সোমবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৪

কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল// আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়

মেহেদী হাসান  ০৩/১১/২০১৪
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের  মৃত্যুদণ্ড বহালা রাখা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ  সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখেন।

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ আজ মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। আজ আপিল বেঞ্চ এর মধ্যে একটি অভিযোগে ( ৩ নং অভিযোগ সোহাগপুর গণহত্যা)  তার মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বহাল রাখেন। মৃত্যুদন্ডের আরেকটি শাস্তি  বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া  হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে  পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা  দেয় ট্রাইব্যুনাল। ৩ এবং ৪ নং অভিযোগে  মৃত্যুদণ্ড, ১ এবং ৭ নং অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আজ আপিল বিভাগের রায়ে ২ এবং ৭ নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত  সাজা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। ১ নং অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।
আপিল বিভাগের রায়ে যে অভিযোগে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখা হয়েছে সেটিতে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং  মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে। আর মৃত্যুদন্ডের যে সাজা বাতিল করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে সেটিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে।

গত বছর ৯ মে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়  ট্রাইব্যুনাল-২।

মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করে আসামী পক্ষ।  গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানী শেষে রায় ঘোষনা অপেক্ষমান রাখা হয়।

গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর  জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ মৃত্যুদন্ডের চূড়ান্ত রায় ঘোষনা করেন।
আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছর ৫ ডিসেম্বর । পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করা যাবে কি যাবেনা এ নিয়ে বিতর্ক চলা অবস্থায় ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ১২টার পর ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেয়া হয় এবং সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষনাও দেয়া হয়। ওই দিনই  রাত সোয়া দশটায় সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ফাঁসি কার্যকর পরের দিন বুধবার সকাল দশটা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন। ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর রাতে কার্যকর করা হয় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি।

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :
রাষ্ট্রপক্ষের আনিত অভিযোগে এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক এবং তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসেবে শেরপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, আলবদর এবং রাজাকার বাহিনী কর্তৃক স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে হত্যা, নির্যাতন, অপহরন গুম, ধর্ষনসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় আনা হয়েছে কামারুজ্জামানের ওপর।  শেরপুরে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের  মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড তার পরামর্শ এবং  সহযোতিায়  পরিচালিত হত বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।

মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনিত সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে সাজা দেয়। এ পাঁচটি অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল বিভাগের সাজা এখানে উল্লেখ করা হল।

১ নম্বর অভিযোগ : বদিউজ্জামানকে অপহরন করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়েছে।

২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো এবং পেটানো হয়।  এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগে এ সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার এবং আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড়শতাধিক মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য নারী ধর্ষনের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ সাজা বহাল রেখেছে।
৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপর মোস্তফবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে ধরে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামানসহ অন্যান্যরা মিলে একটি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে যাবজ্জীবন দিয়েছে।  
৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধচলাকালে ময়মনসিংহ গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া এবং তার ছেলে জহুরুল ইসলাম দারাকে ধরে জেলাপরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে আনা হয়। পরেরদিন সকালে তারা দুজনসহ সাতজনকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীরে আনা হয়। এসময় টেপা মিয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং বাকীদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্টতার  ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ।  আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়।




মুহম্বদ কামারুজ্জামানের আপিল শুনানীর জন্য বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এএইচএম শাসসুদ্দীন চৌধুরী।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি: মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি  জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করেন। এরপর জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজে আইএসসি’তে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। কামারুজ্জামান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা কিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি  সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি দৈনিক সংগ্রমের নির্বাহিী সম্পাদক ছিলেন। 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন