Pages

মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৩

দুর্ভাগ্য, আমাদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে :একান্ত সাক্ষাতকারে অধ্যাপক গোলাম আযম

মেহেদী হাসান, ১৭/১২/১১
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির, প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক গোলাম আযম বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে যে আশঙ্কার কারণে আমরা পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম, আমাদের সেই আশঙ্কা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে। আমরা স্বাধীন নেই। আমরা ভারতের কুক্ষিগত। ভারত যা চায় আমরা সব দিতে বাধ্য। আমাদের অধিকার কিছুই দিতে চায় না তারা। আর তাদের যা ইচ্ছা তাই তারা চায় এবং তাই তারা পায়। এ অবস্থা কোনো স্বাধীন দেশের হতে পারে না।’
নয়া দিগন্ত’র পক্ষে এ প্রতিবেদকের কাছে  অধ্যাপক গোলাম আযম  গত শুক্রবার রাতে নিজ বাসায় একান্ত  সাক্ষাতকারে  এ কথা বলেন। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালে  অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দায়ের করা চার্জশিটে অর্ধশতাধিক অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো অভিযোগ নয় বরং অপবাদ। এর একটাও তারা প্রমান করতে পারবেনা।

সাক্ষাতকারে অধ্যাপক গোলাম আযম বলেছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে যে ধরনের রাজনৈতিক  পরিস্থিতি অত্রিতক্রম করছে তা থেকে  উদ্ধার পাওয়ার জন্য বিরোধী দল যে আন্দোলন  শুরু করেছে তাতে জনগণকে ব্যাপকভাবে সাড়া দিতে হবে। জনগণের অংশগ্রহনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় তাহলে  বাংলাদেশর  ভাল ভবিষ্যত আশা করা যায়। তা নাহলে আমাদের এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি বরণ করতে হবে। 
নিচে তাঁর সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হলো।

নয়া দিগন্ত: ১৯৭১ সালে আপনারা কেন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন?
গোলাম আযম: আমরা ছিলাম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। দুনিয়ার কোথাও সাধারণত এমনটি হয়নি,  মেজরিটি অংশ মাইনরিটি থেকে আলাদা হতে চায়। আলাদা তো হতে চায় যারা মাইনরিটি  তারা। আমরা কোন দুঃখে আলাদা হতে যাব?  যেহেতু আমরা মেজরিটি তাই  আমাদের দায়িত্ব ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানে প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করা। আমরাই পাকিস্তানের আসল শাসক হব। সে সুযোগ না নিয়ে আমরা কেন পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাব।  দ্বিতীয় কথা হলো, পশ্চিম পাকিস্তান ছিল ভারতের বাইরে। আর আমরা পূর্ব পাকিস্তান  ছিলাম  ভারতের পেটের ভেতরে। আমরা তো আলাদা হয়ে ভারতের আধিপত্য থেকে বাঁচতে পারব না। কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তানের সাথে ভারতের দুইবার যুদ্ধ হয়েছে। সেই যুদ্ধে ভারত কিছুই করতে পারেনি এবং দুইবারই তারা পাকিস্তানের সাথে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে ভারত যখন যুদ্ধ লাগাল, তখন তারা জয়ী হল এজন্য যে, এখানে জনগণের কোনো সমর্থন তারা পায়নি।
আওয়ামী লীগ যদি রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন করে যেত, তাহলে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারতাম। কিন্তু  তারা ভারতে গিয়ে ইন্দিরার কাছে সাহায্য চাইল স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। ভারত তার কূটনৈতিক, সামরিক সব শক্তি  ব্যবহার করল। এ পরিস্থিতিতে আমরা এটা বিশ্বাস করতে পারিনি যে, ভারতের সাহায্য নিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন  করতে পারব। ভারত আমাদেরকে স্বাধীন করার উদ্দেশে সাহায্য করেনি। তারা তাদের স্বার্থের কারণে আমাদের সাহায্য করেছে। তাদের স্বার্থ ছিল তিনটা। প্রথমত, পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা  ভারতকে সুযোগ দিয়েছে পাকিস্তানকে ভাগ করে দুর্বল করার। চির দুশমন পাকিস্তানকে দুর্বল করা গেল। দুইবার যুদ্ধ করে ভারত পরাজিত হয়েছে। এবার তারা তৃতীয়বার সুযোগ পেয়েছে তার প্রতিশোধ নেয়া এবং তাকে ভাগ করে দুর্বল করার।  দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু বাংলাদেশ ভারতের পেটের ভেতরে সেজন্য তারা বাংলাদেশকে আলাদা করতে

পারলে আমাদের ওপর তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। তৃতীয় স্বার্থ ছিল, তারা  তাদের পণ্যের বাজারে পরিণত করবে  এই অঞ্চলকে।
তাদের সেই তিনটা স্বার্থই  উদ্ধার হয়েছে।  তিনটা স্বার্থই  পূরণ  হয়েছে। আমরা এই আশঙ্কা করেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারলাম না। আমাদের সেই আশঙ্কা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্যে পরিণত হয়েছে। আমরা স্বাধীন নেই। আমরা এখন ভারতের কুক্ষিগত। ভারত যা চায় আমরা সব দিতে বাধ্য হচ্ছি । আমাদের অধিকার কিছুই দিতে চায় না তারা। আর তাদের যা ইচ্ছা তাই তারা চায় এবং তাই তারা পায়। এ অবস্থা কোনো স্বাধীন দেশের হতে পারে না। আমরা এই আশঙ্কা করেছিলাম এবং এই আশঙ্কার কারনেই ১৯৭১ সালে  ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান রাখার পক্ষে ছিলাম।

নয়া দিগন্ত: কিন্তু বাস্তবতা হল পাকিস্তান ভেঙ্গে গেল।
গোলাম আযম:  আমরা পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য কোনো সুযোগই পাইনি। কোন পথ পাইনি। বরং তারা এমনসব আচরণ জনগণের সাথে করেছে যে, জনগণ  তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। দুই পাকিস্তানকে তো কোন সামরিক শক্তির মাধ্যমে একত্র করা হয়নি। সেটা জনগণের ইচ্ছার মাধ্যমে হয়েছে।  কিন্তু তৎকালীন শাসকশ্রেণী অস্ত্রবলে পাকিস্তানকে এক রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে আমাদের করার কিছুই থাকল না।
আমরা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলাম কথাটার মানে পলিটিক্যালি পাকিস্তান এক থাক সেটা আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু সেজন্য আমারা কি করতে পেরেছি। কিছুই করতে পারিনি। আমাদের কিছু করার সুযোগও ছিলনা, সামর্থ্যও ছিলনা। 

নয়া দিগন্ত: আপনি বলছেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতা অর্জনের পদক্ষেপ নিলে আপনারা আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তো চেয়েছিলেন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে এবং সেজন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান শাসক শ্রেণীই তো সে উদ্যোগ নস্যাৎ করে দিয়ে সামরিক পথ বেছে নিল।
গোলাম আযম: যুদ্ধ করে দেশকে আলাদা করার চিন্তা শেখ মুজিবুর রহমান করেছেন বলে আমার মনে হয়না। তিনি এরকম ঘোষনাও দেননি। যদি দিতেন তাহলে নিজে ইচ্ছা করে পাকিস্তানের হাতে গ্রেফতার হতেননা। তিনি দেশ ভাগ করতে চাননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী  হতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হাতে নিতে চেয়েছিলেন। সেই হিসেবে তিনি পাকিস্তানের কাছে ধরা দিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আইনজীবী ছিলেন এ কে ব্রুহি। ১৯৭১ সালের জুন মাসে লাহোরে তার সাথে আমার দেখা হয়। তার সাথে আমার আগেই পরিচয় ছিল। আইউব খানের সময় যখন জামায়াতকে  নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয় তখন তিনি আমাদের আইনজীবী ছিলেন।  তিনি আমাকে বললেন, দেখেন রুগী যেমন ডাক্তারের কাছে রোগ গোপন করেনা তেমনি  মক্কেলও উকিলের কাছে কিছু গোপন করেনা। আপনারা যদি মনে করেন শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করতে চান, দেশ ভাগ করতে চান সেটি ভুল ধারণা। আমাদের মনে  হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক দিক দিয়ে কোন চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাজউদ্দিন সাহেবরা ভারতে গিয়ে সাহায্য চাইল।  যার ফলে  এ মুক্তিযুদ্ধের পথে যেতে হল।
নয়া দিগন্ত: অর্থাৎ আপনি বলতে চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দুইভাগ হয়ে গিয়েছিল । শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া আবার আওয়ামী লীগের আরেকটি  অংশ  চেয়েছিল ভারতের সাহায্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া।

গোলাম আযম: আমার মনে হয় এটাই সঠিক।
নয়া দিগন্ত: আপনারা চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক প্রকৃয়ায় এগিয়ে যেতে। কিন্তু ১৯৭০ সালে তো আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করেছিল। সে  হিসেবে  শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা   হোক এই অবস্থান কি তখন জামায়াত নিয়েছিল?
গোলাম আযম: আমি বারবার বিবৃতি দিয়েছি। সেগুলো রেকর্ডে আছে। ব্যালটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার হাতে  ক্ষমতা অর্পন করা দরকার। এমনকি ইয়াহিয়া একবার ঘোষনা করেছিলেন যে, শেখ মুজিবুর

রহমান ইজ দি ফিউচার প্রাইম মিনিস্টার অব পাকিস্তান।  সংসদের অধিবেশন  ডাকা হল। প্রথম অধিবেশনেই তো সংবিধান গঠিত হবার কথা। কিন্তু তা হতে পারলনা। প্রথম অধিবেশনই মূলতবী করে দেয়া হল ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে। ভুট্টো ঘোষনা করলো পাকিস্তানে দুইটা মেজরিটি পার্টি। এক দেশে দুইটা মেজরিটি পার্ট হয় নাকি? সে বিরোধী দলের আসনে বসতে রাজি নয়। সে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রস্তাব দিল যে, আমার সাথে আগে পলিটিক্যাল সেটেলমেন্ট কর। এরপর সংসদ বসলে আমরা যাব। সে ঘোষনা দিল আমি তো যাবইনা বরং পূর্ব পাকিস্তান থেকে কেউ আসলে করাচি এয়ারপোর্টে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব। তিনি ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলেছেন। এভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করেছে ভুট্টো। পাকিস্তান ভাগের জন্য প্রধানত দায়ী ভুট্টো । এরপর ভুট্টোকে সহযোগিতা করার জন্য দায়ী  ইয়াহিয়া খান।

নয়া দিগন্ত: পূর্ব পাকিস্তানকে ভাগ  করে পাকিস্তানকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র ভারত কি আগেই করেছিল না তারা উদ্ভুত পরিস্থিতির  সুযোগ নিয়েছে?
গোলাম আযম: সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু আমরা দেখেছি এখানকার নেতৃবৃন্দ তাদের কাছে গিয়ে সাহায্য চাওয়ার পর তারা এ সুযোগ গ্রহণ করেছে।
নয়া দিগন্ত: আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধেদের অভিযোগ আনা  হয়েছে । এটাকে কিভাবে দেখছেন?
গোলাম আযম: আমি তো আশ্চর্য হচ্ছি। আমরা তো যুদ্ধই করলাম না। তাহলে আমাদের যুদ্ধাপরাধী বলে কিভাবে? আমরা যুদ্ধাপরাধী হলাম কিভাবে?
আমি হিসাব করে দেখেছি ১৯৭১ সালের পর থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত এরা কখনো আমাদের যুদ্ধাপরাধী বলেনি। আমাদেরকে রাজাকার গালি দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী বলেছে। কিন্তু  যুদ্ধাপরাধী কখনো বলেনি। তারপর যখন এরশাদের বিরুদ্ধে বিএনপি Ñ জামায়াত মিলে আন্দোলন করল তখন তাদের সাথে আমাদের লিয়াজো কমিটি বসেছে। তখনো তারা আমাদের যুদ্ধাপরাধী বলেনি। আমাদের সহায়তা নিয়ে ১৯৯১ সালে যখন বিএনপি ক্ষমতায় আসল তখন আমরা কেয়ারটেকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি  জানালাম। কেয়ারটেকার ব্যবস্থার কারনেই তো বিএনপি ক্ষমতায় আসল। যদি এরশাদের অধীনে  নির্বাচন হত তাহলে তো তিনি আবার ক্ষমতায় আসতেন। আমরা দাবি  জানালাম যে, এই কেয়ারটেকার সিস্টেমটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। কিন্তু  বিএনপি এতে রাজি  হলনা। ১৯৯৪ সালে  মাগুরার মুহম্মদপুরে উপ নির্বাচনে ঐ আসনটি  বিএনপি দখল করল। ওখানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি মারা যাবার পর উপ নির্বাচন হল। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হলনা।  এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন শেখ হাসিনা। তিনি বললেন, আমরা এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবনা। কেয়ারটেকার সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেয়ারটেকার সিস্টেমের জন্য আন্দোলন ঘোষনা দিলেন। কেয়ারটেকার ইস্যু তো আমাদের ইস্যু ছিল। এ অবস্থায় আমরা যদি চুপ করে  থাকি তো আমাদের রাজনীতিই শেষ। সেজন্য আমরা বাধ্য হয়ে আন্দোলনে যোগদান করলাম। এ আন্দোলন শেখ হাসিনার একলা আন্দোলন ছিলনা। আমাদের মিলিত আন্দোলন ছিল। আমাদের লিয়াজো কমিটির সাথে তারা নিয়মিত বৈঠক করেছে। সেসব বৈঠকে কখনো কখনো শেখ হাসিনা অংশ নিয়েছেন। তখন আমরা যুদ্ধাপরাধী ছিলামনা।
তাহলে এ যুদ্ধাপর ধের অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে কেন আনা হচ্ছে? এর উত্তর তালাশ করতে গিয়ে  আমি দেখলাম ২০০১ সালের নির্বাচনটা ছিল চারদলীয় জোটের ভিত্তিতে। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয়পার্টি আর ইসলামী ঐক্যজোট একত্র হয়ে নির্বাচন করলাম। সিদ্ধান্ত হল এক আসনে দুই দলের কেউ থাকবেনা।  সেই ইলেকশনে জামায়াতে ইসলাম এবং  ইসলামী ঐক্যজোট মিলে ৫০ট“ বেশি আসনে নির্বাচন করেনি। নির্বাচনের পর দেখা গেল  আওয়ামী লীগ বিএনপি এবং উভয়ে ৪০% ভাগ করে ভোট পেয়েছে। বিএনপি ৪০% এর সামান্য কিছু ভোট বেশী পেয়েছে  কিন্তু  তা  ওয়ান পার্সেন্টও বেশি নয়। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল  আওয়ামী লীগ পেল ৫৮, আর বিএনপি পেল ১৯৭। কেমন করে এটা হল?  ৩০০ আসনের মধ্যে আড়াইশ আসনে যেখানে দুই ইসলামী দলের  প থেকে কোন  প্রার্থী ছিলনা সেসব আসনে সব ইসলামপন্থীদের ভোট বিএনপি পেয়েছে। আওয়ামী লীগ একটিও পায়নি।   সমান সমান ভোট পাওয়া সত্ত্বেও এতো বড়ো পার্থক্য কেন হলো?  হয়েছে ইসলামপন্থীদের ভোট বিএনপি একতরফাভাবে পাওয়ার কারনে।

