শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৩

আল্লামা সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড// উত্তর মেলেনি অনেক প্রশ্নের

রায় পর্যালোচনা

মেহেদী হাসান৪/৪/২০১৩
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলমীর নায়েবে আমির আল্লামা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বহুল আলোচিত এবং ঘটনাবহুল এ মামলার রায় ঘোষনা করলেন।

আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে  ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছিল।  এর মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে  উল্লেখ করা হয়েছে।  প্রমানিত আটটি অভিযোগের দুটি অভিযোগ হত্যা বিষয়ক।  ইব্রাহীম কুট্টি এবং বিশাবালী   হত্যার অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে  আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে।  বাকী ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হলেও তাতে কোন শাস্তির কথা উল্লেখ করেননি ট্রাইব্যুনাল।  এ  ছয়টি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে  ধর্মান্তরকরন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরন, ধর্ষনে সহায়তাকরন  প্রভৃতি।

১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয় রায়ে। খালাস দেয়া অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের পিতা এসডিপিও ফফজুর রহমানসহ পিরোজপুরের তিনজন সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ, ভাগিরথী হত্যা এবং ভানুসাহাকে ধর্ষনের অভিযোগ।


মৃত্যুদন্ড  প্রদান করা দুটি হত্যার অভিযোগসহ অন্যান্য যেসব অভিযোগে আল্লামা সাঈদীকে  দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সেসব বিষয়ে অনেক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যার কোন উত্তর মিলছেনা। তাই সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে  বলে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির রায় প্রদানের পরও  মৌলিক কিছু প্রশ্নের  কোন সদুত্তর না মেলায় সাঈদীর দোষী বিষয়ে মানুষের মন থেকে সন্দেহ সংশয় দূর হচ্ছেনা। উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর না মেলায় বরং মানুষের মনে পাল্টা যে প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে তা হল আসলেই কি আল্লামা সাঈদী ১৯৭১ সালে অপরাধের সাথে জড়ি ছিল?

আসুন আমরা প্রথমে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হই এবং বিবেকের কাছে তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করি।

যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদন্ড

১. ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার ঘটনা :
আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ ১৯৭১ সালের ৮ মে তার  নেতৃত্বে  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন পিরোজপুরের পাড়েরহাট বাজারের নিকটস্থ  চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে মানিক পসারীর বাড়িসহ ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজ নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরা দুজন  মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। আল্লামা  সাঈদী এদের দুজনকে ধরে এক দড়িতে বেঁধে  পাড়েরহাট বাজারে নিয়ে যান । এরপর আল্লামা  সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করে পাড়েরহাট বাজারে ব্রিজের কাছে। হত্যার পর তার লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। মফিজকে  হত্যা না করে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে  সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

রায়ে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার এ অভিযোগ  প্রমানিত হয়েছে উল্লেখ করে  আল্লামা সাঈদীকে মুত্যৃ দণ্ড প্রদান করা হয়েছে।


উত্তর মেলেনি  যেসব  প্রশ্নের :
ইব্রাহীম কট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম তার  স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই পিরোজপুরে একটি মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় তিনি পাকিস্তান আর্মিসহ মোট ১৪ জনকে আসামী করেন তখন মমতাজ বেগম স্বামী হত্যায় যাদের আসামী করেন সেই  আসামীর তালিকায়  আল্লামা সাঈদীর নাম নেই। এমনকি মামলার বিবরনে  আল্লামা সাঈদী বিষয়ে একটি শব্দও উল্লেখ নেই। সেই মামলার অভিযোগ তদন্ত করে চার্জশিট গঠন করা হয়েছিল। তাতেও আল্লামা সাঈদীর নাম ছিলনা। মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে চারজনের সাজা হয়েছিল। সেই মামলার সমস্ত ডকুমেন্ট ট্রাইব্যুনালে জমা দেয়া হয়েছিল আসামী পক্ষ থেকে। কিন্তু তার কোন কিছূ আমলে নেননি ট্রাইব্যুনাল। কেন?

ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ঘটনার যে বিবরন দেয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যা বলেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে  ১৯৭১ সালের আট মে মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু  মমতাজ বেগম তার মামলার বিবরনে উল্লেখ করেছেন- ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর তার বাবার বাড়ি (ইব্রাহীমের শ্বশুরবাড়ি) নলবুনিয়া গ্রামে থাকা অবস্থায়  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকজন তাকে  হত্যা করে। তার স্বামীকে হত্যার সময় স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে মমতাজ বেগমের   হাতেও গুলি লাগে। একই ঘটনায় মমতাজ বেগমের  ভাই শিহাব আলী  ওরফে সিরাজ এবং মা সিতারা বেগমকে পিরোজপুরে ধরে নিয়ে যায় আর্মি। পরে  পাকিস্তান আর্মি তার মা সিতারা বেগমকে ছেড়ে দিলেও ভাই শিহাব আলীকে পিরোজপুরে গুলি করে হত্যা করে।
রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করছে ইব্রুহীমকে পাড়েরহাট বাজারে ১৯৭১ সালের ৮ মে হত্যা করা হয়েছে। আর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম দাবি করেছেন তার স্বামীকে  নলবুনিয়ায় তার বাবার বাড়ি  থাকা অবস্থায় ১ অক্টোবার হত্যা করা হয়। কার কথা সত্য ? ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইব্রাহীমের স্ত্রী মমতাজ বেগম না  রাষ্ট্রপক্ষের?

সবচেয়ে বড় বিষয় হল মমতাজ বেগম এখনো জীবিত। কিন্তু তাকে রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি। কেন?

শুধু মমতাজ বেগম নয় ঘটনার শীকার এবং প্রত্যক্ষদর্শী মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম, মমতাজ বেগমের বোন রানী বেগম অন্যান্য ভাই এবং পরিবারের সদস্যরাও জীবিত। তাদের কাউকেই এ ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী হিসেবে হাজির করেনি রাষ্ট্রপক্ষ । কেন?

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ যাদেরকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করেছে তাদের কেউ কলা চোর, কেউ ট্রলার চোর, কেউ স্ত্রী হত্যা চেষ্টা মামলা, কেউ যৌতুক মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধের দায়ে সাজাভোগ করেছেন। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরায় আরো বের হয়ে এসেছে সাক্ষ্য দেয়ার বিনিময়ে তারা কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে  সনদ পেয়েছেন মামলা শুরুর পর।  কেউ কেউ  একটি বাড়ি একটি খামার   প্রকল্প, আশ্রয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন সরকারি অনুদান থেকে বরাদ্দ পেয়েছেন।  কারো ব্যাংক লোন মাফ হয়েছে। এসব সাক্ষী এসে বলেছে তারা দেখেছে  আল্লামা সাঈদীর নির্দেশে ইব্রাহীমকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়। তারা কেউ ইব্রাহীমের কোন আত্মীয় স্বজন বা নিকট প্রতিবেশীও না।  মানুষের মনে প্রশ্ন বিভিন্ন অপরাধে জেলখাটা, সাক্ষী হবার বিনিয়ে নানা সুযোগসুবিধা ভোগকারী এসব লোকের কথা সত্য হয়ে গেল; আর ইব্রাহীমের স্ত্রীর মামলার ডকুমেন্ট এর কোন মূল্য নেই?

এছাড়া আল্লামা সাঈদীর পক্ষেও চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন ইব্রাীহমকে নলবুনিয়ায় তার শ্বশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পরদিন তারা সকলেই মমতাজ বেগমের বাড়িতে সরাসরি হাজির হয়ে  ঘটনা বিষয়ে মমতাজ বেগমের পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্য লোকজনের কাছ থেকে জেনেছেন।  এ হত্যা ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে  কোনদিন তারা আল্লামা সাঈদীর নাম শোনেননি। তারা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন মাওলানা সাঈদী কোন মতেই ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার সাথে জড়িত নন। মানুষের মনে প্রশ্ন আল্লামা সাঈদীর পক্ষের এসব সাক্ষীদের সব কথা মিথ্যা আর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সব কথা সত্য হয়ে গেল?
তাদের মনে আরো প্রশ্ন আল্লামা সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীরা তাকে নির্দোষ দাবি করে যেসব কথা বলেছেন তার একটি কথাও কেন রায়ে উল্লেখ করা হলনা?


মমতাজ বেগমের মামলায় আসামী ছিল যারা:
ইব্রাহীম কুট্টির  স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে স্বামী এবং ভাই হত্যার বিচার চেয়ে পিরোজপুরে দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামী করেছিলেন পাকিস্তান আর্মি।
মমতাজ বেগম তার স্বামীর হত্যা মামলায় অন্য যাদের আসামী করেছেন তারা হলেন, দানেশ মোল্লা,  আতাহার আল, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী কালাম চৌধুরী, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা।  আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আসামীর তালিকায় আল্লামা সাঈদীর নাম নেই।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীরা যা বলেছিল :
ইব্রাহীম কুট্টির হত্যার বিবরন দিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টি তার শশুর বাড়ি নলবুনিয়ায় থাকা অবস্থায় আশ্বিন মাসের দিকে নিহত হন। ইব্রাহীম কুট্টির শশুরের নাম ছিল আজহার আলী। এখানে আসামী পক্ষের একজন সাক্ষীর বরাত দিয়ে ঘটনাটি উল্লেখ করা হল।
২০১২ সালের  নয় অক্টোবর ১১ তম সাক্ষী গোলাম মোস্তাফা মাওলানা সাঈদীপর পক্ষে  সাক্ষ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের (ইব্রাহীম কুট্টির শশুর)  বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই  উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন,  আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাহেব  আলী এবং তার মাকে  নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী  চকিদার, কালাম   চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে  গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টি  মেরে ফেলেছে। ইব্রাহীমের স্ত্রী মমতাজ বেগমও সেকথা জানায়।

এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি।  বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে (মমতাজ বেগমের ভাই এবং ইব্রাহীমের শ্যালক)  এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি  সাহেব আলীর মা সিতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। 
মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অন্য তিন সাক্ষীও ঘটনার প্রায়  একই বর্ননা দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী : সরাসরি ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা এবং মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা বর্ননা করে রাষ্ট্রপক্ষে যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা হলেন, মানিক পসারী,  মফিজ উদ্দিন, সুলতান হাওলাদার এবং মোস্তফা হাওলাদার। রায়ে এদেরসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট নয়জন সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার  অভিযোগ বিষয়ে।  নিহত ইব্রাহীম কুট্টি এবং মফিজ উদ্দিন মানিক পসারীর বাড়িতে কাজ করত। মফিজ উদ্দিন পসারীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন বলে উল্লেখ করেন। রায়ে মফিজউদ্দিনকে চাুস সাক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে তাকে অবিশ্বাস করা যায়না।

ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা যা বলেছেন :
২০১১ সালের  ২৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের  ষষ্ঠ সাক্ষী  মানিক পসারী তার জবানবন্দীতে বলেন,  ১৯৭১ সালে ৮ মে পাক সেনাবাহিনী নিয়ে দেলোয়ার শিকদার বর্তমানে সাঈদী, সেকেন্দার শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, রেজাকার  মবিন, হাকিম কারী, সোবহান মাওলানাসহ আরো অনেক রেজাকার আমার বাড়িতে   প্রবেশ করে। তাদের আসতে দেখে আমি বাড়ির  পাশে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকি এবং সব ঘটনা  দেখতে  থাকি। তারা আমার বাড়িতে প্রবেশ করে আমার ফুফাত ভাই মফিজ উদ্দিন (  বাড়িতে কাজ করত)  এবং অপর কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে আর্মিরা ধরে একই দড়িতে বাঁধে। তারপর  লুটপাট করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।  মফিজ ও ইব্রাহিম কুট্টিকে  বেঁধে পাড়েরহাট নিয়ে যাবার সময় আমি তাদের পেছনে পেছনে যেতে থাকি। তাকে পাড়েরহাট বাজারের মধ্যে  ব্রিজের ওপারে নিয়ে যায়।  আমি  এপারে বসে তাদের লক্ষ্য করি। দেলোয়ার  হোসেন শিকদারকে আর্মির সাথে পরামর্শ করতে দেখি। তারপর দেলোয়ার হোসেন শিকদার, সেকেন্দার শিকদারের সাথে পরামর্শক্রমে পাক আর্মিরা  ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে। ইব্রাহিম চিৎকার মারে। তারপর লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

২০১১ সালের ২১  ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্র্থ সাক্ষী সুলতান আহমদ হাওলাদার বলেন, মানিক পসারীর  বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দেখি দানেশ আলী মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন  শিকদার বর্তমান সাঈদী, মোসলেম মাওলানাসহ অনেক রাজাকার বাহিনী  মানিক পসারীর বাড়ির  কর্মচারী ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাজারের দিকে। আমি তাদের পিছু পিছু  যেতে থাকি। বাজারের ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম দিকে যাবার পর আমি এপার বসে  থাকি। উত্তর দিকে থানার ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাবার পর  দেলোয়ার হোসেন শিকদার বর্তমানে সাঈদী সাহেব পাক আর্মির সাথে কি যেন বলাবলি করছে দেখতে পাই। তখনই বিকট  গুলির শব্দ এবং চিৎকার শুনতে পাই।     এরপর   ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর পরের দিন শুনতে পাই মানিক পসারীর বাড়ির কাজের লোক ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছে।

একই বছর ২৯ ডিসেম্বর   সাক্ষ্য দেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী মফিজউদ্দিন পসারী। মফিজ মানিক পসারীর ফুফাত ভাই এবং সে  মানিক পসারীদের বাড়িতে  কাজ করত বলে দাবি করেছেন মানিক পসারী। ইব্রাহীম কুট্টির সাথে তাকেও ৮ মে পাড়েরহাট ধরে নিয়ে যায় মর্মে দুজন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন। তবে মফিজ উদ্দিন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
মফিজ উদ্দিন তার জবনাবনন্দীতে বলেন,  ১৯৭১ সালের ৮ মে সকালে   গরু মহিষ  নিয়ে চরে যাই। সাথে ইব্রাহিম কুট্টিও ছিল। কিন্তু  আনুমানিক ১০/১১টার দিকে  চরে বসে বসে মামার   বাড়িতে আগুন  এবং  ধোয়া দেখতে পাই। তারপর মামার বাড়ির দিকে ফিরে আসি।  এসময় দেখি ১২/১৪ জন পাক আর্মি, ২০/২২ জন রাজাকার মামার বাড়ি যাচ্ছে । তার মধ্যে দিলু  শিকদার ছিল। আমরা পালাতে চাইলে পাক আর্মি ধরে ফেলে। আমাদের দুজনকে এক দড়িতে  বাঁধে।  এরপর রাজাকাররা ঘরে ঢুকে  লুটপাট করে এবং কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।  আমাদের দুজনকে পারেরহট বাজারে নিয়ে যায়।   পুল থেকে নামিয়ে দিলু শিকদার (তাদের ভাষায় দিলু শিকদার মানে মাওলানা সাঈদী) সেকেন্দার শিকাদর উর্দুতে কি যেন বলল। আমি উর্দু বুঝিনা এবং কি বলেছিল তা  শুনতে পাইনি। এরপর ইব্রাহিমকে  দড়ি থেকে খুলে ছেড়ে দিল এবং আমাকে নিয়ে সামনের দিকে গেল। তারপর গুলির  শব্দ শুনতে পাই। ইব্রাহিম মা বলে চিৎকার করে। পেছনে তাকিয়ে দেখি ইব্রাহিমকে গুলি করছে। সেনাবানিহনী লাথি মেরে লাশ নদীতে ফেলে দিল।


২০১২ সালের  ১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন  মো: মোস্তফা হাওলাদার।  মোস্তফা হাওলাদার  জবানবন্দীতে বলেন, আমি ১৯৭১ সালে পারেরহাট বাজারে বুটমুড়ি ফেরি করে বিক্রি করতাম।  মে মাসের সাত তারিখ  শান্তি কমিটির দেলোয়ার  শিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা এরা  বাজারের উত্তর মাথায় রিক্সা স্ট্যান্ডের কাছে যায়। কিছুক্ষন পর ২৬টি  রিক্সায় ৫২ জন পাক আর্মি আসে।..... অর্মির অর্ডারে শুরু হয় লুটপাট। ....... আমরা খালের ওপারে বসে ধোয়া এবং আগুন দেখতে পাই নুরু খার ঘরের। আগুন আর ধোয়া দেখার পর দেখি  লুটপাট করে লোকজন রইজুদ্দীন কোম্পানীর বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রইজুদ্দীন সইজুদ্দীন পসারীর বাড়িতে (মানিক পসারীদের বাড়ি) দুজন লোক থাকত মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহীম কুট্টি নামে। তারা চরে গিয়েছিল গরু চড়াতে। তারা আগুন দেখে দৌড়ে আসে। এসময় দেলোয়ার শিকদার তাদের চাইপপা ধরে এবং মফিজ উবরাইয়া পরে যায়।  পাক আর্মি ধরে ইব্রাহিম কুট্টিকে। তাদের এক দাড়িতে বেঁধে পারেরহাট বাজারে নিয়ে যায়। তারপর মফিজকে পারেরহাট রাজাকার ক্যাম্পে আর ইব্রাহিমকে নেয়া হয় থানার ঘাটের দিকে। তারপর গুলির শব্দ শুনি। থানার ঘাটের কাছে ব্রিজের গোড়ায় ইব্রাহিম কুট্টিকে গুলি করে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেয়।

আসামী পক্ষের সাক্ষী : ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার ঘটনার সাথে মাওলানা সাঈদী জাড়িত নয় দাবি করে এবং এ ঘটনার বিবরন দিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মোট চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। এরা হলেন, গোলাম মোস্তফা, আব্দুর রাজ্জাক আকন,  জামাল ফকির এবং আব্দুস সালাম হাওলাদার।


মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষীরা যা বলেছেন :

২০১১ সালের ৯ অক্টোবর ১১ তম সাক্ষী গোলাম মোস্তাফার তার জবানবন্দীতে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১ অক্টোবর আমার গ্রাম নলবুনিয়ায় আজাহার আলী হাওলাদারের (ইব্রাহীম কুট্টির শশুর) বাড়িতে একটি ঘটনা ঘটে। ওইদিন ফজরের আজানের পূর্ব মুহূর্তে এক প্রচন্ড শব্দ শুনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠার পরেই মসজিদে আযান হলে মসজিদে নামায পড়তে যাই। নামাজের পরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হতে থাকে যে, আযানের পূর্বে কোথায় এই প্রচন্ড শব্দটি হলো। এই আলাপ আলোচনা করতে করতে আমরা মসজিদের সামান্য দূরে খালের পাড়ের রাস্তায় আসি। একটু পরেই দেখতে পাই  উত্তর দিক থেকে দানেশ আলী মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, সেকেন্দার শিকদার, রুহুল আমীন, মোমিন,  আজহার আলী হাওলাদারের ছেলে সাহেব  আলী এবং তার মাকে  নিয়ে পাড়েরহাটের দিকে যাচ্ছে। তার ৫/৭ মিনিট পরে নৌকায় করে আইউব আলী  চকিদার, কালাম   চকিদার, হামিক মুন্সি, আব্দুল মান্নান, আশরাফ আল মিলে আজহার আল হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টির লাশ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপর আমরা কায়েকজন আজহার হাওলাদারের বাড়ি যাই। সেখানে  গিয়ে বাড়িভর্তি মানুষ এবং ঘরে কান্নার রোল শুনতে পাই। লোকজন বলাবলি করতেছে আজহার হাওলাদারের জামাই ইব্রাহীম কুট্টিকে   মেরে ফেলেছে। ইব্রাহীমের স্ত্রী মমতাজ বেগমও সেকথা জানায়।

এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি।  বিকালের দিকে শুনি সাহেব আলীকে (মমতাজ বেগমের ভাই এবং ইব্রাহীমের শ্যালক)   এবং তার মাকে রাজাকাররা পিরোজপুরে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। পরের দিন শুনি  সাহেব আলীর মা সিতারা বেগম ফিরে এসেছে এবং সাহেব আলীকে পাকিস্তানী বাহিনী পিরোজপুরে গুলি করে মেরেছে। 

এছাড়া মাওলানা সাঈদীর পক্ষে দ্বিতীয় সাক্ষী আব্দুর রাজ্জাক আঁকনও গত ৫  অক্টোবার ইব্রাহীম কুট্টি  হত্যা বিষয়ে একই ধরনের জবানবন্দী প্রদান করেন।

ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিবরন তুলে ধরে ২০১১ সালের ২ অক্টোবর  মাওলানা সাঈদীর পক্ষে সপ্তম সাক্ষী হিসেবে  সাক্ষ্য  দেন পিরোজপুর নলবুনিয়ার জামাল হোসেন ফকির।
তিনি বলেন, আমার বাড়ি পিরোজপুর জেলার নলবুনিয়া গ্রামে অবস্থিত। আমি জমাজমি চাষাবাদ করি এবং মাঝে মধ্যে মাছ ধরি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি একই কাজ করতাম। আমাদের দেশে আশ্বিন মাসে খালে বিলে প্রচুর পানি থাকে।  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমি আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাত্রের প্রথম ভাগে বিলে বড়শি পেতে আসি। রাত্রের শেষ ভাগে আমি নৌকা নিয়ে বড়শি তুলে বাড়ির কাছাকাছি আসলে বিশাল একটা শব্দ শুনতে পাই। শব্দ শুনে আমি খেয়াল করি আমার পাশ লাগানো আজহার আলী হাওলাদারের বাড়িতে কান্নাকাটির শব্দ শোনা যায়। আমি ঘরে চলে আসি। আমার আব্বা বলেন, আজহার মামার বাড়ি বড় একটা শব্দ শোনা গেছে এবং কান্নাকাটিরও শব্দ শোনা যাচ্ছে । চলো গিয়ে দেখে আসি। আজহার আলীর বাড়ি গিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ আইয়ুব আলী চৌকিদার, কালাম চৌকিদার, হাকিম মুন্সি, মান্নান ও আশরাফ আলী খালের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তার পিছে দানেশ মোল্লা, সেকান্দার শিকদার, মোসলেম মওলানা, রুহুল আমিন, মোমিনরা মিলে সাহবে আলীকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে তার মাকেসহ পাড়েরহাটে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সামনে এগিয়ে দেখি ইব্রাহিম কুট্টির লাশ নৌকায় তুলে পাড়েরহাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি সাহেব আলীদের ঘরে চলে আসি। ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেছে এবং তার হাত দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়ছে। তার বোন রানী বেগম মমতাজের হাত বেঁধে দিচ্ছে । তখন আমি ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফুফু তোমার কি হয়েছে? তখন মমতাজ বেগম উত্তর দেয় যে গুলিতে ইব্রাহিম কুট্টি মারা গেছে সেই গুলি তার হাতেও লেগেছে, লাঠি দিয়ে তার আব্বার গায়েও আঘাত করেছে। ঐখানে তখন পাড়া প্রতিবেশী অনেক লোকজন জমায়েত হয়। আমরা বাড়িতে চলে যাই। বিকালে শুনতে পাই যে, সাহেব আলী ও তার আম্মাকে পিরোজপুরে নিয়ে গেছে। ইব্রাহিম কুট্টির লাশ পাড়েরহাট বাদুরা পোলের সাথে নৌকায় বেঁধে রেখেছে। তারপরদিন বেলা এগারোটার দিকে শুনতে পাই যে, সাহেব আলীর আম্মা বাড়িতে ফিরেছে। তারপর আমরা তাদের বাড়িতে যাই। জিজ্ঞাসা করি বুয়া (সাহেব আলীর আম্মা) আপনি এসেছেন, সাহেব আলী চাচা কৈ। তারপর সে বলে যে, পিরোজপুর নিয়া সাহেব আলীকে মিলিটারীরা গুলি  করে মারছে।  এর কিছুদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়।


রায়ে সাক্ষী পর্যালোচনায় তারতম্য :

 আট নং অভিযোগ (ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা)  বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৯ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের জবানবন্দীর সার সংক্ষেপ রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। অপর দিকে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা, মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়া বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে চারজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। মাওলান সাঈদী এ ঘটনার সাথে জড়িত নয় দাবি করে তারা যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা থেকে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।


পিরোজপুরে মানিক পসারীর মামলা এবং মফিজ প্রসঙ্গ :  মানিক পসারীর বাড়িতে আগুন দেয়া এবং ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যার ঘটনার বিষয়ে মানিক পসারী ২০০৯ সালে পিরোজপুরে একটি মামলা করেন। কিন্তু সেই মামলায় তিনি মফিজের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি। যদিও  মানিক পসারী, মফিজ এবং অন্য সাক্ষীরা  ট্রাইব্যুনালে এসে বলেছেন ইব্রাহীম কুট্টির সাথে মফিজকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন। মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, একসাথে দুইজন লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হল। তাদের একজন পালিয়ে এলেন। সে জীবিত। ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিলেন।  কিন্তু ওই ঘটনার এত বড় একজন  ভুক্তভোগী এবং যে কি-না মানিক পসারীর ফুফাত ভাই আবেং তাদের বাড়িতেই কাজ করত আর তার বিষয়ে মানিক পসারী পিরোজপুরের মামলায় কিছু বললেননা। এটা কি করে সম্ভব হতে পারে?   পরে মানিক পসারী মফিজের মামলায় পিরোজপর মেজিস্ট্রেট এর কাছে জবানবন্দীতে বলেছিলেন ইব্রাহীমের কি হয়েছে তা তিনি জানেননা। অথচ  তিনি ট্রাইব্যুনালে এসে বলেছেন তার সামনে ইব্রাহীমকে গুলি করে মারা হয়েছে। মিজানুল ইসলাম বলেন, মফিজ পিরোজপুরে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আমরা এখানে জমা দিয়েছে এবং প্রদর্শনও হয়েছে। কিন্তু  রায়ে এ বিষয়েও কিছু উল্লেখ নেই।


২. বিশাবালী হত্যার ঘটনা :

অপর যে   অভিযোগে আল্লামা সাঈদীকে  মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেটি হল বিশাবালী হত্যাকান্ড। এ অভিযোগ বিষয়ে  উল্লেখ করা হয়েছে   ১৯৭১ সালের ৬ জুন  সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে হিন্দুপাড়ায়  সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে তাদের বাড়ির সামনে  নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়। সাঈদীর নির্দেশে  একজন রাজাকার তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আল্লামা  সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে এ অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে এবং মাওলানা সাঈদীকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে।


এ ঘটনাওয় উত্তর মেলেনি যেসব প্রশ্নের :
নিহত বিশাবালীর ছোট ভাই’র নাম  সুখরঞ্জন বালী।  সুখরঞ্জন বালী বর্তমানে জীবিত এবং তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দিতে না এসে মাওলানা সাঈদীপর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন গত  পাঁচ নভেম্বর (২০১২)। সেদিন তাকে গোয়েন্দা পুলিশ অপহরন করে নিয়ে যায় ট্রাইব্যুালের গেট থেকে।

কয়েকটি সংবাদপত্র এবং একটি টেলিভিশন সুখরঞ্জন বালীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিল সে অপহরনের  আগের দিন। সাক্ষাৎকারে সুরখরঞ্জন বালী বলেছিলেন  তার ভাই বিশাবালীকে সাঈদী  সাহেব মারেনি।  পাকিস্তান আর্মি এবং দেশীয় রাজাকাররা তার ভাইকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে হত্যা করে। তিনি জানান  তার ভাই হত্যা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সত্য সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তিনি এসেছেন। রাষ্ট্রপক্ষ তাকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলাতে চেয়েছিল সেজন্য তিনি তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসেননি। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে এসে এসব কথা প্রকাশ করার আগেই তাকে অপহরন করে নিয়ে গেল পুলিশ। আজ পর্যন্ত তার কোন খোঁজ নেই।
তাকে কেন অপহরন করল গোয়েন্দা পুলিশ? ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবে সেজন্য?

ট্রাইব্যুালের  চার দিকে কয়েকডজন গোপন সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেখানে রেকর্ড হয়ে আছে কে বা কারা তাকে অপহরন করেছে। সাঈদীর আইনজীবীসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে তা দেখে কেন ঘটনা ফাঁস করার নির্দেশ দিলনা ট্রাইব্যুনাল? জনগনের প্রশ্ন আপন ভাই হত্যা বিষয়ে এতড় একজন সাক্ষী  ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরও তার কোন হদিস না নিয়ে কিভাবে তার ভাই হত্যার সাথে  আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যায় অন্য সাক্ষীদের কথার ওপর ভিত্তি করে?

৫ নভেম্বর অপহরনের আগে সুখরঞ্জন বালীর গ্রহণ করা সাক্ষাৎকার  দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ৬ নভেম্বর। আমার দেশ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে সুখরঞ্জন বালী বলেছিলেন “সাঈদী সাইব মোর ভাই বিশাবালীরে খুন করে নাই এডা ডাহা মিথ্যা কতা। মুই মোর ভাইর মরন লইয়া এই রহমের মিত্যা কতা কইতে পারমুনা।”
তিনি বলেছিলেন, মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার আমাকে  বলতে বলে সাঈদী সাহেব ছিল এই কথা বলবা। আমাকে দিয়া তারা মিথ্যা কথা বলানোর জন্য চেষ্টা করছে । তাতে রাজি না হওয়ায় আমারে তারা আনেনাই। আমিও   হেদিকে  যাই নাই ।

সুখরঞ্জন বালী বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার সাথে সাঈদী সাহেব কোন ভাবেই জড়িত ছিলেন না। এতটি বছরে আমার ভাইয়ের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে মাওলানা সাঈদী জড়িত ছিলেন বলে আমরা শুনতে পাইনি।

সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রী যা বললেন : নিখোজ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালীর স্ত্রীর নাম  রীতা। রীতা বলেন, আমার শ্বাশুড়ী আমাকে বলেছেন  ঘটনার সময়  বিশাবালী অসুস্থ ছিলেন। তাকে গুলি করে মারা হয়নি। তাকে বন্দুক দিয়ে  পাক বাহিনী বুকে তিনটি ঘা মারে।  এর তিনঘন্টা পর তিনি মারা যান। গুলি করার কথা সত্য নয়। সেখানে সেসময় কারা ছিল তাদের তিনি দেখেনওনি চেনেনওনি।
আরো মজার ঘটনা হল রাষ্ট্রপক্ষের যেসব সাক্ষী  বলেছেন  আল্লামা সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালীকে হত্যা করা হয় তারা কেউ জেরায় বলতে পারেননি বিশাবালীর কবর এখন কোথায়। তারা কেউ বলতে পারেননি কোন রাজাকার বিশবালীকে গুলি করেছিল। আল্লামা সাঈদী গুলি করতে নির্দেশ দিল এবং তাকে তারা চিনল তখন কিন্তু কে   গুলি করে মারল তা  কেউই চিনলনা?


একজন বিচারকও মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেননা:
তিনজন বিচারক নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল-১ আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।  কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এই তিনজন বিচারকের একজনও  আল্লামা সাঈদীর মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেউ জড়িত ছিলেন। কেউ পুরো মামলার সাক্ষ্য প্রমান  শুনতে বা দেখতে  পারেননি। অথচ তারাই একজন মানুষকে মুত্যৃদণ্ড দিয়ে দিলেন। গোটা বিশ্বের আইনজ্ঞদের কাছে এটা বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ সাক্ষী যখন কোর্টে এসে সাক্ষ্য দেয় এবং তার জেরা  হয় তখন তার চেহারা সুরত এবং কথা বলার ধরন থেকেই বিচারক অনেক কিছু বুঝে যান যে, সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে। কিন্তু তাদের বক্তব্য সরাসরি না  শুনে এবং না দেখে  লিখিত জবানবন্দী এবং জেরা পড়ে সঠিকভাবে অনেক কিছু বোঝা যায়না বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। 

যে তিনজন বিচারক মিলে আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন  তাদের একজন হলেন চেয়ারম্যান এটিএম ফজলে কবির। তিনি  ২০১০ সালের মার্চ মাসে ট্রাইব্যুনাল গঠনের  শুরু থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ছিলেন। ২০১২ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় তাকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে বদলী করা হয়। এরপর স্কাইপ কেলেঙ্কারির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর   ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করার পর দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল থেকে এটিএম ফজলে কবিরকে আবার আনা হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ। তাকে ট্রাইব্যুনাল -১ এর চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি যখন ট্রাইব্যুনাল -১ এ আসলেন তখন আল্লামা সাঈদীর বিচার কার্যক্রম শেষ এবং যেকোন দিন রায় ঘোষনা করা হবে বলে রায়ের তারিখ উহ্য অবস্থায় ছিল।  ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।  দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে বদলি হবার আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপক্ষের অধিকাংশ সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ দেখেছেন কিন্তু আসামী পক্ষের কোন সাক্ষ্য গ্রহণ তিনি দেখেননি। তিনি ট্রাইব্যুনাল-১  চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করার পর আসামী পক্ষ পুরো মামলার কার্যক্রম নতুন করে শুরুর আবেদন করে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেন, আমি আমার কলিগদের কাছ থেকে শুনে নেব এবং পড়ে নেব। এরপর তিনি শুধুমাত্র যুক্তি উপস্থাপন পুনরায় শুরুর নির্দেশ দেন।

ট্রাইব্যুনালের আরেকজন বিচারক হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনিও মামলার শুরু থেকে ছিলেননা। ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট বিচারক একেএম জহির আহমেদকে সরকার জোর করে সরিয়ে  দেয়ার পর তাকে তার স্থলে নিয়োগ দেন।
আরেক বিচারক হলেন আনোয়ারুল হক । তিনিও শুরু থেকে ছিলেননা। ২০১২ সালের মার্চ মাসে এটিএম ফজলে কবিরকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ বদলী করার পর তার স্থলে তাকে তখন নিয়োগ দেয়া হয়।
সুতরাং কেউই পুরো মামলার কার্যক্রম সরাসরি না দেখে এবং না শুনে একজনকে মৃত্যুদন্ডের রায় দিলেন যা গোটা বিশ্বের কাছে বিস্ময়কর।  লন্ডনের বিশ্বখ্যাত সামিয়কীসহ অনেক প্রভাবশালী মিডিয়ায় এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে।


উত্তর মেলেনি আরো অনেক প্রশ্নের :

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশীয় দৃস্কৃতকারী, পাকিস্তানন আর্মির সহযোগী, রাজাকার, পিস কমিটির লোকজনের বিচারের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দালাল আইন প্রনয়ন করা  হয়। লক্ষ লক্ষ লোককে দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয়। ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। পিরোজপুরেও শত শত রাজাকার এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু আল্লামা সাঈদীর বিরুদ্ধে তখন কেউ একটি মামলাও করলনা কেউ?
রাষ্ট্রপক্ষের দাবি মতে সাঈদীই তখন পিরোজপুরের স্বাধীনতা বিরোধী সমস্ত কর্মকান্ডের হোতা ছিলেন। তার নির্দেশে এবং অঙ্গুলি হেলনে  পিরোজপুরে পাকিস্তান আর্মি চলত, সমস্ত অপারেশ চালাত।  পাড়েরহাটে পাকিস্তান আর্মি আসার পর তিনি তাদের অভ্যর্থনা জানান। ক্যাপ্টেন এজাজের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে তিনি উর্দু ভাল জানার কারনে। আল্লামা সাঈদীর নির্দেশেই পাড়েরহাটে রাজার এবং পিস কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এসবের তাত্ত্বিক নেতা।  পাড়েরহাটের আশপাশের সমস্ত লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন আল্লামা সাঈদী। এতবড় মাপের একজন স্বাধীনতা বিরোধী, জঘন্য অপরাধী, সকল কুকর্মের  চিহ্নিত হোতাকে সবারই চেনার কথা। কিন্তিু স্বাধীনতার পর   কেউ তার বিরুদ্ধে একটি জিড়িও কেউ  কেন  করলনা?

সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের পর পিরোজপুরে যেসব বড় বড় রাজাকার, লুটপাটকারী, ধর্ষণকারী এবং বিভিন্ন অপরাধের হোতা ছিল তাদেরকে নৌকা ভরে ভরে সুন্দরবন নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাঈদী সেরকম কিছু  হলে তার এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়। এছাড়া পিরোজপুরেও সাধারন মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের রোষে পড়ে, গণপিটুনিতে অনেক রাজাকার, লুটপাটকারী ধর্ষণকারী নিহত হয়েছে। জনগনের প্রশ্ন সাঈদীর মত এতবড় অপরাধী কিভাবে পার পেল? এতবড় অপরাধী কিছুদিন পালিয়ে থেকে আবার আত্মপ্রকাশ করল এবং সবাই সব কিছু ভুলে গিয়ে তাকে  ফুল দিয়ে বরন করে নিল এবং হিন্দুরাসহ সবাই তাকে ভোট দিয়ে দুই বার এমপি বানাল? এসব প্রশ্নের উত্তর কি?

মেজর জিয়াউদ্দিন, হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজসহ অনেকে পিরোজপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ঘটনাবলী নিয়ে অনেক বই রচনা করেছেন, গবেষনা করেছেন।  আল্লামা সাঈদী এতবড় অপরাধী  আর তার কোন বিববরন তো দূরের কথা নামটি পর্যন্ত নেই কোন তাদের বইয়ে? কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত  প্রমান্য দলিল স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রে  পিরোজপুর অধ্যায়ে নেই কেন সাঈদীর নাম?

মেজর জিয়াউদ্দিন কেন সাক্ষ্য দিতে আসলেননা যখন তিনি প্রায়ই ঢাকায় বসে টিভিতে টকশো করেন? সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি হুমায়ুন আহমেদের পিতাকে হত্যা করেছেন। কিন্তু তার ছেলে হুমায়ুন আহমেদ তখনো জীবিত ছিলেন। এখনো জীবিত  আছেন অন্য ছেলে জাফর ইকবাল, আহসান হাবিব, বোন সুফিয়া হায়দার এবং হুমায়ুন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ। তারা কেউ কেন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে না এসে টিভি টকশোতে/ শাহবাগে বলে বেড়িয়েছে  সাঈদী তার পিতাকে হত্যা করেছে? হুমায়ুন আহমেদের বড় দুলাভাই আলী হায়দার সাহেব হাইকোর্টে প্রাকটিস করেন। তার বাড়ি পিরোজপুর।  তিনিই বা কেন আসলেননা তার শ্বশুরের হত্যা বিষয়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে?


সাঈদী এবং শিকদার প্রসঙ্গ :
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারে একটি আলোচিত বিষয় হল ‘সাঈদী’ এবং ‘শিকদার’  নামের প্রসঙ্গ।  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বাধীনতার পূর্বে তার নাম ছিল দেলোয়ার   শিকদার বা দেলোয়ার হোসেন।  স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে পরবর্তীতে আশির দশকে  তিনি নামের শেষে  শিকদার শব্দ বাদ দিয়ে ‘সাঈদী’ যোগ করে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।  এরপর থেকে তিনি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামে পরিচিতি লাভ করেন।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের  বেশ কয়েকজন  সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং চার্জশিটেও  বিষয়টি উল্লেখ  আছে।  ট্রাইব্যুনালও রায়ে বলেছেন  আমরা ৪০ বছর আগের দেলোয়ার হোসেন নামে এক যুবকের বিচার করছি। বর্তমান সাঈদীর নয়। তখন তাকে দেলু নামে লোকজন  ডাকত। পিরোজপুরে পরিচালিত সবগুলো অপারেশনের সাথে সে জড়িত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ সাঈদীকে দেলোয়ার শিকদার বলে আখ্যায়িত করলেও সে বিষয়ে কোন প্রমান দিয়েছে মর্মে রায়ে কোন কিছু নেই।

জনমনে এ নিয়ে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাহল রাষ্ট্রপক্ষ  দেলোয়ার শিকদার নামে একজনকে বিচারের নামে হাজির করেছে যিনি বর্তমানে সাঈদী নাম ধারন করেছে এবং সাঈদী নামে পরিচিতি। অপর দিকে আসামী পক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষেরও  সমস্ত ডকুমেন্ট থেকে দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ দেলোয়ার শিকদার বলে যাকে দাবি করেছে সে এবং বর্তমান সাঈদী এক ব্যক্তি নয়। দেলোয়ার শিকদার নামে  কুখ্যাত একজন রাজাকার ছিল । তার পিতার নাম রসুল শিকদার।  তাকে স্বাধীনতার পর ুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করে তার অপকর্মের কারনে। অপর দিকে আল্লামা সাঈদীর নাম জন্মের পর থেকেই সাঈদী এবং তার পিতার নাম ইউসুফ সাঈদী।   কিন্তু এ বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে রায়ে বর্তমান সাঈদীকে দেলু আখ্যায়িত করার বিষয়ে সাধারন মানুষ  কোন কিছু মেলাতে পারছেনা। তাদের প্রশ্ন নিহত দেলোয়ার শিকদারের অপরাধ আল্লামা সাঈদীর ওপর চাপিয়ে কি তাকে সাজা দেয়া হল?


দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য:

মুক্তিযোদ্ধা  সংসদ পিরোজপুর জেলা কমান্ড কাউন্সিলের  প্রস্তুতকৃত পিরোজপুরের  রাজাকারদের  তালিকায় রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের নাম রয়েছে । সেখানে দেলোয়ার শিকদারের পিতার নাম রসুল শিকদার  উল্লেখ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের  আইনজীবীরা মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের যে ডকুমেন্ট সরবরাহ করেছেন  তার ভলিউম-৩, পৃষ্ঠা ২১৩ তেও রাজাকার তালিকায় দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদারের নাম উল্লেখ আছে।
পিরোজপুর এবং পাড়েরহাটের প্রবীণ স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে রাজাকার দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে স্থানীয় লোকজন  ‘দেউল্লা’ ‘দেইল্লা’  বা দেলু রাজাকার নামে চেনেন। তবে দেউল্লা রাজাকার নামে বেশি  পরিচিত সে। তার পিতার নাম  রসুল শিকদার (মৃত)।  তাদের বাড়ি পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে চিলাগ্রামের শিকদার বাড়ি। ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধের  সময় নাজিরপুর থেকে পারেরহাট পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব ছিল রাজাকার দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেউল্লার। তবে পাড়েরহাট বন্দরেই সে  অত্যাচার নির্যাতন বেশি পরিচালনা করে।

স্থানীয় সূত্র জানায় পাক আর্মিদের  ক্যাম্পে মেয়েদের তুলে দেয়া, হিন্দুদের ধরিয়ে দেয়া, হিন্দু  সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি দোকানপাট দেখিয়ে দেয়া,  হিন্দু পাড়ায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যেসব অভিযোগ রয়েছে তার  অনেক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এই দেলোয়ার  শিকদার ওরফে দেউল্লা রাজাকার। অনেক হিন্দুদের বাড়িতে রাজাকার এবং  পাক আর্মি নিয়ে যাবার  বিষয়ে সে নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়     তার ব্যক্তিগত অনেক অপকর্ম যা ভুক্তভোগী এবং স্থানীয়রা জানত কিন্তু তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। অনেকে মুখবুজে সহ্য করেছে কোথাও প্রকাশও করেনি মান  সম্মানের কারনে।

পিরোজপুর পাড়েরহাট, উমেদপুর, মাছিমপুর, শঙ্করপাশা প্রভৃতি এলাকায় হিন্দু পাড়া জ্বালিয়ে দেয়া, লুটাপাট, হিন্দুদের হত্যা  বিষয়ে  রাজাকার দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার, রাজ্জাক রাজাকার, মবিন রাজাকার, মোসলেম মাওলানা, দানেশ মোল্লা, সেকেন্দার শিকদার  সরাসরি জড়িত বলে স্থানীয় প্রবীনদের কাছে তথ্য পাওয়া গেছে।

মাছিমপুরে ১৩  জন হিন্দুকে হত্যা, উমেদপুরে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, জহর তালুকদার, হরেন ঠাকুর, অনিল মন্ডল, সতিষ বালাদের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় দেলোয়ার, রাজ্জাক এবং  মবিন রাজাকারের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ করেছে  স্থানীয় লোকজন। পারেরহাট বাজারে হিন্দু  পাড়ায় হরলাল মালাকার, অরুন কুমার, তরনী কান্ত, নন্দ কুমারসহ মোট ১৩ জন হিন্দুকে এক  দড়িতে বেঁেধ নিয়ে পাক আর্মিদের হাতে তুলে দেয়া এবং হত্যার ঘটনার সাথেও  রাজাকার দেলোয়ার শিকদারের  জড়িত থাকা বিষয়ে জানিয়ছেন এলাকাবাসী।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার এসব অপকর্মের  বিষয়ে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের  কাছে অভিযোগ করেন। । রাজাকার দেলোয়ার শিকদার  পালিয়ে যাবার সময় কদমতলায় সে ধরা পড়ে  এবং মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলীর গুলিতে সে নিহত হয় বলে জানিয়েছে সূত্র ।

পিরোজপুর এবং পাড়েরহাটের প্রবীণ স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপ করে রাজাকার দেলোয়ার শিকদার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। রাজাকার দেলোয়ার শিকদারকে স্থানীয় লোকজন  ‘দেউল্লা’ ‘দেইল্লা’  বা দেলু রাজাকার নামে চেনেন। তবে দেউল্লা রাজাকার নামে বেশি  পরিচিত সে। তার পিতার নাম  রসুল শিকদার (মৃত)।  তাদের বাড়ি পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে চিলাগ্রামের শিকদার বাড়ি। ১৯৭১ সালে  মুক্তিযুদ্ধের  সময় নাজিরপুর থেকে পারেরহাট পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব ছিল রাজাকার দেলোয়ার শিকদার ওরফে দেউল্লার। তবে পাড়েরহাট বন্দরেই সে  অত্যাচার নির্যাতন বেশি পরিচালনা করে। তার অন্যান্য ভাইয়েরা হলেন এনায়েত শিকদার (পিরোজপুর শহরে চালের দোকানদার), বেলায়েত শিকদার, মতি শিকদার, চান শিকদার, ফুলু শিকদার (মৃত) এবং লাল মিয়া (মৃত) ।

স্থানীয় সূত্র জানায় পাক আর্মিদের  ক্যাম্পে মেয়েদের তুলে দেয়া, হিন্দুদের ধরিয়ে দেয়া, হিন্দু  সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি দোকানপাট দেখিয়ে দেয়া,  হিন্দু পাড়ায় হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের যেসব অভিযোগ রয়েছে তার  অনেক ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল এই দেলোয়ার  শিকদার ওরফে দেউল্লা রাজাকার। ।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তার এসব অপকর্মের  বিষয়ে এলাকাবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের  কাছে অভিযোগ করেন। । রাজাকার দেলোয়ার শিকদার  পালিয়ে যাবার সময় কদমতলায় সে ধরা পড়ে  এবং মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আলীর গুলিতে সে নিহত হয় বলে জানিয়েছে সূত্র ।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে  গত ১ ফেব্রুয়ারি   আদালতে সাক্ষ্য দেন  ৮১ বছর বয়স্ক আলোচিত সাক্ষী  মধুসূদন ঘরামী।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে   প্রবীন সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী দেলোয়ার শিকদার, পিতা রসুল শিকদার নামে পিরোজপুরে   একজন রাজাকার থাকার কথা স্বীকার করেছেন সাক্ষী  মধুসূদন ঘরামী। সে গনরোষে পিরোজপুর নিহত হয়ে থাকতে পারে বলেও স্বীকার করেছেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের জেরার সময়।

জন্ম থেকেই তিনি সাঈদী :
সাঈদী  শব্দটি নামের সাথে  পূর্বে ছিল না পরবর্তীতে যোগ করা হয়েছে এ বিষয়ে অনুসন্ধানে  জানা গেছে  ‘দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’ এটি তার জন্মগত নাম। জন্মের পর এ নাম রাখা হয়  এবং  ডকুমেন্টারি যেসব স্থানে তার নাম লিখতে হয়েছে তার সকল স্থানে  নামের শেষে সাঈদী শব্দটি পাওয়া গেছে। তার পিতার নামের শেষেও সাঈদী শব্দ যুক্ত রয়েছে। মাওলানা সাঈদীর ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদ, ১৯৬০ সালের  আলিম সনদ, ১৯৬৪ সালের ওয়াজ মাহফিলের লিফলেট এবং   পাসপোর্টে তার নামের   শেষে সাঈদী পাওয়া গেছে। স্বাধীনতার পূর্ব এবং পরে  বিভিন্ন সময় ওয়াজ মাহফিল নিয়ে পত্রপত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতেও ‘মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’ লেখা  হয়েছে। 

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৫৭ সালে দাখিল পাশ করেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীতে অবস্থিত ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলীয়া মাদ্রাসা (শর্ষিণ  নামে পরিচিত) )  থেকে।  ১৯৫৭ সালের দাখিল সনদে তার নাম লেখা রয়েছে “দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী, পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী”।

১৯৬৪ সালে (বাংলা ১৩৬৯, ১৪ ফালগুন) যশোরের কেশবপুর থানার ফতেহপুর গ্রামে ফতেহপুর মসজিদ প্রাঙ্গনে একটি আজিমুশ্ শান জলসার আয়োজন করা হয়। সে জলসা উপলক্ষে তখন লিফলেট প্রচার করা হয় এলাকায়। যশোর  আল আমিন আর্ট প্রেস কর্তৃক  ছাপাকৃত সেই লিফলেটের একটি কপি  পাওয়া গেছে।  লিফলেটে  ওয়াজ মাহফিলে দুজন বক্তার পরিচিতি তুলে ধরা হয়।  একজন হলেন মাওলানা মো: নুরুল ইসলাম ফারুকী এবং অপরজন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। লিফলেটে  “মাওলানা মো: দেলওয়ার হোসেন সাইদী” এভাবে নামটি  লেখা আছে। অর্থাৎ সেখানেও নামের সাথে সাঈদী শব্দটি ছিল।
ফতেহপুর মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে  প্রচার করা হয় এ লিফলেট।

আরামানিটোলায় ১৯৭৩ সালের ওয়াজ মাহফিল, মতিঝিল কলোনী মাঠে ১৯৭৪ সালের ওয়াজ মাহফিল এর খবর তখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে মাওলানা সাঈদী ওয়াজ  পেশ করেন এবং তার নামের শেষে সাঈদী লেখা আছে।

কাজেই আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন স্বাধীনতার  পর দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকে শিকদার নাম বাদ দিয়ে সাঈদী নাম ধারন করে ভুয়া মাওলানা হিসেবে আত্মপ্রকাশের যে দাবি রাষ্ট্রপক্ষ করেছে এবং রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছে তা মিথ্যা প্রমান করতে সাক্ষম হয়েছে বলে  দাবি আসামী পক্ষের আইনজীবীদের। আসামী পক্ষ থেকে সমস্ত প্রমান হাজির করে প্রমান করা হয়েছে যে, দেলোযার শিকদার নামে আরেকজন লোক ছিল। তার পিতার নাম ছিল রুসল শিকদার।  বর্তমান সাঈদী এবং সেই দেলোয়ার শিকদার এক ব্যক্তি নয়। কিন্তু তারপরও  ট্রাইব্যুনাল রায়ের সময় বললেন আমরা ৪০ বছর আগের দেলোয়ার হোসেন নামে এক যুবকের বিচার করছি। বর্তমান সাঈদীর নয়। তখন তাকে দেলু নামে লোকজন  ডাকত। পিরোজপুরে পরিচালিত সবগুলো অপারেশনের সাথে সে জড়িত ছিল।

সাক্ষী সাবুদনামা :
রাষ্ট্রপক্ষ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০ জন ঘটনার সাক্ষী হাজির করে।  তার মধ্যে পাঁচজনের  বিরুদ্ধে জেল খাটার তথ্য বের হয়ে আসে জেরায়। চারজনের  বিরুদ্ধে  চুরির মামলা হয়েছিল এবং অপরাধ  প্রমান শেষে কারো কারো সাজাও হয়েছে।  অপর আরো এক সাক্ষীর বিরুদ্ধে জেল খাটার অভিযোগ করেন মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা।  কজন হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় সাত মাস সাজাভোগ করেন।
তিনজন সাক্ষী আদালতে স্বীকার করেছেন তারা  মুক্তিযোদ্ধা নন। কিন্তু মামলা শুরু হবার  পর তাদেরকে   মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত  করার জন্য স্থানীয় এমপি এম এ আউয়াল তাদের ডিও লেটার দিয়েছেন ।
কয়েকজন স্বীকার করেছেন তারা মামলা শুরুর পর  সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা গ্রহণ করেছেন। 

মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার চুরির মামলায় জেল খেটেছেন।  এছাড়া স্ত্রীর যৌতুক মামলায় তার সাজা বহাল রয়েছে  এবং বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য  হলেন সুন্দরবন সাবসেক্টর কমান্ডর মেজর (অব) জিয়াউদ্দিনের সেকেন্ড ইন কমান্ড শামসুল আলম তালুকদার।
জনমনে প্রশ্ন আল্লামা সাঈদীর পক্ষে ১৭ জন সাক্ষীর একটি কথাও সত্য নয় আর রাষ্ট্রপক্ষের সব সাক্ষী  যাদের অনেকে চুরির অপরাধে জেল খেটেছে, সাক্ষী হবার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটসহ রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগসুবিধা পেয়েছে তাদের  কথা সত্য?


ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর সাড়াজাগানো   বক্তব্য
২০১২ সালে ৬ ডিসেম্বর রায়ের তারিখ ঘোষনার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নিয়ে মাত্র আড়াই থেকে তিন মিনিট  আবেগময়ী এবং মর্মস্পর্শী   বক্তব্য রাখেন।    নিজেকে বিশ্বাসের চূড়ান্ত এবং শেষ স্তরে সপে দিয়ে মাওলানা সাঈদী  অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারন করেন  আমার বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার একটিও যদি সত্য হয় তাহলে আমি যেন ঈমান নিয়ে মরতে না পারি । রোজ কিয়াকমতের দিন যেন রসুল (সা) এর শাফায়াত  আমি না পাই। আর যারা আমার বিরুদ্ধে  মিথ্যা অভিযোগ  এনেছে  তারা যদি তওবা না করে এবং তওবা যদি তাদের নসিব না হয় তাহলে  গত দুইটি বছর  আমি এবং আমার সন্তানরা যে যন্ত্রনা ভোগ করেছি, আমার যে পরিমান  চোখের পানি ঝরেছে, আমার সন্তানদের যে চোখের  পানি ঝরেছে, তার  প্রতিটি ফোটা অভিশাপের বহ্নিশিখা হয়ে  আমার থেকে শতগুন যন্ত্রনা এবং কষ্ট ভোগের আগে যেন তাদের মৃত্যু না হয়। আর জাহান্নাম হয় যেন তাদের চির ঠিকানা।

মাওলানা সাঈদী বলেন, যদি আমার প্রতি  জুলুম করা হয় করা  হয় তাহলে এ বিচারের দুইটি পর্ব হবে। আজ এখানে একটি পর্ব শেষ হবে। আর কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে আরেকটি বিচার বসবে। সেই বিচারে আমি হব বাদী। আর আমার বিরুদ্ধে যারা জুলুম করেছে তারা হবে আসামী।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ২৯ জানুয়ারি রায়ের তারিখ  বিষয়ে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।  রায়ের তারিখ বিষয়ে আদেশ ঘোষনার আগ  মুহুর্তে কাঠগড়ায় অপেক্ষমান মাওলানা সাঈদী দাড়িয়ে বলেন, আমি হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে দাড়াতে প্রস্তুত আছি। আমি মৃত্যুকে পরোয়া করিনা। মৃত্যু নিয়ে কোন ভয়ভীতি আমার নেই। আমি আমার যৌবন কাল থেকে শুরু করে  আজ ৭৩ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষকে পবিত্র কোরআনের দাওয়াত দিয়েছি।   কোরআনের একজন খাদেম হিসেবে গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোরআনের দাওয়াত পৌছে দিয়েছি।  লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার মাহফিলে যোগ দেয়। অসংখ্য মানুষ এসব মাহফিল থেকে সঠিক পথের দিশা পেয়েছে।  দেশ বিদেশের লক্ষ কোটি মানুষ আমাকে  ভালবাসেন। আমি সাঈদী লক্ষ কোটি মানুষের চোখের পানি মিশ্রিত দোয়া ও ভালবাসায় সিক্ত।  এটাই কি আমার অপরাধ? আমি  কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। এটাই কি আমার অপরাধ? এটা যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে এ অপরাধে অপরাধী হয়ে হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে আমি রাজি আছি।
আজ আমি আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে আপনাদের সামনে বলতে চাই, সরকার ও তার রাষ্ট্র যন্ত্র কর্তৃক চিত্রিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের হত্যাকারী, লুন্ঠন, গণ হত্যাকারী, ধর্ষক, অগ্নি সংযোগকারী, দেলোয়ার শিকদার বা ‘দেলু’ বা দেইল্যা রাজাকার আমি নই। আমি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় জন্মভূমি এই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের নিকট চিরচেনা পবিত্র কোরআনের একজন তাফসীরকারক, কোরআনের  একজন খাদেম, কোরআনের পথে মানুষকে আহ্বানকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
তিনি বলেন,  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ৪২ বছরের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোন বিষয়েই কোন মামলা ছিলো না। সামান্য একটি জিডিও ছিলো না। গণতন্ত্রের লেবাসধারী বর্তমান এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের বদান্যতায়, মহানুভবতায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আজ আমি ১৭টি মামলার আসামী। সেই জুন ২০১০ থেকে অদ্যাবধি কথিত মানবতাবিরোধী ২০ টি অপরাধের অভিযোগসহ ১৭টি মামলা আমার বিরুদ্ধে দায়ের করে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে সরকার আমাকে তাদের এক রাজনৈতিক তামাশার পাত্রে পরিনত করেছে, যা আজ দেশবাসীর কাছে মেঘমুক্ত আকাশে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতই স্পষ্ট।
যে ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আজ আপনাদের সম্মুখে আমি দন্ডায়মান, সেগুলো সরকারের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই সাজানো। ১৯৭১ সনে পিরোজপুর বা পাড়েরহাটে পাক বাহিনী যা ঘটিয়েছে, সেসব কাহিনী সৃজন করে চরম মিথ্যাবাদী ও প্রতারক এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তার সহযোগীরা নীতি নৈতিকতার মূলে পদাঘাত করে আমার নামটি জুড়ে দিয়েছেন। 


মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ :

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগে বিচার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর জেলার পাড়েরহাট বন্দর এলাকায়   রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠনে নেতৃত্ব প্রদান, পাড়েরহাট ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনেকে হত্যা, নির্যাতনে  নেতৃত্ব প্রদান এবং এসবে অংশগ্রহণ।  পাকিস্তান আর্মি, রাজাকার এবং  শান্তি কমিটির লোকজন নিয়ে পাড়েরহাট বাজারে  হিন্দু  সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের  দোকানপাট লুটপাট, বাড়িঘরে  অগ্নিসংযোগ ।  এসব বাড়িঘর  দোকানপাট লুটপাটে নেতৃত্বদান এবং সরাসরি  অংশগ্রহনের অভিযোগ।  ভানুসাহাসহ বিভিন্ন মেয়েদের  ধর্ষন  এবং ধর্ষনের উদ্দেশে গ্রামের  অনেক নারীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  ক্যাম্পে  তুলে দেয়ার অভিযোগ।  হত্যা, গণহত্যা,  মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে নিজে জড়িত থাকাসহ এসবে নেতৃত্ব প্রদান, পরিচালনা  এবং পাকিস্তান আর্মিকে এসব অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করার অভিযোগ।
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জশিটে ৩২টি অভিযোগ জমা দেয়া হয় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে। এখান থেকে ২০টি অভিযোগ নিয়ে  তার বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। এ ২০টি অভিযোগ হল

১.    ১৯৭১ সালের ৪ মে মাওলানা সাঈদীর  নেতৃত্বের লোকজন পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে পিরোজপুর মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে যায়। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে লোকজন জড়ো করে ২০ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
২.    একই তারিখে  মাওলানা সাঈদী ও তার দল পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় যায়। সেখানে হিন্দুদের বাড়িঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়।   এসময় পলায়নপর লোকজনের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে ১৩ জন মারা যায়।
৩.    একই দিন সাঈদী নিজে মাসিমপুর মনীন্দ্রনাথ ও সুরেশ চন্দ্র মন্ডলের বাড়ি লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় আশপাশের আরো অনেক বাড়িতে আগুন ধরানো হয়।
৪.    একই দিন সাঈদী তার রাজাকার বাহিনী  পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে  ধোপাবাড়ি  সামনে এবং এলজিইডি ভবনের পেছনের হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলে। এসময়  তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে দেবেন্দ্রনাথ  মন্ডল, পলিন বিহারী, জগেন্দ্র  মন্ডল, মুকুন্দ বালা মারা যায়।
৫.    পরের দিন  ৫ মে সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিয়ে পিরোজপুর হাসপাতালে যায়। সেখান থেকে তারা সাইফ মিজানুর রহমানকে ধরে  বলেশ্বর নদীর তীরে  নিয়ে যায়। সাইফ মিজানুর রহমান ছিলেন  সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতা। একই দিন লেখক হুমায়ুন আহমেদের পিতা পিরোজপুরের সাবডিভিশন পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) ফয়জুর রহমান এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে কর্মস্থল থেকে ধরে নিয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন সরকারী কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
৬.    দুই দিন পর ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাড়েরহাট বাজারে হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরববাড়ি  দেখিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে। এরপর সেসব প্রতিষ্ঠানে নির্বিচানের লুটপাট চালানো হয়। পরে আগুন দেয়া হয়। লুটপাটে  সাঈদী নিজে অংশ নেন। মাখনলাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের ¯¦র্ণ লুট করা হয়। মাওলানা সাঈদীর নেতৃত্বে  শান্তি কমিটির লোকজন দোকানপাট লুটে অংশ নেয়।
৭.    পরের দিন ৮ মে  বেলা দেড়টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী নিয়ে বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে শহিদুল ইসলাম সেলিম খানের বাড়িতে যায়। নুরুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পরে তাকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। এরপর তাদের বাড়ি আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
৮.    একই দিন বেলা  তিনটার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে চিথলিয়া গ্রামে যায় এবং মানিক পসারীর বাড়ি লুট করে । এখানে ৫টি ঘর তারা কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লুটপাটের পর। মানিক পসারীর বাড়ি থেকে ইব্রাহীম কৃট্টি  এবং মফিজুল নামে দুজনকে  ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সাঈদীর প্ররোচনায় ইব্রাহীমকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং মফিজকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া  হয়।
৯.    ২ জুন সকাল ৯টায়  নলবুনিয়া গ্রামের আব্দুল হালিমের বাড়িতে মূল্যবান জিনিস লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
১০.    একই দিন সকাল ১০টার দিকে উমেদপুর গ্রামে সাঈদীর নেতৃত্বে ২৫টি ঘর আগুন  দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসময় সাঈদীর নির্দেশে বিশাবালী নামে একজনকে নারকেল গাছের সাথে বেঁধে হত্যা করা হয়।
১১.    একই দিন সাঈদী  পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে টেংরাটিলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে যায় ।   তার বড় ভাই মাহবুবুল আলম হাওলাদারকে নির্যাতন এবং বাড়িতে লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া  হয়।
১২.     সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল পাড়েরহটা বাজারের  ১৪ জন হিন্দুকে  এক দড়িতে বেধে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়া  হয়।
১৩.    যুদ্ধ  শুরুর ২/৩ মাস পর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনা দল নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যায়। আজহার আলীর ছেলে সাহেব আলীকে পিরোজপুর  নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
১৪.    মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায়  যায়। এখানে মহিলাদের ধর্ষণ করা হয় এবং তাদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়।
১৫.     মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে সাঈদীর নেতত্বে ১৫ /২০ জনের একটি দল হোগলাবুনিয়ার গ্রামের ১০  জন হিন্দুকে  ধরে পাকিস্তান সেনাদের হাতে  তুলে দেয়া হয় এবং তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
১৬.    সাঈদীর নেতৃত্বে পারেরহাট বাজারের গৌরাঙ্গ সাহার তিনবোনকে ধরে পাকিস্তানীদের হাতে তুলে দেয়া হয । তিনবোনকে তিন দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে ধর্ষনের পর ছেড়ে দেয়া হয়।
১৭.    সাঈদী ও তার নেতৃত্বের রাজাকাররা পাড়েরহাট বাজারের বিপদ  সাহার  মেয়ে ভানুস সাহাকে  তার বাড়িতে আটকে রেখে নিয়মিত ধর্ষণ করত।
১৮.    ভাগীরথী নামে একটি মেয়ে পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পে কাজ করত। সাঈদী পাকিস্তানী সেনাদের খবর দেয় যে, ভাগীরথী  মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পের খবর  মুক্তিযোদ্ধাদের পৌছে দেয়। এরপর পাকিস্তান সেনারা তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
১৯.    সাঈদীর  ১০০ থেকে ১০৫ জন হিন্দুকে জোর করে মুসলমান বানায় এবং তাদের মসজিদে নামাজ পড়তে বাধ্য করে।
২০.     নভেম্বরের শেষের দিকে সাঈদী খবর পান  মানুষজন ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ১০ /১২ জনের একটি দল ইন্দুরকানী গ্রামে  তালুকদার বাড়িতে আক্রমন চালায়। ৮৫ জনকে আটক করা হয়। ১০/১২ জন বাদ দিয়ে বাকীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।

প্রমানিত অভিযোগ:  উপরোক্ত ২০টি অভিযোগ থেকে আটটি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ইব্রাহীম কুট্টি এবং বিশাবালী হত্যা ছাড়া  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অপর যে ছয়টি অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল (অভিযোগ নং ৬) পাড়েরহাট বাজারে হিন্দু ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের  দোকানপাট, বাড়িঘরে লুটপাট এবং আগুন দেয়ার বিষয়ে নেতৃত্ব প্রদান এবং অংশ নেয়া, (৭) শহিদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে আগুন দেয়া, (১১) মাহবুবুল আলম হাওলাদার বাড়িতে লুট এবং তার ভাইকে নির্যাতন (১৪)  ১৯৭১ সালে  হোগলাবুনিয়া এলাকায় হিন্দু পাড়ায় আক্রমন এবং শেফালী ঘরামী নামে একজন মহিলাকে রাজাকার কর্তৃক  ধর্ষনে সহায়তা এবং সেখানে উপস্থিত থাকা  (১৬) গৌরাঙ্গ সাহার তিন বোন মহামায়া, অন্নরানী  এবং কমলা নামে তিন বোনকে অপহরন করে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয়া  এবং তিনদিন ক্যাম্পে রেখে পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক ধর্ষনের পর ছেড়ে দেয়ার ঘটনা এবং (১৯) মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ১০০ থেকে ১৫০ জন হিন্দুকে জোর করে ধর্মান্তরকরন। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে তবে শাস্তি প্রদান করা হয়নি।

খালাস ১২টি অভিযোগ : যে ১২টি অভিযোগ থেকে মাওলানা সাঈদীকে খালাস দেয়া হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অভিযোগ হল  পিরোজপুরের পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান (হুমায়ূন আহমেদের পিতা), মেজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহামান  এবং এসডিও আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার অভিযোগ। এছাড়া ১৯৭১ সালে পিরোজপুরে নির্মম হত্যার শিকার ভাগিরথীকে হত্যা এবং  ভানু সাহাকে ধর্ষনের  অভিযোগ থেকেও খালাস দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীকে। এছাড়া মাছিমপুর বাস স্ট্যান্ডের পেছনে, মাসিমপুর হিন্দুপাড়া এবং ধোপপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিপুল সংখ্যাক হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া, লুটপাট করা, হিন্দুদের  অনেক হিন্দুকে এক দড়িতে বেঁধে হত্যঅ করা, হত্যার উদ্দেশে হিন্দুদের  পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেয়াসহ মোট ১২টি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমানিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

আলোচিত এবং ঘটনাবহুল একটি মামলা :

১৯৭১ সালে সংঘটিত মাবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ২ এ যে কয়টি মামলা হয়েছে এখন পর্যন্ত তার মধ্যে নানা কারনে সবচেয়ে আলোচিত এবং ঘটনাবহুল মামলা ছিল মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা।  মাওলানা সাঈদী একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মোফাসসিরে কোরআন এবং সুললিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী  হওয়ায় গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ মামলা।

এই মামলার শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে  ট্রাইব্যুনালের পদত্যাগী  চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নিরপেক্ষতা নিয়ে। ১৯৯২ সালে অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচারের জন্য জাহানারা ঈমামের নেতৃত্বে গঠিত গনআদালত  এবং পরর্তীতে  মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য জামায়াত নেতাদের বিচারের জন্য  গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সাথে জড়িত ছিলেন বিচারপতি নিজামুল হক।

এরপর সর্বশেষ স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং ট্রাইব্যুনালের সামনে থেকে মাওলানা সাঈদীর পক্ষের  একজন হিন্দু সাক্ষী অপহরনের ঘটনা,  রাষ্ট্রপক্ষের হিন্দু সাক্ষী  গণেশ চন্দ্র মাওলানা সাঈদীর পক্ষে এসে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিদেশী গনমাধ্যমেও স্থান পায় স্কাইপ কেলেঙ্কারি এবং সাক্ষী অপহরনের ঘটনা। স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারনে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয় ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুলক হককে। মাওলানা সাঈদীর মামলার বিচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক থাকলেও তিনি এ মামলার রায় ঘোষনা করতে পারলেননা। স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে তাকে  পদত্যাগ করতে হয়  এবং ট্রাইব্যুনালে নতুন চেয়ারম্যান  হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় এটিএম ফজলে কবিরকে। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের কারনে মাওলানা সাঈদীর   বিচার কার্যক্রম শেষ হবার পরও আবার নতুন করে শুরু করতে হয় যুক্তি তর্ক  উপস্থাপন। এছাড়া বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের আরেক সদস্য বিচারক জহির আহমেদ পদতাগ করেন। বিচার বিষয়ে অন্য বিচারকদের সাথে মতভিন্নতা এবং কিছুটা নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বনের চেষ্টার কারনে তাকে সরকার পদত্যাগে বাধ্য করে বলে পরবর্তীতে প্রমানিত হয়েছে।  বিচারক জহির আহমেদকে সরিয়ে দেয়ার পর নতুন বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান  জাহাঙ্গীর হোসেন । এসব কারনে  ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা হওয়া সত্ত্বেও মাওলানা সাঈদীর মামলার রায় ঘোষনার পূর্বে ট্রাইব্যুনাল-২ এ অন্য দুটি মামলার রায় ঘোষনা করা হয়েছে।

এছাড়া আসামী পক্ষ কর্তৃক সেফ হাউজের  ডকুমেন্ট উদ্ধারের ঘটনাও এ মামলার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল।  রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৪৬ জন সাক্ষীর ব্যাপারে লিখিত দরখাস্ত দিয়ে  ট্রাইব্যুনালে আবেদন করে বলা হয় তাদের হাজির করা আদৌ সম্ভব নয়। কারণ তাদের অনেকে  মাওলানা সাঈদীর সন্ত্রাসীর ভয়ে বাড়িছাড়া, নিখোঁজ, পলাতক। কেউবা অসুস্থ। তাই তারা তদন্ত কর্মকর্তার কাছে  যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা যেন তাদের অনুপস্থিতিতেই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেখান থেকে ১৫ জনের জবানবন্দী (পরে আরেকজন বেড়েছে) সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তীতে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা  একটি ডকুমেন্ট হাজির করে দেখান যে, ৪৬ জন সাক্ষীদের অনেককে ঢাকায় একটি সেফ হাউজে দীর্ঘদিন রেখেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। কিন্তু তারা তাদের শেখানো মতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় তাদের হাজির করেনি রাষ্ট্রপক্ষ। সেফ হাউজের এ ডকুমেন্ট নিয়ে তখন সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

১৫ জন সাক্ষীকে  ট্রাইব্যুনালে হাজির না  করে তাদের জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ঘটনাও বেশ সমালোচনার জন্ম দেয় এ মামলার ক্ষেত্রে।
মাওলানা সাঈদীর মামলায় উভয় পক্ষের হাজির করা সাক্ষীদের জেরা বছরজুড়ে পাঠকের কাছে ছিল  আকর্ষনীয় বিষয় । পিরোজপুরের বর্তমান এমপি একেএমএ আউয়াল মাওলানা সাঈদীর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেন। মাওলান সাঈদীর পক্ষেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের    শুরুতে আইন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তবে  ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে শুরু হওয়া সব বিতর্ক ছাপিয়ে যায় বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা। বিচারের বিভিন্ন  আদেশ/বিষয় আসয় বেলজিয়াম থেকে লিখে পাঠানোর ঘটনার চিত্র বের হয়ে পড়ে এতে। বিচার কাজে সরকার এবং বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তি এবং মহলের যোগসাজস এবং নিয়ন্ত্রনের ঘটনায় দেশ এবং বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা অতীতে আর কখনো ঘটেনি বলে  মন্তব্য করেন আইনজ্ঞরা।

এ বিচার চলাকালে  এবং বন্দী থাকা অবস্থায় মাওলানা সাঈদী প্রথমে তার মাকে হারান। এরপর গত বছর জুন মাসে বিচার চলাকালে  ট্রাইব্যুনালে বসে অসুস্থ হয়ে মুত্যৃর কোলে ঢলে পড়েন তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী। রাফিক বিন সাঈদী মারা যাবার পর মাওলানা সাঈদী কারাবন্দী থাকা অবস্থায়  গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন তাকে   হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। বর্তমানে মাওলানা সাঈদীর বড় ছেলে শামীম সাঈদীও কারাগারে বন্দী রয়েছেন।

মাওলানা সাঈদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ পিরোজপুরের সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মওলানা ইউসুফ সাঈদী দেশের দণিাঞ্চলের সুপরিচিত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ছিলেন।
মাওলানা সাঈদী নিজ পিতার প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিা লাভ  করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠীতে অবস্থিত শর্ষিণা (ছারছিনা) মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর তিনি খুলনার একটি মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করেন। 
১৯৬৭ থেকে মাওলানা  সাঈদী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এবং বিশ্বের বহু দেশে  মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাফসীর করেছেন।  তার ওয়াজ শুনে  অনেক  হিন্দু  এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। কোরআন হাদিস এবং ইসলামের ওপর রচনা করেছেন অসংখ্য পুস্তক। পেয়েছেন নানা উপাধি, খ্যাতি ও  সম্মান। তার তাফসিরের অডিও ভিডিও পাওয়া যায় দেশে বিদেশে সর্বত্র।  দেশে বিদেশে তৈরি হয়েছে তার অগনিত ভক্ত অনুরাগী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মাওলানা সাঈদীর ওয়াজ মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশ থেকে নামকরা অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের  আমন্ত্রনে তিনি সেসব দেশ সফর করেছেন এবং  কোরআনের  তাফসির করেছেন।
মাওলানা সাঈদী ১৯৭৯ সালে সাধারন সমর্থক হিসেবে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং  ১৯৮৯ সালে মজলিসে শুরায় সদস্য নির্বাচিত  হন।  তিনি দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি তিন সন্তানের পিতা। বিচার চলাকালে তার বড় ছেলে রাফিক বিন সাঈদী ইন্তেকাল করেছেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এক বছরের মাথায় ২০১২ সালের  ৬ ডিসেম্বর  মামলার সমস্ত  কার্যক্রম শেষে রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করেন ১১ ডিসেম্বর। এরপর মাওলানা সাঈদীসহ অন্যান্য মামলার পুনরায় বিচার দাবি করে দরখাস্ত করা হয় আসামী পক্ষ থেকে। সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তবে মাওলানা সাঈদীর মামলায় পুনরায় যুক্তি  উপস্থাপন শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ১৩ জানুয়ারি পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয় এবং ২৯ জানুয়ারি  উভয় পক্ষের যুক্তি পেশ শেষ হলে  সেদিন পুনরায় রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনা করেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের তারিখ অপেক্ষমান ঘোষনার এক মাসের মাথায় রায় ঘোষনা করলেন ট্রাইব্যুনাল।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত  মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের মার্চ মাসে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গঠন করা হয়।  ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটিই ছিল প্রথম মামলা। তবে স্কাইপ কেলেঙ্করির কারনে  পিছিয়ে যায় এ মামলার রায় ঘোষনার বিষয়টি।

মানিক পসারী নামে এক লোক   পিরোজপুরের মেজিস্ট্রেট আদালতে  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ঘটনায় একটি মামলা করেন। এর কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করেন পিরোজপুর  মেজিস্ট্রেট আদালতে।

২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে পিরোজপুরে  মামলার বাদী মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবী করেন।  এভাবে মাওলানা সাঈদীর বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে এবং  বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ১৪ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় প্রসিকিউশনের কাছে এবং ৩/১০/২০১১ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয় মাওলানা সাঈদীকে। সেই থেকে তিনি বন্দী ছিলেন রায় ঘোষনার দিন পর্যন্ত।

মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ২৮ জন সাক্ষী হাজির করে। এর মধ্যে ঘটনার সাক্ষী ছিল ২০ জন  (গতকাল আমরা ভুলক্রমে ১৮ জন লিখেছিলাম) । বাকীরা জব্দ তালিকার এবং একজন তদন্ত কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৬৮ জন ঘটনার সাক্ষীর তালিকা জমা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনালে।   ৬৮ জনের মধ্য থেকে হাজির করা হয়নি এমন ১৬ জন সাক্ষীর তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দী সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
অপরদিকে আসামী পক্ষে মোট ২০ জন সাক্ষীর তালিকা নির্ধারন করে দেন ট্রাইবু্যুনাল এবং তার মধ্য থেকে ১৭ জন সাক্ষী হাজির করে আসামী পক্ষ।


মামলা শুরু যেভাবেমাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই চিকিৎসার জন্য  সৌদি আরব যাচ্ছিলেন। এয়ারপোর্টে তাকে আটকে দেয়া হল। তিনি আদালতের স্মরনাপন্ন হলেন। ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট হাইকোর্ট তাকে  বিদেশ গমনে বাঁধাদানকে অবৈধ উল্লেখ করে  তার পক্ষে রায় দেন। রায়ে তাকে বিদেশ গমন এবং বিদেশ থেকে ফেরত আসা বিষয়ে  কোন প্রকাশ  বাঁধা না দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন আদালত। হাইকোর্টের এ আদেশের আড়াই ঘন্টার মাথায়  সুপ্রীম কোর্টের চেম্বার বেঞ্চ স্থগিত করেন সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে।

দুপুর বারটার দিকে হাইকোর্ট তাকে বিদেশ যাবার অনুমতি দিয়ে রায় দেয়ার পর আড়াইটার দিকে চেম্বার বেঞ্চ  কর্তৃক তা স্থগিত করে দেয়া হল।  বিদেশ গমনে বাঁধা বিষয়ক শুনানীতে অংশ নিয়ে মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন তার বিরুদ্ধে কোন  অভিযোগ নেই এবং কোন মামলাও নেই। এর জবাবে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন মামলা নেই কিন্তু মামলা হতে কতক্ষন।

এটর্নি জেনারেল এর মন্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেদিনই অর্থাৎ  ২০০৯ সালের ১২ আগস্ট পিরোজপুরে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল  ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে। মানিক পশারী নামে এক লোক   পিরোজপুর মুখ্য বিচারকি হাকিমের  আদালতে  মাওলানা  দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীসহ ৫ জনের  বিরুদ্ধে এ মামলাটি করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয় ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা  সাঈদী  পাকিস্তান আর্মি নিয়ে তাদের বাড়িতে যায়। বাড়ি লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বাড়ির কাজের লোক ইব্রাহীম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নির্দেশে পাকিস্তান আর্মি তাকে  পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করে।

মানিক পশারীর এ মামলা দায়েরের  কয়েক দিন পর ৯ সেপ্টেম্বর মাহবুবুল আলম হাওলাদার  নামে আরেক ব্যক্তি মাওলানা  দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও অন্য তিনজনের বিরুদ্ধে  পিরোজপুর নালিশী আদালতে একটি নালিশী দরখান্ত দাখিল করেন। এটিও ১৯৭১ সালের ঘটনা বিষয়ে।

২০১০ সালের মার্চ মাসে গঠিত হয়  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ট্রাইব্যুনাল  গঠনের পর মাহবুবুল আলম হাওলাদার  ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি দরখাস্ত দাখিল করেন। দরখাস্তে তিনি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে বিচার দাবি করেন।  তার এ দরখাস্তের সূত্র ধরে মাওলানা  হোসাইন সাঈদীর  বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের অধীনে আসে । এরপর ২০১০ সালের ২১ জুলাই থেকে  তদন্ত সংস্থা মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে শুরু করে তদন্ত কাজ। ২০১১ সালের  ৩ অক্টোবর চার্জ গঠনের মাধ্যমে শুরু হয়  বিচার কার্যক্রম। 

পিরোজপুরের মামলা বিষয়ে আসামী পক্ষের অভিযোগ
মানিক পশারী এবং মাহবুবুল আলম হাওলাদার ২০০৯ সালে পিরোজপুরে মাওলানা  সাঈদীর বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা দায়ের করেন সে বিষয়ে আসামী পক্ষ থেকে  বিভিন্ন সময় ট্রাইব্যুনালে  অভিযোগ করে বলা  হয়েছে- এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম  সাংবাদিকদের সামনে  বলেন- মামলা  নেই কিন্তু মামলা হতে কতক্ষন। তিনি একথা বলার কয়েক ঘন্টার মধেই পিরোজপুরে তার বিরুদ্ধে মানিক পশারী মামলা করেন। এ থেকে বোঝা যায় এটর্নি জেনারেল এবং মানিক পশারীর মামলার সাথে একটি যোগসূত্র রয়েছে। মানিক পশারী কর্তৃক মামলা  দায়ের করার এক মাসের মধ্যে  মাহবুবুল আলম হাওলাদার যে আরেকটি মামলা করেন সেটিও সরকারের নির্দেশে তাকে দিয়ে করানো হয়েছে বলে আসামী পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।

যেভাবে গ্রেফতার 
তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরী ২০১০ সালের ২১ মার্চ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের  পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে। মামলার আসামীরা হলেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ঢাকা মহনগর জামায়াতের আমির রফিকুল ইসলাম খান এবং ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর দক্ষিনের সভাপতি আ স ম ইয়াহিয়া।

মামলায় বলা হয়, ১৭ মার্চ (২০১০)  সিরাতুন্নবী (সা.) উপলে ছাত্রশিবিরের আলোচনা সভায় রফিকুল ইসলাম খান মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামীকে তুলনা করেন, যা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে। ওই সভায় নিজামীসহ অন্য আসামিরা উপস্থিত ছিলেন। মামলার পর মহানগর হাকিম তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন। ২৯ জুন  তাদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য ধার্য্য করা হয়। আ স ম ইয়াহিয়া ছাড়া জামায়াতের চার নেতা হাজির না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এরপর মাওলানা সাঈদীকে ওইদিন অর্থাৎ ২৯ জুন বিকালে শহীদবাগের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে প্রেসকাবের সামনে থেকে এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে সাভার থেকে বাড়ি যাবার পথে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর পুলিশের কর্তব্য কাজে বাঁধাদান, গাড়ি ভাংচুর, উত্তরা ষড়যন্ত্রের সাথে জাড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মামলায় মাওলানা সাঈদীসহ অন্য দুই নেতার প্রত্যেককে ১৬ দিন করে রিমান্ড প্রদান করেন আদালত।

মাওলানা সাঈদীর পক্ষে মামলায়  যেসব আইনজীবী অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মনজুর আহমেদ আনসারী, ব্যারিস্টার তানভির আহমেদ আল আমিন প্রমুথ।
অন্যদিকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামালায় রাষ্ট্রপক্ষের নির্ধারিত আইনজীবী ছিলেন সৈয়দ  হায়দার আলী।


আব্দুল কাদের মোল্লার রায় পর্যালোচনা


পর্যালোচনা১:
ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের জবানবন্দী এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে


মেহেদী হাসান
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যে দুটি  অভিযোগে  যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান  করা হয়েছে তার মধ্যে একটি অভিযোগ হল মিরপুরে কালাপানি লেনে হযরত আলী,  তার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীকে হত্যা ও    মেয়েদের ধর্ষনের ঘটনা।
এ ঘটনায় বেঁচে যায় হযরতী আলী লস্করের   বড় মেয়ে মোমেনা বেগম। মোমেনা বেগম ট্রাইব্যুনালে এসে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এ ঘটনা বিষয়ে । একই সাক্ষী মোমেনা বেগম তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ধর্ষনের ঘটনা বিষয়ে ২০০৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ যাদঘর কর্তৃপক্ষের কাছে জবানবন্দী দিয়েছেন। ট্রাইবু্যুনালে মোমেনা বেগম বলেছেন ঘটনার সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ধর্ষনের ঘটনা দেখেছেন। তিনি নিজেও  লাঞ্ছনার শীকার হন এবং এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন। অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে  কাছে  তিনি  ঘটনার বর্ননা দিয়ে বলেছেন ঘটনার দুই দিন আগে তিনি শশুরবাড়ি চলে যাওয়ায় প্রানে বেঁচে যান। কোর্টে তিনি বললেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আর মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত বক্তব্যে দেখা যায় তিনি ঘটনার দুই দিন আগে শশুর বাড়ি চলে যান।
ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে (রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনা)  মোমেন বেগমের  সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় ট্রাইব্যুনালে।  ফলে সেসময় মোমেনা বেগমের সাক্ষ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রচার বা প্রকাশিত হয়নি। তবে মোমেনা বেগম কোর্টে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ে  বর্ননা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে।

ট্রাইব্যুনালে মোমেনা বেগমের  জবানবন্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘটনা ঘটে। মোমেনা বেগমরা তখন মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের  ৫ নং কালাপানি লেনে ২১ নম্বর বাসায় থাকতেন। মোমেনা বেগম কোর্টে সাক্ষ্য দিয়ে  ঘটনা বিষয়ে বলেন, সন্ধ্যার সময় তার পিতা হযরত আলী হন্তদন্ত হয়ে  ঘরে আসলেন এবং  বললেন কাদের মোল্লা তাকে মেরে ফেলবে। কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সাগরেদ আক্তার গুন্ডা তার পিতাকে হত্যার জন্য ধাওয়া করছে। তার পিতা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর তারা বাইরো বোমা ফাটাল। দরজা খোলার জন্য গালিগালাজ করল। তার মা দাও  হাতে নিয়ে দরজা খুলল। তারা ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করল তার মাকে। কাদের মোল্লা তার পিতাকে কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তার সঙ্গীরা তার বোন খাদিজা এবং তাসলিমাকে জবাই করল। দুই বছরের ভাইকে আছড়িয়ে হত্যা করে।
মোমেনা জানায় সে এবং তার  ১১ বছর বয়স্ক অপর বোন আমেনা খটের নিচে আশ্রয় নেয় ঘটনার সময়। আমেনা ভয়ে চিৎকার দেয়ায় তাকে খটের নিচ থেকে টেনে বের করে জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে তার কান্না থেমে যায়।  এক পর্যায়ে তাকেও টেনে বের করে এবং ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে জ্ঞান হারায় এবং জ্ঞান ফিরে পেটে প্রচন্ড ব্যর্থা অনুভব করে। তার পরনের প্যকণ্ট ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পান তিনি। পরে এক  ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং তাদের সেবার মাধ্যমে কিছুটা সুস্থ হন। পরে তার শশুর খবর পেয়ে তাকে এসে নিয়ে যান।
রয়ে মোমেনা বেগমের বরাদ দিয়ে তাদের পরিবারের ঘটনার    বর্ননা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র এটি।
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টে যা রয়েছে :
হযরত আলী হত্যাকান্ডসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড বিষয়ে  শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের  সাক্ষাতকার,  লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত  বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে মিরপুর জল্লাদখানা যাদুঘরে।  মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত  পাম্প হাউজে  এনে ১৯৭১ সালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে  এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং  অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে  জল্লাদখানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরের অংশ।  জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন  সময়ে তাদের সাক্ষাতকার  বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
যে হযরত আলী হত্যাঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে সেই ঘটনার একটি বিবরন রক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে। হযরত আলীর বেঁচে যাওয়া একমাত্র মেয়ে মোমেনা বেগমের বরাত দিয়েই সে ঘটনার বর্ননা  লিপিবদ্ধ এবং সংরক্ষন করা হয়েছে।  মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার গ্রহনের মাধ্যমে এ ঘটনার বিবরন তারা সংগ্রহ করে।    মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত সে ডকুমেন্টে  লেখা আছে ঘটনার দুই দিন আগে মোমেনা বেগম তার শশুর বাড়ি চলে যান।

হযরত আলী হত্যাকান্ড বিষয়ে তার মেয়ে মোমেনা বেগমের সাক্ষাতকার যাদুঘর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে ২৮/৯/২০৭  তারিখ। তিনি তখন তাদের কাছে ঘটনার যে বিবরন দেন তা নিম্নরূপ।  ‘ঘটনার বিবরণ : ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে কিছু বাঙালি পরিবারও বাস করতো। ৭ মার্চ এর পর থেকে দেশের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে কিছু কিছু বাঙালি পরিবার এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেকের অন্যত্র যাওয়ার অবস্থা ছিল না ফলে এলাকায় রয়ে গেলেন। যে কয়েকটি পরিবার অন্যত্র যেতে পারলেন না তাদের মধ্যে একটি হযরত আলী লস্কর-এর পরিবার।
হযরত আলী লস্কর ছিলেন একজন দর্জি/খলিফা। মিরপুরেই তার দোকান ছিল। সকলে যখন এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আলী লস্করকেও তারা চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু হয়ে গেলে ২৬ মার্চ সকাল সাতটার দিকে বিহারির হযরত আলী লস্কর-এর বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই তারা তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা ও শিশু পুত্রকে ধরে নিয়ে যায় এবং সকলকে এক সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বাড়ির কুয়োতে সব লাশ ফেলে যায়। বিহারিরা তার দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমকে ঘরের ভতর সারাদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করে। পরে তাকেও হত্যা করে সেই কুয়োতে ফেলে। হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম মাত্র দুইদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে চলে যাওয়ায় একমাত্র সেই প্রানে বেঁচে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত আলী স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্বা ছিল।
কয়েকদিন পরই এ খবর হযরত আলীর বড় মেয়ে মোমেনা বেগম জানতে পারেন। কিন্তু মিরপুরের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে তিনি বাড়ি আসতে পারলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ বাড়িতে এসে তিনি আর কিছুই অবশিষ্ট পেলেন না। ভগ্নহৃদয়ে ফিরে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে।”

রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে মোমেনা বেগম তার পিতামাতা এবং ভাইবোনকে হত্যার ঘটনাটি যে স্বচক্ষে দেখেছেন তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে। তার বয়স ছিল তখন ১৩ বছর এবং অলৌকিকভাবে সে বেঁচে যায়। তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। রায়ে মোমেনা বেগমের জবানবন্দী বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে।


আসামী পক্ষ থেকে দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানানো হয়েছে মোমেনা বেগমের যে জবানবন্দী মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের কাছে রক্ষিত রয়েছে তা  তারা ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছিলেন।  ট্রাইব্যুনাল তখন তা  নথিভুক্ত করে জানিয়েছিলেন বিষয়টি তারা রায়ের সময় বিবেচনা করবেন। তবে রায়ে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। রায়ে আসামী পক্ষের দাবি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আসামী পক্ষ দাবি করেছে মোমেনা বেগম  হযরত আলী লস্করের মেয়ে নন। তিনি যে হযরত আলী রস্করের মেয়ে সে মর্মে রাষ্ট্রপক্ষ তা তিনি কোন  ডকুমেন্ট হাজির করেনি। তাছাড়া জেরায় আসামী পক্ষ মোমেনা বেগমের যেসব দুর্বল বিষয়    বরে করে আনে তাও উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।
আসামী পক্ষ কর্তৃক মোমেনা বগমের জেরার পর্যালোচা করে রায়ে  বলা হয়েছে, জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে মোমেনা বেগম জানান, পাকিস্তান আর্মি এবং বিহারীদের সাথে যে বাঙ্গালী এসেছিল তিনি বাংলায় কথা বলছিলেন এবং তার বাবার কলার ধরে যিনি  নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি হলে কাদের মোল্লা। তিনি   খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেন। কাদের মোল্লা যে সেখানে উপস্থিত ছিলেন তা এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে রায়ে মন্তব্য করা  হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে মোমেনা বেগমের মা বাবা ভাই বোনকে কাদের মোল্লা নিজে হত্যা করেছে  চার্জে সে অভিযোগ করা হয়েছে বলে মনে হয়না। তবে রায়ে বলা হয়েছে কাদের মোল্লার উপস্থিতিতে, সহায়তায় এবং নৈতিক সমর্থনে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। মানবতা বিরোধী এ ধরনের হত্যা ঘটনা  ব্যক্তি সরাসরি ঘটিয়েছে তা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন  হয়না।

রায়ে আরো বলা হয়েছে এ ঘটনায় একজনমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী   জীবিত সাক্ষী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হলেন মোমেনা বেগম। তার এভিডেন্সেকে পাশ কাটানো যায়না বা সন্দেহ পোশন করা যায়না।   

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা  হয় এবং এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে কারাদান্ড প্রদান করা হয় আব্দুল কাদের মোল্লাকে।  দুটি   হযরত আলী হত্যা ঘটনাটি ছিয় ছয় নম্বর অভিযোগ এবং এ অভিযোগসহ আরো একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয়। হযরত আলী আওয়ামী লীগ করার কারনে এবং স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারনে  আব্দুল কাদের মোল্লা বিহারী এবং আর্মিদের সাথে নিয়ে তাকেসহ পরিবারের লোকজনকে হত্যা করে মর্মে অভিযোগ করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে।


রায় পর্যালোচনা২ :
এক নং চার্জ পল্লব হত্যার ভিত্তি শোনা কথা
কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ ঘটাননি


মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গত পাঁচ  তারিখ মঙ্গলবার রায় ঘোষনা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে পাঁচটি অভিযোগে কারাদণ্ড প্রদান করা হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি হল ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে  মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা ঘটনা। এ হত্যা ঘটনার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার   অভিযোগে তাকে  ১৫ বছরের জেল দেয়া হয়েছে।

রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা বিশ্লেষন করে উল্লেখ করা হয়েছে এ হত্যা ঘটনার অভিযোগের ভিত্তি হল শোনা কথা।  ট্রাইব্যুনালের হাতে  যা এসেছে তাতে দেখা যায় আব্দুল কাদের মোল্লা  ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ সংঘটন করেছেন এমন অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত নন।

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। একটি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়ে পাঁচটি অভিযোগে তাকে  কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে  ছয়টি অভিযোগ  সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে। তারপর প্রত্যেকটি অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের যেসব সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তা বিশ্লেষন করা হয়েছে। এরপর আসামী পক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষন করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগের পক্ষে দুই পক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে।  কোন অভিযোগে কেন আসামীকে দন্ডিত করা হল, সাক্ষীর সাক্ষ্য কেন, কতটুকু মাত্রায় গ্রহণ করা হল তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে দণ্ড ঘোষনা করা হয়েছে রায়ে।

রায়ে পল্লব হত্যার ঘটনা : আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এক নং চার্জ ছিল পল্লব হত্যার ঘটনা।   এ অভিযোগটি বিশ্লেষনের শুরুতে রায়ে ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে  তুলে ধরা হয়েছে।   এতে  উল্লেখ করা হয় আব্দুল কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে নওয়াবপুর থেকে জোর করে আব্দুল কাদের মোল্লার কাছে ধরে আনা হয়। তারপর আব্দুল কাদের মোল্লার সাঙ্গপাঙ্গরা  পল্লবকে  মিরপুর ১২ নম্বর থেকে ১ নং  শাহআলী মাজার পর্যন্ত টেনে  নিয়ে যায়।  এরপর তাকে আবার মিরপুর ১২ নং ঈদগাহ মাঠে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর কাদের মোল্লার সহযোগী আক্তার গুন্ডা এবং অন্যারা মিলে  পল্লবকে ৫ এপ্রিল হত্যা করে। পল্লাব হত্যায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যাকান্ড ঘটানোর অপরাধ হিসেবে  মানবাতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় চার্জে।  অথবা হত্যা ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে।

সাক্ষী : রায়ে বলা হয় পল্লব হত্যা ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদের একজন হলেন শহিদুল হক মামা এবং সৈয়দ আব্দুল কাইউম। অপর দিকে আসামী পক্ষে  এ ঘটনায় সাক্ষ্য দিয়েছেন পল্লবের ভাবী সাহেরা খাতুন। সাহেরা  খাতুন ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। তবে তিনি রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য  না দিয়ে আসামীর পক্ষে সাক্ষ্য  দিয়েছেন।

সাক্ষী পর্যালোচনা : রায়ে বলা হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী  শহিদুল হক মামা পল্লবকে হত্যার জন্য আব্দুল কাদের মোল্লা নির্দেশ দিয়েছেন তা দেখননি। অথবা পল্লবকে যে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে আসা হয়েছে তাও দেখেননি। জেরায় সাক্ষী বলেছেন,  তিনি জনতা এবং যাদেরকে তিনি চিনতেন তাদের কাছে পল্লবকে জোর করে ধরে আনা, নির্যাতন করা এবং হত্যার ঘটনা শুনেছেন ।
রাষ্ট্রপক্ষের অপর সাক্ষী আব্দুল কাইউমও বলেছেন তিনি শুনেছেন কাদের মোল্লা  বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে হত্যা করেছে।
সাক্ষী শহিদুল হক মামা যদিও শোনা কথা বলেছেন তবু তিনি একজন ন্যাচারাল সাক্ষী। অন্যথায় তিনি বাড়িয়ে বলতে পারতেন  যে, তিনি দেখেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা পল্লবকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। তার যদি কোন অসৎ উদ্দেশ্য থাকত তাহলে তিনি  বলতে পারতেন যে, তিনি ওই ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তা  না বলে তিনি এ ঘটনায় কিভাবে, কাদের পরিকল্পনায়  ঘটানো হয়েছে সে বিষয়ে বলেছেন। তিনি বলেছেন তিনি জনতার কাছে এবং যাদেরকে তিনি চেনেন এমন অনেকের কাছে এ ঘটনা শুনেছেন।

রায়ে সাক্ষী সাক্ষী শহিদুল মামা সম্পর্কে  বিস্তারিতভাবে  তুলে ধরা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে প্রদত্ত তার জবানবন্দীর ভিত্তিতে। এতে  বলা হয় সাক্ষী শহিদুল হক মামা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা।  সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন,  আব্দুল কাদের মোল্লা বিহারীরা, আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাশিম হাসবি, নেহাল গোলাম আযমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় অংশ নিয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে স্লোগন দিত।
রায়ে  বলা হয় আব্দুল কাদের মোল্লা যদিও একজন বাঙ্গালী ছিলেন কিন্তু স্থানীয় আক্তার গুন্ডা এবং বিহারী গুন্ডাদের সাথে তার ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাক্ষী শহিদুর হক মামা বলেছেন ২৫ মার্চের আগেই  ছয় দফা এবং ১১ দফা আন্দোলনের সময় তিনি জামায়াতের আব্দুল কাদের মোল্লাসহ কনভেনশন মুসলিম লীগের  নেতা কর্মীদের দ্বারা  প্রতিরোধ এবং আক্রান্ত হয়েছেন। এসব কারনে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং বিহারী গুন্ডা ও আক্তার গুন্ডাদের সাথে  সাক্ষী শহিদুল হক মামার সাথে  আগে থেকেই বিরোধ ছিল। ২৫ মার্চ রাতে মিরপুরেও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। সাক্ষী শহিদুল হক মামা রাতে শাহ আলী মাজারে আশ্রয় নেন। সকালে মাজার থেকে বের হয়ে আসার পর তিনি ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পান এবং কাদের মোল্লাসহ অন্যান্যরা তাকে ধাওয়া দেয়।
রায়ে বলা হয় জেরায় এসব বিষয়  প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় রয়ে গেছে।

সাক্ষী মূল্যায়ন : রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামী পক্ষের  বিজ্ঞ আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন বেনামী শোনা কথার কোন বিচারিক মূল্য নেই। জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন আইনে শোনা কথা গ্রহণযোগ্য।

অভিযোগের ভিত্তি শোনা কথা : রায়ে বলা হয়েছে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এক নং অভিযোগ পল্লব হত্যার অভিযোগের ভিত্তি হল শোনা কথা। সোনা কথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের ডিসক্রিশন, আইনে প্রদত্ত বৈধতা, পারিপার্শিক পরিস্থিতি, সাক্ষীর গ্রহণযোগ্যতা, সংশ্লিষ্ট ঘটনা ছাড়াও  সার্বিক বিষয়ে আসামীর সংশ্লিষ্টতা প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষন করা হয়েছে এ পর্যায়ে। রায়ে বলা হয় যেহেতু টেকনিক্যাল রুল অব  এভিডেন্স ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয় এবং পারিপার্শিক পরিস্থিতি, বিহারী গুন্ডা, আক্তার গুন্ডার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার   ঘনিষ্ঠতা ছিল তাই  প্রভৃতি বিবেচনায় শোনাকথাকে সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে। 
রায়ে বলা হয় সেসময়  সেখানে যে  ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করে তাতে কোন বাঙ্গাীর পক্ষে এ  হত্যা ঘটনা, জোর করে পল্লবকে কাদের মোল্লার কাছে ধরে আনা  বা কাদের মোল্লা কর্তৃক পল্লবকে হত্যার নির্দেশ দেয়ার ঘটনা দেখা সহজ ছিলনা। সাক্ষীর মতে মিরপুরে তখন ৯০ ভাগ মানুষ ছিল বিহারী। সামান্য যে দশ ভাগ বাঙ্গালী ছিল তারা ছিল  ভয়ে ভীত। হঠাৎ  করে বিহারী গুন্ডা, স্বাধীনতা বিরোধী বাঙ্গালী যারা জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে জড়িত ছিল তারা  পাকিস্তান আর্মির সাথে মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধ’র শুরুতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির অবতারনা ঘটায় তাতে বাঙ্গালীরা ত্রাসের মধ্যে ছিল সেখানে। তাই সাক্ষী শহিদুল হক মামা লোকজনের কাছে পল্লব হত্যার ঘটনা শুনেছেন বলে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাকে উড়িয়ে দেয়া যায়না। কোন চাুস সাক্ষী নেই বলে তার সাক্ষ্যকে অস্বীকার করা যায়না।
তাছাড়া দীর্ঘ ৪১ বছর পর এ বিষয়ে  জীবিত সাক্ষী  নাও পাওয়া যেতে পারে এবং সেসময়কার ভয়াবহ পরিস্থিতির কারনে এ ঘটনা কারো পক্ষে  দেখা সম্ভব নাও হতে পারে। সাক্ষী শহিদুল হক মামা একজন মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা এবং তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িত। তাই তার পক্ষে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং অন্য যারা পাকিস্তানপন্থী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে তাদেরকে চেনা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা যায়।


আসামী পক্ষের সাক্ষী সম্পর্কে রায়ে যা বলা হয়েছে : পল্লবের ভাবী সাহেরা ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী।  কিন্তু তিনি  রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে   আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিয়ে উল্টো ট্রাইব্যুনালে এসে কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন।  তিনি পল্লবের আপন ভাবী। এ সাক্ষী  সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, তিনি একজন ম্যানেজড সাক্ষী। অর্থাৎ আসামী পক্ষ তাকে ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছে। সত্য প্রকাশ না করার জন্য, রাষ্ট্রপক্ষের  অভিযোগকে মিথ্যা প্রমানের জন্য এবং আসামীকে সুবিধা পাইয়ে দেয়ার  মেকানিজমের অংশ হিসেবে তাকে আনা হয়।

রায়ে আরো বলা হয় সাক্ষী সাহেরা জেরায় এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার নাম জীবনেও শোনেননি। যদি এটা সত্য হয় তাহলে কাদের মোল্লা তখন এ  ঘটনার সাথে জড়িত ছিল  বা ছিলনা এ বিষয়েও তার কিছু জানানর কথা নয়। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে সংশ্লিষ্টতা, স্থানীয় বিহারী, স্বাধীনতা বিরোধী, বাঙ্গালী বিরোধীদের সাথে সম্পর্ক এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কর্মতৎপরতার  সাথে জড়িত থাকার কারনে ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনার আগে থেকেই  কাদের মোল্লা পরিচিত ছিলেন। কাজেই জীবনে একবারও আব্দুল কাদের মোল্লার নাম না শোনার কথা মিথ্যা হিসেবে পরিগনিত।
এমনিভাবে আরো কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে কেন আসামী পক্ষের সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্য নয় সে বিষয়ে। রায়ে বলা হয়েছে যেহেতু এ সাক্ষী  সত্যকে গোপন করে আসামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তাই তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী প্রদানের কথাও অস্বীকার করেছেন।  নি:সন্দেহে  এ সাক্ষী সত্য গোপন করেছেন বিশেষ করে ঘটনার সাথে আসামীর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে। অন্যদিকে তার সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষের শোনা কথাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। 


রায়ে বলা হয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে স্থানীয় বিহারী এবং স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর  ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত। রায়ে উদাহরন পেশ করে বলা হয়েছে যেসব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তার সাথে অভিযুক্তর সরাসরি সম্পৃক্ত বা জড়িত থাকতে হবে  বিষয়টি এমন নয়। প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমান, পারিপাশ্বির্ক পরিস্থিতি এবং ঘটনা বিশ্লেষন করে আমরা পেয়েছি যে, আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সহযোগীরা মিলে বেসামরিক নাগরিক পল্লব হত্যা পরিকল্পনা করেছে।     নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর আক্রমনের অংশ হিসেবে পল্লবকে হত্যা করা হয়। পল্লবকে যেখন হত্যা করা হয় তখন সেখানে আসামীকে উপস্থিত থাকতে হবে এমনটি অপরিহার্য নয়। রায়ে বলা হয়, তার নৈতিক সমর্থনে, জ্ঞাতসারে এবং পরিকল্পনায় এ হত্যা ঘটনা ঘটে, যদিও ঘটনাস্থলে তিনি উপস্থিত ছিলেননা।  কারণ পল্লব ছিল স্বাধীনতার পক্ষের।  বেসারিমক নাগরিকদের  বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত আক্রমনের অংশ হিসেবে পল্লবকে হত্যা করা হয়। তাই এটি একক হত্যাকান্ড হলেও আইনে বর্নিত মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবেও গন্য এটি।

রায়ের শেষ দিকে উল্লেখ করা হয়েছে  ট্রাইব্যুনালের কাছে যেসব বিষয় উত্থাপিত হয়েছে তাতে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা ব্যক্তিগতভাবে কোন অপরাধ সংঘটন করেছেন সে মর্মে কোন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই। বরং যেটি প্রমানিত হয়েছে সেটি হল মিরপুরে স্বাধীনতা বিরোধী বিহারী গুন্ডাদের সাথে তার যোগসাজস ছিল। অপরাধ সংঘটনের আগে থেকেই তাদের সাথে তার এ  সম্পর্ক ছিল।
আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ে এক নং চার্জ বা পল্লব হত্যার ঘটনাটি প্রায় ১৮ পৃষ্ঠা জুড়ে বিশ্লেষন করা হয়েছে।

আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী যা বলেছেন : পল্লবের ভাবী সাহেরা ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী। কিন্তু গত ২ ডিসেম্বর তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে   আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে চমক সৃস্টি করলেন। সাহেরা সেদিন ট্রাইব্যুনালে বলেন, তার দেবর পল্লবকে আব্দুল কাদের মোল্লা নয় বরং আক্তার গুন্ডা এবং বিহারীরা হত্যা  করে। সাহেরা কর্তৃক  আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার ঘটনাটি রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তিনি কি বলেছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি।  বরং   তাকে ম্যানেজড সাক্ষী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে রায়ে।
সাক্ষী সাহেরা  ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দীতে যা বলেছিলেন তা এখানে তুলে ধরা হল।
আমার নাম মোছা ঃ সাহেরা। স্বামী মৃত ফজর আলী। আমার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। বাসা ১১ নং তালতলা বস্তি, থানা পল্লবী। আমার স্বামী ফজর আলীরা ৫ ভাই ছিলেন। বড় ভাসুরের নাম সেকেন্দার, মেজো ফজর আলী (আমার স্বামী), মন্টু, টুনটুনি ও আব্বাস। আমার শ্বশুরের নাম মৃত মানিক সরকার, শ্বাশুড়ির নাম গোলেহার। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা সাভারে ছিলাম। সাভারে যাওয়ার আগে মিরপুর ১২ নম্বরে থাকতাম। ঐ বাসায় আমার শ্বাশুড়ি, ভাসুর, দেবর, আমি, আমার স্বামীসহ সবাই একত্রে বাস করতাম। ১২ নম্বর মুসলিম বাজার ছিল আমাদে বাসার ঠিকানা। টুনটুনির নামই পল্লব। পল্লব তখন মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বড় ছেলে ফারুক ৫ মাস বয়সের ছিল। আমার ও আমার স্বামীর ভোটার আই ডি কার্ড আমার কাছে আছে। পল্লবকে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় আক্তার গুন্ডা আর বিহারীরা হত্যা করেছে। যুদ্ধের পর সাভার থেকে আমরা আবার মিরপুরে ফিরে আসি। মুসলিম বাজারের ঈদগা মাছে টুনটুনি ওরফে পল্লবকে আক্তার গুন্ডা ও বিহারীরা হত্যা করে। আমি শুনেছি আমার দেবর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারত যাচ্ছিল তখন নবাবপুর থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে এবং মুসলিম বাজারে তাকে হত্যা করে। আমি জনগণের কাছ থেকে শুনেছি পল্লবের হত্যাকান্ডের ঘটনা। ইতিপূর্বে এই মামলার ঘটনার ব্যাপারে আমি কারো কাছে কোন জবানবন্দী দেইনি।


রায় পর্যালোচনা-৩ :
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগের ভিত্তিও শোনা কথা//
কাদের মোল্লা হত্যাকান্ডে সশরীরে অংশ নেননি//
মেহেরুন্নেসার ঘরেও  প্রবেশ করেননি


মেহেদী হাসান
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে  যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি ঘটনা হল মিরপুরে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ড।
কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লাকে  দন্ডিত করে প্রদত্ত রায়ে  বলা হয়েছে  অভিযুক্ত কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসার ঘরে  নিজে প্রবেশ করেননি হত্যাকান্ডের সময় । হত্যাকান্ডে কাদের মোল্লা নিজে সশরীরে অংশগ্রহণও করেননি। তবে  যারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তাদেরকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছেন এবং  এ  কাজে তার নৈতিক সমর্থন ছিল। কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমান নেই।
রায়ে আরো বলা হয়েছে এ হত্যাকান্ডের অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। অর্থাৎ  অভিযোগের ভিত্তি হল সাক্ষীদের শোনা কথা। 

আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ছয়টি অভিযোগ আনে। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি  মঙ্গলবার রায় প্রদান করেন। দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়। একটিতে খালাস  দেয়া হয়। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগটি ছিল দ্বিতীয় অভিযোগ।  ১৩২ পৃষ্ঠার রায়ে পাঁচটি অভিযোগে  কাদের মোল্লাকে দন্ডিত করা এবং একটিতে খালাস দেয়া বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।  প্রত্যেকটি অভিযোগের সার সংক্ষেপ তুলে ধরে উভয় পক্ষের  সাক্ষীদের সাক্ষ্য,  যুক্তি বিশ্লেষন করাসহ কেন কোন প্রেক্ষাপটে  অভিযুক্তকে দণ্ড  প্রদান বা খালাস দেয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দুই নং অভিযোগ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যার অভিযোগে কাদের মোল্লাকে দন্ডিত করা বিষয়ে রায়ে যে ব্যাখ্যা  বিশ্লেষন করা হয়েছে তা  শিরোনামসহ তুলে ধরা হল  ।

২ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে মিরপুর ৬ নং সেকশনে নিজ ঘরে  থাকা অবস্থায় স্বাধীনতাপন্থী কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা করে। এ হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং হত্যাকান্ড ঘটানোয় সহায়তার অভিযোগ আনা হয় যা আইনে বর্নিত মানবতা বিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য।

সাক্ষী : রাষ্ট্রপক্ষ কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ড বিষয়ে তিনজন সাক্ষী হাজির করে।  রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্লেষন করে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে কবি মেহেরুন্নেসা  এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার অভিযোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ শোনা সাক্ষীর ওপর নির্ভর করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ২, ৪ এবং ১০  নং সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন তারা  জানতে পেরেছেন  আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার বিহারী সহযোগী আক্তার গুন্ডা এবং অন্যান্যরা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তারা এ ঘটনা  দেখেছেন তা দাবি করেননি।
আসামী নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া  হয় তাহলে যে অর্থ দাড়ায় তাহল আসামী নিজে এ বর্বর হত্যাকান্ড  ঘটানোর ক্ষেত্রে  সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি।

সাক্ষ্য পর্যালোচনা : রাষ্ট্রপক্ষের ২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমি, আব্বাস চেয়ারম্যান, আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল এবং অন্যান্যরা মিলে ২৭ মার্চ কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই এবং মাকে করে হত্যা করে। জেরায় তার এ দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। জেরায় তিনি আবারো বলেছেন তিনি এ ঘটনা জনতার কাফেলার কাছ থেকে শুনেছেন।

রাষ্ট্রপক্ষের চার নং সাক্ষী কাজী রোজী আরেকজন শোনা সাক্ষী। তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন যে, ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি জানতে পেরেছেন  আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীরা কবি মেহেরুন্নেসা, তার দুই ভাই এবং মাকে   হত্যা করেছে তাদের ঘরে প্রবেশ করে। এর পরের বাক্যেই তিনি বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা এ হত্যাকান্ড পরিচালনা করে; কিন্তু  আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে কবি মেহের এর  ঘরে  প্রবেশ করেছিল কি-না তা বলতে পারেননি সাক্ষী। দুই দিন পরে তিনি অবাঙ্গালী গুলজার এবং আরেকজন বিহারীর  কাছ থেকে ঘটনা বিষয়ে জানতে পারেন।

উপরোক্ত দুই সাক্ষীর বক্তব্য জেরায় নির্দিষ্টভাবে অস্বীকার করা হয়নি। উপরোক্ত শোনা কথার ভিত্তিতে আমরা একটি জিনিস পেয়েছি তা হল আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে একটি দুর্বৃত্ত দল কবি মেহেরুননিসার ঘরে আক্রমন পরিচালনা করে। এ বিষয়টি আসামী পক্ষ জেরার মাধ্যমে দূর করতে পারেনি।  আসামী নিজে ঘরে প্রবেশ করেনি এটি যদি সত্য ধরে নেয়া  হয় তাহলে যে অর্থ দাড়ায় তাহল আসামী নিজে এ বর্বর হত্যাকান্ড  ঘটানোর ক্ষেত্রে  সশরীরে অংশগ্রহণ করেননি; যদিও তিনি  দুর্বৃত্তদের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নেতৃৃত্ব দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন চার নং সাক্ষী।

রায়ে প্রশ্ন  করা হয়েছে  কবি মেহেরুন্নেসা এবং তার পরিবারকে কেন টার্গেট করা হল? এর ব্যাখ্যায় রায়ে বলা হয় চার নং সাক্ষী কাজী রোজী জানিয়েছেন যে,  মিরপুরে বাঙ্গালীদের দুর্দশা দূর করার জন্য তারা একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেছিলেন যার সদস্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। ২৫ মার্চ  সকালে তারা একটি মিটিং করেন এবং বাসায় ফেরার পর  তিনি জানতে পারেন যে, তার এবং কবি মেহেরের ওপর আক্রমন  করা হবে। তিনি মেহেরকে সতর্ক করে ছিলেন বাসায় না থাকার ব্যাপারে।   তিনি (চার নং সাক্ষী) নিজে মিরপুর ছেড়ে গিয়েছিলেন।
রায়ে বলা হয় এ বিষয়টি জেরায় সম্পূর্ণভাবে থেকে গেছে। তাই এটা পরিস্কার যে, স্বাধীনতাপন্থী, প্রগতিশীল  নাগরিক হওয়ায় এবং বাঙ্গালীদের দুর্দশা লাঘবে উদ্যোগী হওয়ায়  ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট  শুরুর পরপরই আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে  কবি মেহের এবং তার পরিবারের ওপর আক্রমন চালানো হয়।

রায়ে বলা হয় ২নং সাক্ষীর বর্ননা থেকে এটা  প্রতিষ্ঠিত যে, আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭০ এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী গোলাম আযমের পক্ষে প্রচারনায় অংশ নিয়েছে সক্রিয়ভাবে। তাই আমরা নির্ভুলভবে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, স্থানীয় বিহারী আক্তার গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল গুন্ডা এবং অন্যান্যা বিহারী  গুন্ডারা আব্দুল কাদের মোল্লার সার্বক্ষনিক সঙ্গী ছিল।

অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন্নেসা হত্যাকান্ড ঘটাননি বরং অন্য  কোন এক কাদের মোল্লা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আসামী পক্ষ থেকে  চার নং সাক্ষীকে জেরার সময় সাজেশন দেয়া হয় । সাক্ষী তা অস্বীকার করেন।  আসামী পক্ষের এ সাজেশন থেকে এটা প্রমানিত যে, কাদের মোল্লা নামে একজন  দুর্বৃত্ত এ ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে। কিন্তু সেই কাদের মোল্লা যে বর্তমানে অভিযুক্ত  আব্দুল কাদের মোল্লা নয় এ মর্মে আসামী পক্ষ কোন প্রমান হাজির করতে পারেনি। কাজেই এ কুকর্মে সহকারি হিসেবে আব্দুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার   পক্ষে প্রমান হিসেবে শোনা সাক্ষী ২ এবং ৪ এর দাবি যথেষ্ট  নিশ্চয়তা প্রদান করে।

এ ঘটনার ব্যপারে রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী (১০ নং) হলেন সৈয়দ আব্দুল কাইউম। তিনি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে,  অবাঙ্গালীরা কবি মেহেরুননিসা এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।

সাক্ষ্য মূল্যায়ন এবং প্রাপ্তি :
এখানে মূলত উভয় পক্ষের যুক্তি তুলে  ধরে রায়ে বলা হয় আসামী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব  আব্দুর রাজ্জাক এ নং অভিযোগ সম্পর্কে যা বলেছেন এ ক্ষেত্রেও তাই বললেন। তিনি বলেন, ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং আল বদর কোন সহযোগী বাহিনী ছিলনা। কাজেই তিনি এর সদস্য থাকলেও বলা যায়না তিনি কোন পাকিস্তান আর্মির সহযোগী সংস্থার সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে শুধুমাত্র রাজাকার বাহিনীকে গেজেটের মাধ্যমে আর্মির কমান্ডের অধীনে  সহযোগী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।  আব্দুল কাদের মোল্লা সেসময় কোন রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন এ কথা রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেননি।  তিনি দাবি করেন  তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ প্রমানিত হয়নি।

আসামী পক্ষের অপর বিজ্ঞ আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ তিনজন সাক্ষী হাজির করেছে এবং তিনজনই বলেছেন তারা এ ঘটনা শুনেছেন।  তাছাড়া আব্দুল কাদের মোল্লা এ কাজে সহায়তা করেছে মর্মে কোন প্রমানও রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি।
আব্দুস সোবহান তরফদার বলেন, চুতর্থ সাক্ষী কাজী রোজী ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ নামে একটি বই লিখেছেন যা এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। বইটি ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে।  কাজী রোজী তার নিজের লেখা এ বইয়ে কবি মেহেরুন্নেসা হত্যা ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লা সম্পর্কে কিছুই  উল্লেখ করেননি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতেও এ ঘটনা বিষয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।
তিনি বলেন, শোনা কথার কোন মূল্য নেই। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের ১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন, কবি মেহেরুন্নেসাকে  মিরপুরের স্থানীয় অবাঙ্গালীরা হত্যা করেছে।

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ২ এবং ৪ নং সাক্ষীর শোনা কথা সম্পূর্ণরুপে নির্ভরযোগ্য এবং পারিপার্শিক অবস্থার প্রেক্ষিত বিবেচনায়  তাদের সাক্ষ্যের বিচাররিক মূল্য রয়েছে। তিনি বলেন, সহযোগী বাহিনীর সদস্য না হলেও ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে বিচারের আওতায় আনা যায় যদি দেখা যায় তিনি আইনের ধারা অনুসারে অপরাধ করেছেন।
রায়ে বলা হয়, ১৯৭২ সালের আইনে শোনা কথা (হেয়ারসে এভিডেন্স) গ্রহণযোগ্য। যদি এর বিচারকি মূল্য থাকে তবে তার ওপর ভিত্তি করে কাজ করার এখতিয়ার  রয়েছে ট্রাইব্যুনালের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশস সার্চ লাইট শুরুর পরপরই ২৭ মার্চ দুর্বৃত্তরা কবি মেহেরুন্নেসার পরিবারের ওপর হামলা করে এটা প্রমানিত  এবং তিনি যে তার ঘরে নির্মম হত্যার শীকার হন তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই।

আসামী পক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরায় এটাও প্রমান করতে পারেনি যে, এটা ছিল একটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকান্ড, কোন পরিকল্পিত  এবং সিসটেমেটিক আক্রমনের অংশ নয়। কাজেই  ঘটনার বিষয়বস্তু, ঘটনা এবং ঘটনার পারিপার্শিকতা বিবেচনায় এটা প্রমানিত যে, এটা ছিল মানবতা বিরোধী একটি অপরাধ।

২ নং সাক্ষী শহিদুল হক মামার সোনা কথার সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমানিত হয়েছে যে, ২৭ মার্চ আব্দুল কাদের মোল্লা, হাসিব হাশমিম আব্বাস চেয়ারম্যান,ত হাক্কা গুন্ডা, আক্তার গুন্ডা, নেহাল এবং তাদের সহযোগীরা  কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা এবং দুই ভাইকে হত্যা করে। জেরায় আসামী পক্ষ এটি অস্বীকার  করেছে কিন্তু দুর্বল করতে পারেনি। সাক্ষী শহিদুল হক মামা জনতার কাফেলা (ম্যাস পিপল)  থেকে এ হত্যার ঘটনা শুনেছেন। আসামী পক্ষ এটা দুর্বল করতে পারেনি। তাছাড়া তখন সেখানে যে ভয়ানক পরিস্তিতি বিরাজ করে তাতে কোন বাঙ্গালীর পক্ষে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করা স্বাভাবিক এবং সম্ববপর ছিলনা। কাজেই জনতার কাফেলা থেকে শোনাটাই স্বাভাবিক এবং সম্ভবপর। কাজেই  ঘটনা পরম্পরা, ঘটনার ধারাবাহিকতা এবং স্থানীয় বিহারীদের সাথে অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লার যোগসাজ সব বিবেচনা করলে  ২ নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য বিবেচনায় নেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

চার নং সাক্ষী কোজী রোজীর সোনা সাক্ষ্য বিবেচনা করা যাক এবার। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, তার এবং কবি মেহেরুন্নেসার ওপর আক্রমনের নির্দেশ দেয়া হতে পারে কারণ তারা অ্যকশন কিমিটর সাথে জড়িত ছিলেন যে কমিটি মিরপুরের দুর্দশাগ্রস্ত বাঙ্গালীদের সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছিল। এ ঘটনা অবিকৃত রয়েছে। এটা ইতোমধ্যে প্রমানিত হয়েছে যে, স্থানীয়  বিহারী আক্তার গুন্ডা, নেহাল গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা এবং অন্যান্য বিহারী গুন্ডারা আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গী ছিল । কাদের মোল্লা   এ গ্যাংদেরকে অপরাধ স্থলে নিয়ে যাবার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছিল। চার নং সাক্ষী থেকে আমরা আরো প্রমান পেয়েছি যে আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে মেহেরুন্নেসার ঘরে প্রবেশ করেনি।

রায়ে বলা হয় এ থেকে আমরা নির্দিধায় একথা বলতে পারি যে, অপরাধ স্থলে গ্যাংদের নিয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং অপরাধ সংঘটনের সাথে অভিযুক্তের  যোগসাজসের বিষয়টি এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের হাতে যে তথ্য প্রমান এসেছে তাতে আমরা  যা  পেলাম সেটি হল আব্দুল কাদের মোল্লা দুর্বৃত্তদের  নিরস্ত্র বেসামরিক ভিকটিম (মেহেরুন্নেসা) এর  ঘরে নিয়ে যাবার নেতৃত্ব দিয়েছে কিন্তু অভিযুক্ত আব্দুল কাদের মোল্লা নিজে এ অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে মর্মে প্রমান নেই। কাজেই চার নং সাক্ষীর শোনা সাক্ষ্য, ঘটনার পারিপার্শিকতা, বিহারী দুর্বৃত্তদের সাথে সম্পর্ক এটা নির্দেশ করে যে, এ বর্বর এ  ঘটনার সাথে তার একটা লিংক ছিল।
সেকশন ৩(২) ধারা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে হত্যা সংঘটনের জন্য আসামীকে সশরীরে ঘটনা স্থলে উপস্থিত থাকতে হবে তা প্রতিষ্ঠার করার প্রয়োজন নেই রাষ্ট্রপক্ষের। এ ধরনের অপরাধ সংঘঠনের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি যদি যেকোনভাবে প্রমানিত হয় তাহলে এর দায় দায়িত্ব হিসেবে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের দায় বর্তায় ।

আসামী পক্ষ দাবি করেছে চতুর্থ সাক্ষী কাজী রোজী বিশ্বাসযোগ্য নয়  কারণ তিনি কোর্টে এসে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার  তার নিজের লেখা বই ‘শহীদ কবি মেহেরুন্নেসা’ বর্নিত তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।
সাক্ষী শীকার করেছেন যে, তিনি তার বইয়ে কারো নাম উল্লেখ করেননি কারণ তখন দুর্বত্তদের বিচারের কোন ব্যবস্থা ছিলনা। তিনি আরো বলেছেন দুর্বৃত্তদের ভয়ে তিনি দায়ীদের নাম  উল্লেখ করেননি। এখন যেহেতু বিচারের  উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাই তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে রায়ের ব্যাখ্যায় বলা হয় কারো মৌখিক সাক্ষ্য পূর্বের বর্ননার সাথে হুবহু মিল নাও হতে পারে। পুর্বের সাক্ষাতকারে তাকে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিচারের সময় তাকে তা থেকে  ভিন্ন প্রশ্নও করা হতে পারে।  এবং কোর্টে যখন তাকে নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন সে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করতে পারে। তাছাড়া সম্ভাব্য ভয়ের কারনে তাকে এটি থেকে বিরত রাখতে পারে বলে অনুমান করা যায়। এটা অনস্বিকার্য যে, উপযুক্ত পরিবেশ পরিস্থিতি এবং সুপ্রতিষ্ঠিত  ঐকমত্যের অভাবের কারনে ১৯৭১ সালে সংঘটিত ভয়াবহ অপরাধের  অপরাধীদের বিচারের কাজ  কয়েক দশক ধরে থেমে ছিল। এ সময়ের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল স্বাধীন বাংলাদেশে  তাদের অবস্থান  আবার চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছে কোন বাঁধা ছাড়াই।
সে কারনে একজন স্বাধীনতাপন্থী ব্যক্তি হিসেবে ঝুকি এবং ভয়ের কারনে  চতুর্থ সাক্ষী তার বইয়ে সবকিছু বর্ননা করেননি  যে বই  তিনি তার সাক্ষ্য দেয়ার পূর্বে লিখেছেন। তাছাড়া বইয়ে শুধুমাত্র দুর্বৃৃত্তদের নাম নির্দিষ্ট করে  উল্লেখ না করা এবং বইয়ে কোন কিছু বাদ রাখার কারনে তিনি কোর্টে শপথ নিয়ে যা বলেছেন তা  টিকবেনা তা নয়।
অপরাধীদের নেতৃত্ব নিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া নি:সন্দেহে অপরাধ সংঘটনের একটি অংশ এবং এটি  অপরাধ সংঘটনে  নৈতিক সমর্থন, উৎসাহ যোগানোর  শামিল। অভিযুক্ত সশরীরে অপরাধ সংঘটনে অংশ নেননি শুধুমাত্র এ কারনে তাকে এর দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া যায়না যেহেতু অভিযুক্ত কর্তৃক নেতৃত্ব দিয়ে অপরাধীদের অপরাধ স্থলে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে  অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে নৈতিক সমর্থন এবং উৎসাহ যুগিয়েছে।
সুতরাং সরাসরি সাক্ষ্য নেই এ কারনে শোনা সাক্ষীকে  পাশকাটিয়ে রাখা যায়না।

রায় পর্যালোচনা-৪ :
ফরমাল চার্জ, রায় এবং সাক্ষীদের বর্ননায় ঘটনার গরমিল//
সাংবাদিক  আবু তালেব হত্যার অভিযোগের ভিত্তিও শোনা কথা


মেহেদী হাসান
আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে তিনটি অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড  প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে একটি হল সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা। এ ঘটনায়ও আব্দুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে দুজন সাক্ষীর শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে।
অপর দিকে  খন্দকার আবু তালেব হত্যার ঘটনা বিষয়ে একটি ক্ষেত্রে বিরাট গরমিল রয়েছে ফরমাল চার্জ  ও   রায়ে বর্নিত ঘটনার বিবরন এবং সাক্ষীদের জবানবন্দীর মধ্যে। ফরমাল চার্জ এবং রায়ে খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার যে বিবরন তুলে ধরা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে মিরপর ১০ নং বাস স্ট্যান্ড থেকে  আবু তালেবকে কাদের মোল্লা অন্যান্য আলবদর, রাজাকার এবং বিহারী দৃস্কৃতকারীদের নিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানায় নিয়ে হত্যা করে। অপর দিকে এ ঘটনা বিষয়ে  রাষ্ট্রপক্ষের যে দুজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা বলেছেন খন্দকার আবু তালেব ইত্তেফাক থেকে মিরপুর বাসায় ফেরার পথে ইত্তেফাকেরই  প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা বিহারী আব্দুল হালিম তাকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়। আব্দুল হালিম মিরপুরে পৌছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে  খন্দকার আবু তালিবকে তোলে এবং তাকে কাদের মোল্লা/বিহারীদের হাতে তুলে দেয়।
খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান  ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পিতার হত্যা বিষয়ে। কিন্তু তিনি ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তার সাথে বিস্তর গরমিল রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে রক্ষিত ডকুমেন্টের সাথে। সেখানে খন্দকার আবুল আহসান কর্তৃক বর্নিত তার পিতার হত্যার ঘটনার বর্ননায় দেখা যায় সেখানে আব্দুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করা হয়নি।

গত  পাঁচ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায় দেন।   তিন নং অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান বিষয়ে রায়ে বর্নিত বিশ্লেষন, মূল্যায়ন এবং যুক্তি নিম্নে তুলে ধরা হল।

৩ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ সাংবাদিক আইনজীবী খন্দকার আবু তালেব তার মিরপুর ১০ নং সেকশনে অবস্থিত বাসা থেকে  আরামবাগ যাচ্ছিলেন। তিনি মিরপুর ১০ নং বাস স্ট্যান্ডে পৌছার পর ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা  আব্দুল কাদের মোল্লা অন্যান্য আল বদর সদস্যা, রাজাকার  এবং দৃষ্কৃতকার এবং বিহারীদের সাথে নিয়ে তাকে ধরে ফেলে।  তারা খন্দকার আবু তালেবকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মিরপুর জল্লাদখানা পাম্প হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে সেখানে হত্যা করা হয়। একজন বেসামরিক ব্যক্তির হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণ এবং সহাতার কারনে তার বিরুদ্ধে আইনে বর্নিত মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে । 

সাক্ষী :  রায়ে বলা হয় এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ দুই জন সাক্ষী হাজির করেছে। এদের মধ্যে একজন হলেন খন্দকার আবু তালেবের ছেলে খন্দকার আবুল আহসান (৫ নং সাক্ষী) এবং অপর আরেকজন সাক্ষী হলেন  খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু সৈয়দ আব্দুল কাইউম (১০ নং সাক্ষী)।  তারা তখন মিরপুরে থাকতেন। তাদের দুজনেই এ হত্যাকান্ডের কথা শুনেছেন, দেখেননি।

সাক্ষ্য বিশ্লেষন : সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান  ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, ২৫ মার্চ ইত্তেফাক অফিস গুড়িয়ে দেয়ার  খবর শুনে তার পিতা খন্দকার আবু তালেব সেখানে যান তার সহকর্মীদের অবস্থা জানতে। তিনি সেখানে কিছু মৃতদেহ দেখতে পান। ২৯ মার্চ তিনি তাদের মিরপুর বাসায় আসছিলেন তার গাড়ি এবং টাকা নেয়ার জন্য। কিন্তু মিরপুর যাবার পথে ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা  অবাঙ্গালী আব্দুল হালিমের সাথে দেখা হয় তার। আব্দুল হালিম  তাকে পৌছে দেয়ার নাম করে তার গাড়িতে ওঠান এবং আব্দুল কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যান। এরপর মিরপুর ১০ জল্লাদ খানায় তার পিতাকে আব্দুল কাদের মোল্লা হত্যা করে।  এসময় আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে আক্তার গুন্ডা এবং আরো অবাঙ্গালী দুস্কৃতকারীরা ছিল।

সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান জেরায় জানান, তিনি অ্যাডভোকেট খলিল  এর কাছ থেকে শুনেছেন যে, ইত্তেফাকের প্রধান হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা আব্দুুল হালিম  তার পিতাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে কাদের মোল্লা এবং তার সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছে। জেরায় তিনি আরো বলেন, তাদের অবঙ্গালী  ড্রাইভার নিজাম তাকে বলেছেন যে,  আব্দুল হালিম তার পিতাকে আব্দুল কাদের মোল্লা এবং তার সঙ্গীদের হাতে তুলে দিয়েছে।

রায়ে বলা হয়, সাক্ষী  খন্দকার আবুল আহসান এর জবানবন্দী এবং জেরা বিশ্লেষন করলে দেখা যায়  তার পিতাকে গাড়িতে করে আব্দুল হালিম কর্তৃক নিয়ে যাওয়া এবং আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীতের হাতে তুলে দেয়ার ঘটনা বিষয়ে সাক্ষী যে শোনা কথা বলেছেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। তিনি যাদের কাছ থেকে তার পিতাকে তুলে নেয়ার ঘটনা শুনেছেন সেই অ্যাডভোকেট খলিল এবং নিজাম  ড্রাইভার কেউ জীবিত নেই।
সাক্ষী বলেছেন, তিনি নিজে তার পিতার হত্যার ঘটনা দেখেননি এবং তখনকার পরিস্থিতিতে সীমিত কিছ বাঙ্গালী  লোক ছাড়া এটা দেখা সম্ভব ছিলনা। এটা থেকে তখনকার  ভয়াবহ পরিস্থিতি বোঝা যায় এবং  খন্দকার আবু তালেবকে হত্যার ঘটনা দেখা বিষয়ে সরাসরি সাক্ষী পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে বলে রায়ে  বলা হয়।
রায়ে বলা হয় সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান আরো জানান যে, তিনি তাদের ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে পরাজয়ের পর কাদের মোল্লার নির্দেশে মিরপুরে মুসলিম বাজার, শিয়ালবারি, জল্লাদখানায় হত্যাকান্ড চালানো হয়।
১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম মিরপুরের  বাসিন্দা এবং খন্দকার আবু তালেবের বন্ধু ছিলেন। সৈয়দ আব্দুল কাইউম ২৩ মার্চ হামলায় আহত  হন এবং তাকে  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে  ভর্তি করানো নয়।   চিকিৎসা শেষে ২৭ মার্চ তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। সৈয়দ  আব্দুল কাইউম বলেছেন জুন মাসে ফারুক খান তাকে তার গ্রামের বাড়ি নাসির নগরে দেখতে আসেন।  ফারুক খানের কাছে তিনি শুনেছেন যে, স্থানীয় আক্তার গুন্ডা, বিহারী এবং কাদের মোল্লা তালেব সাহেবকে হত্যা করেছে মিপুর ১০ জল্লাদ  খানায়। এছাড়া  তালেব সাহেবের  ড্রাইভার নিজামের কাছ থেকেও তিনি  শুনেছেন যে, খন্দকার আবু তালেব মিরপুরে তার বাসায় আসার পথে ইত্তেফাকের অবাঙ্গালী হিসাব রক্ষন কর্মকর্তা   আব্দুল হালিম তাকে  বিহারীদের হাতে তুলে দেয় যারা তাকে মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় হত্যা করে।

সাক্ষ্য মুল্যায়ন : রায়ে বলা হয় খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুর ১০ জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। ৫ নং সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটা প্রমানিত যে, খন্দকার আবু তালেব ২৯ মার্চ ইত্তেফাক এর অবাঙ্গালী একাউনট্যান্ট আব্দুল হালিমের  গাড়িতে করে মিরপুরে তার বাসায় আসছিলেন। তাকে আব্দুল কাদের মোল্লার হাতে তুলে দেয়ার  ঘটনা অস্বীকার করেছে আসামী পক্ষ। কিন্তু আক্তার গুন্ডা এবং স্থানীয় বিহারী কর্তৃক তাকে হত্যার  বিষয়টি অবিকৃত রয়ে গেছে।
আসামী পক্ষ ৫ নং  সাক্ষীর শোনা কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে সাক্ষী কর্তৃক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত  স্টেটমেন্ট এবং কোর্টে প্রদত্ত জবানবন্দীর মধ্যে   পার্থক্য রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জেরায় বলেছেন, অবাঙ্গী  আব্দুল হালিম  কর্তৃক খন্দকার আবু তালেবকে গাড়িতে করে নিয়ে আসা  এবং আব্দুল কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীতের  হাতে তুলে দেয়ার কথা তার কাছে বলেননি।
আসামী পক্ষ  আরো যুক্তি উপস্থাপন করেছে যে,  সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান এবং সৈয়দ আব্দুল কাইউম দুজনেই বলেছেন যে, তারা আবু তালেবকে আব্দুল কাদের মোল্লার হাতে  তুলে দেয়ার ঘটনা ড্রাইভার নিজামের কাছে শুনেছেন।  কিন্তু সাক্ষী আব্দুল কাইউমও তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এ কথা বলেননি।
বরং এখানে যে বই প্রদর্শন করা হয়েছে (কবি মেহেরুন্নেসার ওপর লিখিত কাজী রোজীর বই)  তাতে দেখা যায় সৈয়দ আব্দুল কাইউম বলেছেন,  আবু তালেবকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
কাজেই আবু তালেবকে আব্দুল হালিম কর্তৃক মিরপুরে নিয়ে আসা তাকে বিহারী কর্তৃক হত্যার ঘটনা আসামী পক্ষও অস্বীকার করছেনা। কিন্তু  শোনা সাক্ষী খন্দকার আবুল আহসান তার পিতাকে তুলে দেয়ার বিষয়ে  কোর্টে যা বলেছেন তার সাথে অমিল রয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে  প্রদত্ত স্টেটমেন্টে। কাজেই আসামী পক্ষের দাবি  আবু তালেবকে বিহারীদের হাতে তুলে দেয়ার সাথে কাদের মোল্লার কোন সংযোগ ছিলনা এবং তিনি এ বিষয়ে কোন ভূমিকা পালন করেননি।

আসামী পক্ষ  যুক্তি তুলে ধরে আরো বলে, ১০ নং সাক্ষী সৈয়দ আব্দুল কাইউম এ ঘটনা প্রথম শুনেছেন ১৯৭১ সালে ফারুক  খানের কাছে এবং এরপর তিনি তা শুনেছেন ১৯৭২ সালে  বিহারী নিজাম ড্রাইভারের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন ফারক খানের কাছে তিনি শুনেছেন আবু তালেবকে  বিহারী,  আক্তার গুন্ডা এবং কাদের মোল্লা হত্যা করেছে মুসলিম বাজারে। কিন্তু ড্রাইভার নিজাম যেটা বলেছে তা হল বিহারীরা এবং আক্তার গুন্ডা আবু তালেবকে হত্যা করেছে ।  তার এ কথার সাথে মিল রয়েছে কাজী রোজীর লেখা বইয়ের তথ্যের সাথে। কাজেই কোনটা সত্য এ প্রশ্ন আসামী পক্ষের। 
আসামী পক্ষের দাবি পরষ্পর বিরোধী শোনা কথার ওপর ভিত্তি করে আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়না।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন যে, ৫ নং সাক্ষী তাকে বলেছেন  তিনি তার পিতাকে আব্দুল হালিমের গাড়িতে করে নিয়ে আসার ঘটনা অ্যাডভোকেট খলিলের কাছ থেকে শুনেছেন। কাজেই এটা পরষ্পর বিরোধী হতে পারেনা।
রায়ে বলা হয়েছে, সকল ফৌজদারি কেসে  মানুষের সাধারন পর্যবেক্ষন, সময়ের ব্যবধানে স্মৃতি লোপ পাওয়া,   শোকাবহ ঘটনার কারনে মানসিক পীড়ন প্রভৃতি কারনে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে গোলযোগ ঘটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কাজেই ছোটখাট বৈপরিত্য, অসামাঞ্জস্য এবং অমিলের কারনে পুরো বিষয়কে  বাতিল করা যায়না।

ঘটনার দিন আবু তালেবকে  আব্দুল হালিম কর্তৃক গাড়িতে করে নিয়ে আসা, তাকে  বিহারীদের হাতে তুলে দেয়া এবং জল্লাদখানায় হত্যার ঘটনা  অবিতর্কিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ৫ এবং ১০ নং সাক্ষীর শোনা কথা বিশ্বাসযোগ্য, প্রাসঙ্গিক  বলে মনে হয় এবং  এর বিচারকি মূল্য রয়েছে।

রায়ে বলা হয় ২ নং সাক্ষীর (শহিদুর হক মামা) কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি আব্দুল কাদের মোল্লার সহযোগী কারা ছিল এবং তাদের সাথে তার কিরকম যোগসাজস ছিল; বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে । এটা প্রমানিত যে, ২৫ মার্চ এর আগে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মিরপুর এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন  ধরনের বর্বরতার   ঘটানোর ক্ষেত্রে  আব্দুল কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল  স্থানীয় বিহারী আক্তার গুন্ডা, হাক্কা  গুন্ডা, নেহাল, আব্বাস চেয়ারম্যান, হাসিব হাশমি।   ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট শুরুর চার দিনের মাথায় ২৯ মার্চ আবু তালেব হত্যার ঘটনা ঘটে। স্থানীয় বিহারী গুন্ডাদের সাথে কাদের মোল্লার ঘনিষ্ঠতা, তার ভূমিকা এবং কর্মকান্ড বিষয়ে ২ নং সাক্ষীর কাছ থেকে আমরা পরিস্কার বর্ননা পেয়েছি। কাজেই আবু তালেব হত্যায় আব্দুল কাদের মোল্লা সহযোগীতার বিষয়টি  খুবই প্রাসঙ্গিক।
উপরোক্ত প্রমানাদি এবং ৫ নং সাক্ষীর সাক্ষ্য  একত্র করলে দেখা যায় যায় যে, আব্দুল কাদের মোল্লা, আক্তার গুন্ডা এবং কিছু অবাঙ্গালী দৃস্কৃতকারী জল্লাদখানায় ছিল যখন খন্দকার আবু তালেবকে হত্যা করা হয়।  এ ঘটনায়  আব্দুল কাদের মোল্লার সহযোগিতার বিষয়টি  ভালভাবে প্রমানিত। কাজেই আমরা নিশ্চিত যে, ৫ নং সাক্ষীর শোনা কথার বিচারিক মূল্য রয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক।

রায়ে  বলা হয়েছে মিরপুরে ১০ ভাগ বাঙ্গালী ছিল।  নিজ বাঙ্গালীদের সহযোগিতার বদলে আব্দুল কাদের মোল্লা সব  সময় বাঙ্গালী বিদ্বেষী  বিহারী গুন্ডা বিশেষ করে আক্তার   গুন্ডা, হাক্কা গুন্ডা, নেহাল এদের সাথে থাকত কেন? তার এ সহযোগিতা বিহারীদের স্বাধীনতাপপন্থী বাঙ্গালী নিধনে  উৎসাহ যোগিয়েছে।
রায়ে বলা হয় পারিপার্শ্বিক বিষয় সরাসরি সাক্ষ্যের তুলনায় কম মূল্য বহন করেনা। উপরে যে সাক্ষ্য বিশ্লেষন করা হয়েছে তাতে আবু তালেব হত্যার ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লার জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমান করে।  আক্রমনের বিষয় এবং ধরন থেকে এটা বোঝা যায় যে, এটি ছিল নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমনের একটি অংশ। খন্দকার আবু তালেব ছিলেন একজন  স্বাধীনতাপন্থী নাগরিক। কাজেই এ হত্যার ঘটনা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আমরা আগেই বলেছি যে, অপরাধ ঘটানোর সময় অভিযুক্ত’র সশরীরে হাজির থাকতে হবে  বিষয়টি এমন  নয়। যদি এটা দেখা যায় যে, তিনি এ   ঘটনা  ঘটার বিষয়ে জ্ঞাত তাহলে বলা যায় তার এতে অংশগ্রহণ রয়েছে।

জল্লাদখানা যাদুঘরের ডকুমেন্টে  যা রয়েছে : 
শহীদ খন্দকার আবু তালেব, পল্লব হত্যাকান্ড  এবং হযরত আলী হত্যাকান্ডসহ আরো অনেক হত্যাকান্ড বিষয়ে  শহীদ পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের  সাক্ষাতকার,  লিখিত বক্তব্যের মূল কপি, অডিও ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়া লিখিত  বক্তব্যের ডুপ্লিকেট কপি সংরক্ষিত আছে জল্লাদখানা যাদুঘরে।  মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত  পাম্প হাউজে  এনে ১৯৭১ সালে বিহারীরা বাঙ্গালীদের হত্যা করত। হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিত পানির ট্যাংকি এবং পার্শবর্তী ডোবায়। ১৯৯০ দশকে  এখানকার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয় এবং  অসংখ্য শহীদদের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এরপর পাম্প হাউজটিকে  জল্লাদ খানা যাদুঘর করা হয় এবং এটি বর্তমানে মুুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরের অংশ।  জল্লাদখানায় ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের পরিবারে অনেক আত্মীয় স্বজনকে খুঁজে বের করে বিভিন্ন  সময়ে তাদের সাক্ষাতকার  বক্তব্য রেকর্ড করে তা যাদুঘরে সংরক্ষন করে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

সেখানে শহীদ  সাংবাদিক    খন্দকার আবু তালেব  সম্পর্কে তার ছেলে খন্দকার  আবুল আহসানের  বক্তব্য রেকর্ড করা আছে যিনি ট্রাইব্যুনালেও সাক্ষ্য দিয়েছেন। সে রেকডে দেখা যায় খন্দকার আবুল আহসান তার পিতার হত্যার ঘটনার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার নামই উল্লেখ করেননি।
এই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর  কর্তৃপক্ষের কাছে খন্দকার আবুল আহসান  কর্তৃক  আবু তালেব হত্যা  ঘটনার যে বিবরন উল্লেখ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ। 

‘আজ দীর্ঘ ছত্রিশ বছর ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করার সমস্ত পথ পাকিস্তানি হায়েনারা বন্ধ করে দিয়ে করেছে এতিম, মাকে করেছেন উন্মাদিনী, পাগল ও বিধবা। একজনের অনুপস্থিতি একটা পরিবারের সহায়-সম্বলহীন করে দেয় তার জ্বলন্ত সাক্ষী এই শহীদ খন্দকার আবু তালেবের পরিবার।

আমার বাবা ছিলেন কর্মমুখী, দায়িত্বশীল, পরোপকারী এবং স্বাধীনচেতা একজন মানুষ জ্ঞানচর্চা, তার পছন্দের বিষয় ছিল। আমাদের ভাই-বোনের সাথে তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুসুলব। আমাদেরকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু বাবাকে হারানোর পর আমাদের সে রকম সুযোগ হয়নি ভালভাবে পড়ালেখা। আমাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। যুদ্ধের সময় দেশে মা ও ভাই-বোনকে টাকা পাঠাতাম ঢাকায়-- বিক্রি করে। আমাদের পরনে কাপড় পর্যন্ত ছিল না। আর্থিক দৈন্যের কারণে গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে লেখা করতে হয়েছে। বড় ভাইও অনেক কষ্ট করেছেন। স্বাধীনতার পর পরই তিনি প্রথমে গণ--- ৭৪ সালে দৈনিক অবজারভারে চাকরি করে সংসারের ভরণ-পোষণ করেছেন। কষ্ট করতে করতে উন্মাদিনী মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আর্থিক দৈন্য না কাটলেও আমরা বেঁচে আছি।
কারো কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। সকল শহীদ পরিবারের মতো শহীদদের স্বপ্ন--- দেশই আমাদের একান্ত কাম্য।’


রায় পর্যালোচনা৫
আলুবদি হত্যাকান্ড এবং যাবজ্জীন কারাদণ্ড  বিষয়ে রায়ে যা বলা হয়েছে


মেহেদী হাসান
আব্দুল কাদের মোল্লাকে যে দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারদন্ড প্রদান করা হয় তার মধ্যে একটি হল মিরপুরের আলুবদি  গ্রামে গণহত্যার  ঘটনা। আব্দুল  কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এটি ছিল পাঁচ নং অভিযোগ। এ ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লাকে কারাদণ্ড প্রদান বিষয়ে রায়ে উভয় পক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য  বিশ্লেষন, ঘটনার বিবরন,  মুল্যায়ন  প্রভৃতি শিরোনামে  যা বলা হয়েছে  তা নিম্নে তুলে ধরা হল।


৫ নং অভিযোগ : রায়ে  আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ৫ নং অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরন তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়- ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল  সাড়ে চারটার সময় আব্দুল কাদের মোল্লার  সদস্যরা (মেম্বারস)  পাকিস্তান আর্মি সাথে নিয়ে মিরপুর পল্লাবীর  আলুবদি গ্রামে নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ওপর আক্রমন পরিচালনা করে । আক্রমনের অংশ হিসেবে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং এতে ৩৪৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়। এ গণহত্যায় সহায়তার অভিযোগে আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

সাক্ষী : রায়ে বলা হয়েছে এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ দুই জন সাক্ষী হাজির করেছে। তারা হলেন  ৬ নং সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা এবং ৯ নং সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা। তারা দাবি করেছেন তারা এ গনহত্যা দেখেছেন এবং আব্দুল কাদের মোল্লা মূল নায়ক হিসেবে এতে অংশগ্রহণ করে। তারা সে সময় ওই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।

৬ নং সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা : এ সাক্ষী জানিয়েছেন তার বয়স তখন ১৯ বছর ছিল। ২৪ এপ্রিল সকালে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। তিনি দেখলেন গ্রামের পশ্চিম পাশে নদীর ধারে হেলিকপ্টার নামছে। এরপর নির্বিচারে গুলির শব্দ শুনে ভয়ে ভীত হয়ে দৌড়ে গ্রামের মধ্যে চলে আসলেন । এখানে সেখানে অনেক মৃতদেহ দেখলেন তিনি। গ্রামের উত্তর দিকে ঝোপের  নিচে  লুকিয়ে থাকলেন এরপর । সেখান থেকে তিনি দেখলেন   গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে  পাকিস্তান আর্মি গ্রামবাসী এবং ধানকাটা কৃষকদের ধরে আনছে। এরপর তিনি আরো দেখলেন আব্দুল কাদের মোল্লা, তার বিহারী দুস্কৃতকারী সহযোগী এবং পাকিস্তান আর্মি পূর্ব দিক থেকে গ্রামবাসী এবং ধানকাটা কৃষকদের ধরে নিয়ে আসছে এবং তাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করছে।
একটু পরে সাক্ষী দেখলেন আব্দুল কাদের মোল্লা পাকিস্তান আর্মিদের সাথে উর্দু ভাষায় কথা বলছেন। তবে তিনি তা ঠিকমত শুনতে পাননি। এরপর  ধরে আনা লোকজনের ওপর গুলি শুরু হল এবং আব্দুল কাদের মোল্লা নিজেও গুলি করে রাইফেল দিয়ে। এভাবে তারা ৩৬০/৩৭০ জনকে হত্যা করে । এর মধ্যে ৭০/৮০ জন ছিল ধানকাটা কৃষক। তার মধ্যে একজন ছিল সাক্ষীর নিজের চাচা নবিউল্লাহ। সকাল ১১টা পর্যন্ত চলে এ  আক্রমন। এসময় তারা লুটপাট এবং গ্রামের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।

ঘটনা বিশ্লেষন করে রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে, সাক্ষী কর্তৃক এ ঘটনা দেখা, পাকিস্তান আর্মির উপস্থিতিতে  আব্দুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে গুলি করতে দেখার  ঘটনা সাক্ষী মিথ্যা বলছে তার কোন কারণ আমরা দেখছিনা।
প্রশ্ন হল কাদের মোল্লাকে সে তখন চিনল কিভাবে। তিনি কি তাকে আগে থেকে চিনতেন? সাক্ষী বলেছেন তিনি তখন ছাত্রলীগ করতেন এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিনের পক্ষে প্রচারনায় অংশ নিয়েছেন। আব্দুল কাদের মোল্লা তখন ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর দাড়িপাল্লা প্রার্থীর পক্ষে প্রচারনা করেছেন।  ২ এবং ৫ নং সাক্ষীও এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।  ৫ নং সাক্ষী বলেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা তখন মিরপুর দুয়ারিপাড়ায় থাকতেন। এ থেকে বোঝা যায় সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লা  ঘটনার আগে থেকেই আব্দুল কাদের মোল্লাকে চিনতেন।
রায়ে বলা হয় রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নং সাক্ষী   আমির হোসেন মোল্লা বলেছেন আলুবদি গ্রামে প্রায় ৪০০ লোক হত্যার ঘটনায় আব্দুল কাদের মোল্লা সরাসরি অংশ নিয়েছেন। ৫ নং সাক্ষীও একথা বলেছেন।
 ৯ নং সাক্ষী তখন আলুবদি গ্রামে থাকতেন এবং তিনি  একজন মুক্তিযোদ্ধা। ৯ নং সাক্ষী আমির হোসেন মোল্লা বলেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা ছাত্রসংঘের ৭০/৮০ জন লোকজন নিয়ে বিহারীদের প্রশিক্ষন দিয়েছে পাকিস্তান রক্ষার নামে। এ থেকেও বোঝা যায় তিনিও আগে থেকেই আব্দুল কাদের মোল্লাকে চিনতেন।

এ সাক্ষী বলেছেন ২৪ এপ্রিল ফজরের সময়  গ্রামের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর তীরে  হেলিকপ্টার নামে। পূর্ব পাশ থেকে ১০০/১৫০  জন  বিহারী এবং বাঙ্গালী নিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা গ্রামে  প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলি চালায়। এরপর তারা ৬৪/৬৫ জন গ্রামবাসীকে ঘর থেকে ধরে এনে গ্রামের উত্তর পাশে লাইনে দাড় করায়। ৩০০/৩৫০ জন ধানকাটা কৃষক যারা গ্রামে আসছিল ধানকাটার জন্য তাদেরও ধরে একই স্থানে  লাইনে দাড় করিয়ে গুলি চালায়।
৯ নং সাক্ষী বলেছেন তিনি দেখেছেন সেখানে আব্দুল কাদের মোল্লা রাইফেল হাতি দাড়িয়ে ছিল। আক্তার গুন্ডার হাতেও রাইফেল ছিল। তারাও  পাঞ্জাবীদের (পাকিস্তান আর্মি) সাথে গুলি চালায়। সেখানে প্রায় ৪০০ লোক মারা যায়। সাক্ষী জেরায় বলেছেন তিনি আক্তার গুন্ডাকে চিনতেন এবং তাকে ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পর জেলে পাঠানো হয়েছিল। জেরায় তিনি আরো বলেন তিনি এবং তার পিতা গ্রামের পশ্চিম-উত্তর পাশে লুকিয়ে থেকে এ ঘটনা দেখেন। এ ঘটনায় তাদের ২১ জন আত্মীয় স্বজন প্রাণ হারায়।

মূল্যায়ন : রায়ে বলা  হয় আসামী পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সোবহান বলেন,  রাষ্ট্রপক্ষের ৬ এবং ৯ নং সাক্ষীর সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য নয় কারণ তাদের দুই জনের তথ্যে গরমিল রয়েছে।  তারা ওই সময় গ্রামেও ছিলনা। ৬ নং সাক্ষীকে ওই দিন খুব সকালে সাভারের বিরুলিয়া পাঠিয়েছিলেন তার চাচা  নবিউল্লা।  আসামী পক্ষের ৫ নং সাক্ষী আলতাফ উদ্দিন মোল্লা ট্রাইব্যুনালে একথা বলেছেন। আলতাফ উদ্দিন মোল্লা রাষ্ট্রপক্ষের ৬ নং সাক্ষী শফিউদ্দিন মোল্লার ছোটভাই। (শফিউদ্দিন মোল্লা রাষ্ট্রপক্ষে এবং তার ছোট ভাই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে)।

আসামী পক্ষের আইনজীবী দাবি করেছেন ৯  নং সাক্ষীর কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় কারণ তার বিরুদ্ধে অসংখ্য ফৌজদারি মামলা ছিল।
রায়ে মন্তব্য করা হয় সিভিল এবং ক্রিমিনাল কেসে জড়িত থাকলেই একজন যে খারাপ চরিত্রের অধিকারী তা বোঝায় না এবং এ কারনে তার শপথসহ সাক্ষ্য উড়িয়ে দেয়া যায়না।
তাছাড়া ৬ নং সাক্ষীর ছোট ভাই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা যিনি আসামী পক্ষের হয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি তখন  ওই গ্রামে ছিলনা এবং তার বয়স ছিল মাত্র সাত বছর।
রায়ে বলা হয় ২৫ মার্চ গনহত্যার মাত্র এক মাসের মাথায় মিরপুরের এ ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান আর্মি হাজার মাইল দূর থেকে এখানে আসে। গ্রাম সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা না থাকা স্বাভাবিক । গ্রামের কোথায় কি রয়েছে তাও তারা জানতনা।   পাকিস্তান সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কখন কিভাবে এবং কোন গ্রুপকে আক্রমন করতে হবে  সে বিষয়েও তাদের ধারণা ছিলনা। স্বাভাবিকভাইে স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী লোকজনই তাদেরকে এ কাজে গাইড করেছে।  এরপর রায়ে বলা হয় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস  বিবেচনায়  আমরা এ বিষয়টি  কমন নলেজ হিসেবে নিতে পারি।
পাকিস্তান সৈন্যদের তখন স্থানীয় পাকিস্তানপন্থী এবং জামায়াতে ইসলামের সাথে জড়িতদের সহায়তা নিতে হয়েছিল। আব্দুল কাদের মোল্লা তখন জামায়াতের  ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম লিখিত জীবনে যা দেখলাম বইয়েও এ তথ্য রয়েছে।

রায়ে বলা হয় সাবির্ক ঘটনা এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা এটা  বিশ্বাস করতে পারি যে, ৬ নং সাক্ষী  কর্তৃক আব্দুল কাদের মোল্লাকে ঘটনা স্থলে  রাইফেল হাতে দেখা কথা সত্য। তিনি নিজেও গুলি চালিয়েছেন রাইফেল দিয়ে ।   তবে  গনহত্যার  মূল হোতা ছিল পাকিস্তান আর্মি।

রাষ্ট্রপক্ষের ৬ নং সাক্ষীর ছোট ভাই আলতাফ উদ্দিন মোল্লা আসামীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন । তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন মূলত আসামীকে এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়ার জন্য। ঘটনার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর। গনহত্যার ঘটনা তিনি অস্বীকার করেননি।

আসামী পক্ষের সাক্ষী আলতাফ উদ্দিন মোল্লা বলেছেন সাভারে বিরুলিয়ায় তাদের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে আক্তার গুন্ডা, ডোমাম গুল মোহাম্মদসহ ৪/৫ হাজার বিহারী  পাকিস্তান আর্মির নেতৃত্বে  আলুবদি গ্রামে আক্রমনের পর তারা বিরুলিয়ায় আশ্রয় নেন। তিনি বলেছেন তার বড় ভাই শফিউদ্দিন মোল্লা তখন গ্রামে ছিল এবং ২৪ এপ্রিল যেদিন সকালে গ্রামে হেলিকপ্টার নামল সেদিন সকালে তার চাচা নবিউল্লাহ তাকে বিরুলিয়ায় পাঠিয়েছিল। তিনি (আলতাফ উদ্দিন মোল্লা) এটি  ঘটনা জানল কি করে? তার ব্যাখ্যা করা হয়নি।
রায়ে বলা হয়  নিবউল্লাহ ওই ঘটনায়  মারা যায়। কাজেই  আলতাফ উদ্দিন মোল্লা  কেমন করে জানল যে, তার বড় ভাই শফিউদ্দিন মোল্লাকে নবিউল্লা বিরুলিয়ায় পাঠিয়েছিল? এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বিস্মিত। এ বিষয়ে আলতাফ উদ্দিন মোল্লা নিশ্চুপ। তিনি ঘটনার আগে থেকেই  বিরুলিয়ায় তার পরিবারের সাথে থাকতেন। কাজেই  এটা সত্য হলে আব্দুল কাদের মোল্লা এ ঘটনার সাথে জড়িত ছিল কি-না তা  বলার উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি নন। তিনি বলেছেন আব্দুল কাদের মোল্লা তখন ঘটাস্থলে ছিলনা এবং তিনি তাকে দেখেননি। তিনি আরো বলেছেন এ মামলা শুরুর আগে তিনি আব্দুল কাদের মোল্লার নামও শুনেননি। এটাও যদি সত্য হয় তাহলে  আব্দুল কাদের মোল্লা এ ঘটনায় ছিল কি-না  তাও  তার জানার কথা নয়। আব্দুল কাদের মোল্লা সেখানে ছিলনা বলে যেকথা তিনি বলেছেন তাও অসত্য  হিসেবে গন্য এবং  এ ঘটনার সাথে আব্দুল কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতা থেকে তাকে রেহাই দেয়ার জন্য তিনি এটি বলেছেন।
আসামী পক্ষ বলেছে, ৯ নং সাক্ষী আব্দুল কাদের মোল্লাকে রাইফেল হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছে এবং অংশগ্রহণ করেছে এবং ৪০০ লোক হত্যা করা হয়েছে  বলে ট্রাইব্যুনালে যে কথা বলেছে সে কথা সে  তদন্ত কর্মকর্তার কাছে  বলেনি। আসামী পক্ষের এ দাবি অস্বীকার করেছে সাক্ষী। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, সাক্ষী তাকে বলেছেন, আব্দুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে  অসিম, আক্তার গুন্ডা, নওয়াজ, লতিফ, ডোমাসহ  ১৪০-১৫০ জন  লোক আলুবদি গ্রামে হামলা চালায়।
রায়ে বলা হয় ৪০ বছর আগের ঘটনা বর্ননায় সামান্য এদিক সেদিক হওয়া অস্বাভিক নয়।
৯ নং সাক্ষীর বিরুদ্ধে ক্রিমানল কেসের সাথে জড়িত  বিধায় তার বিশ্বাসযোগ্যতা  নেই বলে আসামী পক্ষের দাবির সাথে আমরা একমত নই। ক্রিমিনাল কেসের সাথে জড়িত থাকলেই তার চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হবে তিনি সাক্ষ্য দিতে পারবেননা তা নয়। এমনিক কারো যদি  ক্রিমিনাল কেসে  সাজাও হয় এবং  অপরাধ ঘটিয়েও থাকে তবু আমরা তার সাক্ষ্য বাতিল করার প্রয়োজন মনে করিনা।  ফৌজাদারি অপরাধে সাক্ষীর  সাজা হওয়া এবং অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িত হওয়ার  বিষয়টি  কোর্টে প্রদত্ত সাক্ষ্যকে প্রভাবিত করে কি-না সেটা হল দেখার বিষয়। এ বিষয়টি কিভাবে তার সাক্ষ্যকে প্রভাবিত বা দুর্বল করেছে তা আসামী পক্ষ প্রমান করতে পারেনি।

রায়ে বলা হয় এটা সন্দেহাতিতভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, আব্দুল কাদের মোল্লা ঘটনার ঘটনাস্থলে সময় উপস্থিত ছিল। তিনি পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তা করেছেন, অংশগ্রহণ করেছেন এবং জঘন্য এ গনহত্যায় তার নৈতিক সমর্থন ছিল। আব্দুল কালে মোল্লা শুধুমাত্র ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল আমরা যদি  শুধু এটুকুও ধরে নেই তবু এর  দায়  এবং এর প্রতি নৈতিক সমর্থন তিনি  এড়াতে পারেননা।
কাজেই আসামী আব্দুল কাদের মোল্লা রাইফেল হাতে ঘটনা স্থলে উপস্থিত ছিল  অন্যান্যদের সাথে নিয়ে এ বিষয়টি আইনগতভাবে এবং বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমান করতে পেরেছে।
Verdict analysis of abdul kader mollah
International Crimes Tribunal, Bangladesh




ট্রাইব্যুনালে মাওলানা সাঈদীর সাড়াজাগানো বক্তব্য// আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য হলে আমি যেন ঈমান নিয়ে মরতে না পারি


Mehedy Hasan
০৬/১২/২০১২
৬ ডিসেম্বর ২০১২। বৃহষ্পতিবার। মাওলানা সাঈদীর সমস্ত  বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। রায়ের তারিখ ঘোষনা করা হবে। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে গিজ গিজ করছে সাংবাদিক, আইনজীবী এবং আরো কয়েক শ্রেণি পেশার  মানুষ। ঘড়ির কাটায় তখন বিকাল সাড়ে তিনটা। উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে আইনজীবী  মিজানুল ইসলাম  ট্রাইব্যুনালের কাছে অনুরোধ করেন মাত্র পাঁচ মিনিট  মাওলানা সাঈদীকে কথা বলতে দেয়ার জন্য। কাঠগড়ায় অবস্থানরত মাওলানা সাঈদী তখন দাড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন- পাঁচ মিনিট নয় মাত্র দুই থেকে আড়াই মিনিটে  আমি শেষ করতে পারব ইনশাআল্লাহ। এরপর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক  তাকে কথা বলার অনুমতি দেন শর্তসাপেক্ষে। বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, কাউকে কটাক্ষ করে বা কোন রাজনৈতিক বক্তব্য  দেয়া হবেনা এ নিশ্চয়তা দেয়া হলে কথা বলতে দেয়া হবে।

অনুমতি পাবার পর রায়ের তারিখ ঘোষনার ঠিক পূর্ব মুহুর্তে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী মাত্র আড়াই থেকে তিন মিনিট  আবেগময়ী এবং মর্মস্পর্শী   বক্তব্য রাখেন।    নিজেকে বিশ্বাসের চূড়ান্ত এবং শেষ স্তরে সপে দিয়ে মাওলানা সাঈদী  অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারন করেন-  আমার বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার একটিও যদি সত্য হয় তাহলে আমি যেন ঈমান নিয়ে মরতে না পারি । রোজ কিয়াকমতের দিন যেন রসুল (সা) এর শাফায়াত  আমি না পাই। আর যারা আমার বিরুদ্ধে  মিথ্যা অভিযোগ  এনেছে  তারা যদি তওবা না করে এবং তওবা যদি তাদের নসিব না হয় তাহলে  গত দুইটি বছর  আমি এবং আমার সন্তানরা যে যন্ত্রনা ভোগ করেছি, আমার যে পরিমান  চোখের পানি ঝরেছে, আমার সন্তানদের যে চোখের  পানি ঝরেছে, তার  প্রতিটি ফোটা অভিশাপের বহ্নিশিখা হয়ে  আমার থেকে শতগুন যন্ত্রনা এবং কষ্ট ভোগের আগে যেন তাদের মৃত্যু না হয়। আর জাহান্নাম হয় যেন তাদের চির ঠিকানা।

মাওলানা সাঈদী বলেন, যদি আমার প্রতি  জুলুম করা হয় করা  হয় তাহলে এ বিচারের দুইটি পর্ব হবে। আজ এখানে একটি পর্ব শেষ হবে। আর কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে আরেকটি বিচার বসবে। সেই বিচারে আমি হব বাদী। আর আমার বিরুদ্ধে যারা জুলুম করেছে তারা হবে আসামী।

তিনি যখন  কথা বলেন তখন পিনপতন নিরবতা বিরাজ করে ট্রাইব্যুনালে ।
বিচার কার্যক্রম শেষে মাওলানা সাঈদীর   তিন ছেলে, আত্মীয় স্বজন এবং আইনজীবীরা  যখন তার  কাঠগড়ার সামনে যান তখন তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি তার সন্তানদের মাথায় চুমু খান। আইনজীবী এবং অন্যান্যদের সাথে করমর্দন করেন এবং দোয়া করেন। এরপর পুলিশ এসে তাকে  হাজত খানায় নিয়ে যায়।

মাওলানা সাঈদী যা বলেছেন :
আমি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের এই বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলার আপামর জনগনের  নিকট অতি পরিচিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। এই মামলায় আমার নাম বিকৃতি করে তদন্ত কর্মকর্তা কখনো দেলোয়ার শিকদার বর্তমানে সাঈদী, কখনো দেলু ওরফে দেইল্যা, দেউল্লা বলে আখ্যায়িত করেছে আমাকে।
আমার বিরুদ্ধে  চুরি ডাকাতি, জেনা ব্যাভিচার এর অভিযোগ আনছেন তিনি। তিনি ১২/১৪ বার পিরোজপুর গেছেন। রাজনৈতিক কারনে বর্তমান সরকার দ্বারা প্ররোরিচত হয়ে তিনি এসব অভিযো  এনেছেন। স্থানীয় এমপির সাথে বসে তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী সাবুদ তৈরি করেছেন।
রোজ কিয়ামতের ভয় আছে, পরকালে বিশ্বাস আছে এমন কোন মুসলমান কোন মানুষের বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ আনতে পারেনা।
আমার বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ আনা হয়েছে তার একটিও যদি সত্য হয় তাহলে আমি যেন ঈমান নিয়ে মরতে না পারি । রোজ কিয়াকমতের দিন যেন রসুল (সা) এর শাফায়াত  আমি না পাই। আর যদি আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা হয় এবং যারা এ মিথ্যা অভিযোগ এনেছে তারা যদি তওবা না করে এবং তওবা যদি তাদের নসিব না হয় তাহলে  গত দুইটি বছর আমি এবং আমার সন্তানরা যে কষ্ট এবং যন্ত্রনা ভোগ করেছে,  আমার যে চোখের পানি ঝরেছে, আমার সন্তানদের যে চোখের  পানি ঝরেছে তার  প্রতিটি ফোটা যেন  অভিশাপের বহ্নিশিখা হয়ে আমার থেকে শত গুন যন্ত্রনা ভোগের আগে, কষ্ট ভোগের আগে আল্লাহ তায়ালা যেনো তাদের মৃত্যু না দেন। মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ অযুত ধারায় বর্ষিত হোক। আর জাহান্নাম যেন হয় এদের চিরস্থায়ী ঠিকানা।

আমার  প্রতি যদি জুলুম করা হয় তাহলে এ বিচারের দুউটি পর্ব হবে। আজ এখানে একটি পর্ব শেষ হবে। আর রোজ কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে আরেকটি  বিচার বসবে। সেদিন রাজাধিরাজ, সকল সম্রাটদের সম্রাট, সকল বিচারকরদের বিচারপতি, আসমান ও জমিনের  মালিক  মহান আল্লাহ হবেন  বিচারপতি। যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে  আমার প্রতি  জুলুম করা হয় তাহলে আমার প্রতি যারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন, আজ এখানে যারা আছেন তারা হবেন আসামী। আর আমি হব বাদী। আপনাদের তিনজনের প্রতি আমি আশা রেখে বলছি আপনাদের ন্যায় বিচারের তৌফিক দান করুন আল্লাহ।



আমি হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে দাড়াতে প্রস্তুত
২৯/০১/২০১৩
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, আমি হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে দাড়াতে প্রস্তুত আছি। আমি মৃত্যুকে পরোয়া করিনা। মৃত্যু নিয়ে কোন ভয়ভীতি আমার নেই। আমি আমার যৌবন কাল থেকে শুরু করে  আজ ৭৩ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষকে পবিত্র কোরআনের দাওয়াত দিয়েছি।   কোরআনের একজন খাদেম হিসেবে গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কোরআনের দাওয়াত পৌছে দিয়েছি।  লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার মাহফিলে যোগ দেয়। অসংখ্য মানুষ এসব মাহফিল থেকে সঠিক পথের দিশা পেয়েছে।  দেশ বিদেশের লক্ষ কোটি মানুষ আমাকে  ভালবাসেন। আমি সাঈদী লক্ষ কোটি মানুষের চোখের পানি মিশ্রিত দোয়া ও ভালবাসায় সিক্ত।  এটাই কি আমার অপরাধ? আমি  কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। এটাই কি আমার অপরাধ? এটা যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে এ অপরাধে অপরাধী হয়ে হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে আমি রাজি আছি।

আলোচিত স্কাইপ কেলেঙ্কারির জের ধরে ট্রাইব্যুনাল পুনরায় গঠনের পর মাওলানা সাঈদীর মামলার ক্ষেত্রে পুনরায় যুক্তি শোনার ব্যবস্থা করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৯ জানুয়ারি ২০১৩  উভয় পক্ষের পুনরায় যুক্তি উপস্থান শেষ হলে সেদিন আবার নতুন করে  রায়ের তারিখ ঘোষনার  আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ।  রায়ের তারিখ বিষয়ে আদেশ ঘোষনার আগ  মুহুর্তে কাঠগড়ায় অপেক্ষমান মাওলানা সাঈদী দাড়িয়ে বলেন, মাননীয় আদালত আনপারা সবার কথা শুনলেন। রাষ্ট্রপক্ষের কথা শুনলেন, আসামী পক্ষের আইনজীবীদের কথা শুনলেন কিন্তু অভিযুক্ত হিসেবে আমার কথা শুনলেননা। আমরা বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে আমার কিছু কথা ছিল তা আপনাদের শোনা উচিত। আমি অতি সংক্ষেপে তা বলতে চাই।
তখন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, আপনার কথা বলার সুযোগ নাই। এরপর মাওলানা সাঈদী কথা বলতে শুরু  করেন। কথা বলা শুরুর পরপর বারবার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়।   রাষ্ট্রপক্ষের  আপত্তি এবং বাঁধার মুখে ট্রাইব্যুনালও মাওলানা সাঈদীকে অনুরোধ করেন কথা বলা শেষ করার জন্য।  আসামী পক্ষের আইনজীবীদের ট্রাইব্যুনাল অনুরোধ করেন তাকে থামানোর জন্য।  কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের বাঁধা উপক্ষো করে মাওলানা সাঈদী তার কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।  এর এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করা হলে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে  উত্তেজনা  দেখা দেয়। শেষে এ অবস্থার মধ্যে মাওলানা সাঈদী তার লিখিত বক্তব্যের মূল অংশ পড়ে  শুনিয়ে শেষ করেন।

মাওলানা সাঈদী বলেন,
২০১১ সালের অক্টোবরের ৩ তারিখ এই আদালতের তদানিন্তন চেয়ারম্যান নিজামুল হক আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পড়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি দোষী না নির্দোষ? আপনি তখন এই আদালতের  একজন বিচারক  ছিলেন। বিচারাতি নিজামুল হক ন্যায়  বিচারে ভ্রষ্ট পথ অনুসরন করেছিলেন বিধায় একরাশ গ্লানি নিয়ে স্বেচ্ছায় সরে পড়তে হয়েছে। আজ সেই চেয়ারে আপনি সম্মানিত চেয়ারম্যান। এটাই আল্লাহর বিচার। 
কোরআনের আয়াত পড়ে মাওলানা সাঈদী বলেন,  আল্লাহ  যাকে খুসী সম্মানিত করেন  আর যাকে খুসী অসম্মানিত করেন।

তিনি বলেন, সেদিন তখনকার চেয়ারম্যান নিজামুল হকের প্রশ্নের জবাবে আমি যা বলেছিলাম, সেখান থেকেই আমার সামান্য কিছু বক্তব্য শুরু করছি। নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে আমি বলেছিলাম- আমার বিরুদ্ধে আনীত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত এবং শতাব্দীর জঘন্য ও নিকৃষ্টতম মিথ্যাচার। আল্লাহ কসম! আমার বিরুদ্ধে রচনা করা চার সহা¯্রাধিক পৃষ্ঠার প্রতিটি পাতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ, প্রত্যেকটি বর্ণ মিথ্যা, মিথ্যা এবং মিথ্যা। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে কোন এক দেলোয়ার শিকদারের করা অপরাধ সমূহ আমার উপর চাপিয়ে দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যার পাহাড় রচনা করেছেন।
আজ আমি আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে আপনাদের সামনে বলতে চাই, সরকার ও তার রাষ্ট্র যন্ত্র কর্তৃক চিত্রিত ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত অপরাধের হত্যাকারী, লুন্ঠন, গণ হত্যাকারী, ধর্ষক, অগ্নি সংযোগকারী, দেলোয়ার শিকদার বা ‘দেলু’ বা দেইল্যা রাজাকার আমি নই। আমি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় জন্মভূমি এই বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের নিকট চিরচেনা পবিত্র কোরআনের একজন তাফসীরকারক, কোরআনের  একজন খাদেম, কোরআনের পথে মানুষকে আহ্বানকারী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
যে আমি সেই যৌবন কাল থেকেই শান্তি ও মানবতার উৎকর্ষ সাধনে পবিত্র কুরআনের শ্বাশ্বত বানী প্রচার করার লক্ষ্যে নিজ জন্ম ভূমি থেকে শুরু করে বিশ্বের অর্ধশত দেশ গ্রেফতারের পূর্ব পর্যন্ত ভ্রমন করেছি।  সেই আমি আজ ৭৩ বছর বয়সে জীবন সায়াহ্নে এসে সরকার ও সরকারী দলের দায়ের করা ‘ধর্র্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত হানার’ হাস্যকর ও মিথ্যা মামলায় গত ২৯ জুন ২০১০ থেকে আজ পর্যন্ত কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে মানবেতর অবস্থায় দিনাতিপাত করছি।
আমার বিরুদ্ধে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত হানার অভিযোগ উত্থাপন এবং তজ্জন্য আমাকে তড়িৎ গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার কাজটি করলো এমন এক সরকার, যারা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস কথাটি দেশের সংবিধানে বহাল রাখাকে সহ্য করতে না পেরে অবলীলায় তা মুছে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি।
এ পর্যায়ে  রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে  বাঁধা দেয়া হয় মাওলানা সাঈদীর বক্তব্য রাখা প্রসঙ্গে।  সে বাঁধা উপেক্ষা করে মাওলানা সাঈদী  তার কথা বলতে থাকেন। তিনি বলেন,  দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই ৪২ বছরের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কোন বিষয়েই কোন মামলা ছিলো না। সামান্য একটি জিডিও ছিলো না। গণতন্ত্রের লেবাসধারী বর্তমান এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের বদান্যতায়, মহানুভবতায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আজ আমি ১৭টি মামলার আসামী। সেই জুন ২০১০ থেকে অদ্যাবধি কথিত মানবতাবিরোধী ২০ টি অপরাধের অভিযোগসহ ১৭টি মামলা আমার বিরুদ্ধে দায়ের করে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে সরকার আমাকে তাদের এক রাজনৈতিক তামাশার পাত্রে পরিনত করেছে, যা আজ দেশবাসীর কাছে মেঘমুক্ত আকাশে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতই স্পষ্ট।
যে ২০টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আজ আপনাদের সম্মুখে আমি দন্ডায়মান, সেগুলো সরকারের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যেই সাজানো। ১৯৭১ সনে পিরোজপুর বা পাড়েরহাটে পাক বাহিনী যা ঘটিয়েছে, সেসব কাহিনী সৃজন করে চরম মিথ্যাবাদী ও প্রতারক এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তার সহযোগীরা

নীতি নৈতিকতার মূলে পদাঘাত করে আমার নামটি জুড়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী, মৃত্যুর পরের আযাবে বিশ্বাসী, পরকাল ও জাহান্নামের কঠিন শাস্তিতে বিশ্বাসী কোন মুসলমানের পক্ষে এতো জঘন্য মিথ্যাচার আদৌ সম্ভব নয়।
তদন্ত কর্মকর্তা এবং সহযোগিতরা তাদের সৃজিত অভিযোগগুলো প্রমানের জন্য কয়েকজন বিতর্কিত চরিত্র, ভ্রষ্ট ও সরকারী সুবিধাভোগী দলীয় লোক ব্যতিত স্বাক্ষী প্রদানের জন্য কাউকেই হাজির করতে পারেননি।
 এ সমসয় আবারো রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হয় তার বক্তব্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য। তারপরও মাওলানা সাঈদী তার কথা অব্যাহত রাখেন। তিনি বলেন,  প্রচন্ড ক্ষিপ্রতার সাথে এই ট্রাইব্যুনালের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বিচার প্রক্রিয়ার সমাপ্তি টেনেছেন। তিনি আইন-কানুন, ন্যায় বিচারের শপথ, অভিযুক্ত হিসেবে আমার বক্তব্য প্রদানের প্রাপ্য অধিকার প্রদান কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেননি বরং তিনি রায় ঘোষনার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় মহান রাব্বুল আলামিনের হস্তক্ষেপের ঘটনা। আজ সেই একদা সমাপ্তকৃত বিতর্কিত মামলার পূন: সমাপ্তির দ্বিতীয় আয়োজন। কিন্তু আমি পূর্বের ন্যায় একই উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি মামলা যেনো-তেনো প্রকারে শেষ করার সেই একই ত্রস্ততা।
মাওলানা সাঈদী বলেন, এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৃত বিবেচনায় আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলার রায় প্রকাশ করে গেছেন। সাবেক চেয়ারম্যান মিডিয়ায় প্রকাশিত স্কাইপ সংলাপকে মেনে নিয়ে অন্যায় ও বে-আইনীভাবে পরিচালিত বিচার কার্যের সকল দায়ভার বহন করে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বিদায় হয়েছেন। ষড়যন্ত্র ও অন্যায়ভাবে বিচার কার্য্য পরিচালনার বিষয়টি তার স্কাইপ কথোপকথনে প্রকাশ পেয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যানের বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে উঠে এসেছে কিভাবে সরকারের চাপে পড়ে, সুপ্রীম কোর্টের জনৈক বিচারপতির প্রলোভনে পড়ে, তথাকথিত ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের ডিকটেশন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করে এবং তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে প্রসিকিউশনের সাথে অবৈধ যোগসাজসে বিচার কার্য পরিচালনায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, আদালতের ক্ষমতাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে আমার পক্ষের স্বাক্ষীর অগ্রিম তালিকা জমা দিতে বাধ্য করে সেই তালিকা প্রসিকিউশন এবং তাদের মাধ্যমে সরকার, সরকারী দল ও স্থানীয় প্রশাসনকে সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহন করে স্বাক্ষীদের উপর চাপ সৃষ্টি ও ভয় ভীতি দেখিয়ে স্বাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালতে হাজির না হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টিসহ নানাবিধ অনিয়ম ও বে আইনী কর্মপন্থার মাধ্যমে সমগ্র বিচার কার্যটি কলুষিত করেছেন।
এ পর্যায়ে আবারো রাষ্ট্রপক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হয়। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির  মাওলানা সাঈদীকে অনুরোধ করেন থামার জন্য। তখন মাওলানা সাঈদী তার লিখিত বক্তব্য সংক্ষেপ করে বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এর পূর্বে দু’বার ক্ষমতাসীন ছিলো। তখন আমি যুদ্ধাপরাধী ছিলাম না, আমার বিরুদ্ধে কোন মামলাও হয়নি। একটি জিডিও হয়নি বাংলাদেশের কোথাও। আর তদন্ত কর্মকর্তা এই আদালতে বলেছেন ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আমি নাকি ৮৫ সাল পর্যন্ত পলাতক ছিলাম। তিনি আমাকে ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম বলে মিথ্যচার করেছে। ১৯৭৯ সালে আমি সাধারন সমর্থক হিসেবে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করি। এর পূর্বে আমি কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক ছিলাম না। ১৯৯০ সনের শুরু অবধি আমার রাজনৈতিক কোন পরিচয়ও ছিল না। ১৯৮৯ সালে আমি জামায়াতের মজলিসে শুরায় সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হই।
মাওলানা সাঈদী বলেন, দেশবাসী স্বাক্ষী, রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার কখনো কোনকালেই তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। বরাবরই আমার বিচরন ছিলো কোরআনের ময়দানে। জনগনকে কোরআনের দাওয়াত পৌঁছানোই ছিল আমার কাজ। আমার তাফসীর মাহফিলগুলোতে হাজারো লাখো মানুষ অংশগ্রহন করে। এইসব মাহফিল থেকে অসংখ্য অগনিত মানুষ সঠিক পথের দিশা পেয়েছে, নামাজি হয়েছে। এটাই কি আমার অপরাধ? দেশ বিদেশের লক্ষ কোটি মানুষ আমার উপর আস্থা রাখেন, আমাকে বিশ্বাস করেন, আমাকে ভালবাসেন। আমি সাঈদী লক্ষ কোটি মানুষের চোখের পানি মিশ্রিত দোয়া ও ভালবাসায় সিক্ত। এই ভালবাসাই কি অপরাধ? বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে আমি কোরআনের দাওয়াত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছি, এটাই কি আমার অপরাধ? আমি কোরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছি, এটাই কি আমার অপরাধ? মাননীয় আদালত এটা যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে, এ অপরাধে অপরাধী হয়ে হাজার বার ফাঁসির মঞ্চে যেতে আমি রাজি আছি। আমি  মৃত্যুকে পরোয়া করিনা। মৃত্যু নিয়ে কোন ধরনের ভয় বা ভীতি আমার মধ্যে নেই।
মাওলানা সাঈদী বলেন, আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব ও একত্ববাদ এবং কোরআনের বিপ্লবী দাওয়াত প্রচারে আমি অকুন্ঠ চিত্ত। এ কারনে সরকার তাদের ইসলাম বিদ্বেষী মিশন বাস্তবায়নে আমাকে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে আমাকে বিতর্কিত ও জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন করার এবং নিশ্চিহ্ন করার জন্যই আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আমার বিরুদ্ধে পরিচালিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চারিতার্থ করার জন্য এবং আমাকে তাদের আদর্শিক শত্রু মনে করে সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমার বিরুদ্ধে শতাব্দীর জঘন্য ও নিকৃষ্টতম মিথ্যা এ মামলা পরিচালনা করেছেন। আমি রাজাবিরাজ, স¤্রাটের স¤্রাট, সকল বিচারপতির মহা বিচারপতি আকাশও জমীনের সার্বভৌমত্বের একচ্ছত্র অধিপতি, মহান আরশের মালিক, সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নামে শপথ করে বলছি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন মানবতা বিরোধী অপরাধ আমি করি নাই।
আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে আল্লাহ! আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা, তার সহযোগী প্রসিকিউশন এবং মিথ্যা স্বাক্ষ্যদাতাদের হেদায়েত করো আর হেদায়েত তাদের নসীবে না থাকলে তাদের সকলকে শারিরিক, মানসিক ও পারিবারিকভাবে সে রকম অশান্তির আগুনে দগ্ধিভুত করো যেমনটি আমাকে, আমার পরিবারকে এবং বিশ্বব্যাপি আমার অগনিত ভক্তবৃন্দকে মানসিক যন্ত্রনা দিয়েছে। আর জাহান্নাম করো তাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা। এসময়   রাষ্ট্রপক্ষের তীব্র আপত্তি এবং  বাঁধার  ফলে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।  মাওলানা সাঈদী বলেন, আমি আমার সকল বিষয় সেই মহান আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি, যিনি আমার কর্ম বিধায়ক এবং তাঁকেই আমি আমার একমাত্র অভিভাবক হিসেবে গ্রহন করেছি। সাহায্যকারী হিসেবে মহান আরশের মালিক আল্লাহ রব্বুল আলামীন-ই আমার জন্য যথেষ্ঠ।  এর পর তিনি কথা বলা বন্ধ করেন।




২৪/৪/২০১২
শেষ বিচারের মালিকের ফয়সালার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি

বিচারের নামে আমাকে নিয়ে যা করা হচ্ছে তাতে আমি হতভম্ব, স্তম্ভিত ও বিস্ময়ে বিমুঢ়। তাই আমি আদালতের কার্যক্রম অনুসরণ করা ও বোঝার প্রচেষ্টা অনেক আগেই পরিত্যাগ করে আদালত চলাকালে পবিত্র কুরআন মাজিদ তেলাওয়াতে মগ্ন থাকি এবং শেষ বিচারের মালিকের ফয়সালার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণি। আদালতের রেওয়াজ পূরণের দায়িত্ব আমার আইনজীবিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।

আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং মিথ্যাচার একাকার হয়ে আমার জন্য যে ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির আবহ সৃষ্টি করেছে তা উপলদ্ধি কিংবা মোকাবিলা করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। আমি আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বেপরোয়া, যথেচ্ছাচার এবং তা বাস্তবায়নের এক আগ্রাসী মিথ্যাচারের শিকার।

মাননীয় আদালতের কাছে আমার একটি নিবেদন, অন্তত ৭২ বছরের বৃদ্ধ বয়সে এই রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রতিদিন আদালতে উপস্থিত থাকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে মাননীয় আদালত ও প্রসিকিউশন মিলে যা যা করার তা সম্পন্ন করতে পারেন।

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি আয়োজিত হরতালের দ্বিতীয় দিন চলছে আজ মঙ্গলবার,  ২৪ এপ্রিল২০১২। গতকাল সোমবার  হরতালের প্রথম দিনে ট্রাইব্যুনাল চলেনি। আজো হরতালের কারনে মাওলানা সাঈদীর সিনিয়র  কোন আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে আসতে পারেননি।

জুনিয়র কয়েকজন আইনজীবী আদালতে হাজির হয়ে বলেন, আমরা পায়ে হেটে এসেছি। সিনিয়র আইনজীবীগন আসতে পারেননি। একথা বলার জন্য তারা আমাদের পাঠিয়েছেন। জুনিয়র আইনজীবীরা এরপর আদালতের কার্যক্রম মুলতবি দাবি করেন। কিন্তু আদালত মুলতবি প্রস্তাবে রাজি না হয়ে কোর্ট  পরিচালনার কথা জানান। তখন   কাঠগড়ায় থাকা মাওলানা সাঈদী দাড়িয়ে আদালতের অনুমতি নিয়ে নিজে  কথা বলেন মুলতবি আবেদনের পক্ষে।

মাননীয় আদালত
দেশে আজও হরতাল পালিত হচ্ছে। ফলে সকল প্রকার চলাচল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় সঙ্গত কারণেই গতকালের ন্যায় আজকেও আমার আইনজীবীগণ আদালতে উপস্থিত থাকতে সক্ষম হননি। অনুরূপ পরিস্থিতিতে গতকাল আসামি হিসাবে আমার অবস্থান ব্যাখ্যা করার পর আপনি আদালত মুলতবী করেছিলেন। একই পরিস্থিতিতে আজকে আবার আদালত কার্যক্রম চালানোর প্রয়াস পাবেন তা আমি আশা করিনি।

মাননীয় আদালত
আমাদের দেশে হরতাল চলাকালে নি¤œ কিংবা উচ্চ আদালতের কোথাও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না। সুবিচারের স্বার্থে এ রেওয়াজ দীর্ঘদিন থেকেই বহাল রয়েছে, ব্যতিক্রম শুধু এই আদালত। তাতেও আমার কোনো আপত্তি থাকার সুযোগ থাকত না, যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার আইনজীবীগণ আদালতে হাজির হতে সক্ষম হতেন।

মাননীয় আদালত
আইন অনুযায়ী ওকালাতনামা আদালতে দাখিল করার পর আসামীর কোনো কিছু বলার অধিকার রহিত হয়ে যায়। আসামীর কৌঁসুলিই তার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এবং সুবিচার প্রাপ্তির জন্য তৎপর থাকেন, তাই আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সুবিচার পরিপন্থি। আসামি হিসাবে আমার এই অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আরো প্রনিধানযোগ্য। বিশেষ করে এমন একটি সময়ে, যখন এই সম্মানিত আদালত একাধারে আইন প্রণয়ন এবং সেই আইনকে অনুসরণপূর্বক বিচারকার্য সমাধান করার দ্বিবিধ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে স্বাক্ষ্য আইনের একটি শ্বাশত ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়ে আসামির চিরায়ত অধিকার হরণ করে আই ও-কে দিয়ে স্বাক্ষীদের প্রক্সি স্বাক্ষ্য গ্রহণের এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করছেন।

মাননীয় আদালত
আমি একজন ব্যক্তি মাত্র। আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও মিথ্যাচার একাকার হয়ে গিয়ে আমার জন্য যে ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির আবহ সৃষ্টি করেছে তা উপলদ্ধি করা কিংবা মোকাবিলা করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই।

মাননীয় আদালত
আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বিচার প্রার্থী হিসেবে আমার অবস্থান তথা অনুভূতি প্রকাশের কোনো অবকাশ থাকলে আমি বলতে চাই যে, বিচারের নামে আমাকে নিয়ে যা করা হচ্ছে তাতে আমি হতভম্ব, স্তম্ভিত ও বিস্ময়ে বিমুঢ়। তাই আমি আদালতের কার্যক্রম অনুসরণ করা ও বুঝার প্রচেষ্টা অনেক আগেই পরিত্যাগ করে আদালত চলাকালীন সময়ে পবিত্র কুরআন মাজিদ তেলাওয়াতে মগ্ন থাকি এবং শেষ বিচারের মালিকের ফয়সালার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণি। আদালতের রেওয়াজ পূরণের দায়িত্ব আমার আইনজীবিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন আইনজীবি উপস্থিত থাকার সেই নূন্যতম শর্তটা মান্য করার বিলম্বটি মেনে নেয়ার ফুসরতও যদি আপনাদের না থাকে, তাহলে সবর করা ছাড়া আমার কী বা করার আছে! আমার আইনজীবির অনুপস্থিতিতে আমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আমার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি বিচার প্রাপ্তিতে আমার কোনো পার্থক্য নির্ণয় করবে না।

এক্ষেত্রে মাননীয় আদালতের কাছে আমার একটি নিবেদন থাকবে যে, অন্ততপক্ষে ৭২ বছরের এই বৃদ্ধ বয়সে এই রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রতিদিন আদালতে উপস্থিত থাকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে অব্যহতি দিয়ে আমার অনুপস্থিতিতে মাননীয় আদালত ও প্রসিকিউশন মিলে যা যা করার তা সম্পন্ন করতে পারেন।

কার হিম্মত আছে আপনাদের কাছে জানতে চাওয়ার যে,  ঔটঝঞওঈঊ ঐটজজওঊউ ঔটঝঞওঈঊ ইটজজওঊউ বা ঔটঝঞওঈঊ ঘঙঞ ঙঘখণ ঞঙ ইঊ উঊখওঠঊজঊউ, ইটঞ ঞঙ ইঊ ঝঊঊঘ অখঝঙ -এই অমোঘ বাণীসমূহ এই আদালতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ক্ষেত্রে আপ্ত বাক্য হিসেবেই থেকে যাবে।

মাননীয় আদালত
আমি আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বেপরোয়া যথেচ্ছাচার এবং তা বাস্তবায়নের এক আগ্রাসী মিথ্যাচারের শিকার। আপনার এই মহান আদালত রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমি ব্যক্তি সাঈদীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য তথা ন্যায়বিচার করার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। আমি আপনার সেই শপথ ও দায়বদ্ধতার বিষয়ে আস্থাশীল থাকতে চাই।
আমাকে কথাগুলো বলতে দেয়ার জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

এরপর আদালত মুলতবি আবেদন বাতিল  করে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু করেন এবং     তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। মাওলানা সাঈদীর পক্ষে জুনিয়র আইনজীবীরা আদালতের অনুমতি নিয়ে বেশ কয়েকবার কোর্টরুম ত্যাগ করতে চাইলেও তাদের কোর্টরুম ত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়নি। তাদের কোর্টরুমে বসে  থাকতে বাধ্য করেন আদালত এবং এভাবে ১২টারও কিছু সময় পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহন শেষে মুলতবি করা হয়।


৩/১০/২০১১
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচার
আজ ৩/১০/২০১১ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে  চার্জ গঠন করা হল। চার্জ গঠনের আদেশ উপলক্ষে সকাল দশটার দিকে মাওলানা সাঈদীকে আদালত কক্ষের কাঠগড়ায়  হাজির করা হয়। এরপরই চার্জ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
যেসব অভিযোগে চার্জ গঠন করা হল তাকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচার হিসেবে আখ্যায়িত করলেন মাওলানা সাঈদী।
মাওলানা সাঈদী নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে দৃঢকণ্ঠে বললেন, “আমার   বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা।  একাত্তরে আমি কোনও অপরাধ করিনি । কোনও রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার তো দূরের কথা পদেও আমি ছিলাম না। মাবতাবিরোধী নয়, মানবতার পে বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে বক্তব্য দিয়েছি। আমাকে অন্য কেউ রাজাকার বলেনা। কেবল ভারতের রাজাকাররাই আমাকে রাজাকার বলে।

আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সহস্রাধিক রচনা লেখা হয়েছে। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন মিথ্যা। এমন মিথ্যা প্রতিবেদনের জন্য আল্লাহর আরশ কাঁপবে। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে যারা এমন প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। আমি সেই লানত দেখার অপোয় আছি।’

ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে অভিযোগের আদেশ ঘোষণার পর তাকে এজলাসে হাজির করা হয়। এ সময় চেয়ারম্যান তাকে বলেন, ‘আমি অর্ডার ইংরেজিতে দিয়েছি এখন আপনার সুবিধার্তে বাংলায় বলব।  আপনি  যদি দোষী বা নির্দোষ হন তা হলে বলবেন।
জবাবে মাওলানা  সাঈদী বলেন, ‘বাংলায় দেওয়ার দরকার নেই আপনার ইংরেজি অর্ডার আমি বুঝতে পেরেছি।’ এরপর  তিনি তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান। 
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান তখন বলেন, ‘এ ধরনের কোনও সুযোগ নেই। মাওলানা সাঈদী তখন  বলেন, ‘সুযোগ না থাকলে আমি দু-তিন কথায় এর জবাব দেবো। এরপর  মাওলানা সাঈদী প্রথমে সবাইকে সালাম দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন।

আপনি তখন হজ করে এসেছিলেন। হজের নুরানি আভা চেহারায় তখনো নষ্ট হয়নি। আমাকে এখানে আনার পর একজন প্রসিকিউটর আমার নাম বিকৃত করে বলেছিলেন।  আমি আশা করেছিলাম, আপনি জিজ্ঞেস করবেন, এইটা কোথায় পেয়েছেন? উনার সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট বা অন্য কোন দলিলপত্র থেকে পেয়েছেন কি-না?
কিন্তু আপনি তা করলেন না। বরং অর্ডারে ওই নামে আমাকে উল্লেখ করলেন।
আপনি একদিন বলেছিলেন, আল্লাহ আপনাকে অনেক বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। আপনি সেই দায়িত্ব পালন করতে চান। আসলেই বিচারকের দায়িত্ব অনেক বড়। হাশরের দিনে সাত শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবেন। এর প্রথম হচ্ছেন, ন্যায় বিচারক।  তাই আমি আশা করি আপনি ন্যায় বিচার করবেন।
বিচারকের দায়বদ্ধতা আল্লাহ ও বিবেকের কাছে। তৃতীয় কোন স্থানে দায়বদ্ধতা থাকলে ন্যায় বিচার করা যায় না। বরং যেটা করা হয়, সেটা জুলুম হয়ে যায়। আর জুলুমের পরিণাম জাহান্নাম। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পর মানবতা বিরোধী অপরাধের কোন অভিযোগ আসেনি। ১৯৮০ সালে জামায়াতের মজলিসে শুরার সদস্য হওয়ার পর এটা আসতে শুরু করে। যখনই এ ধরণের অভিযোগ এসেছে, আমি প্রতিবাদ করেছি, সংসদে বলেছি, মামলা দায়ের করেছি। যার অনেকগুলো এখনো বিচারাধীন রয়েছে। মানবতা বিরোধী অপরাধ করা তো দূরে থাক, বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে দেশে বিদেশে মানবতার  রক্ষায় কাজ করেছি। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে চার সহস্রাধিক পৃষ্ঠার একটি রচনা তৈরি করা হয়েছে। যারা এটা রচনা করেছেন, তাদের মনে আল্লাহর ভয় ছিলো না। তাই তারা এটা করতে পেরেছেন। রাজাকারের কমান্ডার হওয়াতো দূরে থাক, তাদের সঙ্গে আমার কোনই সম্পর্ক ছিলো না। আমি শাান্তি বাহিনীর সদস্য ছিলাম না, রাজাকার ছিলাম না। পাক বাহিনীর সঙ্গে আমি এক মিনিটের জন্যও বৈঠক করিনি।
আমি চাই, আপনি আমাকে এই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিবেন। দিতে পারবেন। আমি একজন নিরীহ মানুষ। এই অবিচার করা হলে, আল্লাহর আরশ কাঁপবে। আল্লাহর লানতে পড়বে। সারা পৃথিবী  তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে।

আমার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সহস্রাধিক রচনা লেখা হয়েছে। ‘এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন মিথ্যা। এমন মিথ্যা প্রতিবেদনের জন্য আল্লাহর আরশ কাঁপবে। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে যারা এমন প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে। আমি সেই লানত দেখার অপোয় আছি।’
আমি কখনোই শান্তি কমিটিতে বা রাজাকার- আলবদর ছিলেন না। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে এক দিনের বা এক মিনিটের জন্যও আমার সাথে কোন সম্পর্ক ছিলনা। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দুর্ভাগ্যজ্জনক। সুরা হুজরাতের ১১ নং আয়াতে  নামের বিষয়ে বলা আছে- ‘কোনও মানুষকে বিকৃত করে ডেকোনা।’

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর আরশের নিচে সাত শ্রেণীর মানুষ ছায়া পাবে। তার মধ্যে ন্যায় বিচারকরা প্রথমেই রয়েছেন। আপনাদের (ট্রাইব্যুনাল) কাছ থেকে সেই ন্যায় বিচার আশা করি। তাই আপনি ন্যায় বিচার করবেন। তিনি বলেন, বিচারকদের নিরপেক্ষতা, বিবেক, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা না থাকলে সুবিচার নিশ্চিত হয়না।

‘৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক যুগের বেশি সময় আমাকে নিয়ে কোনও কথা হয়নি।  ১৯৮০ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়ার পর আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় আমাকে গ্রেফতারের পর। আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে সরকার গঠন হয়। সেই সংসদে আমি ২০ মিনিটের বক্তব্য দিয়ে বলেছিলাম, আমি রাজাকার নই। সেই ২০ মিনিটের বক্তব্যের একটি কথাও এক্সপাঞ্জ করা হয়নি।’

বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনাল সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির বলেন, ‘সাঈদী সাহেব তারা (রাষ্ট্রপ) যদি আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারে, তাহলে আপনি মুক্তি পাবেন।’
তখন মাওলানা সাঈদী বলেন,  ‘আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ’ । এই বলে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।  মাওলানা সাঈদীর বক্তব্যের সময় আদালতে  পিন পতন নিরবতা বিরাজ করে। । প্রসিকিউটর কিংবা সরকার পক্ষে নিযুক্ত কেউই এ বক্তব্যের বিরোধিতা কিংবা দ্বিমত পোষণ করেননি। সবাই সম্মোহিতের মত এই খ্যাতনামা আলেমে দ্বীনের বক্তব্য শোনেন। বক্তব্য শোনার পর ট্রাইব্যুনাল ৩০ অক্টোবর থেকে অভিযোগের ওপর শুনানি শুরুর দিন ধার্য্য করেন।





হে আল্লাহ তোমার ইজ্জতের কসম ৭১ এর কোন কাদা আমার গায়ে লাগেনি। আমি মজলুম তোমার  কাছে বিচার চাই
ছেলের জানাজার পূর্বে  মাওলানা সাঈদী


 ১৪/৬/২০১২
 হে আল্লাহ আমি মজলুম। আল্লাহ আমি তোমার কাছে বিচার চাই। আমি  গত ৫০ বছর ধরে  সারা দেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তোমার কোরআনের কথা প্রচার করেছি। আজ আমাকে বলা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী। ও আল্লাহ তোমার ইজ্জতের কসম, তোমার জাতের কসম, তুমি সাক্ষী  ১৯৭১ সালের কোন কাদা  এবং কাদার এক ফোটা পানিও আমার গায়ে লাগেনি। 

আজ বৃহষ্পতিবার ১৪/৬/২০১২ বড় ছেলে রাফকী বিন সাঈদীর জানাজার নামাজের পূর্বে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী  একথা বলেন। মতিঝিল বয়েজ স্কুল মাঠে  সন্ধ্যার পূর্বে অনুষ্ঠিত জানাজায় বিশাল মাঠের গন্ডি পেরিয়ে পুরো রাজারবাগ, শাহজাহানপুর  এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। স্থবির হয়ে পড়ে  ওই এলাকার সকল রাস্তাঘাটের চলাচল ব্যবস্থা।

মাওলানা সাঈদী  অগনিত মানুষের সামনে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, হে আল্লাহ আমি  তোমার জন্য  শহীদ হতে প্রস্তুত আছি।  তবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে, হত্যাকারী হিসেবে, ধর্ষণকারী হিসেবে, চোর, লন্ঠনকারী হিসেবে আমি ফাঁসি কেন একদিনেরও  সাজা চাইনা। এসব অপবাদ নিয়ে  আমি মরতে চাইনা। হে আল্লাহ আমি মজলুম। মজলুমের দোয়া এবং তোমার মাঝে কোন পর্দা নাই। আমি তোমার কাছে বিচার চাই।
এরপর মাওলানা সাঈদী বলেন, হে আল্লাহ তুমি হয় জালিমকে হেদায়েত দাও না হয় তাদের বিদায় কর। হে আল্লাহ ১৬ কোটি মুসলমানের দেশ বাংলাদেশকে তুমি  কাশ্মীর বানিওনা, আফগান বানিওনা, ইরাক বানিওনা। বাংলাদেশকে  তুমি রক্ষা কর।
হে আল্লাহ  মুসলমানের দেশে আজ মুসলমান তার পরিচয় নিয়ে চলতে পারেনা। তাদের বেইজ্জতি করা হচ্ছে।
মাওলানা সাঈদী বলেন, আমার কোরআন প্রচার  নাস্তিকক্যবাদীরা পছন্দ করেনা। সে কারনে আমাকে বন্দী করে রেখেছে।

৬টা ১০ মিনিটে মাওলানা সাঈদীকে প্রিজন ভ্যানে করে  কড়া পুলিশী নিরাপত্তায় মাঠে নিয়ে আসা হয়। এসময় উপস্থিত জনতা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। নারায়ে তাকবীর  আল্লাহু আকাবর বলে স্লোগান দেয় তারা। তবে জানাজা আয়োজক কর্তৃপক্ষ মাইকে  তাদের কোন ধরনের স্লোগন দিতে নিষেধ করেন এবং মাওলানা সাঈদীকে নির্বিঘেœ মাঠে প্রবেশে সহায়তা করতে অনুরোধ করেন।
মাওলানা সাঈদী  ছেলের লাশের কাছে আসলে জানাজা আয়োজক কর্তৃপক্ষ মাওলানা সাঈদীকে   উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে সালাম  জানানোর অনুরোধ করেন তাকে পাহারাত পুলিশের প্রতি।
এরপর মাওলানা সাঈদী মাইক নিয়ে  উচ্চস্বরে সালাম  দেন। এরপর ইন্নালিল্লাহ পড়েন। এসময় তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নার রোল এসময় ছড়িয়ে পড়ে উপস্থিত শোকাহাত হাজারো জনতার মাঝে। সবাই হুহু করে কাঁদতে থাকেন মাওলানার সাথে।
কান্না থামিয়ে মাওলানা সাঈদী এরপর বলেন, হে আল্লাহ  কয়েক মাস আগে এই এখানে আমি আমার মায়ের জানাজা পড়িয়েছি।
আমাকে আমার বাসায় যেতে দেয়া হয়নি। আমাকে আমার পরিবার পরিজনের সাথে বাসায় গিয়ে মিলিত হতে দেয়া হয়নি।
আজ এখানে আমার ছেলে আমার কলিজার টুকরার জানাজায় আমাকে নিয়ে আসা হল।
হে আল্লাহ  দুনিয়াতে সবচেয়ে ভারী বোঝা হল পিতার কান্ধে পুত্রের লাশ। আমার ছেলে রাফীককে আমি বলতাম তুমি আমার জানাজা পড়াবা। রাফীক বলত না তুমি আমার জানাজা পড়াবা। আজ আমি তার জানাজা পড়াচ্ছি। এসময় আবার তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সাথে সাথে কাঁদতে থাকেন জানাজার উদ্দেশে আগতরা।
মাওলানা সাঈদী বলেন, আমার বড় ছেলে গতকাল  বুধবার  বিকালে মারা গেছে। আজ আছরের সময় আমাকে জানানো হয়েছে। একথা বলে তিনি আবারো কাঁদতে থাকেন।
মাওলানা সাঈদী বলেন, হে আল্লাহ আমার কলিজার টুকরা, হে আল্লাহ আমার কলিজার টুকরা, হে আল্লাহ আমার কলিজার টুকরা রাফীককে তুমি বেহেশত দান কর। তার কবরকে তুমি জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দিও। তার কবরের সাথে  তুমি জান্নাতের সরাসরি রাস্তা করে দিও। বেহেশতে তুমি তার সাথে আমাকে মিলিত করে দিও।

মাওলানা সাঈদী বলেন, আমার ছেলে গতকাল  ট্রাইব্যুনালে ছিল ।   কোর্ট রুম থেকে বের হয়ে যাবার সময় আমাকে বলে যেতে পারেনি। আমি বুঝতে পারিনি ওটাই ছিল আমার সামনে তার শেষ যাত্রা।
এরপর মাওলানা সাঈদী উপস্থিত সবাইকে নিয়ে তাহ তুলে দোয়া করেন আল্লাহর দরবারে।
তিনি বলেন, হে আল্লাহ রাফীকের তিনটা ছেলে মেয়ে আছে। আমি তার সন্তান এবং তার স্ত্রীকে তোমার উপর সোপর্দ করলাম।
তারপর  সাড়ে ছয়টার দিকে তিনি জানাজা পড়াতে শুরু করেন তিনি।