শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

পিডব্লিউ ৯

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১২
আমি এস. আই মোঃ আমিনুল ইসলাম। আমার বয়স ৩৭ বৎসর।
 আমি বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর থানার এস. আই হিসাবে কর্মরত আছি। বিগত ০৯-০১-২০১১ ইং তারিখে আমি পুলিশ সুপারের কার্যালয়, মিল ব্যারাক ঢাকা রিজার্ভ অফিসার ২ হিসাবে কর্তব্যরত ছিলাম। ঐদিন অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জনাব মতিউর রহমান সাহেব তার কয়েকজন সহকর্মীসহ আমাদের অফিসে এসে শহীদ এস.আই সিরুমিয়া এর চাকুরী সংক্রান্ত, কাগজপত্র দেখতে চান। আমি উধ্বংতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের স্মারক নং ৩৫৯৯/আর ও তারিখ ১৪-০৮-৯৬ ইং সহ সংযুক্ত কাগজপত্র দেখাই। তখন তিনি এ কাগজপত্রের ফটোকপি করেন এবং আর আই সাহেব এ ফটোকপিগুলি সত্যায়িত করার পর আমার সম্মুখে ঐ গুলি জব্দ নামা মূলে জব্দ করেন। এই সেই জব্দ তালিকা প্রদর্শনী- ৫১১ এবং উহাতে সাক্ষী হিসাবে আমার একটি দস্তখত প্রদর্শনী ৫১১/১ হিসাবে চিহ্নিত হল। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঐ সত্যায়িত ফটোকপি জব্দ করার পর মূল কাগজপত্র জিম্মানামা মূলে আমার জিম্মায় দেন এং আমি উহা গ্রহণ করি। এই সেই জিম্মানামা প্রদর্শনী -৫১২ এবং উহাতে জিম্মা গ্রহণকারী হিসাবে আমার দস্তখত প্রদর্শনী ৫১২/১ হিসাবে চিহ্নিত হল। এই সেই জব্দকৃত সংযুক্তিসহ স্মারক প্রদর্শনী-৫১৩ হিসাবে চিহ্নিত হইল।

জেরাঃ
স্মারকের সংযুক্ত তালিকায় সহকারী দারোগা ৪৯৪ মুহাম্মাদ সিরু মিয়া পিতা-মৃত আমিনুদ্দিন মিয়া নামে একজনই আছে। তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মাতা দুদ মেহের বিবি উল্লেখ আছে। (সমাপ্ত)


সফিউদ্দিন আহমেদ,

বুধবার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২
আমার নাম সফিউদ্দিন আহমেদ, আমার বয়স-৫৮ বৎসর।
আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা থানাধীন রামনগর গ্রামে। আমি ১৯৬৯ সালে আমাদের গ্রামের রামকৃষ্ণপুর কে,কে,আর,কে উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস,এস,সি, পাশ করি। ১৯৭০ সালে আমি তদানিন্তন পাকিস্তানের করাচিতে সরকারি বাংলা মহাবিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই। ১৯৭১ সালের জুন মাসে আমি পি,আই,এ, বিমান যোগে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসিয়া আমার গ্রামের বাড়িতে যাই। আমার পার্শ্ববর্তী গ্রাম রামকৃষ্ণপুর শহীদ সিরু মিয়া দারোগার বাড়িতে অস্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প ছিল। আমি সেখানে যোগাযোগ করি। ওখানে আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সকল কাজ শুরু করি। আমার কাজ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐ ক্যাম্প থেকে মুজিব নগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদের স্ত্রী জোহরা তাজুদ্দিনকে আমরা ভারতে পাঠিয়ে দিই। এর কিছুদিন পরে সাবেক রাষ্ট্রপতি জনাব বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে তার পরিবার পরিজন সহ একই ভাবে ভারতে পাঠিয়ে দিই। ঐ ক্যাম্প থেকে সিরু মিয়া দারোগার সংগে আমি সহ মোট ২৫জন ২৫শে অক্টোবর রাতে ভারতের উদ্দেশ্যে নৌকা যোগে রওনা করি। অন্যরা ছিলেন জনাব সিরু মিয়ার সন্তান শহীদ আনোয়ার কামাল, দাউদকান্দি থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার শহীদ নজরুল ইসলাম, শহীদ আবুল কাশেম, জাহাঙ্গীর সেলিম। আমরা প্রথমে সিমান্তবর্তী এলাকায় ছত্রা গ্রামে পৌঁছি এবং সেখানে ২৬শে অক্টোবর অবস্থান করি। ২৭শে অক্টোবর আমরা সিমান্তের দিকে রওনা করি। আমাদের সাথে ছিলেন আমাদের গাইডম্যান তালেব। সে এসে আমাদেরকে খবর দেয় রাস্তা কিয়ার। তখন আমরা সেই রাস্তা দিয়ে রওনা করি। রওনা করার আগে সিরু মিয়া দারোগা তার স্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখে চিঠিটি তালেবকে দেয় তার স্ত্রীর নিকট পৌঁছাবার জন্য। রাস্তার উপর উঠার সংগে সংগে রাজাকারদের চেক পোষ্ট তন্তরে পৌঁছালে হঠাৎ ২০/২৫ জন রাজাকার আমাদের ৬জনকে ঘিরিয়া ফেলে এবং আমাদের দুইজন দুইজন করে বেঁধে ফেলে। সিরু মিয়াকে তার ছেলে আনোয়ার কামালের সংগে, নজরুলকে জাহাঙ্গীর সেলিমের সংগে এবং আমাকে আবুল কাশেমের সংগে বাঁধে। ৫/১০ মিনিট পরে কুমিল্লার দিক থেকে একটি পাকিস্তান আর্মির জীপ আসে এবং সেই জীপ থেকে ৫/৬ জন আর্মি নামে। নজরুল এবং সিরু মিয়া দারোগার কাছে দুটি রিভলবার ছিল। তারা রিভরবার দুটি নিয়ে নেয়। এরপরে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গামী একটি চাউলের ট্রাকে তোলা হয় এবং সংগে ৫/৭ জন রাজাকারকে আমাদেরকে পাহারা দেওয়ার জন্য দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রথম প্রান্তে আমাদেরকে ট্রাক হতে নামায়ে নেয় এবং তৎপর পায়ে হাটিয়ে  আমাদেরকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আমদেরকে মাঠে রাখা হয়, অনেক লোকজন আমাদেরকে দেখতে আসে। এরমধ্যে সাদা পাঞ্জাবী পরা হাতে বেত সহ এক ব্যক্তি আসেন এবং তিনি আমদেরকে গালাগালি করেন। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি সেই লোকটির নাম পেয়ারা মিয়া। পেয়ারা মিয়ার সংগে ৫/৭ জন যুবক বয়সের ছেলে ছিল। তারা আমাদের হাতের ঘড়ি ও আংটি ছিনিয়ে নেয়। এরপরে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা স্কুলের সামনে কালি বাড়ি, তখনকার নাম ছিল রাজাকার মঞ্জিল সেখানে হাটিয়ে নিয়ে যায়। পথে হ্যান্ড মাইক দিয়ে ঘোষণা করা হয় স্পেশাল বাহিনীর ৬জন অস্ত্র সহ ধরা পড়েছে। তখন আমাদের দেখার জন্য প্রচুর লোকজন সমাগম হয়। ঐরাত্রে আমরা রাজাকার মঞ্জিলে অবস্থান করি। পরদিন সকাল ১০-০০টার দিকে আমাদেরকে আগে পিছে আর্মি স্কট দিয়ে পায়ে হাটিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের সামনে দানা মিয়ার বাড়িতে নেয়া হয়। সেটা ছিল আর্মির নির্যাতন ক্যাম্প। আমাদের ৬জনকে একটি রুমে নেয়া হয়। তখন সেখানে আসেন পাকিস্তান আর্মির ক্যাপ্টেন আলী রেজা, ব্রিগেডিয়ার সাদাৎ উল্লাহ, মেজর আব্দুল্লাহ, হাবিলদার বশিরউদ্দিন। উনারা এসে আমাদেরকে নির্যাতন করা শুরু করে। নির্যাতনের ফলে আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়লে উনারা বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যায়। সন্ধ্যায় দিকে আমাদের জ্ঞান ফিরলে আর্মির গাড়িতে আমাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানা হাজতে পাঠানো হয়। পরের দিন সকালে পুনরায় দানা মিয়ার বাড়িতে আনা হয়। এইভাবে আমাদেরকে দানা মিয়ার বাড়িতে ২/৩দিন নির্যাতন করা হয়। এরপর আমি ছাড়া আমার সাথী বাকী ৫জনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠানো হয়। দুইদিন পর আমাকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠানো হয়। হঠাৎ একদিন আর্মির গাড়ি আসে জেলখানার গেট খুলে দেওয়া হয় এবং আমি সহ ৩০/৩৫ জন মুক্তিবাহিনীর লোককে জেলখানা হতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মেড্ডা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে প্রত্যেকের শরীর থেকে সিরিজ দিয়ে রক্ত নেওয়া হয়। এরপর আমাদেরকে পুনরায় জেলখানায় পাঠানো হয়। আরও কিছুদিন পর ২১শে নভেম্বর রোজার ঈদের দিনে দিবাগত রাত্রে পাকিস্তান আর্মির গাড়ি আসলে জেলখানার গেট খুলে দেওয়া হয়। নাম ডেকে ডেকে আমাদের ৪০জন বন্দিকে রশি দিয়ে বাঁধা হয় এবং সবাইকে আর্মির গাড়িতে তোলা হয়। এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার সাদ উল্লাহ আমাকে দেখে বলেন “ফেরেস্তাকো ছোড় দো।” এরপর আমার বাঁধন খুলে আমাকে ৪ নম্বর সেলে ঢোকানো হয়। সেলের ভিতরে আমি একজন লোককে দেখতে পাই, তার পরিচয় জানতে চাইলে সে বলে তার নাম মেজর অনন্ত সিংহ, তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য। সিমান্ত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে। পরদিন সাকালে জেল গেটে শুনতে পাই যে ৩৯ জনকে রাত্রে নেয়া হয়েছিল তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্বাধীন হওয়ার পর আমি জেল থেকে মুক্তি পাই। অসুস্থ অবস্থায় এক সাথী মুক্তিযোদ্ধা আমাকে নবীনগর ক্যাম্পে পাঠায়। সেখান থেকে আমি আমার গ্রামের বাড়ি চলে আসি। যে ৩৯ জন নিহত হয়েছেন মর্মে আমি বলেছি তাদের মধ্যে থেকে একচন বেঁচে যায় মর্মে আমি জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরে শুনি। আনুমানিক ৪/৫ মাস পরে তার সংগে আমার ঢাকায় দেখা হয়, তার নাম ছিল চিনু। সে তার বাম পাজরে গুরির চিহ্ন আমাকে দেখায়। সে কিভাবে বেঁচে যায় সে ঘটনার পুরা বর্ণনা আমাকে বলে। সে আমাকে জানায় যে ৩৮জনকে গুলি হত্যা করে পৈরতলায় মাটি চাপা দেয় হয়েছিল। আরও জানলাম সেই ৩৮ জনের ভিতর আমার ৪ সাথী ছিল তারা হলেন ১। শহীদ সিরু মিয়া দারোগা, ২। তার ছেলে শীহদ আনোয়ার কামাল, ৩। শহীদ নজরুল ইসলাম ও ৪। শহীদ আবুল কাশেম। আমি যে পেয়ারা মিয়ার কথা বলেছি তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। জেল হতে বের হয়ে জানতে পারি পেয়ারা মিয়া শান্তি কমিটির লোক ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রীর নিকট থেকে আমি জানতে পারি যে, তিনি তার স্বামী এবং সন্তানকে বাঁচাবার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট থেকে একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছবি আমি পত্র পত্রিকায় দেখেছি। অদ্য আমি তাকে ট্রাইব্যুনালে দেখেছি। আমি অত্র মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি।
জেরা-(চলবে)

জেরা
১৯৭১ সালে বা তার আগে সাধারণভাবে আমাদের সঙ্গে ব্রাহ্মাণবাড়িয়ার যোগাযোগ ছিল। যেখান থেকে আমাদের আটক করা হয়েছিল সেখানে আমি ঐদিনই প্রথম যাই। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পূর্বে আমি কোন দিন ব্রাহ্মাণবাড়িয়ায় যাই নাই। ১৯৭১ সাল বা তার আগে ব্রাহ্মাণবাড়িয়ায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং তাদের নেতাদের সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ সিরু মিয়া দারোগার স্ত্রীর নিকট থেকে আমি জানতে পারি যে, তিনি তার স্বামী এবং সন্তানকে বাঁচাবার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট থেকে একটি চিঠি নিয়ে এসেছিলেন। একথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য। তবে অদ্য আদালতে আমি সত্য কথাই বলেছি। একথাগুলি প্রসিকিউশনের শিখানো মতে বলেছি, ইহা সত্য নহে।

সোনামিয়া

বৃহষ্পতিবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১২
আমার নাম সোনামিয়া। আমার বয়স ৭৫ বৎসর হবে। আমার মায়ের নাম মনে নাই।
গ্রামের বাড়ি পৌরতলা দক্ষিণপাড়া, থানা ও জেলা ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঈদের রাত্রে আমি গাড়ির শব্দ এবং লোকের আনাগুনা শুনতে পাই। ঐ রাত্রে পাঞ্জাবীরা লোকদের গুলি করে মারে। গুলির শব্দ রাত্রে শুনি এবং সকালে ঘটনা শুনি এবং দেখি। রাজাকাররা আমাদের দেখে চিৎকার করে বলে এদিকে কেন আসছো। তখন আমরা দেখি তারা গর্ত খুড়িতেছে এবং অনেক লাশ পড়ে রয়েছে। একজনের হাত নাড়াচাড়া করতে দেখে আমি বলি জীবন্ত মানুষ কবর দিওনা। তখন সেই লোকটিকে ছেড়ে দিলে সে চলে যায়। রাজাকাররা সেখানে ৩৮ জনকে মাটি চাপা দিয়েছিল। ঐ রাজাকারদের মধ্যে একজনকে আমি চিনতে পারি তার নাম রুহুল। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার নিকট গেলে আমি তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করি। অনেক সাংবাদিকও গিয়েছিল তাদের নিকটও আমি ঘটনার কথা বলেছি।

জেরা-
আমি সকালে ঘটনা দেখতে একাই গিয়েছিলাম। গ্রামের অন্য কাউকে সেখানে দেখি নাই। আমাদের দক্ষিণ পাড়ায় ১০/১২ টি বাড়ি ঘর ছিল। রুহুল রাজাকার এখন জীবিত নাই। সে মারা গেছে। তার বাড়ি ছিল গুপোন ঘাট। রুহুলকে আমি আগে থেকে চিনতাম। একাত্তরে ভুলব কেমনে আমার নানার নাম মালু। (সমাপ্ত)

সুলতানা কামাল

সোমবার ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২
আমার নাম এ্যাডভোটেক সুলতানা কামাল। আমার বয়স আনুমানিক ৬৩ বৎসর। আমি আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৮। আমি সর্বেেত্র ঢাকাতে পড়াশুনা করেছি। আমি সর্বপ্রথম ঢাকায় অবস্থিত নারী শিা মন্দির স্কুলে পড়াশুনা করি। আমি এস,এস,সি পাশ করেছি আজিমপুর গালর্স হাইস্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে। হলিক্রস কলেজ থেকে এইচ,এস,সি, পাশ করেছি ১৯৬৭ সালে। ১৯৬৭ সালেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হই। আমি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্স পাশ করি এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭১ সালের পরীা ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত এম,এ, পাশ করি। মুক্তিযুদ্ধের কারণে ঐ পরীা বিলম্বিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ধানমন্ডি ল কলেজ থেকে ১৯৭৮ সারৈ আমি এল এল বি পাশ করি। ১৯৮৪ সালে আমি বার কাউন্সিল থেকে সনদ নেই। ১৯৭১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনা যদি বলতে হয় তাহলে আমাকে পারিবারিক পরিস্থিতির কথা একটু উল্লেখ করতে হয় যে, এটা হয়তো সবারই জানা যে আমার মা সুফিয়া কামাল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। তার ফলে ১৯৭০ সালে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল মতা হস্তান্তরের বিষয়ে সে সকল বিষয় আমরা খুব কাছে থেকে আগ্রহের সাথে ল্য করে যাচ্ছিলাম। আমার মা ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ বলে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতির আন্দোলনের সাথে। তার ফলে নির্বাচনের ফলাফল, সংসদ বসা না বসা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের অত্যন্ত গভীর একটি আগ্রহ ছিল এবং মার্চ মাসে যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠিনকভাবে অংশগ্রহন করছিলাম এবং সেই সময়ে যে সমস্ত সভা, সমিতি ও সমাবেশ হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহন করেছি সক্রিয়ভাবে। ৭ মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করেছি এবং “আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই বাণীতে উজ্জিবীত হয়েছিলাম। এর পরই বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল যেখানে একদিকে ইয়াহিয়া খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকে মতা হস্তান্তরের আলোচনার ভান চালিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জিবীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা রকম হামলাও চালানো হচ্ছিল। এভাবেই চলছিল অনিশ্চিতের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রি ১২:০০টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে আমাদের নিকট জানতে চান যে, ঢাকার অবস্থা কেমন এবং শুধু এটুকুই বলতে পারেন যে, অবস্থা ভাল নয়, একথা বলার পর পরই টেলিফোনের লাইন কেটে যায়। একই সঙ্গে আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমার মা বাবার বাড়ি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে সেই সময় ৪/৫টি বাড়ির ব্যবধানে ছিল এবং মেশিনগান এবং কামানের গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই এবং সেই সময় পিলখানা থেকেও আমরা পাল্টাপাল্টি গুলির শব্দ শুনতে পাই। একদিক থেকে রাইফেলের গুলি শব্দ এবং অন্য প্রাপ্ত থেকে কামানের গোলার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাই। আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যেও একটি ভীতির সঞ্চার হয়। আমার মা এবং বাবাকে যেহেতু স্থানীয়রা মুরুব্বী শ্রেণীর মনে করতেন সেহেতু তারা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকেন কি হয়েছে। আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির একজন জানালেরন যে, তাদের বাড়ির ছাদ থেকে কোনাকোনিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে এবং আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মানাধীন বাড়ির ছাদে একটি কালো পাতাক উড়ছিল এবং সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে পানির লেকের উপর একটি ব্রীজ আছে এবং ঐ ব্রীজের উপর দিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং ঐ ব্রীজের উপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। পরে জানতে যে, স্থানীয়ভাবে বিখ্যাত পানাউল্লা সাহেবের ছেলে সম্ভবত তার নাম খোকনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর আমরা এলোপাতাড়ি গুলির শব্দ শুনতে পাই যা রাতভর চলছিল। পিলখানার গোলাগুলির শব্দ স্পষ্ট মনে আছে ২৭ মার্চ ভোর পর্যন্ত চলছিল। ইতোমধ্যে প্রচার করা হয় যে, কারফিউ দেওয়া হয়েছে ঘর থেকে কেউ বের হবে না। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউশিথিল করা হয়। আমরা তখন রাস্তায় বের হয়ে জানার চেষ্টা করি যে, কি হলো। আমাদের বাড়িতে তখন কিছু লোকের সমাগম হতে শুরু করে, যাদের মধ্যে সাংবাদিক এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরাও ছিলেন। তারা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাংঘাতিক হত্যাকান্ড সংঘঠিত হয়েছে। প্রফেসর মনিরুজ্জামান, ডঃ জি,সি,দেব নিহত হয়েছেন, ডঃ জ্যেতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে গুলি করা হয়েছে, উনি আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এবং অন্যান্য অনেক শিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ তাদেরকে হত্যা করার জন্য খোঁজা হচ্ছিল। জগন্নাথ হলে দফায় দফায় ছাত্রদেরকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ইকবাল হয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মধুর ক্যান্টিনের মধুদার পরিবারের উপর আক্রমন করা হয়েছে, ঐ পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। রোকেয়া হলের ধোপা বাসুদেব, তাকে ও তার পরিবারসহ হত্যা করা হয়েছে। রোকেয়া হলেও সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছিল। হাটখোলা অঞ্চল থেকে প্রয়াত সাংবাদিক সাহাদাৎ চৌধুরী জানান যে, ইত্তেফাক অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অফিসের সামনে এলোপাতাড়ি গোলাগুলিতে অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে। আমার একটি ছবি অনেক সময় দেখি যে, রিক্সার উপর রিক্সাওয়ালা এবং এক যাত্রী একত্রে নিহত হয়ে পড়ে আছে। সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়ছার সংবাদ পাঠালেন যে, সংবাদ অফিসেও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার ভিতরে লেখক সাংবাদিক শহীদ সাদবের জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এরকম বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকে যে, আগুন লাগানো হয়েছে, হত্যাকান্ড হয়েছে এবং মানুষ যত্রতত্র লাশ হয়ে পড়ে আছে। নারায়ণগঞ্জে আমাদের আত্মীয় সাত্তার জুটমিলসের ছিলেন তারাও জানালেন যে, সেখানেও হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে এবং একটি বাড়িতে ঘরের ভিতর ঢুকে মশারীর ভিতর শায়িত মা ও শিশুকে একই সংগে হত্যা করা হয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম যে, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী সর্বত্রই একই ধরনের হত্যাকান্ড চলছে এবং পুলিশের তৎকালীন বড় কর্মকর্তা মামুণ মাহমুদ রাজশাহীতে ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণকে হত্যা করা হয়েছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে যে লেক আছে সেই লেকের পাড়ে এবং তার ঠিক কাছেই সেই সময়ে ধানমন্ডি গালর্স হাইস্কুল ছিল তার সামনে তখন কোন বাড়ি ছিল না, সেই গালর্স স্কুলের ছাদে মেশিনগান ফিট করা হচ্ছিল এবং লেকের পাড়েও মেশিনগান নিয়ে পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনী অবস্থান নিচ্ছিল। অর্থাৎ ২৫ মার্চের সন্ধ্যা থেকেই তাদের এই আক্রমণের প্রস্তুতি চলছিল। ২৭ মার্চ সকাল বেলায় যখন আমরা রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে হেটে যাই আমি নিজে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পাকিমস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাকে তুলছিল। কারফিউ যখন আবার দেওয়া হয় তখন আমরা ঘরে ফিরে আসি এবং বিবিসি এবং অন্যান্য রেডিও থেকে আরও শুনতে পাই যে, তদনিন্তন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে অপারেশন সার্চ লাইট নামে একটি হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে যা গণহত্যার সামিল এবং ল ল লোক নিজেদের বাড়ি ঘর ছেরে এখান থেকে সেখানে, এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং সিমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সেখানে ৮০ বৎসরের বৃদ্ধ বৃদ্ধা থেকে শুরু করে নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে মা পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। অর্থাৎ কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ, যুবক, সবল কিংবা অসমর্থ মানুষ চরম অনিরাপত্তাবোধ নিয়ে প্রাণ ভয়ে শুধুমাত্র প্রাণটুকু রা করার জন্য এদিক সেদিক ছুটে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছিল। আমাদের মতে এটা একটা চরম মানবতার অবমাননা এবং মানবাধিকারের নিকৃষ্টতম লংঘন। ইতোমধ্যে এই খবরটিও পাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে ২৬ মার্চ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সেই খবরও পাচ্ছিলাম। আমাদের কিছু বন্ধু বান্ধব যারা বিভিন্ন আন্দোলনের সংগে যুক্ত ছিলেন তারা মুক্তিবাহিনী গঠন হওয়ার খবরও নিয়ে আসছিল এবং তারা সেই বাহিনীতে ক্রমশঃ যোগ দিচ্ছিলেন এবং আমাদের সংগে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন এবং সেভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল। আমার মাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারে মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল এবং আমরা দুই বোন সক্রিয়ভাবে উক্ত কার্যে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। এভাবেই তখন আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগে জড়িত নানাভাবে তথ্য আদান প্রদান, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টি করা এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অন্যদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা চলছিলই এবং হঠাৎ করে এপ্রিল মাস থেকে আমরা জানতে পারলাম যে তখনকার কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সংগে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। তখনকার পত্র পত্রিকায় সেই খবরগুলি অত্যন্ত ফলাও করে ছাপা হতো। কাজেই সেই ঘটনা শুলির সাথে কারা কারা যুক্ত ছিলেন তাদের নামও আমরা জানতে পারি এবং ঘুরে ফিরেই জামায়াতে ইসলামী, পি,ডি,পি, মুসলিম লীগ এই দলগুলির নাম উঠে আসতো এবং একটি নাম খুব বেশী করেই আমাদের চোখে পড়তো সেই নামটি হলো গোলাম আযম, যিনি টিক্কা খান এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে প্রায়ই মিলিত হতেন এবং কিভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতা রা করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করতেন এবং বক্তৃতা ও বিবৃতি দিতেন। দুটো বিষয় খুব স্পষ্টভাবে উঠে আসতো যে, পাকিস্তান অর্থই হচ্ছে ইসলাম এবং পাকিস্তানের বিরোধীতা করা মানেই হচ্ছে ইসলামের বিরোধীতা করা। অর্থাৎ ইসলামকে বাঁচাতে হলে পাকিস্তানকে রা করতে হবে এবং তাদের ভাষায় মুক্তিযোদ্ধারাই দুস্কৃতিকারী তাদেরকে নির্মূল করতে হবে এবং এজন্য দেশবাসীকে উজ্জিবীত করতে হবে এবং সে দায়িত্ব তারা নিতে চান। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পেলাম যে, তারা প্রথমে শান্তি কমিটি নামে কিছু সাংগঠনিক তৎপরতা চালায় এবং জনসাধারণকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে চাপ সৃষ্টি করে যোগ দিতে বাধ্য করতে থাকে। এরপর আমরা দেখা পাই যে, তারা মে মাসে রাজাকার বাহিনী নামে একটি বাহিনী তৈরী করে। যতদূর মনে পড়ে রাজাকার বাহিনী জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে খুলনায় প্রথম সূচনা হয়েছিল। আমরা এও জানতে পারি যে, তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছে এবং আলবদর, আলসামস নামে দুটি বাহিনী ঐ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় এবং তারা খুব গোপনে এ কাজগুলি করবে মর্মে জেনেছিলাম। আমরা জানতে পাই যে, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র এবং তরুণ কর্মীদেরকে নিয়ে এই বাহিনী তৈরী করা হয়েছিল। সর্বেেত্রই এসব কর্মকান্ডের সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে গোলাম আযমের নামই বার বার উল্লেখিত হয়েছে। প্রায়সই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে টিক্কা কান সহ গোলাম আযমের নাম ধরেই প্রসংশা করেছেন যে, পাকিস্তানের অখন্ডতা রার জন্যই তিনি এক কাজ করছেন। সেই সময়ে গোলাম আযম পাকিস্তান পর্যন্ত সফর করেন এবং সেখানে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলেন এবং বার বার একথা বলেন যে, তিনিই পাকিস্তানের অখন্ডতা রা করার জন্য যে কোন কিছু করতে প্রস্তুত। জুন মাসে আমার ছোট বোন সাইদা কামাল যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ১৮৩৫ এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতের আগরতলায় যেতে বাধ্য হই। জুন মাসে একটি ঘটনার পরিপ্রেেিত আমার সেই ছোট বোন এবং আমি সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে স্কোয়ার্ড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান সাহেব থাকতেন। তিনি খবর পাচ্ছিলেন যে, বিমান বাহিনীতে যে বাঙ্গালী কর্মকর্তারা রয়েছেন তাদেরকে যখন ডাকা হয় তারপর তারা আর ফিরে আসেন না। এরকম একটা সময় যখন হামিদুল্লাহ খান সাহেবকে হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে বলা হলো এবং নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় একটি অপারেশনে তাকে যেতে হবে। তখন তিনি আমার মায়ের নিকট এসে সাহায্য চান কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে তিনি বাঁচতে পারেন। তখন আমরা তাকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে সাহায্য করি। দুঃখজনকভাবে তার বাড়ির কাজের যে ছেলেটি ছিল তাকে পাক বাহিনী পরদিন ধরে নিয়ে যায়। আমরা হামিদুল্লাহ খান সাহেবের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করি। তখন একটা শংকা দেখা দিল যে কাজের ছেলেটি যদি জিজ্ঞাসাবাদের চাপে আমাদের পরিবারের সংগে হামিদুল্লাহ খান সাহেবদের যে যোগাযোগ হচ্ছিল সে খবর যদি বলে দেয় তাহলে আমাদের সংগে মুক্তিবাহিনীর যে যোগাযোগ আছে তাও প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। তখন আমাদেরকে পরামর্শ দেয়া হলো যেন আমরা দুই বোন অন্ততঃ সীমান্ত পার হয়ে যাই। তারপরে আমরা ১৬ জুন ঢাকা থেকে স্থল পথে রওনা হয়ে নদী পার হয়ে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে রিক্সা করে আগরতলার সোনামুড়ায় পৌঁছাই। সোনামুড়া অঞ্চলে আমাদের পূর্ব পরিচিত একজন ডাক্তার যিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন তিনি সোনামুড়া ফরেস্ট বাংলাতে একটি ছোট চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য তিনি এবং তার স্ত্রী সেখানে ছিলেন এবং তারা দুজনই আমাদের বন্ধু ছিলেন। আমরা তাদের সংগে দেখা করি এবং আমরা দুই বোন তাদের সংগে কাজ করতে যোগ দেই। সেই চিকিৎসা কেন্দ্রটি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ সাহেব। তার সংগে আমরা দেখা করলাম। তিনি আমাদের অনুমতি দিলেন সেখানে কাজকরার জন্য এবং আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নিবন্ধিত হলাম। সেখানে থাকতে থাকতে একটা বড় হাসপাতালের পরিকল্পনা নেয়া হলো সেটা বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল নামে পরিচিতি হয়েছিল। আগরতলা থেকে ৬০ মাইল ভিতরে বিশ্রামগঞ্জ নামক স্থানে আমরা হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করি। সেখানে আমাদের সংগে এই কর্মকান্ডে জড়িত হন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী, ডাঃ মোবিন, ডাঃ কামরুজ্জামান প্রমুখ যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত এবং সুপরিচিত। পরে ডাঃ ক্যাপ্টেন সিতারা এসে আমাদের সংগে অক্টোবর মাসে যোগ দেন যিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমাদেরকে এ ব্যাপারে প্রথমে যিনি সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি ক্যাপ্টেন আখতার আহম্মেদ তিনিও পরবর্তী সময়ে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। আমরা সেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা বাংলাদেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে কাজ করছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল তারাও সেখানে এস হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজে যোগ দেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নিলিমা, ডাঃ ডালিয়া শামছুদ্দিন উল্লেখযোগ্য। আমরা সবাই একত্রে সেই হাসপাতালে কাজ করেছি। আমরা নানাভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম। বিভিন্ন বেতা, বিশেষ করে বিবিসি, আকাশ বাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের নিকট আমরা মায়ের দেয়া কোড ল্যংগুয়েজের চিঠি সমূহ যাহা ভাইয়ের মাধ্যমে আমাদের নিকট দেয়া হতো সেগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম। তদুপরি মুক্তিযোদ্ধারা যখন গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য দেশের অভ্যন্তরে যেত তারা ফিরে আসলে তাদের মাধ্যমেও খবরাখবর পেতাম। ২ নম্বর সেক্টরের যে সব মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করতো তাদের মাধ্যমে আমরা সেই সব অপারেশনের খবর এবং যারা দেশের অভ্যন্তরে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করতো অর্থাৎ শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলসামস তাদের কার্যাবলীর খবরাখবরও আমরা পেতাম। শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু, সামাদ, আলভী গং দের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের ঘটনা সবকিছুই আমরা নিয়মিত ঐ হাসপাতালে বসে পেতাম। আমরা খবর পেতাম যে, রাজাকার, আলবদর, আলসামস, শান্তি কমিটির লোকজন পাকিন্তান হানাদার বাহিনীদেরকে দেশের অভ্যন্তরের সমস্ত খবরাখবর প্রদান করতো বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপরে পরিবারবর্গের সব খবরাখবর, তাদের বাসস্থান, তাদের কার্যাবলী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নিকট প্রদান করতো। আমরা আরও খবর পাই যে, তারা বিভিন্ন বয়সের নারীদের ধরে নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে এবং বাংকারে প্রদান করতো। যার ফলে ক্রমাগত যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে তাদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এবং অনেকেই নির্যাতনের কারণে সেই ক্যাম্প কিংবা বাংকারে নিহত হয়েছেন। রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর নেতা হিসাবে অনেকের নামের সংগে প্রায় সমসময়ই আমরা গোলাম আযমের নাম শুনতাম। তার সংগে আমরা আরও অনেক নাম শুনছি। যেমন, মতিউর রহমান নিজামী, আলি আহসান মোঃ মুজাহিদ, আব্বাস আলী খান গং দের নাম প্রায়শঃ শুনতাম তবে তাদের মধ্যে সর্বদাই জামায়াতের নেতা হিসেবে গোলাম আযমের নাম উচ্চারিত হতো। আলবদর, আলসামস, রাজাকার এই বাহিনী সমূহের নেতা হিসাবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম। সেই সময়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা জেনেছি যে, প্রাণ রক্ষার্থে তাদেরকে দেশের ভিতরে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পালাতে হয়েছে, ভারতে আশ্র নিতে হয়েছে এবং আমরা আরও অনেক ঘটনা শুনেছি যে, তাদেরকে সমস্ত সম্পত্তি ফেলে শুধুমাত্র নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। চার্চের মধ্যে ঢুকেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদেরকে এই অত্যাচারিত ও ধর্মান্তিরিত হতে হয়েছে। (চলবে)


১১-০৬-২০১২ ইং পুনরায় জবানবন্দী শুরুঃ
শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদেরকেই একই উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়েছে তা নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের উপরে নির্যাতন করা হয়েছে, তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদেরকে চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের উপরে হত্যা, লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে। ২৫ শে মার্চের অপারেশন সার্চ সাইট পৃথিবীর অন্যতম একটি নিকৃষ্টতম গণহত্যা বলে চিহ্নিত এই কারণে যে, একটি গণতন্ত্রকামী জনগোষ্ঠীর ওপর যারা মূলত নিরস্ত্র ছিল তাদের ওপরে সশস্ত্র হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করতে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপরে হত্যাকান্ড, ইকবাল হল পুড়িয়ে দেওয়া, জগন্নাথ হলের ছাত্র হত্যা, রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে হত্যাকান্ড, কালি মন্দির আক্রমণ, শাখারী বাজার, রায়েরবাজার, হাটখোলা ওয়ারী যে সমস্ত জায়গা হিন্দু অধ্যুষিত বলে পরিচিত কারফিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ কর আবার একই সাথে রাজারবাগে অগণিত পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, একই রকমভাবে পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের উপর আক্রমণ করা একটি ঘৃণ্য গণহত্যার উদাহরণ স্থাপন করে। একইভাবে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ধরনের গণহত্যা চলতে থাকে। বরিশালের একটি উদাহরণ দেই বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠীর ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ যখন দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে গেছে তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদেরকে বিপরীত দিক থেকে গুলি করেছে। এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এরকম ঘটনা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল। এই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা যারা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার এবং আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে, বেতারের মাধ্যমে যা সেই সময়কার তথ্য সরবরাহের মূল মাধ্যম ছিল জানতে পারি এই সমর্থনের এবং সহযোগিতার মাষ্টার মাইন্ড ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এবং শান্তি কমিটিরও অন্যতম শীর্ষ নেতা গোলাম আযম। আমরা এও জেনেছি যে, ১৯৭১ সালের ২৩ শে আগষ্ট এবং ৩১ আগষ্ট তারিখে গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর এবং হায়দারাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এই সব কর্মকান্ডকে সমর্থন দিয়েছেন এবং মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহবান জানিয়েছেন। লক্ষ্য করা যেতে পারে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভবত দুইজন সদস্যকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য করে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে গোলাম আযম বলেন ঠিক সে লক্ষ্যে শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে একই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, শান্তি কমিটি কখনও সশস্ত্র কোন অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছে কিনা? আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তারা কখনও কখনও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সাথে সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ্য করি ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে, মুক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তিনি দম্ভ করে একথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট।
   
লক্ষনীয় যে, একটি ব্যক্তি গণহত্যা পরিচালনাকারী সরকারের কতখানি কাছের লোক এবং আস্থাভাজন হলে ঐ সময়ে তাদের নেতার সাক্ষাত পান এবং তাদের পক্ষে কথা বলেন এবং আমরা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর একটি মরিয়া এবং নৃশংস আচরণ প্রত্যক্ষ করি ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ভিতরে। যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় নাৎসী আমলেরও অনেক হত্যাকান্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি রাকাজার, শান্তি কমিটি এবং আলবদর ও আলশামস এই সমস্ত বাহিনীর দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিচালনায় নেতৃত্বে দিয়েছেন গোলাম আযম। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে আমরা ফিল্ড হাসপাতাল থেকে কলিকাতায় চলে যাই। তৎপর ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী তারিখে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসি। ১৬ ডিসেম্বরে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর আমরা কলিকাতায় বসেই পাই। তখন যাতায়াতের ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আমরা ট্রেনে বেনাপোল পর্যন্ত এসে তারপর বিভিন্নভাবে ঢাকায় প্রবেশ করি, কখনও রিক্সায়, কখনও নৌকায়, কখনও বাসে। কারণ যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসি যেখানে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, তাদের পরিবারের কেউ না ক্ েনিহত হয়েছেন, কোন কোন পরিবারের একাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদেরকে হারিয়েছি, সহপাঠিদের হারিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধে যারা যোগ দিয়েছিল সেই বন্ধুদেরকে হারিয়েছি, এক একটি পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি নিহত হওয়াতে দুরবস্থায় পতিত হয়েছে, নারীদের অবস্থা ততোধিক বিপন্ন কারণ তারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা সবাই জানি দুই লক্ষ নারী মুক্তিযুদ্ধকালীন সমেয় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আরও দুই লক্ষ নারী নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন এবং পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষ অভিভাবক হারা হয়ে অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়েছেন। তারা অনেকেই আমার মা সুফিয়া কামালের কাছে তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা বলতে আসেন এবং বাঁচার একটি উপায় খুঁজে দিতে এবং সাহায্য করার জন্য অনুরোধ জানায়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আমার মা সুফিয়া কামাল তার অন্যান্য সহকর্মীদেরকে নিয়ে নারীদের পুনর্বাসনের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ব্রাক নামে পরিচিত যে বেসরকারী সংস্থাটি আছে তার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন  আমার মা। ব্রাক এবং নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এ সমস্ত সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং এর জনগণের পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আমরা পরিবারের লোকেরাও ঐ কাজে যুক্ত হয়ে যাই। সেই কারণে নারী পুনর্বাসনের কাজে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাই। একই সংগে মানবাধিকার লংঘন এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এই ইস্যুগুলি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। এর ধারাবাহিকতায় মানবাধিকারের কাজের সাথে যুক্ত হই এবং আইন অধ্যয়ন করতে শুরু করি যা শেষ করি ১৯৭৮ সালে। নারী পুনর্বসান কেন্দ্রে মূলত যে কাজ করা হতো সেটা হলো যারা সাহায্য প্রার্থী হয়ে আসতেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কারণ তাদের মধ্যে অধিকাংশই অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। তাদের নিরাপদে থাকা এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক প্রয়োজন মেটানো, তারা যাতে করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারেন সেজন্য তাদের জন্য নানান সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া এবং যারা পরিবারে ফিরে যেতে চেয়েছেন তারা যেন স্বসম্মানে পরিবারে ফিরে যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা। আমি একটি বিশেষ দায়িত্বের কাণে ১৯ জন অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলামন যারা সবাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছিলেন এবং তাদের অনেককেই স্থানীয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোষরেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত করেছিল। এরা মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্থ অবস্থায় ছিলেন এবং তাদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা দেখার জন্য বিশেষ করে এই সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়েছিল। নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে একজন বিদেশী ডাক্তার ছিলেন যার নাম ডাক্তার ডেবিস। তাছাড়াও দেশীয় নারী, পুরুষ স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররাও ছিলেন। সার্বক্ষণিকভাবে আমার মা সুফিয়া কামাল, রাজনীতিবিদ বদরুন্নেছা আহমেদ, সমাজসেবী ছায়রা আহম্মেদ, মালেকা খান, আফিফা হক প্রমুখ এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ঐ পুনর্বাসন কেন্দ্রটি ঢাকার ইস্কাটনে অবস্থিত ছিল। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে সমস্ত যুদ্ধ শিশু ছিল তাদের মায়েদেরকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছিল যে, তারা রাজি থাকলে ঐ শিশুদেরকে দত্তক দেয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সংগে সম্পৃক্ততার কারণে এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ যোগ থাকার কারণে একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে মানবাধিকার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবতার মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং সেই অবস্থান থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি ট্রাইবুনালের কাছে এই প্রত্যাশা রাখি যে, পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম একটি গণহত্যার সংগে যারা জড়িত নীতিগতভাবে সমর্থন দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে এই গণহত্যাকে সমর্থন যুগিয়েছে এবং মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে ৩০ লক্ষ মানুষের প্রাণ হানি ঘটিয়েছে, সাড়ে সাত কোটি জনগণের কিছু সংখ্যক ব্যক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তারা ব্যতীত অন্য মানুষের মধ্যে এক কোটি লোককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে, দেশের অভ্যন্তরে যারা ছিল তাদেরকে অনবরত ভীতিকর অবস্থায় নিজের বাড়ি, ঘর, গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয়ের জ্য ছোটাছুটি করতে বাধ্য করেছে, দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণের শিকার করেছে, আরও লক্ষ লক্ষ নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত করেছে এবং এই যুদ্ধের কারণে কোটি কোটি পরিবারকে বিপর্যস্থ করেছে, বিচারের মাধ্যমে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবে। আমি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। অধ্যাপক গোলাম আযম আজ ট্রাইবুনালে আসামীর কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন। এই আমার জবানবন্দী।

জেরা ঃ
আমি তদন্তকারী কর্মকর্তা মনোয়ারা বেগমের নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছি। তিনি অনেকবার আমার নিকট গিয়েছেন তবে যতদূর মনে পড়ে ২০১২ সালের, পরে বলেন ২০১১ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখে তার নিকট জবানবন্দী দেওয়া শেষ হয়েছে। তার নিকট একাধিকবার আমি জবানবন্দীর জন্য বসেছি। জবানবন্দী নেওয়ার জন্য তিনি আমার অফিসে এসছিলেন। আমি মনে করতে পারিনা যে, আমি কখনও তদন্ত সংস্থার অফিসে গিয়েছিলাম কিনা। যখন তদন্ত এবং প্রসিকিউশনের অফিস বই ট্রাইব্যুনালে ছিল তখন আমি ট্রাইব্যুনালের বিল্ডিংয়ে এসে রাজাকার অর্ডিন্যান্স তদন্ত সংস্থার কাছে দিয়েছিলাম।খুব সম্ভবত ২০১০ সালে দিয়েছিলাম, তবে তারিখ মনে নাই। তদন্ত সংস্থা বর্তমান অফিসটি কবে সেখানে স্থানন্তরিত হয়েছে তা আমার জানা নাই। আমি এই মামলায় কোন নালিশকালী ব্যক্তি নই। তদন্ত সংস্থার কমপ্লেইন রেজিস্টার ক্রমিক নং- ৫ তারিখ০১-০৮-২০১০ এর নালিশ কারীকে তা আমি জানি না। অধ্যাপক গোলাম বাংলাদেশের একজন পরিচিত ব্যক্তি। আসামী কাঠগড়ায় একজন ব্যক্তিই উপস্থিত আছেন।
রাজাকার বাহিনী গঠন তারিখ আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না তবে খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় জৈনিক ইউসুফের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ, আজাদ পত্রিকা, মর্নিং নিউজ, দি পিপল পত্রিকা ইত্যাদি আসতো। দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠনের খবর পড়েছিলাম। উক্ত দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকাটি আমার সংরক্ষনে নাই, আমি উহা তদন্ত সংস্থায় জমা দিই নাই। আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ খবরে ইউসুফ সাহেবের নাম ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইউসুফ সাহেব খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠন করেছেন এই খবরটি প্রকাশিত হওয়ার কথা, তবে আমি অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় দেখেছি কিনা তা এ মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। খুব সম্ভবত খবরটি সাপ্তাহিক বিচিত্রায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। আশির দশকে কোন এক সময়ে বিচিত্রায় এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। ঐ সময়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নির্বাহী সম্পাদক ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির বর্তমান আহ্বায়ক জনাব শাহরিয়ার কবির। জনাব শাহরিয়ার কবীর সাহেব ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির আহ্বায়ক হওয়ার পূর্বে মস্তারি শফি ঐ কমিটির সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন তা আমি জানি। তবে আহ্বায়ক ছিলেন কিনা তা আমি জানি। রাজাকার বাহিনী গঠনের ব্যাপারে গেজেট বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আমি অবগত আছি যেটা আগষ্ট মাসে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সামরিক সরকারের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধিনস্থ করা হয় এটা আমি শুনেছি। রাজাকার বাহিনী সরকারের প্রতিষ্ঠিত একটি ডিরেক্টরেটরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এবং উহার প্রধান ছিলেন একজন ডিরেক্টর। রাজাকার বাহিনীর প্রথম ডিরেক্টর রহিম সাহেব পুলিশের ডিআইজি ছিলেন কিনা তা আমি জানিনা কেননা তখন আমি দেশে ছিলাম না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আব্দুর রহিম নামে কোন সচিব ছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। রাজাকারদেরকে স্থানীয় এস.ডি.ও সাহেব নিয়োগ দিতেন কারন একটি গেজেটের মাধ্যমে যখন কোন সংগঠন কাজ করে তখন তাদের সরকারের নির্দেশনা বা কর্তৃত্ব মনে করতে হয়। রাজাকার বাহিনীর ট্রেনিং দিতেন সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ কর্তৃক দেয়া হতো যখন তাদের কন্ট্রোলিং দায়িত্ব সরকারের উপর অর্পিত হয়।
প্রশ্ন ঃ আগষ্ট মাসের পূর্বে রাজাকারদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে এরুপ কোন খবর সরকারী বিধিবদ্ধ বাহিনী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে ২রা আগষ্ট, ১৯৭১ এর পূর্বে রাজাকার বাহিনী কোন সশস্ত্র বাহিনী ছিলো কি?
উত্তর ঃ রাজাকারের মত বাহিনীর কার্যক্রমের জন্য  তাদের নিকট অস্ত্র থাকা অপরিহার্য ছিল না কারন তারা বিভিন্নভাবে যেমন তথ্য সরবরাহ করা, বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া, হুমকি দেওয়া, হয়রানী করা এসবের জন্য অস্ত্র প্রয়োজন হয় না।
আমি ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম। ঐ সময় ধানমন্ডি এলাকা লালবাগ থানার অধীনে ছিল। দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে ঢাকা জেলার রাজাকার এ্যাডজুটেন্ট কে ছিলেন সে খবর আমি নেই নাই। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ থেকে ৩রা জুন তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাস করতে যেতাম না। আমাদের বাড়িতে কখনও আর্মি, রাজাকার, আলবদর আসে নাই, তবে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আমার মায়ের উপর আলবদর কর্তৃক একটি হামলা করার পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। আমার মা সুফিয়া কামাল দুইটি ডায়রী লিখতেন, একটি দৈনন্দিন অন্যটি কবিকা লেখা সংক্রান্ত। পরবর্তী আমার মায়ের দৈনন্দিন ডায়রীটি পরবর্তীকালে বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর দৈনন্দিন ডায়রীতে ১৯৭১ সালের শেষের দিকে কোন এক জায়গায় তাকে আলবদর কর্তৃক হামলায় কথা উল্লেখ আছে। এই ষড়যন্ত্রকারীআলবদরদের নাম জানার কোন সুযোগ ছিলনা এবং তিনি আমাদের কে বলেও নাই। আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন পর্যন্ত আমাদের ঢাকায় থাকা অবস্থায় কোন আলবদরের সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই। কারন তারা গোপন কিনা ফোর্স ছিল বিধায় কারো কাছেই নিজেদের নাম প্রকাশ করেনি এমনটি যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের সামনেও তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে এসেছে। (চলবে)

১১-০৯-২০১২ ইং ২:০০ মিঃ পুনরায় জেরা শুরু ঃ
১৯৭১ সালে কোন আলদরকে নাম এবং চেহেরা দিয়ে আমি সনাক্ত করতে পারি নাই। ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন তারিখ পর্যন্ত আমি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় ছিলাম, তখন রাজাকার বাহিনী গঠন হচ্ছে, সেই সময় পর্যন্ত কোন রাজাকার সদস্য আমি ধানমন্ডি এলাকায় দেখি নাই এবং কারও নামও আমি শুনি নাই। দেশ স্বাধীনের পরে দেশে ফিরে এসে আমি আমাদের ঐ ধানমন্ডিরবাড়িতেই ছিলাম এবং এখনও সেখানে আছি। আমার মা সুফিয়া কামালভারতে যান নাই। আমি দেশে ফেরত আসার পরে ধানমন্ডি এলাকার কোন রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদষ্যকে দেখি নাই এবং কারও নামও শুনি নাই। দেশ স্বাধীনের অব্যবহিত পর পরই বাংলাদেশে যে সমস্ত পত্রিকা প্রকাশিত হতো সেই সমস্ত পত্রিকায় রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস প্রধানদের নাম প্রকাশিত হয় নাই, তবে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়েছে। আমি সর্বপ্রথম আলশামস বাহিনীর প্রধানের নাম কবে শুনেছি তার সঠিক তারিখ মনে নাই এবং তার নামও মনে নাই।আলশামস সদস্যের নাম আমি কোনদিন পত্রিকায় দেখি নাই, তবে আলবদর সদস্যের নাম দেখেছি। আমি সর্বপ্রথম আলবদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর নাম আশির দশকের প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কোন পদে ছিলেন তা আমার মনে নাই, তবে শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আমার নিকট পরিচিত ব্যক্তি ছিল না। আমি কখনও সরাসরি কোন ছাত্র রাজনীতি করি নাই। আমি ছয় দফা এবং এগার দফা আন্দোলনের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে অংশগ্রহন করেছি। এগার দফা আন্দোলনের উদ্যেক্তা একটা বড় রাজনৈতিক জোটের মাধ্যমে হয়েছিল তার মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থী দলগুলো ছিল। স্বাধীনতা পূর্বকালে পাকিস্তানে তিনটি রাজনৈতিক ধারা ছিল, একটি জাতীয়তাবাদী, একটি সমাজতান্ত্রিক এবং অন্যটি ধর্মভিত্তিক ১৯৭১ সালে ধর্মভিত্তিক দল সমূহ পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহন করেছিল তার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী একটি দল। শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন খাজা খয়েরুদ্দিন। শান্তি কমিটি কার্য পরিচালনা করতোবিভিন্নঅঞ্চলেপাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানোর মাধ্যমে। তারা ধর্মকে রাষ্ট্রের উপর অবস্থান দিয়েছিল এবং পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিরু মুসলমানরাই পাকিস্তানের অধিবাসী একথা প্রচার করতো, তদুপরি আরও প্রচার করতো যারা ভাল মুসলমান তারা বাংলাদেশ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন করতে পারে না। তারা ধর্মভিরু মানুষদেরকে মনোস্তাত্বিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা বলতে যা বুঝায় তার পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করতো। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি এবং তারা শাখা সমূহ কত সদস্য বিশিষ্ট ছিল তা আমি জানি না। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি সর্বপ্রথম কত তারিখে মিটিং করেছি তা আমি বলতে পারব না। এপ্রিল মাসের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল কিনা তা আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কোন দলের ছিল তা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারব না, তবে তারা মুসলিম লীগ, পিডিবি, জামায়াতে ইসলামীর ছিল তা আমার মনে আছে।
খাজা খয়রুদ্দিন কর্তৃক পরিচালিত শান্তি কমিটি ব্যতিত অন্য কোন শান্তি কমিটি ছিল কিনা তা আমি জানি না, তবে মৌলভী ফরিদ আহমদ নামে একজনের শান্তি কমিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন মর্মে পত্র পত্রিকায় দেখেছি। মৌলভী ফরিদ আহমদ সাহেব সম্ভবত পি.ডি.বি করতেন। তিনি ধানমন্ডি এলাকায় বসবাস করতেন কিনা তা আমি জানি না। ধানমন্ডি এলাকায় কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির একটি অফিস ছিল কিনা তা আমি জানি না। আমার দেশে থাকা ধানমন্ডি এলাকায় শান্তি কমিটির কোন নেতার সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই বা সে এলাকায় থাকে এমন কোন নেতার নামও শুনি নাই। খাজা খয়রুদ্দিন সাহেবের শান্তি কমিটির অফিস কোথায় ছিল তা আমি জানি না। শান্তি কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহনের প্রক্রিয়া কি ছিল তা আমরা জানি না। তৎকালীন বিভিন্ন জেলা শান্তি কমিটির প্রধান এবং তার দলীয় পরিচয় আমি জানি না।
ইউনিয়ন পর্যায়ে কিছু কিছু ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শান্তি কমিটির প্রধান করা হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়টি সশস্ত্র অপারেশনে শান্তি কমিটি অংশ গ্রহন করেছিল সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট সংখ্যা আমি এ মুহুর্তে বলতে পারছি না, তবে একাধিক অপারেশনে অংশ গ্রহন করেছিল। এ সংক্রান্ত কিছু কিছু তথ্য তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট আমি প্রদান করেছি।কিছু তথ্য আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। কিছু তথ্য আমাদের সংঙগঠন আইনও শালিশ কেন্দ্রের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত এবং কিছু তথ্য পত্র পত্রিকার কাটিং থেকে প্রাপ্ত। যে সমস্ত শান্তি কমিটির সদস্যরা এই সকল অপারেশনে অংশ গ্রহন করেছিল আমাদের প্রদত্ত তথ্যের মধ্যে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নাম আছে কিনা তা আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। শান্তি কমিটির সদস্যদের অস্ত্র সরবরাহের কোন নির্দেশ পাকিস্তান সরকার দিয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে কোন তথ্য আমার নিকট নাই। যেভাবে শান্তি কমিটি তাদের পরিচয় দিয়েছিল তাতে শান্তি কমিটি একটি বেসামরিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। (চলবে)

১২-০৯-১২ পুনরায় জেরা শুরু ঃ-
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে শান্তি কমিটি যে সকল অপারেশনে থাকতো সেই সকল অপারেশনে ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যাক্তি বা পরিবারের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট সরবরাহ করি নাই। পাকিস্তানী আর্মির যে অফিসারের নেতৃত্বে এই অপারেশনগুলি পরিচালিত হয়েছে তার নামও আমি তদন্তকরী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করি নাই। কারণ তদন্তাকরী কর্মকর্তা তদন্ত করে উক্ত নাম সংগ্রহ করার কথা। কোন এলাকায় কত তারিখে কোন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তৎমের্ম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট কোন তথ্য সরবরাহ করি নাই। কারণ এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,অন্যান্য ঘটনার ধারাবাহিকতায় এ সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটেছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে সেগুলি বের করবেন সেজন্য আমি স্থানও তারিখ উল্লেখ করি নাই। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা কবে, কোথায় হয়েছিল একথা বলা সম্ভব নয়, কারণ এধরণের গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা জনগনকে জানিয়ে করা হয়না, তবে আলবদর বাহিনীর কর্তৃক সংঘটিত গুপ্তহত্যার ব্যাপারে যেহেতু আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী এবং তিনিই জামায়াত ইসলামীর নেতা ছিলেন এাবং গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর আমির থাকায় তার অনুমোদন নিয়েই এই ধরনের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল এবং তিনি এর দায় দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। জামায়াত ইসলামীর কোন সভায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল সেটা বলা সম্ভব নয়। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব কবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন প্রমান্য তথ্য আমার জানামতে কোথাও নেই। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বুদ্ধিজীবী হত্যাকন্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন প্রমান্য তথ্য আমার নিকট নাই। তবে এ ধরণের সংগঠনের প্রধন হিসাবে তার সংগঠনের নেতা কর্মীদের কর্তৃক সংঘটিত কোন কাজ তার অনুমোদন ব্যতীত হওয়া সম্ভব নয়, তদুপরি এমন কিছু দেখা যায় না যে, যারা এসব কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যাবস্থা তিনি গ্রহন করেছেন, অতএব নিয়ম অনুযায়ী সংগঠনের প্রধানের উপর এ ধরনের কার্যের দায় দায়িত্ব বর্তায়। রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটি কাঠামোগত ভাবে জামায়াতে ইসলামীর অংগ সংগঠন বলে ধরে নেয়া যায় না, তবে এই সংগঠন সমূহ প্রতিষ্ঠান এবং কর্মপ্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকাই ছিল মূখ্য। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির প্রধান এবং সদস্য সচিব জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন কিনা সে সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধরনা নাই, তবে তাদের কর্মপদ্ধতি এবং গঠন সম্পর্কে গোলাম আযমের মুখ থেকেই আমরা পত্র পত্রিকায় দেখেছি এবং তিনি শান্তি কমিটির মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়ে অংশগ্রহন করেছেন। শান্তি কমিটি গঠনের আহবান জানিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম বিবৃতি দিয়েছিলেন এই মর্মে ১৯৭১ সালের ৫ এবং ৭ এপ্রিলে পূর্বদেশ, দৈনিক আযাদ পত্রিকায় কাটিং তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রদান করা হয়েছে। অধ্যাপক গোলাম আযম শান্তি কমিটির যে মিছিলে নেতৃত্বে দিয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন সেই মিছিলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির আহব্বায়ক ও সদস্য সচিব ছিলেন কি না তা আমি বলতে পারি না, কারণ আমি তাদেরকে চিনি না, আমি যে মিছিলের কথা বলেছি সেই মিছিলের বিষয় আমি পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি। সেই পত্রিকায় আমি ঐ মিছিলের খবর পড়েছি। আমি গোলাম আযমের নাম খোজাঁর জন্য খবর পড়তাম না, খবরের প্রসঙ্গে যখন তার নাম আসতো তখন সেটা লক্ষ্য করতাম। এ খবরে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাম ছাড়া ও অন্য কারো নাম থাকতে পারে তবে আমার এ মূহূর্তে মনে পড়ছে না। শান্তি কমিটির কোন অধ:স্তন শাখাকে বাতিল করার কোন ক্ষমতা এককভাবে গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না সে সম্পর্কে আমার ধারনা নাই। শান্তি কমিটির কোন সদস্যদের দ্বারা বা অধ:স্তন কোন শান্তি কমিটি কর্তৃক কোন সংগঠিত অপরাধের বিচার চেয়ে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ চেয়ে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির বা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের নিকট অভিযোগ আনা হয়েছিল এমন কোন প্রামান্য তথ্য আমার চোখে পড়ে নাই। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্যকে অপসারনের কোন ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না তা আমার জানা নাই। রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর কোন সদস্যকে বরখাস্ত কারার বা শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল কি না তা আমার জানা নাই। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে অনেক মামলা হয়েছিল তবে সংখ্যা ৫০ টি কি না তা আমি বলতে পারব না। শহিদুল্লাহ কায়ছার, মুনির চৌধুরী, ডা: আলিম নৌধুরী হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তিনটি পৃথক মামলা হয়েছিল। শহিদুল্লাহ কায়ছার সাহেব হত্যাকান্ড সম্পর্কিত যে মামলাটি হয়েছিল তাতে অভিযুক্তের নাম ছিল খালেক মজুমদার। তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছিলেন এবং তাকে আলবদর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। উল্লেখিত মামলায় নি¤œ আদালতে শাস্তি প্রদানের পরে উচ্চ আদালতে দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল এবং সেই আপিলে খালেক মাজুমদার সাহেব খালাস পেয়েছিলেন এবং ঐ রায়ে উল্লেখ আছে যে, রাষ্ট্রপক্ষ তাকে আলবদরের সদস্য প্রমানে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্লেখিত তিনটি মামলাসহ বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যান্য মামলা সমূহে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে উল্লেখিত হত্যার পরিকল্পনা কারী বা অন্য কোন ভাবে আসামী করা হয় নাই, কারণ সেগুলো একক ভাবে হত্যা মামলা হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছিল এবং আজকে আমার যে স্বাক্ষ্য সেটা কোন একক হত্যা মামলায় প্রেক্ষিতে নয় সামগ্রিকভাবে ইহা ১৯৭১ সালের গনহত্যা সময়ে অধ্যাপক গোলাম আযম ভূমিকা নিয়ে।
১৯৭১ সালের সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৭২ সালে দুটি মামলা পয়েছিল। উল্লেখিত মামলা দুইটি তার বিরুদ্ধে কমপ্লিসিটির (সম্পৃক্ততা) অভিযোগ ছিল। এ মামলা দুইটির ব্যপারে পরবর্র্তীতে আমি আর খবর রাখি নাই ফলে অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। বুদ্ধিজীবী হত্যকান্ডের বিষয়ে ১৯৭১ সালে বিজয়ের পর পরই একটি সরকারি এবং একটি বেসরকারী তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পরলেও আমার মনে আছে ঐ সময়ে সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে এ ব্যপারে নানা উদ্যেগ নেয়া হয়েছিল তাহা কতদূর পৌছেছে সে সম্পর্কে আমি এ পর্যায়ে বলতে পারছিনা, তবে এই জনমতের চাপে ১৯৭৩ সালে বর্তমান আইনটি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩ প্রনীত হয়।
জহির রায়হান সাহেব বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনেরজন্য অনেক কিছুই করেছিলেন এবং একটি নাগরিক কমিটিও করেছিলেন। এই নাগরিক কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যের নাম আমি বলতে পারব না তবে শহীদ শহীদুল্লাহ কায়ছারের স্ত্রী পান্না কায়সার এ ব্যাপারে আমার মায়ের সংগে যোগাযোগ রাখতেন। বিজয় অর্জনের পরে দালাল আইনে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ গর্ভণর মালেক সাহেবের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তবে বিচার শেষ হয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। দালাল আইনে বিচার না করে জেনেভ কনভেনশন অনুযায়ী বিচার করার জন্য মালেক সাহেব কোন আবেদন জানিয়েছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। মালেক সাহেবের দালাল আইনে বিচারের বিরোধীতা করে কেউ কোন বিবৃতি দিয়েছিল কিনা তা আমি জানিনা। শহিদুল হক মামা নামে কোন ব্যক্তিকে আমি চিনি না। বাংলাদেশ টেলিভেশন থেকে প্রচারিত রনাঙ্গনের দিনগুলি নামে ধারাবাহিক যে অনুষ্ঠান তা সম্পর্কে আমি জেনেছি, তবে সময়ের অভাবে দেখার সুযোগ আমার হয় নাই। নাসির উদ্দিন ইউসুফ সাহেবের সংগে আমার পরিচয় আছে। তিনি ঐ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও মিরপুর ১৯৭২ সালের ৩১শে জানুয়ারী তারিখে মুক্ত হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কে তারিখ আমার নির্দিষ্ট মনে নাই। তবে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরও বাংলাদেশ কিছু কিছু পকেট হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের দখলে ছিল এবং আস্তে আস্তে সেগুলি দখল মুক্ত হয়। পাকিস্তানের একজন প্রাক্তনমন্ত্রীর বাড়ি থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিল, তবে কার তথ্য মতে উহা পাওয়া গিয়েছিল তাহা আমার এখন মনে নাই। অধ্যাপক মুনির চৌধুরী সাহেব ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতির পক্ষে অনেকের সংগে বিবৃতির স্বাক্ষর করেছিলেন এটা আমার জানা আছে। ১৯৭১ সালে ২২ নভেম্বর পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হয়তো ছিলেন না। কারণ আমি জানি ১লা ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সংগে দেখা করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন এই মর্মে যে, মুক্তি বাহিনীকে নির্মূল করতে রাজাকাররাই যথেষ্ট। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের যে অঞ্চলে বৌদ্ধরা সংখ্যাগরিষ্ট ছিল সেখান থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমারাজাত্রিদিব রায় এম,এন,এ নির্বচিত হয়েছিলেন। ঐ সময় বৌদ্ধ ধর্মগুরু ছিলেন বিশুনান্দ মহাথেরু। উল্লেখিত দুই ব্যক্তি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে কাজ করেছিলেন।  (চলবে)



১৩-০৯-২০১২ ইং পূনরায় জেরা শুরু ঃ

ইহা সত্য যে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে নূরুল আমিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছিল এবং সেই মন্ত্রী সভায় রাজা ত্রিদিব রায় একজন মন্ত্রী ছিলেন। তবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই কারন যে কোন মুক্তিসংগ্রামে আক্রমন কারী পক্ষ যাদের উপর আক্রমন করেছে তাদের মধ্যে কিছু লোককে দেখানোর জন্য বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে সামনে রাখে কারণ তারা মানুষকে ধোকা দেওয়ার চেষ্টা করে যাতে মানুষের কাছে এ ধরনের গণহত্যা বা এথনিককিনজিং এর কথা প্রকাশ না পায়। এটা আমার মনগড়া বক্তব্য নয়, স্বাধীনতার পরবর্তী বিভিন্ন বইয়ে একথা না থাকতে পারে, আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে তৎকালীন ঘটনাসমূহের বিশ্লেষন দিয়েই আমি একথা বলেছি। ইহা সত্য হতে পারে যে, তৎকালীন নূরুল আমিনের মন্ত্রী সভায় জামায়াতে ইসলামীর কোন সদস্য ছিল না। অংশুপ্রু চৌধুরীও বৌদ্ধদের নেতা ছিলেন এবং সেই নির্বাচনে এম.পি.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ও ডাঃ মালেক মন্ত্রী সভায় একজন সদস্য ছিলেন। উনারা ঐ এলাকার জনগনের প্রতিনিধিত্ব করতেন। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা সংগ্রাম পরিষদের সভানেত্রী ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, সম্পাদিকা ছিলেন মালেকা বেগম পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ঐ সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নাম নিয়ে এখনও তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬১ সালে আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত মূল ধারার রাজনীতি বলতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে বুঝিয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমার মা বেগম সুফিয়া কামাল, বাবা এবং বড় ভাই আমাদের ধানমন্ডির বাড়িতেই ছিলেন। আমার মা অসংখ্য পদক ও পুরস্কার পেয়েছেন, তবে ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে কিনা তা আমি বলতে পারব না। এর ভিতরে অনেকগুলি সরকারী ও অনেকগুলি বেসরকারী পদক ছিল। ‘মাহে নও’ নামক একটি মাসিক পত্রিকায় আমার মা লেখালেখি করতেন যার সম্পাদক ছিলেন কবি আব্দুল কাদির।

আমার অপর বোন যিনি আমার সঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি জীবিত আছেন। আমার যে ভাইয়ের মাধ্যমে আমরা ইনফরমেশন পেতাম তিনি এখনও জীবিত আছেন। আমার ভাইয়ের লিখিত বিভিন্ন খবরা খবর দেওয়া চিঠিগুলো আমরা সংরক্ষন করতে পারি নাই। ঐ চিঠিগুলোতে গোলাম আযম সম্পর্কে আমার বর্ণিত মতে কোন বক্তব্য না থাকায় আমি ইচ্ছাকৃতভাবে উহা গোপন করেছি, ইহা সত্য নহে। আমি আইন ও শালিশ কেন্দ্রের শীর্ষ নির্বাহী। আমি ওখান থেকে মাসিক সম্মানি পাই। ১৯৮৪ সালে আমি সিলেটে থাকতাম এবং ওখানে ফ্রিল্যান্স কনসালটেন্সি করতাম। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমি সিলেটে ছিলাম। ঐ সময়ে আমি উল্লেখিত কাজ করতাম। আমার ওকালতিতে আমার সিনিয়র ছিলেন জে.এন.দেব। একটি সনদ পাওয়ার জন্য যতদিন কোর্টে যাওয়া প্রয়োজন আমি ততদিনই কোর্টে গিয়েছি, লাইসেন্স পাওয়ার জন্যে ৬ মাস কোর্টে যেতে হয়। আমি সিভিল প্রাকটিস করি। আমার এখনও সিলেট বারের সদস্য পদ আছে, তবে আমি কোর্টে যাইনি। আমি আমার বার কাউন্সিলে সনদ পাওয়ার জন্য যে এফিডেভিট জমা দিয়েছি সেখানে আমি কোন পেশায় নিয়োজিত নই মর্মে উল্লেখ করেছি। সেখানে আমি বলেছি যে, আমার সিনিয়রের সঙ্গে ফৌজদারী মামলা পরিচালনা করেছি। আমি জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র পড়ি নাই। ঐ সংগঠনের সদস্যপদ পাওয়া বা বাতিল হওয়ার কোন নিয়মাবলী আমি জানি না। আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত বক্তব্য “পত্র পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হতো” এখানে পত্রিকা বলতে আমি তৎকালীন পূর্বদেশ এবং দৈনিক আজাদ কে বুঝিয়েছি। ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল এবং ৭ই এপ্রিল তারিখে ঐ পত্রিকাগুলিতে খবর প্রচারিত হয়েছিল। ঐ পত্রিকাগুলোতে আমার বর্ণিত মতে গোলাম আযম সাহেবের ভূমিকা সম্পর্কে কোন বক্তব্য নাই, ইহা সত্য নহে। ঐ তারিখ সমূহের দৈনিক আজাদ পত্রিকায় এ ধরনের কোন খবরও নাই, ইহা সত্য নহে। ১৯৭১ সালের ৬ই এপ্রিল তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যে বক্তব্য এসেছিল তাতে পি.ডি.পি’র নূরুল আমিন সাহেবের নেতৃত্বে খ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে সাক্ষাত করে এবং দেশের স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য সহযোগিতার কথা বলা হয় এবং সেখানে গোলাম আযমের নেতৃত্বের কথা বলা হয় নাই, এর উত্তরে সাক্ষী বলেন যে, ইহা সত্য হতেও পারে, তবে ঐ সময়ে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় গোলাম আযমের নেতৃত্বে কথা বলা হয়েছে এবং শান্তি কমিটি গঠনের ব্যপারে তার মূখ্য ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি যে, মিছিল, মিটিং হয়েছে বক্তৃতা দেয়া হয়েছে এমনকি গোলাম আযম সাহেবের দসতখত সম্বলিত এক টাকা মূল্যমানের টিকিটও বিক্রয় হয়েছে। শান্তি কমিটি গঠনের ব্যাপারে গোলাম আযম মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন একথাগুলি ১৯৭১ সালের ৫ ও ৭ই এপ্রিলের দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় আছে। নূরুল আমিনের নেতৃত্বে সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করার পরে ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ এর দৈনিক আজাম পত্রিকায় শান্তি কমিটি গঠিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়, তবে ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ এর পত্রিকায় কিনা তা আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন মুসলীম লীগ নেতা খাজা খয়রুদ্দিন। সেই শান্তি কমিটি ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট ছিল কিনা তা আমার জানা নাই। এই কমিটির ডিকারেশন লেখা ছিল “নাগরিকদের প্রত্যহিক জীবনে স্বত্তর স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং জনমতে অহেতুক ও ভিত্তিহীন শংকা দূর করার উদ্দেশ্যে এই কমিটি গঠন করা হয়” ইহা সত্য তবে যে সময়ে জনগনকে হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং লোকদেরকে নির্বিচারে হত্যা উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেই সময়ে এই ঘটনাগুলোকে অহেতুক ভিত্তিহীন শংকা বলে প্রকাশ করে তারা নিজেরাই নিজেদের দোষ সমূহকে ঢাকার অপচেষ্টা করে তাদের মানসিকতা এবং অপরাধের প্রতি তাদের সমর্থনকে তারাই প্রকাশ করেছে। এই ব্যাখ্যাটি আমার রাজনৈতিক অবস্থান এবং জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমের প্রতি আমার বিদ্বেষ প্রসূত, ইহা সত্য নহে। গোলাম আযমের বক্তব্য বা বিবৃতিতে মুক্তিযোদ্ধারাই দুষ্কৃতিকারী এই ধরনের বক্তব্য সম্বলিত বক্তৃতা বা লিফলেট বা পেপার কাটিং আমার নিকট আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকেও আমি দিয়েছি তবে অদ্য ট্রাইব্যুনালে আনি নাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চাপ সৃষ্টি করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কাউকে শান্তি কমিটিতে যোগদান করার ব্যাপারে বক্তব্য সম্বলিত কাগজপত্র আমার নিকট আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিয়েছি তবে অদ্য ট্রাইব্যুনালে আনি নাই। যুদ্ধকালীন সময়ে অত্র বক্তব্য সম্বলিত দেশী বা বিদেশী কোন পত্রিকা আমার সংগ্রহে আপাততঃ নাই।

আমার জবানবন্দীতে প্রদত্ত বক্তব্য “গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে....তারা গোপনে কাজগুলো করবে মর্মে জেনেছি” মর্মে যে বক্তব্য আমি দিয়েছি সে ব্যাপারে দেশী বা বিদেশী কোন পত্র পত্রিকায় যুদ্ধকালীন সময় খবর প্রকাশিত হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না, তবে এই খবরগুলো যে সব মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে আসতেন এবং যারা আবার ভারতে ফিরে যেতেন তাদের মধ্যে অনেক গোয়েন্দাও ছিল তাদের নিকট থেকে আমরা জেনেছিলাম। এই খবরগুলি আমরা আগষ্টের শেষ দিকে, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে পেয়েছিলাম। এই খবরগুলি অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে শুনেছি, তাদের মধ্যে খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার এরাই মূখ্য ছিলেন, তারা আমাদেরকে সব সময় দেশের অভ্যন্তরের কথা আমাদের আত্মীয় স্বজনের কথা বলতে গিয়ে একথাগুলি বলেছিলেন। আমরা যখন জুন মাসে ভারত যাই জনাব খালেদ মোশাররফ সাহেব তার আগে থেকেই সেক্টর ২ এর কমান্ডার ছিলেন। জামায়াত ইসলামী একটি রাজনৈতিক সংগঠন। এর জন্ম অবিভক্ত ভারতে হয়েছে। আমরা শুনেছি যে, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন গোলাম আযম। তিনি কবে থেকে আমিরের দায়িত্ব নিয়েছেন তা আমি বলতে পারব না। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠিত শান্তি কমিটির রাজাকার, আলবদর, আলশামস সবগুলি এপ্রিল ১৯৭১ বা তার পরে হয়েছে। গঠনতন্ত্র মতে শান্তি কমিটি ছিল সামাজিক শক্তি এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছিল সহায়ক (ধীঁরষরধৎু) বাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এগুলি অস্তিত্যহীন হয়ে যায়। গোলাম আযম সাহেব ঐ সময়ে কোন কমিটি বা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন না, তবে তার অধীনস্থ মতিউর রহমান নিজামী সাহেব আলবদর প্রধান ছিলেন এবং উল্লেখিত চারটি সংগঠন তৈরিতে গোলাম আযম সাহেবই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, হিটলার নাৎসি বাহিনীর প্রধান ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না, এমনকি সদস্যও ছিলেন না কিন্তু তিনি ছিলেন ন্যাৎসী বাাহিনীর অত্যাচারের মূল নায়ক তেমনি যদিও গোলাম আযম সাহেব উল্লেখিত চারটি সংগঠনের প্রাতিষ্ঠানিক মূখ্য নেতা ছিলেন না কিন্তু এই সবগুলি সংগঠন তার নির্দেশে ও নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যা করেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমি মনে করি গোলাম আযম সাহেব সেরকমই করেছেন। হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় ছিলে ইয়াহিয়া খান এবং তৎকালীন গভর্নর ছিলেন টিক্কা খান। হিটলারের অবস্থানে ১৯৭১ সালে গোলাম আযম সাহেব ক্ষমতাবান ছিলেন না। হিটলারের সঙ্গে গোলাম আযম সাহেবের তুলনা করা অস্বাভাবিক এবং উদ্দেশ্যমূলক, ইহা সত্য নহে। (চলবে)



১৩-০৯-১২ ইং- ২.০০ ঘটিকা, পূনরায় জেরা শুরু ঃ
স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে যত ইতিহাস লেখা হয়েছে, যত বই লেখা হয়েছে সব জায়গায় ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, গোলাম আযম সাহেবকে সঙ্গে নয়, আমি গোলাম আযম সাহেবের নাম উল্লেখ করে ইতিহাস বিকৃতি করছি, ইহা সত্য নহে, আমি গোলাম আযম সাহেবকে ঐ দুইজনের সঙ্গে যুক্ত করছি। ইহা সত্য নহে যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর উচ্চতম পর্যায় থেকে গোলাম আযমের প্রশংসা করে কোন বিবৃতি দেয়া হয় নাই। এই প্রশংসা সম্বলিত বিবৃতি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রদান করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অঞ্চলীয় কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক লিখিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইটি আমি পড়েছি। উনি কোন পাকিস্তানপন্থী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় প্রভাব থাকায় কথা স্বীকার করেন নাই, ইহা তাহার নিজস্ব মতামত। হামিদুল্লাহ খান সাহেবের বাসায় কাজের ছেলেটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা আমি আমার জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছি তাকে যুদ্ধকালীন অবস্থায় এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকলেও খোঁজ করা হয়েছে কিন্তু তার কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। সেই ছেলেটির নাম আমার এ মুহুর্তে মনে পড়ছে না। ১৯৭১ সালে দেশী, বিদেশী পত্রিকায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর নেতা হিসাবে গোলাম আযমের নাম আসে নাই ইহা সত্য, তবে তাদের কার্যকলাপের সঙ্গে তার নাম এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের পত্র-পত্রিকায় আলবদর, আলশামস ও রাজাকারদের অভিযান ও কার্যাবলীর খবরের সঙ্গে গোলাম আযম সাহেবের নাম এসেছে এই ধরনের ঐ সময়কার কোন পত্র পত্রিকা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দিই নাই।
একটি সামরিক বাহিনীর সহায়ক বাহিনী যখন কোন অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করে তখন তার কৌশলগত দিক এবং পরিকল্পনা হয় তারা নিজেরা তৈরি করে সামরিক বাহিনী অনুমোদন নেয় অথবা সামরিক বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করে নিয়ম মত তাই হয় (প্রসিকিউশনেরে আপত্তি সহকারে), তবে নিয়ম মত ঐ তিন বাহিনী কাজ করছে তা তৎকালীন ঘটনা সমূহ দেখলে মনে হয় না। রাজাকার বাহিনী গেজেটের মাধ্যমে সরকারী তত্ত্বাবধানে আসার আগে তার প্রধান কে ছিলেন তার নাম আমার মনে নাই। নারী পূনর্বাসন কেন্দ্রে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছি। আমি যে ১৯ জন অত্যাচারিত নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তাদের নাম আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট দিতে পারি নাই, কারন সেগুলি যেখানে ছিল সেখান থেকে ১৯৭৫ সালের পর নষ্ট করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট তারিখ বা সাল বলতে পারব না। এই নষ্ট করার ব্যাপারে অভিযোগ করার দায়িত্ব নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের। তারা তা করেছে কিনা তা আমার জানা নাই। আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত বরিশালের যে ঘটনা অর্থাৎ সমবেত জনগনের উপর হিলকপ্টার ও লঞ্চ থেকে গুলি বর্ষনের ঘটনা খুব সম্ভবত মে মাসের ১০ তারিখে সংঘটিত হয়েছিল এবং সেই ঘটনায় আমাদের বাড়ির কেয়ার টেকার আব্দুল মালেক সরদার, যাকে আমরা কাকা বলে ডাকতাম তিনি নিহত হন। ঐ ঘটনায় বহু প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে কেউ বর্তমানে জীবিত আছেন কিনা তা আমার জানা নাই। আক্রমনকারী হেলিকপ্টার ও লঞ্চ এর নিয়ন্ত্রকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট ছিল বলে আমরা জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর চলাচল রোধকল্পে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় ব্রীজ কালভার্ট ধ্বংস করেছে। অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের সঙ্গে বেসামরিক ব্যক্তি হিসেবে শুধুমাত্র জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম শোনা যায় ইহা সত্য, ইহাতেও মনে হয় ঐ সময় বেসামরিক ব্যক্তিরাও জড়িত ছিল।
ইহা সত্য নহে যে, আমার মা ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম পরিষদ বলে একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছিল মূল ধারার রাজনীতির আন্দোলনের সাথে, বা মার্চ মাসে যখন থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে আমরা সাংগঠনিকভাবে অংশগ্রহন করেছিলাম এবং সেই সময়ে সে সমস্ত সভা, সমিতি ও সমাবেশ হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহন করেছি সক্রিয়ভাবে। ৭ই মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায়ও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহন করেছি এবং “আমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই বানীতে উজ্জিবীত হয়েছিলাম, বা অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক কর্মী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উজ্জিবীত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা রকম হামলাও চালানো হচ্ছিল, বা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রি ১২-০০ টার দিকে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম থেকে টেলিফোনে আমাদের নিকট জানতে চান যে, ঢাকার অবস্থা কেমন এবং শুধু এটুকুই বলতে পারেন যে, অবস্থা ভাল নয়, একথা বলার পর পরই টেলিফোনের লাইন কেটে যায়, বা আমাদের পাশের দোতলা বাড়ির একজন জানালেন যে, তাদের বাড়ির ছাদ থেকে কোনাকোনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আগুনের হলকা দেখা যাচ্ছে এবং আমাদের বাড়ির সামনে একটি নির্মানাধীন বাড়ির ছাদে একটি কালো পতাকা উড়ছিল এবং সেই বাড়ির দারোয়ানকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির সামনে পানির লেকের উপর একটি ব্রীজ আছে এবং ঐ ব্রীজের উপর দিয়ে মানুষের দৌড়াদৌড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং ঐ ব্রীজের উপর একজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, বা সাংবাদিক শহিদুল্লাহ কায়ছার সংবাদ পাঠালেন যে, বা আস্তে আস্তে আমরা জানতে পারলাম যে, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোর, রাজশাহী সর্বত্রই একই ধরনের হত্যাকান্ড চলছে এবং পুলিশের তৎকালীন বড় কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ রাজশাহীতে ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় কর্মরত বাঙ্গালী উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণকে হত্যা করা হয়েছে, বা ২৭শে মার্চ সকাল বেলায় যখন আমরা রাস্তা পার হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে হেটে যাই আমি নিজে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে ট্রাকে তুলছিল, বা তারা কিছু গোপন কিলার ফোর্স তৈরি করার উদ্যেগ নিয়েছে এবং আলবদর, আলশামস নামে দুটি বাহিনী ঐ উদ্দেশ্যে গঠন করা হয় এবং তারা খুব গোপনে একাজগুলি করবে মর্মে জেনেছিলাম, বা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, রায়ের বাজারের কাছে হিন্দু অধ্যূষিত এলাকায় একটি অপারেশনে তাকে যেতে হবে, বা সেই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন খালেদ মোশাররফ সাহেব। তার সঙ্গে আমরা দেখা করলাম, বা সেখানে আমাদের সঙ্গে এই কর্মকান্ডে জড়িত হন ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী, ডাঃ মোবিন, ডাঃ কামারুজ্জামান প্রমুখ যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অত্যন্ত সম্মানিত ও সুপরিচিত। পরে ডাঃ ক্যাপ্টেন সিতারা এসে আমাদের সাথে অক্টোবর মাসে যোগ দেন যিনি পরবর্তীতে বীর প্রতীক উপাধীতে ভূষিত হন, বা আমরা যেখানে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ থেকে আরও কয়েকজন মেয়ে যারা বাংলাদেশে ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করছিল এবং যোগাযোগ রাখছিল তারাও সেখানে এসে হাসপাতালে সেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজে যোগ দেন। যাদের মধ্যে প্রফেসর জাকিয়া খাতুন, আসমা, রেশমা, মিনু, অনুপমা, পদ্মা, নিলিমা, ডাঃ ডালিয়া শামসুদ্দিন উল্লেখযোগ্য, বা আমেরিকা প্রবাসী ভাইয়ের নিকট আমার মায়ের দেয়া কোড ল্যাংগুয়েজের চিঠি সমূহ যাহা আমাদের নিকট দেয়া হতো সেগুলির মাধ্যমে আমরা দেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর পেতাম, বা শেরাটনের বোমা হামলার ঘটনা, রুমি, বদি, আলম, বাদল, চুন্নু সামাদ, আলভী গংদের বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে ঘটনা সবকিছুই আমরা নিয়মিত ঐ হাসপাতালে বসে পেতাম, বা আলশামস, রাজাকার এই বাহিনী সমূহের নেতা হিসেবে গোলাম আযম স্বাধীনতার পক্ষের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন এর বিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম, বা চার্চের মধ্যেও ঢুকেও তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে তাদেরকে এই অত্যাচারিত ও ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে, বা শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান দেরকেই একই উদ্দেশ্যে আক্রমন করা হয়েছে তা নয়, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং স্বাধীনতার পক্ষের প্রত্যেকটি মানুষের চেতনাকে আঘাত করে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়েছে, তবে বিশেষভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় কারণে তাদের উপর হত্যা লুন্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণ সহ বিভিন্ন অপরাধ করা হয়েছে, বা কালি মন্দির আক্রমন, শাখারী বাজার, রায়ের বাজার, হাটখোলা ওয়ারী যে সমস্ত জায়গা হিন্দু অধ্যূষিত বলে পরিচিত কারপিউ দিয়ে অগ্নিসংযোগ করা আবার একই সাথে রাজারবাগে অগনিত পুলিশ বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, একই রকমভাবে পিলখানায় রাইফেলসের সদস্যদের উপর আক্রমন করা একটি ঘৃন্য গণহত্যার উদাহরন স্থাপন করে, বা বরিশালের একটি উদাহরন দেই বাজারে সমবেত জনগোষ্ঠির উপর  হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করা হয়। ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ দৌড়ে নদীতে ঝাপ দিতে গেছে তখন লঞ্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদেরকে বিপরীত দিতে থেকে গুলি করেছে। এই ধরনের ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এরকম ঘটনা দেশের সর্বত্রই হয়েছিল। এই ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার কৌশল এবং সেই কৌশলকে সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে তারাও এই অপরাধের সমান ভাগিদার, বা সহযোগিতার মাস্টার মাইন্ড, বা ১৯৭১ সালের ২৩শে আগষ্ট এবং ৩১শে আগষ্ট তারিখে গোলাম আযম পাকিস্তানের লাহোর এবং হায়দারাবাদে নিজে উপস্থিত থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এইসব কর্মকান্ডকে সমর্থন দিয়েছেন এবং মক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন এবং মুক্তিবাহিনীকে নির্মূল করার আহ্বান জানিয়েছেন। লক্ষ্য করা যেতে পারে সেপ্টেম্বর মাসে যখন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রী সভা গঠন করা হয় সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদেরকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এখানে একটা প্রশ্ন পরিস্কার করা প্রয়োজন যে, শান্তি কমিটি কখনও সশস্ত্র কোন অভিযানে অংশ গ্রহন করেছে কিনা। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তারা কখনও কখনও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে তারা সশস্ত্র অভিযানে অংশ নিয়েছে। রাজাকারদের কাছে অস্ত্র ছিল সেটা সকলেরই জানা আছে। আমরা আরও লক্ষ্য করি ১৯৭১ সালের ১লা ডিসেম্বর যখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে তখনও গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে, মক্তিবাহিনীকে পরাভূত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তিনি দম্ভভরে একথাও বলেন যে, সে ব্যাপারে রাজাকাররাই যথেষ্ট, বা যে উপায়ে এবং যে নির্যাতন ও অত্যাচার করে এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় নাৎসী আমলেরও অনেক হত্যাকান্ড তা দেখে লজ্জিত হবে। আমরা জানি রাজাকার, শান্তি কমিটি ও আলবদর ও আলশামস এই সমস্ত বাহিনীল দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন গোলাম আযম। এই কথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই। আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের অত্যাচারের ব্যপারে আমি যা বলেছি তা আমি তদন্তাকারী কর্মকর্তার নিকট বলি নাই, ইহা সত্য নহে। রাজশাহীর উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা মামুন মাহমুদকে আমি চিনি, তিনি বাঙ্গালী ছিলেন, তিনি আমাদের অতিপরিচিত বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন। আমি আমার আত্মজীবনী মূলক একটি বই লিখেছি তার নাম “আত্ম কথা নিলীমার নীচে”। আমি রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা হয়েছিলাম। এই উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার আগে বেবী মওদুদ, আসাদুজ্জামান নূর, সাবের হোসেন চৌধুরী এবং মোনায়েম সরকার আমাকে টেলিফোন করে বলেছিলেন তোমার নাম নেত্রী শেখ হাসিনা উপদেষ্টা হিসাবে ১৪ দলের পক্ষ থেকে পাঠিয়েছে, যদি সিলেক্ট করে তবে তুমি না করোনা। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এম,পি সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা আমাদের অফিসিয়াল যোগাযোগ। আমি আমার জবানবন্দীতে অধ্যাপক গোলাম আযমকে স্বাধীনতা বিরোধীতার প্রতীক, গণহত্যা সমর্থনের ও সহযোগিতায় মাস্টার মাইন্ড, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের দার্শনিক এবং কৌশলগত পরিকল্পনাকারী সহ তার বিরুদ্ধে জবানবন্দীতে এবং জেরার উত্তরে যে সমস্ত অভিযোগ এনেছি তাহা সম্পূর্ণ অসত্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত, ইহা সত্য নহে। আমি তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছি ইহা সত্য নহে। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব পাকিস্তানের অখন্ডতা বিশ্বাসী হলেও তার ভূমিকা শুধুমাত্র রাজনৈতিক, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)

মুনতাসির মামুন

শনিবার, ১ জুলাই, ২০১২
আমার নাম মুনতাসির উদ্দিন খান মামুন ওরফে মুনতাসির মামুন। আমার বয়স ৬১ বৎসর। আমি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। আমি ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর হাই স্কুল থেকে এস,এস,সি পাশ করি, ১৯৬৮ সনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচ,এস,সি পাশ করি। তৎপর ১৯৬৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়ে ¯œাতক সম্মান ও ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করি ১৯৭২ সালে। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আমাদের ¯œাতকোত্তর পরীক্ষা ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু ডিগ্রীটি হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করি। ১৯৮৩ সালে আমি পি,এইচ,ডি ডিগ্রী লাভ করি। আমার লেখালেখি এবং মুখ্য গবেষণার বিষয় তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ বর্তমানে বাংলাদেশ এর সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নগরায়ন ও মুক্তিযুদ্ধ। আমি ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিশু লেখক হিসাবে প্রেসিডেন্ট পুরষ্কার লাভ করি। খুব সম্ভব ১৯৯৩ সালে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরষ্কার লাভ করি। ২০১০ সালে ২১ পদক লাভ করি গবেষণার জন্য। সুনির্দিষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার জন্য মার্কেণ্টাইল ব্যাংক পুরষ্কার লাভ করি। এছাড়া আরও অন্যান্য পুরষ্কার প্রাপ্ত হই। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়টা বাঙ্গালী জাতির জীবনে সবচেয়ে সংকটময় এবং ক্রান্তিকালীন সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যারা তখন পড়াশুনা করেছি তাদের অধিকাংশই কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত ছিল বাঙ্গালী জাতির আশা আকাংখা পরিপূরণে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তানিদের ভাষায় আমাদের ক্রোধান্বিত করেছিল। এই ক্রোধ ও ক্ষোভ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৬৯ সনের গণ-আন্দোলনে। এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই কম বেশি জানি। সে কারণে বিস্তারিত বলব না। তবে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পর আমরা ভেবেছিলাম এই প্রথম আমাদের ন্যায্য দাবিগুলি পূরণ হবে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চের পর আমরা অনুধাবন করলাম হয়তো আবার আমাদের বঞ্চিত করা হবে। শুধু এটুকু বলতে পারি আমাদের জেনারেশনের প্রায় সবাই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলাম। ১৯৭১ সালের পুরা মার্চ মাসে আমি ঢাকায় ছিলাম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যা ঘটেছিল তা এখনও স্মরণ করলে মর্মাহত হই। আমাদের বয়সী কারো পক্ষে ঐ সময়কার বর্বর উপাক্ষ্যান তুলে ধরা খুবই কষ্টকর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত আমি ছিলাম মিরপুরের পল্লবীতে। ২৫ মার্চ রাতে গোলাগুলির শব্দে আমরা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়ি। পল্লবী তখন খুবই নিরিবিলি জায়গা ছিল এবং মীরপুরে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ ছিল অবাঙ্গালী। কি হয়েছে তা দেখার জন্য আমরা ছাদে উঠি। গোলাগুলির ষ্পষ্ট আওয়াজ পাচ্ছিলাম, দূরে আগুনের লেলিহান শিখা চোখে পড়ছিল এবং কিছুক্ষণ পর আমরা দেখলাম কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য সামনের রাস্তা দিয়ে টহল দিচ্ছে। এর আগে আহম্মদ ছফা টেলিফোনে জানিয়েছিলেন ঢাকা শহরে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়েছে এবং পাকিস্তানী সেনারা রাস্তায় নেমে পড়েছে। পরের দিন রেডিওতে আকাশ বাণী থেকে শোনা গেল তাদের ভাষায় পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং তারপর বার বার আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি বাজানো হচ্ছিল। আমি এটুকুই বুঝে নিয়েছিলাম যে, পাকিস্তানী বাহিনী বন্দুকের সাহায্যে আমাদের দাবি নস্যাৎ করে দিতে চাচ্ছে। ২৯ মার্চ পর্যন্ত মিরপুরে অবাঙ্গালীরা পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তায় প্রায় প্রতিটি বাঙ্গালীর বাড়ি লুট করে, হত্যা করে এবং আমাদের কয়েকটি পরিবার তখন কয়েকজন অবাঙ্গালীর সহৃদয়তায় বেঁচে যায়। ২৯ মার্চ আমি মীরপুর থেকে ঢাকায় আসি। ঢাকায় আসার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরানো ঢাকার কয়েকটি এলাকায় বন্ধু বান্ধবদের খোঁজ করি। তখন দেখেছি পাকিস্তানী বাহিনী কি নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংস কান্ড চালিয়েছে। ঢাকা শহর থেকে যেভাবে মানুষ পালাচ্ছিলেন তাতেই বোঝা যায় মানুষ কেমন আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। এটুকু হচ্ছে মার্চ মাস পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ। আমি খুব সম্ভবত অক্টোবর মাস পর্যন্ত ঢাকাতে ছিলাম। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পরে ঢাকা থেকে কয়েকটি সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল বলে আমার মনে পড়ে। যার মধ্যে ডেইলী অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তান, সংগ্রাম, পূর্বদেশ পত্রিকাও ছিল। তখনকার পত্র পত্রিকাগুলির ব্যাপারে বলতে পারি সেগুলি ছিল অবরুদ্ধ দেশের সংবাদপত্র। কোন পত্রিকাই সরকারি অনুমোদন হীন কোন খবর প্রকাশের ক্ষমতা ছিল না। আমরা পত্রিকাগুলি পড়তাম একটা কারণে। সরকার কি করছে সরকারের সংগে যারা আছে তারা কি বলছে, কি করছে এই সব বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়ার জন্য। আরেকটি বিষয়ের সত্যতার জন্য খবরের কাগজে আমরা খুজতাম তৎকালীন সরকার ও রাজনীতিকদের ভাষায় ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ কর্মকান্ড জানার জন্য। কেননা দুষ্কৃতিকারী মানেই ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। এছাড়া আরও খবর জানার জন্য আমরা নির্ভরশীল ছিলাম বি,বি,সি, রেডিও অষ্ট্রেলিয়া, আকাশ বাণী এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উপর। ফলে খবরের সত্যতা যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতো। মার্চ মাসের পর থেকে যেসব রাজনৈতিক দল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগের বিভিন্ন অংশ, পি,ডি,পি এবং আরও কিছু দলের শাখা। তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগের ভূমিকাই ছিল বেশী। আগেই উল্লেখ করেছি ২৫ মার্চের পর থেকে কোন দলগুলি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে এবং তাদের প্রতিনিধি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে কিভাবে সহায়তা করেছিল। তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল টিক্কা খানের সদলবলে দেখা করা এবং এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা এ কাজটি করেছিল যখন প্রতিদিনই পাকিস্তানী বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ, লুট, ধর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এ রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে প্রখ্যাত ছিলেন নূরুল আমিন এবং গোলাম আযম এবং আমরা বার বার দেখি যে এপ্রিলে তাদের পরামর্শে ও উৎসাহে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটি পরবর্তীকালে দুভাগ হয়ে গেলেও খাজা খয়রুদ্দিন গোলম আযমের নেতৃত্বোধীন শান্তি কমিটি প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তা পেয়েছিল। অচিরেই আমরা দেখতে পাই তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী, আল-বদর, আল-শামস ইত্যাদি বাহিনী। লক্ষ্যণীয় এই যে, এই সব কমিটি ও বাহিনীতে জামায়াতে ইসলামীর প্রাধান্য ছিল বেশি। উল্লেখ্য সে সময়ের সংবাদপত্রগুলি যদি দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাবো জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির জনাব গোলাম আযমের বক্তব্য প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজাকার বাহিনীর সূত্রপাত জামায়াতে ইসলামীর নেতার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার তার একটি আইনী কাঠামো তৈরি করে। আল-বদর বাহিনীরও নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ছিল সবচেয়ে বড় সে কারণে এসব কমিটি এবং বিভিন্ন বাহিনীতে জামায়াতের কর্মীদের আধিক্য ছিল বেশি। এর সাথে অন্যান্য দল যাদের কথা আগে উল্লেখ করেছি তাদের কর্মীরাও প্রধানত শান্তি কমিটি ও বাহিনীতে ছিল। আমি যখন একটি দলের নাম বলছি তখন তার ভিতরে সেই দলের অঙ্গ সংগঠনকেও অন্তর্ভূক্ত করছি এবং প্রত্যেকটি দলের ব্যাপারেই একথা প্রযোজ্য। এসব দলের নেতারা প্রতিনিয়ত বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে তাদের কর্মীদের উদ্বৃদ্ধ করেছে, প্রনোদনা যুগিয়েছে এসব কমিটি ও বাহিনীতে যোগদানের জন্য। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক জান্তাকে সহায়তা করার জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতের তৎকালীন আমির জনাব গোলাম আযম। আজকে ৪০ বৎসর পরও যখন শান্তি কমিটির সদস্য রাজাকারদের এবং আল-বদরদের হত্যাযজ্ঞ, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এগুলোর কথা স্মরণ করি তখন শিউরে উঠি। পাকিস্তান বাহিনী তো ছিলই কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে তাদের এই সহযোগীরা যদি না থাকতো তাহলে হয়তো এই ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা খানিকটা কম হোত এবং আমরা আরও আগে জয়ী হতে পারতাম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ আমি লিখেছি। প্রধানত আমি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির উপর বেশি গবেষণা করেছি। আমার সব সময় একটা কৌতহল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া বাঙ্গালী যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে তাদের মনোজগৎটা কেমন ছিল। তারা এ ধরণের নিষ্ঠুর কর্মকান্ড একই জাতির মানুষের উপর, একই ধর্মালম্বীদের উপর কিভাবে করতে পারে সেটা মিমাংসা আমরা করতে পারিনি। এ ধরনের যে কটি বইয়ের কথা আমার মনে পড়ছে তার মধ্যে আছে দুই খন্ডে প্রকাশিত ‘রাজাকারের মন’, ‘পাকিস্তানী জেনারেলদের মন’, ‘সেই সব পাকিস্তানী’, ‘শান্তি কমিটি’ ইত্যাদি। এছাড়াও আমার সম্পদানায় প্রকাশিত হয়েছে পাঁচ খন্ডের ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র’, ‘১৩ নম্বর সেক্টর’ প্রভৃতি। এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের সংখ্যা সোয়া দুইশত এর মত হবে। আমরা যারা তখন দেশে ছিলাম তারা দেখেছি, শুনেছি রাজাকার বাহিনী, আল-বদর এবং শান্তি কমিটির নৃশংস কর্মকান্ড। পরবর্তীকালে যখন গবেষণা করতে গেছি তখন এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জেনেছি। আমরা অনেকে এসব কমিটির বা বাহিনীর কর্মকান্ডের মধ্যে সুক্ষ্ম তফাৎ করার চেষ্টা করি। কিন্তু মূলত এদের সবার লক্ষ্য ছিল একই। সেটি হচ্ছে তৎকালীন ক্ষমতার সংগে সংযুক্ত থাকা, সম্পদ লুটের মাধ্যমে আহরণ, জনগণকে দমিত করার জন্য হত্যা ও ধর্ষণকে ব্যবহার। যদি আমরা শান্তি কমিটির কথা ধরি তাহলে আমরা দেখবো যে শান্তি কমিটি কেন্দ্র হতে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত ছিল এবং এই শান্তি কমিটি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিভিন্ন জায়গায় পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছে, হত্যা করেছে বা সহায়তা করেছে, বাঙ্গালী নারীকে ধর্ষণ করেছে বা ধর্ষণে সহায়তা করেছে এবং সম্পদ লুট করেছে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ কর্মী এবং হিন্দু ধর্মালম্বীদের। তাদের সব সময় প্ররোচনা দিয়েছে, প্রনোদনা যুগিয়েছে শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম ছিলেন প্রধান। এর উদারহণ আমরা পাই তৎকালীন পত্র পত্রিকায়। আমরা যদি তুলনামূলক আলোচনা করি তাহলে দেখবো জনাব আযমের বক্তব্যই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। আমার যতদূর মনে পড়ে তার বক্তব্যের ধরণ ছিল কয়েকটি
(১) দুষ্কৃতিকারী অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের প্রতিহত করা এবং নির্মূল করা।
(২) তাদের ভাষায় দেশ প্রেমিক অর্থাৎ পাকিস্তানী ও পাকিস্তানের সহযোগীদের সমর্থনের আহ্বান।
(৩) এই সব দেশ প্রেমিককে প্রয়োজনে অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিতকরণ।

তাদেরকে প্রকাশ্যে উজ্জিবীত করায় এবং সহায়তা করায় প্রকৃতপক্ষে হত্যাযজ্ঞ, লুট ও ধর্ষণে সহায়তা করা হয়েছে এবং এর জন্য তাদের কোন দায়বদ্ধতা ছিল না। রাজাকার বাহিনী প্রথমে জামায়াতের কর্মীদের নিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার তাদের এক ধরনের আইনী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসে। তারাও একই ভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে, সহায়তা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের অংশ গ্রহণ করেছে। এককভাবে তারা (রাজাকার বাহিনী) একই ধরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে। উদ্দেশ্য ছিল একই, ক্ষমতার সংগে অবস্থান এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে যারা বিশ্বাসী তাদের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করা। ঐ সময়ের নথিপত্র যদি আমরা দেখি বিশেষ করে যারা ধর্ষিত হয়েছে, আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই মানুষ কিভাবে এ ধরনের কাজ করতে পারে। এ সম্পর্কে কিছু বই বেরিয়েছে সেখানে দেখলে দেখা যাবে তার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর। রাজাকারদের একই ভাবে উৎসাহ দিয়েছে, প্রনোদনা যুগিয়েছে এবং প্ররোচনাও দিয়েছে ঐ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। যার মধ্যে জামায়াতের তৎকালীন আমির জনাব গোলাম আযম উল্লেখযোগ্য। সেই সময় পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তার বিভিন্ন বক্তব্য এর প্রমাণ। আল-বদর বাহিনীর ভূমিকা ছিল সুনির্দিষ্ট। শান্তি কমিটি বা রাজাকাররা নির্বিচারে গণহত্যা করেছে, লুটপাট এবং ধর্ষণ করেছে। কিন্তু আল-বদররা প্রধানত পেশাজীবীদের (বুদ্ধিজীবীসহ) হত্যা করেছে। এর কারণ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসীদের মধ্যে যাতে একটা প্রবল শুন্যতা সৃষ্টি হয়। এই আল-বদর বাহিনী প্রধানত জামায়াত কর্মীদের দ্বারাই গঠিত হয়েছিল, যার প্রধান ছিলেন জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী। সুতরাং একটা জিনিষ পরিষ্কার যারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোষর হিসাবে কাজ করেছে এর মধ্যে ব্যক্তি, দল সবই অন্তর্ভূক্ত। তারা প্রকাশ্যে এই সব হত্যাকান্ড, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী। কেননা বলা যেতে পারে তারা এক প্রকার লাইসেন্স প্রদান করেছে হত্যা করার জন্য। কারণ তারা অহরহ রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে এসব কমিটির সদস্য ও বাহিনীর সদস্যদেরকে উৎসাহিত করেছে এসব বর্বর কর্মকান্ড করার জন্য এবং এসব করলে তাদের কোন শাস্তি হবে না সেটাও নিশ্চিত করা হয়েছে। কারণ এসব কর্মকান্ড যারা করেছে তাদের কেউ কখনও দন্ডিত হয় নাই। ফলে যারা উৎসাহ যুগিয়েছে এবং যারা কর্মকান্ড করেছে তারা প্রত্যেকেই এই হত্যাযজ্ঞ বা গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটের জন্য দায়ী। আমি যখন আল-বদরদের কথা বলেছিলাম তখন বলেছিলাম তারা নির্দিষ্টভাবে পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে চেয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু ছিল সব ধরনের আন্দোলনের সুতিকার সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলগুলির আক্রোশ ছিল বেশি। জেনারেল রাও ফরমান আলী নিজে এক সাক্ষাতকারে আমাকে একথা বলেছেন। আমার শিক্ষকদের মধ্যে অনেককেই পাকিস্তানী বাহিনী প্রথমেই হত্যা করেছিল ২৫ মার্চ রাত থেকে। পরবর্তীকালে আল-বদর বাহিনীর সদস্যরাই আমাদের বা আমার শিক্ষকদের হত্যা করেছে। এর মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সংগে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিশেষ করে আমার শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন সাহেবের কথা আমার মনে পড়ছে। শিক্ষকদের ছাত্ররা, আল-বদরের অধিকাংশ সদস্যই ছিল ছাত্র শিবিরের কর্মী সেহেতু বলছি ছাত্ররা শিক্ষকদের হত্যা করতে পারে এটা আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে অন্য কোথাও দেখিনি। আমি প্রায় ৪ দশক শিক্ষকতার সংগে যুক্ত আমার ছাত্ররা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু কখনও তারা শিক্ষক হিসাবে আমাকে অসম্মান করেনি আমিও যে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের হউক না কেন যখন ছাত্র হিসাবে আমার কাছে এসেছে আমি তাদের প্রতি সমভাবে আচরণ করেছি। সে কারণে বললাম কতটা মানুষত্ব বিবর্জিত হলে শিক্ষককে মিথ্যা কথা বলে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারে। ইতিহাসে এর উদাহরণ পাওয়া খুব কঠিন। (চলবে)

পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, ঢাকা।

০১-০৭-২০১২ ইং ২:০০ পুনরায় জবানবন্দী শুরুঃ-
এ মুহূর্তে আমার একটি বইয়ের নাম ও দলিলের কথা মনে পড়ছে। বইটির লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা ও সাবেক রেজিষ্ট্রার তার নাম সম্ভবত নাজিম উদ্দিন হতে পারে। বইটির ‘যখন কৃতদাস’। বইটির কথা উল্লেখ করছি একটি কারণে, বইটির শিরোনামের মাধ্যমে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিকামী বাঙ্গালীর অবস্থা কি ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মুক্তিকামী মানুষ কৃতদাস ছিল, কৃতদাস হতে বাধ্য করা হয়েছিল। হত্যার কথা বলেছি, তার সংগে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তর করণ, দেশান্তর সবকিছুই এই প্রত্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। কৃতদাসের কোন ইচ্ছা থাকে না, এই অবস্থা সৃষ্টির মাধম্যে বাঙ্গালীদেরও এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে, তারা স্বইচ্ছায় কোন কাজ করতে পারতো না। জেনারেল নিয়াজির একটি দলিলের কথা উল্লেখ করতে চাই যেটি আমার বই ‘মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র’ এ উল্লেখ করেছি। নিয়াজি তার নথিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, পাকিস্তানিদের উচিত হবে বাঙ্গালীদের সংখ্যালঘুতে পরিনত করা। এখন আমরা যদি সেই সব রাজনীতিবিদ যাদের কথা ইতিপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি সেসব কমিটি ও বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা এই দুটি লক্ষ্য পূরণে পাকিস্তানী জান্তাকে সহায়তা করে গেছে। অর্থাৎ মুসলমান ছাড়া অন্যান্য ধর্মালম্বী বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা। এক্ষেত্রে তারা সিষ্টেমেটিক্যালী কাজ করছে। এর প্রমাণ প্রায় এক কোটি লোকের দেশ ত্যাগ। যারা ছিলেন তাদের পাকিস্তানী বাহিনী এবং সহযোগী শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল-বদর বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করেছে। দেশ জুড়ে অসংখ্য বধ্যভূমি এর প্রমাণ। হত্যার আগে এবং হত্যা না করলেও যে পরিমাণ নির্যাতন করেছে তা অকল্পনীয়। এই নির্যাতনের উপর অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয় ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আমার গবেষণায় আমার ধারণা হয়েছে এর সংখ্যা এর থেকেও বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে নদীর পার্শ্বে যেখানে সেতু আছে সেখানে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে যাদের বধ্য ভূমিতে স্থান হয় নাই। উদাহরণ স্বরুপ আমি একবার বরিশালের উজিরপুরে এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানকার লোকেরা সাধারণত পান চাষ করে। তারা আমাকে জানিয়েছিল যে, রাজাকাররা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের পথ দেখিয়ে সেই গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেই গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। গণহত্যার বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায়ে কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সেটা ঐ গ্রামের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। অনেক গণহত্যার পর অনেকের লাশ গণকবর না দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সেই হিসাবে ত্রিশ লক্ষ্যের অধিক লোককে হত্যা করা হয়েছিল। শরনার্থী বা দেশ ত্যাগে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছিল তার একটা কারণ ছিল তাদের সম্পত্তি লুষ্ঠন করা। আমার পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থে আমি কিছু দলিলপত্র সংযোজন করেছি। সেই দলিলপত্রে দেখা যায় যারা শরনার্থী হয়ে গেছে বা যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বাড়ি শান্তি কমিটির সদস্যদের দিয়ে দেয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। ফলে অবরুদ্ধ দেশে এই যে চিত্র আমরা দেখি তার কারণ একমাত্র পাকিস্তানী বাহিনী নয়, এর সহযোগী শক্তিরাও অর্থাৎ রাজনৈতিক দল এর জন্য দায়ী। কেননা তাদের পরিকল্পনায়, পরামর্শে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল-বদর ইত্যাদি গঠিত হয়েছিল। এইসব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমি আগেও উল্লেখ করেছি, আবারও বলছি জামায়াতে ইসলামী ছিল প্রধান এবং এর দায় দায়িত্ব জামায়াতের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির বা প্রধান জনাব গোলাম আযমের উপর বর্তায়। দেখা যায় এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে তিনি দুবার টিক্কা খানের সাথে দেখা করেছিলেন, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল তাদের সাথে সাক্ষাত করেছিলন। পত্র পত্রিকায় তার কথাই বার বার এসেছে। এর অর্থ এই নয় যে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নাম এবং কথা আসেনি। আমি যে সকল অপরাধের কথা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি তার মধ্যে বিশেষ করে নারী নির্যাতনের কথা ঊল্লেখ করতে চাই । আমার কাছে যে সকল কাগজপত্র আছে বা যে সকল বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৩ থেকে ২০ বছরের বালিকা ও তরুণীদের তুলে নেয়া হয়েছিল। গ্রামে গ্রামে যখন ইচ্ছা হয়েছে বাড়ি ঘেরাও করে বালিকা ও তরুণীদের ধর্ষণ করেছে এবং ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। অনেক বিবরণে আমরা দেখি রাজাকার বাহিনী তাদের সহযোগী হয়ে বাড়ি ঘর চিহ্নিত করেছে এবং ধর্ষণ করেছে, ক্যাম্পে নিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। ১৩/১৪ বৎরের বালিকারাও জানিয়েছে প্রতিদিন কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ বার তাদের ধর্ষণ করা হতো। এই ধর্ষিতার সংখ্যা আমরা এখন চার লক্ষ বলি বটে তবে আসল সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি। আমি এসব কথা মনে করতে চাই না, কারণ তাতে প্রমাণিত হয় জাতি হিসাবে আমরা কত মনুষ্যত্ব হীন হয়েছিলাম।
কেননা এই রাজাকারদের এবং শান্তি কমিটির অধিকাংশই ছিল বাঙ্গালী যা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। আমি ভাবতে পারি না যে, বাঙ্গালী রাজনীতিবিদরা যারা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসাবে কাজ করছিল তারা কিভাবে এ কাজে পরামর্শ দিলেন, সহায়তা করলেন, তাদেরও তো স্ত্রী, কন্যা ছিল। নারী ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনকে ব্যবহার করা হয়েছে বাঙ্গালী মুক্তিকামী মানুষকে কৃতদাস করে রাখার জন্য। আমরা শরনার্থীদের কথা বলি কিন্তু শরনার্থী শিবিরে কত মানুষ মারা গেছে সেটা উল্লেখ করি না। এসব মানুষও গণহত্যার অন্তর্ভূক্ত। সামগ্রিক ভাবে এ সমস্ত কর্মকান্ড গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। তারা এসব কর্মকান্ডে এত বদ্ধ পরিকর ছিল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করে। কোন আদর্শে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, ধর্মান্তকরণ, দেশান্তর করণ উপাদান হিসাবে থাকতে পারে না। আদর্শের উৎসই হচ্ছে মানুষের কল্যাণ। সুতরাং এই যে কর্মকান্ড তাকে যে রাজনৈতিক আদর্শের মধ্য দিয়ে বলা যাবে না যে, এটি একটি রাজনীতি। আমাদের প্রয়াত ধর্মপ্রাণ দার্শনিক জনাব দেওয়ান মোঃ আজরফ বলেছিলেন যে, ধর্মের নামে এত মুসলমান এর আগে এত হত্যা করা হয় নাই। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে তা আমি যদি দিনের পর দিন বর্ণনা করি তাও শেষ করা যাবে না। আমার জীবিত কালে বা জীবন কালে এত অশ্রু, এত রক্ত, এত বেদনার সম্মুখীন আর কখনো হয়নি, হতে চাইও না আল্লাহর কাছে এটি আমার প্রার্থনা। এ কারণে আমি সব সময় মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক আমার লেখায় ও প্রবন্ধে এই সকল হত্যাকারীদের বিচার চেয়েছি। ইহা তো সত্য ১৯৭১ সালে আমার বর্ণিত ঘটনাগুলি ঘটেছিল। আমি যাই বলি না কে তা পুনরাবৃত্তি হবে এবং বিস্তৃতিকরণ হবে। ১৯৭১ মানে আমাদের জেনারেশনের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের যাদের কথা আগে আমি উল্লেখ করেছি তাদের সংঘটিত গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ, ধর্মীয় সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন করণ ও কোটি লোকের দেশ ত্যাগ। আমি যে গোলাম আযমের কথা বলেছি তিনি অদ্য ট্রাইব্যুানলে উপস্থিত আছেন।

 জেরা
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ছিলাম। আমি অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি নাই। তবে মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের আগে কিংবা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোলাম আযমের সহিত আমার ব্যক্তিগত কোন যোগাযোগ হয় নাই। অধ্যাপক গোলাম আযম যে সকল সভায় বক্তব্য দিয়েছেন আমি সেই সকল সভায় কোন দিন উপস্থিত ছিলাম না।

জামায়াতে ইসলামীর কোন সভা সমাবেশে আমি কোন দিন যোগদান করি নাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করাকালীন ছাত্র ইউনিয়নে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমি ছাত্র ইউনিয়নের কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখার কার্যক্রম কমিটির সদস্য ছিলাম না। আমি কোন সভায় ছাত্র ইউনিয়নের কোন পদাধিকারী ছিলাম না। স্বাধীনতার পূর্বে ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন কবে হয়েছিল তা আমার স্মরণ নেই এবং সেই নির্বাচনে আমি কোন প্রার্র্র্র্র্র্র্র্র্থী ছিলাম না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম ডাকসু নির্বাচন কোন সালে হয়েছিল তা আমার স্মরণ নেই। ডাকসু নির্বাচন সংক্রান্ত কোন তথ্য আমি দিতে পারব না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে বাংলাদেশে প্রথম কখন আদমশুমারী হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এদেশে সর্বশেষ কত সালে আদমশুমারী হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শরুর সময় এদেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি ছিল বলা হয়। আমি ১৯৭৪ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা শুরু করি, তবে তার আগে থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখি। আমি ১৯৭৪ সালের আগে থেকেই দৈনিক বাংলা এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লেখালেখি করতাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের পূর্ব পর্যন্ত অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কোন প্রবন্ধ লিখেছি কিনা তা আমার স্মরণ নাই। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন তা আমি কত সালে সর্বপ্রথম জানতে পারি তা বলতে পারি না তবে যখন গঠন করেছিলেন তখনই জেনেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে তিনি সেটা গঠন করেছিলেন ১৯৭৩ সালে। এই সংবাদ আমি রেডিও, টেলিভিশন, পত্র/পত্রিকা বা কোন লোকের পত্র বা টেলিফোনের মাধ্যমে জেনেছিলাম কিনা তা আমার স্মরণ নাই। অধ্যাপক গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন তার কোন দৃশ্যমান কাগজ আমার নিকট নাই। কতজন লোক নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়েছিল তা আমি বলতে পারব না। কমিটির সম্পাদক কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। কারণ আমাদের কাছে গোলাম আযমের ব্যাপারটিই মুখ্য ছিল অন্য কিছু নয়। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেছিলেন তৎমর্মে ১৯৭৫ সালের পূর্বে দেশের কোন সাংবাদপত্র বা পত্রিকা আমার সংগ্রহে নাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মিরপুরের সঙ্গে কোন এলাকা নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আসন ছিল তা আমার মনে নাই।

১৯৬৯ সালের শেষের দিক থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত আমি আমার চাচার বাড়ি পল্লবীতে থাকতাম। আমি ২৫ মার্চ থেকে পরবর্তী যে কয়দিন মিরপুরে ছিলাম তখন মিরপুরে অবাঙ্গালীরা বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে যে দুটি আসন আওয়ামী লীগ পায় নাই সে দুটির মধ্যে একটি হলো ময়মনসিংহ এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রাম।

প্রাদেশিক পরিষদ এবং জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর গণপরিষদ গঠিত হয় তবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের লোকদের বাদ দেয়া হয়। এদের সংখ্যা আমি বলতে পারব না। আমি জেনারেল নিয়াজের যে দলিলের কথা জবানবন্দীতে উল্লেখ করেছি তা ছিল টাইপ করা নথির অংশ। তাহাতে নিয়াজী সাহেবের কোন স্বাক্ষর ছিল না। উক্ত দলিলটি আমি রাজশাহী হেরিটেজ আর্কাইভ হইতে সংগ্রহ করেছিলাম। হেরিটেজ আর্কাইভ প্রতিষ্ঠানটি হলো অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত যাহা রাজশাহীর কাজলা এলাকায় অবস্থিত। ইহা চার/পাঁচ বছর আগে শুরু হয়েছে। উদ্ভোদনী অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। আমার লিখিত “মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র” বইটি খুব সম্ভব ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক। তিনি কতসালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন তা আমার স্মরণ নাই। তিনি আমার থেকে বয়োকনিষ্ঠ। তিনি অধ্যাপনায় যোগদানের পূর্বে আমার জানা মতে অন্য কোন পেশায় ছিলেন না। তিনি কোথা থেকে নিয়াজির সাহেবের দলিলটি সংগ্রহ করেছেন তা আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি নাই। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে আত্মসর্ম্পণে সময় জেনারেল নিয়াজি সাহেব তার অস্ত্র-সস্ত্রসহ দলিলপত্র মিত্রবাহিনীর প্রধান জগজিৎসিংহ অররার নিকট প্রদান করেছিলেন কিনা তা আমি এ মুহূর্তে বলতে পারব না। ১৯৭১ সালে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান সাহেবের বয়স কত ছিল তা আমি বলতে পারব না। জেনারেল নিয়াজি সাহেবের সাথে মাহবুবুর রহমানের কখনও সাক্ষাত হয়েছিল কিনা তা আমি জানি না। ১৯৭১ সালে বা তার পরিবর্তী সময়ে কোন পাকিস্তান জেনারেল বা কোন কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান সাহেবের কোন দেখা সাক্ষাত হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না। জেনারেল নিয়াজির দলিলটি কোন নথির ধারাবাহিক বিবরণ বা অংশ সে ব্যাপারে আমি কোন অনুসন্ধান করি নাই। (চলবে)


০৩-০৭-২০১২ইং পুনরায় জেরা শুরু ঃ-
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস করতাম না। আমার সাবসিডিয়ারী বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইংরেজী। ১৯৪৭ সালের পরে পূর্ব পাকিস্তানের যে বঞ্চনার কথা বলেছি তা বলেছি এই কারণে যে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় আমাদের একটা আশা ছিল যে পাকিস্তানে সাম্য বজায় থাকবে, তা না থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার জন্য বঞ্চনার কথা এসেছে। আর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্বকালে যে বঞ্চনার কথা বলা হয় সেটা পৃথিবীর জন্ম থেকেই ঐধাব ধহফ যধাব হড়ঃ দের আলোচনার সময় বলা হয় সেই বঞ্চনা কোনভাবেই ১৯৪৭ পরবর্তী বঞ্চনার সংগে তুলনীয় নহে। ১৯৪৭ সালের আগে পূর্ব বঙ্গের কতজন ব্যক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন অফিসার ছিলেন সে সম্পর্কে আমার নিকট কোন তথ্য নাই। অনুরূপভাবে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস এবং বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে কতজন ব্যক্তি পূর্ববঙ্গ থেকে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ছিলেন সে সম্পর্কে কোন ধারণা নাই কারণ সেটি আমার বিষয় নহে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে পূর্ববঙ্গে কোন পাটকল আমার জানা মতে ছিল না। এটিও আমার বিষয় নহে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে আমার জানামতে পূর্ববঙ্গে কোন ভারী শিল্প কারখানার অস্তিত্ব ছিল না। পূর্ববঙ্গ এবং সিলেট একক মুসলিম রাষ্ট্র অর্থাৎ পাকিস্তান হবে এটা তৎকালীন সংখ্যা গরিষ্ঠ জনসাধারণই দিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে যারা এই অঞ্চলের মুসলামনদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা কেউ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কোন সময় জামায়াতে ইসলামী আমার জানামতে ছিল না।

১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মুসলিম লীগ ছিল কখনও সামরিক বাহিনী ছিল, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যুক্তফ্রন্টের অঙ্গ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল। পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান তৈরির সময় পার্লামেন্টের পক্ষে বিপক্ষে মত এসেছে, তবে সংবিধান গ্রহণ করার পরে তাহার কোন বিরুদ্ধ মতের অস্তিত্ব থাকে না। যে পরিষদ কর্তৃক সংবিধান গৃহীত হয়েছিল তার অন্যতম সদস্য ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীকালে সামরিক শাসক যে সংবিধান তৈরি করেছিলেন তার প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন কিনা তা আমি জানি না। মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে প্রেসিডেন্ট থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত সকল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না। আইয়ূব বিরুধী আন্দোলনে বিভিন্ন সময় ‘পি.ডি.এম,’ ‘কপ’ এবং ‘ডাক’ নামে রাজনৈতিক মোর্চা তৈরি হয়েছিল। আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহ একজন প্রার্থী ছিলেন। তিনি ‘কপ’ এর প্রার্থী ছিলেন। এই ‘কপ’ এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী দুই দলই ছিল। পার্লামেন্টে সংযুক্ত বিরুধী দল হিসাবে তারা ভূমিকা রাখতো কিনা তা আমি জানি না। আইয়ূব খানের আমলে শেষবারে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে বিরুধী দলের নেতা কাহারা ছিলেন তাদের নাম আমার মনে নাই। ‘পিডিএম’- এ জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ ছিল কিনা তা আমার স্মরণ নাই। আমাদের দেশে প্রচলিত অধিকাংশ আইনই বৃটিশ আমলে গৃহীত কিনা তা আমি বলতে পারব না।

আমি আমার সম্পাদিত “মুক্তিযুদ্ধ কোষ” এর দ্বিতীয় খন্ডের ৯০-৯১ পৃষ্ঠায় বিভিন্ন লেখকের লেখা ‘ভুক্তি’ অর্ন্তভুক্ত করেছি। অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের লেখা তার আত্মজীবনীর অংশ উদ্বৃত করেছি এবং পঞ্চম খন্ডে নির্দেশিকা অধ্যায়ে ৪৯১ ক্রমিকে রেফারেন্স হিসাবে উল্লেখ করেছি। অধ্যাপক গোলাম আযমের উল্লেখিত লেখা উদ্বৃত করার জন্য আমি তার নিকট থেকে কোন অনুমতি গ্রহণ করি নাই। সেটা আমি ঐ বইয়ে উল্লেখ করেছি। প্রতি খন্ডের ভূমিকায় দ্বিতীয় পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় আমি উল্লেখ করেছি যে, “যে সব বই থেকে সংকলন করা হয়েছে তাদের অনেকের কাছ থেকে আমরা অনুমতি গ্রহণ করেছি। কিন্তু অনেকের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া সম্ভব হয়নি। কারণ স্থানীয়ভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক বই বেরিয়েছে বা কোন একটি সংস্থা প্রকাশক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল তারপর উঠে গেছে। এরকম অনেক ব্যক্তি/ সংস্থার সংগে যোগাযোগ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকাশিত ঠিকানায় ব্যক্তি/ সংস্থাতে পাইনি। এই অক্ষমতা আশা করি লেখকেরা (যাদের অনুমতি ছাড়া লেখা সংকলন হয়েছে) আমাদের ক্ষমা করবেন। আমার সদিচ্ছার অভাব ছিল না।” এই অংশটুকু অর্থাৎ আমার বক্তব্য উদ্বৃতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নহে শুধু ‘ভুক্তি’ এর বেলায় প্রযোজ্য। আমার এই ব্যাখ্যাটি ভূমিকায় উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি নাই। ছয় দফাতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কোন প্রস্তাবনা ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কোন প্রস্তাবনা ছিল না। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন সামরিক সরকারের এল.এফ.ও এর অধীনে হয়েছিল।

এল.এফ.ও এর অধীনে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের কোন সুনির্দিষ্ট মেয়াদ ছিল না। এই পরিষদের মধ্য হতে মন্ত্রী সভা গঠন করা হবে এ ধরণের কোন প্রস্তাবনা ছিল কিনা তা আমি জানি না। এই জাতীয় পরিষদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন করা এই বক্তব্যের সহিত আমি একমত নহি। এল.এফ.ও অনুযায়ী জাতীয় পরিষদের প্রণীত সংবিধানের সাথে প্রেসিডেন্ট একমত না হলে জাতীয় পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে এরকম ধারা সন্নিবেশিত ছিল কিনা তা আমার জানা নাই। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন থেকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করা না হলে জাতীয় পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে এরকম ধারা ছিল কিনা তা আমার জানা নাই। ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতেই সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে এরকম বেশ কয়েকটি ধারা এর মধ্যে ছিল কিনা তা আমার জানা নাই। এল.এফ.ও এর বিরোধীতায় অধিকার সংরক্ষণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোন বক্তব্য রেখেছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পিডিপি জামায়াতে ইসলামী না মুসলিম লীগ বেশি প্রার্থী দিয়েছিলেন তা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। উক্ত নির্বাচনে উল্লেখিত দলসমূহের মধ্যে কোন দল বেশি ভোট পেয়েছিল তা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা কতভাগ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল তাও কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টুতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কোন বক্তব্য ছিল না।

স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রাজনৈতিক দল বা সমমনা রাজনৈতিক দলের সংগে কোন বৈঠক করেছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা তৎকালীন প্রচার মাধ্যমের দূর্বলতার কারণে এবং পাকিস্তান সরকারের সেন্সরশীপ থাকার কারণে অধিকাংশ জনগণের নিকট পৌছায় নাই, ইহা সত্য নহে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে মীরপুর এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে জনাব জহির উদ্দিন সাহেব নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নহি। তিনি একজন উর্দূভাষী অবাঙ্গালী কিনা সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত নহি। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান না করে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সহায়তা করেছিলেন কিনা তা আমার জানা নেই। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার কারণে পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী অনেকের সদস্য পদ বাতিল করলেও জনাব জহির উদ্দিনের সদস্যপদ বহাল ছিল কিনা আমি কাগজ পত্র না দেখলে বলতে পারব না।

প্রশ্ন: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার কারণে পাকিস্তান সরকার অনেক জাতীয় পরিষদ সদস্যপদ বাতিল করে প্রহসনের উপনির্বাচনের করেছিলেন কিনা?

উত্তরঃ ঐ সময়ে জাতীয় পরিষদের কোন অস্তিত্বই ছিলনা। সেজন্যই উপনির্বাচন করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মীরপুর এলাকায় কোন উপনির্বাচন হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নাই। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল। ঐ গণপরিষদে সদস্য ছিলেন যারা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান এলাকা থেকে জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলন। তবে তাদের মধ্যে যাহারা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল তাদের গণপরিষদের সদস্য করা হয় নাই কিনা তা কাগজপত্র না দেখে আমরা বলতে পারব না। গণপরিষদের সদস্য কত ছিল তা কাগজপত্র না দেখে আমি বলতে পারব না। জনাব জহির উদ্দিন সাহেব গণপরিষদের সদস্য ছিলেন কিনা তা আমি বলতে পারব না। জনাব জহির উদ্দিন সাহেব পরবর্তী অন্য কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন কিনা তা আমি বলতে পারব না। জনাব জহির উদ্দিন সাহেব সম্পর্কে আমি জানা নাই হিসাবে যা বললাম তা সবই জানি তবে জানা নাই মর্মে অসত্য বলেছি, ইহা সত্য নহে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মিথ্যা ছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না। তবে মিথ্যা আখ্যায়িত করে এই মামলা প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলন হয়েছিল, ইহা সত্য। এখন অনেকেই বলেছেন মামলার অভিযোগটি সত্য ছিল। তার মধ্যে বর্তমান সংসদরে মাননীয় ডেপুটি স্পিকার সাহেবও একথা বলে থাকতে পারেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিষয়ে আমি কোন গবেষণা করি নাই। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নগরায়ন ও মুক্তিযোদ্ধার বর্হিভূত বিষয় নহে। উপমহাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চলছে তা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে শুরু হয়েছে ইহা সম্পূর্ণ সঠিক নহে। উপমহাদেশের চলমান রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সবচেয়ে পুরাতন। পরবর্তীতে এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগও কমিউনিষ্ট পার্টিসহ অন্যান্য দলসমূহের কার্যক্রম শুরু হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অহিংস পদ্ধতিতে স্বাধীনতা আদায়ে বিশ্বাসী ছিল ইহা পূর্ণাঙ্গ সত্য নহে। এক সময়ে তারা অহিংস আন্দোলনকে একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সুভাষ চন্দ্র বসু তার পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছিলেন তার মধ্যে সশস্ত্র কর্মপন্থাও ছিল, তবে ইহাই একমাত্র পথ তাহা তিনি বলেছিলেন কিনা তা আমার জানা নাই। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না এই মতাদর্শ বিশ্বাস করে ভারতীয় মুসলিম লীগের জন্ম হয়, ইহা সত্য। মুসলিম লীগ তার জন্মলগ্ন থেকে মুসলমানদের জন্য নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না। সম্প্রদায় ভিত্তিক দাবিকে কেউ ধর্মীয় রাজনীতি আবার কেউ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হিসাবে অভিহিত করেন কিনা তা আমি বলতে বলতে পারব না। জামায়াতে ইসলামীকে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্ম ব্যবসায়ী দল হিসাবে মনে করি। মুসলীম লীগের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবির ব্যাপারে জাতীয় কংগ্রেসের ঘোর আপত্তি ছিল কিনা তা আমি বলতে পারি না। পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের চেষ্টা করা হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্বে মিঃ গান্ধির নিকট অর্পন করা হয়েছিল কিনা তা  আমি বলতে পারব না। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নি¤œবর্ণের হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত আসন সমর্থন করলেও মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সমর্থন করে নাই, ইহা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের কথা উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালে একাধিক রাষ্ট্রের স্থলে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব পাশ করা হয়। উক্ত প্রস্তাব বৃটিশরা মেনে নিলেও কংগ্রেসের প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলার অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ পাকিস্তান থেকে পৃথক করে এবং পাঞ্জাবের হিন্দু ও শিখ অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ পাকিস্তানের অন্তর্ভূত না করে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করা হয়, ইহা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পরব না। ১৯৪৬ সালে যে সম্মেলনে একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত হয় তার নেতৃত্বে জিন্নাহ সাহেব এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন কিনা তা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পরব না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সময়ে মুসলিম লীগ করতেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেবকে পূর্ব পাকিস্তানের এ্যাডভোকেট জেনারেল হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। (চলবে)


০৩-০৭-২০১২ ইং ২-০০মি পুনরায় জেরা শুরু ঃ-
বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম কোন দাবির প্রেক্ষিতে প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় কিনা সে সম্পর্কে আমার কোন ধরনা নাই। জনাব আতাউর রহমান খান সাহেব আওয়ামী লীগ দলীয় লোক হিসাবে যুক্তফ্রন্টের মুখ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন বলে আমার মনে পড়ে। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক সাহেবের ছেলে এ.কে ফায়জুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের সংগে সংযুক্ত ছিলেন কিনা তা আমি বলতে পরব না। ১৯৯৬ সালে এ.কে. ফায়জুল হক সাহেব আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ছিলেন কিনা তা আমার স্মরণ নাই। ১৯৭১ সালে এ.কে ফায়জুল হক সাহেবের ভূমিকা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ২৫ শে মার্চের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে অধ্যাপক গোলাম আযম অথবা জামায়াতে ইসলামী কোন বক্তব্য দিয়েছিলেন কিনা তাহা কাগজপত্র না দেখে আমি বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধীতা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন জনাব জুলফিকার ভূট্টো সাহেব একথা কাগজপত্র না দেখে বলা যাবেনা, তবে তিনি জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
খুব সম্ভব কাগজে এ কথা পড়েছিলাম যে জানাব ভূট্টো সাহেব দুই প্রধানমন্ত্রীত্বের কথা বলেছিলেন। এই দুইজনের মধ্যে তিনি নিজে একজন দাবিদার ছিলেন কিনা তা কাগজপত্রে না দেখে বলতে পারব না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ যে কার্যকর হতে না পারে সে জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া ও জানাব ভূট্টো সাহেব ষড়যন্ত্র করেছিলেন, ইহা একটি সাধারণ ধারণা।
২৫শে মার্চের নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর আক্রমনের পরিকল্পনা পাকিস্তান সামরিক সরকার পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করে থাকতে পারে। ২৫শে মার্চের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগে যে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের লোক দেখানো আচার ছিল মাত্র, ইহা অনেকরই ধারণা। আলোচনাকে ব্যবহার করে তিনি পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করেছিলেন, ইহা হতে পারে। লারকানাই পাখি শিকারের নামে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জনাব ভূট্টো সাহেব বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন, তবে অপারেশন সার্চ-লাইটের বিষয় চুড়ান্ত করেছিলেন কি না তা আমি পত্রিকায় পড়ি নাই। আপারেশন সার্চ-লাইট শুরু করার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান সাহেব এবং জনাব ভূট্টো সাহেব ঢাকাতে ছিলেন। অপারেশন সার্চ-লাইট শুরুর আগ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো সাহেবের সংগে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের সাক্ষাত হয়েছিল কিনা তা আমার স্মরণ নাই। আমার দীর্ঘ গবেষণা কালে এ সংক্রান্ত কোন সংবাদ আমার সাংগ্রহে আসে কিনা তা আমার স্মরণ নাই। অপারেশন সার্চ-লাইট বিষয়টি সর্বপ্রথম আমি কবে শুনেছি তা খেয়াল নাই, তবে পরে শুনেছি। অপারেশন সার্চ-লাইট শব্দটি আমি ১৯৭১ সালে বিজয়ের আগে না পরে শুনেছি তা আমার খোয়াল নাই। অপারেশন সার্চ-লাইট শব্দটি কোন মাধ্যমের নিকট থেকে সর্বপ্রথম জানতে পারি তা আমার খেয়াল নেই। অপারেশন সার্চ-লাইটের পুরো বিষয়বস্তু সম্বলিত কোন দলিল আমার সংগ্রহে নাই। আমি জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। অপারেশন সার্চ-লাইটের পরিকল্পনা, কর্মপন্থা এবং বিস্তৃতি সম্পর্কে আমার সাক্ষাতকার না দেখলে আমি বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ২৫শে মার্চের পর যখন দখলদার বাহিনী যে স্থানে অবস্থান নিয়েছে সে স্থান সমূহ মুক্তিকামী জনতার নিয়ন্ত্রনে ছিল। দখলদার পাক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ-লাইট’ ছাড়া ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্য কোন কোড নামে এদেশে অপারেশন চালিয়েছে কিনা তা আমার জানা নাই, এ সম্পর্কে পাকিস্তান জেনারেলদের বই পড়লে হয়তো জানা যাবে। অপারেশন সার্চ-লাইটের নীতি ও কর্মপন্থার আলোকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের কর্মকান্ড চালিয়েছিল কিনা তার সম্পূর্ন দলিল আমি দেখি নাই বিধায় বলতে পারছিনা। অপারেশন সার্চ-লাইট পরিকল্পনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী করেছিল। কোন বেসামরিক ব্যক্তি এর সংঙ্গে জড়িত ছিল কিনা তা আমার জানা নাই।
প্রশ্নঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ১৯৭১ সালে কোন বেসামরিক ব্যক্তি নিয়ন্ত্রন করতেন কি না ?
উত্তরঃ প্রভাবান্বিত করত।
নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবান্বিত করা দুটি ভিন্ন শব্দ এবং ভিন্ন অর্থ। ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি গঠনের আগ পর্যন্ত এ দেশের কোন বেসামরিক ব্যক্তির সহিত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের যোগাযোগ ছিল না, ইহা আমার মনে হয় না। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর থেকে ১৯৭১ সালের ৪টা এপ্রিলের আগ পর্যন্ত এদেশের আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান বা অন্য কোন পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের সংগে সাক্ষাত করেছেন যোগাযোগ স্থাপন করেছেন এমর্মে কোন তথ্য ভিত্তিক সংগ্রহ আমার কাছে না থাকলেও এটা অনুমান করে বোঝা যায় যে, যোগাযোগ না থাকলে ৪ঠা এপ্রিলের বৈঠক হতে পরতো না। ৪ঠা এপ্রিলের যোগাযোগ করে ৪ঠা এপ্রিলে মিটিং করা সম্ভব কিনা তা আমি বলতে পারব না। সম্ভবত সর্বপ্রথম এপ্রিলের ৯ তারিখে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল। তখন এর আহবায়ক ছিল খাজা খয়েরুদ্দিন সাহেব। সম্পাদক কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। যতদূর মনে পড়ে ৯ই এপ্রিলের পরে মৌলভী ফরিদ আহম্মেদের নেতৃত্বে উক্ত শান্তি কমিটি বিভক্ত হয়ে শান্তি কল্যান কমিটি নামে আরেকটি কমিটি হয়। দখলদার বাহিনীর সামরিক অফিসারদের মধ্যে বেসামরিক বিষয় দেখাশুনা করবার জন্য জেনারেল রাও ফরমান আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয় মর্মে কাগজপত্রে দেখা যায়। খাজা খয়রুদ্দিনের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল তবে ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট কিনা তা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারছিনা। মৌলভী ফরিদ আহম্মদের নেতৃত্বে যে শান্তি কল্যান কমিটি গঠিত হয়েছিল তার সংখ্যা কত ছিল তা কাগজ পত্র না দেখে আমি বলতে পরব না। উল্লেখিত শান্তি কমিটির ১৪০ জনের মধ্যে এডভোকেট এ.কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম, সৈয়দ মো: মাসুম. গোলাম আযম, আব্দুল জব্বার খদ্দর, মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া, এ কে রফিকুল ইসলাম, আবুল কাশেম, গোলাম সরোয়ার, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া, এ.এস.এম. সোলায়মান,পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া, শফিকুর রহমান, মেজর অব: আফসার উদ্দিন, সৈয়দ মহসীন আলী, ফজলুল হক চৌধুরী, সিরাজ উদ্দিন, এ্যাডভোকেট এ.টি. সাদি, আতাউল হক খান, মকবুলুর রহমান, নুরুজ্জামান, জনাব সিদ্দিক আহম্মেদ, এ্যাডভোকেট আক্তার উদ্দিন, রাজা ত্রিদিব রায়, ফয়েজ বক্স সদস্য ছিলেন আমার যতদূর মনে পড়ে। উল্লেখিত ব্যক্তিগনের মধ্যে গোলাম আযম সাহেব জামায়াত ইসলামীর সদস্য ছিলেন এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, অন্যদের ব্যপারে কাগজপত্র না দেখে আমি বলতে পরব না, তবে বিভিন্ন দলের ছিলেন। শান্তি কমিটি পরবর্তীকালে তাদের মধ্য থেকে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করেছিল। সেই কার্য নির্বহী কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২১ জন। এ কার্যকরী কমিটির আহবায়ক খাজা খয়রুদ্দিন ছিলেন কি না তা আমি বই না দেখে বলতে পারব না। তিনি এই কার্য নির্বহী কমিটির সদস্য ছিলেন কিনা তা বই না দেখে আমি বলতে পরব না। কার্য নির্বাহী কমিটিতে জামায়াতে ইসলামীর কতজন সদস্য ছিলেন তা আমি বই না দেখে বলতে পরব না। তবে গোলাম আযম সাহেব ছিলেন সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। শান্তি কমিটির প্রথম বৈঠকের পর পরবর্তীতে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত শান্তি কমিটির পূর্ণাঙ্গ বৈঠক হয়েছিল কি না সেটা আমি আমার বই না দেখে বলতে পরব না। শান্তি কমিটির বৈঠকের কোরাম কত সদস্য উপস্থিত থাকলে হতো তাও আমি বলতে পরব না। তৎকালীন রাজশাহীর চাপাই নবাবগঞ্জ মহকুমায় শান্তি কমিটির প্রধানের নাম আমি বই না দেখে বলতে পরব না। তিনি কোন দলের সদস্য ছিলেন তাও আমি বই না দেখে বলতে পরব না। রাজাশাহী চাপাই নবাবগঞ্জ মহকুমায় শান্তি কমিটির প্রধানের সাথেগোলাম আযম সাহেবের ১৯৭১ সালে দেখা সাক্ষাত হয়েছিল কি না তৎবিষয়ে আমার গবেষণার বই না দেখে বলতে পরব না। “গোলাম আযম সাহেব চাপাই নাবাবগঞ্জের শান্তি কমিটির কোন সদস্যকে কোন লিখিত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন কিনা তাও আমি আমার গবেষনার বই না দেখে বলতে পরব না।
চাপাই নবাবগঞ্জ শান্তি কমিটি যৌথভাবে বা শান্তি কমিটির কোন সদস্য একক ভাবে গোলাম আযম সাহেবের সাথে দেখা করেছিলেন তৎমের্ম আমি আমার গবেষণার বই না দেখে বলতে পরব না।”
“পরবর্তীতে সাক্ষী বলেন কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সমস্ত নির্দেশনা পাঠানো হতো তা সব জেলা কমিটিতে যেত এবং সে অনুযায়ী কাজ হতো।”
কোটেশনের মধ্যে উপরে উল্লেখিত সাক্ষীর জেরার বক্তব্য সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনাল পড়িয়া শুনাইলে সাক্ষী বলেন যে, ঐ বাক্তব্য আমার বলা মত সঠিকভাবে লেখা হয় নাই তখন ট্রাইব্যুনাল উপরে উল্লেখিত প্রশ্ন গুলি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলে এই ব্যাপারে আসামীপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের আপত্তিসহ সাক্ষী নিন্মরুপ উত্তর প্রদান করে:-
প্রশ্নঃ গোলাম আযম সাহেব চাপাই নবাবগঞ্জের শান্তি কমিটির কোন সদস্যকে কোন লিখিত নির্দেশ পাঠিয়ে ছিলেন কি না ?
উত্তরঃ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সমস্ত সার্কুলার ইউনিয়ন পর্যন্ত শান্তি কমিটিতে প্রেরণ করা হতো।
প্রশ্নঃ চাপাইনবাবগঞ্জ শান্তি কমিটি যৌথভাবে বা শান্তি কমিটির কোন সদস্য এককভাবে গোলাম আযম সাহেবের সাথে দেখা করেছিলেন কিনা ?
উত্তরঃ যেহেতু তারা শান্তি কমিটির সদস্য সেহেতু তার সাথে যোগাযোগ থাকাটা স্বাভাবিক। (চলবে)

০৪-০৭-২০১২ইং পুনরায় জেরা শুরু:
প্রশ্নঃ শান্তি কমিটির কোন সার্কুলার কোন স্থানে যাওয়া এবং শান্তি কমিটির কোন ব্যক্তির চিঠি যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে কিনা?

উত্তরঃ এ ক্ষেত্রে পার্থক্যটি কম। কেননা কোন ব্যক্তি যখন নি¤œ পর্যায়ে কমিটির কাউকে লেখেন এবং শান্তি কমিটি সংক্রান্ত কোন বিষয় সেখানে থাকে তখন পার্থক্যটি কম। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থাকলে অবশ্যই তার মধ্যে প্রার্থক্য থাকতে পারে।

প্রশ্নঃ শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে কোন সার্কুলার যাওয়া এবং শান্তি কমিটির কোন লোকের কাছ থেকে নি¤œ কমিটির কারো কাছে যোগাযোগ করা একই ঘটনা কিনা?

উত্তরঃ আমার প্রদত্ত পূর্বের উত্তরের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর আছে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি হতে চাপাইনবাবগঞ্জ শান্তি কমিটিতে কোন নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল এ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কেননা আমার সামনে সে ধারণের কোন ডকুমেন্ট নাই বিধায় স্মরণ করতে পারছি না। অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষ হতে চাপাইনবাবগঞ্জ শান্তি কমিটির কাছে কোন নির্দেশনা পাঠানো হয়েছিল কিনা তা আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অধিকাংশ সময় আমি ঢাকার ধানমন্ডীতে ছিলাম। ধানমন্ডী কোন থানা ছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না। তখন ধানমন্ডী থানার শান্তি কমিটির সভাপতি কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। আমার বাড়ির সবচেয়ে নিকটবর্তী শান্তি কমিটির সদস্য কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে ধানমন্ডী এলাকাসহ পুরা ঢাকা পাকিস্তান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। ঐ এলাকার প্রশাসনও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাধারণ আচরণ ছিল লোক দেখলে তারা বলতো ‘ডানডি’ কার্ড দেখাও। আমি ১৯৭১ সালে ধানমন্ডী এলাকায় থাকা অবস্থায় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ডানডি কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম, ইহা সত্য নহে। সত্য নহে যে আমি ১৯৭১ সালে টেকনিসিয়ান হিসাবে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমি একটি ‘ডানডি’ কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম। তৎকালীন ধানমন্ডীর ১৮ নম্বর রোডে আমি থাকতাম। আমি যে চাচার সাথে মীরপুরে থাকতাম সেই চাচার সাথেই ধানমন্ডীতে থাকতাম। আমার সেই চাচা জীবিত আছেন। আমার সেই চাচার নাম বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন।

আমার উক্ত চাচার আমার সমবয়সী কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আমরা ধানমন্ডী এলাকায় যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেখান থেকে নিকটবর্তী রাজাকার ক্যাম্পের দূরত্ব আমার মনে নাই। ধানমন্ডী এলাকার রাজাকার কমান্ডারের নাম আমি জানি না। ঐ এলাকার আল-বদর অফিস কোথায় ছিল তা আমি বলতে পারব না। ঐ এলাকার আল-বদর কমান্ডারের নামও আমি বলতে পারব না। আমি ১৯৭১ সালে যতদিন ধানমন্ডী এলাকায় ছিলাম তখন প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের হতাম না। ঐ এলাকায় আমরা যেখানে থাকতাম সেইখানে বেশিরভাগ অবাঙ্গালী না বাঙ্গালী ছিল তা আমি বলতে পারব না। ঐ সময় জনাব শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে আামর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। তার সঙ্গে একবার কি দু’বার যোগাযোগ হয়েছিল। পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কোন লোকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো এমন কোন লোকের নাম আমি নির্দিষ্ট কবে বলতে পারব না। আমার চাচা বোরহান উদ্দিন জাহাঙ্গীর সাহেব যতটুকু মনে পড়ে ঐ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ঐ সময়ে তিনি খুব সম্ভব বেসরকারী ফার্মে কাজ করতেন। সেই বেসরকারী ফার্মের নাম আমি বলতে পারব না।

আমরা যে বাসায় থাকতাম সেখান থেকে আমার চাচার অফিসের দূরত্ব আমি বলতে পারব না। আমাদের বাসার বাজার ঘাট কে করতেন তা আমার স্মরণ নাই। আমার চাচা বাসা থেকে বের হয়ে কি যানবাহনে অফিসে যেতেন তা আমি বলতে পারব না। ঐ এলাকায় তখন ২/১ জনের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। যেমন বেবী মওদূদ, বিচারপতি মওদূদের সাহেবের কন্যা যিনি বর্তমানে এম.পি। ১৯৭১ সালে আমি যখন ধানমন্ডীতে থাকতাম তখন সেই এলাকায় আমার সামনে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ইত্যাদি হয়েছিল কিনা তা আমি বলতে পারব না, কারণ আমি প্রায় সময় বাসায় থাকতাম। ইহা সত্য নহে যে, ঐ এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, লুটের কোন ঘটনা আমার গোচরে আসে নাই। ইহা সত্য নহে, কারণ পত্র পত্রিকা, রেডিও কোন ব্যক্তি বা অতিথি আসলে তাদের মাধ্যমে মাঝে মাঝে খবর পেতাম। ঐ সময় ধানমন্ডী এলাকায় নিহত কোন ব্যক্তির নাম আমার স্মরণ নাই। ঐ সময়ে ঐ এলাকার নির্যাতিত কোন মহিলার নাম আমার স্মরণ নাই। ঐ এলাকায় যে সমস্ত বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছিল সে রকম কোন বাড়ির মালিকের নাম আমি বলতে পারব না। আমি নির্দিষ্ট করে ঐ এলাকার কোন বাড়িতে হত্যা, ধর্ষণ, লুট ঘটেছে তা হিসাবে বলতে পারব না।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ তারিখে আমি মীরপুর থেকে এসে প্রথমে সোবহান বাগ যাই। সেখানে আমার চাচার এক আত্মীয়ের বাসায় ছিলাম যতদিন ধানমন্ডীর বাসা ভাড়া না হয় তবে কতদিন সেখানে ছিলাম তা অনুমান করেও বলতে পারছিনা। আমি খুব সম্ভব অক্টোবর মাস পর্যন্ত ধানমন্ডীতে ছিলাম। অক্টোবর মাসের পরে আমি চট্টগ্রাম চলে যাই, আমার পিতার সরকারি কোয়ার্টারে। ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় অর্জন পর্যন্ত আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। আমার পিতা চট্টগ্রাম বন্দরে চাকুরী করতেন। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে প্রশাসন বিভাগে চাকুরী করতেন। বন্দরের প্রশাসন বিভাগের পুরা নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান আর্মিদের ছিল কিনা তা আমার জানা নাই।

বন্দরের চেয়ারম্যান সেনাবাহিনী বা নৌবাহিনীর একজন ছিলেন বলে আমার মনে পড়ে। আমি চট্টগ্রাম যে এলাকায় ছিলাম সেই এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, রাজাকার কমান্ডার, আল-বদর কমান্ডার, আল-শামস এবং আল-মুজাহিদের প্রধান কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। বাড়ির বাইরে বের হওয়া নিরাপদ ছিল না বিধায় পাকিস্তান আর্মিদের কোন রেজিমেন্ট কোথায় ছিল তা আমি বলতে পারব না। আমি চট্টগ্রামে যতদিন ছিলাম সেই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা তাদের সহযোগী বাহিনীর কেহ আমাদের বাড়িতে তল্লাসী চালায় নাই। আমি ধানমন্ডীতে থাকাকালে একদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের বাসা তল্লাসী করেছিল।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাহিরের কোন লোক আমাদের বাসায় ভিতরে প্রবেশ করে নাই। মীরপুরে চাচার যে বাসায় থাকতাম অবাঙ্গালীরা আমাদের সেই বাসা লুটপাট করেছিল। যারা লুটপাট করেছিল তাদেরকে নামে সনাক্ত করা সম্ভব হয় নাই। আমরা যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই বাসার মালিকের নাম আমার মনে নাই। আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই বাড়ির লোকজন আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিল না, তবে রাস্তার বিপরীত দিকে হওয়ায় মুখ চেনা ছিল। ঐ বাড়ির সদস্য সংখ্যা কত ছিল তা আমি বলতে পারব না। সেই বাড়িতে মহিলা ছিল। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম পরবর্তীকালে যেহেতু ১০ বছরে আমি আর ঐদিকে যাই নাই কাজেই তাদের কোন খোঁজ রাখতে পারি নাই। তাদের খোঁজ করা সম্ভব ছিল না। সোবহান বাগের যে বাড়িতে ছিলাম সেটা সরকারি আবাসন। সেটা আমার চাচার এক আত্মীয়ের নামে বরাদ্দ ছিল। সেই আত্মীয়ের নাম আমার মনে নাই। তিনি সরকারি অফিসে চাকুরী করতেন তবে কোথায় চাকুরী করতেন তা আমি জানি না। ১৯৭১ সালে তিনি হয়তো নিয়মিত অফিস করতেন। আমার চাচার সেই আত্মীয়ের সঙ্গে পরবর্তীতে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়েছে। সোবহান বাগ তখন কোন থানার অধীনে ছিল তা আমার মনে নাই। ১৯৭১ সালে সোবহান বাগ এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান রাজাকার কমান্ডার, আল-বদর কমান্ডার, আল-শামস কমান্ডার এবং আল মুজাহিদের প্রধান কে ছিলেন তা আমি বলতে পারব না। ১৯৭১ সালে ঢাকার ধানমন্ডী ও সোবহান বাগে থাকাকালে আমার পক্ষে কোন সময় চট্টগ্রামে যাতায়াত করা সম্ভব ছিল না।

প্রশ্নঃ আপনার লিখিত ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ বইয়ে ২৩৪ এবং ২৩৫ পৃষ্ঠায় পিরোজপুর জেলা শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা উল্লেখ আছে কিনা?

উত্তরঃ যদি থেকে থাকে তাহলে তা তথ্য ভিত্তিক। এর বাইরে আমার কোন বক্তব্য নাই। ১৯৭১ সালে পিরোজপুর জেলা ছিল না, এটা একটা মহকুমা থাকতে পারে। আমি আমার উল্লেখিত বইয়ে ২৩৫ পৃষ্ঠায় পিরোজপুর মহকুমা শান্তি কমিটির পৃথক বর্ণনা দিয়েছি কিনা তা আমার জানা নাই। আমার লিখিত ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ বইটি কোন তথ্য ভিত্তিক নয়, কোন গবেষণার ফল নয়, অসত্য বর্ণনায় উদ্দেশ্য মূলকভাবে মনগড়াভাবে বইটি লিখেছি, ইহা সত্য নহে। এই বইটি তথ্যভিত্তিক গবেষণামূলক একটি গ্রন্থ। ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ গবেষণামূলক বইয়ের সম্পদনা নহে ইহা আমার লিখিত একটি বই মাত্র, ইহা সত্য নহে। এই বইয়ে আমি কোন তথ্যসূত্র উল্লেখ করি নাই, ইহা সত্য নহে।

প্রশ্নঃ চাপাইনবাবগঞ্জের শান্তি কমিটির সদস্যদের ব্যাপারে আপনাকে তথ্য কে দিয়েছিল?

উত্তরঃ উক্ত বইয়ে চাপাইনবাবগঞ্জের ব্যাপারে যদি বক্তব্য থাকে তা তথ্য ভিত্তিক, এর বাইরে আমার কোন বক্তব্য নাই। (চলবে)


০৪-০৭-২০১২ ইং ২-০০ মিঃ পুনরায় জেরা শুরুঃ-
প্রশ্নঃ পিরোজপুর জেলা ও মহকুমার পিস কমিটির সদস্যদের তালিকা আপনাকে কে সরবরাহ করেছিল?

উত্তরঃ আমি যদি এরকম কিছু লিখে থাকি তাহলে সেটা তথ্যের উপর ভিত্তি করে লিখেছি।

প্রশ্নঃ আপনার লিখিত ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ গ্রন্থে যে সকল শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে তা আপনাকে কে বা কারা সরবরাহ করেছিল?

উত্তরঃ যদি তা আমার গ্রন্থে থেকে থাকে তাহলে তা তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে, এর বাইরে আমার কোন বক্তব্য নাই।

প্রশ্নঃ পূর্বোল্লিখিত প্রশ্নের উত্তরে আপনি যে ‘যদি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন তার অর্থ কি এই বুঝায় যে, ঐ বইয়ে শান্তি কমিটির কোন তালিকা নাই?

উত্তরঃ আমি আগেও উল্লেখ করেছি, এখনও করছি, যে বইটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা একটি গবেষণামূলক বই। সেখানে যা উল্লেখিত হয়েছে তা সবই তথ্য ভিত্তিক। গবেষক হিসাবে যখন কোন বই লেখা হয় তখন পুংখানুপুংখ বিবরণ একজন মানুষ হিসাবে সব মনে রাখা সম্ভব নয়। কোন গ্রন্থের সারাংশ জানতে চাইলে তা আমি বলতে পারি সেই কারণে আমি ‘যদি’ শব্দটি ব্যবহার করেছি।

প্রশ্নঃ শান্তি কমিটি কোন বিধিবদ্ধ সংস্থা ছিল কিনা?

উত্তরঃ শান্তি কমিটি তৎকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়েছিল। সুতরাং সেটি আইন করে করা হয়েছিল নাকি আইন না করে করা হয়েছিল তা আমার মতে অপ্রাসঙ্গিক।

প্রশ্নঃ শান্তি কমিটি কেন্দ্রীয় অফিসের জন্য কোন সরকারি আবাসন দেয়া হয়েছিল কিনা?

উত্তরঃ আমার জানা নাই।

প্রশ্নঃ শান্তি কমিটির সার্কুলার, নির্দেশনা, সংবাদ বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়ার জন্য কোন সরকারি ব্যবস্থাপনা ছিল কিনা?

উত্তরঃ যারা তৎকালীন শান্তি কমিটিতে ছিলেন সেটা তারাই বলতে পারবেন। শান্তি কমিটি সম্পর্কিত আমার সব বক্তব্য তথ্য ভিত্তিক এর বাইরে আমি কিছু বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্যদের সরকারি ভাতা বা বেতন দেয়া হতো কিনা?

উত্তরঃ শান্তি কমিটির সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা সরকারের কাছে আবেদন করলে সহযোগিতা পেতেন।

প্রশ্নঃ শান্তি কমিটির কোন সদস্য এককভাবে সামরিক বাহিনীর কোন ইউনিটকে বা কোন সদস্যকে নির্দেশ দিয়ে কোন অপরেশনে পাঠাতে পারতো কিনা?

উত্তরঃ শান্তি কমিটির সদস্যরা সব পর্যায়েই কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারতো এবং তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারতো।

প্রশ্নঃ সামরিক বাহিনীর কোন ইউনিট অপারেশনে যাওয়ার পরে ঐ ইউনিট সম্মিলিতভাবে বা ঐ ইউনিটের কোন সদস্য এককভাবে কোন বিশৃঙ্খল কাজের সাথে জড়িত হলে তাদের কে শাস্তিদানের কোন ক্ষমতা শান্তি কমিটির সদস্যদের ছিল কিনা?

উত্তরঃ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কখনও অধিকার থাকে না কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার।

প্রশ্নঃ সামরিক বাহিনীর কোন ইউনিট বা সদস্যকে শান্তি কমিটির কোন সদস্য কোন অপরাশনে যেতে বাধ্য করতে পারতো কিনা?

উত্তরঃ শান্তি কমিটির সদস্যরা সামরিক বাহিনীর ইউনিট বা ব্যক্তিকে পরামর্শ দিতে পারতো, প্রণোদনা যোগাতে পারতো এবং প্ররোচিত করতে পারতো।

প্রশ্নঃ পরামর্শ, প্রণোদনা, প্ররোচিত এবং বাধ্য করা শব্দগুলি প্রত্যেকটি পৃথক শব্দ এবং শব্দগুলির পৃথক অর্থ আছে কিনা?

উত্তরঃ থাকতে পারে।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য কোন সুনির্দিষ্ট অপারেশন পরিচালনার জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে এই মর্মে আপনার নিকট কোন তথ্য আছে কিনা?

উত্তরঃ এ মুহূর্তে আমার নিকট সেরকম কোন তথ্য নাই, কেননা শান্তি কমিটির লোকজন নিজের ইচ্ছায় অনেক কাজ কর্ম করতো।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য সুনির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তিকে হত্যা, কোন এলাকায় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দিয়েছিল এই মর্মে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আপনার নিকট আছে কিনা?

উত্তরঃ কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য সুনির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তিকে হত্যা, কোন এলাকায় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের পরামর্শ দিয়েছিল এই মর্মে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আপনার নিকট আছে কিনা?

উত্তরঃ যতদূর স্মরণে আছে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু কাগজপত্র না দেখে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য সুনির্দিষ্টভাবে কোন এলাকায় কোন ব্যক্তিকে বা কোন এলাকার সাধারণভাবে সকল ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎমর্মে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য আপনার নিকট আছে কিনা?

উত্তরঃ এরকম তথ্য আমরা পেয়েছি বা জেনেছি তবে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।

প্রশ্নঃ কোন এলাকার কোন ব্যক্তি বা সাধারণভাবে সকল ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে তাদেরকে তাদের বাড়ি বা এলাকা থেকে উৎখাত করে তাদেরকে দেশান্তরে বাধ্য করার জন্য কোন নির্দেশনা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বা তার কোন সদস্যের পক্ষ থেকে কোন আদেশ জারী করা হয়েছিল কিনা?

উত্তরঃ এরকম তথ্য আমরা পেয়েছি বা জেনেছি তবে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কাগজপত্র দেখে বলতে হবে।

প্রশ্নঃ কোন এলাকায় কোন ব্যক্তি বা সাধারণভাবে সকল ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে তাদেরকে হত্য করার বা তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার কোন নির্দেশনা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্যের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জারী করা হয়েছিল কিনা এবং যদি হয়ে থাকে তাহলে কত তারিখে হয়েছিল?

উত্তরঃ এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। তবে বিভিন্ন তথ্যে উল্লেখিত ঘটনাগুলি ঘটেছিল মর্মে উল্লেখ আছে বলে আমার মনে হয়। তবে লিখিত নির্দেশনা ও তারিখ বিষয়ে আমি কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ কোন ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তকরণ, সংগঠিত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য ধর্ষণকারী, অগ্নিসংযোগকারী বা ধর্মান্তর সংঘটনকারীর প্রশংসা করে কোন বিবৃতি প্রদান করেছিল কিনা  এবং যদি করে থাকে তাহলে তাহা কত তারিখে করেছিল?

উত্তরঃ নিজেরা যা করেছি তার প্রশংসা করার কি আছে, তবে আমার যতদূর মনে পড়ে কিছু কিছু নথিপত্রে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে এই ধরণের কার্যে উৎসাহিত করার ইঙ্গিত আছে।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কাউকে ধর্ষণ করেছে এমর্মে কোন খবর ঐ সময় বা তৎপরবর্তীকালে কোন সংবাদপত্রে বা কোন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল কিনা?

উত্তরঃ কাগজপত্র না দেখে আমি বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঐ ব্যক্তিকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন এই মর্মে কোন সংবাদ তৎকালীন সংবাদ মাধ্যম বা তৎপরবর্তী কোন সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কিনা এবং যদি হয়ে থাকে তাহলে সেটা কত তারিখে?

উত্তরঃ কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না।

প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কোন বিশেষ ব্যক্তির বাড়ি বা কোন সুনির্দিষ্ট এলাকায় অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন এই মর্মে কোন প্রামাণ্য তথ্য আপনার নিকট আছে কিনা এবং থাকলে উহা কত তারিখে ঘটে?

উত্তরঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বা কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন সদস্য কোন বিশেষ ব্যক্তির বাড়ি বা কোন সুনির্দিষ্ট এলাকায় অগ্নি সংযোগের নির্দেশ দিয়েছেন কিনা তা কাগজপত্র না দেখে বলা যাবে না।

প্রশ্নঃ শান্তি কমিটির সকল সদস্য বেসামরিক ব্যক্তি ছিল কিনা?

উত্তরঃ হ্যঁ ছিল। (চলবে)

০৫-০৭-১২ ইং পূনরায় জেরা শুরু ঃ
প্রশ্ন ঃ শান্তি কমিটির কিছু বিধিবদ্ধ গঠনতন্ত্র ছিল কিনা?
উত্তর ঃ শান্তি কমিটির কিছু বিধিবদ্ধ নির্দেশনা ছিল যার মাধ্যমে তার সদস্যরা কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। সেক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট গঠনতন্ত্র ছিল কিনা তা প্রযোজ্য নহে।
প্রশ্ন ঃ শান্তি কমিটির বিধিবদ্ধ নির্দেশনা সমূহ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি কর্তৃক তৈরী না অন্য কোন সংস্থা বা সরকার কর্তৃক প্রণীত?
উত্তর ঃ এসব নির্দেশনা প্রস্তুত করা হতো কেন্দ্রীয় এবং নির্বাহী কমিটির বৈঠকে এবং সরকার তার সমর্থন করতো।
প্রশ্ন ঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির প্রথম বৈঠকে কি কি নির্দেশনা তৈরি হয়েছিল?
উত্তর ঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্য নির্বাহী সভায় যতদুর আমি স্মরন করতে পারি যেসব নির্দেশনাবলী ছিল তার সারাংশ হলো দুষ্কৃতিকারীদেরকে দমন করতে হবে।
প্রশ্ন ঃ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কোন তারিখের বৈঠকে কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছিল?
উত্তর ঃ আমার যতদুর মনে পড়ে এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে হয়েছিল, সুনির্দিষ্ট তারিখ আমার স্মরন নাই।
প্রশ্ন ঃ কার্যনির্বাহী কমিটি প্রথম মিটিং সংক্রান্ত কোন প্রামান্য তথ্য আপনি সংগ্রহ করেছিলেন কিনা?
উত্তর ঃ আমার গবেষনা লব্ধ সমস্ত রচনা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে লেখা।
প্রশ্ন ঃ এই সংক্রান্ত তথ্য আপনি কার কার নিকট থেকে পেয়েছিলেন?
উত্তর ঃ এই সংক্রান্ত তথ্য আমার গবেষনা লব্ধ রচনায় উল্লেখ করা আছে।
প্রশ্ন ঃ আপনার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষনা সংক্রান্ত প্রথম বই কোন সালে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর ঃ এটা আমার পক্ষে এ মূহুর্তে বলা সম্ভব নয়, কারণ ১৯৬৯ সাল থেকে আমার বই প্রকাশিত হচ্ছে এবং বইয়ের সংখ্যা অনেক।
প্রশ্ন ঃ শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন?
উত্তর ঃ অনেকে উপস্থিত ছিলেন, সুনির্দিষ্টভাবে সবার নাম বলতে না পারলেও এটা বলা যায় যে, সেই বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমির জনাব গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন।
প্রশ্ন ঃ কার্য নির্বাহী কমিটির নির্দেশনা সর্ব প্রথম শান্তি কমিটির কোন শাখার নিকট পৌঁছেছিল?
উত্তর ঃ এই নির্দেশনা একই সঙ্গে সমস্ত শাখা কমিটির কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল?
প্রশ্ন ঃ ১৯৭১ সালে আপনার বাড়ি কোথায় ছিল?
উত্তর ঃ ১৯৭১ সালে আমার বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া থানার কাদলা ইউনিয়নের গুলবাহার গ্রামে ছিল।
প্রশ্ন ঃ অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের বাড়ি কোন জেলার কোন ইউনিয়নে?
উত্তর ঃ আমি যতদুর জানি ব্রাহ্মনবাড়িয়া নবীনগর থানায়।
প্রশ্ন ঃ পূর্ব পাকিস্তানের সকল থানা এবং ইউনিয়নের সর্বশেষ কত তারিখের মধ্যে শান্তি কমিটি গঠন সম্পন্ন হয়েছিল?
উত্তর ঃ আমি সুনির্দিষ্ট তারিখ স্মরন করতে পারছি না, তবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে দীর্ঘদিন চলে।
প্রশ্ন ঃ আপনি এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মতিউর রহমানের নিকট কত তারিখে জবানবন্দী প্রদান করেছেন?
উত্তর ঃ আমি মতিউর রহমানের নিকট কোন জবানবন্দী প্রদান করি নাই তবে তাদের পক্ষ থেকে খুব সম্ভব মনোয়ারা বেগম নামে একজন অথবা এই রকম নামের একজন এসেছিলেন তার নিকট বলেছি এবং তিনি লিখেছেন।
প্রশ্ন ঃ আপনি যার নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছিলেন তিনি আজ ট্রাইবুনালে উপস্থিত আছে কিনা?
উত্তর ঃ হ্যাঁ তিনি উপস্থিত আছেন।
তিনি কত তারিখে আমার নিকট গিয়েছিলেন সঠিক তারিখ মনে নাই। সময়টা এ মূহুর্তে সঠিক মনে নাই। তিনি আমার নিকট মনে হয় ঘন্টা তিনেক উপস্থিত ছিলেন। তার নিকট আমার জবানবন্দীতে উল্লেখিত ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’, ‘রাজকারের মন’, ‘পাকিস্তানি জেনারেলদের মন’, ‘সেই সব পাকিস্তানি’, ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’, ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ এই বইগুলির কথা আমি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছিলাম কিনা তা এ মূহুর্তে স্মরন নাই, তবে কিছু কিছু বইয়ের নাম বলেছিলাম। ‘শান্তি কমিটির ১৯৭১’ বইটি সর্বপ্রথম প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। আমার জবানবন্দীকালে আমি মনোয়ারা বেগকে আমার লিখিত কোন বই দেই নাই এবং তিনিও আমার নিকট হতে কোন বই জব্দ করেন নাই।
প্রশ্ন ঃ কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব অবশ্যই উপস্থিত ছিলেন এই মর্মে আপনার নিকট কোন তথ্য না থাকায় আপনি মনোয়ারা বেগমকে আপনার লিখিত কোন বই প্রদান করেন নাই।
উত্তর ঃ তিনি কোন বই চান নাই।
প্রশ্ন ঃ আপনার লিখিত কোন বইয়ে গোলাম আযম সাহেব কার্য নির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিল মর্মে উল্লেখ আছে?
উত্তর ঃ যেহেতু জনাব গোলাম আযম সাহেব কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সদস্য সেহেতু তিনি অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন এবং তার উপস্থিতি ছাড়া মিটিং হতে পারে না। বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে কিনা সেটা আমার স্মরন নাই।
প্রশ্ন ঃ কার্য নির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করার বিষয়ে আপনার লিখিত কোন বইয়ে উল্লেখ আছে?
উত্তর ঃ আমার লিখিত যে বইয়ে এই প্রসঙ্গে লেখা আছে সেই বইয়ে উল্লেখ আছে। সেই বইয়ের সুনির্দিষ্ট নাম আমার পক্ষে এ মূহুর্তে বলা সম্ভব নহে।
প্রশ্ন ঃ আপনার লিখিত কোন বইয়ে কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম বৈঠকে দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করায় বিষয়ে নির্দেশনা অধস্থন শান্তি কমিটির নিকট প্রেরণ সংক্রান্ত কোন তথ্য না থাকায় আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে আপনার লিখিত কথিত সংশ্লিষ্ট বই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে প্রদান করেন নাই?
উত্তর ঃ ইহা সত্য নহে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার নিকট কোন বই চান নাই।
প্রশ্ন ঃ ইউনিয়ন শান্তি কমিটির তৎকালীন ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন তাদেরকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয়েছিল কিনা?
উত্তর ঃ প্রায় ক্ষেত্রেই ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
প্রশ্ন ঃ ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানরা ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বারদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন?
উত্তর ঃ হতে পারেন।
প্রশ্ন ঃ ইউনিয়ন কাউন্সিল সরাসরি এস,ডি,ও সাহেবদের অধীনে ছিলেন। ইউনিয়ন শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে নিকটতম আর্মি ক্যাম্পে কমান্ডিং অফিসার বা আর্মিদেরকে কোন নির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা ছিল না।
উত্তর ঃ ইউনিয়ন শান্তি কমিটির নিকটস্থ আর্মি ক্যাম্পের আর্মিদেরকে নির্দেশনা দেয়ার ক্ষমতা ছিল না তা আমি এ মূহুর্তে বলতে না পারলেও তাদের সঙ্গে সহযোগী (অক্সিলিয়ারি) ফোর্স হিসাবে যোগাযোগ থাকতোই।
প্রশ্ন ঃ অক্সিলিয়ারি ফোর্সের সঙ্গা আপনার জানা আছে কিনা?
উত্তর ঃ আমার মত করে আমি জানি। আইনের সঙ্গা আমি নির্ধারন করতে পারবো না, তবে অক্সিলিয়ারি ফোর্স হচ্ছে সহযোগী শক্তি যা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানে এবং সহযোগী শক্তির পরামর্শ, উপদেশ প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ গ্রহন করে।
প্রশ্ন ঃ কর্তৃপক্ষ বেসামরিক ও সামরিক দুই ধরনের হতে পারে?
উত্তর ঃ ১৯৭১ সালে কর্তৃপক্ষ বলতে সামরিক কর্তৃপক্ষকে বোঝানো হচ্ছে এবং সেই সময়ে বেসামরিক কর্তৃপক্ষ থাকলেও তারা ও সামরিক কর্তৃপক্ষের অধস্তন হিসাবে কাজ করেছে।
প্রশ্ন ঃ শান্তি কমিটিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অধিনে আনার জন্য কোন সরকারী বা সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কোন বিজ্ঞপ্তি বা গেজেট প্রকাশিত হয় নাই।
উত্তর ঃ এ বিষয়ে আমি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না।
প্রশ্ন ঃ শান্তি কমিটির প্রতিটি সদস্যের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য পাকিস্তানি সরকার কোন আর্মস সরবরাহের আদেশ প্রদান করেন নাই।
উত্তর ঃ কর্তৃপক্ষ থেকে অস্ত্র দেয়া হয়েছিল।
১৯৭১ সালের পূর্ব হতে জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন মওলানা মওদুদী। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তৎকালীন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন মওলানা মওদুদী সাহেব, তবে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ছিলেন কিনা তা আমি জানি না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী থেকে কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ টি আসনের মধ্যে কতটি আসনে জামায়াতে ইসলামী প্রতিদন্দীতা করেছেন তা আমি বলতে পারবো না। ১৯৭০ সালে আমি মিরপুরের যে এলাকায় বসবাস করতাম সেই এলাকা থেকে গোলাম আযম সাহেব নির্বাচনে প্রতিদন্দীতা করেছিলেন। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে কতটি আসনে জামায়াতে ইসলামী প্রতিদন্দীতা করেছিলেন তা আমি বলতে পারবো না। মুসলিম লীগ উভয় পরিষদে ৪৬২ টি আসনের মধ্যে কতটি আসনে প্রতিদন্দীতা করেছিল তা আমার স্মরনে নাই। রাজা ত্রিদীব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ও কর্মী সংখ্যা কত ছিল তা আমার জানা নাই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমি যে এলাকায় থাকতাম সেটা তখন ইউনিয়ন কাউন্সিলের অধীন ছিল কিনা তা আমি বলতে পারবো না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আমি যে এলাকায় থাকতাম সেই এলাকার জামায়াতে ইসলামীর আমির বা জামায়াতে ইসলামীর প্রধান কে ছিলেন তা আমি বলতে পারবো না। আমি ইন্টারমিডিয়েট ২ বছর পড়েছি চট্টগ্রামে। আমাদের কাসে আমাদের মানবিক শ্রেণীতে দুটি শাখা ছিল, প্রতি শাখায় কমপক্ষে ১৫০/২০০ জন ছাত্র ছিল তাদের মধ্যে কতজন ছাত্র সংঘ করতো তা সুনির্দিষ্ট করে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নহে। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন আমার কাসে কতজন ছাত্রসংঘ করতো তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নহে, ২/১ জনের নাম বলাও সম্ভব নহে। আমার কাসে কোন আলবদর ছিল না। (চলবে)



০৫-০৭-১২ ইং ২.০০ পূনরায় জেরা শুরু ঃ
আমি যে ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম সেই ছাত্র সংগঠন নীতিগতভাবে ধর্মীয় রাজনীতির বিরুধী।
প্রশ্ন ঃ আপনি নিজে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি করে অনেক বক্তব্য ও বিবৃতী দিয়েছেন।
উত্তর ঃ আমি ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক ব্যবসার সব সময়ই বিরোধীতা করেছি এবং বিবৃতিও দিয়েছি।
প্রশ্ন ঃ ধর্মীয় রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে ব্যবসা দুটি পৃধক শব্দ এবং এর পৃথক অর্থ আছে।
উত্তর ঃ হতে পারে, আমি ব্যকরণবিদ নই, আমি যা বুঝেছি আমি তাই বলেছি।
প্রশ্ন ঃ রাজনীতি একটা ব্যবসা এটা আপনি মনে করেন কিনা?
উত্তর ঃ আদর্শগত রাজনীতি ব্যবসা নয়।
প্রশ্ন ঃ ব্যবসা অর্থ কোন কিছু বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা।
উত্তর ঃ কোন কিছু পুজি করে মুনাফা অর্জন বা লাভ সেটিই ব্যবসা।
প্রশ্ন ঃ বই বিক্রি করে অর্থ উপার্জনও একটা ব্যবসা।
উত্তর ঃ প্রকাশক যখন বই বিক্রি করার জন্য প্রকাশ করে সেটা একটা ব্যবসা।
প্রশ্ন ঃ জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পি.ডি.পি, নেজামে ইসলামী দল সমূহকে সামরিক বাহিনীর কমান্ডের অধীনে এনে পাকিস্তানি সামরিক সরকার কোন আদেশ জারী করেছিল কিনা তৎমর্মে আপনার নিকট কোন তথ্য আছে কিনা?
উত্তর ঃ এ সম্পর্কে আমার কাছে কোন তথ্য নাই । তারা সবসময় পরস্পর আলোচনা ও পরিকল্পনা করে অগ্রসর হয়েছে, সেই কারণে আলাদা কোন নির্দেশনা জারী করার প্রয়োজন ছিল না।
প্রশ্ন ঃ জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পি.ডি.পি, নেজামে ইসলামী বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থনকারী বা পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার সমর্থনকারী ব্যক্তি বা অন্যান্য দল সমূহের প্রতিটি সদস্য ও কর্মীকে সরকারের পক্ষ থেকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য কোন নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল কিনা ?
উত্তর ঃ উল্লেখিত ৪টি দলের কর্মীরা যখন শান্তি কিমিটি, রাজাকার বা আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিল তখন অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে।
প্রশ্ন ঃ    আপনি শান্তি কমিটির কতজন সদস্যের কাছে সরকারিভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল এ মর্মে আপনার গবেষনাকালে কোন তথ্য পেয়েছিলেন কিনা ?
উত্তর ঃ    এই মূহুর্তে আমার তা স্মরণ নাই।
প্রশ্ন ঃ    জামায়াতে ইসলামী নেতার মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীর সূত্রপাত হয় এই তথ্য আপনি কোথায় পেয়েছেন ?
উত্তর ঃ    এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
প্রশ্ন ঃ    জামায়াতে ইসলামী নেতার মাধ্যেমে রাজাকার বাহিনীর সূত্রপাত হয় ইহা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য এ মর্মে কোন তথ্য আপনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষকে প্রদান করেছিলেন কিনা ?
উত্তরঃ    সুনির্দিষ্টভাবে এত কথা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নহে, তবে যতদূর মনে পড়ে আমি দিয়েছিলাম।
প্রশ্নঃ    ১৯৭১ সালে আপনি পত্র পত্রিকা পরতেন কিনা ?
উত্তরঃ    পড়তাম।
প্রশ্নঃ    ১৯৭১ সালে কোন মাসে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় ?
উত্তরঃ    আমার যতদূর মনে পড়ে মে মাসে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল।
প্রশ্নঃ    মে মাসের কোন তারিখে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় ?
উত্তরঃ    এ মূহুর্তে সুনির্দিষ্ট তারিখ আমার মনে নাই।
প্রশ্নঃ    ১৯৭১ সালের আগষ্ট মাসের ২ তারিখে গেজেট আকারে রাজাকার অর্ডিনেন্স জারী হয় ইহা আপনি জানেন কিনা ?
উত্তরঃ    এ মূহুর্তে সুনির্দিষ্ট তারিখ মনে না করতে পারলেও তা যে বিধিবদ্ধ সংস্থা পরিণত করে গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল মর্মে আমার মনে আছে।
প্রশ্নঃ    আল বদর কোন মাসের কোন তারিখে গঠিত হয়েছিল ?
উত্তরঃ    আমি আগেও বলেছি এপ্রিল মাস থেকে জুন মাসের মধ্যে জামালপুরে প্রথম আলবদর গঠিত হয়েছিল।
প্রশ্নঃ    পাকিস্তান আর্মিরা আলবদর বাহিনী গঠন করেছিল ?
উত্তরঃ    আলবদর বাহিনী জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র সংঘের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তান আর্মিদের সাথে সম্পর্ক থাকায় তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল।
প্রশ্ন ঃ    আলবদর বাহিনী গঠনের জন্য কোন আইন বা বিধি প্রনীত হয়েছিল কিনা ?
উত্তর ঃ    সহযোগী শক্তি বিধায় এর প্রয়োজন ছিল না।
প্রশ্ন ঃ    আল শামস বাহিনী গঠনের জন্য কোন আইন বিধি প্রনীত হয়েছিল কিনা ?
উত্তর ঃ    সহযোগী শক্তি বিধায় এর প্রয়োজন ছিল না।
প্রশ্ন ঃ    আল মুজাহিদ বাহিনী গঠনের জন্য কোন আইন বিধি প্রনীত হয়েছিল কিনা ?
উত্তর ঃ    এই ব্যপারে আমার কোন বক্তব্য নাই।
প্রশ্নঃ    মুজাহিদ বাহিনীর অস্তিত্য ছিল ১৯৭১ সালে ইহা ঠিক কিনা ?
উত্তরঃ    তথ্যাবলীতে তা ঠিক।
প্রশ্নঃ    ই,পি,আর, বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে ঊচঈঅঋ করা হয়েছিল কিনা ?
উত্তর ঃ    এ ব্যপারে আমার কোন বক্তব্য নাই।
প্রশ্ন ঃ    আনছার বাহিনী বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল এবং আনছার বাহিনীর সদস্যদেরকে রাজাকার বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল কিনা ?
উত্তর ঃ    প্রথম অংশ সঠিক এবং দিত্বীয় অংশে দ্বিমত পোষণ করি।
প্রশ্ন ঃ    রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন রাজাকার ডিরেক্টর।
উত্তর ঃ    বিধিবদ্ধ হওয়ার পরে পাকিস্তান সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত ডিরেক্টর দ¦ারা রাজাকার বাহিনী পরিচালিত হতো।
প্রশ্ন ঃ    বিধিবদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজাকার বাহিনী একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছিল ?
উত্তর ঃ    জন্মলগ্ন থেকে এর নাম দেয়া হয়েছিল “রেজাকার”। যা একটি ফার্সি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী, বিধিবদ্ধ হওয়ার পরে এর নাম হয় রাজাকার বাহিনী।
প্রশ্ন ঃ    ৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে রাউয়ালপিন্ডিতে এক ঘোষনার মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে সামরিক বাহিনীর অধিনে নিয়ে আনা হয়।
উত্তর ঃ    এ মূহুর্তে নির্দিষ্ট করে তারিখ বলতে না পারলেও আমি এটুকু বলতে পারি সবকিছু সামরিক বাহিনীর অধিনস্ত ছিল।
প্রশ্ন ঃ    রাজাকার বাহিনী বিধিবদ্ধ হওয়ার পর এর ডিরেক্টর হয়েছিলেন পুলিশ অফিসার আব্দুর রহিম সাহেব ?
উত্তর ঃ    হতে পারে।
প্রশ্ন ঃ    ১৯৭৩ সালে উক্ত আব্দুর রহিম সাহেবকে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
উত্তর ঃ    আমার জানা নাই।
প্রশ্ন ঃ    আব্দুর রহিম সাহেব কোলাবরেটর আইনে গ্রেফতার হয় নাই।
উত্তর ঃ    তা আমার জানা নাই।
প্রশ্ন ঃ    আব্দুর রহিম সাহেবের পরেও আরেকজন ব্যক্তিকেও রাজাকারের ডিরেক্টর নিযুক্ত করা হয়েছিল।
উত্তর ঃ    এ মূহুর্তে আমার জানা নাই।
প্রশ্ন ঃ    ঢাকা জেলা রাজাকার এ্যাডজুটেন্ট এর নাম কি ছিল ?
উত্তর ঃ    তা আমার মনে নাই, এটা প্রশাসনিক বিষয়, যা আমার গবেষনার বিষয় নহে।
প্রশ্ন ঃ    রাজাকার সদস্যদের উপর রাজাকার ডিরেক্টর ও এ্যাডজুটেন্টদের এর নিয়ন্ত্রণ ছিল কিনা ?
উত্তর ঃ    তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না, কেননা তারা অধিকাংশই ছিল জামায়াত কর্মী।
প্রশ্ন ঃ    ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কত ছিল ?
উত্তর ঃ    এ মূহুর্তে নির্দিষ্ট তথ্য দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে।
প্রশ্ন ঃ    ঢাকা জেলার রাজাকারের সংখ্যা কত ছিল ?
উত্তর ঃ    এ মূহুর্তে নির্দিষ্ট তথ্য দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে।
প্রশ্ন ঃ    ঢাকা জেলার রাজাকারদের নাম সংগ্রহের চেষ্টা কখনো করেছেন কি ?
উত্তর ঃ    এই বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নাই।
প্রশ্ন ঃ    রাজাকারদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতকরন ছাড়া তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
উত্তর ঃ    ইহা সত্য নাহে, আমি আগেও বলেছি জামায়াত কর্মী দ্বারা রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টি। যেহেতু জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামে প্রতিনিয়ত জামায়োতের তৎকালীন নেতা জনাব গোলাম আযম ও অন্যান্য জামায়াত নেতৃবৃন্দ, রেজাকার বা রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সবসময় বক্তৃতা ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রনোদনা, প্ররোচনা ও উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং পাকিস্তান সরকার বা সামরিক সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন সেই কারণে আমি একথা বলেছি।
প্রশ্ন ঃ    দৈনিক সংগ্রাম প্রত্রিকা আপনি ১৯৭১ সালে নিয়মিত পড়তেন কিনা ?
উত্তর ঃ    মাঝে মাঝে পড়তাম, যেহেতু অপর পক্ষের সব খবর সেন্সর করা হতো সেজন্য পাকিস্তান সরকার কি করছে বা ভাবছে তা জানার জন্য এটা দরকার ছিল কেননা জামায়াত ছিল পাকিস্তান সরকারের প্রধান সহযোগী শক্তি এবং দৈনিক সংগ্রাম ছিল জামায়াতের মুখপাত্র। সেই হিসাবে সংগ্রাম কর্তৃপক্ষ প্রনোদনকারী, প্ররোচনাকারী ও উৎসাহদানকারী এবং সমর্থনকারী।
প্রশ্ন ঃ    দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা আপনি ১৯৭১ সালে নিয়মিত পড়তেন কিনা ?
উত্তর ঃ    আমি মাঝে মাঝে দৈনিক পাকিস্তান, অবজারভার, সংগ্রাম দেখতাম। এর বাইরে অন্য পত্রিকা সম্পর্কে স্মরণ নাই।
প্রশ্ন ঃ    ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পরে মুক্তিযুদ্ধ গবেষনার জন্য কাজে ব্যবহারের জন্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রকাশিত ইত্তেফাক পত্রিকা সমূহ পর্যালোচনা করেছেন কিনা ?
উত্তর ঃ    কাগজপত্র না দেখে আমি বলতে পারব না।
প্রশ্ন ঃ    ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সরকারের প্রশংসা করে দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় কোন লেখা পর্যালোচনা করেছিলেন কিনা ?
উত্তর ঃ কাগজপত্র না দেখে বলতে পারব না। (চলবে)





২৫-০৯-২০১২ ইং পুনরায় জেরা শুরুঃ
প্রশ্নঃ বিজয়ের পর পরই সরকারি ব্যবস্থাপনায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ব্যাপারে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল কিনা?
উত্তরঃ আমার যতদূর মনে পড়ে স্বাধীনতার পর পরই বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে জহির রায়হান একটি কমিটি গঠন করেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিল গণহত্যা বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকান্ড তদন্ত করা এবং কারা এর জন্য দায়ী তা নির্ধারণ করা। জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর এই কমিটি আর কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তবে সরকারের পক্ষ থেকে নীতি নির্ধারণের অনেকে গণহত্যা বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে তদন্ত করে বিচার করার কথা বলেছিলেন।
প্রশ্নঃ জহির রায়হান সাহেবের যে কমিটি গঠিত হয়েছিল তার প্রধান জহির রায়হান সাহেব ছিলেন কিনা?
উত্তরঃ জহির রায়হান সাহেবই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
প্রশ্নঃ উক্ত কমিটির কাগজপত্র জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর সরকাকে প্রদান করা হয়েছিল নাকি কলিকতায় একজন সাংবাদিক নিয়ে গিয়েছেন?
উত্তরঃ এই সম্পর্কে নানা রকম বর্ণনা আছে। এর মধ্যে একটি রটনা হলো কলিকাতার জনৈক সাংবাদিক কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু এর সত্যতা নির্ধারণ করা যায়নি। আমার যতদূর মনে পড়ে কাগজপত্র কি কি ছিল তার ইনভেনট্রি কখনও তৈরি করা হয়নি তবে কিছু কিছু কাগজপত্র সেই সময়ে এ্যাডভোকেট এস. আর. পালের নিকট মামলার স্বার্থে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মূলকথা হচ্ছে এই সকল কাগজপত্র সম্পর্কে সত্য কখনও নির্ধারণ করা যায় নাই।
প্রশ্নঃ উক্ত কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ছিলেন কিনা?
উত্তরঃ এটা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না, কারণ আমরা এটা জহির রায়হানের কমিটি হিসাবে জানতাম, কারণ তিনি এ কমিটির প্রধান ছিলেন।
প্রশ্নঃ আপনি গবেষণার কার্য পরিকল্পনা ক্ষেত্রে জহির রায়হান সাহেবের তদন্ত কমিটি সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন কিনা?
উত্তরঃ আমি জিজ্ঞাসাবাদ করি নাই।
শহিদুল হক মামা নামে কোন ব্যক্তিকে আমি চিনি না। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত নাছিরুদ্দিন ইউসুফ সাহেবের উপস্থাপনায় “রণাঙ্গনের দিনগুলি” অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নাই, তবে এই ধরণের একটি অনুষ্ঠান চ্যানেল আই’তে প্রচারিত হতে পারে।
৩১ জানুয়ারী ১৯৭২ তারিখে ঢাকার মীরপুর দখল মুক্ত হয়েছিল। ঐ সময়ের খবরের কাগজের প্রতিবেদন যতটুকু মনে পড়ে তাতে আমার যা স্মরণে আছে তা হলো জহির রায়হান তার বড় ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারের খোঁজে উদ্বিগ্ন হয়ে মীরপুরের দিকে রওনা হয়েছিলেন, মীরপুর মুক্ত করতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন এরকম কোন সংবাদ কোথাও দেখি নাই। জহির রায়হান সাহেব মীরপুরে নিহত হওয়ার খবর শুনি নাই, তবে সেখানে তার অন্তর্ধানের খবর শুনেছি। জহির রায়হানের অন্তর্ধানের বিষয়ে সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিকের লিখিত কোন বই আমি পড়েছি কিনা তা আমার স্মরণ নাই। মীরপুরের কোন অবাঙ্গালী নাম যার মাস্তানা তিনি জহির রায়হানকে টেলিফোন করে নিয়ে গিয়েছিলেন এরকম কোন খবর আমার জানা নাই। মীরপুর মুক্ত হওয়ার পর সেখান থেকে ১০/১২ হাজার লোক বা কোন লোক গ্রেফতার হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নাই। ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারী মাসের গ্রেফতারকৃত একজন অবাঙ্গালী রাজাকারের স্বীকারোক্তিনুযায়ী পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী খান এ সবুরের বাসা থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র উদ্ধার হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নাই। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে আমি পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী, নিয়াজী এবং আরও সংশিষ্ট নীতি নির্ধারকদের অনেকের সাক্ষাতকার নিয়েছি। রাও ফরমান আলী ও নিয়াজী ১৯৭১ সালের ঘটনার বর্ণনা নিয়ে বই লিখেছেন তা আমি জানি। নিয়াজী তার লিখিত বই’য়ে একথা উল্লেখ করে থাকতে পারেন যে, রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতো, কিন্তু সেই সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করত পাকিস্তান সেনাবাহিনী, কিন্তু তারা একাই সব কাজ করেছে, ইহা সঠিক নহে, তৎকালীন তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের সম্পূর্ণভাবে সহায়তা করেছে এবং এগুলি তাদের বইয়ে উল্লেখ আছে।
প্রশ্নঃ নিয়াজী আমার কাছে রাজনৈতিক দলসমূহ এবং নেতৃবৃন্দকে আমি বিশ্বাস করি না, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বদা নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণ করি একথা বলেছেন কিনা?
উত্তরঃ নিয়াজী পাকিস্তানের ভাঁড় হিসাবে পরিচিত। তার কথার মূল্য আমরা কেন পাকিস্তানীরও দেয় না। তার সমস্ত বক্তব্যই অন্যান্য তথ্য দ্বারা বিশ্লেষিত হয়েছে। তবে আপনি যা বললেন তা যদি আমার সাক্ষাতকারের অংশ হয়ে থাকে সে সম্পর্কে কাগজপত্র না দেখে আমি কিছুই বলতে পারব না।
প্রশ্নঃ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস নিয়াজীর কমান্ডে ছিল কিনা আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন “তাই। কেউ কেউ বলে, ওরা জামায়াতে ইসলামীর অধীনে ছিল। কিন্তু আমি তা স্বীকার করি না। আল-বদর ও আল-শামস না হওয়ার নেপথ্যে জার্মানীর এক শাসকের ধরণা রয়েছে তিনি অনুরূপ ধারণার উদ্দ্যোক্তা। সেখান থেকে আমি ধারণাটি নিই” একথা সঠিক কিনা?
উত্তরঃ আপনি একটি সাক্ষাতকারের খন্ডাংশ তুলে ধরেছেন তার দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, নিয়াজী যাহা বলেছেন তা সত্য, কেননা আমি আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি নিয়াজীর যে কোন উক্তি অন্যান্য তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে।
প্রশ্নঃ আপনার নিকট দেওয়া সাক্ষাতকারে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস সম্পর্কে নিয়াজী আরও বলেছেন “তারা জামায়াতে ইসলামীর কেউ নয়। আমি রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করি। যারা রাজনীতি করে তাদের কাউকেই আমি ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দিই না। কাজেই আমি কেমন করে এ কাজে সাহায্য সহযোগীতা করতে কোন রাজনৈতিক দলকে বলতে পারি” একথা সঠিক কিনা?
উত্তরঃ আগের প্রশ্নের আমার উত্তরে এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত, তবে জামায়াতের ঐতিহাসিক সেলিম মুনসুর এর উল্টোটি বলেছেন। সেই কারণে আমি বলেছিলাম পাকিস্তানী জেনারেল বা নীতি নির্ধারকদের যে কোন বক্তব্যেই অন্যান্য তথ্যের আলোকে বিচার না করলে সঠিক সত্য নির্ধারণ করা সম্ভব হবে না।
প্রশ্নঃ জামায়াতে ইসলামীর কোন প্রকাশনা সংস্থা আছে কিনা?
উত্তরঃ যতদূর জানি পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের প্রকাশনা সংস্থা এবং বাংলাদেশেও আছে। দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র।
প্রশ্নঃ সেলিম মুনসুরের যে বক্তব্যের কথা আপনি বলেছেন সেটি জামায়াতে ইসলামীর কোন প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তরঃ জামায়াতের তালবা প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তবে যেহেতু শব্দটি উর্দু সেহেতু উচ্চারণে একটু পার্থক্য থাকতে পারে।
জামায়াতের কোন প্রকাশনা সংস্থা হতে সেলিম মুনসুরের উল্লেখিত বক্তব্য সম্বলিত বই প্রকাশিত হয় নাই, ইহা সঠিক নহে। যেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেই সংস্থা জামায়াতের সংলগ্ন সংস্থা বলেই আমরা জানি।
প্রশ্নঃ রাজাকার বাহিনীকে অীঁরষষরধৎু ঋড়ৎপব (অক্সুলিয়ারি ফোর্স)  হিসেবে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড কর্তৃক নয় বরং কেন্দ্রীয় কমান্ড কর্তৃক অন্তর্ভূক করা হয়েছিল কিনা?
উত্তরঃ যা কিছুই হয়েছে তা কেন্দ্রীয় কমান্ড বা সরকার কর্তৃক হয়েছে সেটা পূর্বাঞ্চলীয় হউক আর পশ্চিমাঞ্চলীয় হইক।
প্রশ্নঃ কেন্দ্রীয় কমান্ড বা সরকারকে নির্দেশ, সিদ্ধান্ত প্রদান, বা কোন কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার কোন ক্ষমতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের ছিল না।
উত্তরঃ কোন ব্যক্তি কোন সরকারকে বিশেষ করে সামরিক সরকারকে সরাসরি নির্দেশ প্রদান করতে পারেন না, তবে পরামর্শ দিতে পারে, প্রণোদনা যোগাতে পারে, পরিকল্পনায় সাহায্য করতে পারে, প্ররোচিত করতে পারে এমনকি তাদের সাথে ষড়যন্ত্রেও অংশ গ্রহণ করতে পারে।
প্রশ্নঃ আল-বদর, আল-শামস কোন পৃথক বাহিনী ছিল না, সে দুটি রাজাকার বাহিনীর পৃথক দুটি অংশ ছিল।
উত্তরঃ এই তথ্যটি নতুন। কারণ আমাদের জানামতে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও শান্তি কমিটি আমরা পৃথক পৃথক সংস্থা হিসেবে বিচার করলেও এর সদস্যদের সিংহভাগ জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরাই ছিল। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, জামায়াতে ইসলমাীর সিংহভাগ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং শান্তি কমিটিতে রুপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্নঃ যেহেতু শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের মোট সদস্য সংখ্যা কতছিল সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারণা না থাকার কারণে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের সিংহভাগ সদস্যই জামায়াতে ইসলামীর ছিল মর্মে আপনি যে তথ্য এখানে দিলেন তাহা অসত্য।
উত্তরঃ আপনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। কারণ জামায়াতে ইসলমাীর নেতারা কখনও তাদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করে নাই। (ডিফেন্সের আপত্তি সহকারে)
প্রশ্নঃ আপনি যে সমস্ত রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য, আল-বদর, আল-শামসের সদস্য সনাক্ত করেছেন তাদের সকলের দলীয় পরিচিতি বলতে পারবেন কিনা?
উত্তরঃ আমি কখনও কাউকে নির্দিষ্টভাবে সনাক্ত করেছি একথা বলি নাই, তবে পত্র-পত্রিকার যাদের যে সমস্ত পরিচিতি উল্লেখ করা হয়েছে আমি সেগুলিই উল্লেখ করেছি।
প্রশ্নঃ আপনি কতজন রাজাকার এডজোটেন্টকে সনাক্ত করেছেন?
উত্তরঃ আমি বলতে পারব না।
প্রশ্নঃ আপনি কতজন মহকুমা পিস কমিটির সদস্যকে সনাক্ত করেছেন?
উত্তরঃ এটা আমাকে বই দেখে বলতে হবে।
প্রশ্নঃ আপনি অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের বক্তব্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, ইহা একান্তই আপনার নিজস্ব এবং অসত্য।
উত্তরঃ ইহা সত্য নহে।
প্রশ্নঃ আপনি আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে জামায়াত বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারণা চালাচ্ছেন।
উত্তরঃ আমার রাজনৈতিক আদর্শ সনাক্ত না করা পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নহে, তবে আপনার বক্তব্য সত্য নহে।
প্রশ্নঃ ১৯৭১ সালে অধ্যাপক গোলম আযম সাহেবের ভূমিকা ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক।
উত্তরঃ গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ইত্যাদি যদি রাজনৈতিক আদর্শের অন্তর্ভূক্ত হয় তাহলে আপনার বক্তব্য সঠিক।
প্রশ্নঃ ১৯৭১ সালে অধ্যাপক গোলম আযম সাহেব হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, কোন কাজের সহিত জড়িত ছিলেন না, আপনি তাকে জড়িয়ে অসত্য জবানবন্দী ও সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
উত্তরঃ ইহা সত্য নহে।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমার লেখা লেখি এবং মুখ্য গবেষণার বিষয় তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ বর্তমানে বাংলাদেশ এর সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, নগরায়ন ও মুক্তিযুদ্ধ। আমি ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠ শিশু লেখক হিসাবে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করি। খুব সম্ভব ১৯৬৩ সালে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করি। ২০১০ সালে ২১শে পদক লাভ করি গবেষণার জন্য। সুনির্দিষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার লাভ করি। এছাড়া আরও অন্যান্য পুরস্কার প্রাপ্ত হই।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তানীদের ভাষায় আমাদের ক্রোধান্বিত করেছিল। এই ক্রোধ ও ক্ষোভ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৬৯ সনের গণ-আন্দোলনে।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পরে ঢাকা থেকে কয়েকটি সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল বলে আমার মনে পড়ে। যার মধ্যে ডেইলী অবজারভার, দৈনিক পাকিস্তান, সংগ্রাম, পূর্বদেশ পত্রিকাও ছিল। তখনকার পত্র পত্রিকাগুলির ব্যাপারে বলতে পারি সেগুলি ছিল অবরুদ্ধ দেশের সংবাদপত্র।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
তবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগের ভূমিকাই ছিল বেশী।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমরা বার বার দেখি যে এপ্রিলে তাদের পরামর্শে ও উৎসাহে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটি পরবর্তীকালে দুভাগ হয়ে গেলেও খাজা খয়রুদ্দিন গোলাম আযমের নেতৃত্বাধীন শান্তি কমিটি প্রাধ্যন্য বিস্তার করেছিল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সহায়তা পেয়েছিল। অচিরেই আমরা দেখতে পাই তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
উল্লেখ্য সে সময়ের সংবাদপত্রগুলি যদি দেখা যায় তাহলে আমরা দেখতে পাবো জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির জনাব গোলাম আযমের বক্তব্য প্রাধান্য পাচ্ছে।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমি যখন একটি দলের নাম বলছি তখন তার ভিতরে সেই দলের অঙ্গ সংগঠনকেও অন্তর্ভূক্ত করছি এবং প্রত্যেকটি দলের ব্যাপারেই একথা প্রযোজ্য। এ সব দলের নেতারা প্রতি নিয়ত বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে তাদের কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রণোদনা যুগিয়েছে এসব কমিটি ও বাহিনীতে যোগদানের জন্য। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক জান্তাকে সহায়তা করার জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিলেন জামায়াতের তৎকালীন আমির জনাব গোলাম আযম। আজকে ৪০ বৎসর পরও যখন শান্তি কমিটির সদস্য রাজাকারদের এবং আল-বদরদের হত্যাযজ্ঞ, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এগুলোর কথা স্মরণ করি তখন শিউরে উঠি।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
পাকিস্তান বাহিনী তো ছিলই কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে তাদের এই সহযোগীরা যদি না থাকতো তাহলে হয়তো এই ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা খানিকটা কম হতো এবং আমরা আরও আগে জয়ী হতে পারতাম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ আমি লিখেছি। প্রধানত আমি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তির উপর বেশী গবেষণা করছি।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমার সব সময় একটা কৌতুহল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী ছাড়া বাঙ্গালী যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে তাদের মনোজগৎটা কেমন ছিল। তারা এ ধরণের নিষ্ঠুর কর্মকান্ড একই জাতির মানুষের উপর, একই ধর্মাবলম্বীদের উপর কিভাবে করতে পারে সেটা মিমাংসা আমরা করতে পারিনি।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমরা অনেকে এসব কমিটির বা বাহিনীর কর্মকান্ডের মধ্যে সুক্ষ্ম তফাৎ করার চেষ্টা করি। কিন্তু মূলত এদের সবার লক্ষ্য ছিল একই। সেটি হচ্ছে তৎকালীন ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত থাকা, সম্পদ লুটের মাধ্যমে আহরণ, জনগণকে দমিত করার জন্য হত্যা ও ধর্ষণকে ব্যবহার।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
তাদের সব সময় প্ররোচনা দিয়েছি, প্রণোদনা যুগিয়েছি শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযম ছিলেন প্রধান।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
এ সম্পর্কে কিছু বই বেরিয়েছে সেখানে দেখলে দেখা যাবে তার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর। রাজাকারদের একইভাবে উৎসাহ দিয়েছে, প্ররোদনা যুগিয়েছে এবং প্ররোচনাও দিয়েছে ঐ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। যার মধ্যে জামায়াতের তৎকালীন আমির জনাব গোলাম আযম উল্লেখযোগ্য।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
কেননা বলা যেতে পারে তারা এক প্রকার লাইসেন্স প্রদান করেছে হত্যা করার জন্য। কারণ তারা অহরহ রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে এসব কমিটির সদস্য ও বাহিনীর সদস্যদেরকে উৎসাহিত করেছে এসব বর্বর কর্মকান্ড করার জন্য এবং এসব করলে তাদের কোন শাস্তি হবে না সেটাও নিশ্চিত করা হয়েছে। কারণ এসব কর্মকান্ড যারা করেছে তাদের কেউ কখনও দন্ডিত হয় নাই।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমি প্রায় ৪ দশক শিক্ষকতার সংগে যুক্ত আমার ছাত্ররা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কিন্তু কখনও তারা শিক্ষক হিসাবে আমাকে অসম্মান করেনি আমিও যে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের হউক না কেন যখন ছাত্র হিসাবে আমার কাছে এসেছে আমি তাদের প্রতি সমভাবে আচরণ করেছি। সে কারণে বললাম কতটা মনুষত্ব বিবর্জিত হলে শিক্ষককে মিথ্যা কথা বলে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারে। ইতিহাসে এর উদাহরণ পাওয়া খুব কঠিন।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
এ মুহূর্তে আমার একটি বইয়ের নাম ও দলিলের কথা মনে পড়ছে। বইটির লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা ও সাবেক রেজিষ্ট্রার তার নাম সম্ভবত নাজিম উদ্দিন হতে পারে। বইটির নাম ‘যখন কৃতদাস’। বইটির কথা উল্লেখ করছি একটি কারণে, বইটির শিরোনামের মাধ্যমে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিকামী বাঙ্গালীর অবস্থা কি ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মুক্তিকামী মানুষ কৃতদাস ছিল, কৃতদাস হতে বাধ্য করা হয়েছিল। হত্যার কথা বলেছি, তার সঙ্গে অপহরণ, নির্যাতন, ধর্মান্তর করণ, দেশান্তর সবকিছুই এই প্রত্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত। কৃতদাসের কোন ইচ্ছা থাকে না, এই অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙ্গালীদেরও এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে, তারা স্বইচ্ছায় কোন কাজ করতে পারতো না। জেনারেল নিয়াজীর একটি দলিলের কথা উল্লেখ করতে চাই যেটি আমার বই ‘মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র’-এ উল্লেখ করেছি। নিয়াজী তার নথিতে উল্লেখ করেছিলেন যে, পাকিস্তানীদের উচিত হবে বাঙ্গালীদের সংখ্যাঘুতে পরিণত করা। এখন আমরা যদি সেই সব রাজনীতিবিদ যাদের কথা ইতিপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি সেসব কমিটি ও বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা এই লক্ষ্য পূরণে পাকিস্তানী জান্তাকে সহায়তা করে গেছে। অর্থাৎ মুসলমান ছাড়া অন্যান্য ধর্মালম্বী বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা। এক্ষেত্রে তারা সিষ্টেমেটিক্যালি কাজ করছে। এর প্রমাণ প্রায় এক কোটি লোকের দেশ ত্যাগ।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে নদীর পার্শ্বে যেখানে সেতু আছে সেখানে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে যাদের বধ্যভূমিতে স্থান হয় নাই। উদাহরণ স্বরুপ আমি একবার বরিশালের উজিরপুরে এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানকার লোকেরা সাধারণত পান চাষ করে। তারা আমাকে জানিয়েছিল যে, রাজাকাররা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের পথ দেখিয়ে সেই গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেই গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। গণহত্যার বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায়ে কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সেটা ঐ গ্রামের ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। অনেক গণহত্যার পর অনেকের লাশ গণকবর না দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
এইসব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমি আগেও উল্লেখ করেছি, আবারও বলছি জামায়াতে ইসলামী ছিল প্রধান এবং এর দায় দায়িত্ব জামায়াতের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির বা প্রধান গোলাম আযমের উপর বর্তায়।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমার কাছে যে সকল কাগজপত্র আছে বা যে সকল বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৩ থেকে ২০ বছরের বালিকা ও তরুণীদের তুলে নেয়া হয়েছিল।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
১৩/১৪ বৎসরের বালিকারাও জানিয়েছে প্রতিদিন কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ বার তাদের ধর্ষণ করা হতো।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমি ভাবতে পারি না যে, বাঙ্গালী রাজনীতিবিদরা যারা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসাবে কাজ করছিল তারা কিভাবে এ কাজে পরামর্শ দিলেন, সহায়তা করলেন, তাদেরও তো স্ত্রী, কন্যা ছিল। নারী ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনকে ব্যবহার করা হয়েছে বাঙ্গালী মুক্তিকামী মানুষকে কৃতদাস করে রাখার জন্য। আমরা শরনার্থীদের কথা বলি কিন্তু শরনার্থী শিবিরে কত মানুষ মারা গেছে সেটা উল্লেখ করি না। এসব মানুষও গণহত্যার অন্তর্ভূক্ত।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
তারা এসব কর্মকান্ডে এত বদ্ধ পরিকর ছিল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করে।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমাদের প্রয়াত ধর্মপ্রাণ দার্শনিক জনাব দেওয়ান মোঃ আজরফ বলেছিলেন যে, ধর্মের নামে এত মুসলমান এর আগে এত হত্যা করা হয় নাই।
একথাগুলি আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট বলেছিলাম কিন্তু তিনি লিখেছেন কিনা আমি জানি না।
আমার জীবিত কালে বা জীবন কালে এত অশ্রু, এত রক্ত, এত বেদনার সম্মুখীন আর কখনও হয়নি, হতে চাইও না আল্লাহর কাছে এটি আমার প্রার্থনা।
১৯৭১ সালে সকল পত্রিকার জন্য একই ধরণের সেন্সরশিপ ছিল। মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরষ্কার আমি পেয়েছি। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন আওয়ামী লীগ নেতা জলিল সাহেব। আমি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনষ্টিটিউটের পরিচালক থাকা সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিধি বহির্ভূতভাবে সর্বোমোট ৮,৬৪,৪৮০/- (আট লক্ষ চৌষট্টি হাজার চারশত আশি) টাকা গ্রহণ করেছিলাম মর্মে পূর্ববর্তী সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি প্রমাণ পেয়েছিল, ইহা সত্য নহে। এই কারণে আমার বিরুদ্ধে যাতে অভিযোগ দায়ের না হয় সেই জন্য আমি বর্তমান সরকারের নির্দেশনা মতে অত্র ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করতে এসেছি, ইহাও সত্য নহে। আমি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করি নাই, ইহা সত্য নহে। (সমাপ্ত)