এরপর  থেকেই আওয়ামী লীগ হিসেব করে দেখল যে, জামায়াত আর বিএনপি যদি রাজনৈতিক ময়দানে এক থাকে  তাহলে আওয়ামী লীগ কখনো তাদের পরাজিত করতে পারবেনা। বিএনপি আর জামায়াত একত্র হলেই আওয়ামী লীগ ফেল করে। এর অনেক উদহারণ আছে।
যেমন চট্টগ্রামে মেয়র ইলেকশনে হলো। জামায়াতের প্রার্থী ছিল সেখানে। বেগম জিয়ার অনুরোধে জামায়াত যখন প্রার্থী প্রত্যাহার করলো তখন লক্ষাধিক  ভোট বেশী পেয়ে বিএনপি প্রার্থী পাশ করলো। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশন সর্বশেষ  পরপর দুইবার ইলেকশনে  জামায়াত  বিএনপি এক হয়ে গেল আর আ’লীগ ফেল করলো। এভাবে যেখানেই জামায়াত বিএনপি এক হয় সেখানেই আওয়ামী লীগ ফেল করে।
২০০১ সালে পরাজয়ের আগে কখনো তারা যুদ্ধাপরাধী বলেনি। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি। কোন প্রমান তারা করতে পারবেনা। এখন সেক্টর কমান্ডারদেরও ব্যবহার করছে। এর আগে তারাও এ দাবি তোলেনি।
জামায়াতের প্রতি প্রতিহিংশা, প্রতিশোধ এবং জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবেক পঙ্গু করে ফেলার জন্যই এ  যুদ্ধাপরাধ  বিচার চলছে যাতে জামায়াত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মাঠে কোন পদক্ষেপ নিতে না পারে।  জামায়াতের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে তারা জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করতে চায়। এই সেদিন পাটমন্ত্রী বললেন, বিচারের দরকার  নেই। এদের ফাঁসি দিয় ফেলো। তারা বিচারকে প্রহসন হিসেবে ব্যবহার করছে। বিচারকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। আসল উদ্দেশ্য হল জামায়াতকে খতম করা।
নয়া দিগন্ত: আপনার বিরুদ্ধে চার্জশিট  জমা দেয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। সেখানে আপনার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী  এবং গণহত্যায় নেতৃত্ব দানের অভিযোগসহ নির্দিষ্ট করে আরো অনেক অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে । আপনার বক্তব্য  কি?
গোলাম আযম: এগুলো অভিযোগ নয় আমি একে  অপবাদ বলি। এর একটাও  অভিযোগ নয় এবং এর একটাও তারা প্রমাণ করতে পারবে না।  মাওলানা সাঈদী এবং মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে যেমন মিথ্যা অভিযোগ বানিয়েছে সেগুলো যেমন অপবাদ আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলোও অপবাদ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়  নাকি  ৩৮ জনকে জেল থেকে বের করে হত্যা করেছি। ব্রাক্ষ্মনবারিয়ায় আমি সে সময় গিয়েছি একথা তারা প্রমান করতে পারবে না। ১৯৭১ সালে কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাইনি। আমার তখন কি ক্ষমতা ছিল যে, আমি তাদের অর্ডার দিলাম আর তারা  তাদের জেল থেকে ছেড়ে দিল? আমার হাতে কি ক্ষমতা ছিল যে, যত গণহত্যা হয়েছে তা সব আমার নির্দেশে হয়েছে? গণহত্যাতো করেছে পাকিস্তান আর্মি। এ গণহত্যায় আমি ভূমিকা পালন করলাম কিভাবে?

নয়া দিগন্ত: তাদের বক্তব্য হচ্ছে আপনারা আর্মিকে সহযোগিতা করেছেন?
গোলাম আযম: কেমন করে? সহযোগী হওয়ার তো কোন সুযোগ ছিলনা।
নয়া দিগন্ত: রাজাকার  আল বদর এসব বাহিনীর মাধ্যমে আপনারা সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ?
গোলাম আযম: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাগজপত্র তালাশ করলে পাওয়া যাবে কিভাবে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছে । পুলিশের যেমন সহযোগী বাহিনী আছে আনসার তেমনি পাকিস্তান পুলিশের  সহযোগী বাহিনী হিসেবে গঠন করা হয়েছিল রাজাকার বাহিনী। তাদের  তখন অনেক সহযোগী ফোর্স দরকার ছিল। বর্তমান থানা কর্মকর্তাকে ইউএনও বলা হয়। তখন বলা হত সার্কেল অফিসার। এসব সার্কেল অফিসারদের মাধ্যমে ইউনিয়ন বোর্ডে ঢোল পিটিয়ে রাজাকার বাহিনীতে জনবল রিক্রুট করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে সরকারীভাবে। আমরা করলাম কিভাবে?

নয়া দিগন্ত: অর্থাৎ রাজাকারদের যেসব অপরাধ আপনাদের ওপর  চাপানো হচ্ছে আপনি বলছেন সেগুলোও পাকিস্তান আর্মির একটা অংশ?
গোলাম আযম: অবশ্যই সমস্ত কর্মকান্ডের দায়ভার পাকিস্তান আর্মির।

নয়া দিগন্ত: রাজাকার ছাড়াও পিস কমিটি, আল বদর আল শামস প্রভৃতি বাহিনীও আপনার নেতৃত্বে  গঠিত  এবং পরিচালিত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
গোলাম আযম: এসবই অপবাদ। মার্চের পরে নেজামে ইসলাম পার্টির অল পাকিস্তান সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন ফরিদ আহমেদ। তিনি আমার বাড়িতে আসলেন। এসে বললেন যে, আমরা যেসব রাজনৈতিক দল আছি আমরা  একসাথে বসে একটু পরামর্শ করি। আমরা গেলাম টিক্কা খানের কাছে গেলাম। আমরা বললাম  আর্মিকে জনগণের মধ্যে ছেড়ে দিলে তারা বাড়াবড়ি করবেই। কারণ অস্ত্রের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। এখন যে পাবলিকের ওপর সেনাবাহিনী জুলুম অত্যাচার করছে এর জন্য তারা কার কাছে যাবে? আওয়ামী লীগের লোকজনতো সব ভারতে চলে গেছে। এখন জনগণ আমাদের কাছে আসে। আমরা তাদেরকে কিভাবে সাহায্য করব। মুসলিম লিগের খাজা খায়রুদ্দিন, কৃষক শ্রমিক পার্টির এ এস এম সোলায়মান, জামায়াতের আমি এবং নেজামে ইসলাম পার্টির ফরিদ  আহমেদ। এ কজন আমরা গেলাম। আমরা বললাম ২৫ মার্চ আপনারা যেটা করেছেন এর মাধ্যমে আপনারা  জনগণকে পাকিস্তান বিরোধী বানিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলল, যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে তা দমনের জন্য এটা করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিলনা। তারা অগ্নিসংযোগ শুরু করেছে। নয়া বাজারে কাঠের দোকানে আগুন লাগিয়েছে। দুদিন  ধরে জ্বলেছে। আমরা এ নিয়ে আপত্তি করলে তিনি বললেন এরকম আর হবেনা। এটা আমরা করতে বাধ্য হয়েছি বিদ্রোহ দমন করার জন্য। সামনে আর এরকম হবেনা। আমরা আমাদের উদ্দেশ্য  ব্যক্ত করে বললাম আমরা এরকম একটা সুযোগ চাই যে, জনগণ আমাদের কাছে কোন অভিযোগ করলে আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগ করে প্রতিকারের চেষ্টা করতে পারি। তখন তিনি ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলীকে ডাকলেন। তিনি গভর্ণর হাউজে বসতেন। টিক্কা খান গভর্ণর হলেও তিনি মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন। তিনি বঙ্গভবনে বসতেননা। ক্যান্টনমেন্টে বসতেন। আমরা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দেখা করেছি। তিনি রাওফরমান আলীকে বললেন ওনাদের সব টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দেন যাতে তারা যোগাযোগ করতে পারেন। আমার কয়েকটা ঘটনার কথা স্পষ্ট মনে আছে। আমার কাছে কেস আসছে আমি ফরমান আলীকে জানিয়েছি। কাকরাইলে সে সাকির্ট হাউজ  আছে সেখানে বসতেন ব্রিগেডিয়ার কাসেম নামে  একজন। তিনি বিগ্রেডিয়ার কাসেমের কাছে রেফার করে দিলেন। তার কাছে অভিযোগ গেলে তিনি প্রতিকার করতেন। আমরা এছাড়া তখন আর কিছুই করতে পারিনা।

এত লোক ভিড় করত আমার বাড়িতে যে, আমি কোন অবসর পেতামনা। আমার হার্টে সমস্যা অনুভব করলাম। ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার বললেন আপনার বয়স ৪০ পার হয়েছে। আপনি দুপুরে খাবারের পর অবশ্যই একঘন্টা বিশ্রাম নেবেন  শুয়ে। কিন্তু আমি সে বিশ্রাম নিতে পারিনাই। লোক আসতেই থাকত। এ ধরনের সাহায্য ছাড়া ১৯৭১ সালে আমরা আর কিছুই করতে পারিনি।

নয়া দিগন্ত: অর্থাৎ আপনি বলছেন পাকিস্তান আর্মির যে নিপীড়কমূলক ভূমিকা ছিল সেগুলো থেকে জনগণকে রক্ষার জন্যই আপনারা ভূমিকা পালন করেছেন।
গোলাম আযম: ততটুকুই যতটুকু আমাদের কাছে অভিযোগ আসত। একটি মুক্তিবাহিনী এসে কোন পুল উড়িয়ে দিল পাকিস্তান আর্মির চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টির জন্য। তখন  পাকিস্তান আর্মি এসে ঐ গ্রামটা জ্বালিয়ে দিল। তখন আমরাদের সেখানে কি করণীয় ছিল। এ ধরনের ঘটনায় আমরা কিছুই করতে পারিনি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেগুলি এসেছে সেগুলি আমরা সমাধান করতে পেরেছি।

নয়া দিগন্ত: আপনার পূর্বের কথার জের ধরে  এখানে আরেকটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি বলেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর আপনি শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছেন এবং আপনি এটার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এদেশের মানুষের দাবি আদায়ের রাজপথমুখী যে আন্দোলন সংগ্রাম ছিল সেখানে কি আপনাদের কোন অংশগ্রহণ বা কর্মসূচী ছিল?



গোলাম  আযম: আমাদের শক্তি এবং অবস্থান তখন কতুটুক ছিল? নির্বাচনে আমরা একটা আসনও পাইনি।   প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে শুধু বগুড়ায় একটা আসন পেয়েছিলাম। কেন্দ্রে কোন আসন পাইনি। জামায়াতে ইসলাম তখন খুব গুরুত্বপূণ কোন রাজনৈতিক দল হয়ে উঠতে পারেনি।

নয়া দিগন্ত: যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের চার্জশিটে আপনার  নির্দেশে ব্রাক্ষনবাড়িয়ায়  ৩৮ জন জেলবন্দী হত্যার অভিযোগ ছাড়াও সিরু মিয়া নামে একজনকে আপনার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে বলে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে।
গোলাম আযম: এরকম নাম আমি কোন দিন  শুনিনি। আমি কোন পত্র দিয়েছি তা তারা প্রমান করুক। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি তারা প্রমান করুক।
নয়া দিগন্ত: আপনার নির্দেশে ৩৮ জন জেলবন্দীকে হত্যা করা হয়?
গোলাম আযম: আমি তো কর্তা ছিলাম সরকারের আরকি?
নয়া দিগন্ত: ১৯৭১ সালের বিভিন্ন ঘটনা বিষয়ে সংগ্রাম পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনার নামে যেসব  খবর এবং  উদ্ধৃতি প্রচার করে তা কি সঠিক?
গোলাম আযম: তারা কি প্রচার করে আর আমি কি বলেছিলাম তা না দেখলে বলতে পারবনা। আমার কোন কথাটাকে তারা আমার বিরুদ্ধে  ব্যবহার করছে তা না দেখে বলতে পারছিনা।
নয়া দিগন্ত: আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে  পরাজয় নিশ্চিত জেনে আপনি লন্ডনে পালিয়ে যান। আপনার বক্তব্য কি?
গোলাম আযম:  ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো।  ২০শে নভেম্বর রমজান শেষ হলো।  ঈদের পরের দিন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে যোগদান করার জন্য আমি লাহোর গেলাম। জামায়াতের হেডকোয়ার্টার তখনো ছিল লাহোর।  এরপরে আমি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।  একথা বলার জন্য যে, আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তানে কি হচ্ছে আপনি গিয়ে দেখেন। এজন্য কয়েকদিন সময় লাগলো আমার সেখানে। এভাবে আমি ৩রা ডিসেম্বর রওয়ানা দিলাম করাচী থেকে পিআই এর প্লেনে, এটিই পিআই এর শেষ প্লেন ছিল। ০৩ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে বোমা ফেলা হয়েছে। এয়ারপোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। তখন ইন্ডিয়ার সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল তা ইন্ডিয়ার উপর দিয়ে আসতে দিত না, পাকিস্তানের প্লেন আসতো শ্রীলঙ্কা হয়ে। প্লেন কলম্বো আসল। তিন ঘন্টা পর প্লেন আবার উড়লো।  তখন ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলো যে, করাচী এবং ঢাকা এয়ারপোর্টের কোথাও যাওয়া সম্ভব না, যুদ্ধ বেধে গেছে।  আমাদেরকে প্লেনকে  বলা হল  আমরা তেহরান বা জেদ্দায় গিয়ে যেন আশ্রয় নেই। এইভাবে আমার প্লেন জেদ্দায় চলে গেল। এরপরে ১০ই ডিসেম্বর ইন্ডিয়া পাকিস্তান সীজফায়ার করলো, একদিন যুদ্ধ বন্ধ থাকবে ঘোষণা করলো, যাতে বিদেশীরা চলে যেতে পারে, সেই দিন সেই ১০ তারিখে আমার প্লেন জেদ্দা থেকে করাচী আসলো। এভাবে আমি পাকিস্তানে আসলাম।  ৩রা ডিসেম্বর আমার প্লেন নামতে পারলো না, তারপর জেদ্দায় চলে গেলাম, তারপরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পাকিস্তান থেকে পরে লন্ডন যাই।
নয়া দিগন্ত: আমরা বর্তমান পরিস্থিতিতে আসি। কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার ধারণা আপনি প্রথম দিয়েছিলেন। এখন এটি বাতিল করা  হয়েছে।  আপনার প্রতিক্রিয়া  কি?
গোলাম আযম: আওয়ামী লীগ স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য এটা করেছে।
নয়া দিগন্ত: অনেকে মনে করেন কেয়ারটেকার ব্যবস্থার কারনে বাংলাদেশে ১/১১  পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আপনি কি বলেন?
গোলাম আযম: মোটেই না।   ১১ জানুয়ারির ঘটনাতো ঘটেছে  কেয়ার টেকার সরকার প্রধান কে হবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে মারামারির কারনে। সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে   কেয়ারটেকার প্রধান করা হবে কি হবেনা তা  নিয়েই তো সমস্যার সৃষ্টি হল। তিনি যখন এ পদ গ্রহণে রাজি হলেননা তখন ইয়াজউদ্দিনকে কেয়ারটেকারের কর্তা বানানো হল। আওয়ামী লীগ তো তখন সন্ত্রাসী আন্দোলন করল। তারা এমন সন্ত্রাসী আন্দোলন চালাল যে, সরকার অচল হয়ে গেল। তখন সেনাপ্রধান এটার সুযোগ গ্রহণ করেছে। কেয়ারটেকার সিস্টেমের তো কোন দোষ না। ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি ঘটনার আগে এর অধীনে তিনটা নিবাচন হয়েছে। সেগুলো হল কিভাবে তাহলে?

নয়া দিগন্ত: কেয়ারটেকার সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগ  তা হল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল যে স্পিরিট তার সাথে এটা সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ একটা নির্বাচিত সরকারের প্রতি  আস্থার যে জায়গা সেখানে আঘাত করা। আপনার বক্তব্য কি?
গোলাম আযম: আস্থার অভাবের কারনেই তো এটা আসল। এটা করার আগে আমি চিন্তা করে দেখলাম বাংলাদেশ হবার পরে প্রথম নির্বাচন হল শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭৩ সালে। সেটা মোটেই ফেয়ার ইলেকশন ছিলনা।  ছয়টা বাদে সব আসন  তারা দখল করল। এরপরে ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হল সেটাও ফেয়ার ছিলনা। কেয়ারটেকার ধারণা রাজনীতি বিজ্ঞানে অনেক আগে থেকেই ছিল।  নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পরে তারা কেয়ারকেটার সরকার হিসেবে পরবতী সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগ পর্যন্ত দৈনন্দিন রুটিন কাজ করত। রাজনৈতিক কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের থাকতনা।  একটি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা তাদের প্রধান কাজ ছিল। সরকার তখন থাকবে নাম মাত্র। এটাই ছিল তখন কেয়ারটেকার সরকার। কিন্তু তা হলেও সেটা ছিল পলিটিক্যাল এবং দলীয় কেয়ারটেকার সরকার। আমি তখন চিন্তা করলাম এই কেয়ারটেকার সরকার যদি নির্দলীয় এবং অরাজনৈতিক হয় তাহলে ফেয়ার ইলেকশন সম্ভব। জাস্টিস সাহাবুদ্দিন সাহেবের অধীনে যে দুইটা ফেয়ার ইলেকশন হয়েছে এরকম ফেয়ার ইলেকশন অতীতে কখনো হয়নি। এরপরে হয়নি।
নয়া দিগন্ত: নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেওতো এটা করা যেতে পারে।
গোলাম আযম: এটা হতে পারে যদি রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে। তাদের যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হয় তাহলে সম্ভব। কিন্তু এখনো সেটা হয়নি।
নয়া দিগন্ত: আপনি বললেন কেয়ারটেকার সিস্টেম  নিয়ে সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছে   পদে কাকে বসানো হবে তা নিয়ে। এখানেও একটি অভিযোগ উঠেছে তাহল প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে নগ্ন রাজনীতি চালু হয়েছে। বিচার ব্যবস্থা কলুষিত হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান   কে হবে তা ঠিক করতে গিয়ে।
গোলাম আযম: কেয়ারটেকার সরকার কে হবে তা নিয়ে যদি সমস্যা হয় তাহলে এর প্রধান কে হবে তা নিয় পুনরায় আলোচনা করা যেতে পারে। কেয়ারটেকার সরকার সিস্টেম নিয়ে সবাই মিলে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। প্রধান বিচারপতি ছাড়া আর কাকে প্রধান করা যায় তা আলোচনা করলে অবশ্যই বের করা সম্ভব। আগের পদ্ধতি যদি ঠিক না হয় তাহলে আলোচনা করে সমঝোতা করা হোক। আপত্তিতো নাই কিছু।

নয়া দিগন্ত: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
গোলাম আযম: বাংলাদেশেতো রাজনীতি  নেই। নির্বাচন কমিশনে যেসব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে তার মধ্যে জামায়াতে ইসলাম একটা। সংসদে তাদের প্রতিনিধি আছে। এই দলটাকে জনসভা করতে  দিচ্ছেনা। মিছিল করতে দিচ্ছেনা। রাস্তায় দাড়াতে দিচ্ছেনা। রাস্তায় দাড়ালে পুলিশের সাথে ধাক্কাধাক্কি হলে পুলিশের  কাজে বাঁধা দেয়ার নাম করে গণহারে তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসা হচ্ছে। অফিসে বসে মিটিং করলে বলে গোপন বৈঠক করছে। সেখান থেকে তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারাতো কোন বেআইনী দল নয়। দলীয় বৈঠক তারা গোপনে করবেনা তো কি পুলিশ ডেকে তাদের সামনে করবে? কিন্তু বলা হচ্ছে তারা গোপন বৈঠক করছে, ষড়যন্ত্র করছে। ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে।  রাজনীতি  তো তারা করতে দিচ্ছেনা। এমনকি আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা তারাও পুলিশের সাথে মিলে জামায়াতের ওপর হামলা চালায়। জনসভায় ভাঙচুর  করে। মিছিল করতে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের আবাসিক হল থেকে ছাত্র শিবিরের  নেতাকমীদের ছাত্রলীগের লোকজন মারধর করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে জঙ্গি বলে। তারাই ধরে মারে আবার পুলিশের হাতে তুলে দেয়।   এটা কোন ধরনের রাজনীতি? রাজনীতি করতে দেয়া হচ্ছেনা। এখন দেশে চলছে শেখ হাসিনার স্বৈর শাসন। বাকশাল টাইটের শাসন চলছে। এটাকে আরো স্থায়ী করার জন্য তারা তাদের দলের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। ভারত যা চায় তাই তারা দিয়ে দিচ্ছে। শুধু 


দিচ্ছেনা উৎসাহের সাথে দিচ্ছে। আমার আশঙ্কা আবার তারা  শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসলে  এটা ভারতের না জানি অঙ্গরাজ্য হয়ে যায়।

নয়া দিগন্ত: বিরোধী দল তো সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে
গোলাম আযম: আমি জনগনের কাছে বলতে চাই যে ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পড়েছি তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য বিরোধী দল যে আন্দোলন  শুরু করেছে তাতে জনগণকে ব্যাপকভাবে সাড়া দিতে হবে। জনগণ যদি আন্দোলনে ব্যপকভাবে সাড়া দেয় এবং এর ফলে এ সরকারের পতন হয় তাহলে এরপর একটা ফেয়ার ইলেকশন আশা করা যায় । এটি হলেই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আছে। তানা হয়ে যদি আওয়ামী লীগের হাতে এভাবে দেশকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং তারা দলীয়ভাবে নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসে  তাহলে তাদের বাড়াবাড়িতো আরো বেড়ে যাবে এবং এরপরে বাংলাদেশের  স্বাধীনতা রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়বে।

নয়া দিগন্ত: আপানর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে মামলার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। আপনার মনের অবস্থা কেমন।
গোলাম আযম: জীবনে অনেকবার  গ্রেফতার হয়েছি।  মুমিনতো  মৃত্যুকে ভয় করে না। যদি অন্যায়ভাবে আমাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়, তাহলে মনে করব শহীদ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে যাচ্ছি।  ইসলামী আন্দোলনের একজন  কর্মী হিসাবে আমি  শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করেছি সারা জীবন। সুতরং ভয় কিসের? আমি প্রস্তুত আছি।
নয়া দিগন্ত: আপনাকে ধন্যবাদ:
গোলাম আযম: নয়া দিগন্তকেও ধন্যবাদ।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন