কাদের মোল্লা তালেব সাহেবকে হত্যা করেছে মিপুর ১০ জল্লাদ খানায়। এছাড়া তালেব সাহেবের ড্রাইভার নিজামের কাছ থেকেও তিনি শুনেছেন যে, খন্দকার আবু তালেব মিরপুরে তার বাসায় আসার পথে ইত্তেফাকের অবাঙ্গালী হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা আব্দুল হালিম তাকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয় যারা তাকে মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় হত্যা করে।
খন্দকার আবু তালেবকে ধরে নিয়ে যাওয়া বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষেরই এ বিপরীতধর্মী তথ্য তুলে ধরে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান এবং অপর সাক্ষী আব্দুল কাইউম দুজনেই বলেছেন, ইত্তেফাকের বিহারী হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা আব্দুল হালিম আবু তালিবকে বাসায় পৌছে দেয়ার নাম করে তার নিজের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায় এবং বিহারীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তিনি বলেন, তিন পক্ষের পরষ্পর বিরোধী তথ্যের কোনটা আপনারা বিশ্বাস করবেন? তাছাড়া দুজন সাক্ষীই শোনা কথা বর্ননা করেছেন। অপর দিকে জেরায় তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন আক্তার গুন্ডাম হাক্কা গুন্ডা এবং কাদের মোল্লা আবুল তালেবকে হত্যা করেছে একথা -১০ নং সাক্ষী আব্দুল কাইউম তার কাছে বলেননি।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তাছাড়া জল্লাদখানা যাদুঘর কর্তৃপক্ষের দুই ভাইবোন যথা খন্দকার আবুল আহসান এবং সখিনা বেগম তাদের পিতা আবু তালেব হত্যা বিষয়ে যে জবানবন্দী দিয়েছেন সেখানেও তারা কেউই আব্দুল কাদের মোল্লার নাম উচ্চারন করেননি। জল্লাদখানা যাদুঘর কর্তৃপক্ষও এ ঘটনা বিষয়ে উল্লেখ করেছে অবাঙ্গালী বিহারীরা আবু তালেবকে হত্যা করেছে।
কাজেই আবু তালেব হত্যা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা কোন অবস্থাতেই জড়িত নন।
আজ যুক্তি উপস্থাপনে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাককে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট শিশির মো : মনির। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ আলী চৌধুরী প্রমুখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন