মেহেদী হাসান, ৬/৪/২০১৪
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার নথির খোঁজ করছে রাষ্ট্রপক্ষ। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলার নথি আসামী পক্ষ জমা দিয়েছিল ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে। তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার নথির খোঁজ করছে যখন ট্রাইব্যুনালে এ মামলার রায় হয়ে গেছে এবং আপিল বিভাগেও এ মামলার শুনানী একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার নথির খোঁজে পিরোজপুর এবং বরিশাল সফর করেছেন। গত ২ এবং ৩ এপ্রিল বরিশাল জেলাজজ আদালতের রেকর্ড রুমে তিনি এ মামলার নথির খোঁজ করেছেন। এর আগে তিনি পিরোজপুর সফর করেন একই উদ্দেশে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে নির্দিষ্ট করে বলতে অস্বীকার করেছেন ঠিক কি কাজে তিনি বরিশাল গেছেন এবং কোন মামলার কাগজ পত্র খোঁজ করছেন। তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা তাদের প্রতিবেদনে বরিশাল জেলাজজ আদালতের সূত্র এবং বিভিন্ন আইনজীবীদের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার নথির খোঁজেই অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল গেছেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বর্তমানে এ মামলার আপিল শুনানী শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আপিল শুনানীর এ পর্যায়ে আবারো ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম কর্তৃক ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলার ডকুমেন্ট আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাট বাজারে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে যে মামলা করেন তাতে আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। সেই মামলার ডকুমেন্ট আসামী পক্ষ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন অভিযোগ করে আসামী পক্ষ মামলার প্রয়োজনে এ জাল দলিল তৈরি করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তবে আসামী পক্ষের এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।
গত ৩ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নতেৃত্বে আপিল শুনানীর সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন।
আদালত তখন তাকে প্রশ্ন করেন, আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার ডকমেন্ট সংগ্রহ করতে পারল আর আপনারা পারলেননা কেন? ১৯৭২ সালে আদৌ এ ধরনের কোন এফআইআর হয়েছিল কি-না? পিরোজপুরে অবশ্যই জিআর রেজিস্ট্রেশন বই আছে। আপনারা এটা চাইতে পারতেননা? আপনাদের অনেক বড় মেশিনারীজ আছে। তার মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন? আমরা যদি আসামী পক্ষের দায়ের করা এ ডকুমেন্ট গ্রহণ করি তাহলে অ্যাটলিস্ট আমরা বলতে পারি সাঈদী এ ঘটনায় জড়িত নয়।
আদালত আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ মামলার শুনানী চলছে। আসামী পক্ষ অনেক আগে এ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে। আপনারা অনেক সময় পেয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে আপনারা চাইলে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন।
এরপর গত ১১ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেল আসামী পক্ষের জমা দেয়া মমতাজ বেগমের মামলার মূল সার্টিফাইড কপি আপিল বিভাগের রেকর্ড রুম থেকে দেখার আবেদন করেন। আসামী পক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে তিনি এ কপি দেখার অনুমতি পান। তবে আসামী পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত তাদের কাউকে এ ডাকা হয়নি এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে। গত ১ এপ্রিল শুনানীর পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ মামলার বিচার ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি চান। এরপর খবর বের হল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথির খোঁজে অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল সফর করছেন।
ইব্রাীহম কুট্টি হত্যার অভিযোগ : পাড়েরহাট বাজারের নিকটে সইজুদ্দিন পসারীদের বাড়িতে কাজ করত ইব্রাহীম কুট্টি। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীসহ শান্তি কমিটির অন্যান্য লোকজনের নেতৃত্বে পাকিস্তান সৈন্যরা ওই বাড়িতে আক্রমন করে। এসময় ইব্রাহীম কুট্টি ও অপর আরেকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে। পরে মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে পাকিস্তান সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে পাড়েরহাট বাজারে।
আসামী পক্ষের দাবি : আসামী পক্ষের দাবি ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার সাথে মাওলানা সাঈদী জড়িত নন। এ দাবির পক্ষে তারা ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথি জমা দিয়েছে আদালতে। মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে মোট ১৩ জন আসামী করা হয়। আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আসামী পক্ষের দাবি তিনি যদি এর সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তাকে তখন আসামী করা হত।
মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিবরন : স্বামী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে মমতাজ বেগম দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে একটি মামলা করেন। সে মামলার বিবরনে মমতাজ বেগম উল্লেখ করেছেন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টি তার বাপের বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় শান্তি কমিটির লোকজন এবং পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করেছে। ঘটনার সময়কাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ।
মমতাজ বেগমের মামলায় আরো উল্লেখ আছে যে, ওই ঘটনার সময় তাদের বাড়ি থেকে তার ভাই সাহেব আলী ওরফে সিরাজ এবং তার মা সিতারা বেগমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পিরোজপুর। পরে তার মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে আর ছাড়া হয়নি। তাকে পাকিস্তান পিরোজপুরে আর্মি গুলি করে হত্যা করে।
মমতাজ বেগমের মামলার বিবরনে বলা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবার নলবুনিয়া তার শশুর বাড়ি থাকা অবস্থায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের দাবির্ ৮ মে তাকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যের স¤পূর্ণ বিপরীত তথ্য রয়েছে মমতাজ বেগমের মামলার নথিতে।
মমতাজ বেগমের মামলায় ঘটনার বিবরন নিম্নরূপ :
“ঘটনার বিবরন এই যে, বিবাদীগন পরষ্পর যোগাযোগে রাইফেল পিস্তল ছোরা লাঠি ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া আমার পিতার ঘর বেড়দিয়া আমার স্বামীর উপর গুলি করিয়া হত্যা করিয়া আমার শরীরে জখম করিয়া আমার মাতা ও ভ্রাতাকে ধরিয়া পিরোজপুর আনিয়া আমার মাতাকে ছাড়িয়া দিয়া আমার ভ্রাতা সিরাজুলকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আক্রোশের কারণ এই যে, আমি ও আমার স্বামী আমার স্বামীর বারিতে বাদুরা গ্রামে বাসবাস করিতেছিলাম। গত মে মাসে পাক সৈন্য এদেশে আসিয়া যখন অকারনে গুলি করিয়া মানুষ হত্যা করিতে থাকে তখন কতিপয় হিন্দু আমাদের সরনাপন্ন হওয়ায় আমরা তাহাদের আশ্রয় দেওয়ায় পাক সৈন্য ও তাহাদের দালালরা আমার স্বামীকে হত্যা করিতে খোঁজ করিতে থাকায় আমরা ভয়ে ভীত হইয়া আমরা পিত্রালয়ে বসবাস করিতেছিলাম। তথায় বিবাদীগন ক্রোধ করিয়া উক্তরুপ অত্যাচার করিয়াছে।
প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে আমি গর্ভবতী থাকায় আমার পিতা পারোরহাট আওমীলীগ অফিসে জানাইয়া কোন প্রতিকার পাইনাই। তাই এই দরখাস্ত করিতে বিলম্ব হইল।
সে মতে প্রার্থনা, আদালত দয়া করিয়া উক্ত ধারামতে উক্ত বিবাদীগনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দিয়া ধৃত করাইয়া সুবিচার করিতে আজ্ঞা হয়। ইতি মমতাজ বেগম”
মমতাজ বেগমের মামলার আসামীর তালিকা :
মমতাজ বেগম সে মামলায় মোট ১৩ জনকে আসামী করেছেন। এরা হল দানেশ মোল্লা, আতাহার আলী, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী, কালাম চৌকিদার, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা। এছাড়া পাকিস্তান আর্মিকেও আসামী করা হয় মমতাজ বেগমের মামলায়। কিন্তু মমতাজ বেগমের মামলায় আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।
আপিল শুনানীর সময় মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান আদালতে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের এ ডকুমেন্টকে অসত্য এবং জাল আখ্যায়িত করেছে। তাদের উচিত ছিল পিরোজপুর থেকে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ডাকার ব্যবস্থা করে তাদের দাবি প্রমান করা। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং আমরা থানা থেকে এ মামলার নথিপত্র তলবের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
আসামী পক্ষ যেভাবে সংগ্রহ করল মমতাজ বেগমের মামলার নথি : মাওলানা সাঈদীর ছেলে এবং ১৩ তম সাফাই সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে জেরায় বলেছেন, ‘তার বড় ভাই মরহুম রাফিক বিন সাঈদীকে মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম মামলার মূল সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করেন।’
মামলার বাদী মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম ১৯৭২ সালে এ মামলার সার্টিফাইড কপি পিরোজপুর থেকে ইস্যু করান এবং সিতারা বেগম দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এ মামলার কপি সংরক্ষন করেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল এর বক্তব্য : ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার খোঁজে বরিশাল এবং পিরোজপুর সফর বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিষয়ে আজ বিকালে ফোনে কথা হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সাথে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার নথির খোঁজে বরিশাল এবং পিরোজপুর সফর করেছেন মর্মে খবর বের হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি তাদেরকে বলিনি যে, আমি সাঈদীর মামলার কাজে এবং ইব্রাহীম কুট্টির হত্যা মামলার নথির খোঁজে বরিশাল এবং পিরোজপুর গিয়েছি। আমি অন্য একটি কাজে গিয়েছি।
কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিকরা জেলাজজ সূত্র এবং আইনজীবীদের বরাত দিয়ে বলেছেন, আপনি এ মামলার কাজেই বরিশাল গেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা তাদের অনুমান। তারা দেখেছে আমি দুইদিন জেলাজজ আদালতের রেকর্ডরুমে ছিলাম। সেকারনে তারা এটা বলেছে হয়ত।
তাহলে আমরা কি বলব যে, আপনি সাঈদীর মামলার কাজে নয় অন্য কোন মামলার কাজে বরিশাল গেছেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না আমি এটাও বলতে চাইনা। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা।
আসামী পক্ষ তিন বছর আগে মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোন খোঁজ খবর নেয়নি কেন এবং এখন এতদিন পরেই বা কেন খোঁজ করছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা আমার কলিগ। তাদের আমি কিভাবে সমালোচনা করব। আপনারা তো সবই বোঝেন ।
মাওলানা সাঈদীর মামলায় নিযুক্ত আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল সাঈদীর মামলায় যুক্তি পেশ করছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা যায় তিনি এ মামলার কাজেই বরিশাল গেছেন। আমরা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি ট্রাইব্যুনালে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন একে জাল বলে আখ্যায়িত করলেন। আমরা তখন সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে মামলার নথি তলবের আবেদন করলে রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরোধীতা করে। এখন তিন বছর পর কেন তারা এ মামলার নথির খোঁজ করছে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।
মমতাজ বেগমের মামলার ঘটনাপ্রবাহ :
মামলার নথি ঘেটে দেখা যায় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ মমতাজ বেগম পিরোজপুর এসডিও কোর্টে প্রথম এ মামলা করেন। তখন এসডিও ছিলেন একে আজাদ। ওই তারিখে এসডিও মামলাটি পিরোজপুর থানায় পাঠান।
বাদী মমতাজ বেগমের লিখিত অভিযোগ এসডিওর কাছ থেকে পাবার পর পিরোজপুর থানা ১৬/৭/১৯৭২ তারিখ বেলা ১টা ৩০ মিনিটের সময় অভিযোগটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করে। মামলা নং ৯। জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) নং ৩৭৮/৭২।
১৭/৭/১৯৭২ তারিখ সকাল ৮টায় থানা থেকে মামলাটি পিরোজপুর কোর্টে পাঠানো হয়। তখন থানার ওসি ছিলেন মেফতাউদ্দিন আহমেদ। তিনি নিজে মামলার তদন্ত শুরু করেন। মামলার এজাহারে ঘটনার তারিখ লেখা আছে ১/১০/১৯৭১। বাংলা ১৩ আশ্নিন ১৩৭৮।
২২ জুলাই ১৯৭২ এসডিও কোর্টে মামলাটি উত্থাপন করা হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ পুলিশ এ মামলার চার্জশিট দাখিল করে।
৩ অক্টোবর ১৯৭২ এসডিও বরাবর চার্জশিট উপস্থাপন করা হয়।
মমতাজ বেগমের অভিযোগ অনুসারে এ মামলার তদন্তকালে আসামীদের মধ্য থেকে ২ জনকে আটক করা হয়। এরা হল আইউব আলী চৌকিদার ও সুন্দর আলী দফাদার।
পুলিশের প্রতিবেদনে আসামীদের মধ্য থেকে যাদেরকে পলাতক দেখানো হয় তারা হল
১. দানেশ মোল্লা
২. আশরাফ আলী
৩. আব্দুল মান্নান
৪. কালাম চৌকিদার
৫. আব্দুল হাকিম মুন্সি
৬. মমিন উদ্দিন
৭. মোসমেল মওলানা।
মামলা চলাকালে পলাতক আসামীদের মধ্য থেকে আরো ২ জনকে আটক করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ অক্টোবর আব্দুল মান্নান এবং ১৯৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মমিন উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয় যা মেজিস্ট্রেট কোর্টে সংরক্ষিত জিআর বইতে ৩৭৮/৭২ জিআর কপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়।
জিআর কপি পর্যালোচনা করে আরো দেখা যায় মমতাজ বেগমের দায়ের করা ওই মামলা থেকে আসামী আতাহার আল হাওলাদার, রুহুল আমিন সেকেন্দার শিকদার, শামসুর রহমান (তৎকালীন পিরোজপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই) কে অব্যাহতি দেয় কোর্ট।
মমতাজ বেগমের দায়ের করা মামলাটি ২৭/১১/১৯৭২ সালে তৎকালীন এসডিও এমএ হাশেম মিয়া স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জাজ বরিশাল প্রেরন করেন।
মামলার জিআর বইয়ে দেখা যায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে মামলার কার্যক্রমের জন্য মামলাটি বাকেরগঞ্জ ডিসির কাছে পাঠানো হয়েছিল। জিআর বইয়ের ১৭ নং কলামে লেখা আছে-
Judicial record sent to DC Bakergong provide this memo No 255 Judicial, dated 17/2/1981 vide this complt mcc No 189/81.
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার নথির খোঁজ করছে রাষ্ট্রপক্ষ। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলার নথি আসামী পক্ষ জমা দিয়েছিল ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে। তিন বছরের মাথায় রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলার নথির খোঁজ করছে যখন ট্রাইব্যুনালে এ মামলার রায় হয়ে গেছে এবং আপিল বিভাগেও এ মামলার শুনানী একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার নথির খোঁজে পিরোজপুর এবং বরিশাল সফর করেছেন। গত ২ এবং ৩ এপ্রিল বরিশাল জেলাজজ আদালতের রেকর্ড রুমে তিনি এ মামলার নথির খোঁজ করেছেন। এর আগে তিনি পিরোজপুর সফর করেন একই উদ্দেশে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে নির্দিষ্ট করে বলতে অস্বীকার করেছেন ঠিক কি কাজে তিনি বরিশাল গেছেন এবং কোন মামলার কাগজ পত্র খোঁজ করছেন। তবে স্থানীয় সাংবাদিকরা তাদের প্রতিবেদনে বরিশাল জেলাজজ আদালতের সূত্র এবং বিভিন্ন আইনজীবীদের বরাতে উল্লেখ করেছেন যে, ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার নথির খোঁজেই অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল গেছেন।
মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আলোচিত অভিযোগ হল ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা। এ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বর্তমানে এ মামলার আপিল শুনানী শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আপিল শুনানীর এ পর্যায়ে আবারো ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা এবং তার স্ত্রী মমতাজ বেগম কর্তৃক ১৯৭২ সালে দায়ের করা মামলার ডকুমেন্ট আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মাওলানা সাঈদীর নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে ইব্রাহীম কুট্টিকে পাড়েরহাট বাজারে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম ১৯৭২ সালে স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে যে মামলা করেন তাতে আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। সেই মামলার ডকুমেন্ট আসামী পক্ষ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন অভিযোগ করে আসামী পক্ষ মামলার প্রয়োজনে এ জাল দলিল তৈরি করেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার অভিযোগে মাওলানা সাঈদীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে তবে আসামী পক্ষের এ ডকুমেন্ট বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি রায়ে।
গত ৩ মার্চ প্রধান বিচারপতি মো : মোজাম্মেল হোসেন এর নতেৃত্বে আপিল শুনানীর সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট বিষয়ে একের পর এক প্রশ্নের মুখে পড়েন।
আদালত তখন তাকে প্রশ্ন করেন, আসামী পক্ষ মমতাজ বেগমের মামলার ডকমেন্ট সংগ্রহ করতে পারল আর আপনারা পারলেননা কেন? ১৯৭২ সালে আদৌ এ ধরনের কোন এফআইআর হয়েছিল কি-না? পিরোজপুরে অবশ্যই জিআর রেজিস্ট্রেশন বই আছে। আপনারা এটা চাইতে পারতেননা? আপনাদের অনেক বড় মেশিনারীজ আছে। তার মাধ্যমে এগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন? আমরা যদি আসামী পক্ষের দায়ের করা এ ডকুমেন্ট গ্রহণ করি তাহলে অ্যাটলিস্ট আমরা বলতে পারি সাঈদী এ ঘটনায় জড়িত নয়।
আদালত আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এ মামলার শুনানী চলছে। আসামী পক্ষ অনেক আগে এ বিষয়ে যুক্তি পেশ করেছে। আপনারা অনেক সময় পেয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ে আপনারা চাইলে এ ডকুমেন্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারতেন।
এরপর গত ১১ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেল আসামী পক্ষের জমা দেয়া মমতাজ বেগমের মামলার মূল সার্টিফাইড কপি আপিল বিভাগের রেকর্ড রুম থেকে দেখার আবেদন করেন। আসামী পক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে তিনি এ কপি দেখার অনুমতি পান। তবে আসামী পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এখন পর্যন্ত তাদের কাউকে এ ডাকা হয়নি এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে। গত ১ এপ্রিল শুনানীর পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ মামলার বিচার ৮ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি চান। এরপর খবর বের হল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় আলোচিত ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে তার স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথির খোঁজে অ্যাটর্নি জেনারেল বরিশাল সফর করছেন।
ইব্রাীহম কুট্টি হত্যার অভিযোগ : পাড়েরহাট বাজারের নিকটে সইজুদ্দিন পসারীদের বাড়িতে কাজ করত ইব্রাহীম কুট্টি। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ৮ মে মাওলানা সাঈদীসহ শান্তি কমিটির অন্যান্য লোকজনের নেতৃত্বে পাকিস্তান সৈন্যরা ওই বাড়িতে আক্রমন করে। এসময় ইব্রাহীম কুট্টি ও অপর আরেকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পাড়েরহাট বাজারে। পরে মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে এবং নির্দেশে পাকিস্তান সৈন্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে পাড়েরহাট বাজারে।
আসামী পক্ষের দাবি : আসামী পক্ষের দাবি ইব্রাহীম কুট্টিকে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর নলবুনিয়ায় তার শশুরবাড়ি থাকা অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার সাথে মাওলানা সাঈদী জড়িত নন। এ দাবির পক্ষে তারা ইব্রাহীম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগমের মামলার নথি জমা দিয়েছে আদালতে। মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা বিষয়ে মোট ১৩ জন আসামী করা হয়। আসামীর তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই। আসামী পক্ষের দাবি তিনি যদি এর সাথে জড়িত থাকতেন তাহলে অন্তত মমতাজ বেগমের মামলায় তাকে তখন আসামী করা হত।
মমতাজ বেগমের মামলায় ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিবরন : স্বামী ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার বিচার চেয়ে মমতাজ বেগম দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে পিরোজপুরে একটি মামলা করেন। সে মামলার বিবরনে মমতাজ বেগম উল্লেখ করেছেন তার স্বামী ইব্রাহীম কুট্টি তার বাপের বাড়ি নলবুনিয়া থাকা অবস্থায় শান্তি কমিটির লোকজন এবং পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করেছে। ঘটনার সময়কাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ।
মমতাজ বেগমের মামলায় আরো উল্লেখ আছে যে, ওই ঘটনার সময় তাদের বাড়ি থেকে তার ভাই সাহেব আলী ওরফে সিরাজ এবং তার মা সিতারা বেগমকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পিরোজপুর। পরে তার মাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার ভাই সাহেব আলীকে আর ছাড়া হয়নি। তাকে পাকিস্তান পিরোজপুরে আর্মি গুলি করে হত্যা করে।
মমতাজ বেগমের মামলার বিবরনে বলা হয়েছে ইব্রাহীম কুট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবার নলবুনিয়া তার শশুর বাড়ি থাকা অবস্থায়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের দাবির্ ৮ মে তাকে পাড়েরহাট বাজারে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যের স¤পূর্ণ বিপরীত তথ্য রয়েছে মমতাজ বেগমের মামলার নথিতে।
মমতাজ বেগমের মামলায় ঘটনার বিবরন নিম্নরূপ :
“ঘটনার বিবরন এই যে, বিবাদীগন পরষ্পর যোগাযোগে রাইফেল পিস্তল ছোরা লাঠি ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া আমার পিতার ঘর বেড়দিয়া আমার স্বামীর উপর গুলি করিয়া হত্যা করিয়া আমার শরীরে জখম করিয়া আমার মাতা ও ভ্রাতাকে ধরিয়া পিরোজপুর আনিয়া আমার মাতাকে ছাড়িয়া দিয়া আমার ভ্রাতা সিরাজুলকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আক্রোশের কারণ এই যে, আমি ও আমার স্বামী আমার স্বামীর বারিতে বাদুরা গ্রামে বাসবাস করিতেছিলাম। গত মে মাসে পাক সৈন্য এদেশে আসিয়া যখন অকারনে গুলি করিয়া মানুষ হত্যা করিতে থাকে তখন কতিপয় হিন্দু আমাদের সরনাপন্ন হওয়ায় আমরা তাহাদের আশ্রয় দেওয়ায় পাক সৈন্য ও তাহাদের দালালরা আমার স্বামীকে হত্যা করিতে খোঁজ করিতে থাকায় আমরা ভয়ে ভীত হইয়া আমরা পিত্রালয়ে বসবাস করিতেছিলাম। তথায় বিবাদীগন ক্রোধ করিয়া উক্তরুপ অত্যাচার করিয়াছে।
প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে আমি গর্ভবতী থাকায় আমার পিতা পারোরহাট আওমীলীগ অফিসে জানাইয়া কোন প্রতিকার পাইনাই। তাই এই দরখাস্ত করিতে বিলম্ব হইল।
সে মতে প্রার্থনা, আদালত দয়া করিয়া উক্ত ধারামতে উক্ত বিবাদীগনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট দিয়া ধৃত করাইয়া সুবিচার করিতে আজ্ঞা হয়। ইতি মমতাজ বেগম”
মমতাজ বেগমের মামলার আসামীর তালিকা :
মমতাজ বেগম সে মামলায় মোট ১৩ জনকে আসামী করেছেন। এরা হল দানেশ মোল্লা, আতাহার আলী, আশ্রাব আলী, আব্দুল মান্নান, আইউব আলী, কালাম চৌকিদার, রুহুল আমিন, আব্দুল হাকিম মুন্সি, মমিন উদ্দিন, সেকোন্দার আলী শিকদার, শামসুর রহমান এসআই, মোসলেম মাওলানা। এছাড়া পাকিস্তান আর্মিকেও আসামী করা হয় মমতাজ বেগমের মামলায়। কিন্তু মমতাজ বেগমের মামলায় আসামীদের তালিকায় মাওলানা সাঈদীর নাম নেই।
আপিল শুনানীর সময় মাওলানা সাঈদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান আদালতে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের এ ডকুমেন্টকে অসত্য এবং জাল আখ্যায়িত করেছে। তাদের উচিত ছিল পিরোজপুর থেকে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে ডাকার ব্যবস্থা করে তাদের দাবি প্রমান করা। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং আমরা থানা থেকে এ মামলার নথিপত্র তলবের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।
আসামী পক্ষ যেভাবে সংগ্রহ করল মমতাজ বেগমের মামলার নথি : মাওলানা সাঈদীর ছেলে এবং ১৩ তম সাফাই সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে জেরায় বলেছেন, ‘তার বড় ভাই মরহুম রাফিক বিন সাঈদীকে মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম মামলার মূল সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করেন।’
মামলার বাদী মমতাজ বেগমের মা সিতারা বেগম ১৯৭২ সালে এ মামলার সার্টিফাইড কপি পিরোজপুর থেকে ইস্যু করান এবং সিতারা বেগম দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে এ মামলার কপি সংরক্ষন করেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল এর বক্তব্য : ইব্রাহীম কুট্টি হত্যা মামলার খোঁজে বরিশাল এবং পিরোজপুর সফর বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিষয়ে আজ বিকালে ফোনে কথা হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সাথে। তাকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি ইব্রাহীম কুট্টি হত্যার নথির খোঁজে বরিশাল এবং পিরোজপুর সফর করেছেন মর্মে খবর বের হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি তাদেরকে বলিনি যে, আমি সাঈদীর মামলার কাজে এবং ইব্রাহীম কুট্টির হত্যা মামলার নথির খোঁজে বরিশাল এবং পিরোজপুর গিয়েছি। আমি অন্য একটি কাজে গিয়েছি।
কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিকরা জেলাজজ সূত্র এবং আইনজীবীদের বরাত দিয়ে বলেছেন, আপনি এ মামলার কাজেই বরিশাল গেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা তাদের অনুমান। তারা দেখেছে আমি দুইদিন জেলাজজ আদালতের রেকর্ডরুমে ছিলাম। সেকারনে তারা এটা বলেছে হয়ত।
তাহলে আমরা কি বলব যে, আপনি সাঈদীর মামলার কাজে নয় অন্য কোন মামলার কাজে বরিশাল গেছেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, না আমি এটাও বলতে চাইনা। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা।
আসামী পক্ষ তিন বছর আগে মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছে। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোন খোঁজ খবর নেয়নি কেন এবং এখন এতদিন পরেই বা কেন খোঁজ করছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তারা আমার কলিগ। তাদের আমি কিভাবে সমালোচনা করব। আপনারা তো সবই বোঝেন ।
মাওলানা সাঈদীর মামলায় নিযুক্ত আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল সাঈদীর মামলায় যুক্তি পেশ করছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা যায় তিনি এ মামলার কাজেই বরিশাল গেছেন। আমরা ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে মমতাজ বেগমের মামলার ডকুমেন্ট জমা দিয়েছি ট্রাইব্যুনালে। রাষ্ট্রপক্ষ তখন একে জাল বলে আখ্যায়িত করলেন। আমরা তখন সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে মামলার নথি তলবের আবেদন করলে রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরোধীতা করে। এখন তিন বছর পর কেন তারা এ মামলার নথির খোঁজ করছে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়।
মমতাজ বেগমের মামলার ঘটনাপ্রবাহ :
মামলার নথি ঘেটে দেখা যায় ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ মমতাজ বেগম পিরোজপুর এসডিও কোর্টে প্রথম এ মামলা করেন। তখন এসডিও ছিলেন একে আজাদ। ওই তারিখে এসডিও মামলাটি পিরোজপুর থানায় পাঠান।
বাদী মমতাজ বেগমের লিখিত অভিযোগ এসডিওর কাছ থেকে পাবার পর পিরোজপুর থানা ১৬/৭/১৯৭২ তারিখ বেলা ১টা ৩০ মিনিটের সময় অভিযোগটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করে। মামলা নং ৯। জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) নং ৩৭৮/৭২।
১৭/৭/১৯৭২ তারিখ সকাল ৮টায় থানা থেকে মামলাটি পিরোজপুর কোর্টে পাঠানো হয়। তখন থানার ওসি ছিলেন মেফতাউদ্দিন আহমেদ। তিনি নিজে মামলার তদন্ত শুরু করেন। মামলার এজাহারে ঘটনার তারিখ লেখা আছে ১/১০/১৯৭১। বাংলা ১৩ আশ্নিন ১৩৭৮।
২২ জুলাই ১৯৭২ এসডিও কোর্টে মামলাটি উত্থাপন করা হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ পুলিশ এ মামলার চার্জশিট দাখিল করে।
৩ অক্টোবর ১৯৭২ এসডিও বরাবর চার্জশিট উপস্থাপন করা হয়।
মমতাজ বেগমের অভিযোগ অনুসারে এ মামলার তদন্তকালে আসামীদের মধ্য থেকে ২ জনকে আটক করা হয়। এরা হল আইউব আলী চৌকিদার ও সুন্দর আলী দফাদার।
পুলিশের প্রতিবেদনে আসামীদের মধ্য থেকে যাদেরকে পলাতক দেখানো হয় তারা হল
১. দানেশ মোল্লা
২. আশরাফ আলী
৩. আব্দুল মান্নান
৪. কালাম চৌকিদার
৫. আব্দুল হাকিম মুন্সি
৬. মমিন উদ্দিন
৭. মোসমেল মওলানা।
মামলা চলাকালে পলাতক আসামীদের মধ্য থেকে আরো ২ জনকে আটক করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ অক্টোবর আব্দুল মান্নান এবং ১৯৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মমিন উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয় যা মেজিস্ট্রেট কোর্টে সংরক্ষিত জিআর বইতে ৩৭৮/৭২ জিআর কপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়।
জিআর কপি পর্যালোচনা করে আরো দেখা যায় মমতাজ বেগমের দায়ের করা ওই মামলা থেকে আসামী আতাহার আল হাওলাদার, রুহুল আমিন সেকেন্দার শিকদার, শামসুর রহমান (তৎকালীন পিরোজপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই) কে অব্যাহতি দেয় কোর্ট।
মমতাজ বেগমের দায়ের করা মামলাটি ২৭/১১/১৯৭২ সালে তৎকালীন এসডিও এমএ হাশেম মিয়া স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জাজ বরিশাল প্রেরন করেন।
মামলার জিআর বইয়ে দেখা যায় ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালে মামলার কার্যক্রমের জন্য মামলাটি বাকেরগঞ্জ ডিসির কাছে পাঠানো হয়েছিল। জিআর বইয়ের ১৭ নং কলামে লেখা আছে-
Judicial record sent to DC Bakergong provide this memo No 255 Judicial, dated 17/2/1981 vide this complt mcc No 189/81.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন