মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদনের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ :রিভিউ’র অধিকার পাবে দন্ডিতরা

 
মেহেদী হাসান, ২৫/১১/২০১৪
আাপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ বা পুনরায় বিবেচনার জন্য  আবেদন করার সুযোগ পাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দন্ডিতরা।

আপিল বিভাগ আজ  আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে। রায়ে বলা হয়েছে রিভিউ আবেদন সমর্থনীয় (মেনটেনঅ্যাবল)। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবেনা। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হবে। রায়ে আরো বলা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে জেলকোডের সাত অথবা ২১ দিনের নিয়ম প্রযোজ্য নয়। রায়ে বলা হয়েছে  মেরিট না থাকায় আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়েছে । 

আপিল বিভাগের এ রায়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হল যে, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এবং রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির আগে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কোন সুযোগ নেই। সেই সাথে তিনি রিভিউ আবেদন করতে পারবেন কি পারবেননা তা নিয়ে বিতর্কেরও অবসান হল।

যুদ্ধাপরাধ তথা ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পরবর্তীতে যদি আপিল বিভাগ কোন রায় দেন তাহলে সে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার সুযোগ থাকছে।  তবে রিভিউ’র এ সুযোগ আপিলের সমান নয় বলে আজকের  রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারনত কোন মামলায় আপিল বিভাগ কর্তৃক পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের  ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ করতে হয়। তবে আজকের  রায়ে আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছেন ১৯৭৩ সালের আইনে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য নয়। এ ক্ষেত্রে ৩০ দিনের পরিবর্তে ১৫ দিন কমিয়ে আনা হয়েছে। 

গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। পাঁচ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। আট ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুপরোয়ানা পাঠানো হয়। ১০ ডিসেম্বর সরকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেয়। রাত ১২টা এক মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়। এর  প্রেক্ষিতে রাতেই আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীরা ছুটে যান চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর বাসায়। সেখানে তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত করা বিষয়ে এবং রিভিউ আবেদন জমা দেন। চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রাত সাড়ে দশটায় আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর স্থগিত করে আদেশ দেন। পরের দিন ১১ ডিসেম্বর সকালে প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের  আপিল বেঞ্চে শুনানী শুরু হয়  রিভিউ আবেদন এবং মৃত্যুদণ্ড স্থগিত আদেশ এর মেয়াদ বাড়ানো বিষয়ক আবেদনের ওপর। ওইদিন শুনানী অসমাপ্ত অবস্থায় আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়। ১২ ডিসেম্বরও চলে শুনানী। শুনানী শেষে আদালত আব্দুল কাদের মোল্লার  রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। ওই দিন রাতেই কার্যকর করা হয় ফাঁসি।

পাঁচ ডিসেম্বর আব্দুল কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরপরই  তুমুল  বিতর্ক শুরু হয় আব্দুল কাদের মোল্লা রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কি পাবেননা তা নিয়ে। আসামী পক্ষ দাবি করেন তিনি রিভিউ সুযোগ পাবেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেলসহ অন্যান্যরা দাবি করেন তিনি এ সুযোগ পাবেননা। বিতর্কের এ পর্যায়ে এক পক্ষ মত দেন বিষয়টি এখন আপিল বিভাগই নিষ্পত্তি করতে পারে। এভাবে বিতর্ক নিষ্পত্তি হবার আগেই সরকার ১০ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকরের ঘোষনা দেয়। আসামী পক্ষ অপেক্ষায় ছিল  ৩০ দিনের মাথায় তারা রিভিউ আবেদন করবে । কিন্তু ১০ তারিখ সরকার ফাঁসি কর্যকরের উদ্যোগ নেয়ায় তারা বাধ্য হয়ে ছুটে যান চেম্বার বিচারপতির কাছে এবং ওই রাতেই তারা রিভিউ আবেদন দায়ের করে। ১২ ডিসেম্বর আদালত রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। কিন্তু কোন গ্রাউন্ডে এটি খারিজ করা হয় সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে তখন কোন কিছু উল্লেখ ছিলনা। রিভিউ আবেদন কি মেনটেন্যাবল নয় না কি এর কোন মেরিট নেই সে গ্রাউন্ডে খারিজ করা হয়েছে আবেদন তার কোন কিছু বলা হয়নি। গতকাল পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে আবেদনে মেরিট না থাকায় আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন খারিজ করা হয়েছে। তবে রিভিউ আবেদন মেনটেনঅ্যাবল।

গত ৩ নভেম্বর মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগ রায় ঘোষনা করেন। রায় ঘোষনার পর আবারো শুরু হয় রিভিউ নিয়ে বিতর্ক তুমুল। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বারবার স্পষ্ট করে বলেন, কামারুজ্জামান রিভিউ করার সুযোগ পাবেননা। ফাঁসি কার্যকরের জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষারও দরকার নেই। সংক্ষিপ্ত রায়ের কপি দিয়েই দণ্ড কার্যকর করা যাবে। কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও সাংবাদিকদের বলেন, কামারুজ্জামান প্রাণ ভিক্ষার জন্য সাত দিন সময় পাবেন। এরপরই তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। ফাঁসি কার্যকর করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুতির নিদের্শ দেয়ার কথাও জানান তিনি।
অপর দিকে আসামী পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হয় কামারজ্জামান রিভিউ করার সুযোগ পাবেন এবং পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে দণ্ড কার্যকরের কোন সুযোগ নেই। এটা হবে বেআইনী । ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুরি জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে তার নির্দেশনাকেও আইন এবং কর্তৃত্ব বহির্ভূত হিসেবে আখ্যায়িত করেন আসামী পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির। বির্তকের এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল তার অবস্থান থেকে সরে এসে শেষে বলেন রিভিউ করার সুযোগ পাবেন কি পাবেননা এ বিষয়টি আপিল বিভাগের ওপর নির্ভর করছে।
এ অবস্থায় আজ আপিল বিভাগ এ রায় প্রকাশ করলেন। আর এর মাধ্যমে রিভিউ এবং কামারুজ্জামানের ফাঁসি কবে কার্যকর হবে এ নিয়ে বিতর্কের অবসান হল।
আব্দুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন শুনানী গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী।
মুহম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মনির দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৮ দিনের পরে নয় এমন যেকোন সময় ফাঁসি কার্যকর করার বিধান। এর মধ্যে সাত দিন সময় থাকে প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য। যেহেতু ১৯৭৩ সালের আইনে দন্ডিতদের ক্ষেত্রে জেলকোডের সাত অথবা ২১ দিনের বিষয়টি প্রযোজ্য নয় বলে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে তার মানে এটা এখন সরকারের হাতে। মৃত্যুপরোয়ানা জরির পর সরকার যখন চাইবে তখন ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।
গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।  এ রায়কে কেন্দ্র করে  শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠে । আন্দোলনকারীদের দাবি আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতে হবে। এ  দাবির প্রেক্ষিতে  ১৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়  সরকার পক্ষের জন্য আপিলের বিধান রেখে।  আইন সংশোধনের পর সরকার আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে আপিল আবেদন করে।  ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন  সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় দেন।

১৯৭৩ সালের আইনে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলা আছে কিন্তু  রিভিউর কথা বলা নেই। অপরদিকে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৫ ধারায় আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে নাগরিককে রিভিউ করার অধিকারের কথা বর্ণিত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন