সোমবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৫

কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

মেহেদী হাসান, ১১/৪/২০১৫
 জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের  মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আজ রাত ১০ টা  ৩০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রেীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে কামারুজ্জামানের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।

আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে রাত ১১টা ৪০ মিনিটে অ্যাম্বুলেন্স যোগে কড়া প্রহরায় কামারুজ্জামানের লাশ তার জন্মস্থান শেরপুরের বাজিতখিলার উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একজন ডেপুৃটি জেলারের তত্ত্বাবধানে পাঁচ সদস্যের কারা কর্মকর্তরা তার লাশ নিয়ে শেরপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হন।

সিনিয়র জেলসুপার ফরমান আলী রাত ১১টা ৪৩ মিনিটে কারাগার থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, রাত ১০টা ৩০ মিনিটে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তিনি প্রাণভিক্ষা চাননি।

কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড  কার্যকর বিষয়ক সরকারের নির্বাহী আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিকাল পৌনে তিনটায় কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌছায়।
দণ্ড কার্যকর উপলক্ষে  সন্ধ্যার পর থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বিপুল সংখ্যাক র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, কারারক্ষী এবং সাদা পোশাকে গোয়েন্দা  সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। কারাগারের আশপাশের এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার পর থেকে পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে নির্দিষ্ট কয়েকটি রোডে পুলিশ, সাংবাদিক এবং প্রশাসনের যানবাহন ছাড়া সব গাড়ি এবং লোকজনকে বের হয়ে যেতে বলা হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ঘিরে পুরো রাজধানীজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয় সন্ধ্যার পর থেক্ েগুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়।
বিকাল চারটার দিকে  কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা কারাগারে আসা উপলক্ষে দুপুরের পর থেকেই  বিপুলসংখ্যক দেশী বিদেশী সাংবাদিক জড়ো হয়।

সন্ধ্যা সাতটার পরে কারাগারে একটি অ্যাম্বুলেন্স (ঢাকা মেট্রো-চ ৭৪-০১২৭) প্রবেশ করে ।
সন্ধ্যা ছয়টা ৪৫ মিনিটে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখারুজ্জামান প্রবেশ করেন। সাতটার দিকে প্রবেশ করেন অতিরিক্ত আইজিপি কর্ণেল বজলুল কবির। সোয়া সাতটায় প্রবেশ করেন সহকারি সিভিল সার্জন আহসান হাবিব। এরপর প্রবেশ করেন লালবাগ জোনের ডিসি।

কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল ওয়ামি জানান,  দুপুর  সোয়া একটার দিকে ডেপুটি জেল সুপার তাদেরকে ফোনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসতে বলেন কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করার জন্য।    বিকাল চারটা দশ মিনিটে কামারুজ্জামানের ২২ জন নিকট আত্মীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। সাক্ষাত শেষে পাঁচটা ২০ মিনিটে তারা বের হয়ে আসেন।  কারাফটকের সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের হাসান ইকবাল ওয়ামি জানান, তার বাবা প্রাণভিক্ষা চাননি। তিনি বলেছেন প্রাণ দেয়ার এবং নেয়ার মালিক  আল্লাহ। রাষ্ট্রপতির কাছে  প্রাণভিক্ষার কোন প্রশ্নই আসেনা।

এর আগে গত ছয় এপ্রিল রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পর ওইদিনই কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের কেন্দ্রীয় কারাগারে ডেকে আনে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। এ প্রেক্ষিতে ওইদিন রাতেই কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিচারপতিদের স্বাক্ষরিত রায় কারাগারে না পৌছানোয় দণ্ড কার্যকর করা থেকে বিরত থাকে কর্তৃপক্ষ। এরপর আট এপ্রিল রিভিউ মামলার রায়ের কপিতে বিচারপতিদের স্বাক্ষর এবং তা ওইদিন কারাগারে পাঠানোর পর যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর হতে পারে মর্মে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বলা হতে থাকে। কারাগার সূত্র এবং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ফাঁসি কার্যকরের জন্য সব প্রস্ততি নিয়ে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় নয় এপ্রিল কামারুজ্জামানের সাথে দেখা করেন তার আইনজীবীরা। সাক্ষাত শেষে অ্যাডভোকেট শিশির মো : মনির সাংবাদিকদের জানান, কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না সে বিষয়ে তিনি যথযথ কর্তৃপক্ষকে যথা সময়ে জানাবেন।
এরপর গত শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন দুজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কামারুজ্জামানের প্রাণভিক্ষা বিষয়ে জানার জন্য  তারা কারাগারে যাচ্ছেন কি-না সাংবাদিকরা  কারা ফটকে জানতে চাইলে তারা এ বিষয়ে কোন কিছু জানাতে অস্বীকার করেন।


১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়  এর আগে  ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর  জামায়াতের আরেক সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

গত ৬ এপ্রিল সোমবার  প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন । গত ৮ এপ্রিল  রিভিউ রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেন চার বিচারপতি। এরপর গতরাতে কার্যকর করা হল তার মৃত্যুদণ্ড।

৬ এপ্রিল সোমবার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পরপরই কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখে কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষ। কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যদের কাছে ওইদিন দুপুরের পর চিঠি পাঠানো হয় বিকেল পাঁচটার মধ্যে কারাগারে এসে দেখা করার জন্য। তখন খবর ছড়িয়ে পড়ে সেদিন রাতেই কার্যকর হচ্ছে মৃত্যুদন্ড । তবে বিচারপতিদের স্বাক্ষরিত  রিভিউ রায়ের কপি কারাগারে না পৌছায় কারা কর্তৃপক্ষ দণ্ড কার্যকর করা থেকে বিরত থাকে।

মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি অভিযোগে  মৃত্যুদণ্ড দেয়। গত বছর ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের একটি অভিযোগ বহাল রাখেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। মৃত্যুদণ্ডের আরেকটি সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করেন।
গত ৬ এপ্রিল কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। এর  মাধ্যমে আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত বছর ৩ নভেম্বর যে রায় দিয়েছিলেন তা চূড়ান্তভাবে বহাল থাকে।


মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরন :
১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। 

ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে  অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে মোট পাঁচটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়া  হয়।  দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দুটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং অপর আরেকটি অভিযোগে ২০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষনার এক মাসের মধ্যে আসামী পক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করে। গত বছরের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেন। আপিল বিভাগের সংখ্যাগষ্ঠি রায়ে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া আরেকটি মৃত্যুদণ্ডকে যাবজ্জীবন করা হয়। 
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
৫ মার্চ আসামী পক্ষ রিভিউ আবেদন দায়ের করে আপিল বিভাগে। ৫ এপ্রিল শুনানী শেষে ৬ এপ্রিল  রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় দেন আপিল বিভাগ। ফলে ৩ নভেম্বর মুত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেয়া রায়  বহাল থাকে। ৮ এপ্রিল রিভিউ রায়ে স্বাক্ষর করেন চার বিচারপতি।


ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার  নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের  বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
আপিল  মামলায় কামারুজ্জামানের পক্ষে প্রধান আইনজীবী ছিলেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাকে সহায়তা করেন অ্যাডভোকেট শিশির মো : মনির।

কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি  জিকেএম ইনস্টিটিউশন  থেকে চার বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭২ সালে ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৭৩ (১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত) সালে তিনি ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে ডিস্ট্রিংশনসহ বিএ পাস করেন। এরপর  ১৯৭৬ সালে কামারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন।

১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৯২ সালে  এ দলের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাহিত হবার আগে তিনি দীর্ঘদিন দলের কেন্দ্রেীয় প্রচার সম্পাদকসহ অন্যান্য  গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। জামায়াতে যোগ দেয়ার আগে তিনি  ১৯৭৮-৭৯ সালে দ্বিতীয়বারের মত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন।

মুহম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৮০ সাল থেকে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। দীর্ঘদিন তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি  সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কামারুজ্জামান এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের আন্দোলনে লিয়াজো কমিটির একজন সদস্য ছিলেন।
একজন লেখক এবং সুবক্তা হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে।  তিনি স্ত্রী,  পাঁচ ছেলে, ও এক মেয়ে  রেখে গেছেন। 

লাশ দাফনের প্রস্তুতি :
কামারুজ্জামানের ইচ্ছা অনুযায়ী তার প্রতিষ্ঠিত বাজিতখিলা কুমরী এতিমখানার পাশে লাশ দাফনের প্রস্তুত চলছে। রাত ১১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত শেরপুর সংবাদদাতা জানান, কামারুজ্জামানের আত্মীয়স্বজনরা কবর খননের কাজ করছেন। নিরাপত্তার জন্য সেখানে দুই প্লাটুন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন