Pages

সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৩

মাওলানা নিজামীর মামলায় তাজুল ইসলামের যুক্তি উপস্থাপন


মেহেদী হাসান, ১৮/১১/২০১৩
জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় আজ আসামী পক্ষে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম যুক্তি পেশ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। এ মামলায় তিনি আইনি দিক নিয়ে যুক্তি পেশ করেন ।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে ইনসাইটমেন্ট বা উসকানি বিষয়ক চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। তাজুল ইসলাম বলেন,  এ অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ চারটি মাত্র পেপার কাটিং জমা দিয়েছে এবং এর পক্ষে কোন সাক্ষী নেই তাদের।

মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে একটি উসকানির অভিযোগ হল ১৯৭১ সালে আগস্ট মাসে চট্টগ্রামে ইসলামী ছাত্রসংঘের সমাবেশে তিনি বলেছেন পাকিস্তান আল্লাহর ঘর এবং পাকিস্তান আমি অতীতে যেমন এ ঘর রক্ষা করেছে ভবিষ্যতেও তেমনি রক্ষা করবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র একসময় অনেকের কাছে স্বপ্নের একটি রাষ্ট্রছিল। এ স্বপ্নের রাষ্ট্র অর্জনের জন্য, ব্রিটিশের গোলামী থেকে মুক্তির জন্য  অনেক রক্তক্ষয় এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অনেককে। এ রাষ্ট্রের প্রতি তখনকার মানুষের অনেক মোহমায়া, স্বপ্ন ছিল।  অনেকে অনেকভাবে তার বিশ্বাস এবং স্বপ্নের কথা প্রকাশ করে থাকেন। যেমন কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতাকে তুলনা করেছেন পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিনের সাথে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তুরিন আফরোজ বলেছেন ইসলামের জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়নি। কিন্তু কবি শামসুর রহমান স্বাধীনতাকে পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিনের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু এজন্য তো তাকে  সাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত করা হয়নি। তেমনি মাওলানা নিজামীও পাকিস্তান রাষ্ট্র ঘিরে মানুষের যে আশা আকাঙ্খা এবং স্বপ্ন ছিল সে প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে দেশকে পবিত্র ঘরের সাথে তুলনা করে দেশের প্রতি ভালবাসার বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এখানে উসকানির কোন বিষয় থাততে পারেনা। অনেকে দেশকে দেবী, মা দুর্গার সাথে তুলনা করে। দেশের জন্য আবেগ প্রকাশ করা কি কোন অপরাধ   হতে পারে?
এ বক্তব্যের মাধমে তিনি কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ধ্বংস বা নিশ্চিহকরনের কথা বলেননি। কাজেই এটি কোন উসকানির অভিযোগের মধ্যে পড়েনা।
তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ যে পেপারকাটিং জমা দিয়েছে তাতে প্রতিদেনটি  প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ৫  আগস্ট। চট্টগ্রাম থেকে খবর পাঠিয়েছে ৩ আগস্ট। খবরে লেখা আছে গতকাল সমাবেশ হয়েছে। তার মানে হল সমাবেশটি হয়েছে ২ আগস্ট। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ বলছে ৩ আগস্ট মাওলানা নিজামী এ বক্তব্য দিয়েছেন।  কাজেই রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগ মতে তিনি ৩ আগস্ট এ জাতীয় কোন বক্তব্য দেননি। ফলে এটি কোন অভিযোগ আকারে টেকেনা। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ স্বীকার করেছেন ৫ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশের যে তারিখ লেখা রয়েছে তা তারা নিজেরা লিখেছে। প্রতিবেদনটিতে পত্রিকা প্রকাশের তারিখ ছাপার অক্ষরে কোথাও লেখা নেই।
কাজেই এজাতীয় ডকুমেন্ট কি করে বিশ্বাসযোগ্য  হতে পারে?


মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে উসকানির আরেকটি অভিযোগ হল যশোরে রাজাকারদের একটি সমাবেশে তিনি সুরা তওবার আয়াত পাঠ করে কোরআনের অপব্যাখ্যা করে তাদের উসকানি দিয়েছেন স্বাধীনতাবিরোধী কাজের জন্য।
এ বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, মাওলানা নিজামী সুরা তওবার যে আয়াত পাঠ করেন তার অর্থ হল ‘আল্লাহ মুমিনের জীবন এবং সম্পদ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে। তারা মারে এবং মরে।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ঈমানের সাথে দায়িত্ব পালনের আহবান জানিয়ে  এই আয়াতের ব্যাখ্যা করা কি করে উসকানির মধ্যে পড়তে পারে? কোরআনের আয়াত তাফসির করা কি যুদ্ধাপরাধ? তিনি যদি এ আয়াত ব্যাখ্যা করে তাদেরকে খুন, হত্যার জন্য আহবান জানাতেন তাহলে তাকে উসকানি এবং উসকানির জন্য কোরআনকে ব্যবহারের অভিযোগ আনা যেতে পারত। কিন্তু তাতো তিনি করেননি।
মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে উসকানির আরেকটি অভিযোগ হল ভারতের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বিভিন্ন বৈরি আচরন, পানি ইস্যু, সীমান্ত হত্যা, অসংখ্যবার বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ প্রভৃতি তুলে ধরে তাজুল ইসলাম বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে বক্তব্যের জন্য যারা মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে তাদের বিরুদ্ধে সুয়োমটো রুল জারি করা উচিত ট্রাইব্যুনালের। তিনি বলেন, একটি দেশের বিরুদ্ধে বক্তব্যের কারনে যখন নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তখন বোঝা যায় কতবড় গেম এর পেছনে কাজ করছে।
মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আরেকটি উসকানির অভিযোগে বলা হয়েছে মাদানী নামক এক ব্যক্তিকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তিনি আহবান জানিয়েছেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, এটি তার কোন বক্তৃতা না বিবৃতি তার কিছুই উল্লেখ নেই পেপারকাটিংয়ে।  ইসলামিক একাডেমিতে তিনি এ কথা বলেছেন বলে উল্লেখ আছে  কিন্তু ইসলামিক একাডেমি কোথায় তাও উল্লেখ নেই। মাদানী কে, কি তার পরিচয়, কারা তাকে হত্যা করল তাও উল্লেখ নেই প্রতিবেদনে। যদি এমন হত যে মাদানী ছিল স্বাধীনতাবিরোধী এবং মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করেছে তাহলে তার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার আহবান জানানো মানে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার আহবান জানানো হয়েছে তা বোঝা যেত। কিন্তু মাদানী কে , কারা তাকে হত্যা করল তার কোন কিছু পরিস্কার নয়। তদন্ত কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন জেরায় যে, এ বিষয়ক খবরটি তিনি পুরোপুরি জব্দ করেননি। শুধুমাত্র নিজামীর  বক্তব্যের অংশটুকু জমা দিয়েছেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, এ জাতীয় ডকুমেন্ট  যদি গ্রহণ করা হয় এবং এর ওপর ভিত্তি করে যদি কাউকে অভিযুক্ত করা হয় তাহলে ন্যায় বিচার বলতে আর কিছু থাকবেনা।
তাজুল ইসলাম বলেন, উসকানির পক্ষে শুধুমাত্র চারটি পেপারকাটিং তারা জমা দিয়েছে এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার ৭১ এর দশমাস বইয়ে লিখেছেন তখন এদেশে সংবাদ প্রকাশের ওপর কঠোর সেন্সরশীপ আরোপ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সরকার পক্ষের খবরই তখন গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হত। মাওলানা নিজামীর যেসব বক্তব্য পেপারে ছাপা হয়েছে এবং যা এখানে জমা দেয়া হয়েছে তা যে সেন্সর আকারে প্রকাশিত হয়েছে তা সহজেই ধরে নেয়া যায়।  সরকারের পক্ষে তার যে বক্তব্য ছিল তাই গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হত সেটা ধরে নেয়া যায়। তার যেসব বক্তব্য ছাপা হয়েছে এবং যা এখানে জমা দিয়েছেন তার বাইরে তিনি যে আর কোন কথা বলেননি এবং তা যে সেন্সর করা হয়নি তা আমরা কি করে বলতে পারি।  কাজেই সেন্সর করে প্রকাশিত এবং রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বল এসব ডকুমেন্টকে  আমলে নেয়ার কোন কারণ থাকতে পারেনা।

তাজুল ইসলাম বলেন, উসকানি কিসের প্রতি (ইনসাইটমেন্ট টু হোয়াট)  সে বিষয়ে অভিযোগে কিছু বলা হয়নি। যেমন কোন অপরাধের প্রতি তিনি কাউকে উসকানি দিয়েছেন না কি কাউকে ভালবাসার  জন্য উসকানি দিয়েছেন সে বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই অভিযোগে।
তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের উসকানি, যুদ্ধাপরাধের প্রতি উসকানি কোন উসকানির মধ্যে পড়েনা,  অপরাধের মধ্যে পড়েনা। শুধুমাত্র গনহত্যার বিরুদ্ধে উসকানি অপরাধ এবং গনহত্যা ও উসকানি বিষয়ে সেখানে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের একটি আদেশ তুলে ধরে তাজুল ইসলাম বলেন, উসকানির মধ্যে সুষ্পষ্টভাবে   ঘৃনামূলক বক্তব্য (হেইট স্পিস)  থাকতে হবে এবং তাতে বিপদের আশঙ্কা উপস্থিত থাকতে হবে। তবেই কেবল তা উসকানিমূলক বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন