বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৩

রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে জনতা হত্যা করে

মেহেদী হাসান, ৯/১০/২০১২
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ দু’জন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে।  এদের একজন  হলেন মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন । আরেকজনের নাম গোলাম মোস্তাফা।
আনোয়ার হোসেন তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর  পিরোজপুর মুক্ত হবার ২ দিন পরে দেলোয়ার শিকদার, মানিক খন্দকার এবং  শঙ্করপাশার রাজ্জাক রাজাকারকে উত্তেজিত জনতা মেরে পায়ে দড়ি বেঁধে  তাদের  ক্যাম্পে নিয়ে আসে জনতা।

মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বর্তমানে যে বিচার চলছে তাতে একটি অভিযোগ হল মাওলানা সাঈদীর নাম দেলোয়ার শিকদার ছিল।   স্বাধীনতার অনেক পরে নাম পাল্টে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীগন  ইতোপূর্বে  ট্রাইব্যুনালে প্রমানের  চেষ্টা করেছেন দেলোয়ার শিকদার নামে একজন রাজাকার ছিল এটি সত্য। তবে সে স্বাধীনতার পরপর জনরোষে নিহত হয়। কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার শিকদার এবং মাওলানা সাঈদী সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন ব্যক্তি। তাদের পিতার নামও ভিন্ন। রাষ্ট্রপক্ষের  প্রবীণ সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী জেরায়  স্বীকার করেন দেলোয়ার শিকদার জনরোষে নিহত হয়ে থাকতে পারে।  গতকাল মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বললেন দেলোয়ার হোসেনকে মেরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল জনতা।
অপর দিকে  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন গোলাম মোস্তাফ।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ  ইব্রাহীম কুট্টিকে  ১৯৭১ সালে  ৮ মে পারেরহাট  নিয়ে  মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে হত্যা করা হয়। মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী বললেন ইব্রাহীম কুট্টিকে ১ অক্টোবার তার শশুরবাড়ি নলবুনিয়ায় হত্যা করা হয়। সে মর্মে ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী  মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে যে মামলা করেছিলেন সে মামলার এজাহার  আদালতে দাখিল করা হয়। তাতে ইব্রাহীম কুট্টির হত্যাকান্ডের স্থান নলবুনিয়া এবং হত্যার তারিখ ১ অক্টোবার  উল্লেখ করেছেন তার   স্ত্রী মমতাজ বেগম।

আনোয়ার হোসেনের জবানবন্দী : আমার নাম আনোয়ার হোসেন। বয়স ৫৭ বছর। গ্রাম কদমতলা, থানা এবং জেলা পিরোজপুর। আমি বর্তমানে ব্যবসা করি। ১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাসহ  বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে পাক সেনারা নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। হাজার হাজার  নারনারী খুন করে এবং গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুকে। এ খবর ২৬ মার্চ আমরা  সকালে জানতে  পেরে আমিসহ আরো ৬/৭ জন আমাদের এম  এন এ  অ্যাডভোকেট  জনাব এনায়েত হোসেন  খান এর কাছে চলে যাই। তিনি তখন জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা বলেন, বক্তব্য শোনার জন্য আমরা আসিনি। অস্ত্র চাই। তাৎক্ষনিকভাবে এনায়েত হোসেন সাহেব উত্তেজিত জনতাসহ  ট্রেজারিতে চলে যান। সেখান থেকে বিনা বাঁধায় অস্ত্র গুলি নিয়ে সরকারি স্কুলের মাঠে  চলে যান। অস্ত্র গুলি নিজের কাছে রারেখন। তিনি  বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চান তারা  আগামীকাল সকালে আটটার আগে  একটি থালা, একটি বালিশ, একটি চাদর নিয়ে হাজির হবেন ।  ওইভাবে আমরা ২৭ মার্চ সকালে আমিসহ ২১ জন হাজির হই। আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। আমাদের  মোট ৩০ জনের   গ্রুপে  দুই জন ইনস্ট্রাক্টর ঠিক করে দেয়া হয়। এরা হলেন বরকত এবং গোলাম সরোয়ার। দুইজনই সেনাবাহিনীর সাবেক হাবিলদার ছিলেন। প্রশিক্ষনের এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ ট্রেজারি থেকে টাকা লুট করে। এই টাকা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্ত  তেরি হয় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এটা ঘটে মে  মাসের তিন তারিখ।  আমাদের গ্রুপটি নেতৃত্ব শূণ্য হয়ে পড়ে। আমি ওই দিনই বাকলে বাড়ি চলে আসি। পরের দিন মে মাসের চার তারিখ আমার বড় চাচি আমাকে বলেন, তুমি তোমার অমুক ভাইয়ের সাথে গিয়ে তোমার আপাকে নিয়ে আস। শুনতে পাচ্ছি পিরোজপুরে বড় ধরনের গন্ডগোল হবে। আমার আপার নাম ছিল আনোয়ারা বেগম। ভগ্নিপতি আব্দুস সাত্তার পূর্বে পিরোজপুর এসডিও অফিসে চাকরি করতেন। ১৯৭০ সালে ভোলায় বদলি হন এবং পরে ১৯৭১ সালে আবার বদলী হয়ে পিরোজপুরে এসডিও অফিসে হেডকার্ক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ধোপাবাড়িতে  ভাড়া বাসায় থাকতেন। আমি  এবং আমার ভাই অদুত আপার বাসাই যাই। তখন সকাল অনুমান দশটা হবে। আপাকে নেয়ার কথা বলার পর তিনি গোছগাছ শুরু করেন। এর  ৮/১০ মিনিট পরে বাইরে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি দেখতে পেয়ে আমার ভগ্নিপতি বাইরে বের হন। একটু পরে ফিরে  এসে বললেন হুলারহাট থেকে  মিলিটারি পিরোজপুর আসাতেছে। এই বলে  ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দেন এবং আমাদের বাইরে  বের হতে বারন করেন। অনুমান ১০/৫ মিনিট পরে আমরা বুটের আওয়াজ শুনতে পাই। কাঠের বেড়ার ফাক দিয়ে দেখতে পাই  অনেক মিলিটারি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে  দণি দিকে।  সামনে চারজন বাঙ্গালি ছিল যাদেরকে আমি চিনতাম। এরা হল  হুলারহাটের  আশরাফ চেয়ারম্যান, চিলার দেলোয়ার শিকদার, পিতা রসুল শিকদার, মানিক খন্দকার এবং সাত্তার মোক্তার। আমার ভগ্নিপতিও এ চারজনকে চিনতে পারেন। ৫/৭ মিনিট পরেই আমার বাসা থেকে পশ্চিম দণি দিকে বিকল গুলির শব্দ শুনতে পাই। কাঠের বেড়ার ফাক দিয়ে আগুন এবং ধোয়া দেখতে পাই। ্বরে ৮/১০ মিনিট পর আমাদের বাসার কাছে আবার বিকট গুলির শব্দ  শুনতে পাই। এরপর মিলিটারি আমাদের বাসার সামনে দিয়ে উত্তর দিকে চলে যায়। তখনো ওই চার বাঙ্গালি অগ্রভাগে ছিল। অনুমান আধাঘন্টা পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে রাস্তায় দুয়েকজনকে চলাফেরা করতে দেখে আমরা ভগ্নিপতি বের হন। প্রায় এক ঘন্টা পরে তিনি ফিরে এসে জানালেন মন্ডলপাড়ায় ১০/১২ জন এবং ধোপাপাড়ায় ৪/৫ জনকে খুন করেছে  আর্মি। মিলিটারি শহরে গিয়ে সরকারি স্কুলে ক্যাম্প করেছে। আমরা সন্ধ্যার পর আমাদের বোন, ভাইগনা ভাগ্নীদেগর নিয়ে  বাড়ি আসি।
এরপর আমরা আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকি। অনুমান আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি আমিসহ ২১ জন ভারতে যাই। আমাদের নাম তালিকাভুক্ত   করে  বিভিন্ন  এলাকায় প্রশিক্ষনের জন্য প্রস্ততি চলতে থাকে। অনুমান ১৫ দিন পরে শ্রাবন মাসের প্রথাম দিকে আমার পূর্ব প্রশিক্ষক  গোলাম সরোয়ার আমাদের ক্যাম্পে আসেন। তিনি বলেন, তোমরা কে কে এসেছ। তোমরা অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে চল। আমি ভারত সরকারের কাছ থেকে অনেক অস্ত্র সংগ্রহ করেছি। আমি ট্রেনিংয়ের প্রস্ততির কথা জানালে তিনি বলেন, তুমি তো রাইফেল ট্রেনিং পার। নতুন অস্ত্রের ট্রেনিং বাংলাদেশে গিয়ে আমি তোমাদের দেব। আমাদের ২২ জনের মধ্য থেকে ১৫ জন এবং তার সাথে  থাকা আরো ১৫ জনসহ আমরা  দেশে আসি। নাজিরপুর থানাধীন  কুমরাখালি গ্রামের মধ্যে ক্যাম্প স্থাপন করি। অনুমান শ্রাবন মাসের মাঝামাঝি রাত দশটার দিকে নাজিরপুর রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন করি।  এতে আমাদের  কমান্ডার গোলাম সরোয়ারের কপালে রাজাকারদের গুলি লাগে এবং তিনি শহীদ হন। ওই রাতেই আমরা কদম তলা চলে আসি। জুসখোলা ও কদম তলায় দুটি ক্যাম্প স্থাপন করি। কয়েকদিন পর আমরা জানতে পারি ভাগিরথী নামের এক মহিলা নিয়মিত পাক সেনাদের ক্যাম্পে যাতায়াত করে। তার বাড়ি আমাদের ইউনিয়নে বাগমারা গ্রামে। গোলাম সরোয়ার  মারা যাবার পরে সর্দার মতিউর রহমান (বর্তমানে পিরোজপুর সদর থানার চেয়ারম্যান) আমাদের কমান্ডযার নিযুক্ত হন। সর্দার মতিউর রহমান সাহেব ভাগিরথীর সাথে পরিকল্পনাক্রমে আমাদেরকে বাগমারা গ্রামে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে তিন স্থানে রাখেন।  তিনি জানান, ভাগিরথীর মাধ্যমে জেনেছি  আজ পাক সেনারা আমাদের ধরতে আসবে। আমরাও পাক সেনাদের আক্রমনের অপেক্ষায়  ছিলাম। ওই দিন বিকালে আছরের নামাজের পরে আমাদের ঘেরাওয়ের  মধ্যে এসে পড়ে পাক সেনারা। আমরা তাদের ওপর আক্রমন পরিচালনা  করি।  এতে পাক সেনারা দিশাহীন হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গুলিতে ১০/১২ জন পাক সেনা নিহত হয়। ওদের ফেলে যাওয়া ১০টি রাইফেল,   তিনটি হেলমেট, ২টি লাঠি পাই। রাস্তায় অনেক রক্ত দেখি। ওইদিনই ভাগিরথীর সন্ধান  নেয়ার পর  আমাদেরকে কমান্ডার জানালেন ভাগিরথী আজ  বাড়ি যায়নি। সে  প্রতিদিন বাড়ি ফিরত।  পরের দিন কমান্ডার  মতিউর রহমান সাহেব আমাকে এবং আমার সহযোদ্ধা আব্দুল মালেককে ভাগিরথীর সন্ধানের জন্য পিরোজপুর পাঠান ছদ্মবেসে। তার আদেশে আমি এবং মালেক পিরোজপুর গিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে পৌছামাত্র পূর্ব দিক থেকে একটি গাড়ি আসার শব্দ পাই। ২/১ মিনিট পরে দেখতে পাই আমাদের সামনে দিয়ে একজন মহিলাকে গাড়ির  পেছনে দাড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওই মহিলা বিবস্ত্র অবস্থায় ছিল এবং তার দেহ ক্ষত বিক্ষত ছিল। ওই গাড়িতে চারজন পাক আর্মি এবং একজন চালক ছিল । গাড়ি সামনে দিয়ে চলে গেলে আমরা ক্যাম্পে চলে যাই এবং কমান্ডারকে এ ঘটনা দেখার কথা জানিয়ে বলি ভাগিরথীকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর পাকিস্তানী সেনারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রতিদিন কদমতলা এবং জুসখোলা আসে। আমরা কদমতলা এবং জুসখোলা থেকে সুন্দরবন বগি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে যাই। আমাদেরকে তালতলা খালের মধ্যে ১ নং ক্যাম্পে রাখা হয়। তখন শফিউদ্দিন আহমেদ (ব্রিটিশ  আমলের  হাবিলদার) কে আমাদের কমান্ডার  নিযুক্ত করা হয়। তার নতেৃত্বে আমরা তাফালবাড়ি রাজাকার ক্যােিম্প  একটি অপারেশন পরিচালনা করি। চারজন রাজাকার ধরা পড়ে আমাদের হাতে এবং তাদের হত্যা করি আমরা।
ডিসেম্বর ৭ তারিখ কমান্ডার সাহেব আমাদের আদেশ দিলেন গোলাবারুদ, অস্ত্রসহ সবাই নৌকায় ওঠ।  অনেক মুক্তিযোদ্ধা মিলে কয়েকটি নৌকায় করে মোড়েলগঞ্জে আসি।  ডিসেম্বর ৮  তারিখ তিনি বলেন, সবাই পায়ে হেটে পিরোজপুর যাত্রা কর। পিরোজপুর আক্রমন করতে হবে।  আমাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে বিভিন্ন দিক থেকে প্রবেশের আদেশ দেন। আমাদের  গ্রুপটি পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীর অপর পারে হাজির হই। সন্ধ্যার পর সাতটা সাড়ে সাতট অনুমান এমন সমসয়  চারদিকে আনন্দ ধ্বনি শুনতে পাই। জয়বাংলা, জয় বাংলাদেশ স্লোগান শুনি। আমরা খেয়া পার হয়ে শহরে প্রবেশ করি। সরকারি স্কুলে  মিলিটারি ক্যাম্প  দখল করে  আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। তখন রাজাকারদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসতে থাকে। ২ দিন পরে দেলোয়ার শিকদার, মানিক খন্দকার, শঙ্করপাশার রাজ্জাক রাজাকারকে উত্তেজিত জনতা মেরে পায়ে দড়ি বেধে” আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়া উদ্দিন সাহেব আমাদেরকে কঠোর নির্দেশ দেন আশরাফ চেয়ারম্যান এবং সাত্তার মোক্তারকে খুজে বের করার জন্য। তাদের ধরার জন্য আমরা অনেক খোজাখুজি করি কিন্তু পাইনি। এর পর আমাদেরকে হুলারহাট ক্যাম্পে নিয়োগ দেয়া হয়। অনুমান মার্চ মাসে আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে আমি আমার লেখাপড়ায় ফিরে যাই।

জেরা : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী সাক্ষীকে জেরা করেন। ৮/১০ টি প্রশ্নের মাধ্যমে শেষ হয়ে যায় জেরা।
প্রশ্ন : মুক্তি বার্তায় আপনার নাম আছে?
উত্তর : আছে কি-না দেখিনাই। তবে জাতীয় তালিকায় আমার নাম আছে এবং সেখানে আমার নম্বর ২০। সরকারি তালিকায় আমার নম্বর ২৯২।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা ভোটর তালিকায় আপনার নাম আছে?
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : ভারতে কয়দিন ছিলেন?
উত্তর : অনুমান ১৬/১৬ দিন।
প্রশ্ন : ভাগিরথীর যে ঘটনা বললেন তা অনেক পত্রপত্রিকায় এসেছে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : যেসব ক্যাম্পের নাম বলেছেন তাও বিভিন্ন বইপত্রে এসেছে।
উত্তর :  এসেছে কি-না আমার জানা নেই।
প্রশ্ন : আপনার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের বিষয়টি কোন কাগজপত্র দ্বারা সমর্থিত নয়।
উত্তর : সত্য নয়।

৯/১০/২০১২
গোলাম মোস্তাফার জবানবন্দী : আমার নাম মোঃ গোলাম মোস্তফা, বয়স- ৬২ বছর । গ্রাম নলবুনিয়া, থানা জিয়ানগর, জেলা- পিরোজপুর। বর্তমানে আমি অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই যে, উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাবেহ আলী এবং তার মাকে  নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী  চকিদার, কালাম   চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে  গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাইকে (ইব্রাহীম কুট্টি)  মেরে ফেলেছে। আজহাল আলীর  স্ত্রী এবং ছেলেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেছে। আজাহরকেও মেরেছে। লোকজন বলল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যার সময় তার স্ত্রী মমতাজের হাতেও গুলি লাগে। মমতাজকেও  জিজ্ঞাসা করায় সেও তাই জানাল।
এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি, বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি  সাহেব আলীর মা সেতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে।  এরপর শুনেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মমতাজ বেগম তার স্বামী ও ভাই হত্যার জন্য এস.ডি.ও বরাবরে একটি মামলা দায়ের করেছে।

জেরা : রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী  সৈয়দ হায়দার আলী সাক্ষীকে জেরা করেন।
প্রশ্ন : আপনার কয় ছেলে কয় মেয়ে?
উত্তর : তিন ছেলে তিন মেয়ে।
প্রশ্ন : মেয়েদের নাম কি এবং তারা কি করে?
উত্তর : বড় দুই মেয়ে ডিগ্রী পাশ। তাদের বিয়ে হয়েছে । তারা গৃহিনী। তাদের নাম নূরজাহান বেগম এবং সুমাইয়া আক্তার।  ছোট মেয়ে এম এ, এলএলবি পাশ । সে প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকা। তার নাম তানিয়া আক্তার।
প্রশ্ন :  তানিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার বিরুদ্ধে জঙ্গি অভিযোগে মামলা হয়েছিল।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি রাজনীতির সাথে জড়িত?
উত্তর : হ্যা।  জামায়াতে ইসলামী।
প্রশ্ন : কোন পদে আছেন?
উত্তর : পিরোজপুর পৌরসভার সভাপতি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব গ্রেফতারের পর  তার মুক্তির জন্য আপনি অনেক মিটিং মিছিল করেছেন।
উত্তর : একটি মিছিলে অংশ নিয়েছি।
প্রশ্ন : ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত কয়টি মামলা হয়েছে আপনার বিরুদ্ধে ?
উত্তর : চারটি। একটি খারিজ হয়েছে।  বাকী তিনটি মামলার একটি হয়েছে পুলিশের কাজে বাঁধা দেয়ার অভিযোগে। আরেকটি পুলিশের সাথে সংঘর্ষের অভিযোগে।  এ মামলা দুটির বাদী পুলিশ। আরেকটি হয়েছে আওয়ামী লীগের এক বেকার যুবকের পকেট থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে। এ মামলায় আসামী আমিসহ ৪১ জন।
প্রশ্ন : আপনি  সাঈদী সাহেবে নির্বাচনে আর্থিক সহায়তা করেছেন?
উত্তর : আমি ২০০৯ সালে জামায়াতে যোগ দেই।
প্রশ্ন : ২০০৮ সালে আপপনি ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন সাঈদী সাহেবকে নির্বাচনের জন্য।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন :  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও আপনি স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন
উত্তর : সত্য নয়। আমাদের বাড়িতে পাড়েরহাটের বেনিমাধব সাহাদের পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী  মমতাজ বেগম তার স্বামী এবং ভাই হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালে যে মামলা করেন সে মামলার এজাহার আদালতে উপস্থাপন করেন আসামী পক্ষ। মামলার এ এজাহারকে জাল এবং মামলার প্রয়োজনে তৈরি করা হয়েছে মর্মে সাজেশন দেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোটেক মিজানুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনসারী প্রমুখ  আইনজীবী  উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে নবম সাক্ষীর জবানবন্দী

মেহেদী হাসান, ৭/১০/২০১২, রোববার
আজ  সকালে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে হাজির করা নবম সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, আমারনাম হেমায়েত উদ্দিন। বয়স ৬৪ বছর। আমার গ্রাম টেংরাখালী, থানা-জিয়ানগর, জেলা-পিরোজপুর। আমি মুদি মালের দোকানদারী করি। ১৯৭১ সালেও আমি মুদি মালের দোকানদারী করতাম। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১১ বৎসর আগে আমার মা মারা যায়। তখন আমার বয়স ছিল ১২ বৎসর। মা মারা যাওয়ার পরের দিন আমার ১০ বছর বয়স্ক ছোট বোন মারা যায়। মা মারা যাওয়ার সময় আমার তিন চার মাস বয়সের এক ছোট ভাই রেখে যায়। আমার বাড়ির উপরে এক চাচী আমাদের লালন পালন করে।

স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে জৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি কি শেষের দিকে হবে আমার পার্শ্ববর্তী উমেদপুর গ্রামে আমার চাচীর বাবার বাড়ি সেখানে সে বেড়াতে যাওয়ার পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই খবর পেয়ে আমি একদিন বিকালে চাচীকে সেই বাড়িতে দেখতে যাই। ঐ দিন বিকালে চাচী আর আমাকে আসতে দেয়নি। পরের দিন সকাল সাড়ে নয়টা কি পৌনে দশটা বাঁজে মানুষ চেচামেচি করতেছে পাক সেনারা আসতেছে পাক সেনারা আসতেছে বলে। আমি তখন ঐ ঘর থেকে বের হয়ে আমার সঙ্গে থাকা আফজাল, লতিফ, নুরুল ইসলাম ও অন্যান্য কয়েকজনসহ বাড়িরপূর্ব পার্শ্বে বাগানে গিয়ে দাড়াই। সেখান থেকে দেখতে পাই ১৫/১৬ জন পাক সেনা সাথে মুসলেম মাওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকান্দার সিকদার, আসমত আলী মুন্সী, গণিগাজী, রাজ্জাক, মহসিন, মমিন এরা সবাই উমেদপুর হিন্দু পাড়ায় ঢুকে। কিছু পরেই ঐ বাড়ি থেকে আগুন দেখতে পাই। ১৫/১৬ মিনিট পরে পাক সেনা ও তাদের সাথের লোকজন একজন লোককে ধরে নিয়ে পশ্চিমদিকে বের হয়। আমার সাথে থাকা আফজাল বলে বিশাবালীকে ধরে নিয়ে গেছে। বিশাবালীকে নিয়ে তারা মাঠের উত্তর দিকে হোগলাবুনিয়া হিন্দু পাড়ায় যায়। কিছুক্ষণপরে ঐ হিন্দু পাড়ায় আগুন দেখতে পাই। ঐ খানে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আমি বাড়ি চলে আসি। বিকালে দোকানে গেলে সংবাদ শুনি ১০/১২ টি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। বিশাবালীসহ হোগলাবুনিয়া গ্রাম থেকে আরো ৪/৫ জন হিন্দুকে ধরে নিয়ে গেছে। এর পরের দিন বিকালে দোকানে বসে শুনি হোগলাবুনিয়া গ্রাম থেকে যে ৪/৫ জনকে ধরে নিয়েগিয়ে ছিলতাদেরকে পিরোজপুর বলেশ্বর নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়।



মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অষ্টম সাক্ষীর জবানবন্দী

মেহেদী হাসান, ৪/১০/২০১২, বৃহষ্পতিবার
আজ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে অষ্টম সাক্ষীর  জবানবন্দী এবং জেরা  শেষ হল। জবানবন্দী শেষে তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম,  তাজুল ইসলাম,   ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমীন, মনজুর আহমদ আনসারী প্রমুখ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

জবানবন্দী :
আমারনাম মোঃ কোবাদ আলী । বয়স ৬৯ বছর । আমার গ্রাম মহিরন, থানা- বাঘারপাড়া, জেলা-যশোর। আমি কৃষিকাজ করি। ১৯৭১ সালে আমি কৃষি কাজ করতাম। ১৯৬৯/৭০ সালে মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন   সাঈদী সাহেব যশোর নিউটাউনে বাসাভাড়া করে থাকতেন এবং তিনি যশোর জেলার বিভিন্নএলাকায় মাহফিল করতেন। ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট হতে পাক সেনারা যশোর টাউনের উপরে শেল মারা শুরু করে। তখন টাউনের লোক গ্রামেআশ্রয় নেয় ভয়ে। মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব ও বাসা ছেড়ে আমাদের মহিরন গ্রামে মরহুম সদরউদ্দিন সাহেবেরবাড়িতে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে আশ্রয় নেন। ঐ বাড়িতে ১৫ দিন থাকার পর পীর সাহেব হুজুরের অনুরোধে দোহাকোলার রওশন সাহেব খুশি মনে উনাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায় মে মাসের শুরুতে। ওখানে আড়াই মাসেরমত থাকার পরে দেলোয়ার হোসাইন ন সাঈদী সাহেব জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে দেশের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
জেরা : আপনার এলাকায় সাঈদী সাহেবকে কতবার দেখেছেন?
উত্তর : বহুবার গেছেন।
প্রশ্ন : যতবার উনি গেচেন ততবার আপনি ওনার সাথে থাকতেন?
উত্তর :  দূরে গেলে যেতামনা।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি সবসময় যেতেন?
উত্তর :   মাঝে মাঝে।
প্রশ্ন : কি কারনে যেতেন?
উত্তর : প্রতিবেশি হিসেবে।
প্রশ্ন : সাঈদী  সাহেবের যশোরের বাড়ি  যেতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনারা এলাকায় অন্যান্য যারা ওয়াজ মাহফিল করতে  আসতেন তাদের সবার সাথেও আপনি থাকতেন?
উত্তর : পরিচয় থাকলে যেতাম।
প্রশ্ন : যাদের চিনতেন তাদের দুয়েকজনের নাম বলেন।
উত্তর : মাওলানা গোলাম রসুল, গোলাম মোস্তফা,  আবু সাঈদ।
প্রশ্ন : এরা কোথায় থাকত তা জানেন?
উত্তর : এদের বাড়ি আমাদের এলাকার দ’ুচার মাইল দূরে।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াত করেন। সে কারনে জামায়াত নেতা সাঈদী সাহেবের পক্ষে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সপ্তম সাক্ষীর জেরা শেষ

মেহেদী হাসান, ৩/১০/২০১২, বুধবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষের সপ্তম সাক্ষী জামাল হোসেন ফকিরের  জেরা শেষ হয়েছে। জামাল হোসেন ফকির গত মঙ্গলবার জবানবন্দী প্রদান করেন । তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার  আলী।

জেরা :
প্রশ্ন  : নলবুনিয়ায় কয়টা হাওলাদার বাড়ি আছে?
উত্তর : ২টি।
প্রশ্ন : ফকির বাড়ি কয়টা?
উত্তর : ২টি। একই বংশের তারা।
প্রশ্ন : আপনার আব্বা ওই সময় (১৯৭১) কি করতেন?
উত্তর : জমাজমি চাষাবাদ করতেন।
প্রশ্ন :  বড়শির মাছ কখন তুলতে যান?
উত্তর : ফজরের আজানের আগে।
প্রশ্ন : লেখাপড়া কিছু করেছেন?
উত্তর : সামান্য কিছু করেছি। নাম দস্তখত করতে পারি । কোরআন শরিফ খতম করেছি।
প্রশ্ন : আপনারা কয়ভাই।
উত্তর : ২ ভাই ২ বোন।
প্রশ্ন : বড় কে?
উত্তর : ভাই, নুরুল ইসলাম।
প্রশ্ন : বয়সে নুরুল ইসলাম বড় না  কুট্টি বড়?
উত্তর : সমবয়সী।
প্রশ্ন : প্রাইমারিতে কবে ভর্তি হন?
উত্তর : ৫/৬ বছর বয়সে খুব সম্ভবত।
প্রশ্ন :  এ মামলায় সাক্ষী দেয়ার কথা কবে শুনলেন?
উত্তর : এক বছর  দুই তিন মাস আগে।
প্রশ্ন : তখন কি আপনার নাম, পিতার নাম লিখে দিয়েছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আইডি কার্ড দেখিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাথে আনছেন?
উত্তর : না। ভোটার লিস্ট আনছি।
প্রশ্ন : ভোটার লিস্টে ছবি আছে আপনার?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আতহার আলী হাওলাদারকে চিনতেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় সে কি করত?
উত্তর : বাড়ি থাকত।
প্রশ্ন : সে কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষের লোক ছিল?
উত্তর : পক্ষে।
প্রশ্ন : সে পিস কমিটির  লোক ছিল?
উত্তর : থাকতে পারে।
প্রশ্ন : আপনি যখন আজহার হাওলাদারের বাড়ি গেলেন তখন আতহার আলী কোথায় ছিল?
উত্তর : তাকে ওই দিন দেখিনি সেখানে।
প্রশ্ন : আজহার এবং আতাহারের একই বাড়ি।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : সাহেব আলী এবং তার মাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখনতো আপনি তা দেখেননি।
উত্তর : দেখেছি।
প্রশ্ন : কখন দেখেছেন?
উত্তর : ফজরের পর যখন পরিস্কার হয় তখন দেখেছি। 
প্রশ্ন  : ওই বাড়িতে তখন কি পরিমান আর্মি এবং রাজাকার ছিল?
উত্তর : আর্মি নয় শুধু রাজাকাররা এসেছিল।
প্রশ্ন : সাহেব আলী এবং তার মাকে যারা ধরে নিয়ে গেল তারা রাজাকার ছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : পাড়েরহাটের সব রাজাকারকে চেনেন?
উত্তর : সবাইকে চিনিনা। দুই চার জনকে চিনি।
প্রশ্ন : নলবুনিয়া থেকে পাড়েরহাট ভাটিতে না উজানে?
উত্তর : ভাটিতে।
প্রশ্ন : নলবুনিয়া থেকে পিরোজপুর ভাটিতে না উজানে?
উত্তর : ভাটিতে নেমে পরে জোয়ার দিয়ে উঠতে হয়।
প্রশ্ন : শ্রাবন মাসে খাল বিলে পানি থাকে?
উত্তর : থাকে।
প্রশ্ন : বাংলা কোন মাসের সময় ইংরেজি কোন মাস হয় তা বলতে পারবেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ওই ঘটনা কি আপনি লিখে রেখেছিলেন?
উত্তর : এ ঘটনা এলাকার সব মানুষ জানে। লিখে রাখিনি।
প্রশ্ন : রানী বেগম আপনার ফুফু হয়?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মোস্তফা আপনার ছোট না বড়?
উত্তর : ছোট।
প্রশ্ন : সিতারা বেগম, রানী বেগম, মোস্তফা  এই মামলায় তদন্ত  কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন তা জানেন?
উত্তর : দিতে পারে। আমি জানিনা।
প্রশ্ন : পাকিস্তান আমলে চিথলিয়ায় দুজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন  জানেন?
উত্তর : জানি। সইজুদ্দিন  এবং রইজুদ্দিন পসারী।
প্রশ্ন : সংগ্রামের সময় চিথলিয়া বাদুরার অনেক বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয় তা জানেন?
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : রইজুদ্দিন সুইজুদ্দিন পসারী কি স্বাধীনতার পক্ষের লোক ছিলেন?
উত্তর : পক্ষের।
প্রশ্ন : ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নলবুনিয়া থেকে নিয়ে যাবার যে কথা আপনি বলেছেন তা সত্য নয়।
উত্তর : সতই বলেছি।
প্রশ্ন : আপনার নাম কয়টা?
উত্তর : একটাই।
প্রশ্ন : কি?
উত্তর : জামাল হোসেন ফকির।
প্রশ্ন : জন্ম নিবন্ধন করেছেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : সাথে আনছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন :ধ আপনার বয়স প্রমানের জন্য এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বারের কাছ থেকে  কোন সার্টিফিকেট আনছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন :  চেয়ারম্যান মেম্বার থেকে আপনার পরিচয়পত্র এনেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি এখানে আপনার যে বয়স উল্লেখ করেছেন তা সঠিক নয়। ১৯৭১ সালে আপনি একেবারেই নাবালক ছিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই তিন মাস পরে বাংলা কোন মাস ছিল?
উত্তর : আষাঢ়  মাস।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই তিন মাস পরে পাকিস্তান আর্মি এবং রাজাকাররা সাহেব আলী এবং তার মাকে অপহরন করে নিয়ে যায় কি-না?
উত্তর : পাকিস্তান আর্মি নয় রাজাকাররা তাদের নিয়ে যায়। আর মুক্তিযুদ্ধ  শুরুর দুই তিন মাস পরে নয় আশ্নিন মাসে নিয়ে যায়।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মনজরু আহমদ আনসারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যাকান্ডের বিবরন দিলেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী

মেহেদী হাসান, ২/১০/২০১২ , মঙ্গলবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ  সপ্তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য  দিলেন  পিরোজপুরের নলবুনিয়ার জামাল হোসেন  ফকির। তিনি আলোচিত ইব্রাহিম কুট্টি হত্যাকান্ডের বিবরন তুলে ধরে জবানবন্দী প্রদান করেন।

জবানবন্দী : আমার নাম জামাল হোসেন ফকির, বয়স-৬০ বছর। আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার নলবুনিয়া গ্রামে অবস্থিত। আমি জমাজমি চাষাবাদ করি এবং মাঝে মধ্যে মাছ ধরি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি একই কাজ করতাম। আমাদের দেশে আশ্বিন মাসে খালে বিলে প্রচুর পানি থাকে।  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাত্রের প্রথম ভাগে বিলে বড়শি পেতে আসি। রাত্রের শেষ ভাগে আমি নৌকা নিয়ে বড়শি তুলে বাড়ির কাছাকাছি আসলে বিশাল একটা শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শুনে আমি খেয়াল করি আমার পাশ লাগানো আজহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে কান্নাকাটির শব্দ শোনা যায়। আমি ঘরে চলে আসি। আমার আব্বা বলেন, আজহার মামার বাড়ি বড় একটা শব্দ শোনা গেছে এবং কান্নাকাটিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে । চলো গিয়ে দেখে আসি। আজহার আলীর বাড়ির উঠানের মাঝ বরাবর পূর্ব দিকের গাছের আড়ালে গিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ আইয়ুব আলী চৌকিদার, কালাম চৌকিদার, হাকিম মুন্সি, মান্নান ও আশরাফ আলী খালের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তার পিছে দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, মোসলেম মওলানা, রুহুল আমিন, মোমিনরা মিলে সাহবে আলীকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে তার মাকেসহ পাড়েরহাটে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নৌকায় তুলে পাড়েরহাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সাহেব আলীদের ঘরে চলে আসি। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেছে এবং তার হাত দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। তার বোন রানী বেগম মমতাজের হাত বেঁধে দিচ্ছে দেখি। তখন আমি ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফুফু তোমার কি হয়েছে? তখন মমতাজ বেগম উত্তর দেয় যে গুলিতে ইব্রাহিম কুট্টি মারা গেছে সেই গুলি তার হাতেও লেগেছে, লাঠি দিয়ে তার আব্বার গায়েও আঘাত করেছে। ঐখানে তখন পাড়া প্রতিবেশী অনেক লোকজন জমায়েত হয়। আমরা বাড়িতে চলে যাই। বিকালে শুনতে পাই যে, সাহেব আলী ও তার আম্মাকে পিরোজপুরে নিয়ে গেছে। ইব্রাহিম কুট্টির লাশ পাড়েরহাট বাদুরা পোলের সাথে নৌকায় বেঁধে রেখেছে। তারপরদিন বেলা এগারোটার দিকে শুনতে পাই যে, সাহেব আলীর আম্মা বাড়িতে ফিরেছে। তারপর আমরা তাদের বাড়িতে যাই। জিজ্ঞাসা করি বুয়া (সাহেব আলীর আম্মা) আপনি এসেছেন, সাহেব আলী চাচা কৈ। তারপর সে বলে যে, পিরোজপুর নিয়া সাহেব আলীকে মিলিটারীরা গুলি  করে মারছে।  এর কিছুদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীনের পাঁচ/ছয় মাস পর মমতাজ বেগম ভাই এবং স্বামী হত্যার মামলা করে।

ইব্রাহীম  কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী যা বলেছেন :
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে  বর্তমানে বিচার চলছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হল ইব্রাহীম কুট্টিকে  হত্যা।  রাষ্ট্রপক্ষের   বেশ কয়েকজন সাক্ষী মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার যে  বিবরন দিয়েছেন সে অনুযায়ী  ইব্রাহীম কুট্টিকে   মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে পাক আর্মি ১৯৭১ সালের ৮ মে পারেরহাট বাজারে  গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মানিক পসারী, সুলতান হাওলাদার, মফিজ, মোস্তফা হাওলাদারসহ অনেকে এ  ঘটনার চাুস সাক্ষী হিসেবে নিজেদের উপস্থান করেন।

কিন্তু  আজ  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সপ্তম সাক্ষী জামাল হোসেন ফকির সাক্ষ্য দিয়ে বললেন ১৯৭১ সালের আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি ইব্রাহীম কুট্টিকে নলবুনিয়ায় তার  শশুরবাড়িতে হত্যা করা হয়। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি তারিখ ইংরেজি সেপ্টেম্বরের শেষ অথবা অক্টোবরের শুরু হয়। দুই পক্ষের সাক্ষীর বর্ননায় ঘটনার তারিখ এবং  স্থানের কোন মিল নেই।

গত ২৭ ডিসেম্বর আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় মানিক পসারী  ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার বিবরন দিয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে ৮ মে পাক সেনাবাহিনী নিয়ে দেলোয়ার শিকদার বর্তমানে সাঈদী, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, রেজাকার  মবিন, হাকিম কারী, সোবহান মাওলানাসহ আরো অনেকে রেজাকার আমার বাড়িতে   প্রবেশ করে। তাদের আসতে দেখে আমি বাড়ির  পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি এবং সব ঘটনা  দেখতে  থাকি। তারা আমার বাড়িতে প্রবেশ করে আমার ফুফাত ভাই মফিজ উদ্দিন (  বাড়িতে কাজ করত)  এবং অপর কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে আর্মিরা ধরে একই দড়িতে বাঁধে। তারপর ঘরে লুটপাট করে সোনাদানা দেলু শিকদার, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা নিয়ে যায়। লুটের পর দেলোয়ার শিকদারের (একেই বর্তমান সাঈদী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি)  নেতৃত্বে  রাজাকার বাহিনী ঘরে  কেরোসিন   ছিটায়। তারপর দেলোয়ার শিকদার ঘরে আগন ধরিয়ে দেয়।  মফিজ ও ইব্রাহিম কুট্টিকে  বেঁধে পারেরহাট নিয়ে যাবার সময় আমি তাদের পেছনে পেছনে যেতে থাকি। তাকে পারের  হাট বাজারের মধ্যে  ব্রিজের ওপারে নিয়ে গেলে আমি  এপারে বসে তাদের লক্ষ্য করি। দেলোয়ার  হোসেন শিকদারকে আর্মির সাথে পরামর্শ করতে দেখি। তারপর দেলোয়ার হোসেন শিকদার, সেকেন্দার শিকদারের সাথে পরামর্শক্রমে পাক আর্মিরা  ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে। ইব্রাহিম চিৎকার মারে। তারপর লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

ইব্রাহিক কুট্টিকে মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে   ধরে এবং তারই নির্দেশে হত্যার বিষয়ে এর আগে গত ২১  ডিসেম্বর আদালতে সাক্ষ্য দেন চতুর্থ সাক্ষী সুলতান আহমদ হাওলাদার। তিনিও  ইব্রাহিম কুট্টির হত্যার বিষয়ে  মানিক পসারীর মত ঘটনার বিবরন দিয়ে বলেন, মানিক পসারীর  বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখি দানেশ আলী মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন  শিকদার বর্তমান সাঈদী, মোসলেম মাওলানাসহ অনেক রাজাকার বাহিনী  মানিক পসারীর  কর্মচারী ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাজারের দিকে। আমি তাদের পিছু পিছু  যেতে থাকি। বাজারের ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম দিকে যাবার পর আমি এপার বসে  থাকি। উত্তর দিকে থানার ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবার পর  দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদী সাহেব পাক আর্মির সাথে কি যেন বলাবলি করছে দেখতে পাই। তখনই বিকট  গুলির শব্দ এবং চিৎকার শুনতে পাই।     এরপর   ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর পরের দিন শুনতে পাই মানিক পসারীর বাড়ির কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
ঠিক একইভাবে ইব্রাহীমের সাথে ধরে নিয়ে যাওয়া  এবং পরে  নির্যাতনের শীকার হয়ে পালিয়ে আসা মফিজ, অপর মোস্তফা হাওলাদারও  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিবরন  দিয়ে বলেন, ৮ মে পারেরহাটে তাকে  হত্যা করা হয়।

মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা আদালতে তথ্য প্রমান উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন ইব্রাহীম কুট্টি পারের হাট বাজারে ৮ মে নিহত হননি। তিনি তার শ্বশুর বাড়িতে  থাকা অবস্থায় ১ অক্টোবর  ১৯৭১ সালে  নিহত হন । ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুর  আদালতে ১৩  জনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।  ১৩ জন আসামীর মধ্যে মাওলানা  দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম নেই।  মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর  তিনি তার বাপেরবাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায়  তাদেরই বাড়িদে তার স্বামী ইব্রাহীম  কুট্টিকে হত্যা করা হয।

মমতাজ বেগম তার স্বামীর হত্যা মামলায় যাদের আসামী করেছেন তারা হলেন, দানেশ মোল্লা,  আতাহার আল, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী কালাম চৌধুরী, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা।  আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। যারা আসামী তাদের প্রায় সকলেই কুখ্যাত রাজাকার এবং পিস কমিটির নেতা ছিল বলে স্বাীকার করেছেন  মাওলানা সাঈদীর  বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে আসা সাক্ষীরা।


জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাঈদী সাহেব আমাদের বাড়ি ছিলেন

মেহেদী হাসান, ২৪/৯/২০১২ , সোমবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ  সোমবার  যশোরের রওশন আলী ৬ষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী প্রদান করেন।  রওশন আলী বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাঈদী সাহেব যশোরের বাঘারপাড়ায়  তাদের বাড়ি ছিলেন । এরপর তিনি তার পিরোজপুর গ্রামের বাড়ি চলে যান।

জবানবন্দী :
আমার নাম রওশন আলী। পিতা সুফী দাউদ আলী বিশ্বাস। মাতা সালেহা খাতুন।  আমার বয়স ৬১/৬২ বছর। গ্রাম দোহাকোলা, থানা বাঘারপাড়া, যশোর। আমি আমার বাগান পরিচর্যা করি, ক্ষেত খামার যা আছে তা দেখাশুনা করি। ১৯৭১ সালেও আমি তাই করতাম। আমি আজ এখানে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এসেছি।

১৯৬৯/৭০ সালে আমাদের এলাকায় সাঈদী সাহেব অনেক ধর্মসভা করেছেন। সে ধর্মসভার মাধ্যমে ওনার সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি তখন যশোর নিউটাউনে ভাড়া থাকতেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন পাকিস্তানী সেনারা গুলিগোলা মারতে  শুরু করল তখন শহরের লোকজন গ্রামে আশ্রয় নেয়। সাঈদী সাহেব তার পরিবারসহ বাঘারপাড়ার মহিরন গ্রামের পীর সদরুদ্দীন সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ওখানে সাঈদী সাহেব দুই সপ্তাহ থাকার পর হুজুর আমাকে খবর দেন। সেই খবরে আমি পীর সাহেবের বাড়িতে যাই। পীর সাহেব হুজুর আমাকে বললেন তাদের বাড়িতে সদস্য সংখ্যা অনেক। তারও কিছু আত্মীয় স্বজন ঢাকা থেকে এসেছেন তাদের বাড়িতে। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন  আমি যেন সাঈদী সাহেবকে স্বপরিবারে আমাদের বাড়িতে নিয়ে  রাখার ব্যবস্থা করি। তিনিও (সাঈদী সাহেব) এখানে কষ্ট পাচ্ছেন। মে মাসের প্রথম দিকে তাকে স্বপরিবারে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। আড়াই মাসের মত সাঈদী সাহেব আমার বাড়িতে থাকেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিনি তার গ্রামের বাড়ি চলে যান।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পূর্বে সাক্ষীরা যা বলেছেন : মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজার, উমেদপুর, নলবুনিয়া, চিথলিয়া, মাছিমপুর, ধোপাপাড়সহ  বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় যেসব হত্যা, গনহত্যা,  লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে তা মূলত  ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে   জুলাই মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে।  এ সময়ের মধ্যেই  হুমায়ুন আহমেদের পিতা ফয়জুর রহমানসহ তিনজন সরকারি  কর্মকর্তাকে বলেশ্বর নদীর ঘাটে নিয়ে হত্যা, ইব্রাহিম কুট্টি, বিশাবালী হত্যাসহ  বিভিন্ন হিন্দু এলাকায় গনহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন,  অথচ আজকের  (সোমবার) সাক্ষী  রওশন আলীর জবানবন্দী অনুযায়ী সাঈদী সাহেব তখন পিরোজপুরেই ছিলেননা।

মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার, দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন বলেছিলেন, ৭ মে পারেরহাট  পাকিস্তান আর্মি আসে । মাওলানা সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য শান্তি কমিটির লোকজন তাদের অভ্যর্থনা জানায় পারেরহাট রিক্সাস্ট্যান্ডে। এরপর পারেরহাটে হিন্দু এবং আওযামী লীগের দোকানপাট লুটপাট করে। অন্য আরো অনেক সাক্ষী বলেছেন, মাওলানা সাঈদী অংশ নেন সে লুটপাটে।
ষষ্ঠ সাক্ষী মানিক পসারী বলেছেন ৮ মে সাঈদী সাহেবসহ অন্যান্য লোকজন তাদের বাড়িতে লুটপাট করে আগুন দেয়। তাদের বাড়ির লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাটে ঐদিন হত্যা করা হয়। এছাড়া ৪ মে মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে ২০ জনকে  হত্যা, হিন্দু পাড়ায় ১৩ জনকে হত্যা,  কালিবাড়ি,  শিকারপাড়া, ডুমুর তলা, কদমতলা, নবাবপুরসহ বিভিন্ন   এলাকায় লুটপাট আগুন দেয়া,  ২রা জুন উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় ২৫/৩০টি বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন দেয়া, বিশাবালীকে নারকেল   গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা, মামলার বাদী মাহবুবুল আলমের বাড়ি লুটপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে ।
আজ  জবানবন্দী শেষে সাক্ষী রওশন আলীকে  জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী ।

জেরা :
জেরা : সাঈদী সাহেব যকন আপনাদের বাড়িতে ছিলেন তখন  তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা কত ছিল?
উত্তর : ২ ছেলে, স্ত্রী এবং একজন কাজের লোক।
প্রশ্ন : কাজের লোকের নাম?
উত্তর : মাছি।
প্রশ্ন : তার বাড়ি?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : তার বয়স?
উত্তর : আট নয় হবে।
প্রশ্ন : আপনি আপনার বাড়িতে তখন কত লোক আশ্রয় দিয়েছিলেন?
উত্তর : আগে আমার মামা, খালা ছিলেন। সাঈদী সাহেব যখন ছিলেন তখন আমার খালা ছিলেন।
প্রশ্ন : সাঈদী  সাহেবের ছোট ছেলের বয়স তখন কত ছিল?
উত্তর : বুকের দুধ খেত।
প্রশ্ন : আজ ছাড়া আর কয় মামলায় আপনি সাক্ষ্য দিয়েছেন?
উত্তর : আজ ছাড়া জীবনে আর কোন দিন কোন মামলায় সাক্ষী দেইনি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব আপনার কোন আত্মীয় হয়?
উত্তর : না। ধর্মসভার মাধ্যমে পরিচয়।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বাড়ি গেছেন?
উত্তর : বরিশাল বাড়ি যাইনি। ১৯৭৩ সালে খুলনার বাড়ি গেছি।
প্রশ্ন :  মাঝে মাঝে সেখানে গেছেন?
উত্তর : ১৯৮০ সাল পর্যন্ত গেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সাঈদী সাহেব  গ্রেফতার হয়েছে একথা শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি একবার গ্রেফতার হয়েছেন।
প্রশ্ন : কারণ জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের মোট ছেলে মেয়ে কয়জন?
উত্তর : চার ছেলে।
প্রশ্ন : গ্রামের বাড়িতে তার কি পরিমান বিষয়  সম্পত্তি আছে জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব কি পরিমান লেখাপড়া করেছেন জানা আছে?
উত্তর : না। উনি যখন আমাদের বাড়ি ছিলেন তখন আমিও জিজ্ঞাসা করিনি তিনিও বলেননি।
প্রশ্ন : সদরুদ্দীন পীর সাহেব জীবিত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তার ছেলেরা জীবিত?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার বড় ছেলের বয়স কতদ হবে?
উত্তর : ৪৫  অনুমান।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বয়স কত ছিল তখন?
উত্তর : আমার অনেক বড় ছিলেন।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের আশপাশের বাড়ির দুচারজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : মোখলেছুর, কোবাত আলী, গোলাম মওলা, আশরাফ আলী, মৌলভী এমরান।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি আপনার বাড়ি থেকে  কতদূর?
উত্তর : অনুমান ২ কিলোমিটার।
প্রশ্ন : পীর সাহেব আপনার আত্মীয়?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাই?
উত্তর : ৫ ভাই।
প্রশ্ন : বয়সসহ ভাইদের নাম বলেন।
উত্তর : বড় ভাই গোলাম রব্বানী। সে আমার ২/৩ বছরের বড়। তারপর আমি। এরপর আমার ছোট তিনভাই হলেন, হাফিজুর রহমান, খলিলুর রহমান এবং আব্দুল জলিল। তাদের প্রত্যেকের বয়সের ব্যবধান ২/৩ বছরের হবে।
প্রশ্ন : এ মামলা সম্পর্কে কবে জানলেন?
উত্তর : এক বছর আগে।
প্রশ্ন : কার কাছ থেকে জানলেন?
উত্তর : রাফিক সাঈদী।
প্রশ্ন : রাফিক সাহেবের কাছ থেকে জানার আগে  অন্য কেউ আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিল?
উত্তর : ট্রাইব্যুনাল থেকে গিয়েছিল জানার জন্য।
প্রশ্ন : কতদিন আগে?
উত্তর : রাফিক সাহেবের কাছ থেকে জানার ২/৩ মাস আগে।
প্রশ্ন : কতজন লোক ছিল?
উত্তর : বাঘারপাড়ার থানার ওসি, এলাকার গণ্যমান্য লোকজনসহ ৪০ জনের মত হবে।
প্রশ্ন : তারা গিয়ে কি করল?
উত্তর : সাঈদী সাহেবের সাথে আমার পরিচয় কিভাবে, তিনি কখন এখানে ছিলেন, কখন গেলেন এসব জানতে চান।
প্রশ্ন : গণ্যমান্য দুয়েকজনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ, বাঘারপাড়া থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার শহীদুল্লাহ, বাঘারপাড়া মহিলা কলেজের প্রফেসর আব্দুর রউফ।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ সে বিষয়ে তারা কিছু  বলেছেন?
উত্তর : তা বলেনি।
প্রশ্ন : আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
উত্তর : ফোর ফাইভ।
প্রশ্ন : বাংলা পত্রিকা পড়েন?
উত্তর : পড়ি।
প্রশ্ন : পত্রিকা পড়ে অভিযোগ সম্পর্কে কি জেনেছেন?
উত্তর : যুদ্ধাপরাধের কথা শুনেছি, ঘরবাড়ি জ্বালানো, নারী ধর্ষণ, মানুষ হত্যা ইত্যাদি অভিযোগের কথা  জেনেছি।
প্রশ্ন : ২০০১, ২০০৪, ২০১১ এসময় পত্রিকা পড়তেন?
উত্তর : নিয়মিত পত্রিকা পড়িনি।
প্রশ্ন : এ মামলার আগেও তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের বিষয় পেপারে আসত।
উত্তর : আসতে পারে। আমি পড়িনি।
প্রশ্ন : এ ধরনের অভিযোগ সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে আছে এবং লোকজন তা বলাবলি করত তা  শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব যখন নির্বাচন করেন তখন পিরোজপুর গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তদন্ত কমকর্তা কোন মাসে গিয়েছিল তা মনে আছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তারা কোন অফিস থেকে গিয়েছিল তা পরে খোঁজ নিয়েছেন?
উত্তর : না। তানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার পরে বলেছেন তারা ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছেন।
প্রশ্ন : ১৯৭০ সালে ভোটার ছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তখন মিটিংয়ে যেতেন?
উত্তর : বাঘারপাড়া প্রপারে মিটিং হলে যেতাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের শেষে পীর সাহেব কোথায় ছিলেন?
উত্তর : বাড়িতে।
প্রশ্ন : যারা আপনার এলাকায় ধর্মসভা করতে যেত তাদের সবাইকে আপনি চিনতেন?
উত্তর : প্রায় সবাইকে চিনতাম।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের যশোরের বাসায়  গেছেন?.
উত্তর : ২ বার দাওয়াত দিতে গিয়েছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার এলাকায় রাজাকার, শান্তি কমিটির লোকজন ছিল?
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : ২/৪ জনের নাম বলতে পারবেন?
উত্তর : জবেদ আলী, খালেক মোল্লা, ইউসুফ আলী।
প্রশ্ন :  আপনার পরের ভাই হাফিজুর রহমান কবে বিয়ে করেন?
উত্তর : সে বিয়ে করেনি। চিরকুমার।
প্রশ্ন :  অন্য ভাইরা কবে বিয়ে করেন বলতে পারবেন?
উত্তর : লেখা আছে। না দেখে বলতে পারবনা।
প্রশ্ন : পীর সাহেবের বাড়ি এবং আপনার বাড়ির মাঝে  তখন আর কোন বড় বাড়ি ছিলনা।
উত্তর : ছিলননা।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কি করতেন?
উত্তর : সাব  পোস্ট মাস্টার ছিলেন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি বিপক্ষে কাজ  করেছেন।
উত্তর : জি না। পক্ষে কাজ করেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের আগেও আপনি স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষে কাজ করেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : বর্তমানে আপনি জামায়াতের সাথে জড়িত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব কখনো আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় নেননি।
প্রশ্ন : সত্য নয়।
প্রশ্ন : তিনি মুক্তিযুদ্ধ শেষে পিরোজপুর থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াত করেন। সে কারনে জামায়াত নেতা   সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন।
উত্তর : সত্য নয়।
তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে গতকাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না সোহাগ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আরেক সাক্ষীর জেরা শেষ

মেহেদী হাসান, ১৯/৯/২০১২, বুধবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর  পক্ষে আরেক সাক্ষীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। তার নাম নুরুল হক হাওলাদার। তিনি গত ১০ সেপ্টম্বর মাওলানা সাঈদীর পক্ষে জবানবন্দী প্রদান করেন। সেদিন তার আংশিক জেরা হয়। এরপর অসুস্থতার কারনে তার জেরা মুলতবি ছিল। আজ  তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী। এ নিয়ে  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মোট পাঁচজন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ এবং জেরা সম্পন্ন হল।

জেরা :
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাই?
উত্তর : তিন ভাই।
প্রশ্ন : তাদের নাম বলবেন?
উত্তর :  মোঃ শামসুল হক হাওলাদার,  মোঃ মোজাম্মেল হক হাওলাদার এবং আমি।
প্রশ্ন : অন্য দুজন কি আপনার বড় ?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মোজাম্মেল হকের কয় ছেলে?
উত্তর : চার।
প্রশ্ন : তাদের নাম?
উত্তর :  শাহে আলম, শহিদুল ইসলাম, সাইদুল্লাহ এবং হাফিজুল্লাহ হাওলাদার ।
প্রশ্ন : বড় ভাই শামছুল হকের কয় ছেলে?
উত্তর :  তিন ছেলে।
প্রশ্ন : নাম?
উত্তর :  লোকমান হাওলাদার, সোলায়মান হাওলাদার এবং জামাল উদ্দিন হাওলাদার।
প্রশ্ন : সোলায়মান হাওলাদারের বর্তমান বয়স  কত?
উত্তর : ৫৭/৫৮ বৎসর।
প্রশ্ন : মাহবুবুল আলম হাওলাদার (মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী)  প্রথমে তার চাচাতো বোন বিয়ে করে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনার  ফুফা এবং মাহবুবুল আলম হাওলাদারের শ্বশুর পরস্পর  কি  হন?
উত্তর : চাচাতো ভাই।
প্রশ্ন : মাহবুবুল আলমের ১ম স্ত্রী মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন :  সেই মামলায় সব সময় আপনি মাহবুবুল আলমের বিপক্ষে কাজ করেছেন।
উত্তর : পক্ষেও কাজ করিনি বিপক্ষেও কাজ করিনি।
প্রশ্ন : ওই স্ত্রীর সঙ্গে মাহবুবের এখন সম্পর্ক আছে?
উত্তর : না। ওই মামলায় সে দুই মাস হাজত খেটেছে।
প্রশ্ন :  মাহবুবের বর্তমান বাড়িটি  কিসের?
উত্তর : টিনসেড বিল্ডিং, বর্তমানে দোতলার কাজ চলছে।
প্রশ্ন :  দোতলায় কাজ চলছে কথাটি সত্য বলেনিনি আপনি।
প্রশ্ন : সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আপনি পাড়েরহাট রাজলক্ষী উচ্চ বিদ্যালয়ে গেছেন?
উত্তর : ভেতরে কখনও প্রবেশ করি নাই। আমাদের বাড়ীর নিকটবর্তী রাস্তার পাশে স্কুলটি অবস্থিত। ঐ রাস্তা দিয়ে আমি সর্বদা চলাচল করতাম। দোতলা বাহির থেকে দেখা যেত।
প্রশ্ন : আপনাকে কোনদিন কোন মিলিটারী বা রাজাকাররা ডিস্টার্ব করেছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনার  গ্রামের বাড়িতে বা পাড়েরহাটের বাসায় কোন দিন কোন পাকিস্তানী আর্মি বা রাজাকাররা  গেছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : পাড়েরহাট বাজারে কয়দিন  লুটপাট হয়েছে এবং কয়দিন অগ্নিসংযোগ হয়েছে?
উত্তর : পাড়েরহাট বাজারে একদিনই লুটপাট হয়েছে। তারপর দিন খালের ওপারে বাদুরা চিথলিয়া গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। পাড়েরহাট বাজারে কোন অগ্নিসংযোগ হয় নাই।
প্রশ্ন :  পাড়েরহাট বাজার লুট হওয়ার দিন আপনি  কোথায় ছিলেন?
উত্তর :  পাড়েরহাট বাজারেই ছিলাম।
প্রশ্ন : লুটপাটের পর আপনি কি করলেন?
উত্তর : আমি  আমার বাসায় চলে আসি।
প্রশ্ন : কোন ধরনের লোকদের দোকান বাড়ি লুটপাট হয়েছে?
উত্তর : হিন্দুদের দোকান। পাঁচ ছয়জন হিন্দুদের দোকান লুট হয়। এরা হলেন, মাখন সাহা, মদন সাহা, নারায়ন সাহা, বিজয় মাস্টার, গৌরাঙ্গ পাল।
প্রশ্ন :  দোকানের সঙ্গেই তাদের বাড়ি ছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : গৌরাঙ্গ পাল কোথয় আছে?
উত্তর : মারা গেছে।
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন হিন্দুরা নিজের জীবন বাঁচাতে স্বেচ্চায় মুসলমান হয়েছে। তাদের জীবনের প্রতি কারা হুমকি সৃষ্টি করেছিল?
উত্তর : পাকিস্তান আর্মি। তারা দেখতেছে পাক আর্মি হিন্দুদের  মেরে ফেলছে। তখন তাদের বাঁচার কোন পথ ছিলনা।
প্রশ্ন : পাকিস্তানী আর্মিরা  কে হিন্দু কে মুসলমান তা কি চিনত?
উত্তর : পিস কমিটর লোক তাদের দেখিয়ে দিত।
প্রশ্ন :  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যারা মুসলমান হয়েছিল তাদের সংগে আপনার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : কোথায়?
উত্তর : পাড়েরহাট বাজারে।
প্রশ্ন : আপনি প্রতিদিন গ্রামের বাড়ি যেতেন?
উত্তর :  আমি পাড়েরহাটে থাকতাম। মাঝে মাঝে আমার গ্রামের বাড়ি টগরা যেতাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফিরে এসেছিল?  মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান  তালুকদার ফিরে এসেছিল?
উত্তর : হ্যা বাড়ি ফিরে আসে। মিজানুর রহমান তালুকদারকে  আমি প্রায় ১ মাস পরে দেখেছি।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এসে কোথায় থাতক কি করত?
উত্তর : স্বাধীনতার পরে মুক্তিযোদ্ধারা শান্তি কমিটির অফিস ও রাজাকার ক্যাম্পে থাকতো। জনসাধারণ তাদেরকে  চাউল ডাইল দিত। তা পাকসাক করে খেত তারা।
প্রশ্ন : মান্নান তালুকদার সাব কি করত?
উত্তর :  পিরোজপুরে একটি ব্যাংকে চাকুরী করতো।
প্রশ্ন :  তিনি তার বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যাতায়াত করতেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন :  মান্নান তালুকদার সাহেব কখনও আপনাকে  তার উপর নির্যাতনের কথা বলেন নাই বলে যে কথা বলেছেন তা   অসত্য।
প্রশ্ন : সত্য বলেছি।
প্রশ্ন :  রাজাকাররা লুটকরা মালামাল মিজানুর রহমান তালুকদারের বাড়িতে জমা দিয়েছে। তিনি সেই মালামাল ঢোল সহরত করে যাদের মাল তাদেরকে ফেরত দিয়েছে। আমরা ৪০ বৎসরের মধ্যে  একথা শুনি নাই।  আপনার এই কথাগুলি অসত্য।
উত্তর : সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : আপনি  কখনও মান্নান তালুকদার সাহেবের সংগে টগরা কামিল মাদ্রাসা ও এতিমখানার ম্যানেজিং কমিটিতে ছিলেননা।
উত্তর : ছিলাম।
প্রশ্ন : গৌরাঙ্গ সাহার বাসা  আপনার বাসা থেকে কতদূর?
উত্তর : আমার বাসা থেকে ১০০/১৫০ গজ দূরে ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আপনার  বাড়ি ও গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ির মধ্যখানে  কয়টি দোকান ছিল?
উত্তর : আনুমানিক ২০/২৫টি বাড়িঘর ছিল।
প্রশ্ন : আপনার  বাড়ি ও রাজাকার ক্যাম্পের মাঝখানে কয়টি বাড়িঘর ছিল?
উত্তর : ১০/১৫টি
প্রশ্ন : আপনার  বাড়ি ও গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ির মধ্যখানে যে ২০/২৫টি বাড়ি ছিল তার মধ্যে হিন্দুদে;র কয়টি এবং মুসলমানদের কয়টি?
উত্তর :  ৭/৮টি হিন্দু বাড়ি ছিল।
প্রশ্ন : আপনার সবচেয়ে নিকটে কোন মুসলমানের বাড়ি ছিল?
উত্তর :  শফিজউদ্দিন মৌলভীর বাড়ি।
প্রশ্ন :   শফিজউদ্দিন মৌলভীর  ওই সময় কয়  মেয়ে  ছিল?
উত্তর :  এক মেয়ে।
প্রশ্ন : ছেলে?
উত্তর : ২ জন।
প্রশ্ন : কার বয়স কত ছিল?
উত্তর : বড় ছেলের বয়স ২০/২২ বছর।
প্রশ্ন : গৌরাঙ্গের বাড়ির পাশে কার বাড়ি ছিল?
উত্তর :  সতীন্দ্র ডাক্তারের বাড়ি।  এখন সে বাড়ি ও গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি নাই। নদীতে ভেঙ্গে গেছে।
প্রশ্ন : সতিন্দ্র ডাক্তারের কয়টি মেয়ে ছিল?
উত্তর : জানা নেই।  তবে তার ২ ছেলে ছিল, একজনের নাম সুভাষ, অন্য জনের নাম বলতে পারব না।
প্রশ্ন : সেই সময় গৌরাঙ্গ সাহার বয়স ১০/১১ বৎসর। তার বোনেরা তার ছোট ছিল। বড় বোনের বয়স ৬/৭ বৎসর। আমাদের পাড়ের হাট ইউনিয়েনে কোন মহিলা ধর্ষিত হয় নাই। আজ প্রায় ৪০ বৎসর হয়ে গেছে কোন লোক বলাবলি করে নাই যে, গৌরাঙ্গ সাহার বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আপনার এই কথাগুলি অসত্য।
উত্তর : সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : মোসলেম মাওলানার এখন কয় স্ত্রী?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : তিনি কয়টি বিবাহ করেছেন?
উত্তর : তাও জানা নেই।
প্রশ্ন :  প্রচারিত হয়েছিল যে ঐ মেয়েকে (ভানু সাহা) মোসলেম মাওলানা বিবাহ করেছে। আপনার একথাও সত্য নয়।
উত্তর  : সত্য।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব রাজাকারও ছিলেন না, স্বাধীনতা বিরোধীও ছিলেন না এবং মানবতা বিরোধী কোন কাজ তিনি করেন নাই। তিনি এ ব্যাপারে  তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। জবানবন্দীতে আপনার একথাহুলি  অসত্য।
উত্তর : সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : আপনি কি সব সময় নির্বাচনী জনসভায় যেতেন?
উত্তর : মাঝে মাঝে রাজনৈতিক দল সমূহের জনসভায় উপস্থিত হয়েছি।
প্রশ্ন : নিয়মিত পত্রিকা পড়েন?
উত্তর : মাঝে মাঝে পত্র পত্রিকা পড়ি।
প্রশ্ন : দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তর ও অন্যান্য পত্রিকায় খবর আসত। তা পড়েছেন?
উত্তর : কিছু কিছু পড়েছি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব তিনটি এম,পি, নির্বাচন করেছেন।  তার প্রতিপক্ষ নির্বাচনী প্রচারনায় তার বিরুদ্ধে কোন মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেন নাই।  যদি তিনি এই অপরাধে অভিযুক্ত হতেন তাহলে নিঃসন্দেহে প্রতিপক্ষ তার নির্বাচনী প্রচারনার সময় তা তুলে ধরতো। আপনার এই কথাগুলি সত্য নয়।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের আষাঢ়Ñশ্রাবণ মাসে সাঈদী সাহেব পাড়েরহাটে আসেন। আপনার একথাও সত্য নয়।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : আপনার  ভাতিজা রাজাকার ছিল। আপনাদের  পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন :  বর্তমানে আপনি  জামায়াতে ইসলামী  করেন এবং  পাড়েরহাট জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বে  আছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : দায়িত্বে নেই, তাহলে কোন পদে আছেন?
উত্তর : আমি কোন পদে নেই। আমি জামায়াত করিনা।
প্রশ্ন : আপনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে সক্রিয় আছেন  বিধায় জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য গোপন করে অসত্য সাক্ষ্য প্রদান  করেছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : আপনার বাবা শান্তি কমিটির সদস্য ছিল।
উত্তর : আমি স্যার এইমাত্র শুনলাম।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি  সৈয়দ আনোয়ারুল হক   বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

মোসলেম মাওলানা বিপদ সাহার মেয়েকে নিয়ে তাদের বাড়িতে থাকত

মেহেদী হাসান, ১৮/৯/২০১২, মঙ্গলবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে পঞ্চম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা খসরুল আলমের জেরা আজ সোমবার  শেষ  হয়েছে। গত ১৬ সেপ্টম্বর  তার জবানবন্দী শেষে আংশিক জেরা হয়। গতকাল তাকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।

জেরায় তাকে প্রশ্ন করা হয় “বিপদ সাহা আপনার কাছে তার ক্ষতির কথা বলেছে  বলে  উল্লেখ করেছেন আপনি। তার কি ক্ষতি  হয়েছিল?”

জবাবে সাক্ষী বলেন, তার আর্থিক ক্ষতি হয়নি। সামাজিক এবং মানসিক ক্ষতি হয়েছিল। পিস কমিটির সেক্রেটারি মোসলেম মাওলানা  বিপদ সাহার মেয়েকে নিয়ে বিপদ সাহার বাড়িতে থাকত মুক্তিযুদ্ধের সময়।
খসরুল আলম তার জবানবন্দীতেও এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
এর আগে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  রাষ্ট্রপক্ষেরও একজন সাক্ষী জেরার সময় বলেছেন,  বিপদ সাহার মেয়েকে নিয়ে বিপদ সাহার বাড়িতে থাকত মোসলেম মাওলানা।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যে বিচার বর্তমানে চলছে তাতে একটি আলোচিত   চরিত্র বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহা । ভানু সাহাকে জড়িয়ে মাওলানা  সাঈদী,  রাজাকার, পিস কমিটির লোকজন এবং পাকিস্তান  আর্মির বিরুদ্ধে   আদালতে সাক্ষ্য  দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কয়েকজন সাক্ষী। 

১৯৭১ সালে পিরোজপুর পাড়েরহাট বাজারে বিপদ সাহা তার মেয়ে ভানু সাহাকে নিয়ে বাস করতেন । ।  পাড়েরহাট বাজারে তাদের একটি দোকান ছিল  এবং দোকানের  পেছনেই   ছিল তাদের বসবাসের ঘর।  । 

গত বছর  ২৭ ডিসেম্বর  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পঞ্চম সাক্ষী  মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার জেরার সময় জানান, পারেরহাটে বিপদ সাহার  মেয়েকে নিয়ে বিপদ সাহার বাড়িতেই বাস করতেন  পিস কমিটির নেতা মোসলেম উদ্দিন মাওলানা। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী তাকে প্রশ্ন করেন, ভানু সাহাকে মোসলেম মাওলানা বিয়ে করে জামাই হিসেবে থাকতেন কি-না।  তখন মাহতাব উদ্দিন বলেন, বিয়ে করেছিল কিনা বলতে পারবনা। তবে গন্ডগোলের সময় ভানু সাহাকে নিয়ে মোসলেম মওলানা   থাকতেন বিপদ সাহার বাড়িতে। 

এর আগে গত বছর  ৮ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন নবিন  ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ভানু সাহা ও  ছবি রায়সহ আরো অনেক  মেয়েদের  পাক আর্মি শান্তি কমিটি ও  রাজাকারদের সাথে নিয়ে  ধর্ষন করত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে।  ভানু সাহাকে দীর্ঘ কয়েক মাস  আটকে রেখে পাক  আর্মি উপর্যপুরী ধর্ষন করে। 

খসরুল আলমকে জেরা :
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাই?
উত্তর :  তিন ভাই।
প্রশ্ন : অন্য দুজন কি আপনার বড় না ছোট?
উত্তর : বড়।  বড় ভাই মারা গেছে।
প্রশ্ন : দ্বিতীয় জন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কি করতেন?
উত্তর : সাংসারিক কাজকর্ম করতেন। বর্তমানে সে অসুস্থ। বিছানায় শায়িত।
প্রশ্ন : বড় জন কি করতেন তখন?
উত্তর : তিনিও সাংসারিক কাজকর্ম করতেন। নিম্ন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কি বিবাহিত ছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার তখন সন্তান ছিল?
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : আপনি ছাত্রলীগ করতেন বলেছেন। ছাত্রলীগে কিভাবে সদস্য হতে হয় বা  অন্তর্ভুক্ত হতে হয়?
উত্তর : আমরা স্কুল জীবন থেকেই ছাত্রলীগ করতাম। ছাত্রলীগের নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের শোসনের কথা আমাদের বলতেন। বোঝাতেন। এভাবে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত হই। ওয়াদাপত্রে সই করি।
প্রশ্ন : ওয়াদাপত্রে কি লেখা ছিল?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : ছাত্রলীগের স্লোগান কি ছিল মনে আছে?
উত্তর : স্কুলে থাকতে আমরা ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলাম। কলেজে যাবার পর সদস্য হই।
প্রশ্ন :  কলেজে যাবার পর ছাত্রলীগের স্লোগান কি ছিল মনে আছে?
উত্তর :  তখন  ছাত্রদের শিক্ষা, বিভিন্ন সমস্যার কথা বলতেন । সমস্যার সমাধানের কথা বলতেন। স্লোগান কি ছিল স্মরন নেই।
প্রশ্ন :  আপনি ছাত্রলীগ করতেন এটা সঠিক বলেননি।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন : ছাত্রলীগের কোন ওয়াদাপত্র তখন ছিলনা।
উত্তর : ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
উত্তর : বিকম পরীক্ষা দিয়েছি মোড়েলগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে।
প্রশ্ন : পরীক্ষার পর কোথায় ছিলেন?
উত্তর : মোড়েলগঞ্জে ছিলাম। পারেরহাট  আসতাম। ঢাকাও আসা যাওয়া ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর আজ পর্যন্ত আপনি দেশের বাইরে গেছেন?
উত্তর : ১৯৮৫ সালে আমি সৌদি আরব যাই। ২০ বছর পর দেশে আসি ২০০৪ সালে।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর কোন এক অস্ত্র মামলার আসামী আপনার নাম বলেন। সে কারনে আপনি সৌদি আরব পালিয়ে যান।
উত্তর : নাউজুবিল্লাহ।
প্রশ্ন : সৌদি আরব কি করতেন?
উত্তর : চাকরি করতাম । এয়ার ডিফেন্স এর সিভিল প্রজেক্টে চাকরি করেছি।
প্রশ্ন : জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের পরে একটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড গঠন করে  তা জানা আছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনার কয়টা পাসপোর্ট?
উত্তর : ২টা।
প্রশ্ন : বিয়ে করেছেন কোন সালে?
উত্তর : ১৯৭৮ সালে।
প্রশ্ন : আপনার শশুর কোথায় থাকত কি করত?
উত্তর : পিরোজপুরে তার স্বর্নের দোকান ছিল।
প্রশ্ন : তারা কি বংশপরম্পরায় পিরোজপুর থাকত?
উত্তর : তারা ভারত থেকে এসেছেন। আমার শশুরের আবার সাথে শশুর এসেছেন। তখন তিনি ছোট ছিলেন।
প্রশ্ন : তারা বাংলাভাষী নন।
উত্তর : তারা বাংলাভাষী এবং বাংলায় কথা বলেন।
প্রশ্ন : পারিবারিকভাবে আপনার শশুর পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন এবং এখনো আছেন।
উত্তর : সম্পূর্ণ মিথ্যা বানোয়াট।
প্রশ্ন : শামসুল আলম তালুকদার (মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষী) মুক্তিযুদ্ধের সময়  কোন দল করতেন?
উত্তর : ছাত্র ইউনিয়ন, ভাসানী ন্যাপ গ্রুপ।
প্রশ্ন : তার সাথে তখন আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
উত্তর : ভাল।
প্রশ্ন :  ভাসানী ন্যাপের দুটি গ্রুপ ছিল। একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক ছিল আরেকটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল। শামসুল আলম তালুকদার ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী গ্রুপের লোক।
উত্তর : সত্য নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গ্রুপের লোক ছিলেন।
প্রশ্ন : শঙ্কর পাশার আইউব আলীকে চেনেন?
উত্তর : স্বাধীনতার পর আইউব আলী বেওনেটসহ গ্রেফতার হয়।
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : আইউব আলী গ্রেফতারের পর আপনি ঢাকায় চলে আসেন।
উত্তর : সম্পূর্ণ মিথ্যা।
প্রশ্ন : আপনি কোথায় ছিলেন?
উত্তর : মোড়েলগঞ্জে।
প্রশ্ন : ঢাকায় চাকরির জন্য কবে আসেন?
উত্তর : ১৯৭৭ সালে।
প্রশ্ন : আপনি আত্মগোপনের জন্য ঢাকায় আসেন।
উত্তর : সস্পূর্ণ বানোয়াট।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন ক্যাম্পে ১৫/১৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের কয়েকজনের নাম বলেন।
উত্তর : মোকাররম হোসেন কবির, আব্দুল গনি পসারী, সেলিম খান, আব্দুস সালাম পশারী, আব্দুস সোবহান, মিজানুর রহমান তালুকদার, অনেক পরে আসেন রুহুল আমিন নবিন, তার চাচাত ভাই শাহ আলম প্রথম থেকে আমাদের সাথে ছিল।
প্রশ্ন : বিপদসাহা আপনার কাছে তার ক্ষতির কথা বলেছে  বলে বলছেন আপনি। তার কি ক্ষতি  হয়েছিল?
উত্তর : তার আর্থিক ক্ষতি হয়নি। সামাজিক এবং মানসিক ক্ষতি হয়েছিল। পিস কমিটির সেক্রেটারি মোসলেম মাওলানা  বিপদ সাহার মেয়েকে নিয়ে বিপদ সাহার বাড়িতে থাকত মুক্তিযুদ্ধের সময়।
প্রশ্ন : আপনি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পারেরহাট ক্যাম্পে ছিলেন বলেছেন। তখন পর্যন্ত মোসলেম মাওলানাকে পাননি।
উত্তর : পাইনি কারণ সে পলাতক ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ বা  গ্রেফতার হওয়ার কথা  শুনেছেন?
উত্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের ছেলেরা কে কোথায় লেখাপড়া করেছেন জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের দেশে কোথায় কি সম্পদ আছে জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের আগে তার  কি সম্পদ ছিল?
উত্তর : পৈত্রিক সূত্রে কিছু সম্পদ ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কয় সন্তান ছিল?
উত্তর : সম্ভবত দুই ছেলে।
প্রশ্ন : আপনার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার সময় কয়জন রাজাকার ছিল?
উত্তর : একজন। মহসিন রাজাকার। সাথে পাঞ্জাবী  সেনারা ছিল।
প্রশ্ন : আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেননা। সে কারনে আপনার সনদ বাতিল হয়েছে এবং তালিকা থেকেও নাম বাদ হয়েছে।
উত্তর : বানোয়াট, মিথ্যা।
প্রশ্ন : রাজলক্ষী স্কুলে আর্মি  থাকত মানে কি বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর : মাঝে মাঝে তারা আসত। রাত্রি যাপন করত মাঝে মাঝে।
প্রশ্ন : পারেরহাট ও শঙ্করপাশায় কোন নারী ধর্ষিত হয়নি বলে যে কথা বলেছেন তা সত্য নয়।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : আপনি এখন জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
উত্তর : মোটেই সত্য নয়।
প্রশ্ন : জামায়াতের অর্থানুকুল্যে আপনি সৌদিআরব গেছেন। তাদের  সহায়তায় আপনি জীবন যাপন করেন বলে জামায়াতের নেতা মাওলানা সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য গোপন করে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলেন আপনি।
উত্তর : সত্য নয়।
ট্রাইব্যুনাল (১)  চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমদ আনসারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।


মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন মুক্তিযোদ্ধা খসরুল আলম


মেহেদী হাসান, ১৬/৯/২০১২, রোববার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিলেন  মুক্তিযোদ্ধা খসরুল  আলম। তার বাড়ি  পিরোজপুুরের শঙ্করপাশা  ইউনিয়নে। পাড়েরহাট মুক্ত হওয়ার পর তিনিসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন।

জবানবন্দী:
আমার নমা খসরুল আলম। পিতা মৃত কাসেম আলী মাতুব্বর। বয়স ৬২।
১৯৭১ সালে আমি মোড়েলগঞ্জ  এস এম কলেজে এই কম ছাত্র ছিলাম। ১৯৭০  সালে আমি সেখানে  ভর্তি হই। আমি মোড়েলগঞ্জ কলেজের ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম। কলেজের তখনকার ভিপি লিয়াকত আলী খান, সাবেক ভিপি মোশাররফ হোসেন খান একত্রিত হয়ে মোড়েলগঞ্জের প্রাক্তন আর্মি সুবেদার এস এম কবির আহমেদের নেতৃত্বে  মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনে অগ্রসর হই। এভাবে কবির আহমেদের নেতৃত্বে আমরা রাইফেলের ট্রেনিং নেই। তার সাথে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাই। তারপর সংবাদ পাই আমি ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের কারনে শঙ্করপাশা (ডাক পাড়েরহাট, পিরোজপুর) আমাদের বাড়িতে পাড়েরহাটের পিস কমিটির সদস্য মৌলভী শফিজউদ্দিনের ছেলে মহসিন রাজাকার কয়েকজন পাঞ্জাবী সেনা নিয়ে   যায়। তারপর আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়ে ছাই   করে দেয়। আমার ষাটোর্ধ মাকে পাকিস্তানীরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। মে মাসের শেষের দিকে এ খবর পাই। এ ঘটনা শুনে মোড়েলগঞ্জের ভিপি লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের  স্টুডেন্ট ক্যাম্প গঠন করা হয়।  তার সাথে শামসুল আলম তালুকদার ছিলেন। স্টুডেন্ট ক্যাম্প গঠনের পর আমরা অনেক  ছাত্র ক্যাম্পে যোগ দেই। আমাদের ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যাপ্টেন জিয়া পরিতোষ নামে  একজন ইনস্ট্রাক্টর   নিয়োগ দেন। প্রশিক্ষনের পর অভিযান   শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জিয়া পিরোজপুর দখলের জন্য আড়াইশর  মত মুক্তিযোদ্ধা পাঠান লিয়াকতের নেতৃত্বে। রওয়ানার পরে রাত একটা বা দেড়টার দিকে পাড়েরহাট পৌছাই। লিয়াকত আলী শেখ বাদশা সেখানে কতক্ষন অবস্থান করেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পারেরহাট বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে। আমাদের আসার খবর পেয়ে রাজাকাররা ক্যাম্প থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পালিয়ে যায়। লিয়াকত আলী বাদশা আমাদের ওখানে রেখে যান ক্যাম্প দেখাশুনার জন্য। মোকাররম হোসেন কবির, আব্দুল গনি পশারী ছিলেন আমাদের সাথে। এরপর ক্যাপ্টেন জিয়া এবং তার সেকেন্ড ইন কমান্ড বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পারেরহাট হাজির হন। অনেক লোকজন আসে তাদের অভিনন্দনের জন্য। ক্যাপ্টেন জিয়া ৫/১০ মিনিট  অবস্থান করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে চলে যান। শামসুল আলম  তালুকদার পারেরহাট থেকে যান ২/৩ ঘন্টার জন্য। ক্যাপ্টেন জিয়া পিরোজপুর চলে যান। লিয়াকত আলী ও শামসুল আলম তালুকদার বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেন  যুক্তভাবে। পাড়েরহাট হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্প, যেখানে মাঝে মাঝে পাকিস্তান আর্মি এসে থাকত, সেটাও পরিদর্শন করেন।

একটি কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম তা হল,  রাজাকারদের কার্যকলাপ স্থানীয় লোকজন ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনকে  অবহিত করে। তার মধ্যে সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, মফিজউদ্দিন মৌলভী,


আসমত আলী মুন্সি, আব্দুল হনি হাজী এরা কুখ্যাত রাজাকার এবং পিস কমিটির লোক ছিল। এদের সাথে আরো অন্যান্য রাজাকার ছিল। তৈয়ব আলী মিস্ত্রী, আব্দুল করিম, মফিজ উদ্দিনের জামাই। সাঈদী সাহেব রাজাকার ছিলেন একথা কোন লোকই ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনকে বলেনি ।
মোসলেম মাওলানা ভানু সাহাকে নিয়ে দীর্ঘ আট মাস বিপদ সাহার বাসায় বাস করেছে।
ক্যাপ্টেন জিয়া চলে যাবার সময় আমাদের দায়িত্ব দিয়ে যান এবং সেই অনুযায়ী ঢোলসহরত করে সবাইকে জানাই আপনাদের যা বলার আমাদের বলবেন। কোন রাজাকারকে আশ্রয় দেবেননা। নিশিকান্ত কয়েকদিন ঢোল পেটায়।
মাওলানা সাঈদী সাহেবকে তার বিয়ের পর থেকে চিনতাম। তিনি তার শশুরবাড়িতে আসতেন সেই সূত্রে পরিচয় ছিল। বিপদ সাহা আমার কাঁধে হাত দিয়ে কেঁদে বলেছিল মোসলেম মাওলানা দ্বারা আমার যে ক্ষতি হয়েছে তা  ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা।
আমরা সেকেন্দার সিকদার শফিজউদ্দিন, আব্দুল করিম এদেরকে আমরা আটক করি।
মোসলেম মাওলানা, দানেশ মোল্লা এবং অন্যান্য কুখ্যাত রাজাকারদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছি কয়েকবার।
স্বাধীনতার পর ক্যাম্পে থাকাকালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের সাথে আমার দুয়েকবার দেখা হয়।

জবানবন্দী গ্রহনে সাক্ষীকে পরিচালনা করেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে  উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী। গতকাল মাওলানা সাঈদী কোর্টে উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর গত সপ্তাহ থেকে তাকে  আবার কোর্টে আনা শুরু হয়েছে। 
জবানববন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।

জেরা :
জেরা : শফিউজউদ্দিন মৌলভীরা কয় ভাই?
উক্তর : জানা নেই।
প্রশ্ন :  মহসিন রাজাকাররা কয় ভাই?
উত্তর :  জানা নেই। তারা তখন ছোট ছিল।
প্রশ্ন : এদের বাড় কোথায়?
উত্তর : মূল বাড়ি টগরা। থাকত পাড়েরহাট।
প্রশ্ন : টগরায় কতজন রাজাকার ছিল?
উত্তর : এটা পরিসংখ্যান করা হয়ন্ ি
প্রশ্ন : আপনার জানামতে পারেরহাটে কতজন রাজাকার ছিল?
 উত্তর : ৩০ এর বিশ।
প্রশ্ন : এদের মধ্যে কুখ্যাত কতজন ছিল?
উত্তর : ৪১ বছর আগে ঘটনা।  যা দেখেছি, শুনেছি তার সব মনে নেই। যা দরকার তা মনে আছে।
প্রশ্ন : কোন গ্রামে কয়টি বাড়িতে রাজাকার ধরার জন্য অভিযান চালান?
উত্তর : মোসলেম মাওলানার  বাড়িতে, তার নানা বাড়ি, শশুর বাড়িতে অভিযান চালাই। সাধারন ক্ষমা ঘোষনার আগ পর্যন্ত তাকে পাওয়া যাযনি।
প্রশ্ন : টগরায় কোন মুক্তিযোদ্ধা ছিল?
উত্তর : ছিল।

প্রশ্ন : নাম?
উত্তর : মিজানুর রহমান?
প্রশ্ন : মিজানুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে এসেছিল?
উত্তর : পরে যোগ দেয়।
প্রশ্ন : অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও পরে ক্যাম্পে যোগ দেয়?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ক্যাম্পে কি পরিমান মুক্তিযোদ্ধা ছিল?
উত্তর :১৫/১৬ জন।
প্রশ্ন : ক্যাম্পে কতদিন ছিলেন?
উত্তর : ফেব্রুয়ারির ১৫/২০ তারিখ পর্যন্ত ।
প্রশ্ন : আপনি চলে আসার পরও ক্যাম্প চলছিল?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : ক্যাপ্টেন জিয়া উদ্দিন যখন লোকজনের সাথে কথা বলেন তখন কিভাবে বলেছিলেন অনেক লোকের সাথে একসাথে না আলাদা আলাদভাবে  একজন একজন করে?
উত্তর : তিনি ৫/১০ মিনিট ছিলেন। যাবার সময় আমাদের বললেন রাজাকারদের কেউ আশ্রয় দেবেনা। কারো কোন অভিযোগ থাকলে তা এখানাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বলবেন। এছাড়া তিনি অন্য কারো কথা শোনেননি।
প্রশ্ন :  শামসুল আলম যখন লোকজনের সাথে কথা  বলেন তখন কি পরিমান লোক ছিল?
উত্তর : হাজার/১২শ।
প্রশ্ন : তারা সবাই তার কাছে কথা বলছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কতজন বলেছে অনুমান?
উত্তর : সবারই অভিযোগ ছিল। তবে সবাই তো আর কথা বলতে পারেনি। কিছু লোক বলেছে।
এ পর্যন্ত জেরার পর জেরা আজ  সোমবার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।


সাঈদীসহ আমরা ’৭১ সালের এপ্রিল মাসে যশোর শহর থেকে গ্রামে চলে যাই

মেহেদী হাসান, ১২/৯/২০১২,  বুধবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ  চতুর্থ সাক্ষী জবনাবন্দী দিয়েছেন। তার নাম আবুল হোসেন। বাড়ি যশোর।  জবানবন্দীতে সাক্ষী  বলেন, ১৯৬৮ সাল থেকে তিনি যশোরের নিউটাউনে বাস করতেন। সেখানে তাদের বাসার পাশে বাস করতেন মাওলানা সাঈদী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে   তাদের পরিবার, মাওলানা সাঈদী সাহেবের পরিবারসহ পাশপাশি মোট চারটি বাসার পরিবার একত্র হয়ে যশোরের   শেখহাটি  হয়ে ধানঘাট যান। সেখানে  সাত/আট দিন থাকার পর দুটি পরিবার ভারতে চলে যায় এবং মাওলানা সাঈদী বাঘারপাড়ার মহিরনে তার এক পীরের বাড়ি চলে যান।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের  বেশ কয়েকজন সাক্ষী  ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন মে মাসে  পিরোজপুরের পারেরহাটে পাক আর্মি আসলে মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্যরা তাদের অভ্যর্থনা জানায়। তার  আগে পারেরহাট শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী গঠনে মাওলানা সাঈদী ভূমিকা পালন করেন।

জবানবন্দী :
আমার নাম মো: আবুল হোসেন। বয়স ৫৬ বছর।
আমি একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করি। ১৯৬৮ সাল হতে যশোর নিউ টাউন, ব্লক -এ, ১৮৫ নম্বর বাড়িতে বসবাস করে আসছি। ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ কালরাত্রে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে । যশোর সেনানিবাস থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। ২৬, ২৭  ও ২৮ শে মার্চ ওখান থেকে নিয়মিত গোলাগুলি চলে। আমার বাড়ির পাশে ১৮৪ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতেন শহিদুল ইসলাম সাহেব। তিনি শেখহাটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তার পাশের বাসায় ১৮৩ নম্বর বাড়িতে বসবাস করতেন একই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ( নাম মনে পড়ছেনা এখন) ।  ১৮২ নম্বর বাসায় বসবাস করতেন দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেব। যশোর শহর থেকে অনেক পরিবার ভয়ে শহর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন আমাদের এই চার পরিবারের অভিভাবকরা আলোচনা করলেন যে, এখানে তো আর থাকা যায় না। আমরা ১৯৭১ সালের ৩ অথবা ৪ এপ্রিল তারিখে যশোর থেকে শেখহাটি চলে যাই। রাত্রে শেখহাটিতে অবস্থান করি। ওখান থেকে সকালে আমরা আরও ভিতরে পূর্বদিকে ধানঘাটা গ্রামে চলে গিয়ে অবস্থান নেই। সেখানে ১৮৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দার (তার নাম   মনে পড়ছে আবুল খায়ের) মামার বাড়িতে অবস্থান করি। সেখানে ৭/৮ দিন থাকার পরে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, আমাদের পরিবার এবং শহিদুল ইসলামের পরিবার ভারতে চলে যাবে ।  আবুল খায়ের তিনি তার মামার বাড়ি ধানঘাটায় থেকে গেলেন । সাঈদী সাহেব ওখান থেকে ৮/৯ মাইল দূরে চলে গেলেন যশোরের বাঘারপাড়া থানাধীন মহিরন উনার এক পীর সাহেবের বাড়িতে। আমাদের পরিবার এবং শহিদুল ইসলামের পরিবার ভারতে চলে যাই। এরপর সাঈদী সাহেবের সংগে আমার আর যোগাযোগ হয় নাই।

জবানবন্দী গ্রহনে সাক্ষীকে সহায়তা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মনজুর আহমদ  আনসারী। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।
জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।

জেরা :
প্রশ্ন : জাতীয় পরিচয় পত্র এনেছেন সাথে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন  জাতীয় পরিচয়পত্র আছে?
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন : পরিচয় পত্র ঢাকায় আনেননি না কোর্টে আনেননি  কোনটা?
উত্তর : ঢাকায় আনিনি যশোর থেকে। যশোর আছে।
প্রশ্ন : আপনি কি করেন?
উত্তর : একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি।
প্রশ্ন :  কতদিন ধরে?
উত্তর : ১০/১২ বছর।
প্রশ্ন : ফার্মের নাম কি/.
উত্তর : স্কয়ার ইলেকট্রিক মাইকপট্টি যশোর।
প্রশ্ন : চাকরি করেন সে মর্মে কোন কাগজপত্র এনেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন :  আপনি যে এলাকায় বাস করেন সে মর্মে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বার থেকে কোন কাগজপত্র এনেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি কি  হিসেবে চাকরি করেন দোকানে?
উত্তর : ম্যানেজার।
প্রশ্ন : সেখানে কতজন কর্মচারি আছে?
উত্তর : চার/পাঁচ জন।
প্রশ্ন : মালিকের নাম?
উত্তর : শহিদুল ইসলাম।
প্রশ্ন : তার বয়স?
উত্তর : ৩৬/৩৭ বছর।
প্রশ্ন : এখানে চাকরির আগে কি করতেন?
উত্তর : কিন্ডার  গার্টেন স্কুলে চাকরি করতাম। আমি একজন সঙ্গিত শিল্পী। গানবাজনারও শিক্ষক ছিলাম।
প্রশ্ন : লেখাপড়া?
উত্তর : যশোরে।
প্রশ্ন : লেখাপড়া সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র এনেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আপনার পরিবারের অভিভাবক কে ছিলেন?
উত্তর : বাবা। ১৯৮৫ সালে তিনি মারা গেছেন।
প্রশ্ন : তিনি কি করতেন?
উত্তর : পুলিশ অফিসের হেড এসিসট্যান্ট ছিলেন।
প্রশ্ন : আপনারা কয় ভাইবোন?
উত্তর : নয় ভাই চার বোন।
প্রশ্ন : আপনি কত নম্বর?
উত্তর :  তিন।
প্রশ্ন : আপনার বড় দুই জন কি ভাই  না বোন?
উত্তর : ভাই।
প্রশ্ন : তারা ওই সময় কি করত?
উত্তর :  লেখাপড়া।
প্রশ্ন : আপনার লেখাপড়া কতদূর?
উত্তর : আমি ১৯৭২ সালে এসএসসি পাশ করি।
প্রশ্ন : ভারতে গিয়ে কি করলেন?
উত্তর : বনগা মাদ্রাসার  ক্যাম্পের পাশে থাকতাম।
প্রশ্ন : সবাই মিলে?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনার দাদার বাড়ি কোথায়?
উত্তর : ২৪ পরগান জেলার  বশিরহাট।
প্রশ্ন : আপনাদের ১৮৫ নং বাড়িটি কি সরকারি এলটের?
উত্তর : হ্যা। যারা এলট পেয়েছে তাদের কাছে আমরা কিনেছি।
প্রশ্ন : ১৮২, ১৮৩, ১৮৪ নম্বর বাড়িও সরকারি এলটেড?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : এখানে যারা থাকত তাদের বেশিরভাগই ভারত থেকে এসেছে? তাদের জন্যই এ বাড়িগুলো করা হয়েছিল।
উত্তর :  হ্যা।
প্রশ্ন : ভারত থেকে কবে আসলেন?
উত্তর : স্বাধীনতার এক মাস পর। তার আগে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর আমার বাবা পরিবার নিয়ে এদেশে আসেন এবং তখন থেকে আমরা ওখানেই থাকি।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার পর  দেশে এসে  কি করলেন ?
উত্তর :  গানবজনার সাথে জড়িত হই।
প্রশ্ন : আকড়ায় যেতেন?
উত্তর : আমি আকড়ার শিল্পী নই। আমি রবীন্দ্র, নজরুল, আধুনিক এবং আঞ্চলিক গান করি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব তখন ছেলে মেয়ে নিয়ে ওই বাসায় থাকতেন?
উত্তর : তার দুই সন্তান, পরিবার এবং কাজের মেয়ে নিয়ে থাকতেন।
প্রশ্ন : তিনি কি করতেন?
উত্তর : ওয়াজ মাহফিল করতেন।
প্রশ্ন : তিনি তার দুই সন্তান, পরিবার এবং কাজের মেয়ে নিয়ে থাকার যে কথা বলেছেন তা সত্য নয়।
উত্তর : থাকতেন।
প্রশ্ন : আপনি জীবনে কত মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন?
উত্তর : এ ধরনের মামলায় আমি এই প্রথম সাক্ষ্য দিলাম। তবে আমি যেখানে চাকরি করি সে প্রতিষ্ঠানের মামলায় আমাকে প্রতি মাসে সাক্ষ্য দিতে হয়  বিভিন্ন কোর্টে।

প্রশ্ন : যে কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতেন সেটি এখন আছে?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : সেটি কবে  হয় এবং কবে বন্ধ হয়?
উত্তর : মনে নেই।
প্রশ্ন : ছাত্রজীবনে কোন সংগঠন করতেন/
উত্তর : না।
প্রশ্ন যশোরে কি কি ছাত্রসংগঠন ছিল?
উত্তর : বলতে পারবনা।
প্রশ্ন : ধানগাটা থেকে কারা আগে গেল?
উত্তর : আমরা আগে ভারতে যাই। ওইদিনই সাঈদী সাহেবও চলে যান।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব ওখান থেকে ৮/৯ মাইল দূরে যশোরের বাঘারপাড়া মহিরন চলে যান বলে যে কথা বলেছেন তা মিথ্যা বলেছেন আপনি।
উত্তর : ১০০ ভাগ সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের গ্রামের বাড়ি কোথায় জানেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের পূর্বে সাঈদী সাহেবের সাথে আপনার পরিচয় থাকা, পাশাপাশি বাড়িতে বাস করা, একত্রে পলায়ানের যে কথা বলেছেন তা  সত্য নয়।
উত্তর :  সত্য।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার কথা কে বলেছে আপনাকে?
উত্তর : ওনার শ্যালক নান্না মামা।
প্রশ্ন : ওনার সাথে আগে পরিচয় ছিল?
উত্তর : উনি এক বছর আগে আমাদের বাসায় গিয়ে আমার আব্বাকে খোঁজ করেন। তিনি মারা গেছেন জানার পর আমাকে অনুরোধ করেন সাক্ষ্য দেয়ার জন্য।
প্রশ্ন : আপনার পেশা হল সাক্ষ্য দেয়া। এদের দ্বারা আর্থিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে এবং প্রভাবিত হয়ে আপনি এ মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসলেন।
উত্তর :  আপনি  বলতে পারেন। তবে  তা সত্য নয়।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে তৃতীয় সাক্ষী// পাড়েরহাট রাজাকার ক্যাম্প, পিস কমিটি অফিস এবং লুটপাটের ঘটনায় সাঈদী সাহেবকে দেখিনি

মেহেদী হাসান, ১০/৯/২০১২, সোমবার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে আজ  তৃতীয় সাক্ষী জবানবন্দী দিয়েছেন। তার নাম নুরুল হক হাওলাদার। নুরুল হক হাওলাদার  তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে  স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি পাড়েরহাট বাজারে  তাদের বাড়িতে ছিলেন। পাড়েরহাট বাজারে রাজাকার ক্যাম্প, শান্তি কমিটির অফিসে কারা যেত  তাদের তিনি দেখেছেন। কিন্তু এদের মধ্যে তিনি কখনো মাওলানা সাঈদীকে দেখেননি। তাছাড়া পাড়েরহাট বাজারে আর্মি আসার পর কারা  দোকানপাট লুটপাট করেছে তাও দেখেছেন। কিন্তু এ লুটপাটের ঘটনাও তিনি মাওলানা সাঈদীকে দেখেননি।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী  মাহবুবুল আলম হাওলাদার গত ৭ ডিসেম্বর তার জবানবন্দীতে তাদের বাড়ি লুটের অভিযোগ করেছিলেন । এ বিষয়ে সাক্ষী নুরুল হক গতকাল বলেন, ৪০ বছরে কোনদিন শুনিনাই তাদের বাড়ি লুট হয়েছে। মাহবুবু আলম আমার ভগ্নিপতির ভাগনে এবং ফুফাত ভাইয়ের চাচাত ভাই। তাদের বাড়ি আমার ছোটবেলা থেকে যাওয়া আসা ছিল। সাক্ষী নুরুল হক তার ফুফাত ভাইকে উদ্ধৃত করে  বলেন, বড় রকমের স্বার্থ আদায়ের জন্য মাহবুুব  সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। শুনেছি সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মামলার পর সে দোতলা বাড়ি  করছে। একতলার কাজ শেষ হয়েছে।

সাক্ষীর জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ নুরুল হক হাওলাদার, বয়স  ৬০ বছর।  আমি আমার কলার ক্ষেত পরিচর্যা করি এবং কৃষি জমি দেখাশুনা করি। আমি ট্রাইব্যুনালে এসেছি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। আমি ১৯৬৯ সালে পাড়েরহাট বন্দর নিজ বাসায় বসবাস করতাম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে ফকির দাসের বিল্ডিংয়ে পিস কমিটি অফিস করে। ঐ অফিস আমাদের বাসা থেকে ১০০/১৫০ গজ দূরে হবে। ঐ অফিসে আমি সব সময় দেখেছি সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, মোসলেম মওলানা, হাজী আব্দুল গণি গাজি, শফিক উদ্দিন মৌলভী, আসমত আলী মুন্সিদেরকে। ঐ অফিসে আমি কখনও সাঈদী সাহেবকে দেখি নাই। ১৯৭১ সালের জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে পাড়েরহাট রাজলক্ষী হাইস্কুলের দোতলায় আবার একটি রাজাকার ক্যাম্প করে। ঐ রাজাকার ক্যাম্পে আমি দেখেছি রাজাকার আব্দুল হালিম, মশিউর রহমান, সুলতান, ইছহাক, সোলায়মানদেরকে। আমি ঐ রাজাকার ক্যাম্পে কখনও সাঈদী সাহেবকে দেখি নাই।
১৯৭১ সালে বৈশাখ মাসের শেষের দিকে পাক আর্মিরা পাড়েরহাটে আসে। এসে তারা ৫/৬ টি দোকান লুট করে। ঐ দোকানগুলির মালিক ছিলেন মাখন সাহা, মদন সাহা, নারায়ন সাহা, বিজয় মাষ্টার এবং গৌরাঙ্গ পাল। তারা লুট করে পিরোজপুরে চলে যায়। সেকেন্দার শিকদার, দানেশ মোল্লা, মোসলেম মওলানা হাজি গণি গাজী, আসমত আলী মুন্সি তাদের সাথে ছিল। সাঈদী সাহেবকে কোথাও দেখি নাই। তার পরদিন বাসায় বসে বাহিরে শোরগোল শুনি। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে অনেক লোক দেখতে পাই, তাদের সংগে পাক আর্মিও ছিল। পূর্বে যারা ছিল ঐদিনও পাক বাহিনীর সংগে তারা ছিল। তারা যখন আমাদের বাসা অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে যায় তখন আমি ঐ লোকজনের পিছনে ছিলাম। তারপর দেখি তারা পাড়েরহাট ব্রিজ পার হয়ে বাদুরা গ্রামে যাইতেছিল। আমি ঐ ব্রিজের গোড়ায়  একটি দোকানের আড়ালে ছিলাম। দেখি তারা আওয়ামী লীগের নেতা নুরু খাঁ এর বাড়িতে ঢুকছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম যে, দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। তারপর তারা বাহির হয়ে আবার দক্ষিন দিকে যাইতেছে। এর আধাঘন্টা পর দেখি যে, ধোয়ার কুন্ডলী আকাশের দিকে উঠিতেছে। আনুমানিক ঘন্টা খানেক পরে তারা আবার ব্রিজ পার হয়ে পিরোজপুর চলে যায়।
টেংরাখালীর মাহবুব আলম হাওলাদার আমার ভগ্নিপতির আপন ভাগ্নে। আরেকদিকে তিনি আমার আপন ফুফাতো ভাইয়ের চাচাতো ভাই। সেই হিসাবেও তিনি আমারও ভাই। ফুফাতো ভাইয়ের ঘর ও মাহবুব আলম হাওলাদারের ঘর পাশাপাশি। ছোট বেলা থেকেই ঐ বাড়িতে আমাদের যাওয়া আসা ছিল। ৪০ বৎসরের মধ্যে আমি কোন দিন শুনি নাই যে, তাদের বাড়ি লুট হয়েছিল। আমি শুনি যে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে তিনি একটি মামলা করেছেন। মামলা হওয়ার পরে আমি তার বড় ভাই বাতেন হাওলাদারের নিকট জিজ্ঞাসা করি, ভাইডি মাহবুব তো সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে কেস করল। বাতেন হাওলাদার উত্তরে বলে, ওকথা বলো না, বললে আমার লজ্জা করে, আমাদের বাড়িতে লুট হলে তো তোমরাও জানতা। আমাদের বাড়ি তো দূরের কথা টেংরাখালী গ্রামে কখনও রাজাকার বা পাক বাহিনী আসে নাই। তৎপর আমি আমার ফুফাতো ভাই আব্দুস সালাম হাওলাদারকে জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দিল, ১৯৭১ সালে মাহবুব হাওলাদারের বয়স ১০/১১ বৎসর ছিল এবং সে প্রাইমারী স্কুলে পড়তো। ও বড় কোন স্বার্থের জন্য সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছে। আমাদের বাড়িতে কিংবা আশে পাশে কোন সাক্ষী পাবে না বিধায় দূরের সাক্ষী মেনেছে। সব মিলিয়ে ওর বাবার চার/পাঁচ বিঘা সম্পত্তি ছিল মাত্র। মাহবুবুল আলম হাওলাদারের ভাগে পড়ে এক/দেড় বিঘা সম্পত্তি। সে সম্পত্তি সে বিক্রি করে ফেলেছে এবং তার স্ত্রীর সম্পত্তিও বিক্রয় করে ফেলেছে। সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা করার পর সে এখন দোতলা বিল্ডিং তৈরি করেছে। একতলা শেষ হয়েছে। (ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, তাহলেতো মামলা করে তার উপকার হয়েছে) ।
 মিজানুর রহমান তালুকদার আমার মামাতো ভাইয়ের শ্যালক। সেই হিসাবে তিনি আমার বিয়াই। তার বাড়ি আমার বাড়ির সন্নিকটে। জোরে ডাক দিলে তার বাড়ি থেকে শোনা যায়। তিনি সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে অত্র ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছেন তার বড় ভাই মান্নান তালুকদার সাহেবকে পাড়েরহাট রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। রাজাকাররা মালামাল লুট করে মিজানুর রহমান তালুকদারের বাড়িতে জমা দিয়েছে। তিনি সেই মালামাল ঢোল সহরত করে যাদের মাল তাদেরকে ফেরত দিয়েছে বলে বলেছে।  আমরা আজ ৪০ বৎসরের মধ্যে এমন কথা শুনি নাই। মান্নান তালুকদারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।  তিনি টগরা কামিল মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি ছিলেন। আমি ঐ মাদ্রাসার সহ সভাপতি ছিলাম প্রায় ৮/৯ বৎসর। তিনি অনেক সময় আমার সাথে তার পারিবারিক ব্যাপারে আলাপ করতেন। তিনি কখনও তাকে নিয়ে নির্যাতন করার কথা বলেন নাই। অন্য কোন লোকের নিকট থেকে এই ৪০ বৎসর যাবত পাড়ের হাট রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতনের কথা শুনি নাই।
গৌরাঙ্গ সাহা অভিযোগ করেছে যে, তার বোনকে সাঈদী সাহেব পাক আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করিয়েছে। সেই সময় গৌরাঙ্গ সাহার বয়স ১০/১১ বৎসর। তার বোনেরা তার ছোট ছিল। বড় বোনের বয়স ৬/৭ বৎসর। আমাদের পাড়ের হাট ইউনিয়েনে কোন মহিলা ধর্ষিত হয় নাই। আজ প্রায় ৪০ বৎসর হয়ে গেছে কোন লোক বলাবলি করে নাই যে, গৌরাঙ্গ সাহার বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যদিও আমরা দীর্ঘদিন যাবত বাজারে চলাফেরা করি। হিন্দুরা তাদের জান বাঁচানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে ইয়াছিন মাওলানা সাহেবের খানকায় গিয়ে মুসলমান হয়েছে।
সাক্ষী এ  কথা বলার পর ট্রাইুব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক সাক্ষীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি কিভাবে জানলেন তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলমান হয়েছে? আপনি কি সেখানে তখন ছিলেন?
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম তখন আপত্তি উত্থাপন করে বলেন,  তাকে বলতে দেন। আপনি তো জেরা শুরু করেছেন। তখন বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, মি. তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনাল সাক্ষীকে যেকোন প্রশ্ন করতে পারে। তাজুল ইসলাম বলেন, অবশ্যই পারে। কিন্তু আপনি তো সাক্ষীকে ধমকাচ্ছেন।
এরপর  ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী বলেন,  আমি শুনেছি। তারপর সাক্ষী  আবার জবানবন্দী প্রদান শুরু করেন।
এই ঘটনা ১৯৭১ সালে। দেশ স্বাধীনের পরে তারা  আবার স্ব-ধর্মে ফিরে যান। বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে সাঈদী সাহেব ধর্ষণ করেছে মর্মে অভিযোগ করেছে। এই অভিযোগ অসত্য । মোসলেম মওলানা ঐ বাসায় ১৯৭১ সালে সব সময় থাকতো। বাজারে  প্রচারিত হয়েছিল যে, ঐ মেয়েকে (ভানু সাহা) মোসলেম মওলানা বিবাহ করেছে। সাঈদী সাহেব রাজাকারও ছিলেন না, স্বাধীনতা বিরোধীও ছিলেন না এবং মানবতা বিরোধী কোন কাজ তিনি করেন নাই। তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ। সাঈদী সাহেব তিনবার  এম,পি, নির্বাচন করেছেন।  তার প্রতিপক্ষ নির্বাচনী প্রচারনায় তার বিরুদ্ধে মাঠে কোন দিন এসব অভিযোগ উত্থাপন করেন নাই।  যদি তিনি এই অপরাধে অভিযুক্ত হতেন তাহলে নিঃসন্দেহে প্রতিপক্ষ তার নির্বাচনী প্রচারনার সময় তা তুলে ধরতো।
জবানবন্দী প্রদানে সাক্ষীকে পরিচালনা করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মনজুর আহমেদ আনসারী। এসময় তাকে সহায়ত করেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ মিঠু,  আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।

জবানবন্দী শেষে সাক্ষীকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।

জেরা :
প্রশ্ন :  জমিজমা দেখাশুনা ছাড়া আর কিছু করেন ? যেমন বিচার শালিশী।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কারো বিরুদ্ধে কোন মামলা হলে তার খোঁজ নেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : কোন পক্ষে সাক্ষী জোগাড় করর জন্য যান?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনার কয় ছেলে মেয়ে?
উত্তর : ৩ মেয়ে ১ ছেলে।
প্রশ্ন : তারা কি করছে?
উত্তর : ২ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ২ জন পড়ছে।
প্রশ্ন : মেয়ের বিয়েতে সাঈদী সাহেবকে দাওয়াত দিয়েছিলেন বা তিনি এসেছিলেন?
উত্তর : দাওয়াত দেইনি। তিনি আসেনও নি।
প্রশ্ন ১৯৬৯ সালের আগে থেকেই সাঈদী সাহেবের সংগে আপনার পরিচয় ছিল?
উত্তর : তার আগে থেকেই।
প্রশ্ন : ঢাকা আসলেন কিভাবে?
উত্তর: বাসে করে। সায়েদাবাদ আসার পর সাঈদী সাহেবের শ্যালক আমাকে নিয়ে আসেন।
প্রশ্ন :  আপনাকে কোর্টে এসে সাক্ষ্য দিতে হবে তা প্রথম কবে জানলেন?
উত্তর : প্রায় এক বছর আগে। সাঈদী সাহেবের ছেলে রাফিক সাঈদী আমাদের মাদ্রাসার সামনে যান। সেখানে অনেক লোক   জড়ো হয়। তিনি তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমার আবার বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ আছে আপনারা তা শুনেছেন? আমিসহ অনেকে বলি শুনেছি এবং সব মিথ্যা । তিনি তখন বলেন কোর্টে গিয়ে একথা বলতে পারবেন? আমিসহ অনেকে তখন রাজি হই।
প্রশ্ন : ঐ মাদ্রাসার সভাপতি সেক্রেটারি কে ছিল তখন?
উত্তর : সভাপতি এমপি আওয়াল সাহেব। সেক্রেটারি কে স্মরন নেই।
প্রশ্ন : যখন  রাফিক সাহেবের কাছে মামলার কথা শুনলেন তখন কি মামলার তদন্ত চলছিল?
 উত্তর : চলছিল।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে  ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আপনি পাড়েরহাট ছিলেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনার মত যারা ব্যবসা বানিজ্য করত তারাও কি তখন সেখানে ছিল না পালিয়ে গিয়েছিল>
উত্তর : বিশেষ করে হিন্দুরা পালিয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন : মুসলমান কেউ পালায়নি?
উত্তর : স্মরন নেই।
প্রশ্ন : রাজাকার ক্যাম্পে গেছেন?
উত্তর : কখনো যাইনি। পিস কমিটির অফিসেও  যাইনি।
প্রশ্ন : ওই দুই অফিসে কি কাজ হত তা জানা নেই আপনার।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : রাজাকার শান্তি কমিটির লোকেরা যেখানে যেত তাদের সাথে আপনি যেতেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তাদের কোন অপরাশেনে যেতেন?
উত্তর : না। আমি তো রাজাকার নই যে যাব।
কাল সোমবার তার আবার জেরা শুরু হবার কথা রয়েছে।

মাওলানা সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর আবদেন খারিজ


৯/৯/২০১২, রোববার
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরুর আবদেন খারিজ করে দেয়া হয়েছে। আজ ট্রাইব্যুনাল-১ আবেদনটি শুনানী শেষে খারিজ করে দেন।

ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শুরু হবার অনেক পরে  নতুন  দুজন সদস্য বিচারপতি  নিয়োগ দেয়ার প্রেক্ষাপটে এ আবেদন করা হয়।

গত ২৮ মার্চ  বিচারক এ কে এম জহির আহমেদ ট্রাইব্যুনাল  থেকে পদত্যাগ করেন। এর আগে গত ২৫ মার্চ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল শুরুর আগে অপর সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান করা হয়। এ দুজন সদস্য প্রথম ট্রাইব্যুনালের শুরু থেকে ছিলেন।  বিচারক এ কে এম জহির আহমেদ পদত্যাগ করার পর তার স্থলে  নতুন সদস বিচারপতি  জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির চলে যাবার  পর  তার স্থলে বিচারপতি আনোয়ারুল হককে নিয়োগ দেয়া হয়।

মাওলানা সাঈদীর বিচার পুনররায় শুরুর আবেদনের পক্ষে শুনানীতে অংশগ্রহণ করেন ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন। তিনি বলেন, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে এমন সময় নিয়োগ দেয়া হল যখন মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহন শুরু হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রপক্ষের কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহনে অংশগ্রহণ করতে পারেনন্ ি। অপর দিকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য  গ্রহনের শেষ পর্যায়ে নিয়োগ পান বিচারপতি আনোয়ারুল হক।   ফলে তারা এ মামলার সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত নন।  তাদের অনুপস্থিতিতে চলা  লম্বা বিচারপ্রক্রিয়া পড়ে সম্পূর্ণরুপে অবহিত হওয়াও দুরুহ কাজ। তাই  ন্যায় বিচারের স্বার্থে মাওলানা সাঈদীর বিচার পুনরায় শুরু হওয়া দরকার।

ট্রাইব্যুনাল শুনানী শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেন।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষী হাজির করা হয়নি
আজ মাওলানা সাঈদীর পক্ষে তৃতীয় সাক্ষী হাজিরে কথা ছিল আসামী পক্ষের। সকালে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম  শুরু হলে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে তাজুল ইসলাম জানান,  আজকের জন্য নির্ধারিত সাক্ষী  নুরুল হক হাওলাদার অসুস্থ। এর পরের সাক্ষী আব্দুল হক হাওলাদারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। তাজুল ইসলাম একদিনের জন্য মুলতবি প্রার্থনা করেন। বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, এরপর থেকে আসামী পক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষ কোন পক্ষের সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারনে বিচার মুলতবি করা হবেনা।

আজ   কোন সাক্ষী না থাকায় বিচারপতি নিজামুল হক  বিভিন্ন অনিস্পন্ন আবেদনের শুনানীর জন্য  বলেন আইনজীবীদের। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামকে  তাদের আবেদনের শুনানীর জন্য বলা হলে তিনি বলেন, আজ  সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কোর্টে নেই। আমরা চাই তার উপস্থিতিতে শুনানী হোক। তখন বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, আপনারা কি আজ গ্রুপ করে এসেছেন যে, আমাদের  আজ কোন কাজ করতে দেবেনন? যদি কাজ করতে না দেন তাহলে শনিবার প্রয়োজনে কোর্ট বসাব তা মনে রাখবেন। আমাদের সে ক্ষমতা আছে।

এরপর  বিচারপতি নিজামুল হক মাওলানা সাঈদীর পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিনকে বলেন, আপনাদের দায়ের করা আবেদন শুনানী করেন (হুমায়ুন আহমেদের পিতাকে হত্যা বিষয়ে চ্যানেল আইয়ে শাহরিয়ার কবিরের একটি বক্তব্য প্রচারকে কেন্দ্র করে শাহরিয়ার কবির এবং চ্যানেল আইয়ের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে মাওলানা সাঈদীর পক্ষ থেকে।) তানভির আল আমিন বলেন, এ আবেনটি  আমাদের অপর আইনজীবী মিজানুল ইসলামের শুনানী করার কথা। তিনি আজ দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে রয়েছেন। তাই আজ এটি  শুনানী করতে চাচ্ছিনা আমরা। অন্য কোন দিন তারিখ নির্ধারন করা হোক।

বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, কোন সাক্ষীর সাক্ষ্য  গ্রহণ বন্ধ রেখে আমরা  আবেদন শুনবনা। সাক্ষ্য গ্রহন  থাকবেনা এমন  কোন একদিন বলবেন সেদিন শুনানী হবে।
এরপর  সোমবার পর্যন্ত আদালত মুলতবি করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আসামী পক্ষের প্রধান আইনজীবী   ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউটর  সৈয়দ হায়দার আলী এবং জেয়াদ আল মালুম উপস্থিত ছিলেন অন্যান্যের মধ্যে।

ওরা বলেছিল সাঈদী পারেরহাটে চট বিছিয়ে তেল নুন সাবান মরিচ বিক্রি করত

মেহেদী হাসান, ৬/৯/২০১২, বৃহষ্পতিবার
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের   বেশ কয়েকজন সাক্ষী   ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিলেন , স্বাধীনতা যুদ্ধের  আগে থেকে মাওলানা সাঈদী পারেরহাট বাজারে চট বিছিয়ে তেল, নুন, সাবান, মরিচ বিক্রি করত। এমনকি লঞ্চে ফেরি করে আবে হায়াত নামে দাতের মাজন বিক্রি করত। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি প্রথমে যশোরে পালিয়ে  গিয়ে আত্মগোপন করেন। পরবর্তীতে সেখানে তার অবস্থান জানাজানি হলে সেখান থেকেও  তিনি অন্যত্র পালিয়ে যান।  দীর্ঘদিন  পালিয়ে থাকার পর  নাম পরিবর্তন করে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।

কিন্তু আজ  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে দ্বিতীয় সাক্ষীর জেরায়  সম্পূর্ণ  ভিন্ন তথ্য  বের হয়ে এসেছে। জেরায় সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক জানান,  ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে  মাওলানা সাঈদী এলাকায় ওয়াজ মাহফিল করতেন। স্বাধীনতার এক বছর পরও তিনি এলাকায় ওয়াজ মাহফিল করেছেন।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে দ্বিতীয় সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক আঁকনের জেরা আজ শেষ  হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাককে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী। জেরায়  সাক্ষীকে প্রশ্ন করা হয় “সাঈদী সাহেব মুক্তিযুদ্ধের আগে কি করতেন  তা জানেন?” সাক্ষী বলেন,   “মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মাহফিল করতেন।”
কোথায় মাহফিল করতেন?
আমাদের গ্রামে দিঘির পাড় নামক এক মাঠ আছে সেই মাঠে তার মাহফিল আমি শুনেছি ।
এবং সেটা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে।
যুদ্ধের পর  এলাকায় তিনি  মাহফিল করেছেন?
করেছেন।
কবে করেছে বলতে পারবেন?
যুদ্ধের এক বছর পরে তিনি মাহফিল করেছেন।

জেরা:
প্রশ্ন : আপনি সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসছেন বলেছেন। সাঈদী সাহেবের সাথে আপনার পরিচয় কবে থেকে?
উত্তর : স্বাধীনতার দেড়/দুই বৎসর আগে থেকে।
প্রশ্ন : যে নান্না মিয়া (মাওলানা সাঈদীর শ্যালক) আপনাকে নিয়ে এসেছে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তার সাথে পরিচয় কবে থেকে?
উত্তর :  ১৫/২০ বৎসর পূর্ব থেকে।

প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের বাড়িতে আপননার যাওয়া আসা ছিল বা সাঈদী সাহেব আপনার বাড়িতে যাওয়া আসা করত?
উত্তর : সাঈদী সাহেবের বাড়িতে আমার যাওয়া আসা ছিলনা  এবং সাঈদী সাহেবও আমার বাড়িতে যাওয় আসা করতেন না।
প্রশ্ন : নান্না মিয়ার বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল আপনার?
উত্তর : নান্না মিয়ার পিতা ইউনুস মুন্সির পাড়েরহাট বাজারে কাটা কাপড়ের দোকান ছিল। সেই দোকানে আমরা কাপড় চোপড় সেলাই করতাম সেই হিসাবে পরিচয়।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব মুক্তিযুদ্ধের আগে কি করতেন জানেন?
উত্তর :  মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মাহফিল করতেন।
প্রশ্ন : কোথায় মাহফিল করতেন?
উত্তর : আমাদের গ্রামে দিঘির পাড় নামক এক মাঠ আছে সেই মাঠে তার মাহফিল আমি শুনেছি ।
এবং সেটা স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে।
প্রশ্ন : যুদ্ধের পর  এলাকায় তিনি  মাহফিল করেছেন?
উত্তর :  করেছেন।
প্রশ্ন : কবে করেছে বলতে পারবেন?
উত্তর : যুদ্ধের এক বছর পরে তিনি মাহফিল করেছেন।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেব গ্রেফতার হয়েছে এরকম কিছু শুনেছেন?
উত্তর : এখন গ্রেফতার হয়েছে শুনেছি।
প্রশ্ন : এখনকার নয়, এর আগে গ্রেফতার হওয়ার কথা শুনেছেন?
উত্তর :   আগে কখনও গ্রেফতার হয়েছেন কিনা তা আমি শুনি নাই।
প্রশ্ন :  মুক্তিযুদ্ধের পরে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শুনেছেন?
উত্তর : শুনি নাই। অভিযোগ হয় নাই।
প্রশ্ন : সাঈদী সাহেবের কি কি সম্পত্তি আছে তা জানেন?
উত্তর :  তা কি করে জানব?
প্রশ্ন :  তার ছেলেরা কে কি লেখাপড়া করেছে তা জানেন?
উত্তর :  সঠিক জানি না।
প্রশ্ন :  কুট্রির লাশ নৌকায় কে তুলেছিল তা দেখেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি এবং আপনার ভাগনে বাবুলের বিরুদ্ধে এক মহিলা মামলা করেছিল?
উত্তর :  হ্যা।  বাবুলকে ঐ মহিলার ছেলে কোপাইছিল।  তখন সেই ঘটনার জন্য আমি আমার ভাগনের পক্ষ হয়ে মহিলার বিরুদ্ধে মামলা করি। সেই  কারনে  ঐ মহিলা আমাদের দু জনকে আসামী করে মামলাটি করেছিল কাউন্টার হিসেবে। 
প্রশ্ন : বাবুলদের পৈত্রিক সম্পত্তি তারা কি ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে?
উত্তর : বাহাদুর অনেক সম্পত্তির মালিক এবং মধু এখনও বিবাহ করে নাই সে কারণে ভাগ বাটোয়ারা হয় নাই।
প্রশ্ন : ওই মহিলা যে মামলা করেছে সেখানে আপনার এবং আপনার ভাগনের বয়সের ব্যবধান দেখানো হয়েছে মাত্র দুই বছর।
উত্তর : সেখানে কার বয়স কি দেখানো হয়েছে বা না হয়েছে তা আমি জানিনা।
প্রশ্ন : আপনি সাঈদী সাহেবের  পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন। আপনি আসলে সাঈদী সাহেব সম্পর্কে কিছুই জানেননা।
উত্তর : ইয়েস । জানি।

প্রশ্ন : তখন গিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে সামনের খাল দিয়ে নৌকায় করে ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নিয়ে পাড়ের হাটের দিকে আসতেছে। নৌকায় কালাম চৌকিদার, আইয়ুব আলী চৌকিদার এবং হাকিম মুন্সি দেখি। এরপর দেখি আরও কয়েকজন লোক খালের পাড় দিয়ে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। যে সব লোক আসতেছে তাদের মধ্যে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, রুহুল আমিন, মোমিনা রাজাকার ছিল। আরও দেখি যে, উক্ত লোকেরা আজু হাওলাদারের বৌ এবং তার ছেলে সাহেব আলীকে বেঁধে নিয়ে আসতেছে এবং পাড়েরহাটের দিকে নিয়া যাচ্ছে। তারপর দিন শুনি আজু হাওলাদারের বৌ বাড়িতে আসে এবং সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে । আপনার এই কথাগুলি সত্য নয়। মিথ্যা বলেছেন।
উত্তর : আমি সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : স্বাধীনতার কিছু দিন পরে শুনেছি যে, ইব্রাহিম কুট্টির বৌ একটি মামলা করেছে। আপনার এ কথাও সত্য নয়।
উত্তর : সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার ভাগ্নে আব্দুল হালিম বাবুলের বাড়িতে কোন পাক সেনা এবং রাজাকার যায় নাই, লুট  হয় নাই, আগুন দেয় নাই এবং এরকম কোন ঘটনাই ঘটে নাই- আপনার এ কথাগুলিও সত্য নয়।
প্রশ্ন : আমি সত্য বলেছি।
প্রশ্ন : বাবুলের বাড়ি, খসরু মিয়ার বাড়ি, আমির খাঁর বাড়ি একই দিনে রাজাকাররা পুড়িয়ে দেয়। একথা জানা সত্ত্বেও সেটা গোপন করে আপনি  অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।
প্রশ্ন :  সাঈদী সাহেবের আত্মীয় স্বজনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আপনি  সাঈদী সাহেবকে রক্ষা করার জন্য এই মামলায় অসত্য সাক্ষ্য দিয়েছেন।
উত্তর : সত্য নয়।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীকে পরিচালনা করেন মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী অ্যাডভেকেট তাজুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম,  গিয়াসউদ্দিন আহমেদ মিঠু, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।  আগামী রোববার মাওলানা সাঈদীর পক্ষে তৃতীয় সাক্ষী হাজিরের কথা রয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক, সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি আনোয়ারুল হক  বিচার কার্যক্রমে অংশ নেন। 


আমার ভাগনে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে

মেহেদী হাসান, ৫/৯/২০১২, বুধবার
মাওলানা দেলাওয়ার  হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গত  ১৭  জানুয়ারি  ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন আব্দুল হালিম বাবুল। সাক্ষ্য দেয়ার সময়  তিনি  বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ অন্যান্য রাজাকার  এবং সশস্ত্র  পাক আর্মির লোকজন তাদের ঘরে প্রবেশ করে লুটপাট করে। এরপর তারা ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।  

সাক্ষী আব্দুল হালিম বাবুলের মামা আব্দুর রাজ্জাক আঁকন আজ  ট্রাইব্যুনালে এসে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। আব্দুর রাজ্জাক সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, তার ভাগনে আব্দুল হালিম বাবুল এই ট্রাইব্যুনালে এসে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আমার ভাগনে আব্দুল হালিমের বাড়িতে কোন পাক সেনা, রাজাকার যাই নাই। লুটপাট হই নাই। আগুন দেই নাই। এরকম কোন ঘটনাই ঘটেনি।

আব্দুর রাজ্জাক দ্বিতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিলেন  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে। জবানবন্দী শেষে  আজ তার জেরা শুরু হয়।

আব্দুর রাজ্জাকের জবানবন্দী :
আমার নাম আব্দুর রাজ্জাক আকন। পিতা মৃত ইসকান্দার আলী আকন। মাতা মৃত  আকিমুননেসা। আমার বয়স ৬৫ বছর। গ্রাম নলবুনিয়া। থানা জিয়ানগর। পিরোজপুর। আমি কৃষিকাজ করি। আমরা আট ভাইবোন। আমাদের সবার বড় বোন সাফিয়া খাতুন। এই বোনকে আমাদের পাশের বাড়িতে বিয়ে দেয়া হয়। তার তিন ছেলে। মেয়ে নেই। তিন ছেলেরা হল আব্দুল হালিম বাবুল, আব্দুস সালাম বাহাদুর এবং আব্দুল করিম মধু। আমি আজ সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য সাক্ষ্য দেয়ার জন্য  ট্রাইব্যুনালে এসেছি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে আমার ভাগিনা আব্দুল হালিম বাবুলের বাড়ি কোন পাক সেনা যাইনাই, কোন রাজাকার যাইনাই। লুট হয়নাই। আগুন দেই নাই। এরকম  কোন ঘটনাই ঘটেনি।
আব্দুল হালিম বাবুল এই ট্রাইব্যুনালে এসে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে।স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে  বাবুলের বয়স ছিল মাত্র আট নয় বছর।

এক বছর আগে শোনা গেল বাবুল সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে। একথা শুনে বাবুলের মা  বাবুলকে বলেন বাবা তুমি একরকম একজন ভাল মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেনা।  বাবুলের ভাই আব্দুস সালাম বাহাদুর এবং আব্দুল করিম মধুও বলেছে ভাইয়া তুমি এরকম সাক্ষ্য দেবেনা। উত্তরে বাবুল বলেছে আমি সাক্ষ্য দেব। তখন তার মা রাগে বাবুলের ঘর থেকে বের হয়ে  তার মেঝ ছেলে  আব্দুস সালাম বাহাদুরের  বাসায় ঢাকা আসেন। তার মা আমাকে বলেছেন, আমি যদি সুস্থ থাকতাম তাহলে সাঈদী সাহেবের পক্ষে গিয়ে সাক্ষ্য দিতাম। তুমি সব জান। তুমি গিয়ে সত্য সাক্ষ্য দিয়ে আসবা।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের নলবুনিয়ায় একটা ঘটনাই ঘটেছে। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন শেষ রাত্রে একটা আওয়াজ হয়।  আমি অনুমান করলাম এটা গুলির আওয়াজ। তারপর দেখি যে, ফজরের টাইম হয়ে গেছে। আমি আযান দিয়া নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার পর উত্তরদিকে রাস্তার পাশে যাই কোথায় কি হয়েছে জানার জন্য। তখন গিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে সামনের খাল দিয়ে নৌকায় করে ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নিয়ে পাড়ের হাটের দিকে আসতেছে। নৌকায় কালাম চৌকিদার, আইয়ুব আলী চৌকিদার এবং হাকিম মুন্সিকে দেখি। এরপর দেখি আরও কয়েকজন লোক খালের পাড় দিয়ে উত্তর দিক থেকে আসতেছে। যে সব লোক আসতেছে তাদের মধ্যে দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, মোসলেম মাওলানা, রুহুল আমিন, মোমিন রাজাকার ছিল। আরও দেখি  উক্ত লোকেরা আজু হাওলাদারের বৌ এবং তার ছেলে সাহেব আলীকে বেঁধে নিয়ে আসতেছে এবং পাড়েরহাটের দিকে নিয়া যাচ্ছে। তারপর দিন শুনি আজু হাওলাদারের বৌ বাড়িতে আসে এবং সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে। এটাই আমার বক্তব্য। স্বাধীনতার কিছুদিন পরে শুনেছি যে, ইব্রাহিম কুট্টির বৌ একটা মামলা করেছে।

আব্দুল হালিম বাবুল যা বলেছিলেন:
গত ১৭ জুন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  ১৪ তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন আব্দুল হালিম বাবুল। তিনি জবানবন্দীতে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ২ জুন আমি আমার নিজ বাড়িতে ছিলাম। ঐদিন আমি আমার বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর দাড়িয়ে ছিলাম। এসময় লোকজনের হৈচৈ শুনতে পাই। আমি লোকজনের কাছে  জানতে চাইলাম কি হয়েছে। তারা বলল পাক হানাদার বাহিনী আসতেছে।  আমরা সব সময় পাক হানাদার বাহিনীর  ভয়ে আতঙ্কে থাকতাম। তাদের আসার খবর পেয়ে তাড়াতড়ি বাড়ির লোকদের বললাম তোমরা সবাই সরে যাও।  তারা সবাই আত্মগোপন করে। আমিও আত্মগোপন করলাম। দূর থেকে দেখতে পাই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, দানেশ মোল্লা,  মোসলেম মাওলানা তার সাথে আরো কিছু   সশস্ত্র   রাজাকার   এবং পাক  সেনারা আমার ঘরে  প্রবেশ করে মালামাল লুটপাট করে।  লুটপাটের পর আমার   ঘরে  আগুন দেয়।

অথচ আজ  তার মামা ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়ে বললেন তার  ভাগনে সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীর জবানবন্দীর সময় সাক্ষীকে পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মনজুর আহমদ আনসারী। এসময় তাকে সহায়তা করেন  অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন, আবু বকর সিদ্দিক, হাসানুল বান্না সোহাগ প্রমুখ।

জেরা :
জেরার শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, আসামী পক্ষ থেকে আমাদের সাক্ষীর যে তালিকা দেয়া হয়েছে তাতে আব্দুর রাজ্জাক এবং আব্দুর রাজ্জাক খান নামে দুজন সাক্ষীর নাম আছে। আব্দুর রাজ্জাক আঁকন নামে কোন সাক্ষীর নাম নেই। তারা তালিকায় যে আব্দুর রাজ্জাকের নাম উল্লেখ করেছেন সেই আব্দুর রাজ্জাক আর আজকের আব্দুর রাজ্জাক আঁকন দুজন ভিন্ন ব্যক্তি।
তখন ট্রাইব্যুনালন বলেন, শুরুতে কেন এটা আপনি বলেননি। ট্রাইব্যুনাল আসামী পক্ষের আইনজীবীর কাছে বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দাবি করলে তাজুল ইসলাম বলেন, সাক্ষীর নিরাপত্তার  কারনে কোড নেম ব্যবহার করা যায়। সাক্ষীর নিরাপত্তার কারনে আমরা পারিবারিক পদবী আঁকন শব্দটি ব্যবহার করিনি। তালিকা আব্দুর রাজ্জাক নামে যে সাক্ষীর নাম আমরা জমা দিয়েছি তিনিই আজকের আব্দুর রাজ্জাক আঁকন।  শেষে ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তি এবং আসামী পক্ষের বক্তব্য রেকর্ড করেন জেরার শুরুতে। তারপর জেরা শুরু হয়।

সাক্ষীকে জেরা করেন সৈয়দ হায়দার আলী।
প্রশ্ন :  আপনার বড় বোন, বাবুলের মায়ের  বয়স কত ?
 উত্তর : ৮৫ বছরের উপরে হতে পারে।
প্রশ্ন :  আপনার বড় বোনের পরই কি আপনি?
উত্তর : না আমার উপরে আরও বড় তিন ভাই আছে।
প্রশ্ন : আপনার বড় বোনের বিয়ে হয় কবে বলতে পারবেন?
উত্তর : না। আব্বা বিয়ে দিয়েছেন।
প্রশ্ন : তার বিয়ের সময় আপনার বয়স কত ছিল?
উত্তর : তাও মনে নেই।
প্রশ্ন : বাবুলরা বড় কে?
উত্তর : বাবুল।
প্রশ্ন : বাবুলের জন্ম কবে মনে আছে?
উত্তর : তার আগে আরো চার ভাই জন্মের পর মারা যায়। বাবুলের জন্ম কবে তা মনে নেই।
প্রশ্ন : চারজন কোন সালে মারা গেছে তা মনে আছে?
উত্তর :  স্মরন নেই।
প্রশ্ন : আপনার বড় বোনের বিয়ের সময় ভগ্নিপতির বয়স কত ছিল?
উত্তর :  মনে নেই।
প্রশ্ন : কবে মারা গেছে সে?
উত্তর : স্বাধীনতার পর।
প্রশ্ন : তখন তার বয়স কত ছিল?
উত্তর : তাও জানা নেই।
প্রশ্ন : নলবুনিয়া গ্রাম কোন দিকে লম্বা?
উত্তর : উত্তর দক্ষিনে।
প্রশ্ন : লম্বায় কত?
উত্তর : আধা মাইল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের সময়  হাটবাজার করতেন?
উত্তর : মাঝে মধ্যে।
প্রশ্ন : আশ্বিন মাসে কয়বার পারেরহাট গেছেন?
উত্তর : একবার।
প্রশ্ন : হাটের দিন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আশ্বিন মাসের আগে পরে গেছেন?
উত্তর : গেছি তবে কম।
প্রশ্ন :  কেন কম গেছেন?
উত্তর : পাকিস্তানী এবং রাজাকারতে  ভয়ে।
প্রশ্ন : রাজাকাররা কি করত?
উত্তর : লুট ।
প্রশ্ন : বাড়িঘরে আগুন দিত?
উত্তর : হোগলাবুনিয়া গ্রামে আগুন দেয় শুনেছি।
প্রশ্ন : কাদের বাড়িতে আগুন দিত?
উত্তর : হিন্দুদের।
প্রশ্ন : মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দেয়ার কথা শুনেছেন?
উত্তর : শুনেছি।
প্রশ্ন : কোন মুসলমানদের বাড়িতে দিত?
উত্তর : মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে। শঙ্কর পাশা গ্রামে খসরু মুক্তিযোদ্ধা এবং তার বাড়ির পাশে আরো একজনের বাড়িতে আগুন দেয়।
প্রশ্ন : আপনাদের বাড়িতে কোন মুক্তিযোদ্ধা ছিল?
উত্তির : ছিল।
প্রশ্ন : নাম?
উত্তর : মোবারক। সম্পর্কে আমার ফুফাত ভাই।
প্রশ্ন : আপনার ভগ্নিপতি কি মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করতেন না রাজাকারদের  সমর্থন করতেন?
 উত্তর : তিনি ঘোর আওয়ামী লীগ করতেন।
প্রশ্ন : তার পেশা ?
উত্তর : মোহরার ছিলেন। একার মেম্বার হয়েছিলেন।
প্রশ্ন : জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে আপনার দুলাভাই বাড়িতে থাকত না পালিয়ে থাকত?
উত্তর : তাকে নিয়ে আমি পালিয়ে থাকতাম। অন্য গ্রামে এবং আমাদের গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে পালিয়ে থাকতাম।
প্রশ্ন : তিনি আওয়ামী লীগের কি ছিলেন?
উত্তর : ইউনিয়নের একটা পদে ছিলেন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার ক্যাম্পে গেছেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনার গ্রামে কোন রাজাকার ছিলনা এবং কেউ আসেওনি।
উত্তর : সত্য।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা ছিল?
উত্তর : সাত্তার নামে একজন ছিল।
প্রশ্ন : আর্মি ক্যাম্পে গেছেন কখনো?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আর্মি ক্যাম্প ছিল?
উত্তর : পারেহাটে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। সেখানে মাঝে মাঝে আর্মি আসত।
প্রশ্ন : দিনে পালাতেন না রাতে?
উত্তর : দিনে রাতে কোন সময় আমি পালাইনি। কারন রাজাকারদের কোন চাপ ছিলনা।
প্রশ্ন : আপনার বিয়ের সাল মনে আছে?
উত্তর : ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে।
প্রশ্ন : ঢাকায় কবে আসেন?
উত্তর : গতকাল।
প্রশ্ন কে নিয়ে এসেছেন?
উত্তর : রফিকের মামা।
উত্তর : রফিক কে?
উত্তর : সাঈদী সাহেবের ছেলে।
প্রশ্ন : আপকি কোথায় থাকেন। এ প্রশ্ন করার সাথে সাথে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয় দুই পক্ষের আইনজীবীর মধ্যে। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী তাজুল ইসলাম  এ প্রশ্নে তীব্র আপত্তি জানান। সাথে সাথে সৈয়দ হায়দার আলীও তা প্রত্যাহার করে নেন।
প্রশ্ন : বাবুলের মা কি করম অসুস্থ
উত্তর : পুরো পুরি সুস্থ না। বয়স হয়েছে। কোন রকম চলাফেরা করতে পারেন।
প্রশ্ন : তিনি বেশির ভাগ সময় কোথায় থাকেন?
উত্তর : ঢাকা।
প্রশ্ন : এখন কোথায়?
উত্তর : আমাদের  বাড়িতে।
প্রশ্ন : ঢাকায় এসে কোথায় থাকেন?
উত্তর: ধানমন্ডি ছেলের বাসায়।
প্রশ্ন : লঞ্চ ঘাট থেকে আপনার বাড়ি কতদূর?
উত্তর : ৪/৫ মাইল।
প্রশ্ন :  “এক বছর  আগে শোনা গেল আব্দুল হালিম বাবুল সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা  সাক্ষ্য দেবে।  এই কথা শুনে তার মা তাকে  বলেছিল যে, বাবা তুমি এরকম ভাল মানুষের বিরুদ্ধে অসত্য সাক্ষ্য দিবে না। তার ভাই মধু ও বাহাদুর তাকে বলেছিল ভাইয়া তুমি এরকম সাক্ষ্য দিও না।” এই কথাগুলি অসত্য, আপনি মিথ্যা বলেছেন।
উত্তর :  আমার কথা সত্য। 
প্রশ্ন :     “তার মা আমাকে বলে ভাই আমি যদি সুস্থ থাকতাম তাহলে সাঈদী সাহেবের পক্ষে সত্য সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে যেতাম। তুমি তো সব জান, তাই আমি অসুস্থ বিধায় তুমি গিয়ে সত্য সাক্ষ্য দিয়ে আস। ।” এই কথাগুলি অসত্য, ।
উত্তর  : আমার কথা সত্য।
প্রশ্ন : আব্দুস সালাম বাহাদুর ঢাকায় কি করে তার বয়স কত?
উত্তর : ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে। তার বয়স ৪০ হয়নি।
প্রশ্ন : আব্দুল করিম মধুর বয়স কত?
উত্তর : ৩৫ হবে।
প্রশ্ন : যুদ্ধের সময় বাহাদুর এবং মধু কোথায় থাকত?
উত্তর : বাড়িতে ।
প্রশ্ন : আশ্বিনের মাঝামাঝিঢ় গুলি শোনার কথা বললেন। ওটা যে গুলির শব্দ কিভাবে বুঝলেন?
উত্তর : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অন্যান্য সময়েও গুলির আওয়াজ শুনেছিলাম।
প্রশ্ন : অন্যান্য সময় গুলির শব্দ শুনে তার খোঁজ নিতে সেখানে গিয়েছিলেন?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : তাহলে ওই সময় কারা গুলি করেছে তাও জানেননা।
উত্তর : না।
প্রশ্ন : জৈষ্ঠ্য মাসে পারেরহাট বাজারে গেছেন?
উত্তর : মনে হয় একবার ।
প্রশ্ন :  আপনার ভগ্নিপতি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পারেরহাট বাজারে যেত?
উত্তর : না।
প্রশ্ন : আপনি পারেরহাট গেলে কেউ আপনাকে ভয়ভীতি,  হুমকি বা  খারাপ ব্যবহার করত?
উত্তর : কারো সাথে  আমার সাক্ষাতও হয়নি ভয়ভীতিও দেখায়নি। আমি শেষ বেলায় যেতাম।
প্রশ্ন : সবসময় শেষ বেলায় যেতেন?
উত্তর : হ্যা। সংসারের কাজকর্ম শেষ করে যেতাম।
প্রশ্ন : কারো সাথে দেখা হয়নি বলতে আপনি কাদের মিন করেছেন?
উত্তর : রাজাকার।
প্রশ্ন : রাজাকাররা কখন থাকে বা না থাকে তা জানতেন?
উত্তর : না।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম তালুকদার

মেহেদী হাসান, ২/৯/২০১২, রোববার 
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে ট্রাইব্যুনালে (১) ।   তার পক্ষে প্রথম সাক্ষী হিসেবে আজ  সাক্ষ্য দিয়েছেন নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুক্তিযোদ্ধা শামসুল  আলম  তালুকদার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয়  কমান্ড কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।   শামসুল আলম তালুকদার ট্রাইব্যুনালে   তার জবানবন্দীতে বলেন,  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের পারেরহাটে কে কি অপরাধ করেছে তা স্বাধীনতার পর লোকজন আমাকে বলেছে। কিন্তু মাওলানা সাঈদী সাহেব সম্পর্কে আমাকে তখন কেউ কিছু বলেনি। যদি সাঈদী সাহেব কোন অন্যায় কাজ করতেন তাহলে আমি কমান্ডার হিসেবে  লোকজন  আমার নিকট তা অবশ্যই বলতো।
শামসুল আলম তালুকদার বলেন, ৮ ডিসেম্বর পারেরহাট মুক্ত হওয়ার পর  মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনসহ  (সুন্দরবন সাব সেক্টরের  কমান্ডার ) আমি সেখানে যাই। মেজর জিয়াউদ্দিন ১০/১৫ মিনিট ছিলেন। আমাকে উনি পারেরহাটের  সমস্ত অবস্থা জেনে ২/৩ ঘন্টা পরে পিরোজপুরে আসতে বলেন।  সেখানে আমাদের কমান্ডার খসরু, মোকাররম, লিয়াকত আলী বাদশা, বাতেন, মুনাম, সানু খোন্দকারসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারন তাদের অবস্থা বর্ণনা করে। আমি পারেরহাট মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করি। মোসলেম মওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, রাজ্জাক, দুইজন চৌকিদারসহ আরও কয়েকজন কে কি অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা করে। ঐ সময়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু বলে নাই।

জবানবন্দী :
আমার নাম মোঃ শামসুল আলম তালুকদার, বয়স- ৬৮ বছর।
আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার ইকরি গ্রামে এবং বাগেরহাট জেলার শরনখোলা থানার খুন্তাকাটা গ্রামে।  পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার দিঘিরজান হাইস্কুল থেকে আমি ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাশ করি। তৎপর বাগেরহাট পি,সি কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। ঐ একই কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করি। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে আমি পি,সি, কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬৪ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের খুলনা জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক  এবং  ১৯৬৫ সালে একই জেলার  সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হই। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হই। ১৯৬৯ সালে আমি মাওলানা ভাষানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগদান করি এবং শরনখোলা থানা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হই। ছাত্র অবস্থায় আমি হামিদুর রহমান শিক্ষা রিপোর্ট বিরোধী এবং পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য দুবার কারাবরন করি। ১৯৭০ সালে আমি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নোমিনেশন পেপার দাখিল করি। তখন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলে সর্বনাশা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্যের জন্য এবং অগনিত লাশ দাফন করার জন্য আমার নেতা ভাষানীর নির্দেশক্রমে আমি নির্বাচন থেকে বিরত থাকি।

ছাত্র জীবন থেকেই আমি সামাজিক কর্মকান্ডের সহিত জড়িত। ১৯৬২ সালে আমি আমার গ্রামে খোন্তাকাটা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করি এবং এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় জমি আমি এবং আমার পরিবার দান করি। ১৯৭৯ সালে ঐ স্কুলের পাশেই একটি জুনিয়র গার্লস স্কুল যার নাম বর্তমানে বি,কে গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করি এবং সেখানেও আমি এক একর জমি দান করি। ১৯৬৩ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে আমি তাফালবাড়ি হাইস্কুলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি এবং চাঁদা দিয়ে সবার সহযোগিতায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৭৮ সালে শরনখোলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করি এবং ঐ কলেছে ১৪ কুরা  (এক কুরা= ৬৬ শতক) জমি দান করি। ১৯৬২ সালে শরনখোলা- মোড়লগঞ্জের ছাত্রদের নিয়ে মোড়লগঞ্জে একটি কলেজ করার প্রস্তাব করি এবং পরবর্তীতে   কলেজ প্রতিষ্ঠা করি । সেখানে প্রথম চাঁদা দিই আমি নিজে। বর্তমানে উক্ত কলেজটি এস,এম কলেজ নামে পরিচিত। এভাবে  শরনখোলা থানায় রাজাপুর হাইস্কুল, জনতা হাইস্কুল, বাগেরহাট খানজাহান আলী কলেজ, বাগেরহাট আদর্শ বিদ্যালয়, ভান্ডারিয়া আব্দুস সোবহান মাদ্রাসা  প্রতিষ্ঠা করি সকলের সহযোগিতায়।  ১৯৭০ সালে বাগেরহাট ফাউন্ডেশন জনাব মোস্তাফিজুর রহমান সাহেবের সহযোগিতায় আমরা গরীব দুঃখী ছাত্রদের সহযোগিতার জন্য প্রতিষ্ঠা করি, উক্ত ফাউন্ডেশনে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি টাকা আছে। .....আমার গ্রামে মাছের ঘের এবং যথেষ্ট জমি আছে।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পরে ঘটনা পরম্পরায় আমরা বুঝতে পারি যে, আলোচনায় কোন কাজ হবে না। পরে আমরা এলাকায় যুব সমাজকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে আমরা কিছু চাল, ডাল, খাবার দাবার যোগাড় করে শরনখোলা সংলগ্ন সুন্দরবনের ভিতরে একটা আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করি যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনে সেগুলো কাজে লাগাতে পারি। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে মোড়লগঞ্জে প্রথম রাজাকাররা আসে। ঐ সময়ে ওখানে কিছু পুরানো বাঙ্গালী আর্মি অফিসার এবং অন্যান্য আর্মির লোক ছিল যার মধ্যে কবীর আহমেদ মধু ছিল, তাদের এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা যুবকের নিয়ে আমরা মোড়লগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের রাজাকার ক্যাম্প রাত্রি অনুমান ১১-টায় আক্রমন করি। আক্রমনে আমাদের আবু নামে একটি ছেলে শহীদ  হয়।   তিনজন রাজাকার মারা যায়। রাজাকাররা খুব ভোরে মোড়লগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে মোড়লগঞ্জের দুই মাইল দক্ষিণে রাজা গোবিন্দের বাড়িতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করি। এইভাবে আমরা তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের যে সমস্ত নেতা ছিলেন, তাদেরকে একত্রিত করে রাজা গোবিন্দর বাড়িতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করি। আমরা খবর পেলাম মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব একটি বাড়িতে অবস্থান করছেন।  তখন আমরা একটি দল তৈরি করে তাকে স্বসম্মানে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়ে দিই এবং সন্ধ্যার ভিতর তাকে নিয়ে আসা হয়। তারপর তিনি আমাদের নিকট থেকে সব কিছু শুনেন। শোনার পরে আরও লোকজন একত্রিত করে আমরা একটা বৈঠকে বসি। উক্ত বৈঠকে সবাই মিলে মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেবকে উক্ত এলাকার কমান্ডার নিযুক্ত করি। উক্ত বৈঠকে দেড়/দুই হাজার মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিল। আমাকে সেকেন্ড ইন কমান্ড  নিয়োগ করা হয়। দুইদিন পরে পাকিস্তান আর্মি মোড়লগঞ্জ আক্রমণ করে। আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করি। সুন্দরবনে প্রবেশ করে আমরা রণ নীতি এবং রণ কৌশল কিছুটা পরিবর্তন করি ।  মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেবকে ভারত হতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য নৌকা যোগে ভারত পাঠিয়ে দিই । আমরা ছোট ছোট খালের ভিতর  গিয়  গাছের উপর ছোট ছোট টং তৈরি করি যেখানে প্রতিটি টংয়ে ২০/৩০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে। পরবর্তীতে আমরা কলেজ ছাত্র বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক এবং স্কুল ছাত্র বা তার কম বয়স্ক দুটি গ্রুপ তৈরি করি ।  প্রত্যেকেই আস্তে আস্তে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করে সবাইকে ট্রেনিং দেয়া শুরি করি। এভাবে  একটা বিরাট মুক্তিবাহিনী দল তৈরি হয়। তাদের ট্রেনিংয়ের জন্য আমরা গাছ কেটে মাঠ সমতল করে প্যারেড গ্রাউন্ডের মত তৈরি করি। আমাদের মধ্যে মহিলা মুক্তিযোদ্ধাও ছিল, তাদের একটি ভিন্ন গ্রুপ তৈরি করি। মেজর জিয়াউদ্দিন না ফেরা পর্যন্ত আমরা কোন বড় ধরনের অপারেশনে যাই নাই। আমাদের ঐ ক্যাম্পে আমার স্ত্রী, পটুয়াখালীর সর্দার রশিদ এবং তার দুই বোন আনু ও মনু এবং আরও অনেকে ছিলেন।  তাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল। রুটি বানানো, কাপড় সেলাই, রান্নাসহ   ক্যাম্পে অন্যান্য কাজও করতেন। আমরা ঐখানে একটি ছোট খাট ক্যান্টমেন্টের মত গড়ে তুলি। ইতিমধ্যে মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব ১১ টি নৌকা ভরে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনে ফিরে আসেন। ঐ এলাকার সাউথখালী ইউনিয়নে কোন রাজাকার কখনও ঢুকতে পারে নাই ।  সর্বদা ঐ জায়গা আমাদের দখলে ছিল এবং সেখানে আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব আসার পরে আমাদের সংগে সিদ্ধান্ত হয় যে, আমরা মোড়লগঞ্জ থানা আক্রমণ করব।  তখন মেট্রিক পরীক্ষা হচ্ছিল। মোড়লগঞ্জে তখন পাঁচটি রাজাকার ক্যাম্প ছিল। আমরা ছয়টি গ্রুপ করলাম।  থানা আক্রমণের গ্রুপে সুবেদার আজিজকে দায়িত্ব দেয় হয় যিনি বর্তমানে ভান্ডারিয়া থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। কবির আহম্মদ মধুকে রায়ের বিল্ডিং রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কুঠিবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সুবেদার গফফারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মোড়লগঞ্জ কে.সি. হাইস্কুল রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য কবীর মুকুলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মোড়লগঞ্জ কলেজ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য মেজর জিয়াউদ্দিন নিজে দায়িত্ব নেন এবং সংগে আমাকে রাখেন।  আমরা কলেজকে পশ্চাদপদ রেখে স্কুল আক্রমণ করি। স্কুলের ভেন্টিলেটর দিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিন গ্রেনেড চার্জ করেন। রাজাকাররা হতাহত হয়। তাদের ১৪/১৫ জনকে আমরা আটক করি। আমাদের দুইজন মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং সুন্দরবনে নেওয়ার পথে উক্ত দুইজন মারা যায়। যে সব রাজাকারদের আমরা আটক করি তাদেরকে মেরে ফেলা হয়। আমাদের বিজয়ে গ্রামের লোকেরা আনন্দ প্রকাশ করে এবং আমাদেরকে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী দেয় ।  জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে বরণ করে নেয়।

পরবর্তীতে প্যারেড গ্রাউন্ডে আমরা মিটিং করি এবং কিভাবে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ চালাবে সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করি। ঐ সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই যোগদান করছিল। মেজর জিয়াউদ্দিনের সুযোগ্য নেতৃত্বে সমগ্র এলাকায় অর্থাৎ বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন থানায় কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ চালাবো সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করি। মেজর জিয়াউদ্দিনের তখন বয়স কম হলেও  অত্যন্ত সাহসী এবং কুশলী ছিলেন । আমরা ঝালকাঠির শাহজাহান ওমর সাহেব এবং পটুয়াখালীর মেহেদী সাহেবের সংগেও যোগাযোগ করি এবং হাজার হাজার শরনার্থী আসতেছিল তাদেরকেও ভারতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। ছোট ছোট কিছু আক্রমন পরিচালনার পর  মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেবকে আবার ভারতে পাঠানো হয় এবং তিনি ১৫ দিন পরে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এবং অন্যান্য ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে আবার ফিরে আসেন। রণ নীতি এবং রণ কৌশল পরিবর্তন করে আমরা এবার থানা আক্রমণ শুরু করলাম। প্রথম তুযখালী বন্দর আক্রমণ করে ছয় হাজার মন চাল, দেড়শ রাজাকার ও পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসি। সেখান থেকে দুই হাজার মন চাল ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়ে দেই। এই আক্রমণের পরে আমাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে বিমান এবং গানবোটের মাধ্যমে আক্রমণ করা হয় কিন্তু তারা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে নাই। এরপর আমরা পিরোজপুরের কাউখালী থানা আক্রমণ করি। সেখানে আমরা দুইজন পাঞ্জাবী পুলিশসহ অন্যান্য পুলিশ ও অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে চলে আসি। এরপর ভান্ডারিয়া থানা আক্রমণ করি। ঐ থানার ও.সি সাহেব অস্ত্র-শস্ত্র ও পুলিশসহ আমাদের ক্যাম্পে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এরপর আমরা মংলা  পোর্টে নেভাল পার্টি পাঠাই। তারা তিনটি জাহাজ  ধ্বংস করে আমাদের ক্যাম্পে চলে আসে। তখন প্রায়ই গানবোটের মাধ্যমে আক্রমণ হতো। আমরা ৫/৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে একটি বিশেষ স্থানে রেখে নির্দেশ দিলাম যে, গানবোট দেখলেই গুলি করবে যেন তারা মনে করে সে স্থানে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প অবস্থিত। পরবর্তীকালে তারা ঐ স্থানে বার বার আক্রমণ করে গোলাগুলি করে চলে যেত। ফলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ক্ষতি তারা করতে পারে নাই। পরবর্তীতে আমরা পিরোজপুর এবং বাগেরহাট অঞ্চলের অধিকাংশ থানায় আক্রমণ করি তবে তার পূর্বেই সেই সব থানার পুলিশ এবং রাজাকাররা আমাদের ক্যাম্পে এসে আত্মসমর্পণ করে । এর একটা কারণ ছিল সেটা হলো তুষখালী ক্যাম্প আক্রমণের পরে যে সব রাজাকারদের আমরা রাইফেলের পিন ভেঙ্গে ছেড়ে দিয়েছিলাম তারা ফেরত গিয়ে প্রচার করে যে, মুক্তিযোদ্ধারা কারো প্রতি অত্যাচার করে না বরং তারা বন্ধু মনোভাবাপন্ন । এই প্রচারে কাজ হয় এবং তারপরই পুলিশ এবং রাজাকাররা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করে। এই প্রচারের ফলে পিরোজপুর এবং বাগেরহাট থেকে অনেক রাজাকাররা গোপনে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

হঠাৎ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধি স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে সবাই আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে।  ইতিমধ্যে আমরা একবার পিরোজপুরে মেজর জিয়াউদ্দিনের মায়ের সংগে দেখা করার জন্য রাত্রে সশস্ত্র অবস্থায় যাই এবং সবাইকেই সবার সংগে ভাল ব্যবহার করার জন্য বলি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন থানার দায়িত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণকরি । দোষীদের গ্রেফতার করে পুলিশে দেওয়ার জন্য আদেশ করি, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে নিতে না পারে সেভাবে নির্দেশ দেয়া হয়।  আমাদের সুন্দরবনের দলে তিন থেকে চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদেরকে বলা হয়েছিল যে, আমাদের ইন্সাট্রাকশন ব্যতীত তাদের নিকট রক্ষিত কোন আর্মস বা অন্য কোন কিছু কারো কাছে হস্তান্তর করবে না। আমাদের যোগাযোগ ছিল ভারতের সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সালেকের সঙ্গে এবং তার নির্দেশ মতই আমরা যা করার তা করতাম।

এই অবস্থায় আমরা ৮ই ডিসেম্বর মেজর জিয়াউদ্দিন সহ পিরোজপুরের পাড়ের হাটে যাই। মেজর জিয়াউদ্দিন ১০/১৫ মিনিট ছিলেন। আমাকে উনি সমস্ত অবস্থা জেনে ২/৩ ঘন্টা পরে পিরোজপুরে আসতে বলেছিলেন। সেখানে আমাদের কমান্ডার খসরু, মোকাররম, লিয়াকত আলী বাদশা, বাতেন, মুনাম, সানু খোন্দকার সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক জনসাধারন তাদের অবস্থা বর্ণনা করে। আমি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ও রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করি। মোসলেম মওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার, রাজ্জাক, দুইজন চৌকিদারসহ আরও কয়েকজন কে কি অত্যাচার করেছে তার বর্ণনা করে। ঐ সময়ে দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সম্পর্কে আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ঐ দিন আমরা রাত্রে পিরোজপুরে অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমরা সমস্ত অস্ত্র সারেন্ডার করি।

দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের ছেলে মাসুদ সাঈদী আমাকে তার পিতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার অনুরোধ করে বলেছেন যে,  যা সত্য আমি যেন তাই বলি ট্রাইব্যুনালে গিয়ে। তাই এখানে এসে সাক্ষ্য দিলাম।  আমি সাক্ষ্য দিতে এসে একটিও মিথ্যা কথা বলিনি। যদি সাঈদী সাহেব কোন অন্যায় কাজ করতেন তাহলে আমি কমান্ডার লোকজন তখন আমার নিকট তা বলতো।
জবানবন্দী শেষে শামসুল আলম তালুকদারকে জেরা করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী।

জেরা :
প্রশ্ন :  মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে এমন দুয়েকটি রাজনৈতিক দলের নাম বলতে পারবেন তো?
উত্তর :  মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম সহ অনেক দল ছিল।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের পরেও আপনি  ভাসানী ন্যাপে ছিলেন?
উত্তর : জিয়াউর রহমানের সময়ে ভাসানী ন্যাপ তার সঙ্গে মিটিং করে নিজেদের দলকে সাসপেন্ড করে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে তৈরি করে।
প্রশ্ন : আপনারা  যখন ফ্রন্টে যোগ দেন  তখন আপনাদের পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন মশিউর রহমান জাদু মিয়া।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাওলানা ভাসানী যখন পার্টির প্রধান ছিলেন তখন এই যাদু মিয়া পার্টির সেক্রেটারি  ছিলেন।
উত্তর : মশিউর রহমান যাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধের পরে কারাগারে আটক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার কারনে।
উত্তর : আটক ছিলেন জানি তবে কি করনে তা জানা নেই।
প্রশ্ন : ভাসানী ন্যাপের পরে রাজনীতিতে ছিলেন?
উত্তর : জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট হয়ে আমি বি,এন,পি কে যোগদান করি।
উত্তর : কখন?
উত্তর : ১৯৭৯ সালে আমি বিএনপিতে যোগদান করি।
প্রশ্ন : বিএনপিতে কি ছিলেন আপনি?
উত্তর :  বিএনপিতে  যোগ দেয়ার পর বাগেরহাট জেলা সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হই।
উত্তর : এখনো আছেন রাজনীতিতে?
উত্তর : এখন নিরব। শরীর খারাপ তাই নিরব আছি।
প্রশ্ন : আপনি বিএনপিতে থাকা অবস্থায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে  মামলা করেছিলেন?
উত্তর : হ্যা। সাংগঠনিক কারনে মামলা করেছিলাম এবং প্রেস কনফারেন্সও করেছিলাম।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধকালীন আপনার কোন অফিসিয়াল রেকর্ডপত্র পাওয়া যাবে?
উত্তর : সেসময় কোন অফিসিয়াল রেকর্ডপত্র ছিলনা।
প্রশ্ন :  আপনার একাধিক স্ত্রী আছে।
উত্তর : বর্তমানে আমার দুজন স্ত্রী আছে।
প্রশ্ন : আপনার এক স্ত্রী আপনার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তিনি কততম?
উত্তর : ২য় স্ত্রী আমার বিরুদ্ধে জমিজমা সংক্রান্ত একটি মামলা করেছিল।
প্রশ্ন : আপনার ওই স্ত্রী আপনার  বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে বাগেরহাট থানায় মামলা নং ২৭ তারিখ ১৭-০৭-২০০৯ ইং ধারা ১১(গ) জি,আর ৩৩৮/০৯, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নং ১৯/২০১০ দায়ের করেছিল।
উত্তর : হ্যা। আমার ঐ স্ত্রীর নাম রেহেনা তালুকদার।
প্রশ্ন : তিনি কি এখনো আপনার স্ত্রী আছেন?
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : আপনার বিরুদ্ধে চাাঁদবাজির মামলা হয়।
উত্তর : হ্যা, চাাঁদাবাজি, মাছ লুট ঘের লুটের মামলা হয়।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম স্ত্রীর নাম নাসিমা।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : তার সাথে বর্তমানে আপনার সম্পর্ক কি ?
উত্তর : তালাক হয়েছে।
প্রশ্ন :  মেজর (অব) জিয়া উদ্দিনের বই সম্পর্কে জানা আছে?
উত্তর : আছে।
প্রশ্ন :  তার সাথে পারেরহাট আসা বিষয়ে আপনি  যে বর্ননা দিয়েছেন তার সাথে জিয়অ উদ্দিনের বইয়ের বর্ননার মিল নেই।
উত্তর : একই ঘটনা  ভিন্ন ভিন্ন লোকের বর্ননা ভিন্ন হবে। আমি জানি মেজর জিয়াউদ্দিন সাহেব মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন। আমি পাড়ের হাটে জিয়াউদ্দিন সাহেবের সাথে যাওয়ার সমস্ত ঘটানর বর্ণনা আমার জবানবন্দীতে দিয়েছি তাহা জিয়াউদ্দিন সাহেবের বইয়ে সেভাবে নাও থাকতে পারে।
প্রশ্ন : ভাসানী ন্যাপের ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি ধারা ছিল।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : মশিউর রহমান যাদু মিয়া সাহেব মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের ধারার নেতা ছিল,
উত্তর : হিস্টরি পিটিস ইটসেলফ।  মশিউর রহমান সাহেব ভারতে  গেলেন যুদ্ধের জন্য। পরে তিনি  প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এলেন ভারত থেকে। (এরপর তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বাম দলের মধ্যে বিভক্তি এবং ভিন্ন পলিসি বিষয়ে বর্ননা করেন। )
প্রশ্ন : ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি জামাত একজোট হয়ে রাজনীতি করছে।
উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন : পারেরহাটের যে রাজাকারদের নাম আপনি বলেছেন এবং যাদের নাম মনে নেই বলেছেন তারা কি পালিয়ে গিয়েছিল>
উত্তর : যারা  লুটপাট অত্যাচার করেছে তারা কি পালিয়ে না গিয়ে সামনে  ঘুরে বেড়াবে তখন?
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যেসব দল ও মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদের পুনর্বাসানের যাদু মিয়া এবং আপনার ভূমিকা ছিল।
উত্তর : কোশ্চেন ডাজ নট এরাইজ এট অল।
প্রশ্ন : বিএনপি জামায়াতের জোট থাকায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকান্ড জানা থাকা সত্ত্বেও আপনি তা গোপন করেছেন ইচ্ছাকৃতভাবে।
উত্তর : আপনার সাথে আমি একমত নই।
 জেরা শেষ হলে শামসুল আলম তালুকদার ট্রাইব্যুনালের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন,  আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে সাক্ষী দিতে আসার চারদিন আগে আমার বাসায় গিয়ে পুলিশ হাজির হয়। আমি এ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিলাম। ট্রাইব্যুনালের একটি নৈতিক দায়িত্ব আছে আমার নিরাপত্তার বিষয়ে। আমি  নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা করছি। আমার যাতে কোন সমস্যা না হয় সেটি  দয়া করে দেখবেন।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে আইন আছে।  আসামী পক্ষের আইনজীবীরা চাইলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গতকাল রাষ্ট্রপক্ষে সৈয়দ হায়দার আলী ছাড়া চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, সুলতাম মাহমুদ  সিমন উপস্থিত ছিলেন।
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে  অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর  আহমদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আল আমিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মনজুর আহমদ আনসারী সাক্ষী পরিচালনা করেন।